উষাকালে ব্ৰাহ্মমুহূর্তে নিমতলার ঘাটে গঙ্গায় তিনবার ড়ুব দিল নবীনকুমার। হেমন্ত ঋতুর আকাশ পরিচ্ছন্ন, বাতাস উষ্ণ-মধুর, নদীর জল অনাবিল। নবীনকুমার সন্তরণপটু নয় বলে বুকজলের বেশী দূরে যায় না, কাছেই দুলালচন্দ্র প্রহরায় দণ্ডায়মান। তিনবার ড়ুব দেবার পর নবীনকুমার পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে উচ্চারণ করলো, আঃ! তারপর সে চক্ষু মুদে, দুই কর যুক্ত করে সূর্যস্তব পাঠ করতে লাগলো, ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদুৰ্গতিম…।
আজ নবীনকুমারের মস্তক থেকে যেন একটা পাষাণ ভার নেমে গেল, এখন থেকে সে প্রতিশ্রুতিমুক্ত। আজ দ্বিপ্রহরে বাংলা মহাভারতের ১৭শ বা শেষ খণ্ড প্রকাশিত হবে।
মাত্র আট বৎসরের মধ্যে এই বিপুল মহৎ কর্মটি সে শেষ করেছে। এর খরচ সংকুলানের জন্য কলকাতার কিছু সম্পত্তি ও জমিদারির কিয়দংশ বিক্রয় করে দিতে হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে কোনো ক্ষোভ নেই, সে অবিশ্বাসীদের দেখিয়ে দিয়েছে যে সে পারে। বর্ধমানের মহারাজ তার সঙ্গে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন; তাঁর ধনবল, লোকবল অনেক বেশী, তিনিও পণ্ডিতমণ্ডলী নিযুক্ত করে শুরু করে দিয়েছিলেন মহাভারত অনুবাদের কাজ, কিন্তু তিনি পারলেন আগে শেষ করতে?
তীরে উঠে এসে সিক্ত বস্ত্রেই দাঁড়িয়ে নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, দুলাল, তুই আমার কাচে কী চাস, বল?
দুলাল ঠিক বুঝতে না পেরে বললো, আজ্ঞে?
নবীনকুমার আবার বললো, আজ আমি কল্পতরু হবো তোর মন যা চায়, তুই নিঃসঙ্কোচে আমায় বল, তোকে আমি তা-ই দেবো।
দুলাল হাত কচলে বললো, আজ্ঞে, আপনার কাচে আমি আর কী চাইবো, ছোটবাবু, আপনি তো আমার কোনো অভাব রাকেন নি কো!
—তবু তুই কিচু চা আমার কাচে।
—আপনার স্নেহ-ভালোবাসা যা পেইচি তার অধিক আর কী চাইবো, ছোটবাবু।
—দূর বেল্লিক কোথাকার! তোর কোনো সাধ আহ্লাদ নেই? তোর বউ-ছেলের জন্যও যদি কিচু চাস।।
—সবই তো আমাদের দিয়েচেন, ছোটবাবু!
—বরানগরের বাড়িটা তোর ছেলেকে দিলুম।
—আজ্ঞে, না, না, বড়বাবু শুনলে…
—চোপ! আমার কাতার ওপর কতা! ও বাড়ি আজ থেকে তোর ছেলের। বাড়ি ফিরেই লেখাপড়া করে দেবো। কী, খুশী তো?
—আপনি ভিজে কাপড় ছেড়ে নিন।
—বললি না, খুশী কি না? বেওকুফ হাস একবার। তোর দন্তপাটি দেখি। বাঃ, এইতো।
পোশাক পরিবর্তনের জন্য ব্যস্ত না হয়ে নবীনকুমার সেইভাবেই একটুক্ষণ চেয়ে রইলো নদীর দিকে। এদিকটায় কলের জাহাজ আসে না। এত ভোরেও খেয়া নৌকোয় যাত্রী পারাপার চলছে, জেলে ডিঙ্গি থেকে কেউ একজন গাইছে: বাইতে বাইতে জেবন গেল তবু জেবনের মুখ দ্যাখলাম না…
অস্ফুট স্বরে নবীনকুমার বললো, এ পৃথিবীটা বড় সুন্দর, তাই না রে দুলাল?
–আজ্ঞে।
—এই নদীর মতন কালস্রোত বয়ে চলেছে, তার মধ্যে আমরা সবাই এক একজন যাত্রী।
—আজ্ঞে।
—কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো, কেউ জানে না, তবু যতটুকু দেখে যাওয়া যায়…বড় মধুর বড় আশ্চৰ্য, না রে?
—আজ্ঞে।
—শুধু সঙের মতন ঘাড় নেড়ে নেড়ে আজ্ঞে আজ্ঞে করে যাচ্চিস কেন? তোর কিচু নিজের কতা নেই? এ জীবনটা তোর ভালো লাগে না?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, ভালো লাগে।
—মাছ ভাজা ভালো লাগে?
–আজ্ঞে।
—আর ঘোড়ার ডিম? তাও ভালো লাগে না? অপদাৰ্থ কোথাকার! সবই এক রকম ভালো লাগে…কোনো বোধই নেই।
—একটা কতা বলবো ছোটবাবু?
—এতক্ষণ কী শুনতে চাইচি, অ্যাঁ?
—অনেকদিন পর যে আজ আপনি খুব হাসি-খুশী হয়েচেন, এইটে আমার সবচাইতে ভালো লাগচে।
—বটে। শ্মশানের ধার থেকে তুই ঐ কাঙালীগুলোনকে ডাক, ওদের সবাইকে দশটা করে টাকা দোবো।
দুলালচন্দ্ৰ হাঁক দিতেই গণ্ডায় গণ্ডায় কাঙালী ছুটে এসে চিলুবিলু করতে লাগলো। জুড়ি গাড়ি থেকে টাকার থলি এনে নবীনকুমার দুলালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, দে, ওদের টাকা দিয়ে দে, একজনও যেন না ফেরে!
দুলাল বললো, আপনি নিজের হাতে দিন, ছোটবাবু! নিজের হাতে না দিলে দানের পুণ্যি হয় না।
নবীনকুমার অবজ্ঞার সঙ্গে বললো, দূর গরু কোতাকার। আমি কি পুণ্যের জন্য দান কচ্চি? পরকালের জন্য পুণ্য জমাবার কোনো দরকার নেইকো আমার। আমি ওদের দিতে চাই, দিতে আমার ভালো লাগে বলে।
দুলাল যতক্ষণ টাকা বিলি করতে ব্যস্ত রইলো, ততক্ষণ নবীনকুমার মুগ্ধভাবে চেয়ে থাকলো গঙ্গার দিকে। হঠাৎ একসময় তার মনে পড়লো নিজের জননীর কথা। এই গঙ্গা নদীই তো আসছে হিমালয় থেকে। হরিদ্বার ক্ষেত্রে এই নদী সমতলে নেমেছে, সেই হরিদ্বারে এই নদীর তীরেই রয়েছেন তাঁর মা বিম্ববতী। কতদিন সে মাকে দেখেনি!
গৃহে প্রত্যাবর্তন করে বস্ত্র পরিবর্তন এবং জলপান সেরে নেবার পরই নবীনকুমার আবার বেরিয়ে পড়ল। বাদুড়বাগানে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়িতে শেষ খণ্ডের এক কপি সে নিজে পৌঁছে দেবে। আজ অপরাহ্ন মহাভারত সমাপ্তি উপলক্ষে এক বিশেষ সভা হবে, কিন্তু বিদ্যাসাগর সেখানে আসতে পারবেন না। বগি-গাড়ি ওল্টাবার সেই দুর্ঘটনায় তিনি বিশেষভাবে আহত, তাঁর মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে।
বাদুড়বাগানে উপস্থিত হয়ে নবীনকুমার শুনলো বিদ্যাসাগর প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলা এখন চিকিৎসকদের নিষেধ। তবু নবীনকুমার চাইলো একবার শুধু দর্শন করতে। বিদ্যাসাগরের সুহৃদ রাজকৃষ্ণবাবু এবং ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্ৰ অন্যসব দর্শনাথীদের নিরস্ত করেছেন, কিন্তু নবীনকুমার সিংহকে তাঁরা না বলতে পারলেন না।
সাদা চাদর পাতা সাধারণ একটি খাটে বিদ্যাসাগর নিদ্রিত রয়েছেন, ললাটে চিন্তার রেখা, ওষ্ঠীদ্বয় সামান্য কুঞ্চিত। আসবাবহীন কক্ষটিতে শুধু শোনা যাচ্ছে একটি দেওয়াল ঘড়ির টক টক শব্দ। নবীনকুমার তার হাতের গ্রন্থটি রাখলো বিদ্যাসাগরের শয্যার এক পাশে, তারপর একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বলতে লাগলো, আপনার কাছে আমি শপথ করেচিলুম, তা আমি রক্ষা করিচি, আজ থেকে আমি মুক্ত।
তারপর সে এক অভিমানের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বললো, আপনি আমার ওপর সুবিচার করেননি। আপনি আমার কার্যকলাপ দেকেচেন। কিন্তু আমার হৃদয় পরীক্ষা করেননি। বিদায়, গুরুদেব।
নবীনকুমারের সারাদিন কেটে গোল কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে। আকাশে উড্ডীয়মান লঘুপক্ষ বিহঙ্গমের মতন নিজেকে হাল্কা বোধ হচ্ছে। এতবড় একটা কাজ যে সে সত্যিই শেষ করতে পেরেছে এজন্য ঠিক গর্ব নয়, বিস্ময় মিশ্রিত আনন্দ যেন ছড়িয়ে পড়েছে তার সর্বাঙ্গে। অপরাহের সভায় অনেক মাননীয় বক্তা তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং অনুরোধ জানালেন, এরপর পূর্ণাঙ্গ রামায়ণের গদ্যানুবাদে হাত দেবার জন্য। নবীনকুমার জানালো যে শুধু রামায়ণ নয়, হরিবংশ মদ্ভগবৎ গীতা এবং অন্যান্য আরও অনেক গ্ৰন্থ বাংলায় প্রকাশের বাসনা তার আছে। অনুবাদক পণ্ডিতদের শাল-দোশালা, পিত্তলের কলসী এবং স্বর্ণ মুদ্রা উপহার দেওয়া হলো। সভা শেষ হলো সাতটার তোপধ্বনি শুনতে পাওয়ার পর।
অতিথিরা সকলে চলে যেতেই নবীনকুমার অকস্মাৎ খুব নিঃসঙ্গ বোধ করলো, এরপর সে কী করবে? শুধু মহৎ আদর্শ আর সাধুবাদ শুনলেই তার মানসিক ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হয় না। তার আরও কিছু প্রয়োজন। বাড়িতে তার মন টেকে না। তার স্ত্রী সরোজিনী কাৰ্যত বোবা। অনেক চেষ্টা করে দেখেছে নবীনকুমার, শুধু ঘর-সংসার আর পিত্ৰালয়ের গল্প ছাড়া অন্য কিছুই সরোজিনীকে আকৃষ্ট করে না। ইদানীং তার পুজো-আচ্চার বাতিক চরমে উঠেছে, নবীনকুমার একেবারে পছন্দ না করলেও এ গৃহে সাধু-সন্ন্যাসী ও গণৎকারদের আনাগোনা চলছে কিছুদিন ধরে। তারা সরোজিনীর কাছে আসে। এতদিনেও সন্তান হয়নি বলে সরোজিনীর আশঙ্কা হয়েছে যে সে বুঝি বাঁজা। সে কারণেই তার স্বামী তাকে পছন্দ করে না।
সন্তান অবশ্য কুসুমকুমারীরও হয়নি এখনো, কিন্তু সে এসব দিকে ঝোঁকেনি। গঙ্গানারায়ণ কুসুমকুমারী যে মহলে থাকে, সেখানে প্রায়ই সন্ধ্যার পর গান বাজনার আসর বসে। কুসুমকুমারীর সঙ্গীত অনুরক্তি প্রবল। নবীনকুমারেরও বিশেষ সঙ্গীতপ্রীতি আছে, কিন্তু সে ঐ মহলে কদাচ যায় না। গঙ্গানারায়ণ এবং কুসুমকুমারী এসে অনেকবার অনুরোধ জানিয়েছে, প্রতিবারই নবীনকুমার কোনো না কোনো ছুতো দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে। এখনো সে কুসুমকুমারীর সঙ্গে পারতপক্ষে বাক্যালাপ করে না, নেহাৎ কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে হলেও তার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে না। নবীনকুমারের যে কেন এত বিরাগ কুসুমকুমারীর প্রতি, তা কুসুমকুমারী এ পর্যন্ত বুঝতে সক্ষম হয়নি।
খানিকবাদে নবীনকুমার আবার বেরিয়ে পড়লো জুড়িগাড়ি নিয়ে। কোথায় যাবে সে বিষয়ে আগে থেকে মনস্থির করেনি, তাই কিছুক্ষণ এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করে উপস্থিত হলো ফৌজদারি বালাখানার সন্নিকটে চন্দ্ৰনাথ ওঝার বাড়িতে।
দ্বার খুলে দিল চন্দ্রনাথের সহকারী কালু শেখ ওরফে সুলতান। এবং জানালো যে চন্দ্রনাথ গৃহে নেই।
তবু অফিস ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে নবীনকুমার বললো, কোতায় গেচেন তোর বাবু?
সুলতান বললো, বাবু রোদে গিয়েসেন।
বুঝতে না পেরে নবীনকুমার বললো, রোদে মানে?
সুলতান বললো, আজ্ঞে হাঁ, ইয়াস ষাঁড়, বাবু রোদে গিয়েসেন। রেতের বেলা রোদ্দুর না থাকলেও আমার বাবু একবার করে রোদে যান।
নবীনকুমার বললো, ও, রোঁদে গ্যাচেন। তোর বাবু রোজ রাতে রোঁদে যান কেন, তিনি কি সেপাই নাকি?
—আমার বাবু সেপাই দ্যাখলে ভয় পান না। সাহিব-পুলুশ দাখলেও ভয় পান না।
—ঠিক আচে, তোর বাবু ফিরবেন তো? আমি একটু বসচি।
—বসেন, বসেন ষাঁড়, বসেন। সিক্রেট খাবেন? আমার বাবু সিক্রেট খান।
—না, আমি সিগারেট-পান-তামাক কিচুই চাই না। এই কদিন আগে দেকলুম তোর মাতায় চুল নেই, ভুরু নেই, আজ সব হঠাৎ গজিয়ে গেল কী করে?
—এটা পরচুল। বাবু পরায়ে দিয়েসেন। আর কালি দিয়ে ভুরু আঁকে দিয়েসেন। বাবু আমারে বলেন, ন্যারামুণ্ডি থাকলে ছুলতান হওয়া যায় না।
মৃদু মৃদু হাস্যে নবীনকুমার সুলতানের কথাবার্তা উপভোগ করতে লাগলো।
কয়েকমাস ধরে চন্দ্রনাথের সঙ্গে তার এক অদ্ভুত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এই ষণ্ডমার্ক স্বভাবের লোকটির প্রতি নবীনকুমার বেশ আকর্ষণ বোধ করে, এই ওঝা কোনো সাধারণ চিকিৎসক নয়, এ আক্রমণ করতে চায় সামাজিক ব্যাধিগুলিকে। এইসব বিষয়ে নবীনকুমারও খুব কৌতুক পায়, তাই সে চায় চন্দ্রনাথের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতে। কিন্তু চন্দ্রনাথ কিছুতেই নবীনকুমারের সংশ্রবে থাকতে চায় না, নবীনকুমার নিমন্ত্রণ জানালে সে যায় না, নবীনকুমার সাক্ষাৎ করতে এলেও সে বিরক্ত হয়। ধনিক শ্রেণীর প্রতিই যেন তার এক তীব্র ঘৃণাবোধ আছে।
তবু নবীনকুমার আসে। বিপরীত ধরনের মানুষের প্রতিই যেন তার কৌতূহল বেশী। মোসাহেব, খোসামুদে বা আজ্ঞে-হুজুরের দলকে সে দুচক্ষে দেখতে পারে না। চন্দ্ৰনাথ তার মুখের ওপর ভর্ৎসনা করে, তাতেই সে বেশী মজা পায়।
একমাত্র চন্দ্রনাথই নবীনকুমারের মহাভারত অনুবাদের গৌরব নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। সে একদিন বলেছিল, ভারি একটা কাজ! আপনার জমিদারির গরিব প্রজাদের টাকায় আপনি মচ্ছবি কৰ্চেন। কিচু হাফ এজুকেটেড লোকের মধ্যে ঐ বই বিলি কর্চেন বিনি পয়সায়। যারা গায়ের রক্ত জল করে জমিতে ধান ফলায় তাদের কী উপকারটা হচ্চে এতে?
নবীনকুমার একথা শুনে ক্রুদ্ধ হয় না। হাসতে হাসতে বলে, আমি ধনী বংশে জন্মোচি, সেটা আমার অপরাধ? কর্ণের মতন আমিও বলতে পারি, দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম-।
—তবে ধনীর দুলালের স্বভাব অনুযায়ী কাজ করুন। আমার কাচে আসেন কেন? একদিকে মদ-মেয়েমানুষে টাকা ওড়ান আবার একটা মন্দির বানিয়ে দিয়ে সুনাম কিনুন। এদানি আবার মন্দির বানাবার বদলে ইস্কুল খোলার ফেসিয়ান হয়েচে।
—আমি মন্দিরও বানাইনি, ইস্কুলও খুলিনি, বড় ভুল হয়ে গ্যাচে তো। তা ভাই তোমার ভূত-তাড়ানোর কারবারটি আমার বড় পচন্দ।
–ভূত আপনার মাথার মধ্যেও রয়েচে।
—বটে, বটে? সেটা কেমন ধারা ভূত তুমি বলে দিতে পারবে? যত টাকা খর্চা লাগে আমি দোবো।
–মিঃ সিংহ, যারা কতায় কতায় টাকার গরম দেকায়, আই হেইট দেম।
—কিন্তু এটাই তো তোমার পেশা, তাই না? আমার কেইসটা তুমি টেকআপ করো। তুমি যখন বললেই যে আমার মাতার মধ্যে ভূত আচে
—আমি দুঃখিত, মাই হ্যাণ্ড ইজ ফুল। এখন আমি আর কোনো কেইস নিতে পারবো না। শহরে ভূত-প্রেতি আর বুজরুগ যোগী-সন্ন্যাসীর ধূম ধাড়াক্কা লেগেই আছে, খবর পেলেই নবীনকুমার সেখানে যায়। সে জানে, চন্দ্রনাথ তার সাগরেদকে নিয়ে সেখানে আসবেই। প্রতিবারই বিভিন্ন প্রকার কৌশলে চন্দ্রনাথ জুয়াচুরি ফাঁস করে দেয়। এজন্য কয়েকবার তাকে রীতিমতন বিপদেও পড়তে হয়েছে, বিরুদ্ধপক্ষীয়রা আক্রমণ করতে ধেয়ে এসেছে চন্দ্রনাথকে! মুসলমানপাড়ায় এক বাড়িতে এরকম হাঙ্গামার সময় এক সাধুর ক্ষিপ্ত চ্যালারা চন্দ্রনাথকে মারার জন্য ধেয়ে আসে, তখন নবীনকুমারই দুলালের সাহায্যে ওকে রক্ষা করে নিজের জুড়ি গাড়িতে তুলে নেয়। সেজন্য অবশ্য কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই চন্দ্রনাথের, কোনোরকম সৌজন্য বা ধন্যবাদ বাক্য না বলে সে একটু পরেই গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিল।
চিৎপুরের রাস্তায় চন্দ্রনাথের বাড়ির প্রায় বিপরীত দিকেই আর একটি গৃহের সামনে প্রতিদিন বহু মানুষ সমাগম হয়। একদিন কৌতূহলী হয়ে সেখানে গিয়েছিল নবীনকুমার। সে গৃহের একখানি কামরা ভাড়া নিয়ে বাস করেন। একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, তিনি সাধারণ গরিব-গুবোঁ লোকদের চিকিৎসা করেন এবং ওষুধ দেন। সবই বিনা মূল্যে। ভদ্রলোকের নাম প্ৰাণগোপাল বিষয়ী, কিন্তু তাঁর মনে বিন্দুমাত্র বিষয়বুদ্ধি নেই। নবীনকুমার ওঁর সঙ্গে কথা বলে জানলো যে প্ৰাণগোপালবাবু রীতিমতন মেডিক্যাল কলেজের পাশ করা ডাক্তার, লক্ষ্ণৌতে সরকারি হাসপাতালে কর্মকরতেন, কিছুকাল আগে পত্নী বিয়োগ হওয়ায় তিনি এক প্রকার গৃহী-সন্ন্যাসী হয়েছেন। তাঁর যাবতীয় সঞ্চয় তিনি ব্যয় করছেন দরিদ্র মানুষদের সেবায়।
মাত্র একঘণ্টা আলাপ করবার পরই নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, আপনার এই বাড়িটির মালিক কে? তিনি কোথায় থাকেন? আমি এই বাড়িটি কিনতে চাই। এই বাড়িতে আপনি একটি দাতব্য চিকিৎসালয় খুলুন। আমি প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা দেবো।
নবীনকুমারের যে কথা সেই কাজ এবং সবই অতি দ্রুত। কয়েকদিনের মধ্যে সেই গৃহ ক্রয় করে সেখানে স্থাপিত হলো দাতব্য চিকিৎসালয় এবং প্রাথমিক যন্ত্রপাতির জন্য নবীনকুমার আরও অতিরিক্ত দশ সহস্র মুদ্রা ব্যয় করলো।
তারপর একদিন সে চন্দ্রনাথের কাছে এসে বলেছিল, ওহে ব্রাদার, মন্দির স্থাপন করিনি, ইস্কুলও খুলিনি। দাতব্য চিকিৎসালয় বসিয়েচি, এটা তোমার পচন্দ। এবার তুমি খুশী?
চন্দ্রনাথের মুখখানা রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। সে গম্ভীরকণ্ঠে বলেছিল, এও আপনার বড়-মানুষের দেমাকী। আমার বাড়ির উল্টোদিকেই কি এটা করতে হবে? আপনি নিজের নাম জাহির করবেন, তা দুবেলা দেকতে হবে আমায়!
নবীনকুমার হাসতে হাসতে বলেছিল, সাইন বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দ্যাকো, লেকা আচে, সাধারণ দাতব্য চিকিৎসালয়। আমার নাম কোতাও নেই। তোমায় দেকচি খুশী করা বড় শক্ত। আমোদের জন্য টাকা ওড়ালে তোমার আপত্তি, আর গরিবের জন্য ব্যয় কল্লেও তোমার আপত্তি?
আজ সুলতানের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করবার পরও চন্দ্রনাথ ফিরলো না দেখে নবীনকুমার ভাবলো, আর অপেক্ষা করে কোনো লাভ নেই।
সে উঠে দাঁড়াতেই বাইরের দ্বারের সামনে একটি কেরাঞ্চি গাড়ি এসে থামলো, তার থেকে অবতরণ করলো চন্দ্ৰনাথ। কয়েক পা অগ্রসর হয়েই সে একবার টলে পড়ে যেতে যেতে দেওয়াল ধরে সামলে নিল নিজেকে। নবীনকুমার রীতিমতন বিস্মিত। সে আগে কখনো চন্দ্রনাথকে সুরাপান করে মাতা হতে দেখেনি। শুধু তাই নয়, কেরাঞ্চি গাড়ি থেকে চন্দ্রনাথের পশ্চাতে নেমেছে এক অবগুষ্ঠিতা যুবতী। সুলতান লণ্ঠন নিয়ে তার প্রভুর দিকে ছুটে যেতেই সেই আলোকে নবীনকুমার দেখলে চন্দ্রনাথের সমস্ত পোশাক রক্তাক্ত। তার একটি চক্ষুসমেত কপাল জুড়ে গভীর ক্ষত।
চন্দ্ৰনাথ যে বেশ বড় রকম একটা মারদাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কারণ তার মতন তেজস্বী ও বলশালী মানুষটিও কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলো না। একটি চেয়ারে বসে পড়ে ক্লিষ্ট কণ্ঠে সে বললো, সুলতান, একটু গরম জল করে নিয়ে আয় জলদি।
চন্দ্রনাথের কোট ছিন্নভিন্ন, কোনো ধারালো অস্ত্রের একাধিক ঘা খেয়েছে সে, তার শরীর থেকে ফোঁটাফোঁটা রক্ত পড়ছে মাটিতে।
নবীনকুমার রক্তাক্ত দৃশ্য সহ্য করতে পারে না। সে এগিয়ে এসে চন্দ্রনাথকে কোনো প্রকার সাহায্য করতে পারলো না। গুরুতর আহত চন্দ্রনাথের এখনি চিকিৎসার প্রয়োজন বুঝে সে বললো, ডাক্তার, একজন ডাক্তার ডাকা দরকার। আমাদের হাসপাতাল থেকে ডাক্তারবাবুকে বরং ডেকে আনুক সুলতান।
অবনত মস্তক দুহাতে চেপে ধরে চন্দ্রনাথ বললো, না, তার কোনো দরকার নেই। আমি নিজেই নিজের ব্যবস্থা কত্তে পার্বো।
নবীনকুমার বললো, তোমার এমন অবস্থা হলো কী করে?
চন্দ্ৰনাথ কোনো উত্তর দিল না।
নবীনকুমার বললো, কাচেই যখন ডাক্তার রয়েচোন,–আচ্ছা আমি নিজেই ডেকে আনচি।
চন্দ্রনাথ ধমকের সুরে বললো, বলচি যে আমার দরকার নেই!
অবগুষ্ঠিতা রমণীটি দ্বারের বাইরে এক পাশ বেঁকে আড়ষ্টভাবে দণ্ডায়মান। তরুণীটি বেশ দীঘঙ্গিী, পরনে একটি নীল রঙের সিল্কের বসন। শরীরে যৌবন একেবারে পরিপূর্ণ। তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত বোধ করলো নবীনকুমার। নিশ্চিত আর একটি কুলটা নারী। শহর কলকাতা এমন গৃহত্যাগিনী স্ত্রীলোকে ভরে গেছে। স্বেচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক বা সামাজিক তাড়নাতেই হোক, এই সব রমণীরা একবার পথে নামবার পর ক্রমশ তারা সেই পথকেই পিচ্ছিল করে। সুবালা-পর্বের পর এই সমস্ত রমণীদের সম্পর্কে নবীনকুমারের মনে একটা দারুণ বিরাগ জন্মে গেছে।
গোঁয়ার চন্দ্ৰনাথ যদি চিকিৎসক না ডাকতে চায়, তা হলে এ স্থানে এখন আর নবীনকুমারের করণীয় কিছু নেই। তবু প্ৰস্থানের জন্য উদ্যত হয়েও নবীনকুমার চলে যেতে পারছে না। চন্দ্রনাথের অভিযান-কাহিনীটি শোনার জন্য তার দারুণ কৌতূহল।
চন্দ্রনাথ একবার মুখ তুলে রমণীটিকে উদ্দেশ করে বললো, আপনি ভেতরে এসে বসুন। সুলতান, বাইরের দোর বন্ধ করে দে!
রমণীটি এবার মুখ তুলে কান্না শুরু করে দিল। চন্দ্রনাথ মাথার ক্ষত স্থানটি এক হাতে চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো। একটি চোখ তার বন্ধ হয়ে গেছে, অন্য চক্ষুটিতে নিদারুণ ক্ৰোধ।
কর্কশ স্বরে সে বললো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদাকাটি করে আপনি পাড়াপাড়শীর ভিড় জমাতে চান! ভেতরে এসে যত খুশী কাঁদুন!
স্ত্রীলোকটি বললো, আমার এখন গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে মরাই ভালো! আমাকে ছেড়ে দিন!
—মত্তে চান মরবেন। তার জন্য এত ব্যস্ততার কী আচে!
—আমার কপালে আগুন নেগেচে, আপনি কেন শুধুমুদু নিজের হাত পোড়াবেন?
–সে চিন্তা আপনাকে কত্তে হবে না! সুলতান এর মধ্যেই একটা ছোট গামলা ভর্তি গরম জল, তুলো আর খানিকটা সাদা কাপড় নিয়ে এসেছে।
–আগে বাইরের দরোজটা বন্দ করে দে!
দরজা বন্ধ করে এসে সুলতান অতি দক্ষ হাতে গরম জলে তুলো ভিজিয়ে চন্দ্রনাথের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দিতে লাগলো। চন্দ্রনাথ বললো, আঃ, আস্তে, সাবধানে, দ্যাক বোধহয় একটা কাঁচ ফুটে আচে।
নবনীকুমার সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। স্ত্রীলোকটির দিকেও সে সোজাসুজি তাকাতে পারছে না। সে এখনো স্ত্রীলোকটির মুখ দেখতে পায়নি। স্ত্রীলোকটির মুখ দেয়ালের দিকে। নবীনকুমার বেশ অস্বস্তিজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো।
সুলতান বললো, উরি বাস রে! কেটে একেবারে ফাঁক হয়ে গিইয়েচে। কোন দুশমন বোতল দিয়ে মেইরেচে। অ্যাত্তি বড় একটা কাঁচ।
চন্দ্রনাথ মুখ দিয়ে কোনো যন্ত্রণার শব্দ করছে না। সে বললো, তুই হাত দিয়ে তুলতে পারবি না, একটা সন্না নিয়ে আয়…আমার শোবার ঘরে দেরাজে আচে দ্যাক।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কে তোমায় এমন মারলো, চন্দ্রনাথ?
এবারও চন্দ্ৰনাথ নীরব। আর এখানে থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নবীনকুমার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম করতেই চন্দ্ৰনাথ মুখ তুলে বললো, আপনাকে একটি রিকোয়েস্ট জানাতে পারি?
নবীনকুমার থমকে গিয়ে বললো, কী?
—এই রমণীকে আপনি আজ রাতের মতন কোনো জায়গায় আশ্রয় দিতে পারেন?
—আমি একে আশ্রয় দেবো? আমি কোতায় আশ্রয় দেবো?
—বাঃ! ওউনার অফ ডজনস অ্যাণ্ড ডজনস অফ বিল্ডিংস ইন ক্যালকাটা, তিনি জিজ্ঞেস করচেন, কোতায়?
চন্দ্রনাথের তীব্র ব্যঙ্গোক্তিতে নবীনকুমার অপ্রস্তুত হয়ে গেল, তার মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করলো। তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর না দিয়ে সে চুপ করে রইলো একটুক্ষণ। তারপর ঈষৎ হাস্যের সঙ্গে সে বললো, হ্যাঁ, বাড়ি আমার অনেকগুলোন আচে বটে, তা বলে এই মাঝরাতে একজন অজ্ঞাতকুলশীল স্ত্রীলোককে নিয়ে গিয়ে তুলবো, তাই-ই বা কেমন কতা!
—অজ্ঞাতকুলশীল নিরাশ্রয় বলেই ঠাঁই দেবার প্রশ্ন ওঠে। যার ভদ্রস্থ বাড়িঘর আছে, সে আপনার কাচে রাতের বেলা এমন সাহায্য চাইবে কেন?
—এই রমণীটি কে? কোতায় একে পেলে?
—সে সব কতা পরে জানলে চলে না? আপনি এক্ষুনি যা বললেন, ধরে নিন। তাই, অজ্ঞাতকুলশীল—
—তুমি একে এনেচে, তোমার বাড়িতেই রাকচো না কেন?
—দিস ইজ এ ব্যাচেলরস অ্যাবোড, এখানে কোনো স্ত্রীলোকের থাকা সমীচীন হয় না। সে কারণেই আপনার ওপর এ দায়িত্ব দিতে চাই—
—বাঃ, তুমি কোতায় না কোতায় ইচ্ছে করে হেঙ্গামায় জড়িয়ে পড়বে, নারীহরণ করে আনবে। তারপর তার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে?
—তা হলে সেপাইদের ছাড়া ঘোড়ার মতন আপনার এখানে ফালতু ল্যাজ নাড়াবার তো কোনো প্রয়োজন দেখি না। রাত হয়েচে, আপনি এবার বাড়ি যান।
নবীনকুমারের মুখের ওপরে যেন কশাঘাত হলো। তার কথার মধ্যে সব সময়ই একটা কৌতুকের সুর থাকে। চন্দ্রনাথ তার কাছে এই রমণীটিকে আশ্রয় দেবার ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছে, এটা এমন কী আর কঠিন ব্যাপার। দুলালকে হুকুম দিলেই সে যে-কোনো উপায়ে একটা ব্যবস্থা করবেই। ইচ্ছে করলে সে এই রাত্রেই একটি নতুন গৃহ ক্রয় করে সেখানে এই রমণীকে স্থাপিত করতে পারে। কিন্তু কোনখানে মারপিট হলো এবং কী ভাবে বা কেন এই রমণীটিকে নিয়ে আসা হলো সেই ইতিহাস চন্দ্ৰনাথ বলতে চাইছে না বলেই নবীনকুমার উল্টো সুরে কথা বলছিল তার সঙ্গে। কিন্তু রঙ্গ-রস বোঝার ক্ষমতা এমনিতেই চন্দ্রনাথের কম, তা ছাড়া সাঙ্ঘাতিক আহত অবস্থায় কৌতুক অনুধাবন করা সহজও নয় মোটেও।
এবার নবীনকুমার গম্ভীর স্বরে বললো, দ্যাকো চন্দ্রনাথ ওঝা, বেয়াদপির একটা সীমা আছে। কার সঙ্গে কেমন ভাবে কতা কইতে হয় তুমি জানো না। যদি সমূলে ধ্বংস হতে না চাও তো আমার সামনে মুখ সামলে চলো।
চন্দ্রনাথও এবার একটু সুর নরম করে বললো, আদপ-কায়দা শোকবার তো সুযোগ পাইনি জীবনে, তাই মানী লোকের মান কীভাবে রাকতে হয় হয়তো জানি না। আপনার মতন মানী লোক যেখোনে সঠিক মান পাবেন, সেখেনেই আপনার গতায়াত করা উচিত। আমার মতন একটা চাঁড়ালের বাড়িতে…
পরীক্ষণেই সে চেঁচিয়ে উঠলো, আঃ, আঃ, মেরে ফেলবি, আস্তে, ওরে আস্তে—ইতিমধ্যে সুলতান ওপর থেকে সন্না নিয়ে এসে চন্দ্রনাথের মাথা থেকে কাচের একটি বড় টুকরো তোলার চেষ্টা করছিল। ভুল করে একটা খোঁচা লাগিয়ে দিয়েছে, চন্দ্রনাথের মস্তক থেকে আবার রক্তপাত হচ্ছে।
স্ত্রীলোকটি কান্না থামিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে এতক্ষণ স্থাণুবৎ দাঁড়িয়েছিল, চন্দ্রনাথের আর্ত স্বর শুনে সে আর স্থির থাকতে পারলো না। এগিয়ে এসে সুলতানের পাশে দাঁড়িয়ে সে লজ্জা -শঙ্কামিশ্রিত কম্পিত স্বরে বললো, আমি চেষ্টা করবো?
স্ত্রীলোকটির মুখ থেকে অবগুণ্ঠন সরে গেছে।
সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছাসের মতন বিস্ময়ের এক ঝাপটা লাগলো নবীনকুমারের শরীরে। এই রমণীটি কে? এ নবীনকুমারের সম্পূর্ণ অচেনা, অথচ বিষম চেনা বলে মনে হচ্ছে।
রমণীটি প্রায় পঞ্চবিংশতি বৰ্ষীয়া, অত্যুজ্জ্বল গৌর গাত্রবৰ্ণ, আয়ত চক্ষু, মাথায় ভ্রমর-কৃষ্ণ এক রাশ চুল। কিন্তু তার মুখমণ্ডলে রূপের উগ্রতা নেই, তার দৃষ্টি থেকে ওষ্ঠের ভঙ্গিমা পর্যন্ত কোমল, কমনীয়, স্নিগ্ধ। যেন নবীনকুমারের জননী বিম্ববতীর মুখখানা হুবহু বসানো।
নবীনকুমারের বক্ষ স্পন্দন অতি দ্রুত হয়ে গেল। আজ প্রাতেই সে বহুদিন পর তার জননীর কথা স্মরণ করেছিল, আজ রাতেই সে এ কোন রূপ দেখলো? মানুষে মানুষে এমন মিল সম্ভব? সময় ও স্থানের দূরত্বে বিম্ববতী আজ সুদূরবাসিনী, তবু কোন মন্ত্রবলে যেন তিনি এখানে যৌবনবতী হয়ে উপস্থিত। তবে কি এ বিম্ববতীর কোনো সহোদরা? কিন্তু নবীনকুমার যত দূর জানে, তার মাতৃকুলে কেউ আর জীবিত নেই।
যুবতীটি কুশলী হস্তে সন্না দিয়ে চন্দ্রনাথের মাথা থেকে কাচের একটি বড় টুকরো তুলে আনলো। তারপর সুলতানকে জিজ্ঞেস করলো, বাড়িতে গাঁদা ফুলের গাছ নেই?
সুলতান তৎক্ষণাৎ কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে, প্রায় চক্ষের নিমেষেই হনুমানের বিশল্যকরণী আনয়নের ভঙ্গিতে একরাশ গাঁদা ফুলের গাছ নিয়ে এলো দুই বগলে। কোনো প্রতিবেশীর বাগান থেকে সেগুলি সে সমূলে উপড়ে এনেছে।
যুবতীটি অনেকগুলি পাতা একসঙ্গে নিয়ে থেঁতো করে সেই রসের প্রলেপ দিতে লাগলো চন্দ্রনাথের ক্ষতস্থানে। চন্দ্রনাথ এখন চেয়ারে হেলান নিয়ে স্থির হয়ে বসে আছে, অনেক রক্তক্ষরণে তার মুখখানি পাণ্ডুর বর্ণ। চক্ষু বুজে ফেলেছে সে। সুলতান তার ছিন্নভিন্ন কোট খুলে নিতে দেখা গেল তার ঘাড়ে ও বুকেও তলোয়ারের মতন কোনো ধারালো অস্ত্রের দাগ।
যুবতীটি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, কেন আপনি নিজের জীবনটা এমন ভাবে…কেন আপনি আমার জন্য…
সাদা কাপড় দিয়ে মাথার ক্ষতটি ভালোভাবে বেঁধে দিয়ে যুবতীটি অন্যান্য ক্ষত তুলো দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে বললো, কোনো ওষুধ-বিষুধ না লাগালে…আমি তো কিচুই জানি নাকো…
নবীনকুমার নির্বাক হয়ে সব কিছু দেখে যাচ্ছিল, একবার যুবতীটির সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে জিজ্ঞেস করলো, তুমি…আপনি কে?
যুবতীটি চক্ষু নত করে উত্তর দিল, আমি এক হতভাগিনী!
চন্দ্রনাথ অকস্মাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, সুলতান, আমার হাতটা ধর, আমি এবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বো, আর বসে থাকতে পাচ্ছি নি—
নবীনকুমার বললো, চন্দ্রনাথ, তা হলে একে আমি নিয়ে যাবো! তোমার কোনো চিন্তা নেই, ইনি ভালো জায়গায় থাকবেন। আপনি আসুন আমার সঙ্গে।
যুবতীটি যেন অত্যন্ত ভয়ার্ত হয়ে চন্দ্রনাথের হাত চেপে ধরে বললো, না, না, আমি আর কোতাও যাবো না।
নবীনকুমার বললো, আপনার কোনো ভয় নেই, আপনি সসম্মানে, নিরাপদে থাকবেন। যুবতীটি ফের বললো, আমি এঁকে ছেড়ে যাবো না! এর এত বিপদ,…কেউ যদি সেবা না করে…আমি যতটুকু পারি…
নবীনকুমার বললো, আমি ওর জন্য চিকিৎসক ডাকতে চেয়েছিলুম, উনি রাজি হন নি। তবু আমি এখুনি গিয়ে ডাক্তার আর সারা রাত জেগে সেবা করবার জন্য লোক পাটিয়ে দিচ্চি…
চন্দ্রনাথ বললো, মিঃ সিংহ, আপনি আমার উপকার করবার চেষ্টা করবেন না। আমি কারুর কাচ থেকে উপকার নিই না। কারণ, প্রত্যুপকার করবার বোধশক্তি আমার নেই।
–তুমি বালখিল্যের মতন কতা বলচো, চন্দ্রনাথ। এখন তোমার চিকিৎসার বিশেষ প্রয়োজন, তাই ডাক্তার আসবে। এর মধ্যে উপকারের প্রশ্ন আসচে কোতায়?
—অনেক মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আচে। এতে আমার কিচু হবে না। আমি আবার বেঁচে উঠবো ঠিকই।
তারপর সে যুবতীটিকে উদ্দেশ করে বললো, ইনি নবীনকুমার সিংহ, একজন বিশিষ্ট মানী ব্যক্তি, আপনি এর সঙ্গে ইচ্ছা করলে যেতে পারেন। ইনি আপনাকে তোয়াজের সঙ্গে রাকবেন–
যুবতীটি অতি দ্রুত বললো, নাঃ!
নবীনকুমার মিনতি করে বললো, আপনি চলুন, আমি শপথ করে বলচি, আপনার কোনো ভয় নেই–
যুবতীটি বাঁঝের সঙ্গে চন্দ্রনাথকে বললো, আপনি যদি আমায় অন্যের হাতে সঁপেই দেবেন, তবে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আমায় বাঁচালেন কেন? এখেনে নিয়ে এলেন কেন? আমি আর কোতাও যাবো না, মত্তে হয় তো এখেনেই মর্বো!
চন্দ্রনাথ খুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললো, আমি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাকে বাঁচাই নি-কতগুলো রাফিয়ান, পাষণ্ড পথের মধ্যে আপনাকে কুৎসিতভাবে টানা-হ্যাঁচড়া করছিল, তাই তাদের শাস্তি দিতে গোসলুম–তারপর আপনি আমার সঙ্গে এলেন–মিঃ সিংহ প্ৰথমে আপনাকে আশ্রয় দিতে চান নি, তারপর বোধ হয় আপনার মুখ দেকে আপনাকে পচন্দ হয়েচে…
নবীনকুমার বললো, ছিঃ!
চন্দ্ৰনাথ বললো, ইনি একজন মস্ত বড় বড়মানুষ, আর আমি একটা চাঁড়াল, তা জেনেও যদি আপনি এখেনে থাকতে চান,…তা হলে থাকুন…সুলতান আপনার ব্যবস্থা করে দেবে…
নবীনকুমার বাইরের দিকে দ্বার খুলে উত্তেজিতভাবে ডাকলো, দুলাল! দুলাল!
চন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর ঘুমে জড়িয়ে এসেছে। সে বললো, তা বলে যেন একে জোর করে নিয়ে যাবেন না! আমি স্ত্রীলোকদের ওপরে জোর-জবরদস্তি খাটানো একদম সহ্য কত্তে পারি না।
অপেক্ষমান জুড়িগাড়ি থেকে দুলাল তৎক্ষণাৎ এসে উপস্থিত হতেই নবীনকুমার ব্যগ্রভাবে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করলো, দ্যাক তো দুলাল, এঁকে চিনতে পারিস?
দুলাল একটুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বিমূঢ়ভাবে বললো, আজ্ঞে, না তো।
–এঁকে দেখে কারুর কতা মনে পড়াচে না তো!
দুলালও অতি বাল্যকাল থেকে বিম্ববতীকে দেখেছে। সুতরাং নবীনকুমার আশা করেছিল, দুলালও যুবতীটিকে দেখা মাত্র তারই মতন চমকিত হবে। কিন্তু দুলালের মুখে কোনো রেখাই ফুটলো না। সে আমতা আমতা করে বললো, আজ্ঞে না, ছোটবাবু।
নবীনকুমার অস্থিরভাবে হতাশ নিশ্বাস ফেললো। তারপর যুবতীটির দিকে দুএক পা এগিয়ে এসে অত্যন্ত আন্তরিক কাতরতার সঙ্গে বললো, আপনি চলুন আমার সঙ্গে, এর পর আপনি যা চান, আপনি যেখানে খুশী যেতে চান…আপনাকে সম্মানের জীবন ফিরিয়ে দোবো আমি…
যুবতীটি পুনরায় বললো, না! আমি একে ছেড়ে যাবো না!
চন্দ্রনাথ বললো, আমার ঘুম পাচ্চে, আমার বিষম ঘুম পাচ্চে মিঃ সিংহ, তা হলে আপনি বাড়ি যান…
নবীনকুমার এদিক ওদিক মুখ ফেরালো। একটা কোনো ভারি বস্তু পেলে সে হয়তো কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞানশূন্য হয়ে তখুনি তা দিয়ে চন্দ্রনাথের মাথায় আঘাত হানতো। অতি কষ্টে সে নিজেকে সামলে নিল।
দুলালচন্দ্ৰ কোনোদিন তার প্রভুকে এই অবস্থায় দেখে নি। সে ভয়ে ভয়ে বললো, ছোটবাবু, বাড়ি যাবেন না?
–চল।
যুবতীটির দিকে শেষবারের মতন তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিপাত করে নবীনকুমার নির্গত হয়ে গেল সেই কক্ষ থেকে। তারপর চন্দ্রনাথের বাড়ির দ্বার থেকে তার জুড়িগাড়ি পর্যন্ত যেন বহু দূরের পথ এইভাবে হেঁটে গেল সে।
ভেতরে উঠে বসবার পর বিভ্ৰান্ত দুলাল মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলো, ছোটবাবু, ঐ মেয়েছিলেটি কে? অমনি নবীনকুমার তার গালে প্ৰচণ্ড জোরে এক চপেটাঘাত করে বলে উঠলো, চুপ কর, বেল্লিক! গাড়ি চালাতে বল।
আজ সকালেই নবীনকুমার দুলালের সন্তানকে একটি বাড়ি দান করেছে। সুতরাং, একটা চপেটাঘাত তো তার বিনিময়ে অতি সামান্য। জুতো মেরে গরু দানের সঙ্গে এর তুলনাই চলে না।
জুড়িগাড়ির মধ্যেই ব্র্যাণ্ডির বোতল মজুত থাকে। সেই বোতলের ছিপি খুলে নবীনকুমার ঢাক ঢক করে গলায় ঢালতে লাগলো। একটু পরেই সে কাঁদতে লাগলো খুঁক খুঁকি শব্দে। তার বুকের মধ্যে যে শিশুটি লুক্কায়িত আছে, সেই শিশুটিই যেন অভিমানে কাঁদে। এ এমনই অভিমান, যা কিসের বা কার প্ৰতি কিংবা কী জন্য তা বোঝা যায় না।
গৃহে প্রত্যাবর্তন করে নবীনকুমার স্নান-আহার কিছুই করলো না। তার কোনো কিছুতেই যেন রুচি নেই। তার মুখখানিতে নৈরাশ্যের কালিমা মাখানো। আজই অপরাহ্ন সে মহাভারতের অনুবাদক হিসেবে কত বিজ্ঞ-মানী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সাধুবাদ পেয়েছে, তার নামে সবাই ধন্য ধন্য করেছে, আর এখন এই মধ্য রাত্রে সে যেন একজন নিঃস্ব, পরম দুঃখী মানুষ।
নিজের পৃথক কক্ষে শুয়েও তার ছটফটানি কমলো না। একটু পরেই সে উঠে পড়ে অন্য একটি দ্বারে করাঘাত করে ডাকলো, সরোজ! সরোজ!
সরোজিনী শশব্যাস্তে উঠে এলো শয্যা ছেড়ে। ঘুম জড়িত চক্ষেসে একেবারে বিস্মিত, বিহ্বল। তার বিদ্বান, বিখ্যাত স্বামী তার প্রতি আর মনোযোগ দেয় না। কতদিন পর যে সে এই গভীর রাত্রে আবেগের সঙ্গে ডাক দিয়েছে।
দ্বার খুলে সরোজিনী বললো, আসুন, ভেতরে আসুন।
অল্প নেশাচ্ছন্ন এবং অতিশয় ব্যাকুল কণ্ঠে নবীনকুমার বললো, সরোজ,আমার কিছুই ভালো লাগচে না, আমার একদম কোনো কিচু ভালো লাগচে না, আমি কী করি বলে তো?
এবার সরোজিনীর চক্ষে দেখা দিল ত্ৰাস। আবার কি সেই রকম রোগ ধরলো তার স্বামীকে? সে বললো, আপনার শরীর খারাপ লাগচে? মাতা ব্যাতা কচ্চে? কোবরেজ মশাই, ডাক্তার…দুলালকে ডাকবো?
—না, না। আমার সে রকম কিচু হয়নি। আমার শরীর ভালো আচে, কিন্তু আমার মনটাকে কে যেন খিমচে ধরেচে, আমাকে কে যেন বেড়ালছানার মতন টুটি টিপে দুলিয়ে নিয়ে চলেছে
–ওমা, কী সৰ্ব্বেবানাশ! আপনি সিরাপ খাবেন? সিরাপ খেলে যদি মন ভালো হয়,–আপনার ঘর থেকে বোতল এনে দেবো?
—না, না, ও সব চাই না।
–মাতা টিপে দেবো? পা টিপে দেবো?
—সরোজ, তুমি আমার মনটা সুস্থির করে দিতে পারো? আমার সারা গায়ে যেন হাজার হাজার কাঁটা ফুটচে…
সরোজিনীর যতখানি সাধ্য, তার বেশী সে আর করবে। কী করে! অনেক দিন পর স্বামী যে তার শয্যায় এসে বসেছেন, এতেই সে ধন্য। নবীনকুমার পত্নীর স্কন্ধে হাত রেখে চঞ্চল নেত্ৰে দেখতে লাগলো। এদিক ওদিক। আসঙ্গ লিঙ্কসার উষ্ণতা তার সম্পর্শে নেই। বরং তার ওষ্ঠের ভঙ্গিমায় গম্ভীর কষ্ট লেখা আছে।
সরোজিনী অতি যত্নে স্বামীর পদসেবা করতে লাগলো।
একটু পরেই নবীনকুমার ধাপ করে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়েই তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো। গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাবার ঠিক আগে সে ভাবলো, যত সত্বর সম্ভব সে হরিদ্বারের দিকে যাত্রা করবে। সে তার জননীকে কতদিন দেখে নি!