2 of 2

৬৭. চিত্রার বিয়ে কেমন হল

চিত্রার বিয়ে কেমন হল, জামাই পছন্দ হল কি না তা তো বললে না একবারও।-এলাহাবাদ থেকে বেনারসের ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর এ কথা জিজ্ঞেস করল তৃষা।

শ্রীনাথ জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে ছিল। একটু আনমনা। জীবনে সে কলকাতা ছেড়ে এতদূর আসেনি। অথচ আসার পর নতুন রকমের কিছুও বোধ হচ্ছে না। গোটা দেশটা, গোটা পৃথিবীটাই বোধহয় মোটামুটি একঘেয়ে রকমের। তবু নতুন কিছু বোধ করার খুব চেষ্টা করছিল সে। তৃষার প্রশ্ন শুনে মুখ ঘুরিয়ে বলল, জামাইয়ের মুখে পক্সের দাগ আছে, না?

একটু আছে। খুব বেশি নয়। তেমন চোখে পড়ে না।

কিসের ব্যাবসা ওদের?

কতবার তো বললাম, আবগারি।

আবগারি মানে গাঁজা আফিং এসব নাকি?

হ্যাঁ। তবে চার পুরুষের ব্যাবসা। অনেক টাকা। কত বনেদি নিজের চোখেই তো দেখলে।

হ্যাঁ, অনেক টাকা। টাকা না হলে তোমার মন সহজে ভেজাতে পারত না।

টাকা জিনিসটা কি খুব ফ্যালনা? ছেলের বিদ্যেও তো কম নেই!

শ্রীনাথ মাথা নাড়ল, ভাল। আমাদের আন্দাজে খুবই ভাল পাত্র!

তোমার মেয়ের পছন্দ। কনভেন্টে পড়া, স্টাইলিস্ট মেয়ে যখন পছন্দ করেছে তখন বুঝতে হবে পাত্র ফ্যালনা নয়।

ফেলছে কে?

তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুশি হওনি। চিত্রা চলে যাওয়ার সময় একটু কাঁদলেও না।

কান্না না এলে কী করব?— বিরক্ত শ্রীনাথ বলে, আমার সহজে কান্না-টান্না পায় না।

চিত্রা দুঃখ পেয়েছে। ওকে তুমি ছোটবেলায় কী ভালটাই বাসতে!

শ্রীনাথ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে। তারপর বলে, দুঃখ পাওয়ার কিছু তো নেই। মাসির কাছে ছিল, শ্বশুরবাড়ি গেছে। আমার কাছে তো ছিল না, আমার কাছ থেকে চলেও যায়নি।

ওটা কোনও যুক্তি নয়। দূরে ছিল, তাতে কী? তবু তো তোমার মেয়েই ছিল। এখন গোত্র ছেড়ে অন্য বাড়ির মানুষ হয়ে গেল। মেয়েদের কাছে যে এটা কত বড় ঘটনা!

শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, কী জানি! আমি তেমন দুঃখ-টুঃখ পাচ্ছি না। তবে ওর কথা যেমন মনে হত তেমনি মনে হবে। এলাহাবাদেই ছিল, সেখানেই রইল। দুঃখের যে কী আছে!

ওর বরের সঙ্গে তুমি একটাও কথা বলেনি।

বলিনি!—শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, না, মনে হচ্ছে বলেছি।

কী বলেছ?

ঠিক মনে নেই। তবে বিয়ের পরদিন সকালে ও একটা তোয়ালে খুঁজছিল বাথরুমে যাওয়ার জন্য! আমি একটা তোয়ালে বিছানা থেকে তুলে এনে দিয়েছিলাম। আর সেই সঙ্গে নীচতলার বাথরুমটাও দেখিয়ে দিয়েছিলাম, মনে আছে।

শুধু এইটুকু?

শ্রীনাথ লজ্জিত হয়ে বলে, দরকার না হলে গায়ে পড়ে কথা বলার কী আছে?

শত হলেও সে তোমার জামাই। ছেলের মতো।

জামাই কথাটা হঠাৎ খুব অদ্ভুত লাগল শ্রীনাথের কাছে। তার জামাই, ভারী নতুন কথা। একদা নিজের বিয়ের পর সে যখন জামাই হয়েছিল তখনও তার ভারী নতুন রকমের লাগত কথাটা।

ফার্স্ট ক্লাস কামরায় এতক্ষণ কোনও ভিড় ছিল না। কিন্তু ক্রমে একটি-দুটি স্টেশনে লোক উঠতে লাগল। লোকগুলোকে দেখেই মনে হয় বিনা টিকিটের যাত্রী।

লোক ওঠায় কথাবার্তা কমে গেল। উলটোদিকের সিটে জানালার পাশে বসা নিয়ে মঞ্জু, স্বপ্না আর সজল অনেকক্ষণ মৃদু স্বরে ঝগড়া করছে। অবশ্য সজলই জানালার ধার দখল করেছে শেষ। পর্যন্ত। এপাশে জানালা ধারে শ্রীনাথ, পাশে তৃষা। সরিৎ, বৃন্দা, মংলু আর নিতাই অন্য কামরায় আছে।

শ্রীনাথ বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলল, আমার মতামত বড় কথা নয়। আমি জানি, চিত্রার ভাল বিয়েই হয়েছে। এসব ব্যাপারে তোমার সহজে ভুল হবে না।

তৃষা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ একটু জ্বালাধরা গলায় বলল, চিত্রার বিয়েতে তোমার বাড়ির কেউ এল না। অন্তত দীপু আসবে বলে আশা করেছিলাম। কত করে চিঠি দিলাম, সরিৎ গিয়ে দু’দিন মেসবাড়ি থেকে ফিরে এল দেখা না পেয়ে। সে এলে সম্প্রদানটা তাকে দিয়েই করানোর ইচ্ছে ছিল।

বিয়ে যদি কলকাতায় দিতে তবে আসত। এলাহাবাদ কি সোজা দূর? দীপু কাজের মানুষ।

এমনকী বাবা পর্যন্ত আসতে রাজি হলেন না। ছোট ছেলের কাছে গিয়ে বসে রইলেন। এসব সবাই লক্ষ করে।

বুড়ো মানুষটাকে টেনে এনে খামোখা কষ্ট দেওয়া।

তৃষা চুপ করে চেয়ে রইল সামনের দিকে।

শ্রীনাথ নরম সুরে বলল, তুমি অকারণে ভাবছ। চিত্রার বিয়ে খুব ভাল হয়েছে। আমি বহুকাল এমন ধুমধামের বিয়ে দেখিনি।

ধুমধাম তো মেজদির জন্য। কম করেও বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা ও নিজেই খরচ করেছে। আমাদের গায়ে আঁচ লাগতে দেয়নি।

শ্রীনাথ একটু অবাক হয়ে বলে, তাই নাকি? আমি ভাবলাম—

তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, চিত্রার জন্য আমাদের কোনও দায়ই পোয়াতে হল না। ও যে আমার মেয়ে তা টেরও পেলাম না।

শ্রীনাথ গম্ভীর হয়ে বলে, সে তত তোমার জন্যে। আমি ওকে এলাহাবাদে রাখা পছন্দ করিনি। তৃষা ছোট্ট একটা ধমক দেয়, এখন ওসব কথা থাক।

ফাল্গুনের মাঝামাঝি এসব জায়গায় এখনও বেশ শীত আছে। খোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া আসছে। শ্রীনাথ জানালাটা অর্ধেক নামিয়ে দিয়ে র‍্যাপারে নাক ঢেকে ঢুলতে থাকে।

 

প্রেসের বুড়ো মালিক কাশীতে বহুকাল আগে বাড়ি করে রেখে গেছেন। মালিকের ছেলের কাছে চাইতেই চাবি দিয়ে দিলেন, সঙ্গে বাড়ির দারোয়ানকে লেখা চিঠি।

কাশীতে এসে তাই কোনও অসুবিধেই হল না তাদের। দিন দুই ভারী অদ্ভুত সুন্দর কেটে গেল। বিশ্বনাথ গলিতে ঢুকে শতেক গলির ধাঁধায় ঘুরে বেড়ানো, দশাশ্বমেধ ঘাট, বাজার, রাবড়ি, বেনারসির কারখানা, জর্দা, কাশীর বিখ্যাত বেগুন সব মিলিয়ে রতনপুরের বদ্ধ জীবন থেকে বিচিত্র এক মুক্তি। এ কদিন তাদের সম্পর্কের জটিলতাগুলো বোঝা গেল না, সবাই হাসিখুশি রইল।

বেনারস থেকে রিজার্ভেশন না পেয়ে সরিৎ মোগলসরাই থেকে রিজার্ভেশন করিয়ে আনল। ফিরতেই হবে। চিত্রা আর তার বর দ্বিরাগমনে রতনপুর যাবে। তার আগেই পৌঁছনো দরকার।

যাওয়ার দিন সকালে উঠে গঙ্গাস্নান করে এসে তৃষা হঠাৎ শ্রীনাথকে বলল, কাশীতে একটা বাড়ি করবে?

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, কাশীতে?

ভারী ভাল জায়গা। বহু বাঙালির বাস।

শ্রীনাথ বলে, তা করতে পারো, যদি ইচ্ছে হয়।

আমার খুব ইচ্ছে। এর আগেরবার এসেই জায়গাটা এত পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। এখন যদি তোমার মত থাকে।

আমার মত!–শ্রীনাথ একটু বিরক্ত হয়ে বলে, সংসারে আবার আমার অনুমতির কথা উঠছে কবে থেকে?

তৃষা এই চিমটি গায়ে মাখল না। তার চোখ-মুখ অন্যরকম। একটা অদ্ভুত উদাসীন আনন্দ তাকে বাস্তবতা থেকে অনেকটা দূরে ঠেলে দিয়েছে যেন। সে শান্ত স্বরে বলল, তোমার অনুমতির কথা ওঠে, কারণ তোমাকেও এখানে এসে থাকতে হবে।

আমি থাকব? একা?

তৃষা মৃদু হেসে বলে, একা কেন? আমিও থাকব।

শ্রীনাথ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলে, কাশীবাসী হতে চাও?

হলে দোষ কী? সংসারে তো তোমার আমার মিল হল না, যদি কাশীতে থেকে হয়।

মিল নিয়ে খুব মাথা ঘামাচ্ছ নাকি আজকাল?

তৃষা এলোচুলে গামছার ঝাপটা মেরে জল ঝরিয়ে কিছুক্ষণ জবাবটা এভাল। তারপর বলল, তুমি বোধহয় মিল চাও না!

শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, আর মিল দিয়ে কী হবে? বয়স চলে গেছে, সময় চলে গেছে।

মিলের সঙ্গে বয়সের কী সম্পর্ক বললো তো! মিলটা কি কেবল কম বয়সের ব্যাপার?

তা নয়। বলছিলাম, মিল থাকলে জীবনটা এমন শয্যাকণ্টকী হয়ে উঠত না তৃষা। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আর মিল হওয়ার নয়। এখন মন পেকে গেছে, রুচি পেকে গেছে, অভ্যাস পেকে গেছে, এখন আর কেউ কারও জন্য নিজেকে বদলাতে পারব না। আর ছাড়কাট না করতে পারলে কি মি হয়?

আমার বিশ্বাস, এখানে এসে থাকলে আমরা দুজনেই বদলে যাব।

দরকার কী? রতনপুরে তোমার বিষয়-সম্পত্তি আছে, ছেলেপুলে আছে, সেসব ছেড়ে আসতেও পারবে না। খামোখা স্বপ্ন দেখা।

তোমার পিছুটান নেই?

না। আমি বহুকাল আগে থেকেই আলাদা হয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

তোমার যদি পিছুটান না থাকে তবে আমারও নেই।

নেই? হাসালে।

তৃষা শ্রীনাথের পাশে বসে ক্লান্ত স্বরে বলে, আমি সংসারে সবকিছু ঘেঁটে দেখেছি। আমি জানি ও থেকে আমার কিছু পাওয়ার নেই। একজনেরও মন পাইনি, কেউ আমার জন্য একটু দুঃখ করে না, আমাকে নিয়ে ভাবে না।

ছেলেমেয়েদের কথা বলছ?

তোমার কথাও।

শ্রীনাথ হাসিমুখে বলে, কারও ভালবাসাটাসা তো তুমি কোনওকালে চাওনি। টাকা চেয়েছ। ক্ষমতা চেয়েছ। প্রভুত্ব চেয়েছ। সব পেয়ে গেছ।

প্রভুত্ব! তাই বা পেলাম কোথায়? আমার পেটের ছেলে আমাকে মানে না, জানো?

শ্রীনাথ তৃষার দুর্দশার কথায় খুশি হচ্ছিল। হচ্ছে, হচ্ছে। কর্মের ফল ফলছে আস্তে আস্তে। সে বলল, সজল তোমাকে মানে না বুঝি? ঠিক আছে আমি শাসন করে দেব।

তৃষা করুণ করে একটু হাসে, ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার, দুনিয়ায় সজল একমাত্র তোমাকেই মানে। কিন্তু তোমার ওকে শাসন করার দরকার নেই। শাসনে ওর ভিতরটা তো বদলাবে না।

ও কি তোমাকে ভয় পায় না?

ভয় পেতে বলিও না। কিন্তু আমাকে ঘেন্না করার মতো খারাপ কি আমি? ওকে কোনওদিন জিজ্ঞেস কোরো তো, কেন ও আমাকে ঘেন্না করে!

সজল তোমাকে ঘেন্না করে না। ভয় পায়।

ভয় কবে কেটে গেছে! তুমি জানো না। শুধু আমি জানি। হয়তো তুমিই আস্তে আস্তে ওর মধ্যে এই বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছ।

বিষ! শ্রীনাথের বুকে আচমকা খামচা দিয়ে ধরল এক ভয়। তাই তো! বিষের কথা সে ভুলে গিয়েছিল। প্রতিদিন তার খাবারে, তার জলে, তার শ্বাসবায়ুতে অল্প অল্প করে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে

তৃষা। একটু একটু করে তার আয়ু কমে গেছে। বয়সের আগেই সে বুড়িয়ে গেছে কত।

গলা খাঁকারি দিয়ে শ্রীনাথ বলে, বিষের কথা মনে করিয়ে দিলে! আমার সর্বাঙ্গে বিষ। কী করে যে বেঁচে আছি!

তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, এইসব কথা বলেই না তুমি সজলকে বেয়াড়া তৈরি করেছ। ওরও সন্দেহ আমরা তোমার খাবারে বিষ দিই। বেশ কয়েকবার ও তোমার খাবার আর জলের নমুনা নিয়ে গিয়ে কেমিকেল টেস্ট করিয়েছে।

শ্রীনাথ উজ্জ্বল হয়ে বলে, কী পেয়েছে?

কী পাবে? বিষ তো তোমার মনে।

শ্রীনাথ চুপ করে থাকে।

তৃষা আস্তে করে বলে, সজলকে কেন আমার শক্ত করে তুললে বলো তো!

শ্রীনাথ করুণ হেসে বলে, আমি কাউকেই কিছু করার মধ্যে রাখি না। সজল যদি তোমার শত্রু হয়ে থাকে তবে তা হয়েছে তোমার জন্যেই!

তৃষা হঠাৎ আবার উদাস হয়ে বলল, তাই হবে। একটা দিকে বাধ দিতে গিয়ে আমার অন্যদিকটা ভেসে গেছে।

তৃষা অনেকক্ষণ এলোচুলে বসে থাকে। তারপর বলে, কাশীতে বাড়ি করার কথাটা তা হলে কোথায় দাঁড়াল?

বাড়ি করবে করো।

তুমি?

আমি কী? তোমার সঙ্গে এসে থাকব কি না?

সেই কথাই তো বারবার জিজ্ঞেস করছি।

হঠাৎ কেন যে আমাকে তোমার দরকার হচ্ছে সেইটেই বুঝতে পারছি না।

তুমি কি বিশ্বাস করো যে, আমার কোনও আশ্রয় নেই? কোনও অবলম্বন নেই?

শ্রীনাথ হেসে ফেলল, তুমি নিজেই কি বিশ্বাস করো? তুমি কত লোকের আশ্রয়দাত্রী, পালয়িত্রী। তোমার ডালে ডালে কত পাখি বাসা করে আছে, মৌমাছি চাক বেঁধেছে।

তৃষাও মৃদু হাসল। উঠে গরদের লালপেড়ে একটা শাড়ি পরতে পরতে বলল, চলো দু’জনে বিশ্বনাথের পুজো দিয়ে আসি।

পুজোয় আমার বিশ্বাস নেই। তুমি যাও।

আমারও নেই। কিন্তু কাশীতে এলে কেমন যেন ইচ্ছে হয়।

তৃষা বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্রীনাথ সামনের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপিসাড়ে দেখল, লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরা বয়স্কা সুন্দরী মহিলা রিকশায় উঠছে। একটু ঘোমটা টানল। হাতে তোয়ালে দিয়ে ঢাকা একটা পিতলের রেকাব। দৃশ্যটা খুবই অভিনব। খুবই অদ্ভুত।

ছেলেমেয়েরা সরিতের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি দেখতে গেছে। বাড়িতে থাকলে ওদের ডেকে দৃশ্যটা দেখাত শ্রীনাথ, দ্যাখ, কর্মফল মানুষকে কত নরম-সরম করে তোলে। দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ।

ফাঁকা বড় বাড়িটায় শ্রীনাথ একা একা নিঃশব্দে অনেকক্ষণ হাসল। বৃন্দা আর মংলু রান্নার কাজে ব্যস্ত। ছাদে উঠে গেল শ্রীনাথ। মস্ত কেদো এক বাঁদর ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে ছিল রেলিং-এ। একবার তাকাল শ্রীনাথের দিকে, তবে গ্রাহ্য করল না। শ্রীনাথ বাঁদরটার হাত দশেক দূরে সঁড়িয়ে নীচের দৃশ্য দেখল অনেকক্ষণ। মনটা হালকা লাগছে। ফুরফুরে লাগছে।

রাতে পাঞ্জাব মেল ধরে কলকাতা হয়ে রতনপুর পৌঁছনো পর্যন্ত এমনই ফুরফুরে রইল মনটা।

 

সারাক্ষণ আড়াল-আবডাল থেকে আজকাল সজলকে লক্ষ করে তৃষা। এই বড়সড়, শক্তসমর্থ, বুদ্ধিমান, রাগী, তেজি আর সাহসী ছেলেটিকে বুঝবার চেষ্টা করে। এই একটি মানুষের কাছে এসে হোঁচট খেয়েছে তৃষা।

কবে সেই শিশু সজলের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল এই অচেনা পুরুষ তা বুঝতে পারেনি তৃষা। বুঝতে পারলে আগে থেকে সাবধান হত, লাগাম টেনে ধরত। কিন্তু এখন আর সময় নেই, বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। বুদ্ধিমতী তৃষা জানে, এখন রাশ ধরতে গেলে যে বিস্ফোরণ ঘটবে তা সামলানোর ক্ষমতা তার নেই। এই সংসারে নিশ্চিতভাবে তার আধিপত্যের দিন শেষ হয়ে এল।

সজল তার নিজস্ব কুংফু ক্লাব তৈরি করেছে। তার দলটি বিশাল। দাপট সাংঘাতিক। একদিন সজল এসে বলে, মা, স্কুলবাড়ির জমিটা পড়ে আছে, ওটা ক্লাবকে দেবে?

তৃষা কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে বলে, ক্লাবের জন্য জমির কী দরকার?

আমরা ক্লাবের নিজস্ব বাড়ি করব।

না, ওসব হবে না। স্কুলবাড়ির একটা ঘরে এমনিতে ক্লাব খোলো, নিজস্ব জমি-টমির দরকার নেই।

সজল কাকুতি-মিনতি করল না। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সামনে। ততক্ষণ তৃষা তার মুখের দিকে চাইতে সাহস পেল না।

নিজের সঙ্গে আজকাল এরকম লড়াই করছে তৃষা। অহর্নিশ। ভয় কাকে বলে সে এতকাল জানত না। এই পরিণত বয়সে সে নতুন ভয় পাওয়া শিখছে। তার এই অসময়ে এক দুপুরে এসে হাজির হল দীনাথ। মুখে চওড়া অপরাধী হাসি, হাতে একটা শাড়ির প্যাকেট।

তোমার সঙ্গে কথা বলব না দীপু।

রাগ করেছ জানি। কিন্তু আমার অনেক কাজ ছিল।

ভাইঝির বিয়েটা কি কাজ নয়?

তোমারই তো দোষ। কেন এলাহাবাদে বিয়ে দিলে? এখানে দিলে আমরা সবাই থাকতে পারতাম।

উপায় ছিল না। চিত্রার মাসিই তো ওকে মানুষ করেছে। তার বড় ইচ্ছে, ওইখানেই বিয়ে হোক।

যাক হয়ে যে গেছে এই বেশ।

কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল, তুমি ওকে সম্প্রদান করো।

কে করল?

তোমার মেজদা। কিন্তু বাপকে নাকি সম্প্রদান করতে নেই।

ওসব কুসংস্কার ছাড়া তো। এখন দেখো এই শাড়িটা চিত্রাকে মানাবে কি না।

শাড়ি দেখে অবাক তৃষা বলে, এটার তো অনেক দাম! এ যে খাঁটি কাতান বেনারসি, পাটা জরির কাজ! এক কাড়ি দাম নিয়েছে নিশ্চয়ই।

আর এইটে।-বলে দীপনাথ তার ফোলিও ব্যাগ থেকে একটা গয়নার বাক্স বের করে। তাতে অন্তত আড়াই ভরির একটা মটরদানা হার।

কী পাকা যে হয়েছ দীপু!—তৃষা হাঁ করে চেয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ গয়নার বাক্স, শাড়ির প্যাকেট সব সরিয়ে রেখে আকুল গলায় বলে, শোনো দীপু, তোমার সঙ্গে আমার ভীষণ জরুরি দরকার।

ভাত-টাত খাওয়াবে তো! না কি আগেই প্যান্ডোরার বাক্স খুলে বসবে?

খাওয়াব গো, অত ভেবো না। কিন্তু তোমার কথাই যে আমি সারাক্ষণ ভাবি। আমার যে আর কেউ নেই!

দীপনাথ একটু ম্লান হয়ে বলে, সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি, কখন শুনি পরকালের ডাক?

ছিঃ দীপু! পরকালের ডাক আমিই শুনছি। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারবে না।

দীপনাথ একটু অবাক হয়। বউদিকে এরকম চঞ্চল, বিভ্রান্ত সে কোনওকালে দেখেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *