কাটিহারে গিয়ে দীপ্তিদির বাড়ি খুঁজে বার করতে সূর্যর বিশেষ অসুবিধে হল না। দীপ্তিদির বাবা ওখানকার স্টেশন মাস্টার, সূর্য জানত।
কিন্তু সেখানে গিয়েও দীপ্তিদির দেখা পাওয়া গেল না। মাত্র ছ’দিন আগে দীপ্তিদি কাটিহার ছেড়ে চলে এসেছেন।
ছোট মফস্সল শহরে কোনও বাড়িতে একটি অনাত্মীয় যুবক কোনও মহিলার খোঁজ করে না এ ভাবে। কিন্তু সূর্যর ব্যবহারে কোনও জড়তা নেই। সূর্য সরাসরি এসে বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়েছে, যিনি বেরিয়ে এসেছেন, তাঁকে প্রথমেই বলেছে, দীপ্তিদিকে একটু ডেকে দিন।
বেরিয়ে এসেছিলেন দীপ্তিদির বাবা। তিনি সূর্যর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার নাম?
সূর্যকুমার ভাদুড়ী।
ভেতরে আসুন।
দীপ্তিদির বাবা খুব বেশি চমকিত হলেন না। মনে হয়, এনাম তাঁর চেনা। তার মেয়ে গোপনে রাজনীতিতে ঢোকার পর মাঝে মাঝেই অচেনা লোকজন এসে তার খোঁজ। করেছে। তারা কেউ দীপ্তির নিজের দলের লোক, কেউ বা পুলিশের। কিন্তু দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এখন তো ওসব চুকেবুকে গেছে। এখন আবার সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যাবার কথা।
তিনি সূর্যকে বললেন, তুমি চা খাবে? আমি তোমার কথা অনেকের মুখেই শুনেছি।
দীপ্তিদি কোথায়?
সে তো এখানে নেই।
সূর্য সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কোথায় গেছেন?
দীপ্তিদির বাবা চোখের ইঙ্গিত করে বললেন, বোসো। এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? এখানে এসে তুমি কোথায় উঠেছ?
সূর্য বলল, কোথাও না। আমি আজই ফিরে যাব।
আজ সারা দিনে আর কোনও ট্রেন নেই। ফিরবে কী করে?
সেটা বড় সমস্যা নয়। দীপ্তিদির সঙ্গে আমার একবার দেখা করা দরকার।
আমার বাড়িতে জায়গা আছে। তুমি আজ রাত্তিরটা এখানে থেকে যেতে পারো।
দীপ্তিদি কোথায় গেছেন, আমি শুধু সেই কথাটা জানতে চাইছি।
শোনো, তোমাকে আগে একটা কথা বলি। আমার ছেলেমেয়েদের ওপর আমি কখনও জোর করি না। তারা বড় হয়েছে, ইচ্ছে মতন চলবে। বিশেষত আমার ওই মেয়ে বরাবরই স্বাধীন। সে যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুক, আমি কখনও আপত্তি করব না। কিন্তু সে বিয়ে করতে চায় না। আমার বড়শ্যালক সত্যেনের প্রভাবে পড়েই সে স্বদেশি দলে যোগ দিয়েছিল। সত্যেনও চিরকুমার থেকে দেশের সেবা করতে চায়।
সূর্য ধীরস্থির ভাবে সব কথা শুনল। তারপর বলল, দীপ্তিদি কোথায় গেছেন, সেটা আমাকে বলতে কি কোনও বাধা আছে?
ঠিক ধরেছ। সে জানত তুমি এখানে আসবে। তোমাকে কোনও কথা বলতে সে বারণ করে গেছে?
আমি কয়েক দিন আগে এলে দেখা হত?
সে দেখা করতে চাইত কিনা তা অবশ্য বলতে পারি না।
আচ্ছা, আমি তা হলে যাই।
শোনো, শোনো, বোসো। আর একটু কথা আছে। তোমার জন্য দুটি চাল নিতে বলি? বাইরে থেকে এসেছ, অতিথি মানুষ, কিছু না খেয়ে চলে যাবে, তা কি হয়?
আমি খেয়েই এসেছি।
স্টেশনের ধারে ওই দোকানটা থেকে অখাদ্য খাবারগুলো গিলেছ তো? বড় ভুল কাজ করেছ। এখান থেকে দুটি ভাতেভাত খেয়ে যাও।
আমার এখানে আর দেরি করার কোনও মানে হয় না। দীপ্তিদি কি স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছেন?
সেই রকমই তো শুনছি। তোমাকে সে ভয় পায় কেন? দেখে তো বেশ ভালো ছেলেই মনে হয়।
দীপ্তিদির সঙ্গে একবার অন্তত দেখা করার খুবই দরকার ছিল আমার।
দীপ্তিদির বাবা হঠাৎ মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন, সত্যেন থাকে। জলপাইগুড়িতে। তার সঙ্গে একবার দেখা করে পরামর্শ নিতে পারো।
.
সূর্য কলকাতায় ফিরে স্টেশন থেকেই সোজা চলে গেল দীপ্তিদির বাড়িতে। সেখানে গিয়ে শুনল দীপ্তিদি কলকাতায় ফেরেননি। স্কুলে খোঁজ নিতে গেল। সেখানে দীপ্তিদি চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর পড়াবেন না।
বাড়িতে এসে সূর্য নিজেও একটা চিঠি পেল দীপ্তিদির। চিঠিখানা তার অপেক্ষায় ডাক বাক্সে পড়ে ছিল। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি।
সূর্য,
তোমার বাবার মৃত্যুর সময়েও তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি, কারণ, শোকে সান্ত্বনা জানাবার ভাষা আমি জানি না। আমি জানি, তুমি নিজেই সবকিছু সামলে উঠতে পারবে। তোমার ওপর যে আমার অনেক ভরসা।
কলকাতা আমার আর ভালো লাগছে না। তাই অনেক দূরে চলে গেলাম। আমি যত দূরেই থাকি, আমি সব সময় তোমার সঙ্গে আছি। তুমি ভালো থেকো।
দীপ্তিদি
এ রকম নিরলংকার সাদাসিধে চিঠি, তবু সূর্যর মনে হতে লাগল, এটা যেন হেঁয়ালির ভাষায় লেখা। প্রতিটি অক্ষর সে থেমে থেমে পড়তে লাগল বার বার, যেন ওদের কোনও আলাদা মানে আছে। এবং সে কল্পনা করার চেষ্টা করল, কোন অবস্থায় দীপ্তিদি চিঠিখানা। লিখেছেন। চেয়ার-টেবিলে বসে, না বিছানায় শুয়ে শুয়ে? মাথার চুল খোলা ছিল, না খোঁপাবাঁধা? একবারেই চিঠিটা শেষ করেছেন, না আগে আরও কয়েকটা লিখে ছিঁড়ে ফেলেছেন? এসব কথা জানা যেন সূর্যর বিশেষ দরকার।
সূর্য বাড়ির প্রধান দরজার কাছে চিঠিখানা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, এই সময় বাদল ফিরল। সে জিজ্ঞেস করল, সূর্যদা, কখন ফিরলে?
সূর্যর সুটকেসটা তার পায়ের কাছে রাখা। সে বলল, এখনও ফিরিনি তো?
ওটা কার চিঠি?
দীপ্তিদির।
তুমি তো দীপ্তিদির সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলে? দেখা হল না?
না রে।
সূর্যর মুখখানা খুব শান্ত। তার ব্যবহারেও কোনও চাঞ্চল্য নেই। চিঠিখানা ভজ করে পকেটে রাখল। তারপর সুটকেসটা তুলে নিয়ে বলল, যাই, একটু ঘুরে আসি।
আবার কোথায় যাচ্ছ?
জলপাইগুড়ির দিকে যাব।
এক্ষুনি? বাড়িতে ঢুকবে না? কিছু খেয়েটেয়ে যাবে না?
নাঃ।
কখন ট্রেন?
সেইটাই তো জানি না। সেই জন্য দেরি করতে পারছি না।
বাদল সূর্যর সঙ্গে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত এল। সেখান থেকে ট্যাক্সিতে তুলে দিল।
বাদল ফিরে আসার পর চিররঞ্জন বললেন, সূর্য কোথায় গেল? তোর সঙ্গেই কথা বলছিল না?
আবার তো চলে গেল!
আবার চলে গেল? কোথায়?
জলপাইগুড়ি।
চিররঞ্জন একেবারে আঁতকে উঠলেন। বললেন, একবার বাড়ির ভেতরে পা-ও দিল? অনেকগুলো দরকারি কাগজপত্রে সই করাতে হবে। এখন এসব সামলাবে কে? সব উড়েপুড়ে গোল্লায় যাবে! যাক, আমার কী!
জলপাইগুড়ি শহর থেকে ছমাইল দূরে একটা গ্রামের মধ্যে সত্যেন গুহর বাড়ি। বাড়িটাকে তিনি এখন আশ্রম বানিয়ে ফেলেছেন।
সত্যেন গুহ বরাবরই গান্ধীবাদী। ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় তিনি গান্ধীজির সঙ্গে নোয়াখালি সফরে গিয়েছিলেন। গান্ধীজি নিহত হবার পর তিনি রাজনীতির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ঘুচিয়ে সর্বোদয়ের আদর্শ গ্রহণ করেছেন।
তার ভাগনি দীপ্তিকে তিনি একসময়ে অহিংস সত্যাগ্রহে যোগ দেবার জন্যই টেনে এনেছিলেন। আস্তে আস্তে সে অবশ্য গুপ্ত বিপ্লবীদের দলে চলে যায়। সেকথাও অনেক দিন টের পাওয়া যায়নি। টের পেয়ে তিনি খুব দুঃখিত হয়েছিলেন। এখন দীপ্তি আবার তাঁর আদর্শ গ্রহণ করার জন্য ফিরে এসেছে বলে তিনি খুব প্রসন্ন।
নিজের বাড়িতেই তিনি একটি আবাসিক প্রাথমিক স্কুল খুলেছেন। ছাত্ররা অধিকাংশই নিম্নবর্ণের বা অন্ত্যজ শ্রেণি থেকে এসেছে। কারওর কোনও মাইনে লাগে না।
কিন্তু কাজ করতে হয়। সংলগ্ন খেতে শাকসবজি চাষ, হাঁস, মুরগি, গোরু পালন এবং তাঁতের কাজ–এর থেকেই সবকিছুর খরচ তুলতে হয়। সরকার থেকে কিছু সাহায্যের প্রস্তাব এসেছিল, সত্যেন গুহ তা নিতে চাননি। দেশের মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলাই তাঁর ব্রত।
সারা দিন ধরে মিহিন বাতাসের সঙ্গে উড়ছে বৃষ্টির গুঁড়ো। দূরের পাহাড়গুলোর চূড়া থেকে নেমে আসছে হালকা হালকা মেঘ। রাস্তার দু’পাশের গাছগুলি স্নানসিক্ত রূপসি। ঝরে-পড়া ফুল থেঁতলে থেঁতলে চলে যাচ্ছে গোরুরগাড়ি।
একটা গোরুরগাড়ি থেকে সূর্য নামল। গাড়োয়ানকে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে তার নির্দেশিত সরু পথটা ধরে হাঁটতে লাগল দ্রুত পায়ে। হাতের সুটকেসটা খেলাচ্ছলে দোলাচ্ছে।
টিনের বড় ঘরটার সামনের দরজা বন্ধ। সূর্য ডাকাডাকি করল না। ঘুরে এল অন্য দিকে। উঠোনের চার পাশে কঞ্চির বেড়ার ওপর লকলক করছে মালতীলতা। সূর্য সুটকেসটা বেড়ার ওপর রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
দুটি ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দীপ্তিদি উঠোনে বসে কাপড় কাঁচছিলেন। একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আছেন, সাদা ব্লাউজ, অযত্নে রাখা চুল এসে পড়েছে কপালের ওপরে। এমন সামান্য সাধারণ পোশাক হলেও দীপ্তিদিকে এখানে মনে হয় বিদেশিনী। এই অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী রমণী অন্য কোনও দেশ থেকে যেন এখানে বেড়াতে এসেছেন। গোড়ালিতে ভর দিয়ে বসে এত উৎসাহে কাপড় কাঁচলেও এখনও এই পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে যাননি।
সঙ্গের একটি ছেলের চোখ অনুসরণ করে দীপ্তিদি পেছন ফিরে তাকালেন। সূর্যকে দেখে একটুও চমকে উঠলেন না। ঠান্ডা ভাবে বললেন, এসো, ওই দিক দিয়ে ঘুরে এসো, ভেতরে ঢোকার জায়গা আছে।
সূর্য ভেতরে এসে দীপ্তিদির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। দীপ্তিদি একটি ছেলেকে বললেন, এই, ভেতর থেকে একটা মোড়া নিয়ে আয় তো!
ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে একটা মোড়া নিয়ে এসে পেতে দিল। দীপ্তিদি সেটা দেখিয়ে সূর্যকে বললেন, এখানে বৃষ্টির মধ্যে বসবে, না ভেতরে গিয়ে বসবে?
সূর্য বলল, এখানেই বসি।
দীপ্তিদি কাপড় কাঁচা বন্ধ না করে বললেন, খেয়ে এসেছ?
সূর্য হাসিমুখে বলল, না।
এখন এই ভর দুপুরে তোমাকে কী খেতে দেব? এখানে একটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত উনুন জ্বলে না।
তা বলে কি মুড়ি-চিড়েও কিছু থাকতে নেই?
দীপ্তিদিও এবার হাসিমুখ তুলে ওর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, খুব খিদে পেয়েছে? একটু বোসো তা হলে। হাতের কাজটা সেরে নিই।
এই বৃষ্টির মধ্যে কাপড় কেচে কী লাভ?
এইটাই নিয়ম। রোজ এখানে এ রকম হয়।
তার মানে, কাজ হোক বা না হোক, নিয়মটা মানতে হবেই।
নিয়ম মানাটাই তো একটা কাজ।
একটা কাজ না একমাত্র কাজ?
কোনও কোনও সময় এইটাই একমাত্র কাজ হওয়া ভালো। নইলে জীবনটা বড় ছন্নছাড়া হয়ে যায়।
বাচ্চাদুটোকেও বৃষ্টিতে ভেজাচ্ছ কেন? ওদের যদি অসুখ করে?
ওরা এত বেশি বৃষ্টিতে ভিজেছে যে, এ জন্য ওদের আর অসুখ হয় না।
এটাও প্রকৃতির নিয়ম? যারা জীবনে খুব বেশি দুঃখ পায়, তাদের কি দুঃখের অনুভূতি থাকে না?
দুঃখ তো প্রকৃতি দেয় না। মানুষ নিজে তৈরি করে বেশির ভাগ সময়।
বালতির জল ফুরিয়ে গিয়েছিল, বাচ্চা ছেলেদুটি অদূরের পাতকুয়ো থেকে জল আনতে গেল। মস্ত বড় বালতি, জল ভরার পর দুটি ছেলে দু’দিক ধরে আনছে। সূর্য উঠে গিয়ে নিজেই বালতি নিয়ে এল। তারপর বলল, ছেলেদুটিকে এখন ছুটি দিই? আরও জল আনার দরকার হলে আমিই এনে দিতে পারব।
দীপ্তিদি ছেলেদুটিকে বললেন, আচ্ছা, তোমরা এখন যাও।
কাপড়গুলো নিংড়ে তারে মেলে দিতে দিতে দীপ্তিদি বললেন, মাথা ন্যাড়া করে তোমাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে।
বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মতন? একটি মেয়ে আমাকে বলেছিল কয়েক দিন আগে।
প্যান্ট-শার্ট পরা সন্ন্যাসী? তোমাকে কক্ষনও সন্ন্যাসী মনে হয় না।
তা ঠিক।
তুমি এখানে কেন এসেছ?
দীপ্তিদি, তুমি জানতে না আমি আসবই?
জানতাম। তবু জিজ্ঞেস করছি, কেন এসেছ?
তোমাকে নিয়ে যেতে।
তুমি কি জানেন যে আমাকে আর নিয়ে যেতে পারবে না?
না।
যদি চলেই যাব, তা হলে কলকাতা ছেড়ে চলে এলাম কেন?
কেন চলে এলে, সে কথা তো বলোনি এখনও?
আমি তোমার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাই।
অথচ তুমি বলেছিলে, চিঠিতেও লিখেছ, তুমি সব সময় আমার সঙ্গে থাকবে।
তা তো আছিই। কিন্তু তার জন্য কাছাকাছি থাকা দরকার নেই।
আছে।
না।
তুমি বুঝতে পারো না, তোমাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়? আমি এক মুহূর্তের জন্য অন্য কোনও কিছু চিন্তা করতে পারি না।
আস্তে আস্তে অভ্যাস করতে হবে।
আমি পারব না।
তোমাকে পারতেই হবে, সূর্য। কারণ সেইটাই স্বাভাবিক। তুমি এখন যা চাইছ, সেটা স্বাভাবিক নয়।
মোটেই না!
সূর্য, এখানে কেউ চেঁচিয়ে কথা বলে না। তুমি যদি বাড়াবাড়ি করো, তা হলে আমাকে এ জায়গা ছেড়ে আরও অনেক দূরে চলে যেতে হবে।
দীপ্তিদি, তুমি কত দূরে যাবে? তুমি জানো না, তুমি হিমালয়ের শেষে কিংবা কন্যাকুমারিকায় চলে গেলেও আমি তোমাকে সেখানে তাড়া করে যাব?
দীপ্তিদি হঠাৎ মুখটা ফিরিয়ে নিলেন। মনে হল, তার চোখে জল এসে গেছে। ধরা। গলায় বললেন, তুমি কেন আমাকে এ রকম উতলা করে দিচ্ছ? আমি এখানে খুব শান্তিতে আছি।
সূর্য বলল, আমিও এখানে থাকব। তারপর সে নিচু হয়ে জুতোর ফিতে খুলতে লাগল।
.
সত্যেন গুহ শহরে গিয়েছিলেন, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সূর্য ততক্ষণে গেঞ্জি ও ফুলপ্যান্ট পরে মাঠে ছেলেদের সঙ্গে খেলতে নেমে গেছে। অনেক দিন পর তাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। কাদা-ছড়ানো মাঠে সে দারুণ উৎসাহে দৌড়োদৌড়ি করছে। ছেলেদের সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনার সময় হয়ে গেছে, আশ্রমের বড়মা, অর্থাৎ সত্যেন গুহর দিদি নিরুপমা ডেকে ডেকেও ছেলেদের ফেরাতে পারেননি মাঠ থেকে।
সত্যেন গুহ গোরুরগাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে আসছিলেন। মাঠের মধ্যে একটি অপরিচিত যুবককে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন খেলা, তারপর নিজেই মাঠের মধ্যে ঢুকে বললেন, কই, দাও দেখি, আমার দিকে বলটা দাও একবার।
প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়স হলেও সত্যেন গুহর স্বাস্থ্যটি এখনও মজবুত আছে। রোগা পাতলা বেঁটেখাটো মানুষ, মাথার চুলগুলো পেকে গেলেও হাঁটাচলা খুব সাবলীল। বলে জোরে এক কিক কষিয়ে তিনি বললেন, হেড করো।
সূর্য ছুটে এসেও বলটা মাথায় লাগাতে পারল না। স্কুলে পড়ার সময় সে ভালোই খেলত, তারপর অনেক দিন অভ্যাস নেই।
সত্যেন গুহ তাকে বললেন, একটা হাই কিক করো তো, দেখি কত জোরে মারতে পারো!
সূর্য বলটা হাতে ধরে কিক করল, বেশ উঁচুতেই উঠল, কাছাকাছি গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে। সত্যেন গুহ বললেন, বাঃ!
দু’জনে কেউ কারওর পরিচয় জিজ্ঞেস করেনি এখনও। খেলার মাঠে তার দরকার হয় না বলেই। ছেলেদের দল দু’ভাগ করে দুজনে দু’দলে গিয়ে খেলল আরও কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত সত্যেন গুহ একবার কাদার মধ্যে আছাড় খেয়ে পড়লেন। সূর্য দৌড়ে এসে ওঁর হাত ধরে তুলল। তিনি কোমরে হাত দিয়ে বললেন, উ-হুঁ-হুঁ-হুঁ।
খুব বেশি লেগেছে?
কোমরটা আজকাল বড় জ্বালাতন করে। শরীরটা আর নিজের বশে নেই, বুঝলে!
আপনি তো এখনও বেশ ভালোই খেলেন।
এককালে এরিয়ান্স টিমে খেলতাম। তুমি খেলোটেলো নাকি?
না।
তুমি কোথায় থাকো?
সূর্য হাত দেখিয়ে বলল, এই আশ্রমে।
সত্যেন গুহ মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, বটে! এই আশ্রমে থাকো? আর আমিই সেটা জানি না। তুমি কোথা থেকে এসেছ?
কলকাতা থেকে।
ও বুঝেছি। তোমার নাম নিশ্চয়ই সূর্য?
সূর্য বলল, আপনিই কি সত্যেন গুহ?
সত্যেন গুহ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, আমি তো শুনেছি তুমি অতি বদ ছেলে। তুমি এখানে এসেছ কী করতে?
আমি আপনার এখানে থাকব।
তোমাকে খাওয়াবে কে? আমি কি এখানে দানছত্তর খুলেছি যে, যে আসবে তাকেই খাওয়াব?
আপনারা যা খান তাই খাব। তার বদলে কাজ করব।
তুমি কী কাজটা করবে শুনি?
কথা বলতে বলতে ওরা চলে এলেন টিনের ঘরটার সামনে। দরজা এখন খোলা, ভেতরে একটা বিরাট শতরঞ্চি পাতা। দরজার ঠিক বিপরীত দিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটি ছোট বেদিতে গান্ধীজির একটি চন্দনচর্চিত ফটো, সামনে ধূপ জ্বলছে। এক পাশে আশ্রমের বড়মা পূজারিণীর ভঙ্গিতে বসে আছেন।
সত্যেন গুহ হাত-পা ধুয়ে সেখানে গিয়ে বসলেন। ছেলেরাও সবাই হাতে-পায়ে জল দিয়ে বসল এসে শতরঞ্চির ওপর, হাঁটু মুড়ে। দীপ্তি একটা ধূপদানি এনে ঘর ভরিয়ে দিলেন ধূপের ধোঁয়ায়। সত্যেন গুহ রামধুন গান ধরলেন, ছেলেরা গলা মেলাল।
সূর্য দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে। দৃশ্যটা দেখে, অনেক দিন আগে মেদিনীপুরের এক গ্রামে তমোনাশ ডাক্তারের বাড়ির কথা মনে পড়ল। যদিও কিছুটা তফাত আছে। তমোনাশ ডাক্তার খানিকটা পাগল ধরনের ছিলেন, গানের সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিয়ে নাচতে শুরু করতেন। সত্যেন গুহর মধ্যেও অন্য রকম পাগলামি আছে নিশ্চয়ই। গান্ধীবাদীরা পাগল ছাড়া আর কী!
গান শেষ হবার পর, সূর্য আশা করেছিল, সত্যেন গুহ নিশ্চয়ই ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দেবেন, অন্তত হরিজন পত্রিকার পুরনো ফাঁইল থেকে কিছু পড়ে শোনাবেন তো বটেই।
কিন্তু সে রকম কিছু হল না। গান শেষ হবার পর সত্যেন গুহ চোখ বন্ধ করে হাতজোড় করে রইলেন। অন্য সবাই ওঁকে অনুসরণ করল। অর্থাৎ এটা নীরব প্রার্থনার সময়। প্রার্থনার জন্য কোনও সমবেত ভাষা নেই।
সব ছেলেই যদিও চোখ বন্ধ করে ছিল, কিন্তু সত্যেন গুহ চোখ খোলা মাত্রই তারাও চোখ খুলে উঠে দাঁড়াল। কেউ কোনও গোলমাল করল না, নীরবে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাইরে বেরোবার পর তাদের ছোটখাটো চেঁচামেচি শোনা গেল।
ঘর ফাঁকা হয়ে যাবার পর সত্যেন গুহ কাছে আসবার জন্য ইঙ্গিত করলেন। সূর্য হাঁটুগেড়ে বসল। সত্যেন গুহ জিজ্ঞেস করলেন, মাথা ন্যাড়া কেন?
সূর্য কারণটা জানাল।
তুমি জেল খেটেছিলে না একসময়?
হ্যাঁ।
কোন দলে ছিলে?
আমি রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু কখনও ঠিক রাজনীতি করিনি।
এখন?
এখন ও-সব থেকে দূরে থাকতে চাই।
এখনই তো বেশি কাজ করবার সময়।
কাজ করবার জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি।
মিথ্যে কথা বোলো না, মিথ্যে কথা শুনলে আমার গা জ্বলে যায়।
আপনি ঠিক মানুষ চিনতে পারেন না বোধহয়। মিথ্যে কথা বলা আমার স্বভাব নয়। সত্যেন গুহ মুখ তুলে সূর্যর দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, পৃথিবীতে মানুষের অনেক সমস্যা আছে। কারওর হৃদয়ঘটিত সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আমার নেই।
সূর্য ওঁর চোখে চোখ রেখে বলল, আমি আপনার কাছে কোনও সমস্যা নিয়ে আসিনি। আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছি। আমি এখানে থাকতে চাই, তারপর যা হবার তাই হবে।
এই সময় দীপ্তি দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন মামাবাবু আমি একটু আসব?
সত্যেন গুহ দীপ্তিকে দেখে যেন বেশ স্বস্তি পেলেন। বললেন, হ্যাঁ, আয়, আয়। এই ছেলেটাকে আমি একলা সামলাতে পারছি না।
দীপ্তি তার পাশে এসে বসার পর তিনি বললেন, এই ছেলেটি এখানে থাকতে চায়। বলছে।
দীপ্তি খুব শান্ত ভাবে বললেন, আজকের রাতটা তো থাকবেই, আজ তো আর ফিরে যাবার উপায় নেই, কাল চলে যাবে।
সূর্য বলল, না।
সত্যেন গুহ এবার একটু হেসে বললেন, এ তো মনে হচ্ছে পাকাপাকিই থাকতে চায়। এ-বিষয়ে তোর কী মত?
আমার মত নেই।
সূর্য দীপ্তির চোখে চোখ ফেলার চেষ্টা করল। দীপ্তি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন।
সত্যেন গুহ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সূর্যকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে থাকতে চাও কেন।
আপনাকে তো বলেইছি, আমি কিছু কাজ করতে চাই।
তুমি বড়লোকের ছেলে, তুমি এখানে কী কাজ করবে?
আপনি বুঝি গরিব? যাদের মনটা ছোট তারাই মুখে সব সময় গরিব গরিব করে।
ওরে দীপ্তি, এ-যে বড় চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে!
দীপ্তি ভর্ৎসনার সুরে বললেন, সূর্য, তুমি বড়মামার সঙ্গে এ রকম ভাবে কথা বোলো না।
সত্যেন গুহ তাড়াতাড়ি বললেন, না, না, আমি কিছু মনে করিনি। পরিষ্কার কথা বলাই তো ভালো। কিন্তু আমি একটাই কথা শুধু বুঝতে পারছি না, একে আমরা কোন কাজে। লাগাব।
দীপ্তি বললেন, ওর জন্য সে রকম কোনও কাজ আমাদের এখানে নেই।
সূর্য বলল, দীপ্তিদি, আমি তো চাকরি খুঁজতে আসিনি। এটা আশ্রম, এখানে তো যত বেশি কাজের লোক পাওয়া যাবে ততই কাজ বাড়বে।
তোমার বাবাও তো একটা অনাথ আশ্রম চালাতেন কলকাতায়। তুমি তো সেখানেই কিছু করতে পারতে। সেটাই তোমার উচিত ছিল। সেটা না করে তুমি এখানে চলে এলে কেন?
সূর্য এতক্ষণে দীপ্তির চোখের দৃষ্টি ছুঁতে পেরেছে। চাপা রাগে তীব্র ভাবে সেই দিকে তাকিয়ে বলল, দীপ্তিদি, আমাকে এত জেরা কোরো না। আমি যুক্তি সাজিয়ে কথা বলতে পারি না। কিন্তু আমার এখানেই কাজ করতে ভালো লাগবে। কলকাতায় আমার মন টেকে না! আমিও তো কিছু লেখাপড়া জানি, আমি এই আশ্রমের ছেলেমেয়েদের পড়াতেও পারি।
সত্যেন গুহ বললেন, তোমরা যা লেখাপড়া শিখেছ, আমি আমার আশ্রমের ছেলেমেয়েদের তা শেখাতে চাই না। ওই বিদেশি ধাঁচের কুশিক্ষা দেশ থেকে যত তাড়াতাড়ি দূর হয়ে যায় ততই মঙ্গল। ঠিক আছে, তোমাকে আমি অন্য কাজ দেব। তার আগে আর একটা কথা বলব, শুনবে?
বলুন!
আমি সব মানুষকেই সন্ন্যাসী হতে বলি না। তবে প্রত্যেকেরই জীবনের কতকগুলো আলাদা আলাদা ক্ষেত্র আছে। আমি আমার এই আশ্রমটিকে সংসারী মানুষদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে চাই। তোমার মধ্যে যে রকম প্রাণশক্তি আছে, তোমাকে নিজে থেকে আমি সংযমী হবার উপদেশ দিতে পারি না। সেই জন্যই বলছিলাম, তোমার মতন ছেলের জায়গা এটা নয়!
পরীক্ষা করে দেখুন।
তুমি পারবে?
পারব কিনা জানি না। পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কী?
ঠিক আছে দীপ্তি। তুই ছেলেদের ঘরে ওর শোবার জায়গা করে দে আজকের মতন। কাল থেকে অন্য যা-তোক ব্যবস্থা করা যাবে।
সূর্য সেখানেই রয়ে গেল। সকাল থেকে সে ছেলেদের সঙ্গেই সারাক্ষণ থাকে। মাঠে গিয়ে মাটি কোপায়, পুকুরে তাদের সাঁতার শেখায়, দুধেলা গোরুটা কখনও দড়ি খুলে পালিয়ে গেলে দৌড়োদৌড়ি করে ধরে আনে। খেলার মাঠে তো সে আছেই। শুধু সন্ধ্যাবেলার প্রার্থনায় সে যোগ দেয় না। গান্ধীজির ছবির সামনে সে কখনও বসবে না এ কথা সে সত্যেন গুহকে আগেই বলে নিয়েছে। এর সঙ্গে তার বর্তমান জীবনযাত্রার কোনও সম্পর্ক নেই। এ শুধু অতীতের অভিমান।
আশ্রমের পেছন দিকে অনেকখানি জমি পড়ে আছে। সেটা আশ্রমেরই সম্পত্তি। সেটাকে কাজে লাগাবার জন্য সত্যেন গুহ একটা নতুন পরিকল্পনা নিয়েছেন। সেখানে একটা ইটখোলা হবে। আশ্রমেরই ছেলেরা মাটি কেটে ইট বানাবে। তারপর সেগুলো পুড়িয়ে যা ইট তৈরি হবে–তার অর্ধেক বিক্রি করা হবে খরচ তোলার জন্য, বাকি অর্ধেক গ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে বিলি করা হবে। তাদের ঘর তুলে দিতে ছেলেরাই সাহায্য করবে। একজন মাত্র পেশাদার মিস্ত্রিকে নিযুক্ত করা হয়েছে কাজ শেখাবার জন্য।
সূর্য স্বভাবতই এই পরিকল্পনাটার দায়িত্ব নিয়ে নিল। সারা দিন সে অসুরের মতন পরিশ্রম করে। বইটইয়ের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই এখন, কোনও রকম নেশাও। নেই, এই কাজই যেন তার একমাত্র নেশা।
শুধু দীপ্তির সঙ্গে তার একবারও সে রকম ভাবে দেখা হয় না।কখনও কখনও দূর। থেকে একপলক দেখতে পায়। লোকজনের মাঝখানে দীপ্তি সূর্যর সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেন, কিন্তু সূর্যকে একা তার কাছাকাছি আসার সুযোগই দেন না। সে রকম সম্ভাবনা দেখা দিলেও আগে থেকেই এড়িয়ে যান।
কখনও কখনও দীপ্তিকে টুকিটাকি কাজের জন্য যেতে হয় জলপাইগুড়ি শহরে। একা যাবার নিয়ম নেই, অনন্ত নামের একটা কিশোর ছেলেকে নিয়ে যান। সূর্যর মনটা তখন একটু ছটফট করে কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
সত্যেন গুহ প্রথম প্রথম কয়েক দিন সূর্যর দিকে বিশেষ নজর রেখেছিলেন। কোনও ত্রুটি ধরতে পারেননি। সূর্য একবারও লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করার চেষ্টা করেনি দীপ্তির সঙ্গে, কোনও রকম দাবি জানায়নি–সে নিজেকে কাজের মধ্যে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিয়েছে। এই কাজই যেন তার নিজের কাছ থেকে নিজের মুক্তি।
মাটি কাটতে কাটতে হঠাৎ কখনও মুখ তুলে সূর্য দেখে দূরে ক্ষীণ মেঠো রাস্তা ধরে দীপ্তি হেঁটে যাচ্ছেন। গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে আকাশ। দীপ্তির সমুন্নত বরাঙ্গ সূর্যর চোখের সামনের আকাশ ঢেকে দেয়। যতদূর দেখা যায় সূর্যর চোখ তাকে অনুসরণ করে।
সেই সময় সূর্যর মুখ দেখলে মনে হয়, তার মতন অতৃপ্ত মানুষ এ-পৃথিবীতে আর একজনও নেই।