2 of 2

৬৭. চিঠিটা খামে ভরে ভুচুর কাছে ফিরে এল পৃথু

চিঠিটা খামে ভরে ভুচুর কাছে ফিরে এল পৃথু। ভুচু ততক্ষণে দুটো বড় খেয়ে ফেলেছে। একটু তাড়াতাড়িই খেয়েছে।

বলল, কত বড় চিঠি? এতক্ষণ লাগল পড়তে?

অনেক বড়।

বলেই পৃথু চিঠিটা এগিয়ে দিল ভুচুর দিকে।

এ কী?

পরে, পড়ে নিও।

তোমার চিঠি আমি পড়ব কেন? পার্সোনাল ব্যাপার।

আমার আর রুষার সম্পর্কতে কোনও গোপনীয়তা আর রাখার দরকার আমার কাছে অন্তত নেই।

ওখানেই বসে ভুচু চিঠিটা খুলে ফেলল খাম থেকে। পৃথু আসলামকে হ্যারিকেনটা নিয়ে আসতে বলল।

চিঠি পড়তে লাগল ভুচু। আর পৃথু অন্ধকারে মুখ ফিরিয়ে ঝোরাটার দিকে চেয়ে রইল। এদের নাম ঠিক জানে না। তবে, গরমের সময়ই এদের দেখা যায়। দিনের বেলাতেও কোনও কোনও জায়গাতে এদের ডাকে সমস্ত জঙ্গল পাহাড় একেবারে ঝমঝম করতে থাকে।

টুসু আর কুর্চি কী এত গল্প করছে রান্নাঘরে কে জানে? রান্নাঘর থেকে ওদের দুজনের গলার আওয়াজ ঝোরার এবং ঝিঝির আওয়াজকেও ছাপিয়ে আসছে।

বেচারি টুসু! যখন মায়ের সঙ্গে অন্য বাড়িতে থাকতে গেছিল তখন মাকে একা পায়নি। ভিনোদ ইদুরকার সঙ্গে ছিল। বাবাকে একা পাবে বলে এসে এখন কুর্চির সঙ্গেই বসে রয়েছে। কালকে থেকে অবশ্য একাই পাবে তাকে। কুর্চির কাছে পৃথু যাবে অথবা কুর্চি আসবে কখনও সখনও বেড়াতে। টুসুর দাবি তার উপরে কুর্চির দাবির চেয়েও অনেক বেশি।

চিঠি পড়া শেষ করে ভুচু বলল। যাঃ বাবা! এ তো চিন্তার কথা। এমন জানলে তো আমি আসতামই না এখানে। টুসুকে পাঠিয়ে দিতাম অন্য কাউকে দিয়ে।

পৃথু কিছু বলার আগেই ও বলল, কটা বাজে এখন?

আটটা।

ভুচু মনে মনে হিসাব করল কী যেন, খুব দ্রুত।

পৃথু ভাবল, সীওনী থেকে ফোন করবার কথা ভাবছে বোধ হয় কাউকে। হয়তো গিরিশদা অথবা শামীমকেই।

পরমুহূর্তেই জোরে জোরে ভাবতে লাগল ভুচু, সান্দুর থেকে সীওনী এক ঘণ্টা। এবং তারপর ঘণ্টা ছয়েক। সাত থেকে আট ঘণ্টা। ভোরের আগেই পৌঁছে যাব।

বলেই, বলল, পৃথুদা, বৌদি যেমন ভাবে লিখেছেন তাতে আমার এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। তোমাদের তো জীপ আছে। কাল তো তোমরা ফিরেই যাচ্ছ। আমি এগোচ্ছি।

আমার করণীয় নেই কিছুই। ওরা তো আমাকে জিগ্যেস করে ইদুরকারের বাড়ি থাকতে যায়নি। তোমাদের ব্যাপার।

ইদুরকারের বড্ডই বাড় বেড়েছে। একটু শিখলানো দরকার ওকে।

একটু আগেই না বলছিলে অন্য কথা, কেউই কাউকে “শিখলাতে পারে না কিছু।

বলেছিলাম। কিন্তু নিজের জন্যে তো করছি না। এতো পরেরই জন্যে। তুমি আমার কে?

পৃথু বলল, ভুচু, শামীম আমার যা, আমিও তোমার ঠিক তাইই! আসলে, জড়িয়ে যে পড়ার; সে। পড়েই। আর এড়িয়ে যাবার যারা, তারা এড়িয়েই যায়। তবে, এই রাতে এই রকম দুর্গম পথে একেবারে একা এতখানি যাবে? আমার ভাল লাগছে না ভুচু।

হাঃ। পৃথুদা! তুমিও কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ নাকি? রাতের পর রাত আমরা ডিসেম্বর জানুয়ারিতেও কি জীপ চালিয়ে যাইনি? মনে হয়েছে, নাকগুলো সব ঠাণ্ডায় খসেই যাবে আমাদের। আর এখন তো গরম! দিব্যি হাওয়া খেতে খেতে চলে যাব। রাতে এ পথে ট্রাফিকও কম।

এতই বেশি কম যে, সেটাই ভয়ের কথা।

ভুচু চৌপাই ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

কাল ভোরেই গেলে পারতে। এক রাতে কীই বা এমন হবে?

বল কী! এক রাতে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।

পৃথু ভাবছিল, তা অবশ্য ঠিক। যেমন ঘটেছিল কিবুরু বাংলোতে।

মুখে বলল, রুষা নিশ্চয়ই গিরিশদাকে জানাবে, তেমন দরকার পড়লে।

ভুচু অবাক-হওয়া গলায় বলল, তোমার কথায় মনে হচ্ছে রুষা বৌদি তোমার কেউই নয়!

নয়ই তো। একদিন ছিল। আজ আর কেউই নয় ভুচু।

আর মিলি?

হ্যাঁ। মিলি আমার মেয়ে।

ভুচুকে এ কথা বলতে গিয়েও বলল না যে, মিলি চিঠি লিখেছিল পৃথুকে : “তুমি আমাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের অশান্তি হয়।” মিলিকে অথবা রুষাকে ভাল সে কিছু কম বাসত না। কিন্তু এই মুহূর্তে রুষা বা মিলির বিপদকে ও ব্যক্তিগত বিপদ বলে মনে করতে পারছে না চেষ্টা করেও। খুবই খারাপ হয়ে গেছে হয়তো পৃথু। এত উদাসীনতা এবং কাঠিন্য যে কী করে এল ভেতরে? সে যে চিরদিনের নরম মানুষ! কী করে এল তা, ও নিজেই জানে না। জীবনই বোধহয় মানুষকে বদলে দেয়। জবলপুরের হাসপাতাল থেকে অসহায় হয়ে ফিরে দূর থেকে বাড়িতে আলো না-জ্বলতে দেখে, বাড়ির দরজা জানালা সব বন্ধ দেখে তার বুকের মধ্যে যে নীরব কিন্তু হৃদয়-ভাঙা হাহাকার উঠেছিল সেই তীব্র অপমানের বোধ এ জীবনে কখনও ভুলতে পারবে না। সেই শন্তাকে ধীরে ধীরে পূর্ণ করে নিয়েছে ও। জংলি জানোয়ারের ক্ষতেরই মতো নিজের বুকের ক্ষত আপনা আপনিই শুকিয়ে গেছে। আজকে রুষা বা মিলির প্রতি কোনও বিশেষ বোধ আর নেই পৃথুর। শক্ত হবার, নিষ্ঠুর হবার, স্বার্থপর হবার সময়, নিজের দিকে চাইবার সময় সব মানুষের জীবনেই আসে। স্বেচ্ছায় তো বদলায়নি। ওকে বদলে দেওয়া হয়েছে।

 

এই পৃথুকে, পৃথু ঘোষ নিজেও চিনত না আগে।

চলি, পৃথুদা।

ভুচু বলল, হঠাৎ।

চমক ভেঙে পৃথু বলল, সে কী? খেয়ে যাও। এখন তো পথে কোথাও খাবার পাবেও না। পেলেও সেই দেরিই তো হবে। দেরিটা, এখানেই না হয় তোক।

না। জীপকেও তো একটু রেস্ট দিতে হবে। গরমের দিন। একটানা আট-ন ঘণ্টা চালানো যাবে না। পথে ধাবা তো পাবোই দু তিন জায়গাতে। কোথাও খেয়ে নেব এখন।

বলেই ও জীপের স্টিয়ারিং-এ গিয়ে বসল।

এ কী! কুর্চিকে আর টুসুকে বলেও যাবে না?

নাঃ পৃথুদা। রুষা বৌদির চিঠিটা পড়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। আমি চললাম।

রাম-এর বোতলটা?

তুমি খাও। তোমার জন্যেই এনেছি।

আমি আজকাল খাই না বেশি। আরও একটা ঢেলে নিচ্ছি। এই বোতলটা তুমি নিয়ে যাও ভুচু।

বলেই, নিজের গ্লাসে একটা ঢেলে বোতলটা ভুচুকে দিল। বলল, ড্রাইভ করতে করতে -খাওয়াই ভাল। সাবধানে যেয়ো। একা যাচ্ছ এতটা পথ!

পৃথুর কথার উত্তর না দিয়ে পৃথুর মুখে এক ঝলক তাকিয়ে এক ঝটকায় স্টার্ট করল ও জীপটাকে। তারপর বোধহয় পৃথুকে দেখানোর জন্যেই বোতলটা ঠোঁটের সামনে ধরে ঢকঢক করে নীট রাম খেল অনেকখানি। জিনস-এর শার্টের হাতায় ঠোঁট মুছে হঠাৎ বলল; তুমি, অনেকই বদলে গেছ পৃথুদা!

উত্তরে পৃথু কিছু বলার আগেই আরও কী যেন বলল ভুচু। শুনতে পেল না পৃথু। কথাগুলো রেভড-আপ ইঞ্জিনের শব্দে ড়ুবে গেল। এক ঝাঁকুনিতে জীপটা যুদ্ধের ঘোড়ার মতোই ছুটে গেল অন্ধকার জঙ্গলের অসমান পথে। পরক্ষণেই টেইল-লাইটের লাল আলো দুটো কোনও প্রাগৈতিহাসিক প্রকাণ্ড জানোয়ারের দু চোখের মতো জ্বলতে জ্বলতে পাহাড় চড়তে লাগল। ফারস্ট গীয়ারের গোঁ গোঁ শব্দে। পেট্রোলের গন্ধে রাত ভরে গেল।

অত জোরে হঠাৎ-যাওয়া জীপের শব্দে টুসু ও কুর্চি ভেতর থেকে দৌড়ে এল। কুর্চি বলল, ও কী? কোথায় গেলেন ভুচুবাবু? না খেয়ে?

ওর তাড়া ছিল।

পৃথু বলল।

অবাক হয়ে কুর্চি বলল, তাড়া?

হ্যাঁ।

এখুনি হাটচান্দ্রাতে ফিরে যাবেন? এই রাতে? ওই সাংঘাতিক রাস্তা দিয়ে একদম একা একা? কিছুক্ষণ আগেই তো এসে পৌঁছলেন!

হ্যাঁ।

পৃথু বলল, অন্যমনস্কর মতো।

আপনি মানা করলেন না?

মানা, শুনল না। সত্যিই ওর তাড়া ছিল।

পৃথু ভাবছিল, সাংঘাতিক রাস্তা দিয়ে একদম একা একাই যেতে হয় সকলকে। কেউ ভুচুর মতো জেনেশুনে যায়; আর কেউ রুষার মতো, কুর্চির মতো, অথবা হয়তো পৃথুরই মতো, না জেনে যায়। পথ না পেরুলে তো গন্তব্যে পৌঁছনো যায় না। জীবনের কোনও গন্তব্যেই!

মুসুর ডালের খিচুড়ি বেঁধেছিল কুর্চি। মধ্যে পেঁয়াজ, আলু, কাঁচা লঙ্কা সব আস্ত ফেলে দিয়েছিল। সঙ্গে সান্দুর বস্তির খাঁটি ঘি। আলু দিয়ে, সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ ও লঙ্কা কুচিয়ে ভাত্তাও বানিয়ে ছিল। গরম গরম খেলো ওরা তিন জনে একসঙ্গে বসে। উপাদেয় লাগল পৃথুর। সাহেবি খাওয়া খেয়ে অভ্যস্ত টুসু দু বার চেয়ে নিয়ে চেটেপুটে খেল।

পৃথু মনে মনে বলল, খা। খা। বাঙালির ছেলে, বাঙালির মতো হাপুস হুপুস করে বাঙালি খাওয়া খারে বেটা!

ভাল খেলে টুসু? বাড়িতে তোমরা কত ভাল ভাল জিনিস খাও। তুমি যে এই খিচুড়ি খেতে পারবে তা ভাবিনি। ঝাল লাগেনি তো? রুষা বৌদিও কি এমন করেই রাঁধেন?

মা?

অবাক চোখে ও একবার ওর বাবার দিকে আর একবার অ্যালুমিনিয়মের থালার খিচুড়ির দিকে তাকাল।

তারপর বলল, মা কখনও রান্না করেন না। রান্না তো লছমার সিং…। বলেই, থেমে গেল।

ওর গলায় কোনও অভিযোগ ছিল না। মা নিজে হাতে রান্না করবে এ কথা কেউ ভাবতে পারে যে, এটা ওর কাছে অসীম বিস্ময়ের ব্যাপার!

পৃথু মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল।

রুষার নিন্দা মনে মনে নিশ্চয়ই করা যায়। হয়তো ছেলেমেয়ের সঙ্গেও করা যায় তাদের মায়ের সম্বন্ধে আলোচনা। কিন্তু কুর্চিকে বলতে বাধল যে, দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে রুষা কোনও দিনও একটি পদও রান্না করে খাওয়ায়নি পৃথুকে বা ছেলেমেয়েদেরও। আদৌ করলে, কী করতে পারে বা কেমন করতে পারে সেই প্রসঙ্গ উঠতে পারত। সংসার ও চালিয়েছে উঁচুদরের ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্ট-এর মতো, কিন্তু মজদুর হতে আপত্তি ছিল গোড়া থেকেই।

খাওয়া দাওয়ার পর বহেড়া গাছের নীচের চৌপাইতে বসে ওরা একটু গল্পসল্প করল। কুর্চির সঙ্গে টুসুর বেশ ভাব হয়ে গেছে। কুর্চির অনুরোধে টুসু বয়স্কাউটের একটি গানও গেয়ে শোনাল কুর্চিকে। বেশ সুরে বলে গলা। টুসু যে গান গাইতে পারে তা জানতই না পৃথু।

কুর্চি বলল, মিলি গায়? গান?

টুসু বলল, চোখ বড় বড় করে, গায় না? বনি এম, রোলিং স্টোস, দ্যা পোলিস, অ্যাব্বা! আব্বা এখন ব্যাক ডেটেড হয়ে গেছে। এই সবই গায়। দারুণ গলা দিদির।

এসব কী গান?

কুর্চি বোকার মতো শুধোল। পৃথু কৌতুকের চোখে চেয়ে রইল ছেলের মুখের দিকে।

ও গড! এগুলো ডিফারেন্ট গ্রুপস-এর নাম। শোনোনি তোমরা কখনও! আমি ক্যাসেট নিয়ে এসেছি। শোনাব তোমাদের কাল।

মিলি রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় না? অতুলপ্রসাদ?

ওগুলো কী গান? শুনিনি তো কখনও? ফানি!

কুর্চি আর টুসু দুজনে এক ঘরে শুয়েছিল। পৃথু, পাশের ঘরে। দু ঘরের মধ্যে অবশ্য দরজা ছিল কোনও।

বেচারি কুর্চি। এই গভীর জঙ্গলের মধ্যের পর্ণকুটিরের এই শেষ রাত। বেচারি টুসু! একা বাবার সঙ্গে প্রথম রাত। এই ক’রাত কুর্চিকে দেখে মনে হয়েছিল যে, ওর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। অফ ওল পার্সনস কুর্চির মতো মেয়ের মধ্যে যে এমন একজন শরীরবিলাসী ছিল এত বছর ওকে জেনেও একটুও বুঝতে পারেনি।

বাইরে একটা হ্যারিকেন ঝোলানো থাকে রাতে। এই ডেরাতে অন্য কোনও লোক শোয়না যদিও, কাছাকাছিই আরও ডেরা আছে। পিস্তলটা খুলে মাথার বালিশের নীচে রেখে শুয়েছে এ কদিন রোজই শোওয়ার সময়। সারা রাত যত জানোয়ার আর পাখি ডেকেছে সবই চিনিয়ে দিতে হয়েছে কুর্চিকে। কৌতুহলের সীমা নেই ওর। একদিন ওরা দুজনেই হয়তো অ্যাডামসদের মতো বা ডগলাস-হ্যামিলনদের মতো বনের মধ্যেই বাস করে বনের পশুদের সম্বন্ধে জানবে শুনবে। লাইফ ইজ ভেরী ইয়াং। এখনও অনেক কিছু করা যেতে পারে এই ক্ষত বিক্ষত অঙ্গহৃত জীবনখানি নিয়েও।

মাঝরাতে একবার বাইরে গেছিল পৃথু। টর্চ নিয়ে। পত্রহীন জঙ্গলে মোড়া পাহাড়ের মাথার উপর কালপুরুষ তরোয়াল কাঁধে নিশি জাগছেন। ঝোরার আওয়াজটা রাত যত গভীর হয় ততই জোর হয়। সান্দুর বস্তিতে কোনও সাড়া শব্দ ছিল না তখন। একটি ডেরা থেকে একজন বুড়ো কুলি খকখক করে কেশে উঠল দু বার। হায়না ডাকল পাহাড়ের উপর থেকে হাঃ হাঃ হাঃ করে। কে জানে ওই বুক কাঁপানো ডাকে টুসু ভয় পেয়ে জেগে গেল কি না!

তারাদের অবস্থান দেখে অনুমান করল রাত তখন দুটো হবে। ভুচু নিশ্চয়ই এখন টিকিয়া উড়ান। জীপ চালিয়ে যাচ্ছে গভীর রাতে গা-ছমছম পাহাড় বনের মধ্যে নির্জন পথকে হেডলাইটের আলোর বন্যায় ভাসিয়ে আর টায়ারে হুস হুস শব্দ তুলে। ওর ক্যাসেট প্লেয়ারে কি এখন ওর প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে? “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি।” এখনও কি স্টীয়ারিং-এ বসে রাম এর বোতল থেকে রাম খাচ্ছে ও? সঙ্গে আরও কি ছিল বোতল? কাজটা ভাল করছে না। যখন তখন অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে।

ভুচু বলছিল যে, পৃথু অনেক বদলে গেছে। কে জানে, হয়তো গেছে। বদলানোই তো স্বাভাবিক। না বদলানো মানেই থেমে-থাকা। ভুচু জানে না এখনও যে ভুচু নিজেও বদলাবে।

অথবা, বদলে কি গেছেই?

বড় তাড়া করল ভুচু যাবার সময়। অত তাড়ার কিছু কি ছিল? মনে হচ্ছিল, ভুচু ভিনোদ ইদুরকারের সঙ্গে মোকাবিলা করার ওই তাড়াকে অন্য কোনও গভীর তাড়াতেই তাড়া করে নিয়ে গেল। কোন তাড়া সে? তারাভরা বোবা রাত চুপ করে চেয়ে রইল পৃথুর মুখে।

ঝোরার জলের শব্দের সঙ্গে বহুদূরের রাতের পথ দিয়ে উড়ে-যাওয়া ভুচুর জীপের শব্দ মিলে গেল।

ছেলেটা বড় ভাল!

পৃথু বলল, ক্রাচ দুটো পাশে নামিয়ে রেখে শুতে শুতে। ভাল হোক। ওর ভাল হোক।

ভোরবেলা ঘুম ভাঙল কুর্চি আর টুসুর গলার স্বরে। কুর্চি বলছে, ওমাঃ ওটা কী পাখি জানো টুসু? কী সুন্দর লাল টুকটুকে, না?

কোথায় দেখছ তুমি পাখি? কুর্চি মাসি? টুসুর মেয়েলি গলা শোনা গেল। বয়স, এখনও ওর গলার স্বরে পুরুষালিভাব আনেনি।

ওই যে! ঝোরাটার পাশের বুনো আমগাছটার মগডালে। দেখতে পাচ্ছ না?

কই?

ওই তো!

হ্যাঁ। হ্যাঁ। এবারে দেখেছি। ওমা! ওটা তো স্কার্লেট-মিনিভেট। তাও জানো না?

আমি কিছু জানি না রে টুসু। আমাকে তুমি সব পাখি চেনাবে তো?

সব তো চিনি না আমি। সব চিনতে হলে বাবাকে বলতে হবে! আমি অল্প অল্প চিনি। তোমার কাছে সালিম আলির বই নেই?

সালিম আলি কে?

ওঃ গশ্‌! হতাশ গলায় বলল টুসু। সালিম আলি যে কে, তাও তুমি জানো না? তোমাকে নিয়ে আমার ট্রেমেনডাস ডিফিকাল্টী হবে। হাওয়েভার, চেষ্টা থাকলে আস্তে আস্তে শিখে যাবে। ভয় পেও না।

ওদের ম্যাথস-এর আন্টি টুসুকে ঠিক যে ভাবে বলেন, সেই ডায়ালগ, সেই ইনটোনেশানেই টুসু তার এক এবং একমাত্র ছাত্রীর উপর ঝেড়ে দিল।

মজা লাগছিল পৃথুর। প্রত্যেক শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে এমন ভেবে খুশি হয়। আর বয়সের একঘেয়ে ভারে ন্যুজ হলে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই শিশু হতে চায় মাঝে মাঝে।

ওটা কী পাখি…টুসু? ওই যে। ঝোপের ধারে নড়ছে চড়ছে? হলুদ হলুদ চোখ। অনেকগুলো একসঙ্গে। কী রকম থপথপিয়ে চলছে দ্যাখো।

ওগুলো? আগে দেখোনি?

তা দেখেছি। জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে। পথের উপরেও দেখেছি কখনও কখনও।

ওগুলো তো ব্যাবলার। ওই হলুদ চোখের জন্যেই ওদের নাম ইয়ালো-আইড ব্যালার। দল বেঁধে থাকে। সব সময় কথা বলে। ভীষণ টিকেটিভ ওরা।

ওই দ্যাখো। ওই লম্বা ল্যাজ ঝোলা রূপোলি গায়ের কালো মাথা একটা পাখি। বাঁশের বনে বসে আছে। মাথাটা ঠিক কালোও নয়, কেমন বন্দুকের নলের মতো কালো রঙ। ওটার নাম কী জানো টুসু?

দেখি, দেখি। বলে, টুসু একটু এগিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখে বলল, ওঃ। ওটা বিখ্যাত পাখি। ওদের বলে প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার। পোকা খায় কপাৎ কপাৎ করে উড়ে উড়ে। ফড়িং-উড়িং যা পায় তাইই খায়।

প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচারের নাম শুনে তাড়াতাড়ি বাইরে এল পৃথুও। বলল, কোথায় রে টুসু? কোথায় দেখলি?

ওই তো! দেখেছ বাবা?

হ্যাঁ। হ্যাঁ। আশ্চর্য তো! আগে তুই কোথায় দেখেছিস এ পাখি? হাটচান্দ্রাতে? না রাত মোহানার কাছে?

না বাবা। আগে দেখিনি। তবে বইয়ে ছবি দেখেছি।

এই পাখি এদিকে আমিও দেখিনি। অথচ দেখা উচিত ছিল। কানহার জঙ্গলে অবশ্য দেখেছি।

টুসু ঝোরার দিকে এগিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার ভাল করে দেখবে বলে।

কুর্চি বলল, টুসু তো দেখছি রীতিমতো পাখি-বিশারদ।

হ্যাঁ। ওদের জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা আমাদের মতো ভাসাভাসা জ্ঞানে বিশ্বাস করে না। টুসু একাই নয়। ওরা সকলেই অন্যরকম। আমরা পাখিকে পাখি বলেই খুশি ছিলাম। ওরা সব জিনিসেরই গভীরে গিয়ে সবকিছু জানতে চায়। ওদের আই-কিউও আমাদের চেয়ে অনেকই বেশি। আমার খুব ভাল লাগে ওদের এই জন্যে। ওরা অনেক কিছুই জানে তা নয়। তবে, যেটুকু জানে, সেটুকু ভাল করে জানতে চায়। ফাঁকি ব্যাপারটা কম ওদের মধ্যেও। ওদের মনও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বিজ্ঞান ও তথ্য-বিশ্বাসী।

টুসু ফিরে এলেই কুর্চি বলল, আমি তাহলে নাস্তার বন্দোবস্ত করি গিয়ে।

তুমি নিজেই রান্না করো? কুর্চি মাসি? রোজ রোজ?

হ্যাঁ। আমি গরীব লোক। বেয়ারা বাবুর্চি কোথায় পাব বলো?

ডিম কিন্তু আমি স্ক্র্যাম্বলড খাব। বেকন থাকলে বেকন, নইলে হ্যাম।

ডিম তো নেই বাবা এখানে।

তবে? কী হবে ব্রেকফাস্টে? ডিম ছাড়া, পরিজ বা কর্নফ্লেকস ছাড়া কি ব্রেকফার্স্ট হয়?

দ্যাখোই না আমি তোমার জন্যে কেমন মুচমুচে পরোটা আর ঝালঝাল আলুর তরকারি বানিয়ে দিচ্ছি। দ্যাখো খেয়ে। সান্দুর বস্তির আহির এখুনি আসবে দুধ নিয়ে। দুধ জ্বাল দিয়ে দেব তোমাকে। আমি আর তোমার বাবা চা খাব।

বেশি ঝাল দিও না কুর্চি মাসি। ঝাল খেলে লিভার খারাপ হয়। পেটে আলসার হয়।

সে শুকনো লংকা খেলে হয়। কাঁচা লংকা কালো জিরে দিয়ে রাঁধব আমি। ইচ্ছে না করলে লংকা খেয়ো না। লঙ্কার গন্ধ দিয়ে খেও। তোমার বাবা ঝাল খেতে ভালবাসেন। কাঁচা লঙ্কায় ভিটামিন আছে।

আমরা সকালে কডলিভার অয়েলের ক্যাপসুলস আর গার্লিক পার্ল খাই একটা করে। মা রোজ মালটিভিটামিন ট্যাবলেটস খায়।

ওষুধ, অসুখ-বিসুখ না হলে খাওয়া বোধহয় ঠিক নয়। খাবে, এক্সারসাইজ করে হজম করবে আর বেশি করে জল খাবে। দেখবে, গায়ে কত জোর হবে।

বাঁচা গেছে! ওষুধ-ফষুধ আমার একদমই ভাল লাগে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *