2 of 2

৬৮. সূর্যর চালচলন ক্রমশ

সূর্যর চালচলন ক্রমশ বেশ স্বাভাবিক হয়ে এল। তার ছটফটানি এখন আর নজরে পড়ে না। দীপ্তির দিকে আর তাকায় না ঘোরলাগ: চোখে। দীপ্তির সঙ্গে আড়ালে দেখা করার ছুতো খোঁজে না। তা ছাড়া তার সময়ই বা কোথায়। সব সময়েই তো সে নানান কাজে ব্যস্ত। একসময় সূর্যর মনে হয়েছিল, তার কোথাও যাবার জায়গা নেই, কোনও বন্ধু নেই, কোনও দায়িত্বে আস্থা নেই, সেই জন্য দীপ্তির বুকই তার মুখ লুকোবার একমাত্র জায়গা। এখন সূর্য তার মুক্তির একটা ক্ষেত্র পেয়ে গেছে।

এর আরেকটা দিকও আছে। তার রাগ এবং জেদের মতন অভিমানও খুব তীব্র। দীপ্তির প্রতি সে এখন একটা প্রচণ্ড অভিমান বোধ করে। দীপ্তির জন্য সে সবকিছু ছাড়তে রাজি ছিল, তবু দীপ্তির এই রকম ব্যবহারের কোনও কারণই সে খুঁজে পায় না। এই অভিমান বশে সে একলা ঘরে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে পারত কিংবা দীপ্তিকে খুন করতেও পারত, তার বদলে সে নিজেকে বাইরের জীবনে ছড়িয়ে দিল। কারোকে সে কিছু বুঝতে দেয় না। সত্যেনবাবুর মতন ভূয়োদর্শী মানুষও একসময় মনে করলেন, এই ছেলেটির সম্পর্কে তিনি আগে ভুল ভেবেছিলেন। টেররিস্টগুলোর মতন গোঁয়ারতুমি থাকলেও এর নৈতিক চরিত্র সন্দেহের উর্ধ্বে।

সত্যেন গুহ তার আশ্রমটি যে রকম গড়তে চেয়েছিলেন, সূর্য এসে তার রূপ অনেক পালটে দিল। গরিবের ছেলেদের পড়ানো, মাঠে শাকসবজি লাগানো আর প্রার্থনা ট্রার্থনার মতন নিরামিষ ব্যাপারে সে আবদ্ধ রইল না। আগে যে একটি চুপচাপ শান্ত। পরিবেশ ছিল, সূর্য তার মধ্যে এনে দিল প্রাণের চাঞ্চল্য ও হুল্লোড়। আশ্রমের ছেলেগুলোর মধ্যে এনে দিল অ্যাডভেঞ্চার-স্পৃহা। আগে এখানকার ছেলেদের অন্য স্কুলের ছেলেরা গেঁধে আশ্রমের চ্যালা বলে বিদ্রূপ করত কয়েক মাসের মধ্যে এরা। সূর্যর প্রেরণায় জেলা স্কুলের ফুটবল টিমকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সাত গোলে হারিয়ে সম্মান আদায় করে নিল। আগে এদের পোশাক ছিল ঠেঙো ধুতি ও খদ্দরের ফতুয়া, সূর্য সে-সব ছাড়িয়ে এদের হাফপ্যান্ট ও হাফশার্টের ফিটফাট পোশাকের প্রবর্তন করেছে। প্যান্টের সঙ্গে বেল্ট পরা বাধ্যতামূলক। এখানে আশ্রমে চরকায় সুতো কাটা হয়। বটে, কিন্তু সূর্য সেই সুতো খাদি ভাণ্ডারে বিক্রি করে আসে, ছেলেদের ব্যবহার করতে দেয় না। সে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, খদ্দর টদ্দর বড়দের ব্যবহার করার জন্য চলতে পারে, ছোটদের জন্য দরকার নেই। আমেদাবাদ জায়গাটা তো ভারতবর্ষেই, সেখানকার মিলে তৈরি ছিট কাপড় ব্যবহার করায় দোষের কী আছে? সত্যেন গুহ প্রথম প্রথম ক্ষীণ আপত্তি তুলেছেন, কিন্তু জোর করে বাধা দেননি।

আশ্রমের ছেলেগুলো এসেছে খুবই গরিবের সংসার থেকে অনেকের বাড়িতেই খাবার জুটত না। এইসব ছেলেদের বা তাদের বাবা-মা’র একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, যদি ওরা এখানে থেকে লেখাপড়া শিখে কোনওক্রমে ভদ্রলোক হতে পারে। সূর্য ওদের মধ্যে মানুষের মতন মানুষ হয়ে বাঁচবার মতন একটা দৃঢ়তা এনে দিচ্ছে। কেউ মিনমিনে গলায় কথা বললে সূর্য তাকে এক ধমক দেয়।

মাঝে মাঝে সে ওদের নিয়ে যায় দূরের জঙ্গলে শিকার করতে। আশ্রমে অবশ্য পিকনিকের কথা বলে যায়। এর মধ্যে ওরা দুটো বুনোশুয়োর ও একটা হরিণ মেরেছে। হরিণটা অবশ্য মারার ইচ্ছে ছিল না, ধরতেই চেয়েছিল ওরা। কিন্তু ঝটাপটিতে সেটার শিরদাঁড়া ভেঙে যায়। হরিণটাকে নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। হরিণের মাংস আশ্রমে নিয়ে আসার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আবার ফেলে দিয়ে আসার কথাও কি চিন্তা করা যায়? আশ্রমের ছেলেদের আমিষ আহার নিষিদ্ধ। জঙ্গলের মধ্যেই গোপনে সেটা কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলার লোভ সূর্য অতি কষ্টে দমন করেছে। দলবল নিয়ে তিন মাইল দূরের একটা আদিবাসীদের গ্রামে দিয়ে এসেছে হরিণটা। হরিণটা পেয়ে আদিবাসীদের উল্লাস দেখাও একটা উপভোগ্য ব্যাপার। এর কয়েক দিন বাদে আবার সূর্য তার ছেলেদের নিয়ে এই আদিবাসী গ্রামটিতে একটি মস্ত বড় কুয়ো খুঁড়ে দিয়ে আসে।

সূর্যর মধ্যে যে প্রাণশক্তি আছে, তা প্রকাশের একটা পথ পেয়ে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার সরল জেদ কোনও রকম বাধাকেই অনতিক্রম্য মনে করে না।

এতকাল সত্যেন গুহর নিরীহ সর্বোদয় আশ্রমটি সম্পর্কে কারওর কোনও ঔৎসুক্য ছিল না। সূর্য আসার পর অনেকেরই এদিকে চোখ পড়ে, তার সম্পর্কে অনেকেরই বিভিন্ন ধরনের আগ্রহ জাগে। প্রথমত সে অত্যন্ত সুপুরুষ, তার দিকে সকলের চোখ পড়বেই। তা ছাড়া, সে যে একসময় বোমা-পিস্তল নিয়ে কারবার করেছে এবং জেল খেটেছে–এ খবরও সহস্ৰকান জনতার জানা হয়ে যায়–এ-সম্পর্কে অনেক রোমান্টিক গল্পেরও জন্ম হয়। এবং সে নাকি বড়লোকের ছেলে, সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে এসেছে। সর্বত্যাগী বড়লোকের ছেলেরা এখনও এ-দেশে বেশি শ্রদ্ধা পায়। সুতরাং জনশ্রুতির নায়ক হবার সব রকম যোগ্যতাই তার আছে। আসলে যে সে একটি ছেলেমানুষ ধরনের ক্রেদি মানুষ–এই সত্য পরিচয়টাই লোকের চোখে ধরা পড়ে না।

ফরোয়ার্ড ব্লক, কমিউনিষ্ট পার্টি এবং আর সি পি আই-এর কর্মীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে তার সঙ্গে ভাব জমাতে আসে। তাকে দলে টানার জন্য সকলেই উৎসুক।

সূর্য সকলকেই এক রকম উত্তর জানিয়ে দিয়েছে। সে বলেছে, আপনারা পলিটিকস বোঝেন, আমি রাজনীতিফিতি একেবারেই বুঝি না। আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমি এ-ও জানি, এ-দেশে সমাজতন্ত্র আনতে হলে একটা যুদ্ধ করতে হবে। আগের থেকেও অনেক বড় যুদ্ধ। দেখছেন না, পুঁজিপতি ব্যবসায়ী আর দালালরা এদেশের শাসন যন্ত্রটা কী রকম ভাবে দখল করে নিচ্ছে। যুদ্ধ ছাড়া এরা কেউ সে অধিকার ছাড়বে না। সেই যুদ্ধে আমিও লড়াই করতে রাজি আছি। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। কারণ গান্ধীবাদ আমার অস্থি মজ্জায় নেই। গান্ধীবাদ একজন মানুষের নিজস্ব জীবনের ক্ষেত্রে খুবই ভালো, কিন্ত এই আদর্শে দেশ চালাবার চিন্তা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না। এ-দেশের সরকারও যে খুব শিগগিরই গান্ধীবাদের ভেক ছেড়ে দেবে তাও আমি ভালো ভাবে জানি।

তবে, আমার আর একটা কথা আছে। সমাজতন্ত্রের জন্য সেই লড়াইটা চালাবে কে? যুদ্ধ তো শুধু সোলজার দিয়ে হয় না, তার জন্য একজন সেনাপতি লাগে। কে সেই সেনাপতি হবে। সেইটা আগে আপনারা ঠিক করে নিন। আপনারা এক মার্কসবাদের নাম করেই পাঁচ-ছ’টা আলাদা পার্টি খুলেছেন, আমি এর মানে বুঝতে পারি না, কোনও দিন আমার মাথাতে ঢুকবেও না। আপনারা আগে সবাই একমত হয়ে নিন, কে হবে ভারতের লেনিন। আমি সে রকম কারোকে দেখি না। যদি সে রকম কারোকে পাওয়া যায়, আর বিপ্লবের লড়াইয়ের ঠিক মতন প্রস্তুতি হয়, তা হলে আমাকে খবর দেবেন। আমি একজন সামান্য সোলজার হিসেবে যথা সম্ভব লড়াই দিয়ে আসব। সে রকম দিন যতদিন না আসে, ততদিন আপনারা যত ইচ্ছে পলিটিকস করুন, আমি যে রকম জীবন নিয়ে আছি, তাতেই বেশ আছি।

সূর্যর কথাটা কোনও দলের কর্মীদেরই পছন্দ হয় না। কেন না, সব দলেরই রিজিওন্যাল কমিটির কে সেক্রেটারি আর কে প্রেসিডেন্ট হবে, এ নিয়ে সব সময় চলছে একটা ঠান্ডা লড়াই। রিজিওন্যাল কমিটি থেকে কে কবে যাবে সেন্ট্রাল কমিটিতে– তারও একটা চিন্তা আছে। এইসব জরুরি বিষয় সমাধানের পর তো অন্য কথা। সত্যিকারের বিপ্লবের জন্য কোনও দিন লড়তে হবে, একথা কেউই মনের নিভৃততম প্রদেশে বিশ্বাস করে না। ও রকম যদি কখনও হয় তো হঠাৎ হয়ে যাবে। তার আগে, ব্যক্তিগত জীবনে বা দলগত ভাবে যত রকম দোষত্রুটি সবকিছু ঢাকবার জন্যই বিবেকের কাছে আছে এক মহৌষধ, মূল সমস্যার সমাধান না করতে পারলে এ রকম তো হবেই!

যাকে দলে টানতে পারা যায় না, তাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, এটাই আধুনিক রাজনীতির নিয়ম। সূর্যর অজ্ঞাতে তার শত্ৰুসংখ্যা বাড়তে লাগল। কখনও সখনও সে যখন শহরে আসে, তখন ওইসব কর্মীদের সঙ্গে দেখা হলে সে সাধারণ ভদ্রতা রক্ষার জন্য কথা বলতে যায়। কিন্তু তারা কাষ্ঠ হাসি দিয়ে সরে পড়ে একটু বাদেই। এইসব ছেলেদের মধ্যে অনেকে আছে আন্তরিক দেশকর্মী, কিন্তু নিছক থিয়োরির মন্ত্রে মাথা ঘুলিয়ে ফেলেছে, অন্যের সঙ্গে তর্ক হলেই নানান বইয়ের লাইন উদ্ধার করে উদাহরণ দেয়–মানুষকে তার স্থান কালের পটভূমিতে বিচার করতে ভুলে যায়। সূর্যর মনের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা কেউ করল না।

কয়েক দিন পর আচমকা একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল এলাকাটা জুড়ে। সত্যেন গুহর আশ্রমটা আসলে একটা বেলেল্লাপনার জায়গা। সূর্য আর দীপ্তি বিয়ে না করেও স্বামী-স্ত্রীর মতন একসঙ্গে থাকে। সন্ধ্যাবেলা মাঠের মধ্যে ওদের বেসামাল অবস্থায় কত লোক স্বচক্ষে দেখেছে। কলকাতা থেকে তাড়া খেয়ে ওরা এখানে পালিয়ে এসেছে। কয়েকজন কলকাতা থেকে টাটকা এবং পাকা খবর নিয়ে এসেছে–এককালের চন্দননগর মামলার বিখ্যাত দীপ্তি সরকার এক ছোকরার সঙ্গে বিশ্রী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এখন এখানে এসে আবার সেই লীলাখেলা শুরু করেছেন। এমনকী ওই আশ্রম পরিচালনার টাকা কোন গোপন সূত্র থেকে আসে সে-বিষয়ে তদন্ত করার জন্যও জেলা শাসকের কাছে উড়ো চিঠি গেল।

এসব কথা একবার বাতাসে ছেড়ে দিলেই হল। তারপর বাতাস নিজের গুণেই তা উড়িয়ে বেড়াবে। এবং যত বেশি ছড়ায় ততই এর বলবৃদ্ধি হয়। যৌন ব্যভিচার এবং গুপ্তচর বৃত্তি এই দুটি অভিযোগের মজা এই, যে-কেউ একবার শুনবে, কিছুতেই পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারবে না। যত বিশ্বাসের পাত্রই হোক, তবু মনে হবে ভেতরে একটা কিছু নিশ্চয়ই ব্যাপার আছে। যা রটে তার কিছু অন্তত বটে।

উড়তে উড়তে গুজবটা একদিন আশ্রমে এসেও পৌঁছোল। প্রথম কয়েক দিন কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না, প্রত্যেকেই অপরের কাছে এমন ভাব দেখাতে লাগল যে, সে কিছু শোনেনি।

গুজবটার সবচেয়ে নির্মল দিক এই যে, এটা যে-সময় ছড়াল, সে-সময় সূর্য আর দীপ্তি সম্পূর্ণ নির্দোষ জীবন কাটাচ্ছে। সূর্য মেতে আছে ছেলেদের নিয়ে, দীপ্তি আশ্রম পরিচালনার দিকটা দেখছেন। আর, হাতে কিছুটা সময় পেয়ে সত্যেন গুহ’নোয়াখালিতে গান্ধীজির সঙ্গে এই নামে স্মৃতিকথা রচনায় ব্যাপৃত।

দীপ্তি আশ্রমের একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে শহরে গিয়েছিলেন তেল, নুন, মশলা কিনে আনতে। মাসে দু-তিন বার তাঁকে এ রকম আসতে হয়। দোকানের লোকদের সঙ্গেও চেনা হয়ে গিয়েছিল। সেদিন তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, দোকানের লোকজন যেন তার দিকে একটু বিশেষ দৃষ্টিতে দেখছে। এই রকম দৃষ্টি গায়ে বেঁধে। কিন্তু এসব ব্যাপার শুধু অনুভব করা যায়, মুখে কিছু তো বলা যায় না।

তাড়াতাড়ি কেনাকাটি সেরে দীপ্তি ফিরে আসছিলেন, বাবুপাড়ায় দুটি ছেলে একেবারে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। দীপ্তিকে দেখে একজন বেশ জোরে বলল, এই সেই মাগিটা না?

মাগিটার বেশ চটক আছে কিন্তু। এই চটক দেখেই ছেলেটা মজেছে।

ছেলেটার চেহারাও তো কার্তিকের মতন লালটুমার্কা। দেখিসনি?

আর একজন বলল, হ্যাঁ। ছেলেটা বড় না মেয়েটা বড় রে?

এই রকম আরও কিছু কথা দু’জনে বলাবলি করল। মনে হয় যেন কথাগুলো আগে থেকেই তৈরি করা।

যৌবনে নির্লজ্জতার মধ্যে এক রকম আনন্দ আছে। কেউ কেউ সেই আনন্দের স্বাদটাই একটু বেশি করে পেতে চায়। এই যুবক দুটির মধ্যেও লজ্জা বা গোপনীয়তার চিহ্নমাত্র নেই। তারা দীপ্তিকে কথাগুলো শোনাতেই চেয়েছে। এমনকী, দীপ্তির সঙ্গে যে একটি ছোট ছেলে আছে–ততটা ছোট নয় যাতে এসব বুঝতে পারবে না—তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই।

যুবক দুটির বয়স কুড়ি-একুশ হবে। ওরা যখন নিতান্ত বালক ছিল, তখন দীপ্তি এক রাত্রে পুলিশে বাড়ি ঘিরে ফেলায় পেছনের পাঁচিল থেকে নীচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তারপর অন্ধকারের মধ্যে দৌড়োতে গিয়ে একটা পানাপুকুরে পড়ে যান এবং তাঁর চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে তোলা হয়। মেয়ে বলেও তাকে পরে থানার অত্যাচার থেকে রেহাই দেওয়া হয়নি। বেয়াল্লিশে কোনও দয়ামায়া ছিল না–স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তার হাতের আঙুলের নখের মধ্যে পিন ফোঁটানো হয়েছিল। তারা এইসব সহ্য করেছিলেন শুধু একটা স্বপ্ন দেখে। একদিন এই দেশ স্বাধীন হবে, তারপর এখানে সুস্থ মানব সমাজ গড়ে উঠবে।

যুবক দুটি এসব জানে না। তাদের জানবার কথাও নয়, তাদের বাবা মারা-ই এর মধ্যে ভুলে গেছে। ওই যুবক দুটির চোখে দীপ্তি একটি নারী মাত্র, যার যৌবন এখনও অক্ষুণ্ণ আছে–খানিকটা কলঙ্ক রটায় যাকে আরও মোহময়ী মনে হয়।

কথাগুলো শুনে দীপ্তির.শরীরে যেন একটা ঝাঁকুনি লাগল। সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে মেয়েরা মাথা নিচু করে চলে যায়, না শোনার ভান করে। কিন্তু দীপ্তি জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন। তিনি মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

যুবক দুটি সোজাসুজি দীপ্তির চোখে চোখ রাখল। তারা তৈরি হয়ে আছে। দীপ্তি কিছু বললেই তারা আরও অনেকগুলো কুবাক্য ছড়াবে। এমনকী তারা একটা খারাপ গানও গাইতে পারে। কেউ তাদের সেই অধিকার কেড়ে নিতে পারে না।

দীপ্তি কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন নির্নিমেষে। তাঁর চোখে রাগ নেই। অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটা অভিমান ঠেলে আসতে চাইছে তার বুক থেকে। তিনি বলতে চাইলেন, তোমরা আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, আমার মুখে যদি কোনও পাপ দেখতে না পাও, তা হলে ফিরিয়ে নাও তোমাদের কথা।

কিন্তু মুখে এসব উচ্চারণ করা যায় না। তিনি আবার মুখ ফিরিয়ে সঙ্গের ছেলেটিকে বললেন, চল।

তিনি কিছু দূর চলে যাবার পর যুবকরা আবার মুখ খুলল। তারা বুঝিয়ে দিতে চায়, তারা ওই রমণীর ব্যক্তিত্ব দেখে অভিভূত হয়ে যায়নি। অত সোজা নয়।

একজন বলল, এ আবার তেজ দেখানো হচ্ছে।

আরেকজন বলল,…

অর্থাৎ কোনও নারী বা পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও যদি কাছাকাছি আসে, তা হলে তাদের তেজ দেখাবার কোনও অধিকার নেই। বরং অন্য সকলের অধিকার আছে তাদের ভর্ৎসনা করার। তুমি আমি যা খুশি করি, লোককে ঠকাই, বাবা-মাকে অযত্ন করি, শিশুদের কুশিক্ষা দিই–এ-সবই চলতে পারে, কিন্তু সমাজের স্বীকৃতি ছাড়া দু’জন নারী-পুরুষের মিলন-এ কক্ষনও হতেই পারে না।

আশ্রমে ফিরে এসে দীপ্তি কারোকে কিছু বললেন না, বিছানায় শুয়ে শুয়ে কঁদলেন কিছুক্ষণ। তারপর চোখ মুছে উঠে পড়ে ভাবলেন, ছিঃ, আমি এত দুর্বল হয়ে পড়ছি কেন? লোকের কথায় কী আসে যায়?

সূর্যর কানেও যখন এসব কথা আসতে লাগল, তাকেও কিছু কিছু টিটকিরি সহ্য করতে হল। তখন সে বড় বিপর্যস্ত বোধ করল। এ কী ধরনের অদ্ভুত শত্রুতা, যার প্রতিরোধ করার কোনও উপায় তার জানা নেই। শত্রু এখানে বস্তুত অদৃশ্য। গুজব কে বা কারা ছড়াচ্ছে তা জানার উপায় নেই। রাস্তায় ছেলেরা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বাঁকা বাঁকা উক্তি করলেও তা নিয়ে ঝগড়া করা যায় না। সেটা আরও বিসদৃশ ব্যাপার হয়।

সূর্য খানিকটা মুষড়ে পড়ল। সে বেশি শঙ্কিত বোধ করল দীপ্তিদির জন্য। তার এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু দীপ্তিদি কি এতটা সহ্য করতে পারবেন?

এ-রাস্তায় নতুন বাস চলতে শুরু করেছে। বাস এলেই আশ্রমের ছেলেরা ছুটে তা দেখতে যায়। একদিন সত্যেন গুহ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, চলন্ত বাস থেকে একদল নব্য যুবা তার উদ্দেশে কতকগুলো অশ্রাব্য উক্তি ছড়িয়ে গেল। তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। বিস্ফারিত চোখে তাকালেন আশ্রম-বালকদের দিকে। ফিরে এসেই তিনি প্রার্থনায় বসলেন, প্রায় এক ঘন্টা সেখানেই রইলেন চোখ বুজে, কী সমাধান তিনি পেলেন কে জানে!

সূর্য শিলিগুড়ি স্টেশনে গিয়েছিল একটা কাজে। কাজ সেরে ফেরার জন্য বাস ধরতে যাচ্ছে, দেখল বাসের জানলার পাশের সিটে বসে আছেন দীপ্তি। সূর্য তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে উলটে দিকে ফিরে হন হন করে হাঁটতে লাগল। কাছাকাছি একটা চায়ের দোকান। দেখে ঢুকে পড়ল তার মধ্যে।

দীপ্তি সূর্যকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি নেমে এলেন বাস থেকে। সূর্যর কাছে এসে একটু রুক্ষ ভাবে বললেন, তুমি আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে চলে এলে কেন?

সূর্য তক্ষুনি কোনও উত্তর দিল না। প্রায় তিন-চার মাস বাদে দীপ্তি এই রকম ভাবে  আলাদা কোনও জায়গায় সূর্যর সঙ্গে কথা বললেন। তাও অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত সময়ে।

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সূর্য বলল, আমাদের একসঙ্গে এক বাসে না যাওয়াই তো ভালো।

কেন?

আপনি তো তাই চান।

কে বলেছে তোমাকে? আমরা এক আশ্রমে এক জায়গায় থাকি–অথচ বাইরে দেখা হলে কেউ কারোকে চিনতে পারব না–মুখ ঘুরিয়ে চলে যাব–এটা কি সম্মানজনক। ব্যাপার? লোকের কথার বেশি মূল্য দিলে তারা আরও বেশি পেয়ে বসে।

আপনি আমার সঙ্গে কখনও একসঙ্গে বেরোতে চাননি।

সেটা আলাদা কথা।

সূর্য মুখ ভরিয়ে হাসল। চুম্বক-আকৃষ্টের মতন দীপ্তির চোখে চোখ রেখে মনে মনে বলল, পৃথিবীতে তোমার চেয়ে সুন্দর কেউ নেই। আমি অন্তত আর কারোকে দেখিনি। এখনও তোমাকে দেখলে আমার বুকের মধ্যে কাঁপে।

সূর্য বুক ভরে নিশ্বাস নিল, উজ্জ্বল চোখে তাকাল দীপ্তির দিকে। তারপর বলল, তুমি যদি মনে জোর আনতে পারো, তা হলে আমি কারোকে গ্রাহ্য করি না। আমি তোমার জন্যই চিন্তিত বোধ করছিলাম। কারণ তুমি লোকলজ্জাকে ভয় পাও। এই সামান্য লোকলজ্জার কারণেই তুমি একদিন আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। এর জন্য তুমি তোমার। নিজের মনটাকেও গুটিয়ে রেখেছিলে।

দীপ্তি মৃদুস্বরে বললেন, না ও জন্য নয়। আমি নিজের বিবেক ছাড়া আর কারোর কাছে দায়ী নই।

সূর্য স্পষ্ট গলায় বলল, তা হলে তোমার বিবেক পরিষ্কার করে নাও। আমরা কোনও অন্যায় কাজ করছি না। আমরা পরস্পরকে চাই। এটা সম্পূর্ণ আমাদের দুজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর সঙ্গে আমাদের কাজের কোনও সম্পর্ক নেই। সমাজের জন্য আমরা যা কাজ করছি তার ভালো-মন্দের বিচার হতে পারে, কিন্তু আমাদের নিভৃত জীবনের ব্যাপারে মাথা ঘামাবার অধিকার কারওর নেই। তবু যদি কেউ সেদিকে নোংরা চোখ ফেলতে আসে জোর করে তা অস্বীকার করতে হবে। তুমি যদি ঠিক থাকো, তা হলে আমি প্রকাশ্য রাস্তায় তোমার সঙ্গে পাশাপাশি হাটব, আড়ালে লুকোব না, দরকার হলে হাতে একটা চাবুক রাখব সামনের বাধা সরিয়ে দেবার জন্য। ক্যারাভান যখন যায়, তখন কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, তাতে ক্যারাভান কখনও থামে না।

দীপ্তি বললেন, এসব কথা আলোচনার জায়গা এটা নয়। চলো বাসে উঠবে না?

সূর্য দীপ্তিকে নিয়ে এসে বাসের জানলার কাছে বসল। তার পরেও অবিরাম কথা বলে যাচ্ছে। অন্য কে দেখছে বা শুনছে সে-দিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। এই ক’মাসে দীপ্তি এক দিনও তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেননি, আজ নিজে এসে প্রকাশ্যে তার সঙ্গে কথা বলায় সূর্যর সমস্ত অভিমান যেন এক ফুঙ্কারে উড়ে গেছে।

বাস থেকে নেমে সে আবার বলল, তুমি তো জানেনা, তোমার জন্য আমি সবকিছু। ছাড়তে পারি। তবু তুমি কেন আমাকে এড়িয়ে থাকতে চেয়েছিলে এতদিন? আমি এর কোনও যুক্তির মাথা-মুন্ডু বুঝতে পারি না।

দীপ্তি বললেন, সূর্য, তুমি আমার একটা কথা শুনবে?

বলো।

তুমি অন্য একটি বিয়ে করো। তারপর তুমি যদি চাও তা হলেও এই আশ্রমে থাকতে পারো–আমি বড়মামাকে বলে কয়ে রাজি করাব। এতেই লোকের কথাবার্তা সব থেমে যাবে।

সূর্য প্রস্তাবটা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বলল, এ তুমি কী ছেলেমানুষের মতন কথা বলছ? আমি চাই তোমাকে, আর বিয়ে করব অন্য একটা মেয়েকে? এ রকম ভন্ডামি তুমি আমার কাছ থেকে আশা করো?

আমার সম্পর্কে টানটাও তোমার আস্তে আস্তে কমে যাবে–

তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ?

না, না, সে কথা বলছি না। আমি বলছি যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে সবকিছুই অন্য রকম হয়ে যায়।

পরে কী হবে, সে কথা ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকা আমাদের মানায় না দীপ্তিদি। আমরা জীবনে অনেক রকম ঝুঁকি নিয়েছি। পরে সে জন্য কখনও কি অনুতাপ করেছি? দীপ্তিদি তুমি আর কোনও দ্বিধা কোরো না। আমাকে তোমার পাশে থাকতে দাও। তোমার জন্য আমি সব সময় ছটফট করি। কত দিন তোমাকে ছুঁইনি, তবু এখনও আমার হাতে তোমার শরীরের গন্ধ লেগে আছে। সত্যি করে বলো তো, তুমি আমাকে ভালোবাসো না!

দীপ্তি তক্ষুনি কথাটার উত্তর দিতে পারলেন না। মুখ ফিরিয়ে রইলেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন, সূর্য প্রতীক্ষা করে আছে, বলতে তাকে হবেই। মন্থর ভাবে রাস্তার পাশ থেকে একটা বুনো ফুল ছিঁড়ে নিলেন। তারপর বললেন, কী জানি! ভালোবাসা কাকে বলে আমি ঠিক জানি না বোধহয়। তুমি আমাকে উতলা করে দাও। কিন্তু তোমাকে আমি আগে যা অনেক বার বলেছি সেইটাই সত্যি। মনে মনে সারা জীবন আমরা খুব কাছাকাছি থাকব–তা ছাড়া অন্য উপায় নেই।

মনে মনে কাছাকাছি থাকা নিতান্ত ছেলেমানুষি ব্যাপার। আমরা সেই বয়স পেরিয়ে এসেছি।

সূর্য, আমি জানতাম, এই আশ্রমের জীবন তোমার জন্য নয়।

এতদিনের মধ্যে এক বারও কি আমি অন্যায় কিছু করেছি। এখন তুমি অন্য লোকের কথা শুনে আমাকে এই কথা বলছ। তবে, একথা ঠিক, আমি শুকনো সন্ন্যাসী কিংবা দাঁত-মুখ খিচোনো পলিটিশিয়ান হতে পারব না কখনও। আমি কাজ করতে ভালোবাসি, মানুষের উপকার চাই, তা বলে নিজেকেই বা বঞ্চনা করব কেন? ভবিষ্যৎ জেনারেশনের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য আমরা খাটব ঠিকই, তা বলে নিজেরা সবকিছু ত্যাগ করব–এটা ঠিক নয়। এটা অবৈজ্ঞানিক! যারা মুখে এক কথা বলে আর কাজে অন্য রকম করে–আমি তাদের দলে নই, তুমি তা ভালো করেই জানো।

দীপ্তি মুখ নিচু করে নিঃশব্দে আঁটছেন। সূর্য তাঁর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে আবেগ কম্পিত গলায় বলল, দীপ্তিদি, আমি তোমাকে কী ভীষণ ভাবে চাই, তুমি বুঝতে পারো না? তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ো না। আমরা দু’জনে যদি পাশাপাশি থাকি, আমরা একসঙ্গে অনেক বড় কাজ করতে পারি এখনও। আমরা কারোকে গ্রাহ্য করব না। কেউ আমাদের বাধা দিতে এলে তার মুখে থুতু দেব।

দীপ্তি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ম্লান গলায় বললেন, সূর্য আমি কোনও দিন তোমাকে পাব না। আমি তোমার যোগ্য নই।

এ-কথা বোলো না।

তুমি মেয়েদের কথা বুঝবে না। যেসব মেয়েরা বিয়ে করে, তারা ছেলেবেলা থেকেই বিয়ের কথা ভাবে। তারা না-দেখা স্বামীর স্বপ্ন দেখে, না-জন্মানো ছেলেমেয়েকে মনে মনে আদর করে তখন থেকেই। আমি ছেলেবেলা থেকে কখনও বিয়ের কথা ভাবিনি। আমি অন্য রকম ব্রত নিয়েছিলুম। এখন আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, এখন কি আমার পক্ষে নতুন করে বিয়ের কথা ভাবা সম্ভব? সে সাহসও আমার নেই, সে ইচ্ছেও নেই। তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, আমাদের সমাজ সেটা সহজে মেনে নেয় না, তা ছাড়াও সাংসারিক জীবন, ছেলে মানুষ করা–এসবের সঙ্গে আমি আর নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব না।

তুমি বয়সের কথা বোলো না। তোমার কোনও বয়স নেই। তুমি চিরকালের সুন্দর।

এটা ছেলেমানুষি কথা। আমার তিরিশ বছর পার হয়ে গেছে।

বিয়ে করার ব্যাপারে আমার নিজেরও কোনও ইচ্ছে বা অনিচ্ছে নেই। বিয়ে না করলে কী হয়?

এ-আশ্রমে থেকে সেটা সম্ভব নয়, বুঝতেই পারছ।

আমরা আজই এ-আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে পারি। এ-আশ্রম ছাড়া কি সারা দেশে আর কোনও কাজের জায়গা নেই?

তারপর সারা জীবন আমরা সমাজ থেকে পলাতক থাকব? কিংবা কোনও অচেনা জায়গায় গিয়ে মিথ্যে পরিচয় দেব? ও রকম পাশ্চাত্য ধরনের জীবন আমার জন্য নয়। তোমাকে আর একটা সত্যি কথা বলি, না হলে আমার পাপ হবে!

দীপ্তি গাঢ় চোখ তুলে সূর্যের দিকে তাকালেন। স্পষ্ট বোঝা যায় তার চোখে জল এসে গেছে। তিনি বললেন, তুমি যখন এই আশ্রমে জোর করে থাকতে এলে, তখন আমি সব সময় তোমার ওপর রাগ করতুম। কিন্তু আমি তখন তোমার চেয়েও বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। তোমাকে দেখলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি বলেই তো তোমার কাছ থেকে পালাতে চাই। এখানে, প্রথম দিকে রাত্তিরবেলা আমার ঘুম আসত না, বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করতাম, খালি ইচ্ছে করত, উঠে তোমার ঘরে চলে যাই, তোমার ঘুমন্ত মুখে একবার হাত ছোঁয়াই। কত কষ্টে যে নিজেকে দমন করেছি। নইলে যে আমি নিজের কাছেই ছোট হয়ে যেতাম! এখন আমি নিজেকে সামলে নিতে পেরেছি। এখন আমার বাসনা মরে গেছে। ভালোবাসার জন্য যারা সমাজ থেকে পলাতক হতে পারে, আমি আর তাদের মতন নই।

সূর্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দীপ্তি তাকে বাধা দিয়ে বললেন, আমাকে আর একটু বলতে দাও। যারা একবার রাজনীতি বা সমাজ সেবার কাজে আসে, তারা এর থেকে আর বেরিয়ে যেতে পারে না। এটা একটা সাঙ্ঘাতিক নেশা। আমিও এর থেকে দূরে গিয়ে আর কোনও দিন স্বস্তি পাব না। তুমি রাজনীতিতে এসেছিলে ঝোঁকের মাথায়, তুমি। সবকিছুই করো ঝোঁকের মাথায়, সেইটাই তোমার চরিত্র! কিন্তু আমার ব্যাপার তা নয়, আমি ছেলেবেলা থেকেই এর সঙ্গে মিশে আছি।

আর একটা কথা ভেবে দেখো। আমাদের জন্য বড়মামার আশ্রমটা ভেঙে যেতে বসেছে। আমাদের বয়স আছে, আমরা তবু অন্য কিছু করতে পারি, কিন্তু উনি কী করবেন? এই আশ্রমই ওঁর জীবনের সবকিছু–এটা নষ্ট হয়ে গেলে কী নিয়ে আর বাঁচবেন? দেখছ না, কদিন ধরে কী রকম গুম হয়ে আছেন! জানি, কোনও দিন আমাদের কিছু বলবেন না মুখে–

সূর্য বলল, তা হলে কতকগুলো নীচ চরিত্রের লোকের কথা মতনই আমাদের চলতে হবে? তারা একটা অপবাদ রটাবে বলেই আমরা মাথা নিচু করে থাকব? এ-অন্যায় আমি কিছুতেই সহ্য করব না। আমি দেখতে চাই, ওরা কত দূর যেতে চায়—

এর পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে সূর্য একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে কয়েকজন আততায়ীর হাতে প্রচণ্ড মার খেল। সূর্য তার বেপরোয়া স্বভাবের জন্যই বিপদটা ডেকে আনল। সে তার কাজকর্ম, ছেলেদের নিয়ে হইচই চালিয়ে যাচ্ছিল পুরো মাত্রায়। জলপাইগুড়ি শহরে যখন তখন যায়। পূর্ববর্তী পরিচিত লোকদের সঙ্গে ডেকে ডেকে কথা বলে। কথা বলার সময় সরাসরি তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউ অন্য প্রসঙ্গে কিছু বললেই সে উত্তর দেবে।

কেউ কিছু বলে না। এমনকী কয়েক দিন পর গুজবটা একটু কমেছেও মনে হয়। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে কয়েক জন এসে সূর্যকে লাঠি ও লোহার রড দিয়ে খুব পিটিয়ে যায়। সূর্য হাত-পা ছুঁড়ে যতদূর সম্ভব বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু অতর্কিত আক্রমণের জন্যই নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি।

সেই সব দিন তো এখন আর নেই, যখন শত্রুকে পেছন থেকে আঘাত করত না মানুষ। নিরস্ত্র শত্রুকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র দেওয়া ছিল শৌর্যের নিদর্শন। এখন চুপি চুপি তিন-চার জন মিলে অসহায় একজনকে মারতেও কোনও দ্বিধা নেই। শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে-কোনও কুকর্মও মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের অঙ্গ হিসেবে চলে যায়। স্বাধীনতার পর দলের শক্তি বাড়ানোর জন্য কংগ্রেস দলই প্রথমে গুন্ডা শ্রেণিকে প্রশ্রয় দেয়–তারপর পরম্পরা অনুযায়ী অন্য দলগুলিও সেই পথ গ্রহণ করে এবং এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী চলে।

সূর্যকে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলার বোধহয় ইচ্ছে ছিল না আততায়ীদের, খানিকটা শাস্তি দিতেই চেয়েছিল। সে মরে গেলে এই মুখরোচক প্রসঙ্গটা থেমে যেতে পারে তার বদলে দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার মেরে এটাকে জিইয়ে রাখা দরকার। তা ছাড়া যে মরে, সে অনেক সময় শহীদ হয়ে যায়–এও একটা ঝঞ্জাটের ব্যাপার। আধমরা হলে খবরের কাগজে তার নামও ওঠে না, পুলিশও বিশেষ মাথা ঘামায় না।

আশ্রমের ছেলেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটু বেশি রাত্রে মাঠের মধ্যে সূর্যকে পেয়ে যায়। ধরাধরি করে তাকে নিয়ে আসে ভেতরে। অনেকখানি রক্ত ঝরেছে তার শরীর থেকে। কিন্তু যে বেড়াল অনেক মার খেয়েছে, সে সহজে মরে না।

সত্যেন গুহ পুলিশে খবর দিলেন না, কোনও রকম হাহুতাশও করলেন না। তিনি, দীপ্তি এবং বড়মা মিলে প্রাণপণে সেবা করতে লাগলেন সূর্যর। দীপ্তি রাত জেগে বসে রইলেন সূর্যর শিয়রের কাছে।

মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে পেয়ে সূর্য দীপ্তির হাত চেপে ধরে এবং বড় বড় নিশ্বাস ফেলে। মনে হয় সে খুব সুখে আছে। যদিও তার একটা চোখ বুজে গিয়ে অনেকটা ফুলে গেছে, মাথায় মস্ত বড় ব্যান্ডেজ।

দিন চারেক পর সূর্য একটু সুস্থ হয়েছে সবে, তখনও বাইরে বেরোয় না, দীপ্তিকে দেখে সে খুব শান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, এই সামান্য ব্যাপারে ওরা আমাকে ভয় দেখাবে ভেবেছে? আমাকে চেনে না এখনও। আমি আবার যাব ওদের কাছে। আমি দেখে নেব সবাইকে।

গান্ধী আশ্রমের খাটে শুয়ে যে এ রকম উক্তি মানায় না, সেদিকে খেয়াল নেই সূর্যর।

দীপ্তি কোনও উত্তর দিলেন না।

সূর্য আবার বলল, রিভলভারটা হাতছাড়া করা উচিত হয়নি। আমি মারতাম না ওদের, শুধু একটু ভয় দেখালেই চলত।

দীপ্তি ঘর থেকে চলে গেলেন।

আশ্রমের ছেলেরা মাঝে মাঝে দরজার বাইরে থেকে উঁকি মারে। সূর্য তার চেনা ছেলেদের অনেককেই দেখতে পায় না। তাদের কথা অন্যদের কাছে জিজ্ঞেস করে, ছেলেরা একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকায়, উত্তর দেয় না। আস্তে আস্তে অনেক ছেলেই আশ্রম ছেড়ে যাচ্ছে।

সূর্য লক্ষ করল, সত্যেন গুহ, বড়মা কিংবা দীপ্তিদি যখন তার অসুখের অবস্থা দেখতে কিংবা খাবার দিতে আসেন, তারা কেউই বিশেষ কিছু বলেন না। যেন সূর্যর সঙ্গে মামুলি দু’-একটা কথা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। সূর্য যে প্রতিশোধ নেবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফেলেছে, সে কথা শোনাবার মতন কারোকে পায় না।

একদিন সকালবেলা দীপ্তি এসে বসলেন সূর্যর বিছানার কাছে একটা টুল নিয়ে। এর মধ্যে স্নান সেরে নিয়েছেন, চুল তখনও ভিজে, বাইরে যাবার উপযোগী শাড়ি পরেছেন। কয়েক রাত ভালো করে না ঘুমোবার জন্য চোখের নীচে কালো ছাপ। চিবুকে একটা দুঃখের দাগ। দীপ্তির এই রূপই সূর্যর বুকে একটা ঝাঁপটা মারে।

দীপ্তি বললেন, শোনো, সূর্য, তোমাকে না বলেই যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু মনকে শক্ত করতে পারলাম না, তাই তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি।

সূর্য অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।

কেন?

আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আমাদের দুজনের একসঙ্গে এক জায়গায় থাকা আর কোনও দিন সম্ভব নয়।

শোনো, শোনো, দীপ্তিদি–

সূর্য, এ নিয়ে আর কোনও কথা কিংবা যুক্তিতর্কের দরকার নেই। আমি মন একেবারে ঠিক করে ফেলেছি। আমি যাবই।

তা হলে আমিও যাব তোমার সঙ্গে। আমি এখানে কী করব?

না, তুমি আমার সঙ্গে যাবে না।

নিশ্চয়ই যাব। তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব।

তুমি যদি আমাকে অনুসরণ করো তা হলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। আমি এ-কথাও ভেবে রেখেছি।

দীপ্তির কথার মধ্যে এমন একটা সুর ছিল, যা শুনলেই বোঝা যায় প্রতিবাদ করা এখন অর্থহীন। দীপ্তি খুব শক্ত ধাতুর মেয়ে।

সূর্য শুধু বলল, এতদূর? তারপর চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। দু’জনেই।

একটু বাদে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে সূর্য বলল, ঠিক আছে, তা হলে আমিই চলে যাচ্ছি এখান থেকে। তুমি যাবে কেন? এটা তো তোমারই নিজের জায়গা।

দীপ্তি বললেন, সত্যি যেতে চাও?

হ্যাঁ।

তাতে আমি আপত্তি করব না। আমার জন্য তুমি আর নিজের বিপদ ডেকে এনো না।

সূর্য গম্ভীর ভাবে বলল, ঠিক আছে। আমি কালই চলে যেতে পারব। তাতে তুমি খুশি হবে তো?

হ্যাঁ। আর কখনও এখানে এসো না।

আসব না।

সূর্য, আমি জানি সারা জীবনে আর তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। না হওয়াই ভালো।

সূর্যর চলে যাওয়ার ব্যাপারে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবার পরেও দীপ্তি আর একটাও কোমল কথা বললেন না তার সঙ্গে। আর নিভৃতে দেখা হল না। সত্যেন গুহ দীপ্তিকে কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, দীপ্তি উত্তর দিলেন, না বড়মামা আর কোনও কথা বোলো না। এইটাই সবচেয়ে ভালো পথ। এতে ও আর আমি দু’জনেই ভালো থাকব।

সূর্য যখন আশ্রম থেকে বিদায় নিল তখন আশ্রমের অনেকেরই, এমনকী সত্যেন গুহর পর্যন্ত চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু সূর্যর চোখ শুকনো।

শিলিগুড়ি স্টেশনে সে ট্রেনের কাছে দাঁড়িয়েছে। আশ্রমের যে-দুটি ছেলে তার সঙ্গে এসেছিল তারা চলে গেল এইমাত্র। সূর্য শেষ বার ঘাড় ঘুরিয়ে চতুর্দিকে তাকাল। তার মনে হল, সমস্ত লোকজন যেন আড়চোখে তার দিকেই দেখছে এবং মুখ ফিরিয়ে হাসছে। সকলেই ভাবছে, সে হেরে গেছে, সে কাপুরুষ, সে মার খেয়ে ভয়ে পালাচ্ছে।

সেই সময় সূর্যর উষ্ণ নিশ্বাসের কাছাকাছি যদি কেউ থাকত, তা হলে বোধহয় দগ্ধ হয়ে যেত।

আবার শুরু হল সূর্যর ভ্রাম্যমান জীবন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *