2 of 2

৭০. হিমানীর বাবা-মা এবং দাদারা

হিমানীর বাবা-মা এবং দাদারা এসে আশ্রয় নিয়েছেন বেলেঘাটায়। হিমানীর বাবার বয়স অনেক হয়েছে, তবু বেশ শক্তসমর্থ ছিলেন এতদিন, হঠাৎ তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। মাসখানেক ধরে শয্যাশায়ী, প্রত্যেক দিনই মনে হয়, শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এল বুঝি, কিন্তু বৃদ্ধের প্রাণশক্তি প্রচণ্ড।

হিমানী প্রায় রোজই বাবাকে দেখতে যান। দু’দিন ধরে বেশি বাড়াবাড়ি হয়েছে বলে সেদিন তিনি সকালেই চলে গেলেন স্বামীকে নিয়ে। বাদল কিছুতেই গেল না। সে আগে কয়েক দিন গেছে। কিন্তু অসুখের বাড়িতে তার কিছুই করার থাকে না, ও-বাড়িতে বইপত্রও বেশি নেই–তার সময় কাটানোই এক সমস্যা হয়।

ছোটবেলায় এই দাদামশাই বাদলকে কত ভালোবাসতেন। তাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোতেন রোজ। সেই যুদ্ধের সময়, যখন বাদলরা সবাই পূর্ব বাংলায় মামাবাড়িতে চলে গিয়েছিল। গ্রামের সেই বাড়িও নেই, মানুষগুলোও কেমন যেন বদলে গেছে। মামা-মামিমাদের সঙ্গে বাদল কিছুতেই ভাব জমাতে পারল না। সে একেই তো একটু মুখচোরা লাজুক, তা ছাড়া বাদল যে-জগৎ নিয়ে চিন্তা করে–সে-জগৎ সম্পর্কে এঁদের কারওর মাথাব্যথা নেই। এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ দাদামশাই সম্পর্কে বাদলের আগে একটা বিরাট ধারণা ছিল, এখন কলেজে-পড়া মন নিয়ে বাদল দেখতে পায় দাদামশাইয়ের ব্যক্তিত্ব ও পাণ্ডিত্যও তাকে অনেক সংস্কার থেকে মুক্ত করতে পারেনি।

বাদল দাদামশাইকে অসুখের সময় দেখে এসেছে। তিনি এখন মানুষ চিনতে পারেন না। ওবাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই, তা হলে বাদল শুধু-শুধু গিয়ে কী করবে? খালি ভিড় বাড়ানো। তবু হিমানী বলেন, তার দাদা বউদিরা নাকি রোজই জিজ্ঞেস করেন, বাদল এল না? কেন, এল না কেন? শুনেই বাদলের রাগ ধরে যায়। বাঙালদের সব ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি। কোনও কাজ নেই, তবু মুখ দেখাবার জন্য যেতে হবে?

সেদিন সকালে হিমানী অনেক করে বললেন। বাদল যাবে না একেবারে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে।

হিমানী জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে তুই খাবি কোথায়? হোটেলে মোটেলে খেতে চাস বুঝি?

বাদল বলল, আমি রান্না করে খাব।

রান্না করে খাবি? হেঃ, কোনও দিন রান্নাঘরের ধারেই যেতে দেখলুম না।

সে তোমাদের ভাবতে হবে না। আমি ঠিক ব্যবস্থা করে নেব। তোমরা এখন যাও তো–দশটার সময় বেরোবে বলেছিলে, এখন এগারোটা বাজে–

হিমানী বললেন, বাড়িতে বুঝি বন্ধুবান্ধবদের ডেকে আজ আড্ডা বসানো হবে? নিজের দাদুর এ রকম অসুখ–

বাদল বলল, না, না, আড্ডা হবে না। আমার নিজস্ব কাজ আছে।

একমাত্র ছেলে, সেই জন্যই হিমানী কিছুতেই ইচ্ছে থাকলেও প্রাণখুলে বকতে পারেন না বাদলকে। চিররঞ্জন তার একমাত্র স্বামী হলেও তাকে বকুনি দেবার ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য নেই। স্বামীকে বকেই তিনি আশ মিটিয়ে নেন।

মা বাবা চলে যাবার পর বাদল সত্যিই রান্নার জোগাড়যন্ত্র করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। কোনও দিন সে রান্না করেনি, তাতে কী। ভাত আর আলুসিদ্ধ সবাই রাঁধতে পারে। ইস, রেণুকে দুপুরের বদলে এই সময় যদি আসতে বলত, তা হলে দু’জনে মিলে দারুণ রান্না করা যেত। শুধু দু’জনের পিকনিক। এখন এক ছুটে গিয়ে রেণুকে ডেকে আনলে কেমন হয়? কিন্তু বাদল যে রেণুদের বাড়িতে আর কখনও যাবে না ঠিক করেছে। রেণুদের বাড়িতে টেলিফোনটাও যে থাকে ছোটকাকার ঘরে। বাদল কিছুতেই ছোটকাকাকে বলতে পারবে না, রেণুকে ডেকে দিন। তিনি যদি আবার সেই রকম ‘অ’ বলেন!

থাক, রেণু তো দুপুরে আসবেই–এখন আর তাকে ডাকার চেষ্টা করার দরকার নেই। বাদল রান্নাঘরে গিয়ে স্টোভ জ্বালল।

এ-বাড়িতে ঠাকুর-চাকর সব ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন ঠিকে ঝি শুধু সকালে-বিকেলে এসে বাসন মেজে দিয়ে যায়। ঠাকুর-চাকর রাখার সঙ্গতি এদের আর নেই। বাড়ির নীচতলাটা ভাড়া দিলে কিছু আয় হয়। ইদানীং হঠাৎ কলকাতায় ভাড়াবাড়ির খুব চাহিদা হয়েছে, ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণ প্রায়ই এ বাড়ির একতলাটা ভাড়া হবে কিনা খবর নেবার জন্য লোকজন আসে। একতলাটা একদম খালি, কেউ ব্যবহার করে না, তবু চিররঞ্জন ভরসা করে ভাড়া দিতে পারছেন না। সূর্যকে জিজ্ঞেস না করে ভাড়া দেবেন কী করে? সূর্যর তো পাত্তাই নেই।

বাদল স্টোভের উপর হাঁড়ি চাপিয়ে তাতে জল আর চাল ঢেলে দিল। তারপর সামনে বই খুলে বসল। কিন্তু বই পড়ায় মন বসবে কী করে, প্রতি মিনিটে একবার হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখছে। ভাত তৈরি হতে এতক্ষণ সময় লাগে? টগবগ করে ফুটে উঠলে তখন ঢাকনা খুলে দিতে হয় এবং হাতায় করে খানিকটা তুলে টিপে দেখতে হয় সেদ্ধ হয়েছে। কিনা–এটুকু বাদল জানে।

একসময় টগবগ করল এবং ভাত টিপেও দেখা হল। সব ঠিক আছে। বাদল ফ্যানও গেলে ফেলল হাত না পুড়িয়ে। তবে, চালের আন্দাজ ঠিক করতে পারেনি, ভাত রান্না হয়েছে তাতে অন্তত চার জন লোক পেটভরে খেতে পারে। প্রথমেই আলুগুলো ছেড়ে দেবার ফলে সেগুলো গলে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

যাই হোক, তবু এতখানি সার্থকতায় সে বেশ উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল। তা হলে, এবার একটা কিছু ভেজে ফেললেই বা কেমন হয়? বাদল চাকা চাকা করে একটা বেগুন কেটে ফেলল, তাতে হলুদগুঁড়ো মাখাল কিন্তু নুন মাখাতে ভুলে গেল। সসপ্যানে তেল ঢেলে চাপাল কিন্তু তেলটা যে গরম হবার পর বুদবুদশূন্য হলে তারপর বেগুন ছাড়তে হয় এতটা সে জানবে কী করে? সুতরাং কাঁচা তেলে জলেভেজা বেগুন ছাড়তেই চটপট করে ঝাঁঝিয়ে উঠল, তার মুখ-চোখে ছিটেফেঁটা লাগতে পারত, কিন্তু লাগেনি।

পোড়া পোড়া বেগুনভাজা আর ঈষৎ গলে যাওয়া ভাতে মাখন মেখে বাদল দিব্যি তৃপ্তি করে খেল। অনেক দিন সে এত ভালো করে খায়নি। নিজের হাতের রান্না তো!

খেয়েদেয়ে সে সবেমাত্র সিগারেট ধরিয়ে বারান্দার রোদে বসেছে, এমন সময় মনে হল যেন নীচের দরজায় একটা শব্দ। নিশ্চয়ই রেণু এসেছে। বাদল ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। নীচে গিয়ে দেখল কেউ নয়। ঘড়িতে দেখল মাত্র সোওয়া একটা বাজে। রেণু এর মধ্যে আসবে কী করে? তার তো আসার কথা সেই সাড়ে তিনটের সময়।

এই অতক্ষণ সময় কাটানো বাদলের পক্ষে একটা বিরাট সমস্যা হয়ে উঠল। প্রতিটি মিনিটকে মনে হয় এক ঘণ্টা। যত বার ঘড়ির দিকে তাকায়, মনে হয় কাটা থেমে আছে। আরও দু’বার তাকে নীচে নেমে যেতে হল শুধু শুধু।

সময় কাটাবার জন্য সে রেডিয়োটা খুলেছিল। আবার তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল সেটা এই ভেবে যে রেডিয়োর জন্য নীচে দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ যদি সে শুনতে না। পায়? অনেক বাড়িতে আজকাল কলিংবেল বসানো হয়েছে–এ বাড়িতে কে এসব কথা ভাবে?

আজ আবার এই সময় হঠাৎ কোনও উটকো বন্ধুবান্ধব না এসে পড়ে। জিতেনটা আসতে পারে। মাঝে মাঝেই এসে লম্বা লম্বা কবিতা শোনায়। বাদল কত বার বলেছে, তার আজকাল কবিতাটবিতা ভালো লাগে না। তবু সে শোনাবেই। হঠাৎ এসে পড়লে তো তাকে আর তাড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা হলে আজকের দিনটাই নষ্ট হবে। হে ভগবান, আজ যেন জিতেন না আসে।

কথাটা ভেবেই বাদল আপন মনে হেসে ফেলল। সে ভগবানে বিশ্বাস করে না, বন্ধুদের কাছে এই নিয়ে অনেক বড়াই করেছে কিন্তু বিপদের চিন্তায় কী রকম ভগবানের নাম মনে এসে গেল। আজ যদি জিতেন না আসে এবং রেণু ঠিক সময় আসে, তা হলে বাদল মাসে একদিন ভগবানকে মানতে রাজি আছে।

বাড়িটা অদ্ভুত রকম নিস্তব্ধ। বাড়িতে আর কেউ নেই। এই কথাটা মনে এলেই এ রকম নিস্তব্ধতার অনুভূতি হয়। অনেক সময় তো বাবা দুপুরে দুপুরে বেরিয়ে যান, মা ঘুমিয়ে থাকেন, বাদল একা একা নিজের ঘরে বই পড়ে–তখন তো এ রকম ঠান্ডা নিস্তব্ধতার বোধ আসে না। একদম ফাঁকা বাড়িতে বেশিক্ষণ একা থাকলে কী রকম গা শিরশির করে। বড়বাবু একসময় দিনের পর দিন এ বাড়িতে একা থাকতেন। অনেক দিন পর বড়বাবুর কথা মনে পড়ল। বড়বাবুর একটা জীবনী লেখার কথা একবার সে ভেবেছিল, এখন সেসব চিন্তা ঘুচে গেছে।

ঘড়িতে মাত্র পৌনে তিনটে বাজে। আরও অনেকক্ষণ। রেণু কি একটু বুদ্ধি করে আগে আসতে পারে না? বাদল দারুণ উত্তেজিত বোধ করতে লাগল। এখন তার গা ছুঁলে মনে হবে, তার জ্বর হয়েছে। সত্যি সত্যি তার চোখ ও কানের পাশটায় যেন। আগুনের হলকা লাগছে। সে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারছে না। তখন তার মনে হল, বার বার দোতলা থেকে একতলায় নেমে যাবার বদলে বৈঠকখানায় বসে থাকলেই তো হয়।

বৈঠকখানায় বসে সে ঘন ঘন সিগারেট খেতে লাগল। ঘড়ি আর দেখবেই না।

তার ছেলেবেলার আপন মনে কথা বলার স্বভাব এখনও রয়ে গেছে। দিবাস্বপ্ন দেখাও তার রোগ। সে কল্পনায় দেখতে লাগল, রেণু আসার পর সে কী রকম ভাবে কথা বলছে।

দরজা খুলে দিতেই দেখা গেল রেণু। হাতে দু’খানা মোটা মোটা বই। বাদল জিজ্ঞেস করল, এত দেরি করলে যে?

কোথায় দেরি? ঠিক তো সাড়ে তিনটে।

ভুল করেও কি একটু আগে আসতে নেই?

তুমি কোনও দিন ঠিক সময় আসো? তুমি তো সব সময় দেরি করো–

নাঃ, এ তো ঝগড়ার মতন হয়ে যাচ্ছে শুরু থেকেই। আজ রেণু এলে সে ঝগড়া করবে নাকি? এ রকম ভাবে নয়।

রেণুর হাতে দু’খানা মোটা মোটা বই। বাদল জানে, আজ কলেজ বন্ধ। বাদল জিজ্ঞেস করল, কী বই দেখি? আমার জন্য এনেছ?

এ-বই তোমার পড়া। লাইব্রেরির বই। মাকে বললাম কিনা, সাহিত্য পরিষদ লাইব্রেরিতে যাচ্ছি।

আজকাল বাড়ি থেকে বেরোবার সময় কিছু বলে বেরোতে হয় বুঝি!

বাঃ, এই দুপুর রোদে বেরোলে মা জিজ্ঞেস করবে না? তাও তো মা আসতে দিচ্ছিল না। এত রোদে বেরোলে রং কালো হয়ে যায়।

এই কথা বলে রেণু হাসল। তার উত্তরে বাদল দুম করে বলল, জানো, আজ আমি নিজে রান্না করে খেয়েছি।

সত্যি? যা মিথ্যুক—

বিশ্বাস করো। মা-রা তো দশটার সময় বেরিয়ে গেছেন–হোটেলে না খেয়ে আমি নিজেই রান্না করে খেলাম।

কী কী রাঁধলে?

ধুৎ! রেণু আসতে-না-আসতেই সে রান্নার কথা বলবে নাকি? ভারী একটা কৃতিত্বের ব্যাপার যেন। এটা বড় বোকা বোকা হচ্ছে। রেণু যদি জিজ্ঞেস করে, তা হলে বলা যেতে পারে।

দরজার সামনে রেণু। হাতে বই নেই। রেণু বলল, আমার দেরি হয়ে গেছে বুঝি?

বাদল বলল, ভীষণ, ভীষণ দেরি করেছ। আমি ভাবছিলাম, তুমি আসবেই না।

সত্যিই বোধহয় আসতে পারতাম না। সেজোকাকিমা চারটে সিনেমার টিকিট কেটেছিলেন, তার মধ্যে বেবিমাসির মাথা ধরেছে বলে যেতে পারবেন না, তাই সেজোকাকিমা বললেন আমাকে যেতে। আমি দেখলাম, দারুণ বিপদ। আমি তো মাথা ধরার কথা বলতে পারি না, কারণ একটু বাদেই বেরোব। বললুম, ছবিটা আমার দেখা। তাও শোনে না–একবার দেখলে কি দু’বার দেখা যায় না? কবে আমি দেখলাম, এই সব। তোমার জন্য আমাকে মিথ্যে কথা বলতে হল।

আমার জন্য না হয় বললিই একদিন।

আমি মিথ্যে কথা বলি না সবাই জানে। আমার কী রকম অস্বস্তি হয়।

একদিন বললে কিছু ক্ষতি হয় না। তুই আজ না এলে আমি আজ ভীষণ রেগে যেতাম।

আমি তোমার রাগকে বড্ড ভয় পাই। হঠাৎ আজ ডেকেছ কেন?

আজ অনেকক্ষণ ধরে গল্প করব। কত দিন তো ভালো করে গল্প করা হয়নি। তা ছাড়া আমার কয়েকটা দরকারি কথা আছে।

মাসিমা নেই বাড়িতে?

না, ওরা সাতটা-আটটার আগে ফিরবে না। কাছাকাছি আর কেউ না থাকলে, বেশ এটা, বুঝলি না, বেশ সহজ ভাবে কথা বলা যায়।

হঠাৎ এ রকম গল্প করবার ইচ্ছে হল যে! আজকাল তুমি সব সময় কী রকম গম্ভীর গম্ভীর হয়ে থাকো–

রেণু, আমার খুব মনখারাপ যাচ্ছে।

কেন?

সেই কথাই তো বলব বলে তোকে ডেকেছি। তোকে ছাড়া আর তো কারোকে বলতে পারি না!

আমি তোমার মন ভালো করে দিতে পারি?

শুধু তুইই পারিস। তুই আমার চোখের দিকে তাকাবি, ম্যাজিশিয়ানের মতন ওই। হাত তুলে–

তুমি এই রকম একটা কবিতা লিখেছিলে না?

চল, আমরা ওপরে গিয়ে বসি। চা খাবি? আমি চা তৈরি করে দিতে পারি।

না, চা-টা খাব না। তুমি আজকাল কবিতাটবিতা লেখো না কেন?

কী হবে লিখে? তা ছাড়া, তুই-ও তো আমার কবিতা লেখার প্রেরণা দিচ্ছিস না আজকাল।

আমি আবার কী করে প্রেরণা দেব? ধ্যাৎ!

আমি তোর কাছাকাছি থাকতে চাই। আমার তো এখন আর কোনও বন্ধু নেই– দরজায় এবার সত্যিই শব্দ। বাদল তড়াক করে লাফিয়ে এসে দরজা খুলে দেখল এবার সত্যিই রেণু। হাতে একখানা মাত্র বই, মোটা নয় সরু।

বাদল কোনও কথাই বলল না। রেণু ভেতরে ঢুকে বলল, এ রকম অন্ধকার ঘরে বসে আছ কেন?

বাদল সে কথার কোনও উত্তর দিল না। কোনও কিছু চিন্তাও করল না, দরজাটা বন্ধ করেই রেণুকে জড়িয়ে ধরল দু’হাতে। রেণু বাধা দেবার আগেই তার ঠোঁটে ঠোঁট ডোবাল।

রেণু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এ কী?

একটু সরে গিয়ে রেণু দুঃখ ও অভিমান মিশ্রিত গলায় বলল, তুমি আমাকে এই জন্য ডেকেছিলে?

বাদল অপরাধীর মতন দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বসংসারের বিনিময়েও সে শপথ করে বলতে পারে যে, এক মিনিট আগেও সে এ রকম কোনও কথা ভাবেনি। রেণুকে দেখার পরেই মুহূর্তেই কী যে ঘটে গেল!

কিন্তু অপরাধবোধ থেকে ক্ষমা চাইবার বদলে তার মেজাজ হঠাৎ চড়ে গেল। সে ভাবল, আমি কী দোষ করেছি? রেণু তো আমার নিজস্ব। তাকে নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি।

মনোবল সুদৃঢ় করার জন্য সে ফস করে একটা সিগারেট ধরাল। বেশ কায়দা করে ধোঁয়া ছেড়ে সে বলল, কী হয়েছে কী?

রেণু বলল, তুমি জানো, আমি এসব পছন্দ করি না।

আমার যা খুশি আমি তাই করব।

না।

দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ। মনে হয়, এক্ষুনি ওরা খুব ঝগড়া করবে। তখন বাদলের মনে পড়ল, রেণু আসবার আগে কত কী কল্পনা করেছিল সে।

বাদল হেসে ফেলে বলল, রেণু, তুই এ রকম কেন রে?

রেণু তবু গম্ভীর ভাবে বলল, আমি তো এই রকমই। তুমি খুব সিগারেট খেতে শুরু করেছ আজকাল। আমার মোটেই ভালো লাগে না।

বাদল রেণুকে আরও রাগাবার জন্য সিগারেট সুষ্ঠু হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুই একটু খাবি? একবার টেনে দেখ না!

রেণু বাদলের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। তারপর একটা চেয়ারে বসল অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে। হাতের বইটা খুলে বসল। যেন, সে বাদলের সঙ্গে আর কথা বলতে চায় না।

বাদল ভেতরে অত্যন্ত উত্তেজিত বোধ করছে। তার শরীরের মধ্যে এমন একটা চাঞ্চল্য এসেছে, যাতে সে নিজেও একটু বিস্মিত হয়। রেণু তার কত দিনের চেনা, তবু আজ তাকে দেখে সে কেন এমন ভাবে বদলে যাচ্ছে? ইদানীং রেণুকে দেখলেই তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে যায়। কেন? এ কি রেণুকে হারাবার ভয়ে? ওই তো বসে আছে রেণু, এক শাশ্বত দৃশ্যের মতন বসে-থাকা, সে কোথায় হারাবে?

সিগারেটটা শেষ করে বাদল রেণুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। রেণু মুখ তুলল না। বাদল নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী বই পড়ছিস?

রেণু গম্ভীর ভাবে বলল, বইটা তোমার জন্য এনেছিলাম।

কী বই?

‘সাতটি তারার তিমির’। এ-বইটা দেখেছ আগে? তুমি জীবনানন্দ দাসের নাম শুনেছ?

বাদল অবহেলার সঙ্গে বলল, কবিতার বই? ধুৎ? আমার আর ও-সব পড়তে ভালো লাগে না।

এবার রেণু মুখ তুলে তাকাল। বাদলের মুখে সে খুঁজতে লাগল কী যেন।

বাদল বইটা ছুঁয়েও দেখল না, বলল, তুই কি বইটা কিনেছিস নাকি? হঠাৎ আমার জন্য পয়সা খরচ করতে গেলি কেন?

গতকাল আমার জন্মদিন ছিল। তাই তোমার জন্য একটা কিছু…

তোর জন্মদিন তো আমার জন্য উপহার কেনার কী মানে হয়? আমারই তো একটা কিছু…মানে, কাল তোর জন্মদিন ছিল আমাকে বলিসনি তো?

আমি বুঝি এ কথা সবাইকে বলে বলে বেড়াব?

গত বছর তোর জন্মদিনে আমরা কী করেছিলাম যেন?

ওকথা থাক। আগে তুমি এত কবিতার বই ভালোবাসতে, আর এখন আমার বইটা তুমি নিলে না কেন?

কী হবে কবিতা পড়ে! এসব কবিতা টবিতা তো বুর্জোয়াদের বিলাসিতা।

তুমি আজকাল বড্ড বোকা বোকা কথা বলো।

বাদল আরও কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। যত বার সে ভাবছে রেণুর সঙ্গে ঝগড়া করবে না তত বারই একটা কিছু ঝগড়ার প্রসঙ্গে এসে যাচ্ছে।

এবার সে বইটা তুলে নিল। দ্বিতীয় সাদা পৃষ্ঠাতে রেণু তার সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখেছে, বাদলকে–আমি। বাদল একটু হাসল। রেণু এই কায়দাটা তার থেকেই নিয়েছে। সে আগে যত বার রেণুকে বই উপহার দিয়েছে, কোনও বার নিজের নাম লেখেনি। সব। সময়ই লিখেছে, আমি।

বইটা উলটেপালটে বাদল বলল, অনেকেই বলে, এঁর কবিতা বুঝতে পারা যায় না।

আমিও বুঝতে পারি না সব। ভেবেছিলাম দুজনে একসঙ্গে পড়ব।

এই নির্জন বাড়িতে রেণুর সঙ্গে পাশাপাশি বসে কবিতা গ্রন্থ পাঠ–এই দৃশ্যটির মধ্যে যে রোমান্টিক আবেদন আছে, তা বাদলকে তৎক্ষণাৎ স্পর্শ করে। সে তো এই ধরনের ব্যাপারেই আনন্দ পায়, জীবনের অনেক বড় কৃতিত্বের চেয়ে এই রকম একটা ঘটনার মূল্য তার কাছে অনেক বেশি। তবু সে জোর করে এই দুর্বলতাটা সরিয়ে দেয় মন থেকে। একটু নির্লিপ্ত ভাবে বলে, কবিতা পড়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু বাস্তবটা বড় কঠিন। তোর সঙ্গে অনেক দরকারি কথা আছে।

রেণুর কাঁধ ছুঁয়ে সে বলল, চল, আমরা ওপরে গিয়ে বসি।

রেণু উঠে দাঁড়াল। তারপর টপ করে নিচু হয়ে প্রণাম করল বাদলকে। বিস্মিত বাদল বাধা দেবারও সময় পেল না। রেণু লজ্জারুণ মুখে বলল, কাল আমার জন্মদিনে তোমাকে প্রণাম করতে এসেছিলাম, তুমি বাড়িতেই ছিলে না।

বাদলের আবার শরীরটা কাঁপছে। রেণু তাকে চুম্বকের মতন টানছে। ইচ্ছে করছে রেণুকে জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। কবিতা পাঠের মতন এ-দুর্বলতাও সে দমন করল।

সে বলল, আগে আমিও জন্মদিনে গুরুজনদের প্রণাম করতাম। এখন সূর্যদার দেখাদেখি আর কারোকে প্রণাম করি না।

সূর্যদা এখন কোথায়?

কী জানি! এলাহাবাদ না গোয়ালিয়ার কোথায় যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাত্তাই পাওয়া যায় না।

দু’জনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল দোতলায়। শব্দহীন নির্জন বাড়ি। এ রকম নির্জনতার মধ্যে রেণুর বয়সি কোনও মেয়ে বাদলের বয়সি কোনও ছেলের সঙ্গে স্বাভাবিক থাকতে পারে না। অথচ রেণুর কাছে কিছুই যেন অস্বাভাবিক নয়। এই রকম ফাঁকা বাড়িতে বাদলের সঙ্গে দেখা করতে আসাকেও সে যেমন বিসদৃশ মনে করে না, আবার বাদল এই নির্জনতার সুযোগ নিতে চাইলে প্রথমেই ভৎর্সনা করেছে।

দোতলার সিঁড়ির পাশেই সূর্যর ঘর। আজকাল সব সময় তালা বন্ধ থাকে।

রেণু জিজ্ঞেস করল, মাসিমারা কোথায় গেছেন?

বাদল বলল বেলেঘাটায়। জানিস আজ আমি নিজে রান্না করেছি।

একটুও অবাক না হয়ে রেণু জিজ্ঞেস করলে, কী কী রাঁধলে?

রেণুর উৎসাহের অভাব দেখে বাদল একটু দমে গেল। বলল, ভাত, ডাল, বেগুনভাজা, মাছভাজা–

হাতটাত পোড়াওনি তো?

কিচ্ছু না। রান্না করা তো খুব সহজ।

ডাল আর মাছভাজা–এই দুটো পদ কল্পিত। কেন যে বাদল এই সামান্য মিথ্যে কথাটুকু বলতে গেল রেণুকে তার কোনও যুক্তি নেই। এই দুটো জিনিসের জন্য তার কৃতিত্ব কি বাড়ল খুব? তবু, এক এক সময় এ রকম ছোট্ট মিথ্যে কথা মুখে এসে যায়।

এই মিথ্যেটুকু বলবার জন্য বাদলের অনুতাপ হল। কিন্তু এখন আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। সে যদি এখন হঠাৎ আবার বলে না রে, আজ ডাল আর মাছভাজা খাইনি, মিথ্যে কথা বলেছিলুম, তা হলে কী রকম শোনাবে?

তার বদলে বাদল অকস্মাৎ থমকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, রেণু, তুই কার?

রেণু বলল, হঠাৎ একথা কেন?

না, আমি শুনতে চাই?

তোমার।

ঠিক?

ঠিক।

আমি যতই দোষ করি কিংবা অন্যায় করি, তোর সঙ্গে যদি আমার অনেক দিন দেখা নাও হয়, তবু তুই আমারই থাকবি তো?

তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো?

বাদল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোর সঙ্গে হয়তো আমার আর অনেক দিন দেখা হবে না।

তার মানে?

বলছি, একটু পরে বলছি।

বাদলের ঘরে এসে রেণু বসল বাদলের পড়ার টেবিলের চেয়ারে। বাদল তার কাছেই টেবিলের ওপরেই উঠে বসে বলল, তোকে ডেকে এনেছি এই জন্য যে, অনেক দিন এ রকম ভাবে বসে কথা বলা হয়নি। তা ছাড়া, আর হয়তো বহু দিন তোর সঙ্গে দেখা হবে, না। আমি চলে যাচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছ? চাকরি পেয়েছ কোথাও?

না। চাকরি আমাকে কে দেবে?

আমি জানি, তুমি চাকরির চেষ্টা করছ। সেই জন্যই এম এ পড়লে না।

পড়লুম না নয়। পড়া হল না। আমার একটা চাকরি এক্ষুনি পাওয়া দরকার। কিন্তু কোথাও কোনও চাকরি নেই। চারদিকে শুধু ছাটাই। যুদ্ধের সময় যে লাখ লাখ লোকের চাকরি হয়েছিল, এখন তাদের সব ছাঁটাই করা হচ্ছে। বিচ্ছিরি অবস্থা। সেদিন শুনলাম ইকনমিকসে এম. এ. পাশ এক ভদ্রলোক মাত্র তিরিশ টাকা মাইনের একটা চাকরি নিয়েছেন।

রেণু এসব ব্যাপার ভালো বোঝে না। সে চুপ করে রইল।

বাদল বলল, টিউশানি ফিউশানি করে কোনও রকমে চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ গত মাসে একদিন মনে হল, আমি হেরে যাচ্ছি। আমি কি এই রকম করে জীবন কাটাব নাকি? এই রকম সামান্য হয়ে থাকব? এ হতে পারে না। অনেক ভেবে একটা পথ খুঁজে পেয়েছি। আমার পক্ষে একমাত্র উপায় এখন বাইরে চলে যাওয়া। ওয়েস্ট জার্মানিতে এখন অনেক লোক নিচ্ছে। যুদ্ধের পর ওদের দেশে শক্ত সমর্থ পুরুষ তো খুব কমে গেছে, তাই গেলেই যে-কোনও চাকরি পাওয়া যায়। আমি আর্টস না পড়ে সায়েন্স যদি পড়তাম, অনেক সুবিধে হত–যাই হোক, আর কিছু না হোক, কুলিমজুরের কাজ অন্তত পাওয়া যাবেই একটা। তারপর আস্তে আস্তে…। আমার চেনাশোনা এ রকম তিন-চার জন গেছে। কোনও রকমে ভাড়ার টাকাটা জোগাড় করতে পারলেই হল–জার্মানিতে আমাদের ইন্ডিয়ানদের ভিসা লাগে না

মাসিমা যেতে দেবেন তোমাকে?

কিছুতেই না। এক ছেলে হওয়ার এই এক ঝামেলা। বিষ্ণু ওর মায়ের এক ছেলে– কিন্তু বিষ্ণু বিলেতে পড়তে গেছে সব ব্যবস্থা ট্যবস্থা করে বাড়ি থেকে নিয়মিত টাকা পাঠানো হয়। আমার মতন শূন্যে ঝাঁপিয়ে তো পড়েনি।

মাসিমা আপত্তি করলেও কী করে যাবে তুমি?

কিছু বলিনি এখন পর্যন্ত। সব ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাক, তারপর যতই আপত্তি করুক, আমি যাবই। আমার ইচ্ছে আছে জার্মানি থেকে একদিন রাশিয়া চলে যাওয়ার। রাশিয়া দেখতেই হবে আমাকে। রাশিয়া আমার স্বপ্নের দেশ–সেখানে সব মানুষ সমান, পৃথিবীর ইতিহাসে যা কখনও হয়নি।

রেণু নতমুখে জিজ্ঞেস করল, তুমি কত দিনের জন্য যাবে ভাবছ?

উৎসাহের ঝোঁকে বাদল বলল, চার বছর, পাঁচ বছর, ছ’ বছর—

এ রকম তো অনেকেই বিদেশে যায়। তারা সবাই কি জিতে যাওয়া মানুষ?

তা জানি না। এখানে আমি এ রকম ভাবে পড়ে থাকতে পারব না।

মাসিমা-মেলোমশাইকে দেখবার কেউ নেই। ওঁরা এত দিন তোমাকে ছেড়ে কী করে থাকবেন?

আমি যদি কালকেই হঠাৎ গাড়ি চাপা পড়ে মরে যাই, তা হলে কী হবে? সবকিছুই সহ্য হয়ে যায়। এত পিছুটান থাকলে জীবনে কিছু করা যায় না। তা ছাড়া, আমি তো টাকা পাঠাব।

রেণু বলল, আমরা একবার একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মনে আছে। সেই প্রথম স্বাধীনতার দিনে? তুমি আমাকে যা বলবে আমি শুনব। আমি যা বলব, তোমাকে শুনতে হবে। আমি যদি–

বাদল রেণুর কাধ চেপে ধরে ব্যাকুল ভাবে বলল, না, রেণু না, তুই কিছুতেই আপত্তি করতে পারবি না! প্লিজ…

.

একথার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই যে বাদল তার বাবা মায়ের ঘোর অমত সত্ত্বেও বিদেশে চলে যেতে পারে কিন্তু রেণু একবার না বললেই সে অসহায় হয়ে পড়বে। এখন তার কাছে রেণুর মতামতের দামই সবচেয়ে বেশি। জন্মের পর মায়ের নাড়ির সঙ্গে সন্তানের নাড়ির যে যোগ থাকে, তা কেটে ফেলা হয়। সন্তান যৌবনে পৌঁছেলে অদৃশ্য নাড়ির যোগটাও ছিন্ন হয়ে যায়।

সে তখন মা বাবাকে ধরে নেয় রোদ বৃষ্টি বা শীত–এই রকম কয়েকটি প্রাকৃতিক ঘটনার মতন–রক্তের তেজে যা সে যখন তখন অবজ্ঞা করতে পারে। সে জানে, তার রোদ্দুরে ঘোরাঘুরি, বৃষ্টিভেজা কিংবা শীতের মাঠেও বোতামখোলা শার্ট পরা মা বাবা পছন্দ করেন না–অথচ এইগুলোই তার ভালো লাগে। সুতরাং বাবা-মায়ের অন্য সব কথাও অগ্রহনীয়। যেমন, মাঝে মাঝেই তার ইচ্ছে করে আত্মহত্যা করতে, হঠাৎ এই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হবার মোহময় চিন্তা তাকে পেয়ে বসেসত্যি সত্যি আত্মহত্যা না করলেও এই চিন্তাটার যে সুখ, সে কথা কি বাবা কিংবা মাকে কখনও জানাতে পারবে?

রেণুর কথা আলাদা। রেণু কোনও প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। রেণুকে সে একটু একটু করে সৃষ্টি করছে–আবার তার বাইরেও রেণুর যে রহস্যময় অস্তিত্ব, তাকে আয়ত্ত করতেই হবে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। মৃত্যু কিংবা বেঁচে থাকার চেয়ে বাদল এখন এটাকে বড় মনে করে।

রেণু জিজ্ঞেস করল, তুমি বিদেশে যাবার ব্যাপারটা একেবারে ঠিক করে ফেলেছ?

বাদল বলল, হ্যাঁ।

রেণু বলল, আমাকেও নিয়ে চলো।

তুই সত্যি যাবি? যেতে পারবি?

কেন পারব না?

বাড়ির সবাইকে ছেড়ে থাকতে পারবি? তোদের বাড়িতে যে কেউ তোকে যেতে দেবে না–এ তো জানাই কথা।

যদি বি. এ.-টা পাস করে নিই, তারপর পড়তে যেতেও পারি। লন্ডনে ছোড়দার কাছে থাকব।

বি. এ. পাসের তো এখনও অনেক দেরি।

তুমি আর দু’বছর অপেক্ষা করতে পারবে না?

না। তা ছাড়া আমি লন্ডনে যাব না, আমি যাব জার্মানিতে। ওখানে এখন অনেক চাকরি।

জার্মানির তো এখন কিছুই নেই। সব ভেঙেচুরে গেছে।

সেই জন্যই তো অনেক কাজের লোক দরকার। রেণু, তোকে বেশ একটা ছেলে সাজিয়ে, প্যান্ট শার্ট পরিয়ে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে আমার সঙ্গে নিয়ে গেলে হত!

কেন, মেয়েদের বুঝি যেতে দেবে না?

জার্মানিতে এখন মেয়েই বেশি। ওরা এখন–

হঠাৎ থেমে গিয়েই বাদল প্রসঙ্গ বদলাল। বলল, এখনও জরুরি কথাটাই কিছু বলা হয়নি। আমি যে এতগুলো বছর থাকব না, তুই কি আমার জন্য অপেক্ষা করবি?

রেণু একটু অবাক হয়ে বলল, অপেক্ষা মানে?

তোদের বাড়ি যা কনজারভেটিভ, এই চার-পাঁচ বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই তোর বিয়ে দিয়ে দেবার চেষ্টা করবে। তা হলে কী হবে?

রেণু ভ্রূকূটি করে বলল, কী সব আজেবাজে কথা!

আজে বাজে নয়। এইটাই কাজের কথা। তোদের বাড়িতে তো সবারই খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায়।

জোর করে কারওর বিয়ে হয় না।

ছেলেদের হয় না, মেয়েদের হয়।

তুমি আজকে বড্ড ছেলে-ছেলে মেয়ে-মেয়ে হিসেবে কথা বলছ। জার্মানি যাবার চিন্তাতেই এ রকম হয়েছে বুঝি?

রেণু, আমরা আর ছেলেমানুষ নই। আমরা একটা ব্যাপার জোর করে অস্বীকার করার চেষ্টা করছি। তোকে আর আমাকে এ রকম ভাবে আর বেশি দিন মেলামেশা করতে দেওয়া হবে না। আমাদের বাড়ি থেকে না হলেও তোদের বাড়ি থেকে বাধা দেবেই।

রেণু এসব ব্যাপার সত্যিই যেন বোঝে না। তার সারল্য তার চরিত্রে একটা বিশুদ্ধ তেজ দিয়েছে। সে বলল মেলামেশা কে করতে দেবে না? আমাদের ইচ্ছে আমরা দেখা করব। আমি এবাড়িতে এলে মাসিমা কি আপত্তি করবেন?

কী জানি, করতেও পারেন একদিন। সবকিছুই তো দেখছি অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। একটা ছেলে ও মেয়ের সাধারণ ভাবে মেলামেশা করার ব্যাপারটা কেউ মেনে নিতে পারে না সহজ ভাবে। বিয়ে ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক নেই। আজ থেকে কুড়ি কি তিরিশ বছর বাদে হয়তো এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিংবা আমরা যদি অন্য কোনও দেশে জন্মাতাম–

রেণু বলল, আমার এই দেশই ভালো লাগে।

বাদল রেগে গিয়ে বলল, এটা একটা পচা-গলা দেশ। এদেশের কি হবে না। ভেবেছিলাম, স্বাধীনতার পর সবকিছু বদলে যাবে। দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে হতাশা–

জার্মানি যাচ্ছ তো, তাই এ-দেশ আর পছন্দ হচ্ছে না।

শুধু সে জন্য নয়। আমার মতন ছেলের কোনও সুযোগ আছে এখানে? বি. এ.-তে অনার্স পেয়েছি, তবু এম. এ. পড়তে পারলুম না। একটা কোনও চাকরি করা দরকার, কোনও চাকরি নেই। আমি যে-কোনও কাজ করতে চাই, কেউ কাজ দেবে না। দিন দিন। লক্ষ লক্ষ বেকার বাড়ছে তাদের কাজে লাগাবার কথা কেউ ভাবছে না। পণ্ডিত নেহরু এখন বিশ্বশান্তির ওপর বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন!

বাদল উত্তেজিত হয়ে গেছে দেখে রেণু চুপ করে বসে রইল। দর্শকের বা শ্রোতার, প্রতিক্রিয়া ঠিক মতন বোঝা না গেলে বক্তৃতা জমে না। বাদল একটু বাদেই তাই চুপ করে গেল।

বিক্ষুব্ধ ভাবে আবার বলল, বিয়ে করলেই যদি লোকে শান্তি পায়, তা হলে আমি তোকে বিয়ে করতেও রাজি। কিন্তু বিয়ে করার যোগ্যতাও নেই আমার। যার চাকরিবাকরি নেই, সে আবার বিয়ে করবে কী? সাধ করে কি আমি দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। দেখছি তো, কত অর্ডিনারি ছেলে দু’-এক বছর একটু বিলেতে ঘুরে গায়ে পালিশ লাগিয়ে আসছে, অমনি লোকে তাদের সম্পর্কে একেবারে গদগদ। আমিও জার্মানি থেকে এক গাদা টাকা নিয়ে ফিরব।

জার্মানিতে বুঝি টাকার ছড়াছড়ি যাচ্ছে?

যে খাটতে পারে, তার সুযোগ আছে। ওখান থেকে রাশিয়ায় যাব–যদি থাকতে দেয়, তা হলে রাশিয়াতেই থাকব। মাঝখানে একবার দেশে ফিরে তোকে নিয়ে যাব জোর করে। জোর করতেই হবে, কারণ এমনিতে তোর সঙ্গে আমার বিয়েতে রাজি হবে না কেউ। আমার মা যে তোকে এত ভালোবাসেন, আমার মা-ও আপত্তি করবেন। দেখিস! তোরা যে কায়স্থ।

রেণু খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, তুমি এমন ভাবে কায়স্থ কথাটা উচ্চারণ করলে, যেন এর চেয়ে নিচু জাত আর নেই!

বামুনরা তো অন্য কারোকেই গ্রাহ্য করে না। আমি যদি তোকে কেড়ে নিতে চাই, তবে অবশ্য আটকাবার সাধ্য কারওর নেই। দরকার হলে এ বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় থাকব। কিন্তু তার আগে একটা কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে হবে আমাকে।

রেণুর ঠোঁটে হাসির রেখা লেগে রয়েছে তখনও। সে বলল, সেই যোগ্যতা বুঝি শুধু জার্মানিতে গিয়েই অর্জন করা যায়। আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি একদিন খুব বড় লেখক হবে। সবাই তোমার নাম জানবে। তোমার লেখা পড়ে অনেকে কঁদবে। সেটাও কি একটা যোগ্যতা নয়?

বাদল একটু থতমত খেয়ে গেল। তারপর বলল, রেণু তুই আমাকে লেখার কথা আর বলিস না। ওটা আমার একটা দুর্বল জায়গা।

তুমি লেখা কেন ছেড়ে দিয়েছ, বলো তো? আজ তোমাকে বলতেই হবে?

আমি লিখতে জানি না। আমার তো ভালো লাগত!

তুই বললেই তো হবে না! আমি মানুষের সাম্যে বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাস নিয়ে পার্টির কাজও করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা সবাই আমাকে বলল, আমার লেখাগুলো প্রতিক্রিয়াশীল। তখন আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। আমি নিজে প্রতিক্রিয়াশীল নই, তা হলে আমার লেখা কী করে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যায়? আমি তা হলে কী লিখব? শুধু স্লোগান? আবার ওরা বলে, বিষ্ণু দে খুব প্রগতিশীল লেখক–অথচ তার কবিতা পড়ে আমি সব মানে বুঝতে পারি না। আমার মাথা গুলিয়ে যায় এসব ভাবতে গিয়ে। তার থেকে লেখা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

তুমি অন্যদের কথা শুনে লিখবে কেন? তোমার নিজের কোনও ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই?

আমার ইচ্ছে করে শুধু তোকে নিয়ে লিখতে। কিন্তু তুই তো শুধু একটা মেয়ে, তুই একটা জ্যান্ত প্রতিক্রিয়াশীল। পৃথিবীতে তার কোনও মূল্যই নেই এখন। পৃথিবীতে মানুষের এখন অনেক কাজ। শুধু আমিই কোনও কাজ খুঁজে পাচ্ছি না।

তা হলে একমাত্র জার্মানিতে যাওয়াই তোমার মুক্তির উপায়।

তাই তো দেখছি।

তা হলে ঘুরে এসো।

তুই আমার জন্য অপেক্ষা করবি তো?

তুমি ঠিক সময়ে ফিরে এসো।

তুই যদি এর মধ্যেই আমাকে হঠাৎ ডেকে পাঠাস, তা হলে আমি যে-কোনও উপায়েই তোক চলে আসব। অবশ্য যাওয়ার ব্যাপারে অনেক বাধা আছে এখনও। পাসপোর্ট দেবার আগে পুলিশের ভেরিফিকেশন লাগে। খুব কড়াকড়ি শুনেছি। আমি কিছুদিন পার্টির কাজ করেছি, সেই জন্য আমাকে নাও দিতে পারে। তারপর আছে ভাড়া জোগাড় করার চিন্তা। বাবা-মায়ের কাছ থেকে কিচ্ছু নেব না!

কত টাকা লাগবে?

জাহাজ ভাড়া চোদ্দোশো–সব মিলিয়ে হাজার দুয়েক জোগাড় করতেই হবে। সূর্যদা থাকলে ধার চেয়ে নিতাম। সূর্যদা তো বড়বাবুর সব টাকা ঠুকে দিচ্ছে।

দু’ হাজার টাকা জোগাড় করা খুব শক্ত বুঝি?

বাদল এবার হেসে বলল, তুই একদম ছেলেমানুষ রেণু। দু’হাজার টাকার দাম ঠিক দু’ হাজার টাকা। তোকে বললাম না, লোকে আজকাল তিরিশ-চল্লিশ টাকা মাইনের চাকরির জন্য হন্যে হয়ে যাচ্ছে! তা হলে দু’হাজার টাকা কত হয়?

রেণু বলল, আমারই তো পোস্ট অফিসে তিন হাজার টাকা আছে। বাবা রেখে গিয়েছিলেন আমার নামে। একটা সই করলেই তো সেই টাকা তোলা যায়।

বাদল গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, তুই আমার এই বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটা এখন কারোকে বলিস না। বিষ্ণুকেও কিছু লেখার দরকার নেই।

রেণু বলল, তোমাকে ওই টাকার জন্য আর কোথাও ঘোরাঘুরি করতে হবে না। টাকাটা আমি তুলে দেব পোস্ট অফিস থেকে। একদিন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেয়ো।

তোর টাকা আমি নেব না।

কেন?

ওকথা থাক। এখন অন্য কথা বল!

রেণু উঠে বাদলের সামনে এসে দাঁড়াল। ক্রুদ্ধ চোখে বলল, তুমি যদি আমার টাকা না নাও, তা হলে জীবনে আমি তোমার মুখ আর দেখব না।

বাদল বলল, রেণু, এ রকম ছেলেমানুষি করিস না। টাকা জোগাড় করার চেষ্টা আমি করব, খুব সম্ভবত পেয়েও যাব। তোর কাছ থেকে টাকা নিতে আমি পারি না।

রেণু বলল, কেন পারো না। সেটাই আমি জানতে চাই।

বাদল একটু অসহায় ভাবে হাত নাড়তে লাগল। ঠিক যুক্তিটা তার মনে আসছে না। তারপর বলল, এটা হয় না। এটা ঠিক মানায় না! আমি তোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে যাব, এটা কি সম্ভব?

রেণু বলল, আমার যদি টাকার খুব দরকার হত কখনও, আমি তো তোমার কাছেই চাইতাম। আর কার কাছে চাইব?

সেটা আলাদা ব্যাপার।

আমি এই আলাদা ব্যাপারটাই বুঝতে পারি না। আমার কাছে টাকা থাকলেও তুমি নেবে না, আর অন্য লোকজনের কাছ থেকে অনুগ্রহ চাইবে–এর মানে কী?

বাদল বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। অন্য কোথাও না পেলে তোর কাছ থেকেই নেব।

রেণু এতেও খুশি নয়। সে কঠিন মুখ করে বলল, না, ও-সব চলবে না। তুমি অন্য কারওর কাছে চাইতেই পারবে না।

তুই এত জোর করছিস কেন?

কারওর কাছে টাকা চাইবার পর সে যদি না দেয়, তা হলে অপমান লাগে না? আমি চাই না, কেউ তোমাকে সে রকম অপমান করুক।

তুই যেন আমাকে জার্মানিতে পাঠাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিস?

বাঃ, নিজেই তো এতক্ষণ ধরে বলছিলে এইসব কথা। বিদেশে না গেলে নাকি তোমার জয় হবে না!

যেতে আমাকে হবে ঠিকই। আমি যে চার-পাঁচ বছর বাইরে থাকব, তাতে তোর মনখারাপ লাগবে না তো?

রেণু ভুরু কুঁচকে বলল, না, মনখারাপ লাগবে কেন?

রেণু খুব চাপা মেয়ে, তার মনের ভাব বাদলও সব সময় বুঝতে পারে না।

বাদলের মনে হল, যেন তার বিদেশে যাওয়া সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এক্ষুনি সেই বিচ্ছেদের মুহূর্ত। আসলে তার যাওয়ার ব্যাপারে এখনও কিছুই ঠিক নেই। তবু, সে বিচ্ছেদের নাটকীয় মুহূর্তটিকে মনে মনে কল্পনা করে ফেলে।

মাদ্রাজ গিয়ে তাকে জাহাজ ধরতে হবে। সুতরাং ট্রেনে চেপে যাবে মাদ্রাজে। হাওড়া স্টেশনে কি রেণু যাবে তাকে বিদায় দিতে? বোধহয় পারবে না। তা হলে, রেণুর সঙ্গে বাদলের শেষ দেখা কোথায় হবে? রেণুর বাড়িতে তো বাদল আর যাবেনা কখনও। এই বাড়িতেই, নাকি কোনও পার্কে বা রেস্তোরাঁয়?

এই রকম ভাবতে ভাবতে বাদল রেণুর কাঁধে দু’হাত রাখল। আবেগ কম্পিত গলায় বলল, রেণু, তোর কথা সব সময় আমার মনে থাকবে। যদি প্রতি সপ্তাহে তোর চিঠি না পাই–

রেণু হেসে ফেলল। তারপর বলল, তুমি একটা পাগল!

মেয়েদের এইসব সময়কার হাসি ছেলেদের হতবুদ্ধি করে দেয়। বাদল ঘাবড়ে গেল। সে বুঝতে পারল, রেণুর সামনে সে পুরুষোচিত সপ্রতিভ হতে পারছে না।

তখন সে সবচেয়ে সহজ পুরুষোচিত কাজটি করে ফেলল। সে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল রেণুকে।

আশ্চর্যের ব্যাপার, রেণু এবার বাধা দিল না। বাদলের বুকে মুখ রেখে চুপি চুপি বলল, আমার কথা একদম চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। শুধু শুধু চিন্তা করে নিজের কাজ নষ্ট কোরো না!

এবারেও বাদল একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে ফেলল। সে বলল, রেণু, আমি তোকে ভালোবাসি। দারুণ ভালোবাসি।

রেণু খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে বলল, জানি।

তারপর সে আঙুল দিয়ে বাদলের বুকে দাগ কাটতে লাগল। হিজিবিজি, রেখা অথবা কোনও অক্ষর।

বাদল রেণুর ওই ‘জানি’ কথাটাই শুধু শুনল, আঙুলের রেখার ভাষা বুঝল না।

রেণুর এত শান্ত ব্যবহার ঠিক পছন্দ করতে পারল না সে। নিভৃত গোপন জীবনে একটু নাটকীয়তার দিকে তার ঝোঁক।

সে আবার হঠাৎ কাঁপানো গলায় বলল, রেণু, তোর কাছে একটা জিনিস চাইব, দিবি?

কী বলো?

না বলতে পারবি না কিন্তু?

আচ্ছা দেব। কী?

আমাকে একটু আদর করতে দিবি! আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে। আমি এটাকে স্মৃতি হিসেবে নিয়ে যাব।

রেণু এবার রীতিমতন কাবু হয়ে পড়ল। এতক্ষণ সে কথায়বার্তায় বাদলকে মাথা তুলতে দেয়নি। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে সে অসহায়। আগে থেকেই হ্যাঁ বলে ফেলেছে।

খুব অস্ফুট গলায় বলল, এসব কি ভালো?

এতে কিছু দোষ নেই। তুই তো আমারই।

তবু আমার মনে হয়, সবাইকে লুকিয়ে চুরিয়ে এটা যেন একটা পাপ।

বাদলের গলায় এবার দৃঢ়তা এসেছে। সে জোর দিয়ে বলল, না, পাপ নয়।

রেণু মুখ না তুলেই বলল, আচ্ছা, একবার।

বাদল আঙুল দিয়ে রেণুর থুতনিটা উঁচু করে তুলে ধরল। চোখে রাখল চোখ। দেখল ঝরনার জলের মতন স্বচ্ছ মুখোনি, খুব যত্নের সঙ্গে সে চুমু খেল রেণুকে। জোরজারি। বা ছটফটানি নেই, খুব শান্ত ভাব। শারীরিক বাসনা নয়, সে যেন শিল্প সম্ভোগ করছে। তার নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। রেণু লজ্জায় বাদলের দিকে তাকাতে পারছে না, ফিরিয়ে নিল মুখ।

বাদল উৎসুক ভাবে জিজ্ঞেস করল, তোর ভালো লাগেনি?

রেণু মুখ অন্য দিকে রেখেই বলল, জানি না।

বাদল দু’হাতে রেণুর মুখখানা নিজের দিকে নিয়ে এল আবার। রেণুর ঠোঁটের ওপর রাখল নিজের একটা আঙুল।

রেণু বলল, আর নয়।

বাদল হুকুমের সুরে বলল, আর একবার।

তুমি কথা রাখছ না। দেখো বৃষ্টি এসে গেছে। জানলা দিয়ে জল আসছে।

আসুক!

বাদল আবার তার ঠোঁট রাখল রেণুর ঠোঁটে। রেণু চুম্বনের মর্ম বোঝে না। সে শুধু দেখছে বাদলের চোখ, যা এখন অসম্ভব জ্বলজ্বলে। বাদল রেণুর নীচের ঠোঁট, যাকে অধর বলে, নিয়ে নিল নিজের মুখের মধ্যে এবং সে অনুভব করল, রেণু সত্যিই আমার।

এবার মুখ সরিয়ে নিয়ে রেণু বলল, আমার গায়ের মধ্যে যেন কী রকম করছে। আমার সত্যিই দুর্বল লাগছে শরীরটা।

বাদল অভিজ্ঞের মতন বলল, ও কিছু না। ও রকম হয়।

রেণু বলল, ভীষণ জোরে বৃষ্টি আসছে। কী করে বাড়ি যাব?

একটু পরেই থেমে যাবে।

বাইরে শোনা যায় ঝড়ের শনশন আওয়াজ। জানলার পাল্লাটা ঠকাস ঠাস শব্দে দেওয়ালে আছড়ে পড়ছে। রেণুর গলা জড়িয়ে ধরে তাকে সঙ্গে নিয়েই বাদল চলে এল। জানলার কাছে। দু’জনেই চোখ রাখল বাইরের ক্রুদ্ধ বন্য ঝড়-বৃষ্টির দিকে।

রেণু বলল, আমি তোমার কথা যখন ভাবি, এইসব কথা কিন্তু কখনও ভাবি না।

এইসব ছাড়াও কি আমরা খুব কাছাকাছি থাকতে পারি না?

বাদল বলল, আমি ওসব জানি না। তুই সুন্দর, তাই আমি তোকে ছুঁয়ে থাকতে চাই। কলেজে পড়ার সময় আমার বন্ধুরা মেয়েদের সম্পর্কে কত রকম কথা বলত। আমার শুধু মনে পড়ত তোর কথা।

রেণু বাদলের বুকে আঙুল দিয়ে আবার কিছু আঁকিবুকি বা লিখতে লাগল।

বাদল বলল, রেণু, তোর গালে আমি একটা দাগ করে দেব?

রেণু লজ্জিত ভাবে বলল, অন্যরা দেখে যখন জিজ্ঞেস করবে, কী বলব?

বলবি কোনও পোকায় কামড়ে দিয়েছে।

তুমি বুঝি পোকা?

আচ্ছা, এমন জায়গায় দাগ করে দিচ্ছি, কেউ দেখতে পাবে না।

রেণু কিছু বলছে না। বাধা দিচ্ছে না, দেখছে বাদলকে। বাদল রেণুর ডান হাতে, কাঁধের কাছটায় ব্লাউজটা সরিয়ে দাঁত দিয়ে আলতো ভাবে কামড়ে ধরল। বাদলের চুলসুষ্ঠু মাথাটা রেণুর গালের কাছে। রেণু অন্য হাতটা রাখল বাদলের চুলে। মনে মনে সে-ও ভাবল, এই মানুষটা আমার।

এই উপলব্ধি তার শরীরে একটা শিহরন এনে দেয়। মনে হয়, এই পৃথিবীটা এই মুহূর্তে শুধু ওদের দু’জনের জন্য। আর কেউ নেই কোথাও। পৃথিবীর বুকে যেন একটা কাটা ফুটে ছিল, এইমাত্র সেই কাঁটাটা কেউ তুলে নিল।

রেণু নিজেই বাদলের মাথাটা টেনে এনে চেপে ধরল নিজের বুকে। খুব জোরে। তারপরেই সরিয়ে দিল।

বাদল কোনও দিন রেণুর হাতের আদর পায়নি। কাঙালের মতন চোখ করে তাকাল। তারপর বলল, আমি অনেকক্ষণ তোর বুকে মাথা রাখতে চাই।

রেণু সরে গিয়ে ব্লাউজের হাতাটা টেনে ঠিক করল। তারপর বলল, না, আর কোনও দিন এ রকম কোরো না।

কেন?

আমাদের পবিত্র থাকতে হবে।

আজকেই নিজেকে সবচেয়ে বেশি পবিত্র মনে হচ্ছে আমার।

যে-দিন আমারও সেই রকম মনে হবে, সেই দিন আবার, কেমন!

বাদল আর কিছু বলতে সাহস পেল না। বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রেণুকে। বাদল জিজ্ঞেস করল, জানলা বন্ধ করে দেব?

না থাক। বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগছে।

বাদল সিগারেট ধরিয়ে রেণুর পাশে দাঁড়িয়ে রইল। জলের ঝাঁপটায় দু’জনেরই জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে, তবু খেয়াল নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *