হিরোসিমাতে যে-দিন অ্যাটম বোমা পড়ে, সে-দিনও পৃথিবীতে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছিল, প্রায় এক লক্ষ নারী-পুরুষ বিয়ে করেছিল এবং অন্তত একশো কোটি লোক নিছক আহার্য সন্ধান ছাড়া আর কোনও কিছু চিন্তাই করেনি। অন্যান্য দিনের মতন সে-দিনও যথারীতি সারা পৃথিবী জুড়ে বেশ কিছু নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছে। সেই দিন সেই সময়ে ভাটপাড়ায় এক ভদ্রলোক সনাতন হিন্দু ধর্মকে বাঁচাবার জন্য দারুণ উত্তেজিত, নারায়ণগঞ্জে তখন ইসলাম বিপন্ন বলে ছোট একটি সভা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই আসামের হাফলংয়ে প্রত্যন্ত পাহাড় থেকে আসা এক কাছাড়ি আদিবাসী সদ্য খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে জীবনের প্রথম এক টুকরো পাঁউরুটি খেতে পেল এবং ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে কেঁদে ফেলল। সেই দিনই দুপুরে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামা রাজ্যে এক তুলোখেতে দু’দল খ্রিস্টান নিছক দুরকম গায়ের রঙের জন্য দাঙ্গা করেছিল।
পৃথিবীতে মানুষের কোনও চরিত্র নেই। প্রত্যেক জন্তুজানোয়ারের চরিত্র থাকে, মানুষ জাতিই শুধু চরিত্রহীন। স্পেনে গত তিনশো বছর ধরে যে ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই খেলা হচ্ছে, তাতে এত দিনের মধ্যে একটি ষাঁড়ও সোজা ছুটে আসতে আসতে হঠাৎ ডান দিকে বা বাঁ দিকে বেঁকেনি। মানুষ এ রকম নয়। মানুষ কখন কোন দিকে বেঁকবে তা সে নিজেও জানে না। সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে একদল লোক বাঘের পেটে প্রাণ। দেয়। আবার একদল লোক সারা পৃথিবীর ব্যাঘ্র-সম্পদ বাঁচিয়ে রাখার জন্য সমিতি গড়ে। একজন সন্ন্যাসীর হঠাৎ পদস্খলন হয়ে যায়। একজন ডাকাত হঠাৎ কবি হয়ে ওঠে।
মানুষের সুখেরও কোনও নির্দিষ্ট রূপ নেই। একদল লোক সারা দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত। ভবিষ্যতের এক সুস্থ সমৃদ্ধ মানবসমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে। অবশ্য সেই সমাজের নিয়ন্ত্রণভার তাদেরই হাতে থাকা চাই। আবার একদল লোক খাদ্যশস্য গোপন গুদামে মজুত রেখে হাজার হাজার লোককে না খাইয়ে মারে। দু’দলই সুখের সন্ধানী। মন্দিরের দেওয়ালে সূক্ষ্ম কারুকার্য সৃষ্টি করায় কারওর আনন্দ, কারওর আনন্দ সেই মন্দির ভাঙায়। কেউ একটি নারীর সামান্য সম্মতি পাবার জন্য পাগল হয়, কেউ টাকা দিয়ে নারীকে কিনে আনে।
সকালবেলা শুয়ে শুয়ে আমি এইসব কথা ভাবছিলাম। নিতান্তই অলস চিন্তা। এসব চিন্তারও কোনও মূল্য নেই। পৃথিবী আপন খেয়ালে চলবে। আমার এখন কোনও কাজ নেই বলে আমি যা খুশি আবোলতাবোল ভাবতে পারি। দিবাস্বপ্ন দেখতেও কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু একটু বাদে আমার খিদে পেলে আমাকে বিছানা ছেড়ে উঠতেই হবে। মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ আমার খুব পেটব্যথা করে। তখন আমি যন্ত্রণায় চারদিক অন্ধকার দেখি। সেই সময় পৃথিবীর আর কোনও সমস্যাই আমার কাছে সমস্যা নয়। তখন পৃথিবীটা উচ্ছন্নে যায় যাক।
মেঘলা মেঘলা দিন, বিছানা ছেড়ে আর উঠতেই ইচ্ছে করছে না। খবরের কাগজে চোখ বুলোনো হয়ে গেছে। খানিকটা আগে এক কাপ চা খেয়েছি বটে, কিন্তু জলখাবার খেতে হলে আমাকে উদ্যোগী হতে হবে। এখনও খিদে পায়নি। আর এক কাপ চা খেতে পারলে বেশ হত। কিন্তু মায়ের কাছে চা চাইলেই মা বিছানা ছেড়ে ওঠবার জন্য তাড়া দেবে। মা’র চোখে আমি কুঁড়েদের বাদশা। তার থেকে চুপচাপ থাকাই ভালো। এখনও আমার বিছানা ছেড়ে না-ওঠা কেউ লক্ষই করেনি।
আজ সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকলে কেমন হয়? কিছুই তো করার নেই। কোথাও যাবার নেই। এম এ ক্লাস এখনও শুরু হয়নি। তা ছাড়া এম এ পড়া হবে কিনা তারও ঠিক নেই। ও-সব আর এখন ভাবতে ইচ্ছে করে না। তারচেয়ে শুয়ে থাকা কত ভালো। অসুখ না হলেও কি কেউ সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে না!
কিন্তু একবারে চুপচাপ শুয়ে থাকাও সম্ভব নয়। কিছুনা-কিছু চিন্তা করতেই হয়। জাগ্রত অবস্থায়, কোনও কিছু চিন্তা না করে একটা নিরবচ্ছিন্ন শান্ত ভাব কি কেউ পেতে পারে? আসলে আমি লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে আছি বলেই বিছানায় মুখ গুঁজে আছি। চিন্তার হাত থেকেও মুক্তি চাইছি।
শিয়রের কাছে লাল রঙের মলাট বাঁধানো আমার কবিতার খাতা। হঠাৎ সেটার দিকে তাকিয়ে আমার রাগ হয়ে গেল। ঠেলা দিয়ে ফেলে দিলাম মাটিতে। পরে ওটাকেই ছাইগাদায় ফেলে দিতে হবে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে। কবিতা টবিতা আর লিখব না। কিছুই লিখব না।
এতক্ষণে পার্টি অফিসে অনেকে এসে গেছে। মুড়ি আর তেলেভাজা খেতে খেতে নিশ্চয়ই দারুণ আড্ডা জমেছে। কেউ কি এক বারও বলবে, বাদল ক’দিন ধরে আসছে না কেন? কেউ বলবে না। পার্টির ডিসিপ্লিন দারুণ কড়া। মন্টুর সঙ্গে আমার এত বন্ধুত্ব ছিল, মন্টুও কাল সন্ধ্যাবেলা আমার সঙ্গে গম্ভীর ভাবে কথা বলল। আমি কী এমন দোষটা করেছি? আদিনাথদার সঙ্গে তর্ক করেছি। তর্ক করাটাও দোষের? যেটা আমি বুঝতে পারছি না, সেটা আমাকে বুঝে নিতে হবে না? বিনা প্রশ্নে চুপচাপ সব মেনে। নিলেই কি সত্যিকারের মেনে নেওয়া হয়?
আমার এখন ছুটি, এই সময় আমি পার্টির অনেক কাজ করতে পারতাম। কয়েক জনকে হায়দ্রাবাদ তেলেঙ্গানায় পাঠানো হচ্ছে, আমিও তাদের দলে যেতে রাজি ছিলাম। কিন্তু আদিনাথদার মতে আমি এখনও যথেষ্ট তৈরি হইনি। আমার মধ্যে এখনও অনেক পেটি বুর্জোয়া সেন্টিমেন্ট রয়ে গেছে। আমাকে পার্টি মেম্বারশিপ দেবার এখনও সময় আসেনি। আমি আদিনাথদাকে খুশি করার অনেক চেষ্টা করেছি। তবু আদিনাথদার মন পেলাম না।
ব্যাপারটা হয়েছিল দু’সপ্তাহ আগে। রাজবল্লভপাড়ার একটা বাড়িতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা গল্প পড়ার কথা ছিল। ওঁর শরীর অসুস্থ বলে উনি আসতে পারলেন না। তখন আমাদেরই কয়েকজন নিজেদের লেখা পড়ল। আমাকেও একটা কবিতা পড়তে বলা হয়েছিল। আমি কিছুতেই রাজি হইনি। লোকজনের সামনে কবিতা পড়তে আমার জিভ আটকে যায়। তা ছাড়া আমি কোনও লেখাটেখা নিয়েও যাইনি। সব সময়েই তো পকেটে কবিতা থাকে না।
তবু কয়েক জন পেড়াপিড়ি করতে লাগল। বিশ্বদেব বলল, তোমার একটাও মুখস্থ নেই?
আমি বললাম, আমার অন্যদের কবিতা মুখস্থ থাকে। নিজের কবিতা মুখস্থ থাকে না।
বিশ্বদেব তখন ওর টেবিল ঘেঁটে ফস করে একটা পত্রিকা বার করল। সেই পত্রিকাটায় আমার একটা কবিতা ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটি নতুন, বিশেষ কোনও মতবাদ নেই।
বিশ্বদেব বলল, এতে যে কবিতাটা আছে, সেটাই পড়ে শোনাও।
তখন আর এড়ানো গেল না। কিন্তু ওই কবিতাটা আমার ওই আসরে একেবারেই পড়ার ইচ্ছে ছিল না–নিতান্তই একটা ব্যক্তিগত অনুভূতির লেখা।
যাই হোক, আমার কবিতাটা পড়ার পর কেউ কোনও মন্তব্য করল না। সাধারণত সবার রচনা নিয়েই পরে কিছু আলোচনা হয়। আমার লেখাটার পর সবাই অন্য কথা বলতে লাগল। আমি দুরুদুরু বুকে সকলের মুখের দিকে চাইলাম। মনে হল কেউই পছন্দ করেনি। বন্দনা সেনগুপ্ত সব আলোচনাতেই অংশ নেন, এখন তিনি মুখখানা বাংলার পাঁচ করে আছেন।
ওখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে আসবার পর আদিনাথদা বললেন, বাদল, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।
পানের দোকান থেকে আদিনাথদা চুরুট কিনলেন, আমিও সিগারেট ধরালাম। আজকাল সবার সামনেই সিগারেট খাই। রেণু ছাড়া।
আদিনাথদা বললেন, কী পড়লি আজকে? ওটা কি কবিতা?
আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম, না, ভালো হয়নি ঠিক।
ভালো-মন্দর কথা হচ্ছে না। ওইসব বস্তাপচা জিনিস নিয়েও এখন কবিতা লেখা হয়?
আমি চুপ করে রইলাম। আদিনাথদা কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক করে বল তো, তুই কি বরুণ ঘোষদের সঙ্গে ভিড়ছিস?
আমি তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে বললাম, মোটেই না। আমি ওদের কাগজে লেখা দিইনি।
বরুণ ঘোষকে নিয়ে কিছুদিন আগে একটা কাণ্ড হয়ে গেছে। বরুণ ঘোষ তরুণদের মধ্যে রীতিমতন নামকরা কবি, ইউনিভার্সিটিতে ইউনিয়নের কর্মী। তার লেখা গান আই পি টি-এ থেকে গাওয়াও হয়েছিল। কিন্তু ইদানীং বরুণ ঘোষ প্রেমে পড়ে গিয়ে বেশ কিছু প্রেমের কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। স্বীকার করতেই হবে, কবিতা হিসেবে সেগুলো চমৎকার। কিন্তু সেই নিয়ে পার্টির মধ্যে আপত্তি ওঠে। শেষ পর্যন্ত কথাবার্তা অনেক দূর গড়ায়। বরুণ ঘোষ বরাবরই চটাং চটাং কথা বলে। শেষ পর্যন্ত বরুণকে পার্টি থেকে এক্সপেল করা হল। বরুণ ঘোষও তেজের সঙ্গে বলে গেছে, আমি আলাদা কাগজ বার করব। আমি দেখিয়ে দেব, বাংলা কবিতা কোন দিকে মোড় নেয়। বরুণ ঘোষের পত্রিকা সত্যিই এর মধ্যেই বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
স্বাধীনতার ঠিক পর পরই অধিকাংশ লেখকই বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছিল। অনেকেই তখন মার্কসবাদী। কিন্তু কয়েক বছর পরে সবার লেখা নিয়ে যখন চুলচেরা বিচার করে দেখানো হতে লাগল, কে কতখানি মার্কসবাদী, কোনটা লেখা উচিত আর কোনটা লেখা উচিত নয়–এই নিয়ে পার্টি থেকে যখন বেশ জবরদস্তি হতে লাগল–অনেক লেখকই তখন সরে গেলেন বীতশ্রদ্ধ হয়ে। তাদেরই শেষ উদাহরণ বরুণ ঘোষ।
কিন্তু বরুণ ঘোষদের দিকে যাবার কোনও কারণই নেই আমার। বরুণ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত লেখক, সাহিত্যটা তার জীবন মরণের সমস্যা। আমার তো তা নয়। বাদল মুখার্জির দুটো-চারটে কবিতা শুধু এদিকে সেদিকে বেরিয়েছে। না লিখলেও আমার কিছু আসে যায় না। আমি কাজ করতে চাই। আমি একটা আদর্শকে বিশ্বাস করেছি, আমি সেটা নিয়েই থাকতে চাই।
বরুণ ঘোষ সংক্রান্ত আলোচনার সময় আমি কোনও মন্তব্য করিনি। পার্টির নির্দেশ মেনে নিয়েছি, বরুণ ঘোষের কাগজে লেখা দিইনি–কিন্তু তাকে আমি এখনও ভালো কবি মনে করি। এখন যে সবাই মিলে তাকে রি-অ্যাকশনারি বলতে শুরু করেছে, তা আমি মানতে পারি না। আদর্শের মিল না হলেই একজনকে শ্রেণিস্বার্থের দালাল বলতে হবে? বরুণ ঘোষ মানুষটা যে খাঁটি, তা জোর করে অস্বীকার করা হচ্ছে।
কিছু কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপারেও এখন পার্টির নির্দেশ আসছে। রেণুর সঙ্গে আমি এখানে সেখানে বেড়াই সেটা কয়েকজন দেখে ফেলেছে। প্রথম প্রথম এই নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছে কেউ কেউ। তারপর আমাকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে দেওয়া হল, রেণুর সঙ্গে যদি আমাকে মিশতেও হয় তা হলে আমার উচিত রেণুকে দিয়ে পার্টির কিছু কাজ করানো। আমি তাও চেষ্টা করেছিলুম। কিন্তু রেণু অন্য ধরনের মেয়ে। পড়াশুনো করতেই ভালোবাসে, বেশি লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারে না। এখন আমি রেণুর সঙ্গে যথাসম্ভব গোপনে দেখা করি।
আদিনাথদা বললেন, আজ যে কবিতাটা পড়লি, তাতে কী যেন একটা লাইন ছিল? আঁচল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দিলে, বার বার ঘামে ভেজা মুখ নিয়ে তোমার কাছে ছুটে আসব?
কবিতার লাইন কেউ ভুল বললে আমার বিশ্রী লাগে। অনেক মনোবেদনা, অনেক আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব নিয়ে একটা কবিতা লেখা হয়। সেটা ভালো হোক বা খারাপ হোক–তবু তার সঙ্গে সেই দুঃখ জড়িয়ে থাকে। কেউ তা নিয়ে হাসিঠাট্টা করলে মনে বড় লাগে। কিন্তু প্রতিবাদ তো করা যাবে না। ছাপা হয়ে গেলে সে-সম্পর্কে যা খুশি মন্তব্য করার অধিকার সকলেরই আছে।
ওই কবিতাটা লেখার আগের দিন দুপুরবেলা রেণুর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল কফি হাউসে। আমি তার আগে মায়ের জন্য জর্দা কিনতে গিয়েছিলাম বড়বাজারে। বড়বাজারের একটা বিশেষ দোকানের জর্দা ছাড়া মা’র অন্য জর্দা পছন্দ হয় না। ফেরার সময় হঠাৎ ট্রাফিক জ্যাম, বিশ্রী বিশৃঙ্খলা, রিকশা, ঠ্যালাগাড়ি, লরি–এইসবের মধ্যে আবার দু-তিনটে ষাঁড়। একটা ট্রামে আমি বন্দি হয়ে বসেছিলাম, অসহ্য গুমটের দিন, এদিকে আড়াইটে বেজে গিয়েছে। রেণু অপেক্ষা করে থাকবে।
ট্রাম থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু বাদেই একটা ঘড়িতে দেখি, তিনটে পাঁচ। আগের ঘড়িটা কি ভুল দেখেছিলাম? আমার নিজের ঘড়ি নেই। আরও দু-তিনটে দোকানের ঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম। সত্যিই তিনটে বেজে গেছে। রেণু কি এতক্ষণ বসে থাকবে? ও নিশ্চয়ই ভাববে আমি ভুলে গেছি কিংবা অন্য কিছু। রেণু একলা একলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, এই দৃশ্যটা আমাকে মুচড়ে দিল। আমি দৌড়োতে শুরু করলাম। আমাকে গিয়ে বলতেই হবে, আমি ভুলে যাইনি, সময় আমাকে ঠকিয়েছে।
কোনওক্রমে মিনিট দশেকের মধ্যেই কফি হাউসে পৌঁছে দেখলাম, একটা টেবিলে রেণু একলা চুপ করে বসে আছে। রেণু কফি হাউসে এর আগে একবার-দু’বার মাত্র এসেছে–এখানে বিশেষ কারোকে চেনে না। একলা এতক্ষণ বসে থাকা, একটি মেয়ের পক্ষে, মোটেই সুখকর নয়।
আমি ঝপাং করে রেণুর উলটো দিকের চেয়ারে বসে পড়েই বলতে শুরু করলাম, জানিস বড়বাজারে..উঃ কী অবস্থা…
রেণু সবটা শুনল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, তুমি না এলেও আমি বসেই থাকতাম। রাত্তির পর্যন্ত বসে থাকতাম।
সেই টেবিল থেকে পাখা অনেক দূরে। হাওয়া এসে পৌঁছোচ্ছে না। আমি তখনও হাঁপাচ্ছি। রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসার জন্য আমার সারা শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। বসন্ত রোগীর মতন আমার মুখখানা ঘামের ফোঁটায় ভরতি। এদিকে আবার রুমাল আনতে ভুলে গেছি। হাত দিয়ে বার বার ঘাম মুছেও কুল পাচ্ছি না।
এ রকম ঘর্মাক্ত তেলতেলে মুখে রেণুর সামনে বসে থাকতে আমার খুব লজ্জা করছিল। রুমাল আনতে ভুলে যাবার জন্য ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের মুখে একটা ঘুষি মারি। রেণুর সঙ্গে কথা বলব কী, আমি শুধু ঘাম নিয়েই চিন্তা করছিলুম।
রেণু কফির কাপে একটু একটু চুমুক দিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। একটা হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে আছে। গলায় একটা সরু হার। ডান পাশে সিঁথি কাটা।
রেণু জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
আমি বললুম, রুমাল আনতে ভুলে গেছি।
রেণু অবলীলাক্রমে ওর আঁচলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, মুছে ফেলো।
রেণু আজকাল বাইরে অন্য লোকজনের সামনে তুমি বলে। আগে ওকে বলে বলেও তুই ছাড়ানো যায়নি। হঠাৎ নিজেই একদিন বদলে ফেলেছে।
কফি হাউসে সেদিন আমার বন্ধুবান্ধব কেউ না থাকলেও, অনেকেই মুখচেনা। সকলের মাঝখানে বসে একটি মেয়ের আঁচল দিয়ে কি মুখ মোছা যায়? আশেপাশের টেবিল থেকে আওয়াজ দিতে পারে।
তবু দ্বিধা কাটিয়ে আমি কোনওক্রমে ওর আঁচলটা দিয়ে তাড়াতাড়ি মুখ মুছে ফিরিয়ে দিলাম।
রেণু বলল, ভালো করে মুছলে না? ভালো করে মুছে নাও।
আমি লাজুক ভাবে বললাম, অনেক লোক রয়েছে যে।
রেণু খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, সেই জন্যই তো। লোকজন না থাকলে আমি নিজেই তো তোমার মুখটা মুছিয়ে দিতাম।
এক একটা কথা শুনলে হঠাৎ মনের মধ্যে শিহরন বয়ে যায়। হঠাৎ আমার মনে হল, রেণুর আঁচলটা সুগন্ধে ভরা। হয়তো অন্যদের কাছে এই ব্যাপারটা বা এই কথাটা অতি সাধারণই মনে হবে। আমি কি একটু বেশি বেশি রোমান্টিক?
সেদিন রেণুকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে আমি বাসে ফিরছিলুম। অসহ্য ভিড়, তেমনই গরম। সারা দিন বৃষ্টি আসবে আসবে করেও আসেনি। আমার আবার শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। তখন রেণুর আঁচলটা আর একবার পাওয়ার জন্য আমার ভেতরট ছটফট করতে লাগল।
পরের দিন, এই বিষয় নিয়েই একটা কবিতা লিখে ফেলি। লেখার পরই মনে হল কেন লিখলাম? এই ব্যাপারটা আমার এতই ব্যক্তিগত যে অন্য কারওকে কি বোঝানো যাবে? কিন্তু এক এক সময় নিজেকে প্রতিরোধ করারও ক্ষমতা থাকে না। কবিতা লিখতে বসে, সেই মুহূর্তে আমার আর কিছুই মনে পড়ছিল না, শুধু রেণুর আঁচলটা ছন্দোময় হয়ে ফিরে ফিরে আসছিল। এ ব্যাপারটা আদিনাথদাকে কী করে বোঝাব!
আদিনাথদাকে বললাম, আমি চেষ্টা করেও ভালো লিখতে পারি না!
আদিনাথদা বললেন, সুকান্তর মতন লিখতে পারিস না?
কোনও কবিই অন্য কারওর মতন লেখে না।
সাহিত্য সম্পর্কে তোর ধারণা কী? সাহিত্য কীসের জন্য?
আমি শান্ত ভাবে কথা বললেও আমার ভেতরে ভেতরে দারুণ একটা রাগ জমছিল। কিন্তু সেই রাগের পরিমাণ যে এত বেশি, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।
হঠাৎ চেঁচিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে সে বিষয়ে আলোচনা করে কী হবে? আপনি সাহিত্যের কী বোঝেন?
আদিনাথদা একটু অবাক হলেও গলা চড়ালেন না। আমাকে উপদেশ দেবার ভঙ্গিতে বললেন, আমি অন্তত এইটুকু বুঝি, সাহিত্যকে একটা হাতিয়ার করে তুলতে হবে।
আমি ঠোঁট বেঁকিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গে এতদিন মিশে আমি বুঝতে পেরেছি, আপনার কোনও সাহিত্যবোধই নেই। যে নিজে সাহিত্য সম্পর্কে কিছুই বোঝে না, সাহিত্য সম্পর্কে তার ফতোয়া দেবার কোনও অধিকার নেই।
আদিনাথদার সঙ্গে এ রকম সুরে কথা বলার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। কোনও দিন এ রকম করিনি। কিন্তু আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলাতে পারলাম না কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত এমন হল, আদিনাথদা অন্যদের নিয়ে উলটো দিকে চলে গেলেন, আমি হাঁটতে লাগলাম একা একা। ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল। সাহিত্য ফাহিত্য নিয়ে এত মাথা ঘামাবার কোনও মানে হয় না। আমি লেখা ছেড়ে দিতে পারি যে-কোনও মুহূর্তে। কিন্তু আদিনাথদা আমার মনের কথাটা বুঝতে না পেরে কেন খোঁচা মেরে কথা বলছিলেন! একা একা হাঁটতে এত খারাপ লাগছিল যে আমি একটা পার্কে চুপ করে বসে রইলাম।