ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব
গত ১ রবিউল আওয়াল ১৪০২ হিঃ ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখে চট্টগ্রামের ইসলামি ঐক্যজোট ও হিযবে ইসলামী ‘ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলা নেতৃত্ব’ সম্পর্কে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেছে। প্রচারপত্রটি লিখেছেন ইসলামি ঐক্যজোটের আহ্বায়ক মুফতি মুহাম্মদ ইজহারুল ইসলাম। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন ‘আমাদের বদ আমলের কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ একদলীয় শাসন এ জাতির কাঁধে চাপানো হয় এবং ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের জনসাধারণের চেতনায় এক বিদ্রোহাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি হয় এবং ফলত মুজিবের পতনের পরে পর্যায়ক্রমে জাতর ইতিহাসের পর্দায় জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ঘটে’। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার কারণে কখনও এই দেশে কোনও ধর্মীয় উচ্ছঙ্খলতা সৃষ্টি হয়নি। মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল মসজিদ মাদ্রাসা, তারা অবাধে নামাজ পড়েছে, রোজা করেছে, ঈদুল আযহার উৎসবেও মুসলমানরা কখনও বাধাগ্রস্ত হয়নি। এই অপার স্বাধীনতা পাবার পরও জনসাধারণের চেতনায় বিদ্রোহাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল এবং এ কারণে মুজিবের পতন ঘটেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এই মিথ্যাচার আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু মুজিব আমলের জনরোষ সম্পর্কে র্যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে, তারা নিশ্চয় একথা স্বীকার করবেন যে জনরোষের কারণ আর যা কিছুই হোক, ধর্মনিরপেক্ষতা নয়।
প্রচারপত্রে আরও দাবি করা হয়েছে—‘জিয়াউর রহমান রাজনৈতিকভাবে জাতিকে ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে মুক্ত করে সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজন করেন। শতকরা নববই ভাগ মুসলমানের এ মাটি ও আবহাওয়া ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মদ্রোহিতার নাগপাশ থেকে বাহ্যিকভাবে মুক্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।‘ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মদ্রোহিতা এদেশে ঘটেনি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যা ঘটেছে তা ধর্মনিরপেক্ষতা থাকাকালীন নয়, বরং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করবার পর।
১৯৭০ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত সরকার বদলের যে রাজনৈতিক কারণ এই প্রচারপত্রে বর্ণনা হয়েছে, তা মিথ্যে, ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এইজন্য বললাম, কারণ উদ্দেশ্য এখানে এসে স্পষ্ট হয়— জেনারেল এরশাদের ব্যক্তিগত দুষ্ট আচরণ থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আটরশি ভিত্তিক সকল ভাওতাবাজি দীর্ঘ নয়টি বুছর ওলামায়ে কেরামসহ সর্বস্তরের তৌহিদী জনতা একটিমাত্র কারণেই হজম করেছিল যে, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বে রয়েছেন দু’জন মহিলা।
তা-ই যদি হয়, তবে আমার প্রশ্ন তৌহিদী জনতা যখন এরশাদের পতন ঘটাল এবং দেশে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা হল, তখন এই জনতা কেন মহিলা এবং তার দলকে নির্বাচিত করল? মহিলা ছাড়াও এবং এরশাদ ছাড়াও, পুরুষপ্রধান রাজনৈতিক দল তো এদেশে ছিলই এবং মহাসমারোহে নির্বাচনের প্রার্থীও হয়েছিল। তৌহিদী জনতার মূল আপত্তি নাকি মহিলা নেতৃত্বে। মুফতি তার উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট করেছেন কোরান হাদিসের উদাহরণসহ, যেমন মহিলা নেতৃত্বে কোনও কিছুর সুরাহা হবে না। বরং আমাদের আশঙ্কা, এতে নেমে আসবে আরও অসংখ্য অমঙ্গল ও গজব। কারণ আল্লাহর রাসুল এরশাদ করেছেন– ‘কখনও ঐ জাতির মঙ্গল সাধিত হয় না যাঁরা নিজেদের নেতা নির্ধারণ করেন কোনও মহিলাকে’ (বোখারি শরীফ হাদিস ৪৪২৫)। মুফতি ইজহারুল ইসলাম আরও লিখেছেন–‘মুসলিম মিল্লাতের নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী যিনি, তাকে ইমাম, খলিফা, সুলতান বা আমিরুল মুমেনীন বলা হয়। সেই ইমাম ও খলিফা বা রাষ্ট্র সরকার প্রধান মহিলা হওয়ার কোনও অবকাশ ইসলামী শরিয়তে নেই। বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্কগুলোতে ইসলাম নামটি মাথাব্যথার কারণ হলেও এদেশের শতকরা নববইভাগ মুসলমান এখনও পর্যন্ত আল্লাহ রাসুল ও পরকালে বিশ্বাসী বিধায় ইসলামী শরিয়ত ও খোদায়ী শাসন অনুশাসনের অনুরাগী। রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান মহিলা হওয়ার কোনও রকমের যৌক্তিকতা আছে বলে আজ পর্যন্ত কোনও বিজ্ঞ আলেম মত প্রকাশ করেননি।‘
কিন্তু মুফতি ইজহারুল ইসলামের দুর্ভাগ্য এই যে, দেশের সরকার প্রধান এখন একজন মহিলা। কোনও কোনও বিজ্ঞ আলেমের তোয়াক্কা না করেই দেশের অধিকাংশ জনগণ এই মহিলাকেই নির্বাচিত করেছে।
মুফতি ইজহারুল ইসলাম যুক্তি দিয়েছেন, যেমন পুরুষরাই মহিলাদের তত্ত্বাবধায়ক শাসক, কারণ আল্লাহ তাঁদের এককে অপরের উপর (পুরুষকে নারীর উপর) প্রাধান্য দান করেছেন এবং এ কারণে যে, পুরুষরাই (নারীদের জন্যে) তাদের অর্থ সম্পদ ব্যয় করেন। (সূরা নিসা আয়াত ৩০)
আর যখন তোমাদের দুষ্টু লোকেরা আমীর শাসক আর মালদার ব্যক্তিরা কৃপণ হবে এবং তোমাদের যাবতীয় কার্যাবলি নারীদের হাতে সোপর্দ হবে, তখন এ পৃথিবীর পেট তার পিঠের তুলনায় (অর্থাৎ দুনিয়াতে না থাকাই) তোমাদের জন্য উত্তম হবে (তিরমিজি শরীফ, ২য় খণ্ড, ৫২ পৃষ্ঠা)
পুরুষরা যখন মহিলাদের আনুগত্য স্বীকার করবে তখন তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। (মুসতাদরক আল হাকীম ২৯১ পৃঃ ৪ৰ্থ খণ্ড)
উদ্ধৃত অংশগুলোকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে মুফতি বলেছেন–ইসলামের এইসব মৌলিক বিধানগুলোর আলোকে রাষ্ট্রপ্রধান ও নামাজের ইমাম হওয়া উভয়টি সমানভাবেই মহিলাদের জন্য হারাম। শরিয়তের পরিভাষায় নামাজ পরিচালনা ও দেশ পরিচালনা উভয়টিকেই ইমামত বলা হয়। এই ইমামত কখনও পুরুষ ছাড়া নারীদের জন্যে বৈধ নয়। নামাজের ইমামতিতে পেশ মসল্লায় যেমন কোনও মহিলা দাঁড়িয়ে গেলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া মুসল্লীদের জন্য ফরজ ঠিক তেমনিভাবে রাষ্ট্র নামক বড় মসজিদের পেশ মসল্লায় কোনও মহিলা অধিষ্ঠিতা হয়ে গেলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া সমস্ত মুসলিম জনসাধারণের জন্য ফরজ। খোদাদ্রোহিত না করে বি এন পি দেশ পরিচালনা করলে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়, তবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহিলা আমরা কখনও মেনে নিতে পারি না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম, পীর মোর্শেদ মাশায়েখ ও ইসলামি বুদ্ধিজীবিসহ সর্বস্তরের মুসলিম জনসাধারণের কর্তব্য হল মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশে যাবতীয় নারী নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে একটি সত্যিকারের ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় জানমাল দিয়ে অংশগ্রহণ করা। তাহলে মূল কথাটি এই দাঁড়ায় যে, দেশে একটি হারাম নেতৃত্ব বিরাজমান। আজ পুরো একটি দেশের ইমামতি করছে নারী, এ হিসেবে নামাজের ইমামতি করা নেহাত তুচ্ছ ব্যাপার, দেশ পরিচালনা করছে নারী, একইভাবে দেশের মসজিদগুলোয় নামাজ পরিচালনার দায়িত্বও নারী নিতে পারে, গত মিলাদুন্নবীতে প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের পুরুষ ও নারী এক কাতারে দাঁড়িয়ে এবং বসে মিলাদ পড়েছে, এমন দৃশ্য এর আগে কল্পনাতীত ছিল, কল্পনার অতীত ঘটনাগুলোই এখন ঘটছে, ঘটবে। হারাম-হালালের সংজ্ঞাও সেই সঙ্গে পাল্টাচ্ছে।
নারী এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। পুরুষরা মহিলাদের আনুগত্য স্বীকার করায় মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গল কিছু হয়নি। ওইসব ধ্যান-ধারণা এখন অমূলক, অচল, অযৌক্তিক। দেশের মানুষ ধর্মকে অন্তরে স্থান দিতে চায়, শাসন ব্যবস্থায় নয়, শরিয়তকে পুঁথির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চায়, শরিয়ত যদি উঠে এসে রাষ্ট্রনীতিতে আসন গাড়ে তবে জনগণ এত বোকা নয় যে এতে তাদের সমূহ বিপদের আশঙ্কা তারা করবে না। আশঙ্কা করে বলেই দেশের আশি ভাগ মানুষ ধর্মভীরু হয়েও আশি ভাগ ভোট কোনও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ভাগে পড়ে না। পড়ে শরিয়ত বিরোধী মহিলা নেতৃত্বের দিকে। শরিয়ত-এর কথা বলে জনগণকে বোকা বানাবার দিন ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। তারা এখন নিজেরাই নিজেদের মঙ্গলের জন্য নীতি তৈরি করতে পারে, শরিয়তের সাহায্য ছাড়াই।
তারা ধর্মকে হেলা করছে না, কিন্তু শরিয়তকে মানছে না, তবে কেন এ-ই ধরে নিচ্ছি না যে ধর্ম আসলে চৌদ্দশ বছর আগের নানাবিধ তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা ও তাবৎ আরবীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার উর্ধের্ব উঠে এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যে, সততা ও মহত্ত্বের কথা ছাড়া বাকি অসততা ও অধর্মকে বর্জন করবার ক্ষমতা অর্জন করেছে মানুষ। এই সচেতন মানুষই এক সময় বিদ্যমান সকল শরিয়তি আইন বাতিল করে রাষ্ট্রে, সমাজে ও জীবনে কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে।