৭০
টাকা আসছে। খুব ধীরে আসছে। কিন্তু আসছে ঠিকই। বড়লোকদের যেমনধারা আসে তেমন নয়। কিন্তু গরিবদের মতো করেও তো টাকার আনাগোনা আছে। কাকার কাছ থেকে বাড়তি এক হাজার টাকা পাচ্ছিল বীণা। গত মাসে কাকা সেটা একশো টাকা বাড়িয়ে দিল। বলতে নেই, কাকারও দিনকাল ভাল। চোরাপথে ব্যবসার টাকা তো আছেই, বিশ্ববিজয় অপেরার বুকিংও বড় কম হচ্ছে না। খুব নামডাক চারদিকে। বীণার মাইনে সেখানেও কিছু বেড়েছে। টাকা বেশ কিছু জমে গিয়েছিল বীণার হাতে। শ্বশুরবাড়িতে টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে অনেকদিন। নিমাইকে আর টানতে হচ্ছে না। এই টাকা দিয়ে সে ঘরের মেঝেটা বাঁধিয়ে নিয়েছে। খুব পোক্ত একটা স্টেনলেস স্টিলের বাক্সের মধ্যে প্লাস্টিকে নিচ্ছিদ্র করে ডলার আর পাউন্ডগুলো বেঁধে সে মেঝের অনেক গভীরে পুঁতে দিয়েছে। মেঝে বাঁধানোর পর হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সে। পাকা বন্দোবস্ত হয়ে রইল—ব্যাঙ্কের ভল্টের মতো। পাকা মেঝের তলা থেকে তো আর কেউ বের করতে পারবে না সহসা, না জানলে। বীণা ভেবে দেখেছে, ওই ডলার আর পাউন্ড এখন তার কাজে লাগবে না। দরকারও নেই। ওটা ভবিষ্যতের জন্য থাক।
এই ভবিষ্যৎ কথাটা নিয়ে বীণা আজকাল খুব ভাবে। তার ভবিষ্যৎ কী? নিমাইয়ের সঙ্গে যুতে থেকে তার জীবনটা একরকম নষ্ট হচ্ছিল। আর ওই অলস লোকটাও হয়ে যাচ্ছিল অকেজো। বিদেয় হয়ে ভালই হয়েছে। এখন বীণাও স্বাধীন নিমাইও স্বাধীন। কিন্তু তবু বীণা একটা ভবিষ্যৎ দেখতে চায়। কলকাতার বড় দল বা সিনেমায় সে কি কখনও ডাক পাবে? তার মুখ কি কখনও দেখা যাবে দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে? নাম বেরোবে কি কাগজে? ভবিষ্যৎ বলতে সে এসবই বোঝে। ঘরসংসার নয়, ছেলেপুলে নয়, তার ভবিষ্যৎ হবে ওরকমই কিছু। যদি ততটা নাও হয়, ক্ষতি নেই। খানিকটা সে এগিয়েছে, আরও অনেকটা নিশ্চয়ই এগোবে। বয়স এসে ধরার আগেই সে আরও একটু এগোতে চায়।
সুন্দরবনে এক জায়গায় পালা ছিল। মেলা লোক হল আসরে। পালা জমেও গেল খুব। বীণাপাণির ওপর সেদিন যেন কিসের ভর হয়েছিল। এত ভাল পার্ট করল আর এমন গান গাইল যে আসর মাত।
সেই রাতে পালার শেষে কাকা অবধি মুগ্ধ। আঙুল থেকে আংটি খুলে তাকে দিয়ে বলল, নাও বীণা, আজকের জন্য তোমার প্রাইজ।
বীণার সেদিন হাসি আর কান্না একসঙ্গে পাচ্ছিল। এত আনন্দও আছে জীবনে! আংটিটা দু-হাতের অঞ্জলিতে নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে কাকাকে বলল, তোমার মুখ থেকে যা শুনলাম সেইটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাইজ। আংটিটা ফেরত নাও কাকা।
দেওয়া জিনিস কেউ ফেরত নেয়?
নাও, এটা তোমার কোন গ্ৰহবৈগুণ্যের জন্য তোমার বউ বানিয়ে দিয়েছিল। এ আমি নিতে পারব না। এটা পরার পর থেকেই তোমার উন্নতি হচ্ছে।
আরে, তাতে কি? আবার একটা বানিয়ে নেবোখন।
না কাকা, আংটিটা পরে থাকো। তুমি বেঁচে থাকলেই আমরা অনেকে বাঁচবো।
দোনোমোনো করে কাকা আংটি ফেরত নিল, কিন্তু তার বদলে কড়কড়ে দুশো টাকা দিল তাকে। বলল, এটাই রাখো তা হলে। প্রাইজ।
বীণার সঙ্গে কাকার সম্পর্কটা খুব ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। তবে খারাপ কিছু নয় এখনও। একবার দলের পাপিয়া নামে একটা মেয়ে তাকে বলেছিল, ও বীণাদি, তুমি কাকাকে বিয়ে করো না কেন?
বীণা অবাক হয়ে বলে, বিয়ে! কী বলছিস? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
আলটপকা বলে ফেললাম বলে রাগ কোরো না। কিন্তু হলে কি খারাপ?
আমার একজন বর আছে। অপদার্থ হলেও আছে। কাকারও বউ আছে। তার চেয়ে বড় কথা আমাদের সম্পর্ক ওরকম নয় মোটেই। তোরা বুঝি এসব নিয়ে আড়ালে আলোচনা করিস?
পাপিয়ার মুখ একটু শুকিয়ে গেল। সে জানে, বিশ্ববিজয় অপেরায় এখন ক্ষমতার দিক দিয়ে কাকার পরেই বীণাপাণি। বীণাপাণি ইচ্ছে করলেই তাকে দলছাড়া করতে পারে। সে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, কী জানো, আমি ভাবি তোমার আর কাকার জোড় হলে খুব ভাল হত। দুজনে যেন দুজনের জন্যেই জন্মেছে।
বীণাপাণি রাগ করেনি। সে জানে, পুরুষদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে এই যাত্রা করে বেড়ানো, এর জন্য কানাঘুষো হয়েই থাকে। ওসব গায়ে মাখতে নেই। সে একটু হেসে বলল, মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু, জানিস তো? একটু মেলামেশা হলেই কত কী ভেবে নেয় মেয়েরা। হ্যাঁ রে, মেয়েদের স্বাধীনতার কথা যে এত শোনা যায় সেটা কি তবে একটা হুজুগমাত্র? কাকার সঙ্গে আমার মেলামেশাটা কি বন্ধুর মতো হতে পারে না?
তা তো পারেই।
তা হলে হঠাৎ বিয়ের কথা ওঠে কেন? বিয়েটা কোন্ স্বর্গবাস বল ত! বিয়ে ছাড়া মেয়েদের বুঝি আর কাজ নেই?
আমার ভুল হয়েছে বীণাদি। রাগ কোরো না।
বীণাপাণি বিষণ্ণ গলায় বলল, এইটুকু বয়সে, ভাল করে জ্ঞান হওয়ার আগেই আমার বাবা কোথা থেকে একটা লোক ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দিল। তার ফলটা কী হল বল তো! ক’টা হাত-পা গজাল আমার? কোন্ আনন্দে ছিলাম? বিয়ের কথা শুনলেই তাই আমার পিত্তি জ্বলে যায়। আর তোরাও হয়েছিস তেমনি, বিয়ের জন্য ল্যাল্যা করে বেড়াস। যেন বিয়ে হওয়া মানেই মোক্ষলাভ।
ভুল হয়েছে বীণাদি। মাপ করে দাও।
এ কথা ঠিক যে বীণা সত্যিই আর ঘরসংসারের কথা ভাবে না। নিমাইকে ছেড়েছে বলে যে আর একজন পুরুষের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে এমনটাতেও সে বিশ্বাস করে না। কিন্তু আবার এ কথাও ঠিক যে, তার আজকাল এক এক সময়ে বড় ফাঁকা আর একা লাগে। মাঝে মাঝে অম্বলের ব্যথায় সে ঘুমোতে পারে না বলে রাতে জেগে শুয়ে শুয়ে বড় নিঝুম বোধ করে। মনে হয়, তার বুকের ভিতরেও যেন অন্ধকার, ঝিঝি ডাকছে, হাহা করে পাগলা বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
বর্ষার শুরুতেই জ্বর হল বীণার। শুরুতেই একশো দুই। পরদিন জ্বর ঠেলে উঠল চারে। সঙ্গে কয়েকবার বমি আর দাস্ত। দুদিন জ্বর নিয়েও সে উঠে সব পরিষ্কার করতে পারল। তৃতীয় দিনে বড্ড কাহিল হয়ে পড়ল শরীর। পড়শী এক ডাকের মাসি এসে দেখে-টেখে বলল, এ জ্বর কিন্তু ভোগাবে।
কী করি বলল তো!
ডাক্তার ডাকিনি?
না, কে ডাকবে? দুদিন তো কাউকে খবরও দিতে পারিনি। আজ তুমি এলে।
ডাক্তার ডাকা তো আর শক্ত কাজ নয়। অধীরকে গিয়ে পাঠাচ্ছি বৃন্দাবন ডাক্তারকে ডেকে আনতে। কিন্তু তোর যে এখন কাছে থাকার লোক চাই।
কাকাকে একটা খবর পাঠাবে? তা হলে দলের কোনও মেয়েকে পাঠিয়ে দেবেন। কুসুমের কথা বোলো। কুসুম এলে ভাল হবে।
তাই হবে মা। মাথাটা ধুইয়ে দিয়ে যাই। উঃ, এ যে অনেক জ্বর।
বৃন্দাবন ডাক্তার এল। দেখেটেখে বলল, টাইফয়েড বলেই তো মনে হচ্ছে। কয়েকদিন দেখা যাক, তারপর ক্লোরোমাইসিটিন দেওয়া যাবে।
বীণা একটু অস্থির হয়ে বলল, এখনই সারিয়ে দিন ডাক্তারবাবু। আমার যে অনেক কাজ।
কাজ বললেই শুনছে কে? প্রধানমন্ত্রীর তো তোমার চেয়েও অনেক বেশি কাজ, তাই বলে কি অসুখ হলে তাঁকে শুয়ে থাকতে হয় না?
আমি যে একা। কে সামলাবে সব?
সেটা তো বলতে পারি না। আর একাই-বা কেন? নিমাই কোথায় গেছে?
সে এখন এখানে থাকে না।
অ। তাই তাকে দেখি না আজকাল। কোথায় থাকে এখন সে!
কাঁচড়াপাড়ায়, দোকান দিয়েছে।
যাক, একটা হিল্লে হয়েছে তা হলে! শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াত, দেখে ভারি কষ্ট হত। দোকান দেওয়ার ভারি শখ ছিল।
কুসুম এল বিকেলের দিকে।
কী হল বীণাদি?
ডাক্তার বলছে টাইফয়েড।
ও বাবা!
ভয় পেলি নাকি?
কুসুম একগাল হাসল, আমার আবার ভয়! বাবার ক্যান্সার হয়েছিল, টানা ন’মাস সেবা করেছি। গু-মুত ঘেঁটে আমার অভ্যাস আছে।
সেইজন্যই তো তোকে ডাকা। শোন, বাড়িতে বলে আয়। কয়েকটা দিন আমার কাছেই থাকবি। পারবি তো?
বলেই এসেছি। তোমার চিন্তা নেই।
পারুলদের বাড়িতে একটা তক্তাপোশ পড়ে আছে, ব্যবহার হয় না। ওটা আজই ওরা পৌঁছে দেবে। ওটাতেই শুবি।
তক্তাপোশের কী দরকার ছিল? তোমার তো পাকা মেঝে। এখানেই শুতে পারতাম।
পাকা মেঝে মানে কি আর তেমন কিছু? ড্যাম্প আছে।
জ্বরটা দুপুরের পর এত বাড়ল যে বীণাপাণি একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গেল। ডুবে গিয়ে একটা স্বপ্নের মতো কিছু দেখল। দেখল, বিশাল একটা রেস্টুরেন্টে বসে সে খুব চপ কাটলেট যাচ্ছে। টেবিলে অনেক খাবার। এত খেয়ে শেষ করতে পারবে না।
কে যেন পিছন থেকে বলে উঠল, খাও খাও। খুব খেয়ে নাও, পয়সা লাগবে না। আমাকেও তো অনেক খাইয়েছে।
মুখ ঘুরিয়ে সে নিমাইকে দেখতে পেল। কিন্তু স্বপ্নের চেহারাও অনেক বদলে যায়। এ নিমাই বেশ লম্বা, ভাল স্বাস্থ্য, ফসাও। তবু নিমাই বলে ঠিকই চিনল সে। বলল, শোধ দিচ্ছো নাকি?
জিব কেটে নিমাই বলে, আরে ছি ছি। তোমার ঋণ কি শশাধ করা যায়? তবে আমি নিমকহারাম নই।
তুমি পয়লা নম্বরের নিমকহারাম।
হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই নিমাই এক কাপ আইসক্রিম তার মাথায় উপুড় করে দিল।
বীণা চমকে উঠে বলে, করলে কি? চুলে যে আঠা হয়ে যাবে! আমাকে পালায় নামতে হবে না?
মাথাটা গরম হয়েছে তোমার। ঠাণ্ডা করে দিচ্ছি।
মাথায় সত্যিই ঠাণ্ডা টের পেয়ে চটকা ভাঙল বীণার। টের পেল কুসুম তার মাথায় জল ঢালছে।
কী করছিস রে কুসুম?
মাথা ধুইয়ে দিচ্ছি। জ্বরটা যে বড্ড উঠেছে। ভুল বকছো।
ভুল বকছি? কী বলছিলাম?
কি সব হাবিজাবি। কাকে যেন নিমকহারাম বলে গাল দিচ্ছিলে।
প্রচণ্ড মাথা ধরা, শরীরের প্রগাঢ় দুর্বলতা সত্ত্বেও একটু হাসল বীণাপাণি। বলল, কাকে গাল দিচ্ছিলাম রে? জ্বরের ঘোরে মুখ ফসকে কত কথা বেরিয়ে যায়।
কী খাবে বলল তো!
খাওয়া! ও নামও উচ্চারণ করিসনি। বমি পায়।
ডাক্তার কী বলে গেছে জানো? ঠেসে খাওয়াতে। ভাত অবধি। জন্মে শুনিনি জ্বর হলে কাউকে ভাত দেওয়া হয়। আজকাল সব নিয়ম উলটে যাচ্ছে।
স্নিগ্ধ জলের ধারায় বড় আরাম পাচ্ছিল বীণাপাণি। চোখ বুজল। ঘুম পাচ্ছে।…
ওমা, এ কি তোমার বউ নাকি?
নিমাই খুব লাজুক হাসি হেসে বলল, ওই আর কি।
তার মানে?
করে ফেললাম বিয়ে। করতেই হত তো : আমার বিরাট ব্যবসা, ওদিকেই পড়ে থাকতে হয়, যত্নআত্তি কে করে বলো!
জ্বলে গেল বীণাপাণি। তবু বলল, খুব বীরত্বের কাজ করেছে তো! তা অমন একগলা ঘোমটা কেন? ঘঘামটা সরিয়ে মুখখানা একটু দেখাও।
নিমাই শশব্যস্তে বলল, দেখর মতো নয়। খেঁদিবুঁচি চেহারা। একেবারেই সাদামাঠা। তোমার ধারেকাছে নয়।
আমাকে কি কোনওকালে সুন্দর দেখেছো তুমি?
ও বাবা! তুমি সুন্দর নও? অমন মুখচোখ, অমন শরীর ক’টা মেয়ের আছে?
থাক, আর খোসামোদ করতে হবে না। ঘোমটাটা খোলো, মুখটা দেখি।
দেখলে তোমার খারাপ লাগবে। ট্যারা, দাঁত উঁচু, কালো।
তাই তো হওয়ার কথা। তোমার কি আর ভাল জুটবে? দোজবরে, তার ওপর অপদার্থ।
ঠিকই বলেছে। আমার মতো মানুষের তত তোমার মতো বউ হওয়ার কথা ছিল না। এ তোমাকে বরং একটা প্রণাম করুক। শত হলেও তুমি সম্পর্কে বড়।
বউটা ঢিপ করে একটা প্রণাম করেও ফেলল।
একটু পিছিয়ে গেল বীণাপাণি। বউটা যখন উঠে দাঁড়াল, তখন ঘোমটা সরে গেছে। বীণাপাণি অবাক হয়ে দেখছিল, টুকটুকে ফসা ভরাট লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো একখানা মুখ। দুখানা বড় বড় চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।
বীণাপাণি অবাক হয়েই বলে, এ তো ভীষণ সুন্দর! একে পেলে কোথায়?
চারশো বিশটা অমায়িক গলায় বলল, তুমি নিজে সুন্দর বলেই ওকে সুন্দর দেখছে।
তোমার কাছে সত্যি কথা শুনব না এ তো জানিই। কিন্তু কাঁদছে কেন?
ওকেই জিজ্ঞেস করো।
বীণাপাণি মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল। মুখটা চেনা ঠেকছে কেন? খুব যেন চেনা।
ও মেয়ে, কাঁদছো কেন?
মেয়েটা বলল, আপনি আমাকে মাপ করুন।
গলার শব্দটাও যেন কোথাও শুনেছে বীণা! চেনা, অথচ ধরা যাচ্ছে না।
আমি মাপ করলুম, কিন্তু যার গলায় ঝুললে টের পাবে কেমন মানুষ।
বউটা আরও কেঁদে উঠে বলে, ও কথা বলবেন না। ওঁর মতো মানুষ হয় না। সাক্ষাৎ দেবতা।
বীণা ফুঁসে ওঠে, দেবতা! দেবতা! পুরুষকে দেবতা বানিয়ে বানিয়েই তো নিজেদের বারোটা বাজালে। ওরা দেবতা নয়, হনুমান। তুমি একটি হনুমানের গলায় মুক্তোর মালা। বুঝলে! কিন্তু হনুমান তো মুক্তোর মর্ম বুঝবে না, চিবিয়ে দেখবে, টানাহ্যাচড়া করবে, তারপর ছিঁড়ে ফেলে দেবে একদিন। অমন দেবতার মুখে আগুন।
আপনি কেন পুরুষদের ওপর এত রেগে আছেন দিদি?
দিদি! খবরদার আমাকে দিদি ডাকবে না। এমনি ডাকতে পারো, কিন্তু বড় সতীনকে ছোট সতীন যেমন দিদি ডাকে তেমন ভেবে নয়। বুঝলে? বরং বীণাদি ডাকবে। আচ্ছা, তোমাকে কোথায় দেখেছি, বলো তো?
আমাকে।
ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। একেই বা জোটালে কী করে?
মেয়েটা জবাব দিল না, মুখ নিচু করে পায়ের নখে মাটি খুঁড়ছে।
খুব লাজুক বুঝি তুমি?
মেয়েটা বিষণ্ণ মুখখানা তুলে বলে, লজ্জাই তো ললনার ভূষণ!
তাই বুঝি? তবে আমি তো একদম ভূষণহীনা। আমার একটুও হায়া লজ্জা নেই। কেন, ও বলেনি তোমাকে?
না, তেমন কিছু বলেনি।
ওর যে একটা বউ আছে বা ছিল সেটা বলেছে তো! নাকি সেটা চেপে রেখে বিয়ে করেছে তোমাকে?
সব বলেছেন। কিছু লুকোননি।
যাক, তা হলে একটু সৎ সাহস এখনও আছে। তবে ভাজা ভাজা করে ছাড়বে, দেখো।
নিমাই মিটি মিটি হাসছে। রাগটাগ কিছু নেই মুখে।
আসল শয়তান কারা হয় জানো? যাদের মাথা সবসময়ে ঠাণ্ডা, হাসি-হাসি মুখ, আর মনে জিলিপির প্যাঁচ। ওকে বাইরে থেকে দেখ, কেমন ভালমানুষটি!
দিদি, পায়ে ধরি, ওঁকে নিয়ে ওরকম বলবেন না।
কেন বলব না?
শুনলেও যে আমার পাপ হবে।
আহা ন্যাকা, তোমার পাপ হতে যাবে কোন দুঃখে? শয়তানকে শয়তান বলাই তো ভাল।
উনি যে ভীষণ ভাল লোক।
ছাই ভাল। কতদিন ঘর করেছে?
বেশি দিন নয়। কিন্তু বোঝা যায়।
সজোরে মাথা নেড়ে বীণা বলে, কিছু বোঝা যায় না। আমারই বুঝতে কতদিন সময় লাগল। আচ্ছা, তোমার গলার স্বরটা কোথায় আগে শুনেছি বলো তো!
জানি না তো!
তোমাকে দেখেছি বলেও যে মনে হচ্ছে।
নিমাই হঠাৎ খুব হাসতে লাগল।
তুমি হঠাৎ হাসছো কেন?
চিনতে পারলে না?
না, কে ও?
ভাল করে দেখ।
দেখলাম তো!
তবু পারছে না!
না তো!
তোমার চোখ নেই। নইলে চিনতে দেরি হয়?
বলেই ফেল না।
এ তো বীণা।
তার মানে?
বীণাপাণি। বিষ্ণুপদ বিশ্বাসের মেয়ে। গাঁ শীতলাতলা বিষ্ণুপুর।
বীণা স্তম্ভিত হয়ে বলে, কী যা তা বলছে? মাথা খারাপ হল নাকি?
খুব হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে নিমাই।…
বীণা চোখ মেলে চায়। কপাল ভেজা। বোধ হয় জলপটি দেওয়া হচ্ছে। ঘর একটু আবছা অন্ধকার। বিছানার পাশে দুজন লোক দাঁড়ানো।
কে?
আমি—আমি কাকা।
ও। কখন এলে?
একটু আগে। জ্বরটা কি করে বাঁধালে?
ডাক্তার বলছে টাইফয়েড। কী হবে বলো তো!
কিসের কী হবে? জ্বরজারি তো মানুষেরই হয়।
আমার যে রিহার্সাল চলছে।
কাকা আবার হাসল, প্রাণটা তো আগে। তারপর নাটক। কয়েকটা দিন রিহার্সাল বাদ দিলে কোনও ক্ষতি হবে না।
আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।
নাটক-নাটক করে আমিই পাগল বলে সবাই জানে। তুমি তো দেখছি আমার চেয়েও আরও এক ডিগ্রি বেশি পাগল।
এ পাশ থেকে কুসুম বলে উঠল, জ্বরের ঘোরে অনেক ডায়লগও ছাড়ছে।
তাই? বলে কাকা আবার হাসল।
অমন হেসো না তো। আমি জ্বলছি নিজের জ্বালায়।
তোমার আবার জ্বালা কিসের? ঝাড়া হাত-পা।
কাকা, তোমাকে একটা কথা বলব?
বলো না!
আমার একটা কাজ করে দেবে?
নিশ্চয়ই।
কাঁচড়াপাড়ায় কাউকে পাঠিয়ে একটা খোঁজ নেবে?
কার খোঁজ? নিমাইয়ের?
হ্যাঁ।
খবর দিতে হবে তো!
না না।
কাকা ফের হাসল। বলল, মেয়েদের তেজ বেশিক্ষণ থাকে না। তাই না? যেই জ্বর হল অমনি সব বাঁধ ভেঙে গেল?
ভ্রূকুটি করে বীণা বলে, একটুও না। আমি মোটেই ওকে খবর দিতে বলিনি।
তবে কী বলছো?
আমি শুধু জানতে চাই—বলে বীণা থেমে গেল। কী জানতে চায় সে? কী জানতে চায়? নিমাই সত্যিই আবার বিয়ে করেছে কি না? করলেই কি? তার কি যায় আসে?
বীণা বলল, থাকগে।
আহা, লজ্জা পাচ্ছো কেন? বলেই ফেল না।
তুমি হাসছো? খুব মজা, না?
মজারই ব্যাপার। তবে আনন্দও হচ্ছে।
কিসের আনন্দ?
কাকা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে, নিমাই বড় ভাল লোক ছিল বীণা।
হঠাৎ এ কথার মানে?
কি করে মানে বলি? মানেটানে জানি না। কথাটা হঠাৎ মনে এল। তোমার যে এখনও নিমাইয়ের ওপর টান আছে এটাতেই আমার আনন্দ।
মোটেই টান নেই।
আচ্ছা, তাই হল। অত উত্তেজিত হয়ো না। নিমাইকে তা হলে খবর পাঠাতে হবে না তো! এখনও ভেবে দেখ।
না, কিছুতেই না।
তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো বীণা। রিহার্সালের জন্য মন খারাপ কোরো না। বর্ষাকালে তো আর বায়না নেই। পালা নামতে দেরি আছে।
আমার তো আরও কাজ আছে।
সেসব আমি সামলে নেবো। ঘরটা বাঁধালে বুঝি? ভাল কাজ করেছে।
কাকা চলে যাওয়ার পর বীণা খানিকক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থেকে বলল, হ্যাঁ রে, কুসুম, তোরা কি আমাকে আর কাকাকে নিয়ে আড়ালে কিছু বলিস?
হঠাৎ ওকথা কেন?
সেদিন পাপিয়া হঠাৎ কেন আমাকে বলল, বীণাদি তুমি কাকাকে বিয়ে করো!
ওসব কথা রাখো তো এখন।
বল না কুসুম, কেন বলল?
কুসুম একটু হেসে বলে, ওই যে সুন্দরবনে কেরোকাঠি না কোথায় পালার পর কাকা তোমাকে হাত থেকে আংটি খুলে দিয়েছিল, সেই থেকে চাউর হয়েছে।
আংটি খুলে দিলে কী হয়?
আহা, আংটি দিয়েই তো শকুন্তলা আর দুষ্মন্তের বিয়ে হয়েছিল, মনে নেই!
বীণা হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজে বলে, ভগবান!