অসুস্থ শরীরে থিয়েটার দেখতে এসেছেন মহেন্দ্রলাল সরকার। থিয়েটার তাঁর নেশা। যখন নানারকম ব্যস্ততায় তাঁর নিশ্বাস ফেলারও সময় থাকত না, তখনও কোনও নতুন নাটক শুরু হলেই তিনি অন্য কাজ ফেলে রঙ্গালয়ে এক সন্ধ্যা ব্যয় করতেন। শুধু কাজ আর কাজ নিয়ে থাকলে কর্মক্ষমতাই ধীরে ধীরে কমে যায়। মাঝে মাঝে মন অন্য দিকে ফেরাতে হয়। উত্তম নাট্য-অভিনয় দর্শনে মহেন্দ্রলালের মনে স্ফুর্তি আসে, কর্মের উদ্যম বাড়ে।
এখন অবশ্য মহেন্দ্রলাল এক এক করে বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে মুক্তি নিচ্ছেন। রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ, তাঁর অতি প্রিয় বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানেও আর নিয়মিত যেতে পারেন না। শরীর অশক্ত, হাঁটু দুটি দুর্বল হয়ে গেছে, তবু নাটক দেখতে আসা বন্ধ হয়নি।
এক হাতে ছড়ি, অন্য হাতে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কাঁধে ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন মহেন্দ্রলাল। দীনেন্দ্র এখন বসুমতী নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করে, সেও নাটক-পাগল। মহেন্দ্রলালকে কলকাতার সব কটি রঙ্গমঞ্চের মালিক, ম্যানেজাররা বিশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা করে, তিনি আসবেন এই খবর পেলেই তাঁর জন্য দোতলার একটি বক্স রিজার্ভ করা থাকে।
ক্লাসিক থিয়েটার সম্প্রতি আবার নতুন করে সজ্জিত হয়েছে। পুরনো আসনের বদলে গদি মোড়া নতুন আসন, দেওয়ালে নতুন রং এবং একটি চমকপ্রদ অভিনব সংযোজন–বৈদ্যুতিক পাখা! বৈদ্যুতিক আলো আগেই এসে গিয়েছিল, প্রেক্ষাগৃহ এখন আলোয় ঝলমল করে, এই স্বয়ংক্রিয় পাখা এসে একেবারে দর্শকদের শরীর জুড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যুতের নব নব ব্যবহার দেখে বিস্ময়ের আর অবধি নেই। এ যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই দৈত্য, মানুষের হুকুমে বড় বড় কলকারখানার বিশাল বিশাল যন্ত্রগুলি পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেয়। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, বড়লাটভবনে লর্ড কার্জন নাকি একটি যন্ত্র বসিয়েছেন, তার নাম লিফট। সেই যন্ত্রটির মধ্যে একটি খোপ আছে, সেখানে মানুষজন ঢুকে দাঁড়ায়, আর যন্ত্রটি ওপরে উঠে যায়। সিঁড়ি না ভেঙেও দোতলায়, তিনতলায় ওঠা! এর পর কোনও যন্ত্র বুঝি মানুষকে আকাশে ওড়াবে! ইতিমধ্যে নড়া চড়া ছবি নিয়েও এক অদ্ভুত কীর্তি শুরু হয়েছে। মানুষ হাঁটছে, দৌড়চ্ছে, ঘোড়া ছুটছে, ঝরনা থেকে জল পড়ছে, সবই চলন্ত ছবিতে দেখা যায়। এমনকী যে মানুষটা মরে গেছে, তাকেও জীবন্ত দেখা যেতে পারে, সে হাসছে, কাঁদছে। থিয়েটারওয়ালারা অতিরিক্ত আকর্ষণ হিসেবে পাঁচ-দশ মিনিট সেই চলন্ত ছবি দেখায়।
আসন গ্রহণ করার পর কোটের বোতাম খুলে হাওয়া খেতে খেতে মহেন্দ্রলাল ওপরে ঘূর্ণ্যমান বৈদ্যুতিক পাখার দিকে তাকালেন। মুগ্ধভাবে বললেন, হ্যাঁ হে দীনেন্দ্র, আগে আমরা থিয়েটার দেখতুম কী করে? গরমে গতর সেদ্ধ হয়ে যেত!
দীনেন্দ্র বললেন, আগে যখন এ জিনিস ছিল না, এর অভাববোধও ছিল না। গরম লাগত ঠিকই। কত রাজা-মহারাজা, যাঁদের বাড়িতে টানা পাখার তলায় থাকা অভ্যাস, তাঁরাও তো গরম সহ্য করে থিয়েটার দেখতে আসতেন।
মহেন্দ্রলাল বললেন, রামকৃষ্ণ ঠাকুর মাঝে মাঝে থিয়েটার দেখতে আসতেন, আহা দদর করে ঘেমে নেয়ে একসা হতেন।
তারপর আপনমনে হেসে উঠে বললেন, তখন গরমের কষ্ট ভোলবার জন্য নাটকের মাঝে মাঝেই ধেই ধেই করে সখীদের নাচ জুড়ে দিত। সব নাটকেই ছ’ সাতখানা মাগি নাচবেই। এখন লক্ষ করেছ, নাচ কত কমে গেছে। অকারণে আর নাচ থাকে না। নাটকগুলো বেশি সিরিয়াস হচ্ছে। তা হলে, তোমাদের এই সব নাটক যদি আর্ট হয়, তাকে প্রভাবিত করছে বিজ্ঞান।
দীনেন্দ্র বলল, আপনার এই থিয়োরিটা আগে ভেবে দেখা হয়নি।
বাজনা বেজে উঠল, মঞ্চের সামনের ভারী পদাটা একটু একটু করে গোটাতে শুরু করল। অপূর্ব দৃশ্যপট, যেন সত্যিকারের এক নিবিড় অরণ্য, তার মধ্যে এক ভগ্ন মন্দির। মঞ্চসজ্জা দেখেই দর্শকরা চটাপট হাততালি দিয়ে উঠল।
ক্লাসিক থিয়েটার এখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। উচ্চাভিলাষী অমরেন্দ্রনাথ মিনার্ভা থিয়েটারও দখল নিয়ে এক সঙ্গে দুটি রঙ্গমঞ্চ চালাচ্ছে। নাট্যজগতে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গিরিশচন্দ্রকে সে ফিরিয়ে এনেছে, ফিরে এসেছে দানি। শুধু নাট্যকার ও নাট্যশিক্ষক নন, গিরিশচন্দ্র আবার অমরেন্দ্রনাথের অনুরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয়ও করছেন।
নাটকের নাম ‘ভ্রান্তি’। কাহিনীর পটভূমিকা ঐতিহাসিক, রাজশাহির জমিদার উদয়নারায়ণ বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, কিন্তু সেই ইতিহাস এখানে প্রাধান্য পায়নি। মানব চরিত্রের জটিলতাই এর মূল উপজীব্য। মানুষের জীবনের কত অশান্তি, কত দ্বন্দ্ব, কত অবিশ্বাস, কত আত্মযাতনা তৈরি হয় নিছক ভুল বোঝাবুঝির জন্য, সেটাই ঘটনা পরম্পরায় প্রতিফলিত হয়েছে।
নিরঞ্জন আর পুরঞ্জন নামে দুটি যুবকের চরিত্রে নেমেছে অমরেন্দ্রনাথ আর দানিবাবু, গিরিশচন্দ্র সেজেছেন রঙ্গলাল। সেই নায়ক দু’জনের সঙ্গে যেন সমানে পাল্লা দিয়ে চলেছেন বৃদ্ধ গিরিশচন্দ্র। নাটক দেখতে দেখতে শুধু মুগ্ধ নন, খানিকটা অবিশ্বাস মিশ্রিত বিস্ময়ও বোধ করলেন মহেন্দ্রলাল, এ কী চরিত্র রচেছেন গিরিশ! সাধারণত করুণরস, ভক্তিরস কিংবা রুদ্ররসেই তাঁর হাত খোলে। পরপর দু তিনটি নাটকে টিকিট বিক্রি আশানুরূপ না হলে তিনি একটি ভাঁড়ামির পঞ্চরংও নামিয়ে দেন। কিন্তু এই রঙ্গলাল যে সম্পূর্ণ অন্যরকম, যেন এক উদাসীন, আত্মসুখবিমুখ মানুষ, এ চরিত্রে জনপ্রিয় হবার মতন কোনও গাঢ় রং নেই।
এক দৃশ্যে গঙ্গা নাম্নী এক বারবনিতাকে নিয়ে রঙ্গলাল এসেছে মন্দিরে। দেবীমূর্তির সামনে বসেছে দু’জনে। এই বারবনিতাকে প্রকৃত মানবীর সম্মান দিয়েছে রঙ্গলাল। দেবীমূর্তির সামনে বলছে, অমন পাথুরে মাকে মানি না মানি, তাতে বড় এসে যায় না। …আমার দেবতা প্রত্যক্ষ। আমার দেবতা কথা কয়; আমার দেবতার প্রাণ আছে; আমার দেবতা অমন দৃষ্টিভোগ খায় না। সত্যি ভোগ খায়, আমার তো পরম সুন্দর!
গঙ্গা প্রশ্ন করল, কে তোমার দেবতা শুনি!
রঙ্গলাল বলল, মানুষ আমার দেবতা!… আমার দেবতা প্রাণময় মানুষ–যার সেবা করলে প্রাণ ঠাণ্ডা হয়। যার সেবা করে মনকে জিজ্ঞেস করতে হয় না, ভাল করেছি না মন্দ করেছি। যে দেবতার পূজায় কোনও শাস্ত্রে নিন্দা নাই, তর্ক-বিতর্ক নাই।
মহেন্দ্রলালের দু চক্ষু দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে।
তিনি ধরা গলায় বললেন, ওহে, গিরিশের হল কী! সে কট্টর কালীসাধক, এখন মূর্তিপূজার বদলে মানবসেবার কথা বলছে! তার এ কী পরিবর্তন?
দীনেন্দ্র বললেন, আজ্ঞে, এ তো নাটকের সংলাপ! নাট্যকারকে কত রকম চরিত্র তৈরি করতে হয়। তাদের মুখে মানানসই কথা বসিয়ে দেয়, তা বলে কি নাট্যকার নিজের জীবনে সব মানে?
মহেন্দ্রলাল বললেন, না, না, এ যেন গিরিশেরই মনের কথা। অভিনয় করছে মনে হয়? গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছে।
দীনেন্দ্র বললেন, দেখুন গে, এখনও হয়তো উনি বোজ পুজো আচ্চা করেন!
এর পরেও, রঙ্গলাল যখন অন্যের জন্য প্রাণ দিতে যাচ্ছে, তখন বিস্মিত মুর্শিদকুলি খাঁ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তোমার ধর্মের জন্য এরকম প্রাণ দিচ্ছ? তার উত্তরে রঙ্গলাল বলল, নবাব সাহেব, যে ধর্মের জন্য পরের কাজ করে, সে নিজেকে ঠিক মতন বিলিয়ে দিতে পারে না।
নাটক শেষ হতেই মহেন্দ্রলাল বললেন, দীনু, চলো চলল, গিরিশের সঙ্গে একবার দেখা করে
গিরিশ ইদানীং আর সকলের সঙ্গে দেখা করেন না। প্রত্যেকদিন অভিনয়ের শেষে কিছু দর্শক ভিড় করে আসে, ওদের চাটুকারিতা শোনার ধৈর্য বা লোভ গিরিশের নেই। মঞ্চে দাপাদাপি করার পর তিনি ক্লান্ত বোধ করেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন নিজস্ব একটি ছোট কক্ষে। বিশিষ্ট লোকদেরও সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
কিন্তু মহেন্দ্রলালকে আটকাবে কে? বৃদ্ধ হলেও তো সিংহের জাত তিনি। ওহে গিরিশ, গিরিশ কোথা গেলে। এই হুংকার শুনে গিরিশচন্দ্র নিজেই দরজা খুলে দিলেন।
ঘরের মধ্যে এসে মহেন্দ্রলাল বললেন, সুরার পাত্র কোথায়? শুধু তামাক টান দেখছি?
গিরিশ বললেন, কেন, তোমার পান করবার ইচ্ছে হয়েছে নাকি? তা হলে আনাই।
মহেন্দ্রলাল বললেন, হুঃ, এতকাল ধরাতে পারেনি, এখন মরার কালে এসে মাতাল হব?
গিরিশ বললেন, আমিও আজকাল আর প্রত্যহ খাই না। আমারও তো বয়েস কম হল না।
মহেন্দ্রলাল বললেন, বাঃ, বেশ কথা। তোমার সত্যি সত্যি পরিবর্তন হয়েছে দেখছি। নাটকখানিতেও নতুন কথা বলেছ!
গিরিশ বললেন, বসো, বসো! নাটক কেমন দেখলে বলো!
তাতে মহেন্দ্রলাল বললেন, অতি সরেস। প্রাণ জুড়িয়েছ। এখনও তোমার লেখার বেশ জোর আছে। এখনও তুমি টায়ার্ড হওনি। রঙ্গলাল আর গঙ্গাবাঈ-এর চরিত্রজুটি একেবারে অরিজিনাল। রঙ্গলালের মুখ দিয়ে তুমি কী কথা শোনালে! চোখে জল এসে গিয়েছিল গোনর
গিরিশ হেসে বললেন, ডাক্তার, তোমাকে খুশি করা অতি সহজ। তোমার মতামতের কোনও দাম নেই। তুমি তো নাটক দেখতে বসলেই হাপুস নয়নে কাঁদো। আজও দেখছি তোমার কোটের আস্তিন ভিজে গেছে।
মহেন্দ্রলাল বললেন, নাটক দেখে মোটেই কাঁদি না। কাঁদি আমি গান শুনে। অভিনয়ের উৎকর্ষ দেখে কাঁদি। অভিনয় যখন সত্যিকারের আর্ট হয়ে ওঠে, তখন তা আমাকে কাঁদায়। তোমাদের নাটকগুলি অধিকাংশই রাবিশ! ভেতরে ভূষিমাল। হয় হেঁদো প্রণয়, নয় ভক্তিরসের বাড়াবাড়ি। তবে এ নাটকখানির বাঁধুনি ভাল। মন দিয়ে লিখেছ, তাই না? আমার কথায় যদি বিশ্বাস না করো, সঙ্গে দীনু এসেছে, যে সে লোক নয়, সুসাহিত্যিক, একখানা ম্যাগাজিনের এডিটর। তার কেমন লেগেছে শোনো?
দীনেন্দ্রকুমার বললেন, সত্যি অপূর্ব হয়েছে। রঙ্গলাল চরিত্রটি আপনার অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি। এমন স্বার্থত্যাগ, বাঙালি একবার চোখ খুলে দেখবে কি! একদিকে স্বার্থ-হিংসা দ্বেষ, আর একদিকে স্বর্গের পবিত্রতা। এই রঙ্গলালের চরিত্রের কাছে অধঃপতিত বাঙালির শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। রঙ্গলালের একটা সংলাপ আমার একবার শুনেই মুখস্থ হয়ে গেল, শুনবেন? ‘সংসার যে সাগর বলে, একথা ঠিক। কুলকিনারা নাই। তাতে একটি ধ্রুবতারা আছে, দয়া। দয়া যে পথ দেখায়, সে পথে গেলে কেউ নবাবও হয় না, বাদশাও হয় না, তবে মনটা কিছু ঠাণ্ডা থাকে। এটি প্রত্যক্ষ, তর্ক-যুক্তির দরকার নাই!’
গিরিশ বললেন, সত্যি মুখস্থ করেছেন দেখছি।
মহেন্দ্রলাল ঝুঁকে গিরিশের কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, তোমার কী হল হে? মাঝখানে ধর্ম নিয়ে খুব পাগলামি করেছিলে, পুজো-আচ্চা, অবতারবাদ এই সব নিয়ে কত মূখামিই না করেছ। কতবার বলেছি, কালী নামে ওই ন্যাংটা মাগিটার পুজো বন্ধ করো। লেখাপড়া শিখেও বর্বরের মতন একখানা ওই বীভৎস মূর্তির সামনে নাচানাচি করতে তোমাদের লজ্জা ছিল না। হঠাৎ কী করে তোমার এমন সুমতি হল! মূর্তিপূজার বদলে মানবধর্ম। মানবসেবা!
গিরিশ বললেন, ডাক্তার, তোমার এই এক দোষ। তোমার মুখের লাগাম নেই। অসংখ্য লোক যে মূর্তিকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করে, তা নিয়ে অত খারাপ কথা বলতে যাও কেন? তুমি মানো না, ঠিক আছে। সেটা তোমার মনের মধ্যে রাখো!
মহেন্দ্রলাল হুংকার দিয়ে বললেন, না, আমি বলবই! আমার যা বিশ্বাস, তা আমি বলতে ছাড় কেন? এত ঠাকুর-দেবতায় ভক্তিই তো দেশটার সর্বনাশ করছে! তুমি আর একটা কথাও বড় খাসা লিখেছ। ধর্মের নামে যারা সেবা করে তারা নিঃস্বার্থ নয়। অনেকে মনে করে, কিছু দান-ধ্যান, মানবসেবা করলে ধর্মকর্ম হবে। পুণ্য হবে। সেই পুণ্যের জোরে স্বর্গে যাবে। স্বর্গে গিয়ে দেবীদের পাশে বসতে পাবে, ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভার মতন স্বর্গের বেশ্যারা এসে কোলে শোবে! যত্ত সব ধ্যাস্টামো!
গিরিশ বললেন, আমার নাটক দেখে কি আর মানুষ শোধরাবে? আমার মনে এসেছে, তাই লিখে গেছি!
মহেন্দ্রলাল বললেন, সেইজন্যই তো বলছি, তোমার মনের একটা পরিবর্তন এসেছে।
দীনেন্দ্র বললেন, গানগুলিও অনবদ্য হয়েছে। ‘নেই তো তেমন বনে কুসুম, মনে যেমন ফোটে ফুল’, আহা!
মহেন্দ্রলাল বললেন, হ্যাঁ হে গিরিশ, তোমাকে আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব, অনেকদিন ধরে ভাবছি। তুমি আবার ক্লাসিকে ফিরে এলে কোন মুখে? থিয়েটারের নট-নটীদের কি মানসম্মান থাকতে নেই! ক্লাসিকের মালিক এই অমর ছোঁড়াটার সঙ্গে তোমার মামলা মোকদ্দমা হল, সে তোমায় কত গালমন্দ করল, কত কুচ্ছিত কটুকাটব্য, কাদা ছোঁড়াছুড়ি, এখন দেখছি দুজনে আবার বেশ গলাগলি!
গিরিশ বললেন, কী করব, অমর নিজেই মামলা তুলে নিল, আমার বাড়িতে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল।
মহেন্দ্রলাল বললেন, তার এত দেমাক, তবু সে ক্ষমা চাইতে গেল কেন হঠাৎ!
গিরিশ বললেন, আমার কাছে তার সব দেমাক চূর্ণ হয়ে গেছে। আমার বাড়িতে গিয়ে যখন কান্নাকাটি করতে লাগল, তখন আমি বললুম, শুধু চুপিচুপি আমার বাড়িতে এসে ক্ষমা চাইলে তো হবে না, পাঁচজনকে জানাতে হবে। সর্বসমক্ষে ক্ষমা চাইতে হবে। তখন সে হ্যাঁন্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করলে। পাছে সে আবার ভুলে যায়, সেইজন্য ওই দ্যাখো দেওয়ালে সেই একখানা হ্যাঁন্ডবিল সেঁটে রেখেছি।
বড় বড় অক্ষরে মুদ্রিত হ্যাঁন্ডবিলটিতে লেখা রয়েছে : নাট্যামোদী সুধীবৃন্দকে আনন্দের সঙ্গে জানাইতেছি যে, নটকুলচূড়ামণি পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের সহিত আমাদের সকল বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়া গিয়াছে। বাংলায় যে কয়েকটি স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হইয়াছে, সকলগুলিরই সৃষ্টিকর্তা শ্রীযুক্ত গিরিশ্চন্দ্র! প্রায় সকল অভিনেতা ও অভিনেত্রীই গিরিশচন্দ্রের শিক্ষায় গৌরবান্বিত! তাহার মধ্যে আমি একজন। গিরিশবাবুর সহিত বিবাদ করিয়া, নিতান্তই ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়াছিলাম–বড়ই সুখের বিষয়, সমস্ত মনোমালিন্য অন্তর হইতে মুছিয়া ফেলিয়া, তাঁহার স্নেহময় কোলে আমাকে আবার টানিয়া লইয়াছেন।…
গিরিশচন্দ্র বললেন, কেন অমর আমার কাছে ক্ষমা চাইতে গেল, তা নিয়ে আমার মনেও খটকা ছিল। আসল কারণটি পরে জেনেছি। একটি মেয়ে তাকে জোর করে পাঠিয়েছিল।
মহেন্দ্রলাল বললেন, মেয়েমানুষের কথা পুরুষে শোনে? এ তো বড় তাজ্জব ব্যাপার। বউ নয় নিশ্চয়, বাঙালি ব্যাটাছেলেরা তো বউদের গ্রাহ্যই করে না। বউদের লাথি-ঝাটা মেরে বীরত্ব ফলায়। কোনও পেয়ারের মাগি বুঝি?
গিরিশচন্দ্র বললেন, না, তাও নয়। সে বেটি এই থিয়েটারেরই একজন অ্যাকট্রেস। তুমি নাম শুনলেই চিনবে। সে বড় আজব চিড়িয়া। আমি এত বছর ধরে থিয়েটারের কত মেয়েমদ্দকে চরিয়েছি, এমনটি কখনও দেখিনি। তার রূপ-যৌবন আছে, তবু সে কারুর রক্ষিতা হয় না। কোনও পুরুষের সঙ্গে ঢলানি করে না। অথচ তার কী তেজ! সে অমরকে বলেছিল, গিরিশবাবুকে অপমান করার ফলে ক্লাসিকের স্টেজ অপবিত্র হয়ে গেছে, সে নিজেও এখানে আর পা দেবে না। যতদিন আমি বাইরে ছিলাম, সেও অ্যাক্টিং করেনি, বাড়িতে বসে ছিল। তাতেই অমরের টনক নড়ল, টিকিট বিক্রি কমে আসছিল। সেই মেয়েটার জেদের জন্যই অমর ছুটে গেল আমার কাছে।
দীনেন্দ্র বলল, ওদিকে মিনার্ভার মালিকের সঙ্গেও তো আপনার আর বনছিল না। মিনার্ভার তখন পড়তি অবস্থা।
মহেন্দ্রলাল বললেন, সে মেয়েটি কে? শুনি, শুনি।
গিরিশ বললেন, তাকে ডাকব? দেখি ইতিমধ্যে সে বাড়ি চলে গেছে কি না। ওরে কে আছিস, একবার নয়নমণিকে এখানে আসতে বল তো!
নয়নমণি ততক্ষণে মেক আপ ধুয়ে, বসন বদল করে বাড়ি যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল, লোকজনদের হাঁকডাকে তাকে ফিরতে হল। গিরিশচন্দ্রের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়াল, শরীরে একটিও অলঙ্কার নেই, সাধারণ শাড়ি পরা। এখন তাকে মঞ্চনটী বলে মনে করার কোনও উপায় নেই।
দীনেন্দ্র বলল, এ তো দুর্দান্ত অভিনয় করে, আজকের নাটকেও ফাটিয়েছে!
মহেন্দ্রলাল চশমা খুলে নয়নমণির সর্বাঙ্গ ভাল করে দেখলেন। তারপর কপট বিষাদের সঙ্গে বললেন, আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। তবু এমন রমণীরত্ন দেখলে আবার বিয়ে করতে ইচ্ছে করে। সে কী আর আমার অদৃষ্টে আছে! কী গো, এই বুড়োকে বিয়ে করবে?
নয়নমণি ফিক করে হেসে বলল, হ্যাঁ। রাজি আছি।
মহেন্দ্রলাল ভুরু তুলে বললেন, অ্যাঁ রাজি? মন্তর পড়ে তো আর বিয়ে করতে পারব না। বাড়িতে একখানা জাঁহাবাজ গিন্নি আছে, সে ঝাটাপেটা করবে। তাহলে বলো, দমদমের দিকে একটা বাগানবাড়ি কিনি, সেখানে গান্ধবর্মতে মালাবদল হোক! কী?
নয়নমণি বলল, তাতেও রাজি!
মহেন্দ্রলাল সগর্বে গিরিশের দিকে তাকিয়ে বললেন, তবে? তবে? তুমি যে বললে, ও কারুর সঙ্গে থাকতে রাজি হয় না!
গিরিশ বললেন, তুই যে আমাকে ডোবালি নয়ন! শুনেছি এতকাল ধরে কোনও পুরুষকেই তোর পছন্দ হয়নি। আর আজ এই বুড়োকে দেখে তোর মন মজে গেল? তুই ওঁকে চিনিস? টান মার
নয়নমণি বলল, ওঁকে কে না চেনে? উনি যেনি থিয়েটার দেখতে আসেন, সবাই তটস্থ হয়ে থাকে, কারুর অ্যাক্টিং-এ সেদিন খুঁত থাকে না। ওঁর মতন এমন বিরাট মানুষ তো আর কেউ আমার মতন সামান্য মেয়েকে আগে চাননি!
মহেন্দ্রলাল ডান বাহু ভাঁজ করে মাল টিপে বললেন, এখনও তাগদ আছে। ইচ্ছে করলে এই বুড়ো হাড়েই ভেলকি দেখাতে পারি, বুঝলে গিরিশ! তা হলে ওইটাই ঠিক থাকল তো?
নয়নমণি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
দীনেন্দ্রকুমার প্রাণ খুলে হাসছেন।
মহেন্দ্রলালও এবার হাসতে হাসতে বললেন, এ বেটির রসবোধ আছে। আমার কথা শুনে প্রথমেই চক্ষু ছানাবড়া করেনি! হাঁ গা, গিরিশবাবুর হয়ে তুমি নাকি অমরবাবুর সঙ্গে ঝগড়া করেছিলে? থিয়েটারের নট-নটীদের মধ্যে এমন গুরুভক্তির কথা তো আগে কক্ষনও শুনিনি!
গিরিশ বললেন, আমি ওর তেমন গুরুও নই। ও অর্ধেন্দুর হাতে গড়া।
নয়নমণি বলল, আপনি সকলের গুরু।
মহেন্দ্রলাল বললেন, থিয়েটারের মেয়েদের নিয়ে কত লোকে এখনও কত কুকথা বলে। অথচ এমন মেয়েও তো আছে! অভিনেত্রী হলেই কদর্য জীবন যাপন করতে হবে কেন? বিদ্যেসাগরমশাই বেঁচে থাকলে এই নয়নমণিকে একবার তাঁর সামনে নিয়ে গিয়ে দেখাতুম!
গিরিশ বললেন, এ মেয়েটাকে এত প্রশংসা করবেন না। ওর দোষও আছে। ওর সামনে একটু মুখ আলগা করার উপায় নেই। আমাদের শকার বকার করা বরাবরের অভ্যেস, যখন তখন মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। ভাল করে ধাতানি না দিলে এখানে অনেকে বোঝেও না। নয়নমণির সামনে একটু মুখ খিস্তি করলেই ও মুখ ভার করে উঠে যায়। রিহার্সালও দিতে চায় না। ওকে বুঝিয়ে দাও যে থিয়েটারের অন্দরমহলটা বেহ্মদের আখড়া নয়!
মহেন্দ্রলাল বললেন, এটা ওর দোষ হল!
গিরিশ বললেন, ওর আর একটা দোষ, ও পুরুষদের সঙ্গে মেশে না, মেয়েদের নিয়ে ঘোঁট পাকায়। অন্য কোনও মেয়েকে বকাবকি করলেও নয়নমণি আগ বাড়িয়ে এসে বলে, কেন, কেন, ও কী অন্যায় করেছে? একদিন অমর গুলফম হরিকে একটা থাবড়া মেরেছিল। মাঝে মাঝে এক কথা সাতবার বললেও না বুঝলে মেজাজ ঠিক রাখা যায় না। আমিও দু-একটা চড় থাপ্পড় মারি। নয়নমণি তাতেই গোঁসা করে বসল। মেয়েছেলের গায়ে কেন হাত তোলা হয়েছে? বোঝে মজা, থাবড়া খেল গুলফম হরি, সে রাগ করল না, কিন্তু এই নয়ন বেঁকে বসে থাকল, সেদিন সে স্টেজে নামবে না।
লি মহেন্দ্রলাল মাথা নেড়ে বললেন, হুঁ, এটাও একটা দোষের কথা বটে!
গিরিশচন্দ্র বললেন, সেদিনের শো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নয়নমণি না থাকলে দর্শক খেপে যাবে। আমি যত বোঝাই কিছুতে শোনে না। শেষ পর্যন্ত অমরকে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে
দীনেন্দ্রকুমার বললেন, শুনে ভারী আশ্চর্য লাগছে। অমরেন্দ্রনাথকে দর্পী মানুষ বলেই সবাই জানে। কথায় কথায় কতজনকে তাড়িয়ে দেয়। অনেক সামান্য কারণে নাম করা নট-নটীদের দূর করে দিয়েছে। তবু সে নয়নমণির কথা বারবার শোনে কেন!
গিরিশ বললেন, এ মেয়েকে যে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা উচ্চারণও করা যায় না। নিজে থেকেই বার বার বলে, চলে যাব, চলে যাব! যে শাস্তির ভয় পায় না, তাকে শাস্তি দেওয়া বড় শক্ত!
মহেন্দ্রলাল উঠে এসে নয়নমণির থুতনি ধরে উঁচু করে বললেন, তোর তো দেখছি অনেক দোষ। তুই থিয়েটারে কেন যোগ দিতে এলি পাগলি? তোর তো যোগিনী সন্ন্যাসিনী হওয়ার কথা ছিল!
নয়নমণি কপালে একটা আঙুল ছুঁয়ে নম্র কণ্ঠে বলল, নিয়তি আমাকে এখানে টেনে এনেছে।
মহেন্দ্রলাল বললেন, হয় তোর জেদের জন্য এই থিয়েটারের ভেতরকার পরিবেশ পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, নয়তো তুই আর বেশিদিন এখানে টিকতে পারবি না। আর একদিন এসে তোর নিয়তির গপ্পো শুনব। এখন আর দেরি করতে পারছি না, বাড়িতে গিয়ে গাদাগুচ্ছের ওষুধ খেতে হবে। কই হে দীনু, চলো এবার।
গিরিশও উঠে এলেন মহেন্দ্রলালকে খানিকটা এগিয়ে দেওয়ার জন্য।
ফাঁকা মঞ্চটা পার হয়ে সামনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলেন মহেন্দ্রলাল। তাঁর হাতের ছড়িটা খসে পড়ল, ধপ করে বসে পড়ে তিনি জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন।
কী হল, কী হল, বলে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেল। ছুটে এল আরও অনেকে। কেউ বলল, শুয়ে পড়ন! কেউ বলল, ডাক্তার ডাক। কেউ বলল, অমরবাবুকে খবর দে।
চক্ষু মুদে রয়েছেন মহেন্দ্রলাল। নিজের বুকে হাত বুলোচ্ছেন। নিশ্বাস পড়ছে হাপরের মতন। একটু পরে চক্ষু খুলে দম নিতে নিতে বললেন, ডাক এসে গেছে বুঝতে পারছি। শরীর আর বইছে না।
গিরিশ বললেন, সারাটা জীবন অন্য মানুষদের জন্য হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে গেলে, নিজের শরীরটার দিকে নজর দাওনি। এত রাত্তিরে তো ডাক্তার পাওয়া যাবে না, তুমিই বলে দাও, এখন কী করা উচিত। এই অবস্থায় কি বাড়ি ফেরা ঠিক হবে?
নয়নমণি মহেন্দ্রলালের পায়ের কাছে বসে পড়েছে।
তার দিকে চেয়ে, এই অবস্থাতেও হাসার চেষ্টা করে মহেন্দ্রলাল বললেন, ব্যথা হচ্ছে আমার বুকে, তুই আমার পা টিপে কী করবি? তাতে কিছু সুরাহা হবে?
নয়নমণি বলল, আপনি কত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আমরা আপনার একটু সেবা করতে পারি না?
মহেন্দ্রলাল বললেন, আমি কারুর সেবা চাই না। আমি যখন মরব, তখন কোনও নিরালা নির্জন স্থানে একা গিয়ে শুয়ে থাকব। কেউ জানবে না। মানুষের কান্নাকাটি, আহা-উঁহু, ফোঁসফোঁসানি আমি সহ্য করতে পারি না একেবারে!
কোনওক্রমে তিনি আবার উঠে দাঁড়ালেন। ছড়িতে ভর দিয়ে খানিকটা টলমলভাবে এগিয়ে গেলেন বাইরের দিকে।