৭০
যেদিন রুষারা ফিরে এল এ বাড়িতে সেদিনই বিকেলে খান্ডেলওয়াল সাহেবের ধবধবে সাদা অ্যালশেসিয়ান কুকুরটা, কুচকুচে কালো আয়াটির সঙ্গে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ফিরে আসবার সময় পথের উপরেই ট্রাক চাপা পড়ে মারা গেল।
মেটে-লাল কুকুরীটার এবং আয়ার কিছুই হয়নি।
খাণ্ডেলওয়াল সাহেব কুকুরটাকে একটি বড় ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে কবর দিয়ে সাত দিনের মধ্যেই একটি কালো মদ্দা কুকুর নিয়ে এসেছেন, কুকুরীটার জোড়া হিসেবে। নতুন কুকুরটা দেখতে জংলী; হিংস্র। ঘাড়ের কাছে কেশরের মতো আছে। প্রথম দুদিন কুকুরীটা একটু ভয়ে একটু অপরিচয়ে, নবাগন্তুককে ঘাউ-ঘাউ করেছিল। দেখিয়েছিল, একটু ঢং-ঢংও। এখন দিব্যি প্রেম হয়ে গেছে। এ ওর গা শুঁকছে, জিভ দিয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চাটছে একে অন্যের। এক জাতের কুকুররা সবাইই একই রকম, মানুষদের মতো আলাদা আলাদা নয়। ওই কুকুরীটা কত সহজেই পুরনো সঙ্গীকে ভুলতে পেরেছে। এবং নতুন করে নতুন সাথীকে নিয়ে অবলীলায় সুখীও হতে পেরেছে।
রুষা ভাবছিল, রুষাও কি ওই মেটে লাল কুকুরটরই মতো হয়ে উঠছে? অথবা উঠেছিল? কিংবা কোনওদিন হয়ে উঠবে?
মানুষ হওয়া কুকুর হওয়ার চেয়ে অনেকই কঠিন। এবং কষ্টেরও। কোনও মানুষীই কুকুরী হতে পারে না, মনুষ্যত্ব থেকেই যায় ছাই-ছাপা আগুনের মতো।
ভুচুর চোখের চাউনি, পৃথু এখান থেকে চলে যাবার পর, যেদিন থেকে ভুচুর সঙ্গে বাধ্য হয়েই যোগাযোগ করেছিল ও, সেদিন থেকেই রুষাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে। পুরুষের মুগ্ধ চোখ তার দিকে কৈশোরের প্রথম দিন থেকেই ছিল। তাতে কোনও নতুনত্ব নেই। কোনও পুরুষের চোখে স্তুতি ছিল, কারও চোখে নির্ভেজাল কাম। কারও চোখে শুধুই মুগ্ধতা, নিছকই সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত গা-সিরসির ভাললাগা। সামান্য দু’ একজনের চোখেই এমন ঝড়ের আভাস থাকে। সেই দৃষ্টিকে এড়িয়ে যাওয়া, কোনও মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। সেই চোখে চোখ রাখলেও বুকের মধ্যে সেই ঝড়কেই আঁধি করে তোলা হয়। ঝড়কে আবাহন সব পাখিই করতে পারে, কিন্তু ঝড়ের পরে ডানা ভেঙে, বিচিত্রবর্ণ, নেতানো ঝরাপাতার সঙ্গে ভূলুণ্ঠিত হয়ে থাকবার মত মানসিক প্রস্তুতি থাকে খুব কম পাখিরই! ভারী ভয় করছে রুষার তাই কদিন ধরেই। ও যে ঘর-পোড়া। এ কথাও ও এতদিনে জেনেছে যে, ওর মধ্যে ডাইনিসুলভ কোনও ব্যাপারও আছে। পুরুষমাত্রই এমন অসহায় হয়ে পড়ে ওর সামনে এসেই যে তা বলার নয়। অবশ্য মজা লাগত খুবই, যখন বয়স কম ছিল। মজা এখনও লাগে। তবে এই মজা অবিমিশ্র সুখের নয় যে, তাও জেনেছে এতদিনে। এই মজাই তাকে মজিয়ে ইদুরকারের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল। এই মজার দামও দিতে হল অনেকই।
প্রত্যেক পাপের মধ্যেই বোধহয় ফুলের মধ্যের কাঁটার মতোই প্রাপ্য শাস্তি সুপ্ত থাকেই, একদিন তার হুল ফোটাবে বলে। কবে যে ফোটাবে, তা আগে থেকে জানা যায় না, ওইই যা। কিন্তু কী পাপ? পা কি? রুষা, পা তো করেনি কোনও। মিলির দিকে হাত বাড়িয়ে পাপ করেছিল ইদুরকারই। রুষার মনে কোনওই পাপবোধ নেই। সে যা করেছে, তার জন্যে পৃথুই দায়ী। পৃথুর ঔদাসীন্য, আশ্চর্য অমানুষিক শৈত্যই ধীরে ধীরে তাকে ঠেলে দিয়েছিল ইদুরকারের দিকে। রুষার বিবেক জানে, রুষার কোনও দোষ ছিল না। না ইদুরকারের দিকে দৌড়ে যেতে; না ফিরে আসতে।
হাটচান্দ্রার থানার দারোগা এসেছিলেন। তাকে এবং মিলিকে জিজ্ঞাসাবাদও করে গেছেন অনেকক্ষণ ধরে। সারপ্রাইজিংলি কাম অ্যান্ড আনরাফলড্ ছিল কিন্তু মিলি। ডিটেইলস-এই ও বলেছে যে, কী করে ভুচুরা ওকে উদ্ধার করেছে। অথচ এ কথা চেপে গেছে যে, ভিনোদ তাকে ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল এবং প্রায় রান-ওভারই করেছিল। মিলি বলেছে যে, গিরিশদার গাড়ি তাকে উদ্ধার করেই ফিরে এসেছিল। ভুচুদের জীপকে ও দেখেনি সঙ্গে আসতে।
ইদুরকারের নিরুদ্দেশ হওয়াটা যে স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, এই সন্দেহটা; রুষার এবং হয়তো দারোগারও; তা থেকেই হয়েছে।
ভিনোদ কোনও উইল করে যায়নি? কোনও উইল কি রুষার কাছে আছে?
দারোগা জিগ্যেস করেছিলেন।
সম্পত্তি সব কি আপনিই পাবেন?
রুষা হেসেছিল। দারোগাকে বলেছিল, আপনি কতটুকু জানেন আমার সম্বন্ধে? আমি কি ওর সম্পত্তি সব হাতিয়ে নেওয়ার জন্যেই ইদুরকারের কাছে গিয়েছিলাম বলে ধারণা আপনার?
জী না। বলে, দারোগা অনেকক্ষণ মুখ হাঁ করে বসেছিলেন।
রুষার মনে হচ্ছিল, কোনও মাছি ঢুকে যেতে পারে মুখে অতক্ষণ হাঁ করে থাকলে। এই মিডলক্লাস মেন্টালিটির লোকগুলোকে নিয়ে পারা যায় না!
দারোগা বললেন যে, ইদুরকারের বাবার ওখানে যোগাযোগ করে জানা গেছে যে, সে সেখানেও যায়নি। পুলিশ থেকে মার্সিডিজ গাড়ির নাম্বার দিয়ে সব জায়গায় ওয়্যারলেস করা হয়েছে। গাড়িটা খুঁজে বের করার খুবই চেষ্টা করছেন ওঁরা। ওই গাড়ি তো লুকিয়ে রাখার নয়! মালিককে লুকোলেও লুকোনো যেতে পারে।
দারোগা বলেছিলেন।
ওরা কী যে করেছে। ভিনোদকে কে জানে? পৃথুই কি বলে দিয়েছিল ওকে শেষ করে দিতে? নাকি এ ভুচুরই কাজ? হতে পারে ভুচু নিজেও করে থাকতে পারে। অন হিজ ওওন ইনিসিয়েটিভ। ওর চোখে যা দেখে রুষা ইদানীং তাতে কিছুই অসম্ভব নয়। যে আগুনের ঝড়ের সংকেত পায় ও ভুচুর চোখে, সেই আগুন নেবাভার জন্যে, পৃথুকেও খতম করে দিতে পারে ভুচু। এই রকম মানসিক অবস্থায় একজন পুরুষ সবই পারে। কে জানে, ভুচু কখন বদলে গেল এমন করে? এতদিন তো পৃথুরই ছায়া ছিল সে।
শুধু রুষারই নয়, প্রত্যেক সুন্দরী নারীর মধ্যেই কোনও ডাইনি বাস করে নিশ্চয়ই। সে যে কখন কোন পুরুষের মনোজগতে কী ঘটনা ঘটায় তা আগের মুহূর্তেও বোঝা যায় না। সেই নারী নিজেও বোঝে না।
ভুচু বলছিল, পৃথু আসবে এ সপ্তাহেরই কোনওদিন। ও যা নরম মনের মানুষ। রুষার বুকে মুখ রেখে হয়তো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। দূরে ছিল, তাইই সহজে ভুলে ছিল, কাছে এলেই, পৃথু হয়তো ভেঙেই পড়বে হাঁটু গেড়ে। রুষা জানে রুষাকে চিরদিনই এক ধরনের ভয়ই পেয়ে এসেছে পৃথু। ঠিক ভয় হয়তো নয়, ভালবাসারই, অথবা শান্তিপ্রিয়তারই এক ধরনের প্রকাশ। রুষা যদি ওকে আবারও এক সঙ্গে থাকতে বলে, তবে পৃথু যে খুশি হয়েই থাকবে তাতে রুষার নিজের বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই। কুর্চির কাছে পৃথু হয়তো যেতে পারে, গেছেও হয়তো; যেমন প্রস্টিট্যুট বিজলীর কাছেও গেছিল এক সময়, কিন্তু সেই যাওয়া শুধুই শরীরের জন্যে। মদ্দা কুকুর যেমন করে অল্প-চেনা মাদি কুকুরীর কাছে যায়, অনেকটা তেমনই। কিন্তু রুষার তো কোনওই বিকল্প নেই, থাকতে পারে না, কোনও পুরুষেরই কাছে। সে কথা রুষা ভাল করেই জানে। সে যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী!
ভিননাদের সঙ্গে কী করে যে ব্যাপারটা ঘটে গেছিল। সিলী! খুবই ভাল অভিনেতা ছিল ভিনোদটা! নইলে, পুরুষের আবার মন! শরীর ছাড়া কি কিছু আছে ওদের? তাই-ই, শেল্যাক কোম্পানীর নন-রেসিডেন্ট ডিরেকটর, হ্যান্ডসাম, পাইপ-স্মোকিং—ইংলিশম্যান, মাইকেল হাও ক্লাবের টেম্পোরারী মেম্বার, নাগপুর থেকে আসা মিঃ ঘোড়পাড়ে, বিষেণ নারাং অথবা মিঃ এম চ্যাটার্জী এই সব মানুষের সঙ্গে রুষার ফীজিক্যাল অ্যাফেয়ারের মধ্যে আর ভিনোদের সঙ্গে সম্পর্কর মধ্যে একটু তফাৎ ছিল। ওগুলো শুধুমাত্র একইবারের সম্পর্ক। এবং পিওরলি ফীজিক্যাল ছিল। আর ভিনোদেরটা পৌনঃপুনিক। একটু একটু মন মিশোনো। ভিনোদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা সকলেই জেনে গেছিল। কিন্তু অন্য সম্পর্কগুলো সম্বন্ধে সেই সব দূরে-যাওয়া পুরুষরা আর রুষা নিজে ছাড়া একজনও ঘুণাক্ষুরেও কিছু জানে না আজ অবধি। বুদ্ধিমতী নারীমাত্রই যাযাবরের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্ক করতে ভালবাসে। শিকড়, স্থায়ী ঠিকানা মানেই বিপদ।
অনেক পুরুষই যে তাকে চায় একথা জেনে খুবই ভাল লাগত রুষার। এদেশের মেয়েদের এখনও তো এছাড়া অন্য অ্যাডভেঞ্চার কিছু নেইও। বৈচিত্র্যর এবং অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজই তাই ও তেমন তেমন এক্সট্রা-অর্ডিনারী পুরুষদের অঙ্কশায়িণী হয়েছিল। ওয়েল্। ইট ওজ্ গ্রেট ফান্। রিয়্যালী। ভ্যারাইটি ইজ দ্যা স্পাইসেস অফ্ লাইফ্! একজন নারী যখন চিতার অথবা কবরের সামনে শায়িত থাকেন তখন তাঁর সুগন্ধি শীতল, সুসজ্জিত, ফুলে-ঢাকা নিথর শরীরের মধ্যে অনেকই রহস্য, অনেকই গোপন কথাও বুঝি স্তব্ধ হয়ে থাকে আগুনে জ্বলে যাবার বা ঠাণ্ডা নরম মাটির গভীরের শৈত্যে জমে থাকার অপেক্ষায়। নারীর জীবনের রহস্য সেইই একা জানে। সেই সব গোপন কথাগুলিই বোধ হয় নদীপারের নির্জন শ্মশানভূমির তীব্র গন্ধ ধুলিকণা হয়ে উধাও গ্রীষ্মবাতাসে উড়ে বেড়ায় অথবা ছোট ছোট লাল হলুদ গোল গোল ঘাসফুল হয়ে ফুটে ওঠে গোরস্থানে, পরের বসন্তর শুরুতে, কবরের সামনে। সেই উধাও হাওয়া আর ঘাসফুলের মানে কেইই বা খোঁজে?
মেরী বলল, ব্রেকফাস্ট লাগিয়ে দিয়েছি মেমসাহেব।
মিলি কী করছে?
মিলিও এসেছে টেবলে।
খাচ্ছে?
হাঁ।
কেমন বুঝছ মেরী?
আগের থেকে ভাল। অনেকই ভাল। মেমসাহেব।
ওষুধগুলো দিচ্ছ তো? সময়মতো?
হ্যাঁ।
ডাক্তার এসে মিলিকে সেডেটিভসও দিয়ে গেছেন। শক্ড ও ডেজড্ হয়ে আছে এখনও রুষা এ কথা জেনে যে, রুষার সঙ্গে একটা রাইভাল্রী গড়ে তুলেছিল মিলি। ওর নিজেরই মেয়ে। মানুষের মনের মধ্যে কখন যে কী হয়। মিলিকে ও জন্মই দিয়েছিল মাত্র। ও তো আলাদা একজন ব্যক্তি। তার চাওয়া পাওয়ার উপরে রুষার ইনফ্লুয়েন্স কতটুকু? কোনও ইনফ্লুয়েন্স থাকা উচিতও নয় হয়তো আদৌ।
ডাক্তার অবশ্য বলছেন, শী হ্যাজ টু স্লীপ ইট্ অফফ্। ওটা চলে যাবে। চিন্তার কিছু নেই। তবে বেশিদিন সেডেটিভস্ কন্টিন্যু করতে চান না উনি। রুষাও চায় না। কারণ এই বয়সের ছেলে-মেয়েরাই হঠাৎ ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে পড়ে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি। বড় সাংঘাতিক বয়স এটা। অবশ্য সব বয়সই সাংঘাতিক। মন একবার গড়ন পেয়ে গেলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই সাংঘাতিক বিপজ্জনক। পরীক্ষার পর পরীক্ষা। প্রতিটি মুহূর্ত।
ব্রেকফাস্ট শেষ হয়েছে রুষার তবে, কফি তখনও শেষ হয়নি, ঠিক এমন সময় বাইরে জীপের আওয়াজ শোনা গেল। এঞ্জিন বন্ধ করার আওয়াজও। তারপরই বেল বাজল দরজার। মিলি ব্রেকফাস্ট সেরে উঠে গিয়েছিল। এখনও সবসময় একটা ঘুম ঘুম ভাব রয়েছে ওর। যেন ঘোরের মধ্যেই চলে ফেরে। আগে থেকে অনেকখানিই রিকভার করেছে অবশ্য! আশা করা যায় দু’ একদিনের মধ্যেই নর্ম্যাল হয়ে যাবে। মাকে, “মা” বলেই জানবে; আবারও নির্ভর করবে তারই ওপর সব ব্যাপারে।
মেরী, বেলের আওয়াজ শুনেই তাকাল রুষার মুখে। তারপর এগিয়ে গেল দরজা খুলতে।
রুষা বলল, মেরী। তুমি নিজের কাজ করো। অনেক কাজ পড়ে আছে। আমিই খুলছি। মেরী তাকাল একবার রুষার চোখে। ভুচুর সঙ্গে মেমসাহেবের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতাটা চোখ এড়ায়নি ওর। অদ্ভুত ম্যানিয়াক এই মহিলা! একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল মেরী!
দরজা খুলেই রুষা দেখল, আজ খুবই সেজেছে ভুচু। লাল আর কালো স্ট্রাইপড্ সিল্কের ফুল-স্লিভস শার্ট পরেছে একটা। নীচে, সাদা কর্ডুরয়ের ওয়েল-প্রেসড ট্রাউজার। পায়ে চকচকে ব্রাউন মোকাসিন।
রুষাকে বলল, ভুচু, গুড মর্নিং।
রুষা ওর মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, মর্নিং। ভেরী গুড মর্নিং ইনডিড। আরে! তোমাকে যে চেনাই যাচ্ছে না ভুচু! হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!
কাকেরও তো কখনও ময়ূর হতে ইচ্ছা হয়।
ভুচু বলল, মুখ নিচু করে, হাসবার চেষ্টা করে।
তা যায়। তবে যে-কাক ময়ূরপুচ্ছ পরে ছিল তার অবস্থা কী হয়েছিল তা জানো তো?
জানি।
বলে, ভুচুও হাসল।
সত্যিই চমৎকার সকালটা আজকের! কিন্তু কোথায় চললে এখন এত সেজেগুজে? জানতে ইচ্ছে করছে। পামেলার কাছে কি?
লজ্জা পেল ভুচু। বলতে চাইল যে, এখানে আসবে বলেই তো এত সাজুগুজু করেছিল। কিন্তু মুখে বলল, আজ যে রবিবার! ভাবছি, চার্চ-এ যাব। অনেকই দিন যাইনি। যাবেন আপনি? আমার সঙ্গে?
রুষার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। ওর সৌন্দর্যর ছটায় অন্ধ হয়ে গিয়ে বাঘা-বাঘা পুরুষেরা যখন টোকা-খাওয়া টাকা-কেন্নোর মতো কুঁকড়ে যায় ওর সামনে তখন খুবই মজা লাগে ওর। ভালও লাগে অবশ্য। এইসবই তো বেঁচে থাকার পার্কুইজিটস, প্রত্যেক সুন্দরীর। চোখ তুলে একটুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করল রুষা ভুচুকে। শরীরটি কিন্তু বেশ! ইস্পাতের মতো। টানটান মজবুত; উজ্জ্বল। বয়সে, ভুচু রুষার চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই হবে। কালো হলেও গায়ের চামড়াটি ভারী সুন্দর, কাল-কেউটের মতো জীবনীশক্তিতে একেবারে ফোঁস ফোঁস করছ বিপদের ভয় থাকলেও সব বেদেনিরই এমন সাপ নিয়ে খেলা করতে ইচ্ছে করেই।
সত্যিই মজা লাগে রুষার। একটি তরুণ, অনভিজ্ঞ শিঙাল হরিণ জালে পড়েছে। অভিজ্ঞর সঙ্গে খেলায় এক ধরনের মজা, আর অনভিজ্ঞর সঙ্গে অন্য ধরনের। এখন তাকে মারবে, না বাঁচাবে: মারলে কী ভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় মারবে তাই নিয়ে…।
কিন্তু মোটর মিস্ত্রি? আনথিংকেবল। শী ওজ ওনলী টয়িং উইথ দ্যা আইডিয়া…। পুরুষগুলোর এই ছটফটানি দেখতেই বেশি ভাল লাগে ওর। সঙ্গমের চেয়ে যেমন শৃঙ্গারের সুখই বেশি মধুর, বধ করার আগের এই উত্তেজিত ভয়ার্ত বধ্য পুরুষের কাণ্ডজ্ঞানহীন ছটফটানির মজাটাও মেয়েদের কাছে অনেকই বেশি উপভোগ্য।
রুষা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, আমি কেন চার্চ-এ যাব? আমি তো ক্রীশ্চান নই!
তারপর গলা নামিয়ে ভুচুর চোখে চোখ রেখে বলল, তাছাড়া, আমার তো কনফেশান করারও কিছুই নেই। আই অ্যাম ক্লীন।
ভুচু বুঝল, ইদুরকারের নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার কথাই বলছে রুষা। পরোক্ষে বলছে, খুনীরাই তো চার্চ-এ যায় কনফেশান করতে; কনফেশানালের কাছে।
ভুচু জোর করে হাসল।
বলল, কনফেশান করার কিছু আমারও নেই। যদি থাকত, তবে হয়তো আপনাকেই কনফেশানাল করতাম। তার জন্যে চার্চ-এ যাবার দরকার ছিল না। চার্চ তো আর মসজিদ নয়। আমাদের ধর্মও আপনাদেরই মতো। সকলেরই অবারিত দ্বার সেখানে।
জানি না। আমি কোনও ধর্মই মানি না। স্বধর্মই আমার ধর্ম। আমার শরীর আর মনের ধর্মই সব কিছু আমার কাছে।
রুষা বলল।
ভুচুর মনে হল, একটু বিদ্রূপেরই সঙ্গে।
বলেই, বলল, কফি খাবে? ভুচু?
না।
পৃথুর কোনও খবর জানো? আসবে কবে?
না। যা আগে জানতাম, তাই-ই। তারিখ জানায়নি। লিখেছিল— যে-কোনওদিনই চলে আসবে সামনের সপ্তাহে।
ও। এ সপ্তাহে নয়? তাহলে?
না।
কিসে আসবে?
তাও লেখেনি। হয়তো দিসাওয়াল সাহেবের জীপেই আসবে। জানি না।
আগে থেকে না জানলে ডিনার বা লাঞ্চ বানিয়ে রাখব কী করে? আমার এখানে তো আর এখন লোকজন, বাবুর্চি বেয়ারা নেই।
ভুচু ভাবল, বলে, সে সবই তো একদিন ছিল।
যা বলবে ভেবেছিল, তা না বলে বলল, পৃথুদার সব কিছুতেই অভ্যেস আছে। মানে, মানিয়ে নিতে পারে। খেতে ভালবাসে বটে, তবে এটা না হলে চলবে না ওটা না হলে চলবে না এসব তার একেবারেই নেই।
তা ঠিক। বিদ্রূপের গলায় রুষা বলল, তোমার দাদার সঙ্গে ছাগলের অনেকই মিল আছে। কথায় বলে না, ছাগলে কী না খায়! পৃথু যেমন সহজেই যে-কোনও জায়গায় যেতে পারে, তেমনই সহজে সমস্ত অখাদ্য-কুখাদ্যও খেতে পারে।
ভুচু, এই “যেতে-পারব” মানেটা বুঝল। রুষা বৌদি, বিজ্লী আর কুর্চির কথাই মীন করছেন।
এক গ্লাস জল খাব বৌদি।
বৌদি নই আমি। আমি রুষা।
হ্যাঁ। রুষা!
এই ‘রুষা’ নামটি উচ্চারণ করতেও ভুচুর সমস্ত শরীরে যেন শিহর ওঠে।
রুষা ভিতরে চলে গেল। চলে-যাওয়া রুষার দিকে চেয়ে ভুচুর পা কাঁপতে লাগল, অবশ লাগতে লাগল সারা শরীর। কখনও হয়নি এমন আগে। বসে পড়ল ডানপিটে ভুচু রণক্লান্ত যোদ্ধার মতো নিজেরই রক্ত যখন নিজের সঙ্গে লড়াই করতে থাকে তখন বোধ হয় এমনই হয়! না-হেরে গিয়ে কোনও উপায়ই থাকে না আর।
একটু পরেই মেরী ট্রের উপরে লেস-এর ঢাকনা বসিয়ে হিরের মতো ঝকঝকে কাঁচের গ্লাসে করে জল নিয়ে এল রুষার পেছন পেছন। জল খেতে খেতে রুষাকেই দেখছিল ভুচু গ্লাসের মধ্যে দিয়ে, দু’চোখ ভরে। জলের মধ্যে দিয়ে দেখায় তার মুখটিকে অনেকই বড় দেখাচ্ছিল। ছাই-রঙা সিল্কের শাড়ি পরেছে রুষা। সঙ্গে ছাই-রঙা সিল্কেরই ব্লাউজ। এইই কি মধ্যপ্রদেশের সেই বিখ্যাত হোসসা-সিল্ক? কে জানে? ভুচুর জীবনে সিল্কের কোনও ভূমিকাই ছিল না। তার জীবনের পথ প্রথম দিন থেকেই বড়ই অমসৃণ, রুক্ষ, এবড়ো-খেবড়ো। অথচ সেইই ভুচুই এখন সিল্ক সম্বন্ধে হঠাৎ কৌতুহলী হয়ে উঠেছে। এক দৃষ্টে চেয়ে ছিল ও রুষার দিকে।
রুষাও তাকিয়েছিল ভুচুর দিকে এক দৃষ্টে।
আর কোনও দরকার? আমাকে দিয়ে? বলবেন।
বোকার মতো বলল ভুচু।
এই মুহূর্তে নয়। নট এনী, দ্যাট আই ক্যান থিংক অফ।
আপনার কিন্তু একেবারেই মোবিলিটি নেই। একটা গাড়ি আর ড্রাইভারের বন্দোবস্ত করে দেব কি? আমার কোনওই অসুবিধে নেই কিন্তু। বৌদি?
মানে…?
মানের কিছু নেই। আমি রুষা। আমি একজন ইনডিভিজয়াল। এটাই আমার পরিচয়।
ভুচুর মুখে এসে গেছিল, মিস্ত্রি মানুষ আমি! গাড়ি নিয়েই তো কারবার। গাড়িকাড়ি কোনও প্রবলেমই নয়। গাড়ি একটা পাঠিয়েই দেব। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল যে, ওর মুখ নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল। রুষার কাছে সে যে “মিস্ত্রি”, এ-কথা স্বীকার করতে চাইছিল না ভুচু; যদিও রুষা তা জানেই। প্রেম কি মানুষকে ভণ্ড করে? মিথ্যেবাদী? নিজে যা নয়; তাই-ই করে তোলে কি নিজেকে? নিজেকে বড় করে দেখাতে চায়?
ভাবছিল; লজ্জিত ভুচু।
রুষার দু-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, গাড়ি? হ্যাঁ, দরকার তো খুবই। কিন্তু পৃথু আসুক। দেখি, কী বলে সে? আমার চেয়েও এখন ওরই দরকার বেশি একটা ট্রান্সপোর্টের। ও কি চাকরি ছেড়ে দিয়েই আসছে? জানো কিছু?
ভুচু নিবে গিয়ে বলল, জানি না। কথা হয়নি এ বিষয়ে আমার সঙ্গে। যা নিজে থেকে না বলে, তা জানা মুশকিল। আপনি তো আমার চেয়ে ভাল চেনেন তাকে।
বলেই বলল, আমি তাহলে যাই এখন?
এসো। রোজই এসো তোমার সময়মতো। মেরী খুব ভাল-ফিশ-ফাশ করে। আজ রাতে খাবে নাকি আমার সঙ্গে, ডিনার? ফিশ-ফাশ খেতে চেয়েছে মিলি।
কী হল ভুচুর কে জানে। বলল, নাঃ থাক। পৃথুদা আসুক। তারপর।
মনে মনে ভাবল, রুষাকে রুষার নিজের কথাই ফেরত দিল।
ও। আচ্ছা! অ্যাজ উ্য লাইক ইট। রুষা বলল।
জীপে গিয়ে বসে, এঞ্জিন স্টার্ট করে প্রয়োজনের অনেকই বেশি স্পীডে লাল ধুলো আর ঝরা পাতা উড়িয়ে চলে গেল ভুচু। রুষার কাছ থেকে সেই মুহূর্তে অনেকই দূরে চলে যেতে চাইছিল ও, যত জোরে পারে, এক তীব্র ভাললাগা মিশ্রিত খারাপ লাগায় ওর শরীর জ্বলছিল। লঙ্কা বেটে গায়ে লাগালেও শরীর এমন জ্বলে না।
ভুচুর চলে-যাওয়া-জীপের দিকে চেয়ে খোলা-দরজায় রুষা দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল, বেশির ভাগ পুরুষই বোধ হয় তাদের জীবনীশক্তির অনেকখানিই অপ্রয়োজনে ও বেজায়গায় খরচ করে ফেলে। আশ্চর্য ইডিয়াটিক স্পেসিস!
রুষার চোখ ঝাপসা হয়ে এল এক মুহূর্তের জন্যে। গত দু’ বছরে যত প্রেজেন্ট তার সবই ও পেয়েছিল ইদুরকারের কাছ থেকেই। ভুচুকে দেখে তাই-ই ভয় করছে তার। প্রথম প্রথম ইদুরকারও আজকের ভুচুর মতোই নিস্পাপ, সরল ছিল। সারল্য এবং পবিত্রতাকে রগড়ে দিলেই বোধ হয় তা থেকে বক্রতা আর পাপের বীজ বেরোয়।
রুষার এই ভয়টা অবশ্য আনন্দমিশ্রিত ভয়। হয়তো ভবিষ্যতে ভুচুর কাছ থেকে পাবে ও শত উপহার। পৃথিবীর সব ধনই কোনও সুন্দরীর চাইবার অপেক্ষাতেই তো থাকে শুধু। এই মনটাকে নিয়েই বড় মুশকিল। প্রায়-মরে-আসা শীতের শেষ বিকেলের রোদের মতো বিবেকটাও এখনও কষ্ট দেয়। যার কাছ থেকে তার প্রাপ্য ছিল সবচেয়ে বেশি, সেই স্বামীর কাছ থেকেই পাওয়া হল না কিছুই। সম্বন্ধ করে তো লক্ষ লক্ষ মেয়েরই বিয়ে হয়, তারা অনেকেই তো সুখীও হয়। পৃথুর মতো একজন উদ্ভট স্বভাবের অমানুষকেই যে সে পেয়েছিল স্বামী হিসেবে! দুর্ভাগ্য কার। রুষা কখনওই সেই বিদেশিনী গাইয়ের মতো গাইতে পারবে না সেই বিখ্যাত গান; “আই উইল ট্রেড ওল মাই টুমরোজ ফর আ সিংগল ইয়েস্টারডে”।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা বন্ধ করল রুষা। তারপর ভিতরের দিকে এগোল। দিনের এই সময়টাতে বড়ই বিষণ্ণ বোধ করে ও। সমস্ত বিবাহিতা নারীদেরই কি এই মাঝসকালটাতে মন খারাপ হয়? কে জানে? স্কুল ও কলেজের বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যায়? বাপের বাড়ির জীবনের কথা? আত্মীয়স্বজনের কথা? প্রথম প্রেম, যে-কিশোরটি নিবেদন করেছিল; তাকে? যে প্রথমবার ফুল দিয়েছিল কাঁপাকাঁপা হাতে এনে সেই যুবককেও কি? কালের গতিতে আলতো করে প্রথম চুমু খেয়েছিল যে বা যে খেয়েছিল চোখের পাতায় তাকেও, কাকে কাকে ঠকিয়ে বর্তমানের জীবনকে সে গড়ে নিয়েছে, সেই সব পুরুষদের প্রত্যেকের কথাই কেন যে শুধু দিনের এই সময়টিতেই মনে আসে? কিন্তু আসেই।
পামেলাদের চার্চ-এর দিকেই যাবে ভেবেছিল, কিন্তু দু কিলোমিটার মতে গিয়েই জীপ ঘুরিয়ে দিগা পাঁড়ের কুঁড়ের পথ ধরল ভুচু। জঙ্গলের মধ্যের কাঁচা পথ দিয়ে লাল ধুলো উড়িয়ে থার্ড গীয়ারে জীপ চালিয়ে চলল, ও নানা কথা ভাবতে ভাবতে।
রুষা, ঈভস-উইকলী হাতে করে বেডরুমে জানালার পাশের সোফাতে এসে বসেছিল। কী করে মেয়েদের বুক সুন্দর ও শক্ত রাখতে হয় তার উপরে খুব ভাল একটা আর্টিকেল ছিল বম্বের একজন নামকরা বিউটিসিয়ানের। তাতেই চোখ নিবদ্ধ করল, কিন্তু ওর চোখ ম্যাগাজিনের পাতা থেকে উঠে বাইরের বাগানে পিছলে গেল। গ্রীষ্ম সকালের রুখু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সকালের এই হাওয়াটা একবার জোর হয়, আরেকবার আস্তে। স্মৃতি তো বটেই, নিঃশব্দ স্মৃতির সঙ্গে কত এবং কতরকম ভুলে-যাওয়া শব্দই যে মুখে করে হাওয়াটা অবাধ্য কুকুরের মতো ছোটাছুটি করে এই সময়টাতে! যে গৃহবধু, তাঁর স্বামী সংসার এবং পুত্র-কন্যা নিয়ে অত্যন্তই সুখী, তাঁরও দিনের এই সময়টাতে কেমন এক দুঃখ জাগে মনে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
একটু পরেই জানালাগুলো সব বন্ধ করে দিতে হবে। “লু” বইতে শুরু করবে। চোখ জ্বালা করবে। উড়াল-চুলো পেঁপে গাছে বসে কর্কশ স্বরে দাঁড়কাক ডাকবে। লাটাখাম্বার ক্যাঁচোর-কোঁচোর শব্দ উঠছে বাগানের কুয়ো থেকে। দূরের কাছিম-পেঠা পাহাড়টার গায়ে যেন এগজিমা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের নতুন কালো অ্যাল্সেশিয়ানটা ঘাউ! ঘাউ! ঘাউ! করে ডাকছে। এই ঘাড়ে-কেশরওয়ালা তীব্র-যুবক কুকুরটার সঙ্গে ভুচুর মিল আছে খুবই। কুকুরটার এতই বেশি জীবনীশক্তি যে, তা নিয়ে এই তারুণ্যে-দীপ্ত কুকুর কী যে করবে, তা যেন ভেবে পর্যন্ত পাচ্ছে না। ভিনোদ ছিল, মরে-যাওয়া সাদা অ্যালসেশিয়ানটার মতোই। সেও মরল দুর্ঘটনায়।
পুজো-টুজো সেরে দিগা তার একচড়া চাপাচ্ছিল সবে। এমন সময় ভুচুর জীপ গিয়ে পৌঁছল ধুলো উড়িয়ে।
ভুচু জীপ থেকে নেমে বলল, বেশি করে চাল দাও। আমিও খাব।
ভুচুকে এমন দারুণ পোশাকে দেখেনি কখনও দিগা আগে। অনেকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর বলল, আপনি? হঠাৎ? বাঃ বাঃ। মনে পড়ল তাহলে আমাকে? পৃথু বাবু, সাবীর মিঞা, শামীম ভাই, ঠুঠা ওদের সব খবর কী?
ভুচু বলল, সবই শুনবে। তাড়া কিসের? আজ মৌরসি-পাট্টা গেড়ে বসব বলেই তো এসেছি।
বাইরের বড় পাথরটাতে এখন আর বসা যায় না। শীতেই ওখানে বসতে আরাম। ভুচু বলল, আমি নদীর পাশে গাছের ছায়ায় বসছি গিয়ে। ঠাণ্ডা হবে ওখানে। রান্না হলেই তুমি হাঁড়িসুদ্ধ ওখানেই নিয়ে এসো। নদীর পাশের পাথরের উপরে ঘি দিয়ে জম্পেস করে ভাত মেখে খাব। তারপর অনেক কথা আছে।
দিগা বলল, যেমন বলবেন। কিন্তু খাবেন কী আপনি? কিছুই যে নেই! আপনাকে কী দিয়ে খাবার দিই বলুন তো? অতিথি যে নারায়ণ!
কী আছে?
ভাত, মুগের ডাল, আর নুন।
আর ঘি? ঘি আছে তো?
তা আছে একটু।
ফারস্টক্লাস। আবার কী চাই? আমার তো এখানে আসার ঠিকই ছিল না। হঠাৎই চলে এলাম। নইলে, তোমার জন্যে আনাজ নিয়ে আসতাম। চাল ডালও। কালই সব পাঠিয়ে দেব কাউকে দিয়ে জীপে করে।
না, না। পাঠাবেন কেন আবার? চাল ডাল নুন যা আছে তাতে চলে যাবে আরও দিন সাতেক। তাছাড়া, জঙ্গলে কতরকম মূল আছে; ফল আছে।
এইই দোষ তোমার! তুমি যা বোঝো; কেউই বোঝে না! এগোলাম আমি। এসো রান্না শেষ হলে।
জীপটা নিয়ে হাঁলো নদীর একেবারে গায়েই সাঁটিয়ে দিয়ে জীপ থেকে ভডকার বোতল, প্লাস্টিকের গ্লাস, লেবু আর ছুরি বের করল। তারপর জুতো-মোজা সব খুলে ফেলল। নদীর মধ্যে, পাথরের কোল ঘেঁষে মস্ত একটা চাঁদ গাছের ছায়ায় বড় কালোরঙা ডিমের মতো দেখতে একটা পাথরের উপর বসে লেবু কাটতে লাগল। লেবু কেটে, ট্রাউজার গুটিয়ে নদীতে যখন গ্লাসে জল ভরার জন্যে গেল ও, জলের মধ্যে হঠাৎই লাল-রঙা কী চোখে পড়ল। বুকটা ধ্বক করে উঠল ভুচুর।
রক্ত?
রক্ত কি?
তারপরই বুঝল যে, ভুল।
নিজের সাদা-রঙা মার্সিডিজ গাড়ির মধ্যে কণ্ঠনালীকাটা স্যুটেড-বুটেড্ টাই-পরা ভিনোদ ইদরকার এই হাঁলো নদীরই অনেক নীচে কি এখনও বসে আছে? এতদিনে গভীর জলের মধ্যে ফুলে-ফেঁপে গলেই গেছে কি মৃতদেহটা? প্রাণটা বেরুবার আগে খুবই কি ছটফট করেছিল ও? মুরগি জবাই করার পর একটা মুরগি যেভাবে রক্তের ফিনকি তুলে লাফায়-ঝাঁপায় তা অনেকবারই দেখেছে ভুচু। দেখে, শিকারি ভুচুও আতঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু মানুষ? ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠল ওর। গাড়ির দরজাগুলো কি খুলে গেছে এতদিনে জলের তোড়ে? ছোট ছোট পাহাড়ি মাছে কি ঠুকরে খেয়ে গেছে ইদুরকারের চোখ দুটো? কে জানে? আবারও গা গুলিয়ে উঠল ভুচুর।
বড় করে ভডকা ঢালল গ্লাসে। আজকে মাতালই হয়ে যাবে ভুচু। নিজেকে ভোলা দরকার। নিজের কাছ থেকে নিজে অনেক দূরে পালিয়ে যাবার জন্যে কালেভদ্রে এক আধদিন মাতাল হওয়া মনের স্বাস্থ্যর পক্ষেও বোধ হয় ভাল।
হাঁলো নদী বয়ে যাচ্ছিল গ্রীষ্মবনের বিবাগী, জ্বরতপ্ত শরীরের মধ্যে দিয়ে। গাছগুলোর বেশিরই পাতা নেই এখন। পাতা-ঝরা গাছের সমর্পণের ভঙ্গিতে তাদের অসংখ্য হাত উঁচু করে আগুন-ঝরানো আকাশে কোন অদৃশ্য দেবতার কাছে যে কী বর চায়, তা তারাই জানে। কিছু গাছে এখনও পাতা আছে, প্রখর গ্রীষ্মেও পাতা যাদের ঝরে না। অথবা যাদের পাতা ঝরে শীতে কিংবা শরতে। তারাই গ্রীষ্মবনের দাবদাহ থেকে বাঁচায় বনচারীকে। বনমোরগ ডাকছে নদীপারের বনের ভিতরের একটা দোলামত জায়গা থেকে। দু পারের সব শব্দ মুখে করে ছুটে চলেছে জরির শাড়ির মতো জল। অগভীর জলের মধ্যে গাছগাছালির ফাঁক-ফোঁকরের মধ্যে থেকে সোনালি বেজির মতো অতর্কিতে লাফিয়ে-পড়া রোদ জলজ আলোর সাদা-কালো অসংখ্য সাপেদের ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে।
ভুচুর মাথার দু’পাশেই জুলপির একটু উপরে ঝিরঝিরে একটা অনুভূতি হচ্ছে। পরপর ভডকা খেয়ে যাচ্ছে ও। একটু কাঁচা-লঙ্কা, লেবুর সঙ্গে, বিচিগুলো বের করে ফেলে দিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু নেই। কোনও বিশেষ বিষয়ে সে মনই বসাতে পারছে না। না কাঁচালংকা, না রুষা, না ইদুরকারের ফুলে-ওঠা মৃতদেহ। কোনও বিষয়েই না। জলের পাশের একটা মরা কস্সি গাছের ডালে জলফড়িংটা যেমন তার ফিনফিনে বাদামি ডানায় রোদ চমকিয়ে উড়ছে আর বসছে ভুচুর সামনে, ওর মনও তেমনই উড়ছে আর বসছে। মনটা ফড়িং হয়ে গেছে। কখনওই আজকের মতো এমন করে ভুচু নিছক মাতাল হওয়ারই জন্যে মন্দ খায়নি এর আগে। আনন্দ পেয়েছে বলেই খেয়েছে। কখনওই অসুস্থ বা অপ্রকৃতিস্থ হয়নি। পৃথুদা যেমন মাঝে মাঝে হয়ে পড়ত। কিন্তু আজ পুরোপুরি অপ্রকৃতিস্থ হতে চেয়েও হতে পারছে না। মাতাল হওয়াও যে এমন কঠিন কাজ, তা ওর মতো মদ্যপায়ীরও জানা ছিল না।
কখন যে দিগা এসে, মাটির হাঁড়িটা নদীপারের দুটি ছোট পাথরে হেলান দিয়ে রেখে চাঁর গাছের পাতা ছিঁড়তে শুরু করেছিল তা লক্ষ করেনি ভুচু। তাড়াতাড়ি উঠে, নদীর পাশে একটি চ্যাটালো পাথরে আঁজলা ভরে জল ছিটিয়ে ভাল করে ধুয়ে দিল ভুচু। দিগা এসে তারই উপরে পাতাগুলো দোনার মত করে বিছিয়ে দিল। তার পর হাঁড়িটা আনল। দোনায় মুড়ে নুন এনেছিল, আর ঘি দিয়ে দিয়েছিল হাঁডির মধ্যেই। চমৎকার সুগন্ধ আতপান্নর গন্ধর সঙ্গে জংলি-বস্তির ঘরে-বানানো খাঁটি গাওয়া ঘি-এর গন্ধ, নদী আর বনের গন্ধের সঙ্গে মিশে গেল। পাথরের উপর ওর সাধের সাদা কর্ডুরয়ের ট্রাউজার পরেই আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পড়ল ভুচু দিগার মুখখামুখি। ট্রাইপড-সিল্কের শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে হাপুস-হুপুস করে খেতে লাগল। একটা বড়কি ধনেশ পাখি ‘হ্যাঁককা’, হ্যাক্কো’ হুঁক হুঁক করে নাক্স-ভোমিকা গাছের মগডালে বসে ডাকতে লাগল। এখন তো ফল নেই গাছে। কী করছে সে ওই গাছে কে জানে? তারপরই পাখিটা একটা আওয়াজ করতে লাগল, যেমন নিচু স্বরের একটানা স্বগতোক্তি একমাত্র বড়কি ধনেশরাই করে। মন বড় বিষণ্ণ হয়ে যায় শুনলে।
খাওয়া-দাওয়ার পর সিগারেট ধরিয়ে যে-পাথরে বসে ভডকা খাচ্ছিল তারই উপরে আবার এসে বসল ভুচু। তারপর আরও ভডকা ঢালল।
ভুচুর পোশাক দেখেই বুঝেছিল দিগা পাঁড়ে যে, যেতে চেয়েছিল ভুচু অন্যত্র কিন্তু এসে পড়েছে ওর কাছে। বেশির ভাগ সংসারী মানুষই তো জীবনের পথে বেরিয়ে পড়ে এমনি করেই। যেখানে যেতে চেয়েছিল সেখানে না গিয়ে অন্যত্র পৌঁছে থেবড়ে বসে পড়ে। যাওয়া যে হল না, তা না বুঝেই! গন্তব্যে পৌঁছতে পারে কজন মানুষ? দিগা বলল, আপনার মনে খুব অশান্তি ভুচুবাবু তাই না?
হুঁ। বলে, মাথা নাড়াল ভুচু।
তাই-ই আজ তোমার কাছে এসেছি দিগা। আমার বড়ই অশান্তি। তুমি তো অনেক জানো, অনেক পড়েছ, তুমি কিছু করতে পার কী আমার জন্যে?
একটু চুপ করে থাকল দিগা, জীপের পাশে, মাটিতে উবু হয়ে বসে। তারপর বলল, কারও জন্যেই অন্য কেউই কিছুই করতে পারে না ভুচুবাবু। পথের হদিশই শুধু দিতে পারে কেউ কেউ। সে-পথের হদিশ পেয়েও যে সবাই-ই সে পথে যেতে পারে, এমনও নয়। যা করার, তা নিজেকেই করতে হয়। তবু, আপনি মন খুলে কথা বলুন। মন হালকা লাগবে, সেটাও তো মস্ত লাভ।
ভুচু যন্ত্রণাকাতর মুখে বলল, সেসব এমনই কথা দিগা যে, মন খুলতে চাইলেও খোলা যায় না।
আপনি বোধ হয় প্রেমে পড়েছেন ভুচুবাবু। আপনি যখন এলেন তক্ষুনি আপনার মুখচোখ দেখেই আমি বুঝেছি। “বৈর প্রেম নাহি দূরই দুবএঁ”—শত্রুতা আর প্রেম লুকোতে চাইলেও কখনওই লুকোনো যায় না।
লজ্জিত, ধরা-পড়া গলায় অপরাধীর মতো ভুচু বলল মুখ নামিয়ে, তাই-ই?
দিগা হাসল। বলল, প্রেমে পড়ার মধ্যে তো কোনও দোষ নেই ভুচুবাবু। আমিও তো সবসময় প্রেমেই পড়ে রয়েছি। তবে আপনার প্রেম একজন নারীর সঙ্গে আর আমার ঈশ্বরের সঙ্গে। সেই নারীর মধ্যেও তো ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বর সব জায়গায়ই আছেন। প্রেম এমনই এক সুখ যে তার সেই সুখসুপ্ততার মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ আছে। তুলসীদাস তাইই বলেছিলেন।
“জীব সীম সম সুখ সয়ন সপনে কছু করতুতি।
জাগত দীন মলীন সোই বিকল বিভূতি॥”
মানে কী হল?
উৎসুক গলায় শুধোল ভুচু। বানে ভেসে-যাওয়া জল যেন হাতে গাছ পেয়েছে।
দিগা মধুর পবিত্রতার হাসি হেসে, দুটি হাত বুকের কাছে তুলে নাড়িয়ে বলল, জীব যখন সুখসুপ্ত, তখন সে শিবেরই মতো। তখন স্বপ্নে সে কত কীই না সৃষ্টি করে চলে। কিন্তু যেই জেগে ওঠে অমনি সেই-ই আবার দীন; মলিন। বিষাদেরই প্রতিমূর্তি। প্রেম মানুষকে শিব করে দেয়, এইই-ই বা কম কী? বলুন?
পাঁড়েজী তুমি আমার কথা সব জানো না। আমি ছেলেবেলা থেকে অনেক এবং অনেকরকম কষ্ট করে আজ এখানে এসে পৌঁছেছি জীবনে। আমার কি সুখী হবার কোনওই অধিকার নেই? সারাজীবনই কি একইভাবে কাটবে আমার?
গলা ধরে এল ভুচুর। কিছুটা মানসিক অবস্থার কারণে। বাকিটা ভডকার।
দিগা হেসে বলল,
“সুখ জীবন সব কোউ চাহত সুখ জীবন হরিনাম।
তুলসী দাতা মাগনেউ দেখি অত অবুধ অনাথ॥
আঃ। মানে কী বলো!
দিগা বলল, ভুচু বাবু, সুখী জীবন তো সবাই-ই চায়। কে তা না চায় বলুন? কিন্তু সুখী জীবন তো শুধুমাত্র শ্রীহরিরই হাতে। তুলসীদাসের চোখে, যে দাতা আর যে প্রার্থী; দুজনেই সমান অবোধ। দাতা অবোধ, কারণ সে দানের গর্বেই আবদ্ধ থাকে সব সময়। আর যে প্রার্থী, সেও অবোধ; কারণ সর্বসুখের আকর ঈশ্বরকে না চেয়ে সে অন্য ভোগের প্রার্থনা করে।
তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারছি না দিগা। আমার বড়ই কষ্ট। আমি এমন এক নারীর প্রেমে পড়েছি, যে আমার সবচেয়ে প্রিয়জনেরই আপনতম জন। কী যে করব আমি! বড় পাপবোধ হয় মনে, অথচ ভাল যে বেসে ফেলেছি!
দিগা আবারও হাসল। কৃষ্ণপক্ষর শেষ রাতের চাঁদের মতো গভীর আশ্বাসমাখা সে হাসি। দিগা বলল,
“বড়ি প্রতীতি গঠিবন্ধ তেঁ বড়ো জোগ তেঁ ছেম।
বড়ো সুসেরক সাই তেঁ বড়ো নেম তেঁ প্রেম॥
ভুচুবাবু, তুলসীদাসের কথা হচ্ছে গিয়ে এই যে, বাইরের সমস্ত গ্রন্থিবন্ধনের চেয়েও বিশ্বাস অনেকই বড়। যোগের চেয়ে ক্ষেম বড়। প্রভুর চেয়েও তার শ্রেষ্ঠ সেবক বড়। আর সমস্ত নিয়মের চেয়েও বড় প্রেম। প্রেমেই যদি পড়ে থাকেন, তবে এসব নিয়ে ভাববেন না। কোনও কিছুই প্রেমের সমান হতে পারে না।
ভুচু, দিগার কাছে নেমে এল ওর উঁচু শিলাসন ছেড়ে। নদীপারের লাল মাটির মধ্যে ধবধবে সাদা ট্রাউজার পরেই আসনপিঁড়ি হয়ে দিগার মুখোমুখি বসে বলল, কিন্তু সেই নারী যে আমার প্রিয়জনের স্ত্রী! তুমি বুঝছ না দিগা। সে যে তাকে বুকে করেই রেখেছিল।
এবার খুব জোরে হেসে উঠল দিগা। নদীর জল সেই হাসিকে আলোর মতো প্রতিসরিত করে দিল দু-পাশের গাছপাছালিতে। দিগা হাসতে হাসতেই বলল,
“রাখিতা নারি যদপি উর মাহী * যুবতী, শাস্ত্র, নৃপতি বস নাহী
দেখহু তাত বসুন্ধরা গুহারা * প্রিয়াহীন মোহী ভয় উপজারা”
এর মানে কী হল?
ভুচু উদগ্রীব হয়ে শুধোল।
এর মানে হল, স্ত্রীকে যদি বুকে করেও কেউ রাখে, তবুও যুবতী স্ত্রী, শাস্ত্র এবং নৃপতিরই মতো বশে কখনওই থাকে না। কেউ বুকে করে রাখলেই যে বশে থাকবে তা ভাবা ভুল। ভালই যদি কাউকে বাসেন তো, তাকে পেতে দোষ কোথায়? “মন মোদকহ্নি কী ভুখ বাতাঈ?” মনগড়া মিঠাই দিয়ে কী আর খিদের নিবৃত্তি হয় কখনও?
তুমি জানো না দিগা, আরও একটা ব্যাপারেও আমি মনে মনে একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছি। সাংঘাতিক এক অপরাধ করেছে আমারই এক দোস্ত। অথচ তার মনে বিন্দুমাত্র পাপবোধ নেই। জ্বলে মরছি শুধু আমি সেই অপরাধের গ্লানিতে। অথচ আমার কোনওই হাত ছিল না তাতে।
দিগা বলল, এরকম তো ঘটতেই পারে।
“ঔরু করৈ অপরাধু কোউ ঔর পার ফল ভগু।
অতিবিচিত্র ভগবন্তী গতি কো জগ জানৈ জোগু॥’
অপরাধ করে একজন আর তার ফল ভোগ করে আর একজন। ভগবানের লীলা অতি বিচিত্র। তা জানার ক্ষমতা বা যোগ্যতা কার আছে বল?
ঘুম ভেঙে উঠে বসে পরিষ্কার মাথায় ও ভাবছিল, দিগা পাঁড়ে অনেকই জ্ঞানের কথা শোনাল। কিন্তু এত জ্ঞানে তো ওর দরকার ছিল না। ও যে স্বল্পশিক্ষিত লোক।
আকাশে চেয়ে দেখল, বেলা পড়ে গেছে। দীর্ঘ হয়েছে গাছের ছায়ারা। দিগার কুঁড়ের সামনে জীপটা নিয়ে গেল ভুচু। দিগা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আপনার জন্যে চা বানাই? পাঁচ মিনিটে হয়ে যাবে।
তুমি খাবে তো?
আমি তো খাই না।
তাহলে ছেড়ে দাও। পথেই খেয়ে নেব কোথাও।
বলেই, মুখ বাড়িয়ে বলল, কাল তোমার জন্যে সিধা পাঠিয়ে দেব দিগা। ভাল থেকো। তারপর চাপ দিল অ্যাকসিলারেটরে।
ভাল থাকবেন ভুচুবাবু। আবারও আসবেন। সক্কলকে নিয়ে।
এক ঝাঁক বন-মুরগি কঁক-কঁক-কঁক করতে করতে প্রায় জীপের চাকার তলায় পড়তে পড়তে বেঁচে দৌড়ে গিয়ে পথের ডান দিকের জঙ্গল থেকে বাঁদিকের পড়ন্ত বেলার মাঠে নেমে গেল।
থার্ড গীয়ারে ফেলে দিয়ে আঁকাবাঁকা বনপথে জীপ চালাতে চালাতে ভুচু ভাবছিল আগেকার দিনের মতো “সক্কলকে” নিয়ে আর আসা হবে না দিগার কাছে।