2 of 3

৬৭. হেমাঙ্গর দাড়ি ক্ৰমে বেড়ে যাচ্ছে

৬৭

হেমাঙ্গর দাড়ি ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। গোঁফের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে ঠোঁট। মুখময় দাড়ির একটা রাগী ও সতেজ প্রকাশ। কিন্তু দাড়ি-গোঁফে কিছুই ঢাকতে পারে না হেমাঙ্গ। ঢাকা পড়ে না তার বিষাদ, তার নিঃসঙ্গতা। কাজটা কিরকম হল? হতে পারত। অথচ হল না। রশ্মি আর কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাবে ইংলন্ডে। ভীষণ ব্যস্ত সে। এবার তার পাকাপাকি যাওয়া।

বিচ্ছেদটা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না হেমাঙ্গ। সে রশ্মিকে প্রত্যাখ্যান করেনি। সেই সাধ্যই ছিল না তার। সে প্রত্যাখ্যান করেছিল স্থায়ী বিলাত-বাসকে। রশ্মিকে বলেছিল, আমি পারব না রশ্মি। আমি বড় হোম-সিক, এই দেশে, এই কলকাতায় আমার বড় মায়া। আমি পারব না।

রশ্মি নরম প্রকৃতির মেয়ে, কিন্তু ভাবপ্রবণ নয়, তার আবেগও তাই বেশি নয়। একটু ভেবে বলেছিল, আমি তা জানি হেমাঙ্গ। মানুষকে ট্রানস্‌প্ল্যান্ট করা বেশ কঠিন, যদি তার নস্টালজিয়া স্ট্রং হয়। আমি হয়তো স্বার্থপরের মতো তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। যাকগে।

হেমাঙ্গ অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, তাহলে?

রশ্মি একটু সাদা, একটু উদ্‌ভ্রান্ত মুখে বলেছিল, তুমি ভেব না, আমি এটা সয়ে নেবো।

আমি কি তোমাকে অপমান করছি রশ্মি? আমি— আমি সত্যিই তোমাকে এত ভালবাসি, থাকতেই পারব না।

রশ্মি কিছুক্ষণ তার বিষাদমাখা মুখখানা আকাশের দিকে তুলে রেখেছিল। নৌকো দুলছিল। ঢেউ ভাঙার গভীর শব্দ হচ্ছিল নৌকোর গায়ে। রশ্মি চোখ নামিয়ে বলেছিল, আমাকে তুমি এ দেশে থাকতে বলছো?

প্লিজ, রশ্মি! প্লিজ। থাকো।

রশ্মি দাঁতে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দেখ হেমাঙ্গ, শুধু বিয়ের জন্য যদি থাকি সেটা আমাকে আর তোমাকে পরে যন্ত্রণা দেবে। কোনও সময় হয়তো মনে হবে, আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার এখনও অনেক কাজ পড়ে আছে ওখানে। এ দেশে কিছু হওয়ার নয়, তুমিও তো জানো।

খানিকটা জানি। কিন্তু কেন তুমি ফিরে আসবে না?

ফিরে আসব না, বলিনি। কিন্তু ততদিনে হয়তো বয়স থাকবে না, মনটা অন্যরকম হয়ে যাবে। বাঁধাবাঁধির দরকার কি বলো? মা-বাবা এবার চেয়েছিলেন আমি বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে বিলেত যাই। সেটা সম্ভব হত, তুমি রাজি থাকলে। তুমি যেতে চাইলে না, আমাকে একাই যেতে হবে। কিন্তু তোমাকে কেন কতগুলো কন্ডিশনে বেঁধে যাবো? সহ্য করা কঠিন হবে, কিন্তু তবু কন্ডিশন না থাকাই ভাল।

কেন ভাল?

রশ্মি খুব গম্ভীর মুখ করে বলল, এটা তো সেই আগের যুগ নয়, হৃদয়ের ব্যাপারটা নিয়ে যখন বাড়াবাড়ি হত। এখন আরও কত দিক আছে জীবনের।

যদি আমি অপেক্ষা করি?

কেন করবে?

তুমি রাগ করেছে রশ্মি?

রশ্মি মাথা নেড়ে বলে, রাগ নয়, অভিমান নয়, অপমানও নয়। আমার বরং একটু একা লাগছে। তুমি কেন যেতে চাও না, তা আমি বুঝেছি। আমি ইনকনসিডারেট নই।

শোনো রশ্মি, আমার বিয়ে করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। তোমাকে দেখে সেটা হয়েছিল। কিন্তু আর নয়। এবার আমি একাই থাকব। অপেক্ষা করব।

রশ্মি একটু চুপ করে থেকে বলল, নিজেকে মুক্ত রাখো হেমাঙ্গ। ওরকম শর্ত নিয়ে থেকো না। আমরা অ্যাডোলেসেন্স-এর সময়টা পার হয়ে এসেছি। তাই না?

হেমাঙ্গ চুপ করে থাকে।

রশ্মি খুব নরম করে বলে, এ-দেশে কেউই কেন যে সময়মতো অ্যাডাল্ট হয় না, বহুদিন অবধি ছেলেমানুষ থেকে যায়! তুমিও ছেলেমানুষ।

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, তা নয় রশ্মি। আমি হয়তো একটু আবেগপ্রবণ। কিন্তু তোমাকে যে মনেপ্রাণে চাই।

রশ্মি তার দিকে একটু মায়াভরে চেয়ে থেকে বলেছে, আমিও তো তোমাকে চাই। কিন্তু আমি অন্য সব ব্যাপারগুলোকেও উপেক্ষা করতে পারি না। সেন্টিমেন্টাল হলে কি লাভ বলো! বিয়ের পরই পুরুষ আর মহিলাদের প্রেম একটু একটু করে নেমে আসে। দেখছে না, জোয়ারের জল সরে গেলে কেমন থিক থিক করে কাদা।

যাঃ, কী বিচ্ছিরি উপমা!

রশ্মি হাসল না, গম্ভীর মুখেই বলল, বিয়ের পর হয়তো আমাদের নানারকম ক্যালকুলেশন আসত। তার চেয়ে বরং লেট আস কুইট অ্যাজ ফ্রেন্ডস্‌।

যেরকম সাহেবদের দেশে হয়?

সাহেবরা খারাপ লোক নয় হেমাঙ্গ। অনেক প্র্যাকটিক্যাল যে।

এইভাবেই এক দেশী নৌকোয় দোল খেতে খেতে মাঝদরিয়ায় তাদের সম্পর্ক শেষ হল।

আবার হলও না। হেমাঙ্গর কোনও কাজে মন নেই। পার্টনারদের হাতে অফিস ছেড়ে দিয়ে সে এই শীতে চলে গেল রানিক্ষেত। সেখানে চুপচাপ হোটেলে বসে রইল কিছুদিন। তাতে শান্ত হল না। ফিরে এল।

কিন্তু নদীর ধারের কুটিরটি তাকে আকর্ষণ করতে লাগল ভীষণভাবে। টানা প্রায় একমাস হেমাঙ্গ রয়েছে এখানে। ঘুরে বেড়ায়, নৌকোয় চেপে বেড়িয়ে পড়ে, বইয়ে ডুব দিয়ে বসে থাকে। কেউ তার খোঁজ করে না। সে বাড়িতে জানিয়েই এসেছে।

বাঁকা মিঞা রোজ হাজিরা দেয়। টেনে নিয়ে গিয়ে মাঝে মাঝে দাওয়াত খাওয়ায়।

হেমাঙ্গর কাছে পৃথিবীটা অনেকটাই বিবর্ণ এবং জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে। সেটা প্রেমের চেয়েও বেশি পাপবোধে। সে কি আঘাত করল রশ্মিকে? সে কি ভুল করল ওর প্রস্তাবে রাজি না হয়ে?

আজকাল নিজের বিছানায় একটানা অনেকক্ষণ ধ্যানস্থের মতো বসে থাকে সে। বাইরেটা স্থির, কিন্তু মনের মধ্যে ঝড়ের বাতাস বয়ে যায়।

বাঁকা মিঞা এক সকালে এসে তাকে ধরল, কী হয়েছে বলুন তো! না বললে ছাড়ছি না। আমার তো ভয় হচ্ছে, মনে কথা চেপে রাখতে রাখতে আপনি না পাগল হয়ে যান।

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলে, পাগল বলেই ধরে নাও না কেন?

ধরে নিলেই হল নাকি? আমরা চাষাভুষো যাই হই, তবু অনেকটা পথ তো পার হয়েছি জীবনে। বোকা নই। একটু খুলে বলুন তো। খুন-খারাপি তো করে আসেননি। ব্যাপারটা কী?

এক রকম খুনই।

এই তো হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে!

হেঁয়ালি একটু রাখতে হচ্ছে। সব কথা খুলে বলা যায় না।

বাঁকা মিঞা একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব করে বলে, সেই বিয়ের ব্যাপারটা নাকি?

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

জিজ্ঞেস করতে লজ্জা হয়। তবু বলি, ব্যাপারটা কেঁচিয়ে দিলেন কেন? মেয়েটা দেখতে তো পরীর মতো। তার ওপর কত লেখাপড়া জানে। অবশ্য আমাদের মতো গেরস্তর ঘরে ওসব মেয়ে অচল। কিন্তু আপনার তো তা নয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হেমাঙ্গ বলল, ঠিকই বলেছো। বড় ভাল মেয়ে। অত ভাল আমার সইল না।

তাই ঘরে বসে বসে কেবল বড় বড় শ্বাস ছাড়ছেন? আপনার মতো ছেলের কি মেয়ের অভাব হবে?

তা নয় বাঁকা, মনটা খারাপ।

এখন উঠুন তো। চলুন একটু ঘুরেটুরে আসবেন।

আমার যে একটু চুপচাপ থাকতে ইচ্ছে করছে। নড়তে চড়তে ভালই লাগছে না।

পাগল নাকি? শরীর বসিয়ে রাখলে নানা আধিব্যাধি হয়। মনটাও একটু ফুর্তিতে রাখা দরকার।

কোথায় যাবো?

চলুন আজ গোসাবার দিকে যাওয়া যাক। একটা মোচ্ছব আছে। কীর্তন-টির্তন হবে। বড় গানাদাররা আসছে।

হই-চই ভাল লাগবে না বাঁকা। বরং জঙ্গলের দিকে যাই চলো।

তাই চলুন।

গেল হেমাঙ্গ, নৌকোয় করে নদী আর খাল ধরে বিস্তর ঘুরল। বাঘা-জঙ্গলের ধারেকাছেও ঘোরাফেরা হল। কিন্তু মনের মেঘ কাটল না। এত বিবর্ণ এত নিস্তেজ তার কখনও লাগেনি চারপাশটাকে। তবু এ জায়গা বলে রক্ষা। কলকাতা হলে সে পাগল হয়ে যাবে বোধহয়।

অনেক রাত অবধি বাঁকা আজ রইল তার কাছে। বেশি কথা বলল না। তবে একবার বলল, বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।

হেমাঙ্গ জবাব দিল না। নদীর ঢেউ আর বাতাসের শব্দ শোনে। একঘেয়ে, একটানা, ছেদহীন। ধ্যানস্থের মতো বসে থাকে। রুজি-রোজগার, উন্নতি, সাফল্য, প্রতিষ্ঠা সব বৃথা মনে হয়। বেঁচে থাকাটাও কত দুর্বহ, কত অর্থহীন!

বাবু, মেয়েটাকে কি আপনার খুব পছন্দ ছিল?

হেমাঙ্গ একটু হাসল, অপছন্দের কিছু আছে?

তবে হল না কেন?

সে অনেক কথা বাঁকা।

কথা বলে খোলসা হচ্ছেন না কেন? বাঁকা মিঞা তো পাঁচকান করবে না।

হেমাঙ্গ আবার একটু হাসল, তুমি সাদা লোক। কিন্তু দুষ্টুবুদ্ধিতে কিছু কম নও। চারদিকে খবর দিয়ে আনিয়েছিলে।

সে আপনার অবস্থা দেখে। এখন তো অবস্থা আরও খারাপ দেখছি।

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, এ সমস্যার সমাধান বাইরের কেউ করতে পারবে না বাঁকা।

তা হলে আপনিই করুন না কেন?

কী করব?

একটা ভাল দেখে বিয়ে করে ফেলুন।

হেমাঙ্গ হাসিমুখে বাঁকার দিকে চেয়ে রইল। বাঁকার কোনও হৃদয়ঘটিত সমস্যা হয়নি কখনও। হবেও না। বাঁকা সব সমস্যার সহজ সমাধান করে ফেলতে পারে। হেমাঙ্গ পারে না। দুজনের এই ব্যবধানটাকে সে কিছুক্ষণ মেপে দেখতে চেষ্টা করল।

বাঁকাও তার দিকে চেয়ে ছিল। বলল, মেয়েমানুষ নিয়ে অত ভাববার কী আছে? আমরা তো অত ভাবিটাবি না।

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, তা নয় বাঁকা, মেয়েটার বোধহয় অপমান হল।

বাঁকা একটু শব্দ করেই হাসল, তাহলে বিয়েটা করলেই তো পারতেন। আপনি নিজেই তো গিঁট পাকিয়ে তুলছেন। সেইজন্যই তো ভাবনা।

তুমি বুঝবে না বাঁকা। আমার মনটা বড় খারাপ।

কাল রাতে একটা যাত্রা দেখতে যাবেন? নতুন দল। বনগাঁ থেকে এসেছে।

হেমাঙ্গ মাথা নাড়ল, ইচ্ছে করে না যে!

দেখুন না, ভালও লেগে যেতে পারে। কোরাকাঠিতে হচ্ছে। বেশী দূরও নয়। বিশ্ববিজয় অপেরার এখন বেশ নাম।

হেমাঙ্গ চুপ করে রইল। কোনও আমোদ-প্রমোদই তার ভাল লাগছে না। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। এমনকি সকালের বেড়ানোটা পর্যন্ত ক্লান্তিকর মনে হয়।

বাঁকা চলে যাওয়ার পর অনেক রাত অবধি জানালার কাছে বসে রইল সে। অসহ্য শীত। জল-ছোঁয়া বাতাসে হাড় অবধি অবশ হয়ে যেতে চায়। তবু বসে রইল। ঘুম আসতে চায় না।

শোওয়ার আগে তার হঠাৎ মনে হল, আজ কী বার? ঘরে কোনও ক্যালেন্ডার নেই। পত্রিকা আসে না। রেডিও বা টেলিভিশন নেই। অটোমেটিক ঘড়িটা হাতে দেয় না বলে বন্ধ হয়ে আছে। শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবল সে। আজ কী বার? কত তারিখ? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল, কী হবে জেনে? একটা দিন গেল— এই মাত্র।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল মেঘলা আকাশের ছায়ায়। আজকের দিনটা ভাল যাবে না— মনে হল হেমাঙ্গর। খুব হাওয়া দিচ্ছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। শীত আরও বাড়বে। নিজে এক কাপ কফি করে নিয়ে ঘরে বসল হেমাঙ্গ। আজ কিছু করার নেই।

একটু বেলার দিকে বৃষ্টিটা রইল না। তবে মেঘলা ছাড়েনি। হেমাঙ্গ বাইরে বেরিয়ে দূরের আকাশের দিকে চেয়ে রইল। কাজের মেয়েটা কদিন আসছে না। জ্বরে পড়ে আছে। তাতে কোনও অসুবিধে নেই হেমাঙ্গর। সে ঘর ঝাঁট দেয় না। সামান্য কয়েকখানা বাসন নিজেই মেজে নেয়। বাঁকা মিঞা টের না পেলে না-বেঁধে এবং না-খেয়েও কেটে যায় এক-আধ বেলা।

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাটের দিকে চোখ নেমে এল তার। একখানা ভটভটি এসে ঘাটে লাগল। লোক নামছে। তাদের মধ্যে একজনকে দেখে চমকে উঠল সে। যার কথা আজকাল দিন-রাত ভাবে সে। ভেবে মন খারাপ হয়। সে-ই। পিছনে চারুশীলার বর সুব্রত।

খুব আস্তে আস্তে উঠে এল রশ্মি। একটু রোগা হয়েছে কি? একটু উসকোখুসকো?

ফটকের কাছে এগিয়ে দাঁড়াল হেমাঙ্গ। বুকটা থরথর করছে। হতাশা আর বিহুলতায় নিজের বশে থাকছে না সে।

ঘাট থেকে ওপরে উঠে ডানদিকে তার বাড়িমুখো মোড় নিতেই একটু দূর থেকেই তাকে দেখতে পেল রশ্মি। একটু হাসল। হাসিটা কি খুব বিষণ্ণ! অন্তত প্রাণহীন।

ফটকটা খুলে দিয়ে হেমাঙ্গ বলল, এসো।

কী চেহারা হয়েছে তোমার! চেনাই যায় না যে!

দাড়িটা কাটছি না।

চুলও আঁচড়াও না বোধহয়! বাবরি রাখছো?

একটু তফাতে সুব্রত। ধীরে হাঁটছে। তাদের একটু সুযোগ দিতে চাইছে হয়তো।

আসুন সুব্রতদা।

তুমিই হেমাঙ্গ নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম কোনও চাষীর বাড়িতে ভুল করে ঢুকে পড়ছি।

চাষীই তো! চাষী হওয়ারই চেষ্টা করছি।

সুব্রত ঘরে ঢুকতে চাইল না। বলল, তোমরা ভিতরে গিয়ে একটু কথা বলে নাও। আমি বাইরে বসছি।

হেমাঙ্গর বুকটা কাঁপছিলই। কাঁপন দ্রুততর হল মাত্র। রশ্মিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে সে অপ্রতিভ বোধ করতে লাগল। একটা প্রত্যাশা জাগছিল মনে। হয়তো—

রশ্মি মৃদু স্বরে বলল, কাল চলে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতে এলাম।

বোসো রশ্মি। একটু বোসো।

রশ্মি বসল। বলল, তোমার বাড়িতে ফোন বেজে যায়, কেউ ধরে না। চারুদি বললেন, তুমি কলকাতায় যাচ্ছোই না আজকাল। শুনে ভীষণ খারাপ লাগল।

তাই এলে?

আর দেখা হবে কি না কে জানে! আমি জানতে এলাম, এরকম করছো কেন? কী হয়েছে তোমার?

স্পষ্ট করে বলব?

কেন বলবে না?

আমার কেবল মনে হচ্ছে, তোমার প্রতি বড় অন্যায় করেছি।

রশ্মি হাসল, একটু ফ্যাকাশে হাসি। মৃদুস্বরে বলল, আমি তা মনে করি না।

তোমাকে আমি অজান্তে অপমানও করেছি হয়তো।

এসব ভেবেই সন্ন্যাস নেওয়ার চেষ্টা করছো?

না রশ্মি, আমি তোমাকে ভুলতে পারছি না। কেবল মনে হচ্ছে, ভুল করলাম।

শোনো, ভুল করলে তার সংশোধনের উপায় আছে। ইচ্ছে করলেই তুমি সাতদিনের মধ্যে ইংল্যান্ডে গিয়ে হাজির হতে পারো। তাই না?

গেলে তুমি খুশি হবে?

হবো না? কিন্তু সেটা করার আগে একটু ভেবো। তুমি ভীষণ ভদ্রলোক, তাই তোমার কেবল মনে হচ্ছে আমার প্রতি অন্যায় করেছে, তা তো নয়। অকপট হওয়াই তো ভাল।

হেমাঙ্গ লজ্জায় রশ্মির মুখের দিকে তাকাতে পারল না। নতমুখ হয়ে বলল, আমার একটা আত্মগ্লানি হচ্ছে। আমি তোমাকে ভালবাসি রশ্মি।

আমি জানি। কিন্তু এরকমভাবে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছো কেন? তোমার আপনজনদেরও কষ্ট দিচ্ছো। আমাকেও।

হেমাঙ্গ মৃদু হেসে বলে, এখনও অ্যাডাল্ট হইনি যে!

সেটা বুঝতে পারছি। তুমি এরকম করলে আমারও খুব মনটা খারাপ লাগবে। এমনিতেই লাগছে।

বিয়েটা হচ্ছে না বলে তোমার বাড়িতেও নিশ্চয়ই কথা হচ্ছে।

আমার বাড়িতে কেউ অবুঝ নয়। প্রবলেমটা সবাই বুঝতে পারছে, তাই সিচুয়েশনটা মেনেও নিয়েছে। যদিও তোমাকে সকলেরই খুব পছন্দ ছিল। কিন্তু প্রাকটিক্যাল বাধাগুলোকে তো অস্বীকার করা যাবে না।

হঠাৎ হেমাঙ্গ একটু ঝুঁকে রশ্মির একখানা হাত স্পর্শ করে বলল, কেন যাচ্ছো রশ্মি? কেন যাচ্ছো? আরও বড় হয়ে কী করবে?

রশ্মির চোখ দুটো এ-কথায় ছলছল করে উঠল। সামান্য বিষাদ-মাখা গলায় বলল, আমি কিভাবে বড় হয়েছি তা তো তুমি জানো। আমার ধারাটাই যে অন্যরকম। কাজ আর পড়াশুনো ছাড়া আমার কাছে অন্য সবকিছুই আনইম্পর্টেন্ট। তুমি বিশ্বাস করবে না, আজ অবধি তুমি ছাড়া আমার জীবনে কোনও পুরুষই ওয়েলকাম ছিল না। দো দেয়ার ওয়্যার অফারস্‌ অ্যান্ড প্রোপোজালস্‌। কিন্তু ভেবে দেখেছি, এটা আমি সয়ে নিতে পারব। কোনও অসুবিধে হবে না। তুমিও এরকম ভেঙে পড়ো না। বলছি তো, যদি তোমার মন বদলায়, সত্যিকারের বদলায়, তাহলে চলে যেও।

হেমাঙ্গ করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রশ্মির দিকে।

রশ্মি মৃদু গলায় বলল, এবার ওঠো! আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। কলকাতায়।

যাবো! কিন্তু ইচ্ছে করছে না যে!

প্লিজ। কাল এয়ারপোর্টে আমাকে সি-অফ করতে হবে। আমি তোমার হাসিমুখ দেখে চলে যেতে চাই।

হেমাঙ্গ তবু ঝুম হয়ে বসে রইল।

একটু গলা খাঁকারি দিয়ে সুব্রত ঘরে এল। বলল, চলো হেমাঙ্গ। তোমার চারুদি দিনরাত তোমার কথা বলছে। ইন ফ্যাক্ট সে-ও খুব আপসেট।

কেন?

তোমাদের ঘটকালি তো চারুই করেছিল। চলো।

চারুদির কোনও দোষ নেই।

সেটা তাকে তুমিই বুঝিয়ে বলো। বিডন স্ট্রিটেও খুব ঝামেলা হচ্ছে। তোমার ওল্ড ম্যান আর ওন্ড লেডি দুজনেই খুব আপসেট। তাদের ধারণা, তোমার আইবুড়ো অপবাদ আর ঘুচবে না।

যেতেই হবে?

রশ্মি বলল, হ্যাঁ। একা থাকছো বলেই তোমার মন ভার হয়ে থাকছে। নরম্যাল জীবনে ফিরলেই দেখবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ওঠো। আজ ওয়েদার ভাল নয়। আমরা তাড়াতাড়ি ফিরব।

একটা কথা জিজ্ঞেস করবো রশ্মি?

বলো।

তুমি নিজের গরজে এসেছে, না চারুদি পাঠিয়েছে?

রশ্মি অবাক হয়ে বলে, কেন বলো তো!

এমনি।

কোনটা শুনলে খুশি হবে?

যেটা সত্যি, সেটা।

রশ্মি একটু হাসল। বলল, বড্ড সেন্টিমেন্টাল হয়েছে তো তুমি! সত্যি কথা হল, চাকদির কাছে শুনে আমি নিজেই এসেছি। চারুদি বরং আসতে বারণ করেছিল। বিশ্বাস হল?

একটা গভীর স্বস্তির শ্বাস ফেলে হেমাঙ্গ বলল, হল। মন থেকে একটা ভার নেমে গেল।

সেটাই বা কেন?

তুমি নিজের টানে এসেছে, এটা কত ভাল লাগবে ভাবতে। তাই না, বলো!

তবে কি ভেবেছিলে টান সব ছিড়ে ফেলেছি?

তোমার কথা দিনরাত ভাবছি, তুমিও যে একটু ভাবো এটা জেনে এত ভাল লাগছে!

একটু! কী অদ্ভুত লোক তুমি বলো তো!

এই সময়ে সুব্রত নিঃশব্দে ফের বাইরে গেল।

রশ্মি বলল, তোমার কথা ছাড়া কিছুই ভাবিনি ক’দিন। অন্তত বিশ বার ফোন করেছি। হাতে সময় থাকলে আরও কয়েকদিন আগেই চলে আসতাম। আজও কত কাজ ফেলে এসেছি।

হেমাঙ্গ উঠল। চারদিকে চেয়ে বলল, আমার কিছু গোছানোর নেই। শুধু পোশাকটা পাল্টানো দরকার। লুঙ্গি পরে তো যাওয়া যায় না।

রশ্মি একটু হেসে উঠে বাইরে গেল।

খুব ধীরে ধীরে পোশাক বদলায় হেমাঙ্গ। যদি এই পোশাক বদলের মতো মনটাকেও বদলে ফেলা যেত!

ভটভটিতে রশ্মির কাছাকাছি বসে রইল সে। কিন্তু কথা আসছিল না। কথা হারিয়ে বসে আছে সে। মেঘলা ময়লা আকাশের নিচে ম্লান চরাচর, জল আর ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস। এ সবের মধ্যে একটা শীতল সমাপ্তির আভাস রয়েছে।

সে একবার জিজ্ঞেস করল, মনে থাকবে রশ্মি, আমাকে?

সে কথা তার ঠোঁট থেকে কেড়ে নিয়ে গেল লুঠেরা বাতাস। রশ্মির কানে পৌঁছলো না।

আপনমনে একটু মাথা নাড়ে হেমাঙ্গ। মনে রাখার দবকার কী? কেন বন্ধন? কেন মনের বাঁধনে আটকে থাকা? কোনও দরকার নেই তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *