2 of 2

৭১. সূর্য অনেকটা উদ্দেশ্যহীন

সূর্য অনেকটা উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে উত্তর ও মধ্যভারতে। তার সাত-আট বছরকার পলাতক জীবনের সঙ্গে এই ভ্রমণের অনেক তফাত। এখন তার পকেট-ভরতি টাকা। এবং টাকাপয়সা খরচ করে অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে।

বড়বাবু মৃত্যুর আগে তাকে বার বার গোয়ালিয়ার যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সূর্য পথে থামতে থামতে যাচ্ছে। প্রথমে সে নামল কাশীতে, সেখানে একটি লোককেও চেনে না। হোটেলে থাকে, পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে। সারা দিনে কথা বলে খুব সামান্য। কয়েক দিন বাদে চলে এল এলাহাবাদ।

যে-কোনও কারণেই হোক, কাশীর তুলনায় এলাহাবাদ তার বেশি পছন্দ হয়ে গেল। এমনকী, একথাও তার মনে হল একবার, আর সে কখনও পশ্চিম বাংলায় ফিরবে না, এই শহরেই থেকে যাবে।

এলাহাবাদ শহরেও কেউ তার চেনাশুনো নেই। কিন্তু একদিন সে হাইকোর্টের সামনে একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছে, এমন সময়-অৰু টেবিলে তর্কে মত্ত দু’জন লোকের মধ্যে। একজনের গলার আওয়াজ শুনে সে আকৃষ্ট বোধ করল। একটু ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর এবং ছ-গুলোকে স-এর মতন উচ্চারণ করা, অর্থাৎ গিয়েসেন, করেসেন ইত্যাদি। এই কণ্ঠস্বরটি তার চেনা।

সূর্য ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। যে ব্যক্তিটির কণ্ঠস্বর সূর্যের চেনা মনে হচ্ছে, তিনি সূর্যর দিকে পেছন ফিরে বসে আছেন। ধুতি ও খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা, মধ্যবয়স্ক। সূর্যর তবু মনে হল লোকটির নাম বরদাপ্রসন্ন। মেদিনীপুর জেলে একসময় সূর্যর সঙ্গে মাস ছয়েক ছিলেন।

সূর্যর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই, কারওর খোঁজও সে রাখতে চায় না। কিন্তু যাদের সঙ্গে জেলে কয়েকটা মাস পাশাপাশি কাটিয়েছে, তাদের সঙ্গে একসময় যে-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা আত্মীয়তার চেয়েও বেশি। তাদের দেখলেই এখন সবচেয়ে আপনজন বলে মনে হয়। বরদাপ্রসন্ন যদিও গান্ধীবাদী কংগ্রেসি ছিলেন সে-সময়, জেলখানাতেও থাকতেন আলাদা ব্যারাকে, তবু আলাপ পরিচয় ছিল যথেষ্ট।

সূর্য টেবিল ছেড়ে বরদাপ্রসন্নর সঙ্গে দেখা করতে গেল না। আর এক কাপ চা নিয়ে বসে রইল। ওদের তর্কাতর্কি শুনতে পাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, বরদাপ্রসন্ন রাজনীতির আলোচনাতেই উত্তেজিত। রাজনীতিতে যারা একবার ঢোকে, তারা সারা জীবনে আর কিছুতেই বেরোতে পারে না। বরদাপ্রসন্ন চুটিয়ে নিন্দে করছেন পণ্ডিত নেহরুর। মনে হয়, তিনি প্যাটেল-নীতির সমর্থক। কিংবা ভাবখানা এই, বরদাপ্রসন্নকেই যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্ব দেওয়া হত, তা হলে উনি চোখের নিমেষেই সব সমস্যার সমাধান করে দিতেন।

খানিকটা পরে বরদাপ্রসন্ন উঠে পড়লেন। সূর্যর টেবিলের পাশ দিয়েই তিনি বেরিয়ে পড়লেন কথা বলতে বলতে। সূর্য নিজে থেকেই বরদা-দা বলে একবার ডাকতে যাচ্ছিল, কিন্তু সামলে নিল। তার মনের মধ্যে একটা দোলাচল চলছে। অচেনা শহরে একাকীত্ব বড় মর্মান্তিক। সে চায় কারওর সঙ্গে একটু কথা বলতে, কেউ তার নাম ধরে ডাকবে, হাত চেপে ধরে বলবে, আরে, তুমি?–অমনি এখানকার বাতাস কত হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু সূর্য রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চায় না। সে চায় তার অতীতকে একেবারে মুছে ফেলতে।

সূর্যও বেরিয়ে এল চায়ের দোকান থেকে। বরদাপ্রসন্ন তখনও একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গীর সঙ্গে তর্কে মেতে আছেন। ঘন ঘন নস্যি দিচ্ছেন নাকে। সূর্যর মনে পড়ল, জেলে থাকার সময় বরদাপ্রসন্ন নস্যির অভাবে কী রকম আকুলিবিকুলি করতেন। মেটকে একখানা আস্ত পাঁউরুটি দিয়ে তার বদলে কখনও কখনও পেতেন এক পয়সার এ-জে ‘র’ নস্যি।

সূর্যর মুখে এক মাসের দাড়ি। বরদাপ্রসন্ন হঠাৎ দেখলে সূর্যকে চিনতে পারবেন না হয়তো। সূর্য তবু সে জায়গা ছেড়ে নড়ল না। তৃষ্ণার্ত ভাবে তাকিয়ে রইল এই শহরে তার একমাত্র চেনা মানুষটির দিকে।

একটু বাদে বরদাপ্রসন্ন যখন হাঁটতে শুরু করলেন, সূর্যও যেতে লাগল তার পেছনে পেছনে। এই অনুসরণের কোনও অর্থ নেই। সূর্য যেন চুম্বক-আকৃষ্ট হয়ে হাটছে। তা ছাড়া, কিছু তো করার নেই তার।

অল্প দূরেই একটা ইলেকট্রিকের সরঞ্জামের দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়লেন বরদাপ্রসন্ন। সূর্য কাঁচের শো-উইন্ডোর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দেখে বুঝল, বরদাপ্রসন্ন এ-দোকানের মালিক নন। কেন না চেয়ার টেনে নিয়ে বসে তিনি মালিক-চেহারার একটি লোককে বললেন, এক কাপ চা খাওয়াও হে সতীশ।

সূর্য বুঝতে পারল, বরদাপ্রসন্নও এখন বেকার। ঘুরে ঘুরে আড্ডা দেওয়া ও চা খাওয়াই তার কাজ। সূর্যকে দেখতে পেলে তিনি হাতে চাঁদ পাবেন। মেতে উঠবেন পুরনো দিনের গল্পে, জেলখানার সতীর্থরা এখন কে কোথায় আছে সেই বৃত্তান্তে।

সূর্য আরও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে, তবু বরদাপ্রসন্নকে ডাকল না।

হোটেলে সূর্যর পাশের ঘরেই তিনটি বাঙালি ছেলে এসে উঠেছে দু দিন ধরে। সিঁড়িতে ওঠা-নামার সময় দেখা হয়েছে, কোনও কথা হয়নি।

সে-দিন সন্ধ্যাবেলা ওদের মধ্যে একটি ছেলে এসে সূর্যর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল।

দাদা, আপনি তো বাঙালি?

সূর্য বলল, হ্যাঁ।

ছেলেটি একগাল হেসে বলল, আমরাও তাই ভেবেছিলুম, তবে ঠিক শিয়োর হতে পারিনি। আপনি তাস খেলতে জানেন? আমাদের একজন তোক শর্ট পড়ে গেছে।

আমি তো তাস খেলতে জানি না।

তাস চেনেন তো? আসুন না, শিখিয়ে দেব।

সূর্যকে এবার স্বীকার করতে হল যে, সে তাসও চেনে না।

বাঙালির ছেলে অথচ তাস চেনে না, এতে অপর বাঙালির ছেলেটি বড় আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল, তা হলে সারা সন্ধেবেলাটা কী করবেন? আসুন না আমাদের ঘরে। একটু গল্পটপ্প করা যাক।

অপরিচিত লোকদের সঙ্গে সূর্য একেবারেই ভাব জমাতে পারে না। তবু ছেলেটির আগ্রহ-আতিশয্যে তাকে যেতেই হল।

দুটো খাট ওরা জোড়া লাগিয়েছে। তার ওপর তাস ছড়ানো। দুটো অ্যাশট্রে সিগারেটের টুকরোয় একেবারে ভরে গেছে। সূর্য এসে এক পাশে বসল।

ছেলে তিনটির নাম অরুণ, সুকল্যাণ আর দেবব্রত। সূর্যরই বয়সি, তিন জনই চাকরি করে, বেড়াতে বেরিয়েছে। ওরা এখন ফেরার পথে। দিল্লি পর্যন্ত গিয়েছিল। ওদের মধ্যে একজনের অফিসের একটা কাজ আছে এলাহাবাদে, সুতরাং অন্যরাও কয়েক দিন থেকে যাচ্ছে এখানে।

অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই ওরা নিজেদের সব কথা বলে গেল। খুব সহজেই আলাপ জমিয়ে নিতে পারে ওরা। খাটের তলা থেকে আস্তে আস্তে বার করল তিনটে গেলাস আর একটা মদের বোতল।

সূর্যকে জিজ্ঞেস করল, দাদার চলবে?

দৈর্ঘ্য ও স্বাস্থ্যের জন্য সূর্যকে ওদের তুলনায় বড় দেখায়। সেই জন্য ওরা প্রথম থেকেই সূর্যকে দাদা বলতে শুরু করেছে। প্রথমটা লজ্জা ভাঙার আগে ওরা সূর্যকে দেখে মদের বোতল আর গেলাস লুকিয়েছিল খাটের তলায়।

সূর্য বলল, না।

একজন সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সিগারেট নিন অন্তত।

আমি সিগারেটও খাই না। ধন্যবাদ।

দাদা দেখছি খুব ভালো ছেলে। আমরা এসব খাচ্ছিটাচ্ছি বলে কিছু মনে করছেন না তো?

সূর্য ফ্যাকাশে ভাবে হেসে বলল, না না!

এই ধরনের যুবকদের সঙ্গে আগে মেশার সুযোগ হয়নি সূর্যর। ওরা লম্পট দুশ্চরিত্র কিছুই নয়, সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের চাকুরে বাঙালি যে রকম হয়। বছরে একবার ছুটি নিয়ে বেড়াতে বেরোয়, নিবিড় বন্ধুত্ব, প্রবাসে এসে একটু অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মদ চেখে দেখে, নিজেদের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কখনও চাকরির আলোচনা কখনও স্ত্রীলোকদের সম্পর্কে আলোচনায় মেতে থাকে। তিন জনেরই বিয়ে হবে হবে অবস্থা, বিয়ে হয়ে গেলে এ রকম বন্ধুত্ব আর থাকবে না।

সূর্যকে তাস খেলা শেখাবার চেষ্টা করে একটু পরেই ওরা নিরাশ হল। যার খেলা শেখার আগ্রহ নেই, তাকে শেখানো যায় না। তখন ওরা মেতে উঠল গল্পে। ওরা সদ্য আগ্রা থেকে ঘুরে এসেছে, সেখানকার সম্পর্কে ওদের অনেক সরস গল্প আছে, নারীঘটিত।

সূর্য একসময় বলে ফেলল, আমিও একবার আগ্রায় যাব ভাবছি।

আগে যাননি?

না।

তখন তিন জনেই মহা উৎসাহে সূর্যকে আগ্রা বিষয়ে প্রচুর তথ্য সরবরাহ করতে লাগল। কিন্তু কোন হোটেলে সূর্যর ওঠা উচিত, সে সম্পর্কে একটা মতভেদ দেখা গেল ওদের মধ্যে। দুজনে একটা হোটেলের নাম করে, তৃতীয় জন হাসতে হাসতে বলে, যাঃ, দাদাকে ওই হোটেলে পাঠাসনি! কেন মিছিমিছি—

তারপর তিন জনেই হাসতে আরম্ভ করে। সূর্য ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ওরা তিন জনেই একটি হোটেল বিষয়ে একমত হয় এবং স্টেশনে হোটেলের দালালদের কাছ থেকে কী ভাবে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, কোথায় যেতে টাঙ্গার কত ভাড়া, সব জানিয়ে দেয়।

ওই ছেলে তিনটিকে সূর্যর খারাপ লাগেনি, ভালোও লাগেনি। কিন্তু ওদের সঙ্গে মেলামেশার কোনও টানও সে বোধ করল না। নিজে থেকে সে একটাও কথা বলতে পারে না। ওদের রসিকতাগুলোও তার কাছে অন্য রকম মনে হয়। একমাত্র বরদাপ্রসন্নর সঙ্গেই সে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারত। সূর্য আবার গেল সেই চায়ের দোকানে। বরদাপ্রসন্ন নেই। ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকানেও সে বরদাপ্রসন্নকে দেখতে পেল না আর। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেই দোকানটার সামনে।

.

সূর্য পরদিনই আগ্রা চলে গেল। সেই যুবক তিনটির নির্দেশিত হোটেলে গিয়েই উঠল। এবং চব্বিশ ঘণ্টা যেতে-না-যেতেই বুঝল, ভুল জায়গায় এসেছে। যুবক তিনটি রসিকতা করেছে তার সঙ্গে।

আগ্রাতেও কিছু বাঙালি ভ্রমণকারী রয়েছে। সূর্যর সঙ্গে কারওর ভাব হল না। প্রায় সকলেই সস্ত্রীক। স্ত্রী সঙ্গে থাকলে বাঙালি যুবকরা অচেনা কোনও যুবকের সঙ্গে কথা বলা পছন্দ করে না।

বিকেলের দিকেই সূর্য গিয়েছিল তাজমহল দেখতে। গাইডের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কিছুক্ষণ দেখার পরই বিরক্ত হয়ে উঠল। তবে, সবাই বলাবলি করছে, সে-দিন পূর্ণিমা। পূর্ণিমার রাতে তাজমহল দেখা নাকি দুর্লভ অভিজ্ঞতা।

বড় এক ঠোঙা বাদাম কিনে সূর্য গিয়ে বসল মাঠের মধ্যে। সন্ধ্যার দিকে ভিড় আরও বাড়ছে। বাচ্চারা দৌড়োদৌড়ি করছে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যাও অনেক, আর তরুণ তরুণীদের চোখ ভাবে বিভোর–এখানে এলে এ রকম হওয়াই নিয়ম বোধহয়।

ঘাসের ওপর কাত হয়ে শুয়ে পড়ল সূর্য। খোসা ছাড়িয়ে বাদাম মুখে পুরছে আর মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে তাজমহলের দিকে। যত বার চোখ তুলছে, সে তাজমহল দেখতে পাচ্ছে না ঠিক, দেখছে দীপ্তিকে।

মুখটা কঠিন করে সূর্য মনে মনে বলছে, আমি তোমার কেউ না। তুমি কেন আসছ এখানে, যাও! তুমি তো বলেইছ, তোমার সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হবে না!

দীপ্তি কোনও কথা বলে না। তরল হাওয়ায় মাঝে মাঝে মিলিয়ে যায়। যখন দীপ্তিকে দেখতে পায় না তখন সূর্য বলে, তুমি আমার!

জ্যোৎস্নায় যখন তাজমহলের বিশ্ববিখ্যাত রূপ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, তখনও দীপ্তির মায়াময় মূর্তি এসে দাঁড়াল সূর্যর সামনে। দীপ্তির স্বভাব-গম্ভীর মুখে যে অকস্মাৎ হাসি দেখে সূর্য একসময় পাগল হয়েছিল, সেই রকম হাসি-আঁকা ঠোঁট। সূর্য যেন এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ওই ঠোঁট কামড়ে ধরবে। দীপ্তির ছটফটে শরীরটা বাহুবন্দি করে সে… অত্যন্ত তীব্র অভিমানের সময় সূর্য শারীরিক প্রসঙ্গ ছাড়া ভাবতে পারে না।

সূর্য চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে তাজমহলকে আড়াল করে দিল। যেন। তাজমহলও একটা শরীর, সমস্ত সৌন্দর্যের ঘন রূপ, যা শুধু মানুষকে দুঃখ দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *