2 of 2

৬৭. ব্ৰাহ্মদের সঙ্গে পাল্লা

ব্ৰাহ্মদের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য শহরের অপর দলের বড় মানুষরা নানা রকম উপায় অবলম্বন করছেন, তার মধ্যে মোক্ষামটি হলো পশ্চিম থেকে সন্ন্যাসী আমদানী। নির্জন পর্বত-অরণ্যানী থেকে ধ্যান ভঙ্গ করে ঋষি-যোগীরা দলে দলে আসছেন কলকাতায়। এখানে ভক্তের অভাব নেই। আর চব্য-চুষ্য-লোহা-পেয়র অতি উত্তম ব্যবস্থা।

দুচার গণ্ডা মোসাহেব। আর দু-চারটে রক্ষিতা রাখলেই ঠিক বড় মানুষীর জাঁক হয় না, ও তো রামা ধোপা কিংবা পুঁটে তেলীরাও আজকাল রাখে। বিশেষত পূর্ববঙ্গের জমিদাররা এসে এমন ঢলাঢ়লি করে যে ও জিনিসের আর ইজৎ রইলো না। তার চেয়ে বড় কোনো সন্ন্যাসী এনে জাক-জমক করলে বেশ নতুন রকমের হেঁকড় দেখানো যায়। ধর্ম রক্ষাও হলো আর পয়সার গরম দেখানোও হলো। সন্ন্যাসীকে দিয়ে পুজো-আচা, যাগ-যজ্ঞ, কাঙালীভোজন-সংকীর্তন ইত্যাদি ব্ৰাহ্মদের অনুষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশী বণাঢ্য। ব্ৰাহ্মদের তো শুধু উপাসনা, পুরুষে-পুরুষে ভাই ভাই বলে জড়াজড়ি আর প্ৰেমাশ্রি বর্ষণ।

বন্ধুবিহারীবাবুর ইদানীং বেশ কাঁচা পয়সা হয়েছে। ইনি আগে ছিলেন এক অ্যাটর্নির বাড়ির হেড কেরানী। যে-হেতু উকিল-মোক্তার-অ্যাটনীর বাড়ির ভুষোকালি রঙের বেড়ালটা কিংবা দাড়িওয়ালা রামছাগলটা পর্যন্ত আইনের পাঁচ-ঘোঁচ শিখে যায় সেই সুবাদে বন্ধুবিহারীবাবুও ক্ৰমে মস্ত আইনবিদ হলেন এবং পাড়া গেয়ে বড়লোকদের উচিত মতন শলা-পরামর্শ দিয়ে নিজে ফুলে-ফেপে তারকেশ্বরের কুমড়োপান রূপ ধারণ করলেন। মধ্য বয়েসে এসে তাঁর হঠাৎ উপলব্ধি হলো পয়সা তো যথেষ্ট রোজগার কলুম, এবার একটু নাম কেনা যাক। ধরা-বাঁধা পথে কিছুদিন রাঢ়-ভাঁড়-মদে প্রচুর পয়সা উড়িয়েও এক সময় তাঁর একঘেয়ে লাগলো। সে রকম যেন ঠিক নাম হয় না। বস্তুত ছেলেবেলা থেকেই তাঁর একটি আড়ালের নাম আছে। তিনি সেটা জানেনও, কিন্তু সেটা ঘোচাতে পারছেন না কিছুতেই। বাল্যকালে তিনি দৈবাৎ একবার পাতকুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, তাতে তাঁর নাকের একটি দিক থেৎলে যায়। সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় নাককাটা বন্ধু। তারপর বড় হয়ে তিনি যে এত কীর্তি করলেন, তবু লোকে তাঁকে আড়ালে আবডালে ঐ নাকিকাটা বন্ধু বলেই ডাকে।

কিছুদিনের জন্য সিমলোয় বেড়াতে গিয়ে বন্ধুবিহারীবাবু এক সন্ন্যাসী ধরে আনলেন। সে এক জবরদস্ত সন্ন্যাসী বটে, দেখলে মনে হয় বয়েসের গাছ-পাথর নেই। চলমান পাহাড়ের মতন দেহ, আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত এত চুল যে কোনো মানুষের থাকতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ইনি কথা বলেন না। খোরাকী অবশ্য একটি প্রমাণ আকারের হস্তীর সমতুল্য। দশ জন চ্যালা সমেত সেই সন্ন্যাসী কাঁসাড়ীপাড়ায় বন্ধুবিহারীবাবুর বাড়িতে অধিষ্ঠিত হলেন।

দিনে দিনে সেই সন্ন্যাসীর সুনাম এমনই ছড়িয়ে পড়লো যে কাঁসারীপাড়ায় সকাল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ভিড়ে ভিড়াক্কার। এ অঞ্চলের বিখ্যাত সঙযাত্রার সময়ও বুঝি এত মানুষের জমায়েত হয় না। সন্ন্যাসী এক একদিন এক এক রকম কীর্তি দেখিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। ক্রমে এমন কথাও রটে গেল যে এই সন্ন্যাসী লোহাকে সোনা বানাতে পারেন এবং উপযুক্ত তিথির জন্য অপেক্ষা করছেন। সন্ন্যাসীর শিষ্যদের এই দাবি এক কথায় নস্যাৎ করা যায় না। কারণ মদ্যকে দুগ্ধে পরিণত করেছেন তিনি সর্বসমক্ষেই। এক কোপে বলি দেওয়া হলো একটি পাঠাকে, তারপর সন্ন্যাসী তার শরীরে কয়েকবার হাত বুলিয়ে দিতেই সেই পাঠা অমনি জীবন্ত হয়ে লাফাতে লাফাতে ব্যা ব্যা করতে লাগলো।

সন্ন্যাসীর খ্যাতি মানে তো বন্ধুবিহারীবাবুরও সুনাম। তিনি ভাড়াটে লোক দিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সন্ন্যাসীর কৃতিত্বের কথা প্রচার করতে লাগলেন। সারা শহরময়। ব্ৰাহ্মদের ওপর বন্ধুবিহারীবাবুর বড় রাগ, কেন রাগ তা তিনি নিজেই সঠিক জানেন না, তবু রাগ এবং সেই জন্য খ্যাতনামা ব্ৰাহ্মদের বাড়ির সামনেও তিনি ঢাক-ঢোলওয়ালাদের পাঠালেন বেশী করে। শহরের বিশিষ্ট বাক্তিদের তিনি চিঠি দিয়ে আহ্বান করলেন স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করে যাবার জন্য যে এখনো সনাতন বৈদিক ধর্মের কত মহিমা! মন্ত্রশক্তির কত জোর! অবিশ্বাসীরা হেঁট মুণ্ডে ফিরে যাক।

সত্যিই যেন সন্ন্যাসীর চমকপ্ৰদ অলৌকিক শক্তি দেখে অনেকের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।

কৌতূহলী নবীনকুমার একদিন এলো কাঁসারীপাড়ায়। প্রথমে সে ভেবেছিল বুঝি ভিড় ঠেলে ঢুকতেই পারবে না। দুলাল একটু ধাক্কাধাকি শুরু করেছিল বটে, কিন্তু সামনে যেন পরপর অনেকগুলি স্তরের মনুষ্য-প্রাচীর। কিন্তু একটু পরেই অন্যরূপ ব্যাপার হলো। কিছু লোক তাকে চিনতে পেরে বলে উঠলো, ওরে, নবীনকুমার সিংহ এয়েচেন, পথ ছেড়ে দে! পথ ছেড়ে দে! আবার অন্য কয়েকজন লোক বললো, কই, নবীন সিংগী কই, দেকি দেকি!

ভিড় দু ফাঁক হয়ে গিয়ে উদগ্ৰীবিভাবে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সন্ন্যাসীর তুলনায় নবীনকুমারও কম দৰ্শনীয় নয়।

নবীনকুমার যে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি তা সব সময় তার নিজের মনে থাকে না। তার মনের মধ্যে একটি বিস্ময় ও রাগড়-সন্ধানী বালক আছে, যে মন নিয়ে সে হুতোমপ্যাঁচার নক্সা লেখে, সেই মন নিয়েই সে এখানে এসেছে। কিন্তু লোকচক্ষে সে প্রখ্যাত দাতা, মহাভারতের অনুবাদক, হিন্দু পেট্রিয়টের মালিক ইত্যাদি, এবং বিপুল ধনী তো বটেই! এ ব্যাপারে সজাগ হতেই সে মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে ধীর পদক্ষেপে ভিতরে চলে এলো।

নাককাটা বন্ধু ওরফে বন্ধুবিহারীর সাজসজা দেখবার মতন! পরনে বেঁচে থাকুক বিদ্যেসাগর চিরজীবী হয়ে পাড়ের শান্তিপুরী ধুতি, লাল গজের পিরাণ, তার ওপরে ড়ুরে উড়নি, মস্তকে জড়িয়ে কাবলি তাজ এবং হাতে একটি লাল রঙের রুমাল। যাতে রিং সমেত গুটিকতক চাবি বাঁধা। তিনি খুব খাতির করে প্রথম দফায় নবীনকুমারের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলেন কয়েক বার। তারপর একখিলি পান। দিয়ে নিয়ে এলেন ঠাকুর-দালানে। একদিকে চ্যালা পরিবৃত হয়ে বসে আছেন সন্ন্যাসী। মাঝখানে ছোঁয়াছুয়ি বাঁচাবার জন্য কিছুটা স্থান বাদ রেখে তারপর পাতা হয়েছে বিশিষ্ট দর্শকদের জন্য গালিচা। সেখানে এক পাশে বসলো নবীনকুমার। আশেপাশে অনেক চেনা মুখ।

এই সব সম্ভ্রান্ত দর্শকরা প্রত্যেকে ইচ্ছে করলে দুটি প্রশ্ন করতে পারবেন সন্ন্যাসীকে। সরাসরি কথা বলবার অবশ্য উপায় নেই। বন্ধুবিহারীবাবুর বিশেষ সুহৃদ চূড়ামণি রায় উত্তম হিন্দী জানেন বলে দাবি করেন, প্রশ্নটি শুনে তিনি সেটি হিন্দী অনুবাদ করে বলবেন সন্ন্যাসীর এক চ্যালাকে, চ্যালা আবার সেটি দুর্বোধ্যতর হিন্দী করে শোনাবেন গুরুকে। মৌনী সন্ন্যাসী দু-চারবার মাথা নাডবেন শুধু। সেই মস্তক সঞ্চালনের ভাষা আবার হিন্দীতে অনুদিত হয়ে প্রশ্নকারীর কাছে উত্তর হয়ে ফিরে আসবে।

বন্ধুবিহারী নবীনকুমারকে বললেন, সিংহামোয়াই, আপনি ভাবুন তা হলে, দু-খানা কোয়েশেচন ভাবুন!

নবীনকুমারের পাশেই বসে আছেন সিমলের জগমোহন সরকার। দাঁত সব পড়ে গেছে। ফোকলা মুখ, মাথায় ইন্দ্রলুপ্ত, গোঁফজোড়া পাকা, সেই আগের মানুষটিকে আর চেনাই যায় না। ইদানীং তিনি খুব বৈষ্ণব হয়েছেন, যে-কোনো নারীকেই মা বলে সম্বোধন করেন। এমন কি কখনো কখনো নিজের পত্নীকেও মা বলে ফেলেন।

সেই জগমোহন সরকার হেকে বললেন, আহা, যৌগিবর যেন সাক্ষাৎ বেদবাস। বাবা আমার মনের দুটি সংশয় দূর করুন। কোন সাধনায় জীবাত্মা মিশে যায় পরমাত্মার সহিত? যাতে আর পরজন্ম থাকে না! আর, পুরুষ-প্রকৃতির মিলনের মধ্য দিয়েই কি পরমেশ্বর এই জগতে লীলা করেন?

চূড়ামণির মারফত ঘুরে সেই প্রশ্ন গিয়ে পৌঁছোলো সন্ন্যাসীর কাছে। সন্ন্যাসী আঙুল তুলে বাতাসের গায়ে কী সব অদৃশ্য লিপি লিখতে লাগলেন। একজন শিষ্য সেদিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টি। তারপর সে উত্তরটি জানালো। এমনই দুর্বোধ্য ও জটিল উত্তর যে অনেকেরই তা বোধগম্য হলো না। না বুঝলেই আরও ভক্তি বাড়ে। সাধারণ মানুষ তো নন যে সাধারণ ভাষায় কথা বলবেন।

এই রকম চলতে লাগলো আরও প্রশ্নোত্তর। এর মধ্যে দু-একটি প্রশ্নের উত্তর শুনে হাস্যারোলও ওঠে। যেমন সীতাপতি রায় জিজ্ঞেস করলো, প্ৰভু, আপনি বলে দিন, আমার আয়ু আর কতদিন? এর উত্তরে সন্ন্যাসী জানালেন, তুমি তো ইতিমধ্যেই মরে গেছে! জানো না, গীতায় শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জনকে কী বলেছিলেন?

ভিড়ের মধ্যে একটি থামের পাশে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্ৰনাথ তার সাগরেদকে নিয়ে। কদিন ধরেই নিয়মিত আসছে সে। তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে সন্ন্যাসীর ক্রিয়াকলাপ দেখে এ পর্যন্ত সে একটিও কথা বলেনি। সাগরেদটি ছটফট করলেও সে তার কাঁধ জোর করে ধরে রাখে।

নবীনকুমার কোনো প্রশ্ন করলো না। তবে দেখে শুনে তার তাক লেগে যাচ্ছে ঠিকই। তার মনে পড়লো, কৈশোর বয়সে, কলেজ-জীবনে সে ভূকৈলাশের রাজবাড়িতে এক মহাপুরুষ দর্শন করতে গিয়েছিল, যিনি সত্যযুগের মানুষ, গায়ে উইয়ের টিপি। কিছুদিন পরেই ধরা পড়ে গিয়েছিল তার বুজরুকি। কিন্তু এ সন্ন্যাসীকে তো সেরূপ মনে হয় না। এমন ক্ষমতা তিনি প্রদর্শন করছেন যা ব্যাখ্যার অতীত। একজন কেউ ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভিক্ষা করতেই তিনি শুধু খালি হাতটি তুললেন তার দিকে। অমনি সেই লোকটির গায়ের ওপর একটি গাঁদা ফুল এসে পড়লো। একটি বিড়াল হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল এর মধ্যে। তার পর এত লোক দেখে ভাবোচাকা খেয়ে এদিক ওদিক ছুটতে গিয়ে সোজা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সন্ন্যাসীর কোলে। সকলে হা হা করে উঠলো। কিন্তু সন্ন্যাসী সকলকে শান্ত হবার ইঙ্গিত করে বিড়ালটির গায়ে কয়েকবার হাতের স্পর্শ দিতেই সেটি একটি পারাবিত হয়ে উড়ে গেল। ডানা ঝটপটিয়ে। সকলে একেবারে তাজ্জব। এ জিনিস কেউ কখনো দেখেনি।

জগমোহন সরকার নবীনকুমারের গায়ে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, ভায়া, আমার তো কোটা ফুইরে গ্যাচে, তবু আরও কিছু জিজ্ঞেস কত্তে সাধ হচ্ছে। আপনি দুটো কোয়েশেচন আস্ক করুন না!

কিন্তু কী প্রশ্ন করবে, তা নবীনকুমারের মনে আসছে না। তার কোনো ধর্ম সংশয় নেই, জীবাত্মা-পরমাত্মার মতন ব্যাপারগুলি সম্পর্কেও সে কোনো মাথাব্যথা বোধ করে না। সে শুধু দেখতে এসেছে।

জগমোহন সরকার বললেন, আপনি শুধোন যে, ঈশ্বর যে সর্বত্র উপস্থিত, তার কোনো প্ৰত্যক্ষ প্ৰমাণ পাওয়া সম্ভব?

নবীনকুমার লজ্জা পাচ্ছে দেখে তিনি নিজেই হেঁকে বললেন, নবীন সিংহী মশাই জানতে চাইচেন…।

চূড়ামণি ও শিষ্য মারফত এই প্রশ্ন সন্ন্যাসীর কাছে পৌঁছোবার পর তিনি মস্তক আন্দোলন করলেন না কিংবা বাতাসে অদৃশ্য লিপিও লিখলেন না। সামনের একটি ঘটের দিকে স্থির নেত্ৰে চেয়ে রইলেন।

দু-তিনজন শিষ্য তখন এক যোগে জানালো যে সকলকে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে ঐ ঘটের দিকে চেয়ে থাকতে হবে। কেউ যেন কোনো শব্দ না করে।

ঘটটি সন্ন্যাসীর থেকে দু-তিন হাত দূরে। তার ওপরে অনেকগুলি জবা ফুল। পাশে একটি পেতলের পরাতের ওপর শালগ্রাম শিলা। সন্ন্যাসী নিথর হয়ে চেয়ে আছেন ঘটটির দিকে।

হঠাৎ সেই ঘটের চুড়া থেকে একটি জবা ফুল লাফিয়ে উঠে এসে পড়লো শালগ্রাম শিলার মাথায়।

একসঙ্গে সকলের কণ্ঠ থেকে দারুণ বিস্ময়ের গুঞ্জন বেরিয়ে এলো। নবীনকুমার যেন নিজের চক্ষুকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই যেন একটি কড়কটো ব্যাঙের মতন ফুলটি জীবন্ত হয়ে লম্ফ দিয়ে উঠল। এও কি সম্ভব?

তারপরের কাণ্ডটি আরও যেন অলৌকিক। বন্ধুবিহারীবাবু এই সময় একটি মদের বোতল এনে উপস্থিত করলেন। যারা আগে দু-একদিন এসেছে, তারা জানে। এবার মদ্যকে দুগ্ধে পরিণত করবেন। সন্ন্যাসী। জিনিসটা যে সত্যিই মদ, তার মধ্যে কোনো কারচুপি নেই, সেটা প্রমাণ করবার জন্য একটি নতুন মাটির সরায় বোতলের সবটুকু মদ ঢেলে দেওয়া হলো, ঘর আমোদিত হয়ে গেল পরিচিত সুরার গন্ধে। কিছু কিছু দর্শকের মন আনচান করে উঠলো।

তারপর একজন শিষ্য জিজ্ঞেস করলো, গুরুজী, এ কটোরেমে ক্যা হ্যায়?

গুরুজী কিছু না বলে এক কুশি জল ঢেলে দিলেন সেই সরায়, অমনি সেই তরল পদার্থ দুগ্ধধবল হয়ে গেল।

আবার সকলের সেই বিস্ময়ধ্বনি। নবীনকুমার ভাবলো, এই ভেল্কির সঙ্গে ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণের কী সম্পর্ক আছে তা বোঝা গেল না বটে, কিন্তু মদ্য যে দুগ্ধে পরিণত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এই ক্রিয়াকাণ্ডটির ঠিক আগে চন্দ্রনাথ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। সেও কয়েকদিন ধরে এসে এই ব্যাপারটি দেখেছে। সকলে দুধ দুধ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই সে এবার তার সাগরেদকে ঠেলে দিয়ে বললো, যাঃ!

বাঁটকুল সাগরেদটি ছুটে গেল দুধের সরাটির দিকে। দুজন শিষ্য হা হা করে উঠে তাকে ধরে ফেলতেই সে নাকি নাকি আদুরে গলায় বললো, আঁমি দুঁধ খাঁবো, আঁমি ঐ দুঁধ খাঁবো!

বন্ধুবিহারী বললেন, আরে মোলো, এ ছোঁড়া আবার এলো কোথা থেকে! যা, যা, দূর হ আপদ!

সুলতান আবার আবদার ধরলে ঐ দুধ খাবার জন্য।

তখন জনতার মধ্য থেকে দু-একজন বললো, মোশাই, মদ যখন দুধ হয়েই গ্যাচে, তখন ও ছোঁড়াকে একটু চেখে দেকতে দিন না!

শিষ্যরা প্রবলভাবে আপত্তি জানাতে লাগলো তাতে।

চন্দ্ৰনাথ কয়েক পা এগিয়ে এসে বললো, না মশাইরা, ঐ বাচ্চা ছেলেকে ও জিনিস পান করানো ঠিক হবে না। রং বদলালেও ওটা মদই রয়েছে, যে-কেউ জিব ছুঁইয়ে দেকতে পারেন।

পেছন থেকে একজন গর্জে উঠলো, ঠিক বলেচেন মশাই! মদ কখনো দুধ হয় না। আমরা খবর নিয়ে জেনেচি, আমেরিকান রাম, মার্কিন আনীশ নামের মদে জল দেবা মাত্তর দুধের মতন সাদা হয়ে যায়। ওতে বাহাদুরি কিছু নেই।

এই বক্তা একজন মেডিক্যাল কলেজের তরুণ ছাত্র। ভিড় ঠেলে সেও এগিয়ে এলো সামনে।

চন্দ্রনাথ মদের সরাটি তুলে ধরে বললো, যে-কেউ খেয়ে দেকুন, এটা ঐ আমেরিকান মদ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি আর একটা কতা বলচি। ঐ সন্ন্যাসীর আলখাল্লার ভেতর থেকে আমি যদি একটা মরা বেড়াল বার করতে না পারি তাহলে আপনারা আমাকে পঞ্চাশ ঘা জুতো মারবেন!

গুপী স্যাকরার বাড়িতে জ্যান্ত ভূতদের যা অবস্থা হয়েছিল, এবার সন্ন্যাসী আর তার চ্যালাদেরও সেরকম হল, বহুলোক ঝাঁপিয়ে পড়ে একেবারে তছনছ করে দিল তাদের। সত্যিই সন্ন্যাসীর কম্বলের তলা থেকে বেরুলো মড়া বেড়ালটি। কী অসীম শক্তি ঐ লোকটির, বেড়ালটিকে অতি দ্রুত এমনভাবে গলা মুচড়ে মেরেছে যে সে টু শব্দটি করতে পারেনি। দুৰ্গন্ধযুক্ত একটি কাটা ছাগলও পাওয়া গেল। আর চন্দ্রনাথের বাটকুল সাগরেদটি শূন্যে ঝোলাতে ঝোলাতে নিয়ে এলো সেই লম্ফমান জবাফুলটি। সেটার বোঁটায় একটি ঘোড়ার লেজের বালামচি বাঁধা। ঐ বালামচির অন্যদিক যুক্ত ছিল সন্ন্যাসীর পায়ের অঙ্গুলিতে।

জনতার হুড়োহুড়ি এড়িয়ে নবীনকুমার দাঁড়িয়ে ছিল দ্বারের এক পাশে। সাগরেদ সমেত চন্দ্রনাথকে বেরুতে দেখে সে বললো, মশায়, একটু দাঁড়াবেন কি? মশায়ের নাম জানতে পারি?

বক্ৰ চোখে নবীনকুমারের দিকে চেয়ে চন্দ্রনাথ বললো, আমার নাম সম্পর্কে আপনার কৌতূহলের কারণ জানতে পারি কি আগে?

নবীনকুমার সহাস্যে বললো, আপনাকে আমার বেশ পচন্দ হয়েচে। আমি এই ধাতের মানুষ ভালোবাসি। আপনি আমার সঙ্গে চলুন।

নবীনকুমার তার প্রীতিপূর্ণ দক্ষিণ হস্ত বাড়িয়ে দিল চন্দ্রনাথের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *