সার্কুলার রোডের আখড়া তো ভেঙে গেছে বটেই, একদিন গ্রে স্ট্রিটের আড্ডা থেকেও বারীন্দ্র অদৃশ্য হয়ে গেল! কারুকে কিছু জানিয়ে যায়নি সে, তবু যত দূর মনে হয় সে বরোদায় তার দাদার কাছে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে গেছে। গুপ্ত সমিতির বাকি সদস্যদের দিশাহারা অবস্থা, কর্ণধারহীন তরণর মতন সে সমিতি টলমল করতে লাগল, ডুবতে বেশি দেরি হল না। অরবিন্দ ঘোষ আর কোনও নির্দেশ পাঠায়নি, সে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ।
দেশের কাজ করার জন্য যে-সব যুবকেরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, তারা একে একে ফিরতে লাগল ঘরে। কেউ কেউ জীবিকার সন্ধানে ব্যাপৃত হল, যাদের সে সমস্যা নেই, তারা ভাবল, এবার একটা বিবাহ করলে মন্দ হয় না। ঘরেই যদি ফিরতে হয়, তা হলে আর সংসারধর্ম গ্রহণ করতে আপত্তি কী!
শুধু ভরতেরই কোনও ঘর নেই, তার ফেরার কোনও নির্দিষ্ট স্থান নেই।
হেম কানুনগো ফিরে যাচ্ছে মেদিনীপুরে, সে ভরতকে বলল, বন্ধু, তুমিও চল আমার সঙ্গে। একা একা আর কোথায় ঘুরবে? কলকাতা শহরটা একা থাকার পক্ষে মোটেই সুবিধাজনক নয়।
ভরত বলল, তোমার বাড়িতে গিয়ে কি সারাজীবন অতিথি থাকব? সেটা কিছু দিন পরেই উপদ্রবের মতন মনে হবে।
হেম বলল, আমি উপদ্রব মনে করি বা না করি, বেশি দিন অতিথি থাকা তোমার আত্মসম্মানের পক্ষেই হানিকর। আমি অন্য একটা প্রস্তাব দিতে পারি। মেদিনীপুর শহরের ঠিক বাইরেই আমাদের একটি খামারবাড়ি আছে। কিছুটা ধানজমি, ফলের বাগান, একটা ছোট বাড়ি। পৈতৃক সম্পত্তি, ওটা আমার ভাগে পড়েছে। তুমি ওখানে গিয়ে থাকো না কেন।
ভরত কিছু বলতে যেতেই তাকে বাধা দিয়ে হেম আবার বলল, না, না, দান নয়, আতিথ্যও নয়।
ওই খামারে আমার বিশেষ যাওয়া হয় না, দেখাশুনো করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। অনেক দিন ধরেই ওটা বেচে দেবার কথা ভেবেছি। তুমিই কিনে নাও বরং, সব টাকা একসঙ্গে দিতে না পারলে ক্রমে ক্রমে শোধ করবে।
ভরত ইতস্তত করে বলল, ভাই হেম, আমি গ্রামে কখনও বসবাস করিনি। কিছু দিন পরেই যদি মন উচাটন হয়?
হেম বলল, মেদিনীপুর শহরটাকেও তুমি গ্রাম ভাবো নাকি? ওই খামার থেকে শহর মোটে আধ ঘণ্টার পথ। শহরে অনেক শিক্ষিত লোক আছে, ভাল লাইব্রেরি আছে। তা ছাড়া আমাদের মেদিনীপুরের সমিতি তো ভাঙেনি, সেখানে তুমি কথা বলার লোক অনেক পাবে।
ভরত তবু রাজি হল না। সে বলল, কয়েকটা দিন ভেবে দেখি। তুমি যাও, তোমাকে আমি চিঠি লিখব।
কিন্তু কলকাতার মেসবাড়িতে কয়েকদিনের মধ্যেই ভরতের মন ছটফটিয়ে উঠল। এখানকার একটি লোকের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা হয়নি। সে নিজেই কারুর সঙ্গে মেশে না বলে অন্যরা তার দিকে বাঁকা চোখে চায়। সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে দু-একজন নিচু গলায় মন্তব্য করে। সর্বক্ষণ ঘরের মধ্যেও তো বসে থাকা যায় না! মাঝে মাঝে ট্রামে চেপে ঘুরে বেড়ায়। ট্রামের জানলার ধারে বসে নগর-দর্শন করে এখন অনেকেই।
ত্রিপুরা থেকে ভরত যখন প্রথম কলকাতায় আসে, তখন কলকাতা শহরের যে রূপ ছিল, তার সঙ্গে এখনকার কত তফাত! অথচ খুব বেশি দিনের তো কথা নয়। নতুন শতাব্দী এসে হঠাৎ যেন সব কিছু বদলে দিয়েছে। তখন ঘোড়ায় টানা ট্রাম ছিল বটে, কিন্তু বেশি লোক চড়ত না। দু ঘোড়ায় টানা ছ্যাকড়াগাড়িগুলো ছুটত আরও জোরে। মহিলাদের ট্রামে ওঠার প্রশ্নই ছিল না, তারা। যেত পাল্কিতে। ধনী ব্যক্তিদের ছিল জুড়িগাড়ি, চৌঘড়ি গাড়ি। এখন বৈদ্যুতিক ট্রাম খুব জনপ্রিয়, দুপুরের কয়েক ঘণ্টা ছাড়া ফাঁকা পাওয়াই যায় না। পাল্কির সংখ্যা খুবই কমে গেছে, ছ্যাকড়া গাড়িগুলোরও নাভিশ্বাস উঠেছে। বড়মানুষেরাও এখন ঘোড়ার গাড়ির বদলে মোটর গাড়ি চড়ে।
হাজার হাজার ঘোড়া বাতিল হয়ে যাচ্ছে, এগুলোর কী হবে? কাজে লাগাতে না পারলে ঘোড়াদের তো কেউ দানাপানি দেবে না! শুধু ঘোড়া কেন, বিদ্যুৎ এসে কত মানুষকেও বেকার করে দিয়েছে। সংবাদপত্রে বেরোয়, কত ছাড়া গাড়ির মালিকদের গালে হাত, কয়েক হাজার গাড়োয়ান পথে বসেছে। পাল্কিবাহকরাই বা এখন কী করবে? শুধু তাই নয়, যে-কোনও সচ্ছল পরিবারের বৈঠকখানাতেই ছিল টানা-পাখা, অন্তত দু’জন পাংখাপুলার নিযুক্ত করা হত, তারা পালা করে পাখা টানত। সেই সব পেল্লায় টানা-পাখা খসিয়ে এখন ঘরে ঘরে বসানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক পাখা। পাংখাপুলারদের মাইনে দিয়ে রাখার চেয়ে বৈদ্যুতিক পাখার খরচ অনেক শস্তা। শুধু তাই নয়, পাংখাপুলাররা কাজে গাফিলতি করে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ত, কিন্তু বিদ্যুৎ ক্লান্ত হয় না, ঘুমোয় না, মাথার ওপর এই পাখা সর্বক্ষণ বনবন করে ঘোরে। রাত্রে অনেক রাস্তায় এখনও গ্যাসের বাতি জ্বলে বটে, কিন্তু কোনও কোনও রাস্তায়, বিশেষত সাহেব পাড়ায়, সন্ধে হতে না হতেই ঝলমল করে বৈদ্যুতিক বাতি।
ট্রামে চেপে ঘুরতে ঘুরতে ভরত অনুভব করে, বিদ্যুৎ নামে পরমাশ্চর্য শক্তিটি এসে অনেক লোকের জীবিকা হরণ করেছে বটে, কিন্তু কলকাতা শহরটি আগের তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন হয়েছে। আগে পাল্কি, ছ্যাকড়া গাড়ি আর ঝাঁকামুটেদের দৌড়োদৗড়িতে রাস্তাঘাটে সব সময় বিশৃঙ্খলা থাকত, এখন যানবাহন অনেক দ্রুত গতিতে চলে। ফুটপাথ বাঁধানো হচ্ছে বলে পথচারীরা তার ওপর দিয়ে হাঁটে, জনস্রোতের প্রবাহ অনেক সুশৃঙ্খল মনে হয়।
দিনের পর দিন তো আর ট্রামে বসেও সময় কাটানো যায় না। একদিন থিয়েটার দেখতে গেল, সে অভিজ্ঞতাও সুখকর হল না ভরতের। ক্লাসিক থিয়েটারে সে কিছুতেই যাবে না, গিয়েছিল স্টার থিয়েটারের প্রতাপাদিত্য পালা দেখতে। কিন্তু প্রধান অভিনেত্রীকে দেখেই তার মনে পড়ে গেল ভূমিসূতার কথা! এ নায়িকার সঙ্গে ভূমিসূতার মুখশ্রীর মিল নেই, কিন্তু একই রকম সাজপোশাক, কথা বলার ভঙ্গিতেও যেন বিখ্যাত অভিনেত্রী নয়নমণির অনুকরণ! মাঝপথে উঠে চলে এসেছিল ভরত।
ভূমিসূতা তার সঙ্গে কথা বলেনি, তার দিকে চক্ষু তুলে চায়নি পর্যন্ত। ভূমিসূতা তার কেউ না। আর কোনও দিন তার সঙ্গে দেখা হবে না। তবু বুক পোড়ে কেন! কেন হঠাৎ হঠাৎ চক্ষু জ্বালা করে ওঠে!
এই লক্ষ্যভ্রষ্ট জীবন নিয়ে ভরত কী করবে?
এই একটা বছর গুপ্ত সমিতির সঙ্গে মেতেছিল, কেশ একটা উদ্দীপনার সঞ্চার হয়েছিল। মনে হয়েছিল, একটা মহৎ উদ্দেশ্যে জীবনটা যদি হঠাৎ চলেও যায় তো যাবে। এত উদ্যোগ অতি তুচ্ছ রেষারেষিতে নষ্ট হয়ে গেল!
ভরত গ্রামে যেতে পারেনি, কিন্তু শহরের জীবনের সঙ্গেও সে খাপ খাওয়াতে পারছে না। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চিন্তা করলেই একটা দারুণ সঙ্কোচ তাকে পেয়ে বসে। যাদুগোপাল এখন ব্যস্ত ব্যারিস্টার, তার কাছে গেলে তাকে বিব্রত করা হবে। দ্বারিকা সমৃদ্ধ জমিদার, সে অবশ্য তেমন ব্যস্ত নয়, দেখা হলে খাতির করে, কিন্তু দ্বারিকার স্ত্রীর রহস্যময় কথাবার্তা শুনলেও অস্বস্তিবোধ হয়। তা ছাড়া, দ্বারিকার কাছে গেলে সে ভূমিসূতার প্রসঙ্গ তুলবেই। অন্য বন্ধুরা কে কোথায় হারিয়ে গেছে ঠিক নেই।
একদিন ট্রামে যেতে যেতে ভরত শুনল সামনের দু’জন ব্যক্তি দার্জিলিং বিষয়ে আলোচনা করছে। শিগগিরই তারা দল বেঁধে দার্জিলিং বেড়াতে যাবে, কখন ট্রেন ছাড়ে, কত রাহাখরচ, দার্জিলিঙে গিয়ে থাকার সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি সম্পর্কে কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল। এমন অনেক কথা মানুষকে শুনতে হয়, যাতে তার কোনও প্রয়োজন নেই। জনসাধারণের গাড়িতে দুজন পরিচিত ব্যক্তি কারুর অসুখ-বিসুখ সম্পর্কে এমনভাবে চেঁচিয়ে আলোচনা করে, যা অন্যরা শুনতে বাধ্য। এই লোক দুটি দার্জিলিং যাবে, তার বিবরণ ভরত শুনতে যাবে কেন? কান বন্ধ করারও তো কোনও উপায় নেই।
শুনতে শুনতে এক সময় ভরতের মনে হল, তা হলে আমিও দার্জিলিং ঘুরে আসতে পারি। যাওয়া তো শক্ত কিছু নয়। এই লোক দুটির কাছ থেকে যে অযাচিত জ্ঞান পাওয়া গেল, তা কাজে লাগানো যাক। এই সুযোগে হিমালয় দর্শনও হয়ে যাবে। ভরতের যাযাবর সত্তাটি আবার জেগে উঠল।
রেলপথে টানা দার্জিলিং যাওয়া যায় না। মধ্যে গঙ্গানদী পেরুতে হয়, একটি স্টিমার পার করে দেয়। ওপারের হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে আবার ট্রেন। শিলিগুড়িতে পৌঁছে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আর একটি ছোট ট্রেনে চাপতে হয়। তবু দার্জিলিং পৌঁছনো গেল না, কার্শিয়াং স্টেশনে সে ট্রেন থেমে রইল, ঘুম নামক কোনও স্থানে ধস নেমেছে, ট্রেন আর এগোতে পারবে না।
কার্শিয়াং স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে ভরত, খানিক দূরে দেখল এক জায়গায় ভিড় জমেছে। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সে চিনতে পারল। বিভিন্ন সভাসমিতিতে সে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা ও গান শুনেছে, একবার সামান্য আলাপও হয়েছিল, কিন্তু প্যান্ট-কোট পরা পুরোদস্তুর সাহেবি পোশাক পরিহিত কবিবরকে সে আগে কখনও দেখেনি। তবু তাঁর দীপ্তিমান চক্ষু, গৌরবর্ণ মুখটি কালো দাড়িতে ঢাকা হলেও টিকোলো নাকটি স্পষ্ট, ওষ্ঠে স্মিতহাস্য দেখলেই চেনা যায়। কিন্তু
কবি এই ট্রেনে পৌঁছেছেন, না এখান থেকে ফেরার জন্য ট্রেনে উঠতে এসেছেন, তা ঠিক বোঝা গেল না। ট্রেন ছাড়ার আপাতত কোনও লক্ষণ নেই। কবির সঙ্গে কথা বলার জন্য ভরত এগিয়ে গেল, তখন ডাণ্ডাধারী দু’জন সান্ত্ৰী ধরনের লোক চেঁচিয়ে বলল, হঠো হঠো, রাস্তা ছেড়ে দাও, রাজাবাহাদুরের জন্য রাস্তা ছেড়ে দাও!
ভরতের কৌতূহল হল, রাজাবাহাদুরটি আবার কে! কলকাতা শহরে গণ্ডায় গণ্ডায় রাজা-মহারাজ ঘুরে বেড়ায়, গ্রীষ্মকালে তারা সবাই দার্জিলিং বেড়াতে আসে। ইনি কোন রাজা?
সান্ত্রীদের এড়িয়ে আরও কাছাকাছি গিয়ে ভরত চমকে উঠল। এ তো রাধাকিশোর! পিতৃপদ পেয়েও তার চেহারার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। কবি রবীন্দ্রবাবুর পাশে রাধাকিশোরকে খর্বকায় মনে হয়, তার মুখমণ্ডলে তেমন কোনও রাজকীয় ভাব নেই। বীরচন্দ্র মাণিক্যকে যে কোনও অচেনা লোকও দেখলে বুঝতে পারত ইনি একজন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি। রাধাকিশোরের পরিধানে লম্বা কোটটি স্বর্ণখচিত, গলায় দু সেট মণি-মুক্তার মালা, এরকম মূল্যবান বসন-ভূষণ না থাকলে তাকে নেহাত একজন সাধারণ মানুষ মনে হত।
ভরতের মনের মধ্যে বিচিত্র ভাবের খেলা চলতে লাগল। অনেকদিন পর তার মনে পড়ল, সেও একজন রাজকুমার! এই রাধাকিশোর আর সে একই পিতার সন্তান। সহোদর না হলেও রাধাকিশোর কি তার বড় ভাই নয়? আগের রাজার আমলে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, এখনও কেন তাকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে! ত্রিপুরায় যাওয়া কি এখনও তার জন্য নিষিদ্ধ?
একবার সে ভাবল, সরাসরি রাধাকিশোরের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেবে। তারপর দেখা যাক না কী হয়! এখানে ইংরেজের রাজত্ব। এখানে ত্রিপুরা সরকারের কোনও জারিজুরি খাটবে না।
আবার সে ভাবল, এতকাল পরে রাজকুমার সাজার মতন নিচু ধরনের লোভ তার হচ্ছে কেন? তার কোনও পিতৃপরিচয় নেই, বংশপরিচয় নেই, সে স্বয়ংসিদ্ধ, এটাই কি বেশি গৌরবের নয়!
তবু কোথাও একটা টান থেকে যায়। জন্মভূমির টান, রক্তের টান। মনে পড়ে যায় রাজবাড়ির কথা, কমলদিঘির পারে বসে একা একা বই পড়া। অন্য রাজকুমাররা তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখলেও রাধাকিশোর কখনও তার সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেনি। কোনও চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার নেই, শুধু রাধাকিশোরের সঙ্গে দুটো কথা বলা যায় না! কেমন আছে ত্রিপুরার আর সবাই? মনোমোহিনী নামে সেই রানি?
রাধাকিশোর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছেন স্টেশনের বাইরের দিকে। রাজাদের অন্য দিকে তাকাতে নেই। তিনি ভরতকে দেখতে পেলেন না। দেখলেও চিনতে পারতেন কি না সন্দেহ। ভরত যখন ত্রিপুরা ছেড়ে চলে আসে, তখনই রাধাকিশোর ছিলেন পূর্ণবয়স্ক, তাঁকে চিনতে অসুবিধে নেই। কিন্তু ভরতের তখনও কৈশোর কাটেনি, ত্রিপুরা ত্যাগ করার পর সেই কিশোরটির জীবনে নানান উত্থান-পতনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, স্বপ্নময় চোখ দুটি এখন অনেক কঠিন বাস্তবতায় অভ্যস্ত। অবশ্য রাধাকিশোরের তুলনায় ভরত অনেক সুপুরুষ।
কি চুম্বক আকৃষ্টের মতন ভরত ওদের সঙ্গে সঙ্গে খানিক দূর গেল। স্টেশনের বাইরে পা দেবার পর হঠাৎ তার শরীর কেঁপে উঠল ভয়ে। ভাই? রাজাদের ভ্রাতৃস্নেহ বলে কোনও বস্তু থাকে নাকি! রাধাকিশোর এক সময় নরম স্বভাবের মানুষ ছিলেন, কিন্তু সে তো সিংহাসনে বসার আগে। রাজা হওয়া আর না-হওয়ার মধ্যে যে অনেক তফাত। সব রাজারাই তাদের ভাইদের অবিশ্বাস করে, ভাই মানেই তো সিংহাসনের দাবিদার, যে-কোনও মুহূর্তে আড়ালের ষড়যন্ত্রকারী। কিছু দিন আগেই ভরত এক ইতিহাস গ্রন্থে পড়েছে যে অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানরা কোনও ভাইকেই জীবিত রাখতেন না। এক সুলতান সিংহাসনে আরোহণ করেই তার উনিশজন ভ্রাতাকে হত্যা করেছিলেন। ঔরঙ্গজেবের নিষ্ঠুরতার কাহিনীও সুবিদিত। হিন্দু রাজারাও কম যান না। ত্রিপুরার ইতিহাস রাজাদের ভ্রাতৃবিরোধে কণ্টকিত হয়ে আছে। এই রাধাকিশোরের সঙ্গেই তাই বৈমাত্রেয় ভাই কুমার সমরেন্দ্রর মামলা-মোকদ্দমা হয়নি? জ্যেষ্ঠ পুত্র না হতে পারলে রাজপুত্র হয়েও সুখ নেই।
ভরতকে দেখেই যদি রাধাকিশোরের মনে হয়, সে কোনও মতলবে এসেছে? এই পাহাড় অঞ্চল ত্রিপুরা রাজ্যের অধীন নয়, কিন্তু এখানেও গুপ্তঘাতক নিয়োগ করা যেতে পারে।
ভরতের শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগল। নিয়তি? কলকাতার ট্রামে দু’জন অচেনা মানুষের মুখে দার্জিলিঙের কথা শুনেই সে ট্রেনে চেপে বসল। নিয়তি তাকে বারবার বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। সেই নিয়তিই তাকে এখানে টেনে এনেছে আবার কোনও কৌতুক করার জন্য? না, এবার আর ভরত সেই ফাঁদে পা দেবে না।
দার্জিলিং যাওয়া হল না, ভরত ফিরে এল কলকাতায়। দুদিন পরে কোনও চিঠি না লিখেই সে রওনা হল মেদিনীপুরের দিকে। হেমচন্দ্র একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু, তার কাছাকাছি থাকাই ভাল।
হেম যেন তার প্রতীক্ষাতেই ছিল, কোনও প্রশ্ন না করেই বলল, চল, তোমাকে খামারবাড়িটা দেখিয়ে আনি। দেখো তোমার পছন্দ হয় কি না!
এখানে বিদ্যুৎ আসেনি, মোটর গাড়ি আসেনি। এখনও গরুর গাড়িই সম্বল, শহরের মধ্যে এক ঘোড়ায় টানা এক্কা গাড়ি পাওয়া যায়। অধিকাংশ মানুষ নিজের দুটি পায়ের ওপরই নির্ভর করে।
প্রথম দিনের জন্য একটা এক্কা গাড়িই নিতে হল। খামারবাড়িটিতে পৌঁছার পর ভরত বুঝতে পারল, সেটা সত্যিই খুব দূরে নয়, হেমের বাড়ি থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হেঁটে আসা যেত।
বাড়িটি বহুদিন মেরামত হয়নি, জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বাগানে গাছপালা রয়েছে অনেক, কিন্তু বিশেষ শ্ৰী নেই, কেউ যত্ন করে না, একটি মধ্যম আকারের পুকুর আছে, সেটি পানায় ভরা, বাঁধানো ঘাটটি দেখলে বোঝা যায় এককালে কেউ শখ করে বানিয়েছিল।
সিদ্ধিরাম নামে একজন মালির থাকার কথা এখানে, অনেক ডাকাডাকি করেও তাকে পাওয়া গেল। তালা খুলে ঢোকা হল একতলা বাড়িটার মধ্যে। ভেতরে মাকড়সার জাল, ইঁদুর দৌড়োদৌড়ি করছে, সাপখোপ থাকাও বিচিত্র নয়। মেঝেতে যে ধুলো জমে আছে, তাতে বহুদিন কোনও পায়ের ছাপ পড়েনি।
হেম জিজ্ঞেস করল, দমে গেলে নাকি বন্ধু? খানিকটা সাফ-সুতরো করে নিলেই চেহারা খুলে যাবে। শুনেছি, আমার ঠাকুরদা এখানে এক পশ্চিমা রক্ষিতা পুষেছিলেন। সে নাচ-গান জানত। আমার বাবা পেটরোগা মানুষ ছিলেন, তাঁর ওসব সামর্থ্য ছিল না। তোমার ভূতের ভয় নেই তো?
ভরত মুখ তুলে তাকাল।
হেম বলল, মাঝে মাঝে নাকি রাত্তিরের দিকে নূপুরের আওয়াজ শোমা, যায়। নারীকণ্ঠের খিলখিল হাসি–আমাদের বাড়ির লোকজন কেউ কেউ নাকি শুনেছে, সেই থেকে কেউ আর এখানে আসতে চায় না। আমি দু’-এক রাত শুয়ে দেখেছি, আমার ভাগ্যে তেনারা দেখা দেননি। ভূতে ধরা আর ভূতের নজর লাগা কাকে বলে জানো? ভূতে ধরলে তো বুঝেই গেলে। আর তুমি ভূত দেখতে পেলে না, কিন্তু ভূত তোমায় দেখল, তাতেই নজর লেগে গেল, এরপর তুমি যেখানেই যাও, দিন দিন শুকিয়ে যাবে, অসুস্থ হয়ে পড়বে, ভূত তোমাকে মৃত্যুলোকের ওপরে নিয়ে যাবে।
ভরত বলল, মৃত্যু আমাকে অনেকবার ছুঁয়েছে, আমি সহজে যাচ্ছি না। তা হলে একটা ধাঙ্গড় ডেকে ঘরগুলো পরিষ্কার করাতে হয়।
হেম বলল, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব, তুমি দুটো দিন আমার ও বাড়িতেই অতিথি হয়ে থাকো। দু’দিন থাকলে তোমার মান যাবে না।
ভরত বলল, টাকাপয়সার কথা কিছু হল না। এ খামারের দাম বোধ হয় অনেক হবে, আমার সাধ্যের বাইরে।
হেম বলল, এখনই আমার টাকার প্রয়োজন নেই। ওসব কথা পরে হবে। তুমি বরং মাস মাস আমাকে পনেরো টাকা হিসেবে ভাড়া ধরে দিয়ো। কয়েকটা মাস থেকে দেখো তোমার পোয় কিনা!
দিন সাতেকের মধ্যে ভরত জায়গাটার সঙ্গে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিল। সিদ্ধিরাম মালি তাকে রান্না করে দেয়, সে বাগানের কাজ বিশেষ কিছুই জানে না কিংবা সে কাজে মন নেই, তবে রান্না করতে ভালবাসে। সন্ধের পর সে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। তা যাক, সম্পূর্ণ শব্দহীন, আললহীন এই নির্জনবাস সে বেশ উপভোগ করছে। বহুকাল আগে মৃতা কোনও নর্তকীর আত্মা এসে এখনও তাকে দেখা দেয়নি।
সারাদিন ভরত বাগানে কাটিয়ে দেয়। সে মাটি খোঁড়ে, ফুলগাছের যত্ন করে, বড় গাছের শাখা-প্রশাখা ছেটে দেয়। পুকুরের পানা পরিষ্কার করে। জল-কাদা মাখতে তার আপত্তি নেই, শুধু লুঙ্গি পরা, খালি গা, এখানে এসে সে দাড়ি কামানোও বন্ধ করে দিয়েছে। নতুন চেহারায় নতুন জীবন।
বিকেলের দিকে প্রায় হেম আসে, সঙ্গে থাকে আরও দু-একজন। পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসা হয়। নানারকম প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপচারি চলে অনেকক্ষণ।
গুপ্ত সমিতির অন্য সদস্যেরা ঘরে ফিরে গিয়ে কে কী রকম আছে তা জানে না ভরত, কিন্তু হেমকে দেখলেই বোঝা যায়, সে কিছুতেই সংসারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। সে অশান্ত, অস্থির। সে সত্যিই দেশের কাজ করার জন্য চাকরি ও বাড়িঘর ছেড়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত কিছুই হল, ঘাড় নিচু করে ফিরে আসতে হল, এ ব্যর্থতা সে মানতে পারছে না কিছুতেই। অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন্দ্রের ওপর তার যথেষ্ট ক্ষোভ।
একদিন সে বলল, দেখো ভরত, আমরা গীতা ও তলোয়ার স্পর্শ করে শপথ নিয়েছিলাম, দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকব। সে শপথ আমরা রাখতে পারলাম কই? অরবিন্দবাবু নিজে শপথ নেননি, তাই না? আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, যিনি নেতা, তাঁর শপথ নেবার প্রয়োজন নেই। অথচ তিনিই দলটা ভেঙে দিলেন। ছি ছি ছি!
ভরত বলল, শুধু বারীনের কথা শুনে তিনি যতীনদাকে বিতাড়িত করলেন, এটা ঠিক হয়নি। যতীনদার বক্তব্য তাঁর শোনা উচিত ছিল।
হেম বলল, একটা বিধবা অবলা মেয়ে, তার জন্য একটা এত বড় মহৎ উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে! সে মেয়েটার তো আমি কোনও দোষ দেখিনি। সে একটু আমাদের কাছাকাছি এসে বসতে চাইত, আমাদের কথা শুনতে চাইত, তাতে দোষের কী হল? তাকে দলে নিয়ে নিলেই হত। মেয়ে বলে কি সে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে পারে না? সরলা ঘোষালের সঙ্গে যদি আমরা হাত মেলাতে পারি, তা হলে ও মেয়ে কেন অচ্ছুত হবে? সরলা ঘোষাল ধনীর দুলালী, পেছনে ঠাকুরবাড়ির জ্যোতি রয়েছে, সেই জন্য তার বেশি খাতির!
সরলা ঘোষালের প্রসঙ্গ উঠলেই তার বৈঠকখানা ঘরের দৃশ্যটি ভরতের চোখে ভেসে ওঠে, সে কোনও কথা বলে না।
হেম আবার বলল, অরবিন্দবাবু একজন উচ্চশিক্ষিত, পণ্ডিত লোক, তিনি আমাদের আজগুবি, অলীক গল্প শোনাবেন, এ কী আশা করা যায়? তোমার মনে আছে, উনি বলেছিলেন, সারা ভারতে আর সবাই বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত, এমনকী পাহাড়-জঙ্গলেও আদিবাসীরা ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য অস্ত্র শানিয়ে বসে আছে, শুধু বাঙালিরাই কিছু করছে না। কোথায় কী! এসব ডাহা মিথ্যে কথা! ভারতের আর কোনও রাজ্যের আর কোনও দলের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল? সে রকম কোনও দলের অস্তিত্বই নেই। সারা ভারত এখনও ঘুমিয়ে আছে। পরাধীনতার অপমানের জ্বালা বোধ করার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই এ দেশের মানুষের।
ভরত বলল, বারীন এবং যতীনদাও এরকম কথা বলেছিল। একে ঠিক মিথ্যে বলা যায় না। আমাদের উৎসাহিত করার জন্য, আমাদের চটপট কাজে নেমে পড়ার জন্যই বোধহয় অরবিন্দবাবু সারা ভারতের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিলেন।
হেম উগ্র ভাবে বলল, তা বলে তিনি রূপকথা শোনাবেন! আমরা কি ছেলেমানুষ! মিথ্যের ওপর ভিত্তি করে কিছু গড়তে গেলেই তা এত সহজে ভেঙে যায়।
ভরত বলল, বরোদা থেকে আর কোনও নির্দেশ আসছে না। সব চুপচাপ। এরপর আমরা কী করব, যে-যার কোটরে সেঁধিয়ে থাকব!
হেম বলল, মোটেই না। আমাদের মেদিনীপুরের দল মোটেই দমে যায়নি, নিরাশও হয়নি। আমরা আগেকার মতন কাজ চালিয়ে যাব। প্রথমে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক দরকার। আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে ইংরেজ শাসন ও শোষণের কথা বোঝাব। সাধারণ মানুষের সমর্থন না পেলে বিপ্লব হতে পারে না। কিছু লেখাপড়া জানা ছেলে হঠাৎ হুড়ম হুড়ম করে একটা ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু করে দিল, দেশের অধিকাংশ মানুষ তার মর্ম কিছুই বুঝল না, তা কখনও সার্থক হতে পারে? আমরা আবার গোড়া থেকে কাজ শুরু করব। দেখবে, এই মেদিনীপুরের দলই এক সময় বাংলার নেতৃত্ব দেবে! ‘ সত্যেনও ফিরে এসেছে মেদিনীপুরে। সত্যেনের নামে নারীঘটিত দুর্বলতার অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, বারীন্দ্র তার নিজের মামাকেও ছাড়েনি। হেম অবশ্য সত্যেনের ওপর একটুও বিরূপ না। তার মতে, যতীনদার বিধবা বোনটির প্রতি সত্যেনের যদি কিছুটা দুর্বলতা জন্মেও থাকে, তাতে দোষের কী আছে? বিপ্লবীরা কি সন্ন্যাসী নাকি? তা হলে তো কোনও বিবাহিত লোকই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার যোগ্য নয়। হেম নিজে বিবাহিত, স্বয়ং অরবিন্দ ঘোষও বিবাহ করেছেন। বিবাহ সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনও নারীর প্রতি আসক্ত হওয়া উচিত কি না, সে নৈতিকতা বিচারের দায় সমাজের। বিপ্লবীরা সমাজ বহির্ভূত, তাদের ও নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। যার হৃদয়ে প্রেম নেই, সে কি দেশপ্রেমিক হতে পারে।
সত্যেন নিজে অবশ্য খানিকটা অনুতপ্ত। সে নিঃশব্দে আবার সংগঠনের কাজ শুরু করেছে। বেছে বেছে কিছু যুবককে সংগ্রহ করে তাদের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের কাহিনী পড়ে শোনায়। এ দেশের অর্থনৈতিক অধঃপতনের কথা বুঝিয়ে বলে। গোপনে গোপনে নাকি অস্ত্রশিক্ষার কাজও চলছে।
সত্যেন একদিন এখানে এসে ভরতকে বলে গেল, এই খামারবাড়িটা সে সমিতির কাজে লাগাতে চায়। প্রয়োজনে কয়েকটি ছেলেকে এখানে আশ্রয় দিতে, ভরতকে তাদের পড়াশুনোর ভার নিতে হবে। অর্থাৎ ভরতকে এখানে শুধু গাছপালার পরিচর্যা আর পুকুর পরিষ্কারে ব্যাপৃত থাকলে চলবে না।
হেম মাঝে মাঝে ভরতকে দূর দূর গ্রামাঞ্চলে টেনে নিয়ে যায়। দুটো বাইসাইকেল জোগাড় হয়েছে, সকালে বেরিয়ে সন্ধের সময় ফেরে। হেম সাধারণত কোনও গ্রামে গিয়ে সেখানকার কয়েকজন স্কুল মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাদের সঙ্গে ভাব জমায়। এই সব জায়গায় খবরের কাগজ পৌঁছোয় না, মাস্টাররা নিজেদের গণ্ডির বাইরের কিছু খবরই রাখে না। হেম নিজের টাকায় সখারাম গণেশ দেউস্করের ‘দেশের কথা’ বইটির অনেকগুলো কপি আনিয়েছে, মাস্টারদের এক-একখানা সেই বই দেয়। এই সব শিক্ষকদের যদি সচেতন করা যায়, তা হলে এদের মাধ্যমে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করা যাবে।
হেমের ধৈর্য ও নিষ্ঠা এবং মানুষকে বোঝাবার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় ভরত। কিন্তু হেমের নেতা হবার কোনও অভিলাষ নেই। মেদিনীপুরের সমিতিতে বরং সত্যেনের অনেকটা প্রাধান্য আছে, হেম থাকতে চায় আড়ালে। নিজের পরিবারের প্রতি সব দায়িত্ব অবহেলা করে হেম দিনের পর দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়, এটা যেন তার একটা ব্রত।
একদিন খুব একচোট বৃষ্টির পর রাস্তায় এমন কাদা হয়েছে যে বাইসাইকেল চালানো মুশকিল, ওরা নেমে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে। কথা হচ্ছে বঙ্গভঙ্গ বিষয়ে। বাংলা দেশটা ভাগ হবেই এমন হম্বিতম্বি শোনা যাচ্ছিল ইংরাজ সরকারের পক্ষ থেকে, হঠাৎ যেন তা থেমে গেছে। বাঙালিবাবুদের আপত্তি ও প্রতিবাদের বহর দেখে লর্ড কার্জন পিছিয়ে গেলেন? তিনিও তবে জনমতকে ভয় পান! কিংবা তাঁর সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে!
সবাই এতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও হেম মোটেই খুশি নয়। তার মতামত উল্টো। সে বলল, বাংলা ভাগ হলেই ভাল হত।
ভরত বলল, সে কী! বাংলা এখন ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য। বাঙালিদের কথা সারা ভারত শোনে। এই বাংলাকে টুকরো টুকরো করে দিলে বাঙালিদের শক্তি অনেক কমে যাবে না! তা ছাড়া, এটা যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা, তা তুমি বোঝো না?
হেম দৃঢ়স্বরে বলল, বুঝি, সবই বুঝি। তবু ইংরেজ সরকার যদি জোর করে ছুরি দিয়ে বাংলাকে খণ্ড খণ্ড করে দিত, তা হলে আমি খুশি হতাম। অত্যাচার যত বাড়বে, ততই আমাদের কাজের সুবিধে হবে। এ জাতটা ঘুমিয়ে আছে, মড়ার মতন ঘুমিয়ে আছে, শিরদাঁড়ায় আঘাত না করলে জাগবে না!
আলোচনা আর বেশি দূর এগোল না। মোড়ের গাছতলায় কয়েকটি ছেলে বসে গুলতানি করছিল, তার মধ্য থেকে একজন ছুটে এসে সামনে দাঁড়াল। ছেলেটিকে চেনা চেনা মনে হল ভরতের। আগেরবার দেখেছে, এ সেই দুর্দান্ত, ডানপিটে কিশোরটি, যার দুরন্তপনার শেষ নেই। কী যেন এর নাম, ক্ষুদিরাম?
ছেলেটি বলল, হেমদা, আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
সে এমনভাবে ভরতের দিকে তাকাল, যেন দ্বিতীয় ব্যক্তির সামনে সে কথাটা বলা যাবে না। হেম তা অগ্রাহ্য করে জিজ্ঞেস করল, কী রে ক্ষুদি, কী হয়েছে?
ক্ষুদিরাম বলল, হেমদা, আমায় একটা পিস্তল দিতে হবে। আপনার বাড়ি যাব?
হেম ভুরু কুঁচকে চেয়ে থেকে বলল, পিস্তল! সেটা কি খেলনা নাকি! পিস্তল দিয়ে তুই কী করবি?
ক্ষুদিরাম বলল, একটা সাহেবকে গুলি করব! ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এখানে একজন আদালিকে চড় মেরেছে। কেন মারবে? সাদা চামড়া বলে যা খুশি তাই করবে? কেন, আমরা শোধ নিতে পারি না?
হেম, বলল, তা বলে তুই সাহেবকে মারতে যাবি? সাহেবদের কত ক্ষমতা তা বুঝিস! পুলিশ ঠিক তোকে ধরে ফেলবে, তারপর ফাঁসি দেবে কিংবা কুকুরের মতন গুলি করে মারবে!
ক্ষুদিরাম বলল, ওসব আমি গ্রাহ্য করি না!
হেম এবার বিরাট ধমক দিয়ে বলল, আমার কাছে পিস্তল আছে তোকে কে বলল? বখামি করার আর জায়গা পাসনি! খবরদার, আর এই সব কথা আমার সামনে বলবি না!
ক্ষুদিরাম ক্ষুণ্ণভাবে ফিরে যাবার পর হেম বলল, ভরত দেখলে? এ ছেলেটাকে কিন্তু সত্যেন এখনও দীক্ষা দেয়নি। তবু এই ধরনের ছেলেদের মধ্যে রক্তে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। এ রকম কয়েক হাজার ছেলে তৈরি হলে আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কাঁপিয়ে দিতে পারব না?