টাকা, টাকা, টাকা! সবসময় টাকার চিন্তা। শান্তিনিকেতনে আশ্রম-বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন কাকের মাথায়। এখন আর পিছিয়ে যাওয়া চলে না। কিন্তু বিনা বেতনে ছাত্রদের পড়ানো, তাদের আহারবাসস্থানের ব্যবস্থা ঠিক রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না কিছুতেই। শিক্ষকদের তো প্রতি মাসে তিন দিতে হবেই। হিসেব করে দেখা গেছে, প্রতিটি ছাত্রের জন্য মাসে অন্তত পনেরো টাকা খরচ পড়েই। বছরে একশো আশি টাকা। ভর্তির সময় অভিভাবকদের জানানো হয়েছিল যে এই আদর্শ বিদ্যালয়টি অবৈতনিক, যেমন প্রাচীনকালে গুরুর আশ্রমে শিষ্য-ছাত্রদের কোনও খরচ দিতে হত না। এখন হঠাৎ অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা চাওয়া যায় কী করে? রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, তাঁর এই শুভ উদ্দেশ্য দেখে বন্ধু ও শুভার্থীরা স্বেচ্ছায় সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবেন। ত্রিপুরার মহারাজা মাসিক পঞ্চাশ টাকা পাঠান, আর দু-একজন কখনও কিছু সাহায্য করেন বটে, কিন্তু তা সিন্ধুতে বিন্দুর মতন। যদি দেশের এক একজন ধনী ব্যক্তি এক একটি ছাত্রের দরুন বছরে একশো আশি টাকা দিতেন, তা হলে কোনও সমস্যা থাকত না। সেই মর্মে রবীন্দ্রনাথ কয়েকজনের কাছে। আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন, আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।
প্রতি মাসের শেষেই রবীন্দ্রনাথকে দারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাতে হয়। শিক্ষকদের বেতন চুকিয়ে দিতে না পারলে অসন্তোষের সৃষ্টি হবে। ছাত্রদের প্রতিদিনের খাদ্য সরবরাহ যদি ঠিকমতন না হয়! আরও কত টুকিটাকি খরচ থাকে, ঝড়ে হঠাৎ কোনও বাড়ির চাল উড়ে গেলে বড় খরচের ধাক্কা এসে পড়ে। সব দায়িত্ব একা রবীন্দ্রনাথের। সামনের বছর থেকে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নিতেই হবে, উপায়ান্তর নেই।
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ঋণও কম নয়। যতবার ব্যবসা করতে গেছেন, ততবারই প্রথমে কিছুদিন একটু সোনালি রেখা দেখতে পাওয়ার পরই ক্ষতি শুরু হয়েছে। সুরেন্দ্রের সঙ্গে যৌথ ব্যবসায় নেমে এক মারোয়াড়ির কাছ থেকে ঋণ করতে হয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা, যথা সময়ে অনাদায়ে সেই মহাজন কবি ও তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রকে জেল খাটাবার উপক্রম করেছিল। তারকনাথ পালিতের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে সেই মারোয়াড়ির হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া গেছে। কিন্তু এটাও তো ঋণ, এ বাবদে রবীন্দ্রনাথকে নিজের অংশেই মালিক সুদ দিতে হয় একশো পঁয়তাল্লিশ টাকা তের আনা চার পাই। প্রতি মাসে সেই অর্থ জোগাড়ের দুশ্চিন্তাও মাথায় রাখতে হয়। এত টানাটানির মধ্যেও মৃণালিনী নিজের সংসার চালাচ্ছেন কোন মন্ত্রবলে কে জানে!
অভাব, সংসারের চিন্তা বারংবার মন কেড়ে নিলেও তারই মধ্যে লিখতে হয়। ভারতী, বঙ্গদর্শন, তত্ত্ববোধিনী, সঙ্গীত প্রকাশিকা ইত্যাদি পত্রিকায় লেখা দিতে হয় নিয়মিত, এর মধ্যে বঙ্গদর্শনের অনেকগুলি পৃষ্ঠা ভরানোর দায়িত্ব তাঁর। শুধু দায়িত্ব নয়, কাগজ-কলম তাঁকে চুম্বকের মতন টানে। সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই মুক্তি। একটা গান রচনা করতে পারলে মন উধাও হয়ে যায় সুরলোকে।
‘চোখের বালি’ ধারাবাহিক উপন্যাসটি এবার শেষ করতে হবে। দুজন পুরুষ, তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাদের মাঝখানে এক রহস্যময়ী বিধবা রমণী, বিনোদিনী। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের চেয়ে মানব-হৃদয়ের জটিলতাই এ কাহিনীর প্রধান অবলম্বন। মহেন্দ্র বিবাহিত তবু সে বিনোদিনীর প্রেমে উন্মত্ত, বিহারীও বিনোদিনীকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে তীব্রভাবে কামনা করেছে, কিন্তু তার প্রাণাধিক বন্ধু যার কাছে প্রণয় নিবেদন করেছে, তাকে কি সে নিজের করে পেতে পারে কখনও? কাহিনীটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, প্রতি সংখ্যা প্রকাশের পরই অনেকে লেখককে জিজ্ঞেস করেছে, এর পরিণতি কী হবে?
তিপ্পান্নটি পরিচ্ছেদ লেখা হয়ে গেছে, এবার শেষ করার পালা। লিখতে লিখতে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন রবীন্দ্রনাথ। কাহিনীতে যে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, তার সুষ্ঠু সমাধানের একমাত্র উপায়, বিনোদিনীকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া। কথাশিল্পীরা সকলেই অহিংস হত্যাকারী। কলম নামে অস্ত্রের সামান্য কয়েকটি খোঁচায় তাঁরা অবলীলাক্রমে যে-কোনও নারী অথবা পুরুষের মৃত্যু ঘটাতে পারেন। কিন্তু এতদিন ধরে লিখতে লিখতে বিনোদিনী চরিত্রটির ওপর তার স্রষ্টার বড় মায়া পড়ে গেছে। কেন সে মরবে ! প্রেম কি অপরাধ? বিধবা বলে কি তার হৃদয়ের প্রেমানল জ্বলে উঠতে পারে না! অন্য অনেক সমাজে এ রকম তরুণী বিধবাদের পুনর্বিবাহ হয়। হিন্দুদের মধ্যেও এখন বিধবা বিবাহে আইনের সমর্থন আছে।
মহেন্দ্রর মা রাজলক্ষ্মী বিহারীকেও সন্তানের মতন স্নেহ করেন। তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে দুই বন্ধুর পুনর্মিলন হয়েছে মহেন্দ্রর কাম-ক্রোধ-উন্মত্ততা অনেকখানি প্রশমিত। সে ফিরে এসেছে তার স্ত্রীর কাছে। এখন বিহারীর সঙ্গে বিনোদিনীর বিবাহ দিতে কোনও বাধা নেই। কিন্তু তাতে কি অতিসরলীকরণ হয়ে যায় না? শেষ পর্বে মিলন দৃশ্য দেখালে পাঠক-পাঠিকারা খুশি হয়, কিন্তু সাহিত্যে একটা ঔচিত্যবোধ থাকে, পাঠক-পাঠিকাদের খুশি করার জন্য রসের হানি করা যায় না। এখন বিহারী বিনোদিনীকে বিয়ে করলেও কি ঈর্ষার কাঁটাটি দূর হবে ! বিনোদিনীও কি বিহারীকে ভালবাসতে পারবে পুরোপুরি ! বিহারী বিবাহের প্রস্তাব করলেও বুদ্ধিমতী বিনোদিনীর পক্ষে তা প্রত্যাখ্যান করাই স্বাভাবিক। – বিহারী কলকাতা থেকে দূরে সরে গিয়ে গঙ্গার ধারে একটি বাগানবাড়িতে গরিবদের চিকিৎসার জন্য একটি আশ্রম খুলবে মনস্থ করেছে। এরকম একটা মহৎ আদর্শে মনোনিবেশ করাই তাকে এখন মানায়। বিনোদিনীও যদি থাকতে চায় সেখানে, আশ্রমের কাজে সাহায্য করবে, অন্তত সকলের জন্য বেঁধে দিতেও তো পারবে?
না, এটাও ঠিক হবে না। প্রেম তো সহজে মরে না। বিনোদিনীর প্রতিদিনের সান্নিধ্যে যদি বিহারীর মনে আবার দপ করে জ্বলে ওঠে কামনা ! যদি মহেন্দ্র আবার সেখানে ছুটে যেতে চায় ! কাহিনী তা হলে চলতেই থাকবে।
আজকের ডাকে কয়েকটি চিঠি এসেছে। একজন ভূত্য এসে কবির লেখার টেবিলে রেখে গেল। লিখতে লিখতে থেমে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিঠিগুলি নেড়েচেড়ে দেখলেন। একটি চিঠি এসেছে শিলাইদহ থেকে, আর একটি চিঠির ঠিকানা রথীর হাতের লেখা, আর একটি চিঠি বিলেতের। চিঠি পাওয়ামাত্র খুলে পড়া অভ্যেস, তবু আজ খুললেন না রবীন্দ্রনাথ! বিলেতের চিঠিটা পাঠিয়েছে তাঁর দ্বিতীয় জামাতা সত্যেন, সেটা দেখেই রবীন্দ্রনাথের বিরক্তির উদ্রেক হল। এই জামাতাটি তাঁকে নানাপ্রকারে দোহন করে চলেছে, ইংলন্ডে তার পড়ার খরচের জন্য নিয়মিত মাসোহারা পাঠাতে হয়, তাও যখন-তখন নানা ছুতোয় অতিরিক্ত অর্থ চেয়ে বসে। এ ছাড়াও তার মাকে সাহায্য করার জন্য প্রতি মাসে পাঠাতে হচ্ছে পঞ্চাশ টাকা। শান্তিনিকেতনের চিঠিতেও হয়তো টাকার তাগাদা আছে। এখন এসব চিঠি পড়লে লেখাটা নষ্ট হয়ে যাবে।
কাহিনী শেষ করতে হলে বিনোদিনীকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
একেবারে মৃত্যুর মতন কঠিন শাস্তি না দিয়ে তাকে অনেক দূরে সরিয়ে দিলেও চলে। মহেন্দ্রর কাকিমা অন্নপূর্ণা কাশীতে গিয়ে শেষজীবন কাটাবেন ঠিক করেছেন, বিনোদিনী তার সঙ্গে চলে যেতে পারে। হ্যাঁ, সেটাই ভাল হবে। বাংলার অনেক বিধবার তো কাশীবাসী হওয়াই নিয়তি।
বিদায়ের আগে বিহারী বিনোদিনীর কাছ থেকে কোনও একটা চিহ্ন রেখে দিতে চাইল। তার একগুচ্ছ চুল। এ বিলিতি প্রথা বিনোদিনীর একেবারে পছন্দ নয়। আঁচলের প্রান্ত খুলে সে দুখানি হাজার টাকার নোট বার করল। এই টাকা সে বিহারীর সৎকাজের জন্য দিয়ে যেতে চায়, এটাই তার চিহ্ন।
লিখতে লিখতে রবীন্দ্রনাথের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। লেখককে কেউ এভাবে টাকা দেয় না। কিন্তু লেখক ইচ্ছে করলেই বিনোদিনীর আঁচলে দু হাজার কেন, পাঁচ হাজার টাকাও বেঁধে দিতে পারতেন।
উপন্যাসটি শান্ত রস দিয়ে শেষ করা দরকার। হতভাগিনী বিনোদিনী কি কিছুই পাবে না? সে অন্তত ক্ষমা তো পেতে পারে? সমাজের চোখে সে কুলটা হয়েছিল, তবু রাজলক্ষ্মী এবং অন্নপূর্ণা তাকে ক্ষমা করেছেন। বাকি রইল মহেন্দ্রর স্ত্রী আশা। নিজের স্বামীর এই প্রণয়িনীটিকে সে দু চক্ষে দেখতে পারত না, কিন্তু এখন বিনোদিনী চিরবিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে বলে তার মন নরম হয়ে এল। সজল হয়ে এল তার চক্ষু। মহেন্দ্রও অশ্রুভরা চোখে বিনোদিনীকে প্রণাম করে বলল, বউঠান, মাপ করিয়ো।
বা সমাপ্তিরেখা টানার পর রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। ধারাবাহিকভাবে উপন্যাস লিখতে লিখতে চরিত্রগুলি খুব জীবন্ত, বড় আপন হয়ে যায়। তারা হয়ে থাকে প্রতি দিনের সঙ্গী। এবার এদের ত্যাগ করতে হবে। উপন্যাস শেষ করার পর ঠিক যেন প্রিয়জনের বিচ্ছেদবেদনা বোধ করতে হয়।
বেশিক্ষণ বসে থাকার উপায় নেই, অনেক কাজ, এখনই সংসারের ডাক পড়বে। লেখার কপি প্রেসে পাঠাতে হবে আজই। রবীন্দ্রনাথ চিঠিগুলি খুলতে লাগলেন।
দুঃসংবাদ, শুধু দুঃসংবাদ। জামাইয়ের চিঠিটা তিনি যতখানি খারাপ আশঙ্কা করেছিলেন, তার চেয়েও খারাপ। শ্রীমান সত্যেনকে খরচপত্র দিয়ে হোমিওপ্যাথি শেখবার জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু মাঝপথে সে লন্ডনে নেমে পড়ে। যাই হোক, সেখানেই সে হোমিওপ্যাথি পড়া শুরু করেছিল, পাস করে ফিরে এলে সে স্বাবলম্বী হবে, এই ছিল আশা। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের এখন এদেশে খুব কদর। রবীন্দ্রনাথও এই চিকিৎসা পদ্ধতি পছন্দ করেন। কিন্তু সেই আশার মূলে কুঠারাঘাত পড়ল। সত্যেন জানিয়েছে যে বিলিতি আদব-কায়দা তার পছন্দ হচ্ছে না, ডাক্তারি পড়তেও ভাল লাগছে না, সে দেশে ফিরতে চায় অবিলম্বে। অর্থাৎ তাকে প্রতি মাসে যে দশ পাউন্ড করে পাঠাতে হত, আরও পোশাক কেনা, ভ্রমণ ও অতিথি আপ্যায়নের জন্য মাঝে মাঝেই অতিরিক্ত দাবি ছিল তার, সেই সব টাকাই জলাঞ্জলি গেল। এখন তাকে দেশে ফেরার টিকিট পাঠাতে হবে, তার মানে আরও অন্তত পঁচাত্তর পাউন্ডে ধাক্কা! রাগ করার উপায় নেই। যেমন করে তোক টিকিটের টাকা সংগ্রহ করতেই হবে, রেণুকার মুখ চেয়ে সন্তুষ্ট রাখতেই হবে জামাইকে। রেণুকারও শরীর ভাল নয়, তার ঘুষঘুষে কাশি লেগেই আছে, মাঝে মাঝেই জ্বর হয়। সত্যেনকে টিকিট পাঠাতে যত দেরি হবে, ততই বাড়বে ঋণের বোঝা!
শিলাইদহ থেকে নায়েববাবু লিখেছেন যে রবীন্দ্রনাথের একবার সেখানে যাওয়া দরকার। আদায়পত্র ভাল হচ্ছে না। বাবুমশাইয়ের উপস্থিতিতে এ অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
রথীর চিঠিখানিই সবচেয়ে মারাত্মক। পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। মৃণালিনী দেবী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, একেবারে শয্যাশায়ী। ঠিক কী রোগ হয়েছে, তা রথী লেখেনি, তবে গুরুতর কিছু না হলে সে নিশ্চয়ই বাবাকে জানাত না। মৃণালিনীই বারণ করতেন।
চিঠিটা হাতে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলেন। মৃণালিনী এতদিন পর শুধু স্ত্রী বা। গৃহিণী নয়, সহধর্মিণী হয়ে উঠছিলেন। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে অনেক সাহায্য পাওয়া যেত। দূরে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের এই ভরসা ছিল, মৃণালিনী যখন আছেন, শান্তিনিকেতনের ছেলেরা অন্তত না খেয়ে থাকবে না!
মৃণালিনী কয়েক মাসের অন্তঃসত্ত্বা, এই সময় তাঁর অসুখ…।
পরদিনই শান্তিনিকেতন থেকে একজন তোক এল, তার কাছে মৃণালিনীর রোগের বিবরণ পাওয়া। গেল। বোলপুরের এক মুন্সেফবাবু মৃণালিনী ও রথী-শমীদের একদিন নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেদিন প্রবল বর্ষা, ভাদ্র মাসের আকাশ ফাটিয়ে ধারাবর্ষণ হচ্ছে, তারই মধ্যে যেতে গিয়ে সেই মুন্সেফবাবুর বাড়ির সামনে মৃণালিনী দেবী জোর আছাড় খেয়েছেন। তারপর থেকে তাঁর পেটে অসহ্য ব্যথা। উঠতে পারছেন না, কোনও খাদ্যেও রুচি নেই। ই কলকাতায় অনেকগুলি কাজ না করলেই নয়, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এখনই শান্তিনিকেতনে যাওয়া। সম্ভব হচ্ছে না। তিনি স্ত্রীর জন্য ওষুধপত্র পাঠিয়ে দিলেন।
এখন রবীন্দ্রনাথের দুশ্চিন্তার মধ্যে প্রধান কোনটি, অর্থ সংগ্রহ, না স্ত্রীর ব্যাধি? স্বাভাবিক উত্তর এই যে, দুটোই সমান। কিংবা, এর চেয়েও বড় একটা সমস্যা আছে, তার নাম বিনোদিনী। ‘চোখের বালি’র এই নায়িকাকে রবীন্দ্রনাথ তিল তিল করে নির্মাণ করেছেন। সে এখন বড় বেশি জীবন্ত, কিন্তু উপন্যাস শেষ হয়ে গেলে তো এই চরিত্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তবু সে মাথা জুড়ে থাকে। চোখের সামনে তাকে স্পষ্ট দেখা যায়। এই ভরা যৌবনে সে কাশীতে গিয়ে থাকবে কেমন। করে!
এ বিনোদিনীকে মাথা থেকে তাড়াতে না পারলে অন্য কিছু লেখা যাবে না। এমনকী অর্থচিন্তা কিংবা স্ত্রীর রোগের উৎকণ্ঠা থেকেও বারবার মন সরে যাবে। বিনোদিনী, তুমি যাও, তুমি অলীক, তুমি এখন থেকে শুধু ছাপার অক্ষরেই নিবদ্ধ থাকো!
সারা দিন ঘোরাঘুরির পর বাড়িতে এসে স্নান করলেন অনেকক্ষণ ধরে। যেদিন বৃষ্টি বন্ধ থাকে, সেদিনই সারা শরীরে কুলকুল করে ঘাম বয়। স্নানের পর সারা শরীরে খানিকটা গোলাপজল ছিটিয়ে দিলেন। ছেলেমেয়েরা সবাই শান্তিনিকেতনে, এখানকার বাড়ি শূন্য। রবীন্দ্রনাথ ওপরের ঘরে গিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। বিজলি বাতি এসে গেছে, এখন রাত্রে লেখার খুব সুবিধে।
সম্পূর্ণ অন্য কিছু লিখতে হবে। গদ্য নয়, অনেক দিন কবিতা লেখা হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে থাকতে তিনি নিজের মনটাকে সংসার থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করে নিলেন। এখন তিনি কারুর স্বামী নন, কারুর শ্বশুর নন, শান্তিনিকেতন-বিদ্যালয় চালাবার দায় যার স্কন্ধে, সে অন্য রবীন্দ্রনাথ। এখন তিনি কে? সামনে একটা সুদীর্ঘ পথ, সেখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একাকী পথিক।
রবীন্দ্রনাথ প্রথম দুটি লাইন লিখলেন :
‘পথের পথিক করেছ আমায়।
সেই ভালো ওগো সেই ভালো—’
একবার শুরু করলে আর কোনও বাধা আসে না। কলম যেন নিজেরই গতিতে তরতর করে এগিয়ে যায় :
কোনো
মান তুমি রাখনি আমার
সেই ভালো ওগো, সেই ভালো।
কারণ হৃদয়ের তলে যে আগুন জ্বলে।
সেই আলো মোর সেই আলো।
পাথেয় যে-ক’টি ছিল কড়ি
পথে খসি কবে গেছে পড়ি…
কবিতাটি শেষ করার পর তেমন মনঃপূত হল না। তখনই শুরু করলেন আর একটি। তারও পরে একটি নতুন গানের কয়েক পঙক্তি গুনগুন করতে করতে মন বেশ পরিচ্ছন্ন হয়ে গেল।
মৃণালিনীর শরীর সুস্থ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। শান্তিনিকেতনে তাঁর সেবা করবে কে? মৃণালিনীর সম্পর্কে এক বিধবা পিসি রাজলক্ষ্মী তবু সংসারটা সামলাচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের দেখাশুনোর ভার নিয়েছেন। সঠিক চিকিৎসার জন্য মৃণালিনীকে কলকাতায় নিয়ে আসা দরকার। রবীন্দ্রনাথ নিজেও শান্তিনিকেতন যেতে পারছেন না। তাঁর সমস্ত কবিতাগুলি কাব্যগ্রন্থ নামে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করার উদ্যোগ চলছে, সম্পাদনার ভার যদিও নিয়েছেন মোহিতচন্দ্র সেন, তবু রবীন্দ্রনাথ কবিতাগুলি পরপর সাজানোর ব্যাপারটা নিজে দেখে নিতে চান, মুখবন্ধ হিসেবে কিছু কিছু নতুন কবিতাও লিখে দিতে হচ্ছে।
মৃণালিনীর এক ভাই নগেন আছে শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ শ্যালককে চিঠি লিখে দিলেন মৃণালিনীকে নিয়ে আসার জন্য। রথীও সঙ্গে আসবে।
মৃণালিনীর শরীর খুবই দুর্বল। শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাঁর। এপর্যন্ত কোথাও ঠিক গুছিয়ে সংসার করতে পারেননি, অনেকবার ঠাঁই-নাড়া হতে হয়েছে তাঁকে। জোড়াসাঁকোয় অত আত্মীয় পরিজনের মধ্যে তাঁর থাকতে ইচ্ছে হয় না। শিলাইদহ বেশ পছন্দ হয়েছিল, সেখান থেকে পুরো পরিবারটিকে রবীন্দ্রনাথ আবার উপড়ে এনেছেন শান্তিনিকেতনে। এখানে তিনি আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। এখানকার সংসারের তিনিই ছিলেন পুরোপুরি কী। জোড়াসাঁকোয় গিয়ে আবার জা-ননদ-ভাজদের খুঁত ধরা দৃষ্টির সামনে পড়তে হবে।
কিন্তু বাধা দেওয়ার মতন মনের জোরও আর অবশিষ্ট নেই মৃণালিনীর। ধরাধরি করে তাঁকে ট্রেনের কামরায় এনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে, মাথার কাছে বসে আছে রথী। চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা যায়, কত তালগাছের শ্রেণী, কত বুনো খেজুরের ঝোঁপ। আম-জাম গাছ ও বাঁশঝাড়ে ঘেরা এক একটি শান্ত পল্লীগ্রাম, সদ্য ফসল কাটা খেত, মস্ত বড় মহিষের পিঠে চেপে একটি বাচ্চা ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে। জনশুন্য এক মাঠের মধ্যে একটা পাড় ভাঙা, আধ বোজা পুকুরে ছেয়ে আছে অজস্র সাদা পদ্মফুল। ছেলেমানুষি উৎসাহে রথী বলল, মা, মা, দেখো, কত পদ্ম!
কোনওক্রমে হাতে ভর দিয়ে উঠলেন মৃণালিনী, তার দুই চক্ষু জলে ভরে এল। তাঁর অনবরত মনে হচ্ছে, এই সব দৃশ্য তিনি আর কখনও দেখবেন না।
জোড়াসাঁকোয় যখন পৌঁছলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ বাড়িতে নেই। তাঁকে প্রকাশকের কাছে যেতে হয়েছে। ফিরলেন সন্ধেবেলা, ঘর্মাক্ত কলেবরেই সোজা চলে এলেন স্ত্রীর শয্যার পাশে। মৃণালিনীর রক্তহীন পাণ্ডুর মুখোনি দেখে তিনি নিদারুণ বিমর্ষ বোধ করলেন। অবস্থা যে এতখানি খারাপ হয়েছে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
মৃণালিনী ক্লিষ্টভাবে হেসে বললেন, এইবারে ভাল হয়ে যাব। তোমার যে পিঠ ভিজে গেছে। যাও, জামাকাপড় ছেড়ে এসো!
রবীন্দ্রনাথ একটা হাতপাখা নিয়ে স্ত্রীকে বাতাস করতে করতে বললেন, কলকাতায় গরম পড়েছে সাঙ্ঘাতিক। শান্তিনিকেতনে কি এর চেয়ে বেশি ছিল?
মৃণালিনী বললেন, শান্তিনিকেতনে কষ্ট হয় না। সন্ধেবেলা কী সুন্দর হাওয়া দেয়। শোনো, সত্যেন নাকি ফিরে আসছে?
রবীন্দ্রনাথ শুষ্কভাবে বললেন, হ্যাঁ, তাকে টিকিট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, রওনাও হয়েছে জানি, দু-এক দিনের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।
মৃণালিনী বললেন, ভালই হয়েছে। এবারে রেণুর ফুলশয্যার ব্যবস্থা করো।
রেণুকার বয়েস এখন সাড়ে এগারো বছর, সে সদ্য ঋতুমতী হয়েছে। নিতান্ত বালিকা বয়েসে যাদের বিবাহ হয়, তাদের দ্বিতীয় বিবাহ ও ফুলশয্যার রীতি আছে ঠাকুর পরিবারে। কিন্তু এই অপদার্থ জামাইটিকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার ইচ্ছে নেই রবীন্দ্রনাথের। তা ছাড়া এসব করা মানেই তো আবার খরচের ধাক্কা! তবু রুগণ স্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক আছে, ব্যবস্থা করা যাবে।
মৃণালিনী বললেন, মুঙ্গেরে বেলি আর শরৎকেও চিঠি লিখে দাও, ওরাও চলে আসুক। কতদিন ওদের দেখিনি। শিগগিরই তো পুজোর ছুটি পড়ে যাবে।
এখন বাড়ি আবার লোকজনে ভরে যাবে, সব সময় হইহল্লা হবে। এ দেশের মানুষ রুগিকেও শান্তিতে একলা থাকতে দেয় না, তার ঘরে বসেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে। এসব রবীন্দ্রনাথের পছন্দ নয়। সত্যেন্দ্র-রেণুকার ফুলশয্যার উদ্যোগ চলতে লাগল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সে সময় এখানে থাকতে চাইলেন না। তাঁর মন ছটফটিয়ে উঠল। তিনি শান্তিনিকেতনে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু মৃণালিনীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়া সহজ নয়, তিনি স্বামীকে চক্ষু-ছাড়া করতে চান না।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, নাটোরের রাজা জগদীন্দ্র যাচ্ছেন শান্তিনিকেতনে। এ সময় কি আমার না গেলে চলে? অনেক দিন আগে থেকেই কথা দেওয়া আছে।
নাটোরের রাজা পারিবারিক বন্ধুই শুধু নন, এই ধরনের ধনী ব্যক্তিদের শান্তিনিকেতনের কর্মকাণ্ড দেখাতে পারলে অনেক রকম সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, মৃণালিনী জানেন।
শমীকে নিয়ে শান্তিনিকেতন চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ।
নাটোরের রাজা শান্তিনিকেতন সফর শেষ করে বিদায় নেওয়ার পরেও রবীন্দ্রনাথের ফেরা হল না। একবার এসে পড়লে অনেক কাজ, অনেক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। তার মনেও ওই ভিড়ের বাড়িতে ফেরার জন্য কোনও তাগিদ নেই। তবে একটা স্বস্তির ব্যাপার এই যে মুঙ্গের থেকে মাধুরীলতা এসে গেছে। সে যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনই কাজের মেয়ে। সে থাকতে তার অসুস্থ মায়ের সেবাযত্নের কোনও ত্রুটি হবে না।
টাকাপয়সার সমস্যা ছাড়াও এক-একটা এমন অদ্ভুত সমস্যা এসে পড়ে, যার সামাল দেওয়া কম কঠিন নয়। ছাত্রদের জন্য রান্না ও পরিবেশনের কাজে দুটি লোককে নিযুক্ত করা হয়েছে। পাঁচকটি ব্রাহ্মণ হলেও পরিবেশকটি ব্রাহ্মণ নয় বলে জানা গেছে। অব্রাহ্মণ পরিবেশকের হাতের ছোঁওয়া কি ব্রাহ্মণ ছাত্ররা খেতে পারে?
ঠাকুরবাড়িতে এসব শুচিবাই নেই। অব্রাহ্মণ শুধু নয়, অহিন্দুর হাতের রান্না খেতেও কেউ আপত্তি করেন না। বিলেতে গেলে কাঁদের হাতের রান্না খেতে হয়? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানি। একবার এখানে খ্রিস্টানি ভাবধারা প্রচারের অভিযোগ উঠেছিল। ব্রাহ্মদের আদর্শে নয়, সনাতন হিন্দু ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আদর্শে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। হিন্দু সমাজ যা মানে না, তেমন কিছু এখানে করতে গেলে ছাত্র পাওয়া দুর্ঘট হবে।
পরিবেশকটিকে বরখাস্ত করে এক ব্রাহ্মণকে খুঁজে আনা হল। অশিক্ষিত, অপরিচ্ছন্ন, কদাকার যাই হোক, ব্রাহ্মণ তো বটে!
এর পরের সমস্যা একজন অধ্যাপককে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিয়ম করেছেন যে প্রতিদিন ছাত্ররা অধ্যাপকদের প্রণাম করে পাঠ শুরু করবে। কিন্তু অন্যতম অধ্যাপক কুঞ্জলাল ঘোষ ব্রাহ্মণ নন, তাঁকেও কি ব্রাহ্মণ ছাত্ররা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে? হিন্দু সমাজে এ রীতি নেই। উপবীতধারী ব্রাহ্মণ বালকেরও পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন অনেক প্রবীণ অব্রাহ্মণ ব্যক্তি, কিন্তু একজন
অব্রাহ্মণ যতই জ্ঞানী বা গুণী হন, কোনও ব্রাহ্মণ তাঁর পা স্পর্শ করবে না।
তা হলে ছাত্ররা কি অন্য অধ্যাপকদের প্রণাম করবে, কুঞ্জলাল ঘোষকে বাদ দিয়ে? তা হতে পারে না। শেষ পর্যন্ত একটা সমাধানের পথ রবীন্দ্রনাথের মনে এল। কুঞ্জলাল ঘোষকে অধ্যাপনার দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত করা হলে তাঁর সঙ্গে ছাত্রদের আর গুরুশিষ্য সম্বন্ধ থাকবে না। তিনি খাওয়াদাওয়া ও অফিস পরিচালনার কাজ দেখবেন।
শান্তিনিকেতনে থেকে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর চিকিৎসার খবরাখবর নিচ্ছেন। কিন্তু ফেরা আর হচ্ছে না। এখানে নিরিবিলিতে তাঁর নিজের লেখার অনেক সুবিধে। বঙ্গদর্শনের জন্য অনেকগুলি রচনা লিখতে হয়। শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ফিরতে হল অন্য কারণে।
জগদীশচন্দ্র বসু পাশ্চাত্যে যশের মুকুট পরিধান করে দেশে ফিরছেন। চিঠির পর চিঠি লিখছেন কবিকে। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি উন্মুখ। এই বন্ধুর জন্যই প্রায় দু বছর ইওরোপে কাটিয়ে আসা তাঁর পক্ষে অনেকটা সম্ভব হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও তাঁর বন্ধুর কৃতিত্বে বিশেষ গর্বিত। জগদীশচন্দ্র হাওড়া স্টেশনে নেমেই কবিকে খুঁজবেন, সুতরাং রবীন্দ্রনাথকে তো যেতেই হবে।
মৃণালিনীর পেটের ব্যথা কিছুতেই কমছে না! পেটের অভ্যন্তরে যে কী ঘটছে, তা জানার তো কোনও উপায় নেই। এই ব্যথার জন্য ঘুমও আসে না। তাতে শরীর আরও বিশীর্ণ, মলিন হয়ে যাচ্ছে। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় কোনও কাজ হচ্ছে না দেখে রবীন্দ্রনাথ হোমিওপ্যাথ ডাক্তারদের ডাকলেন!
সত্যেন ঘরজামাই হিসেবে এ বাড়িতেই আস্তানা নিয়েছে। তার বাবুয়ানার শেষ নেই, তাকে মাসে দেড়শো টাকা হাতখরচ দিতে হয়, তা ছাড়াও যখন-তখন সে গাড়ি ভাড়া বাবদ আরও টাকা চেয়ে নেয়। এখন সে আবার একটা নতুন বায়না ধরেছে। ডাক্তারি শেখা তার হল না, সে একটা ওষুধের দোকান খুলতে চায়। একটা ডিসপেনসারি সাজাতে গেলে অন্তত দু হাজার টাকার দরকার, সে টাকাও দিতে হবে শ্বশুরকে।
তাড়াহুড়ো করে কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এখন তাঁকে তার ফলভোগ করতে হচ্ছে। ওইটুকু মেয়ে রেণুকা, সেও তার বাবার মনের অবস্থা বোঝে। সে সবসময় বিষণ্ণ হয়ে থাকে। তার স্বামীটি যে একটি অপোগণ্ড, বিলেতে শুধু শুধু গুচ্ছের টাকা খরচ করে এল, কাজের কাজ কিছুই শিখল না, তা নিয়ে বাড়ির লোকেরা আড়ালে আবডালে টিপ্পনী কাটে। কিছু কিছু রেণুকার কানে আসে, সে অপমান তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। শরীর এমনিতেই ভাল নয়, এর মধ্যে সে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। তার কাশির সঙ্গে একটু একটু রক্ত পড়ে।
বাবা কখনও পাশে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে রেণুকা হু হু করে কেঁদে ওঠে, মুখে কিছু বলে না। রবীন্দ্রনাথের বুক মুচড়ে ওঠে। এ মেয়েকে তিনি কী বলে সান্ত্বনা দেবেন? তাঁরও চোখ ভিজে আসে। সন্তান যেন নিজের আত্মারই একটা টুকরো। একটা বিশেষ টুকরো। মানুষ নিজে অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারে। কিন্তু সন্তানের কষ্ট দেখলে বুক একেবারে আথালি পাথালি করে। সবচেয়ে অসহায় লাগে যখন সেই কষ্ট দূর করার কোনও উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না।
ইচ্ছে থাকলেও কন্যার পাশে বেশিক্ষণ বসে থাকারও উপায় নেই। আজ জগদীশচন্দ্র এসে পৌঁছবেন।
দুবার তারিখ বদল হয়েছে বলে জগদীশচন্দ্রের আগমনবার্তা বেশি লোক জানতে পারেনি। তবু হাওড়া স্টেশনে শতাধিক লোক অপেক্ষমাণ। ট্রেন কিছুটা বিলম্বে আসছে। ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন রবীন্দ্রনাথ। কাছেই পুরোদস্তুর সাহেবি পোশাক রা এক বিশাল চেহারার ব্যক্তি একা একা চুরুট টানছেন, বয়েস অন্তত সত্তরের কাছাকাছি হবে, মাথার চুল সব সাদা, মুখের চামড়ায়। অনেক ভাঁজ, হাতে একটা ছড়ি। মানুষটিকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল অথচ ঠিক মনে করতে পারছেন না।
একবার ভদ্রলোক এদিকে মুখ ফেরালেন, দু জনের চোখাচোখি হল। তিনি নিজেই ছড়িতে ভর দিয়ে ঈষৎ পা টেনে টেনে এগিয়ে এসে বললেন, কবিবর যে! সংবাদ সব কুশল!
কণ্ঠস্বর শোনামাত্র রবীন্দ্রনাথ চিনতে পারলেন। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার! অনেককাল দেখা হয়নি। এর মধ্যে ওঁর মুখে বড় বেশি বার্ধক্যের ছাপ পড়ে গেছে! শরীরটিও যেন বেশ ক্লান্ত।
রবীন্দ্রনাথ নমস্কার জানিয়ে বললেন, আপনাকে অনেক দিন কোনও সভা-সমিতিতে দেখা যায়নি।
মহেন্দ্রলাল বললেন, শরীর আর বইছে না। কাজের নেশায় দিনরাত্তিরের খেয়াল থাকত না। এখন তার দাম দিতে হচ্ছে। আজ না এসে পারলাম না। তোমার কথা জানি, অবলা চিঠি লিখে জানিয়েছে, দুঃসময়ে তুমি ওদের প্রচুর সাহায্য করেছ, অনেক টাকাপয়সা জোগাড় করে দিয়েছ। ত্রিপুরার রাজাটিকে ধরে তুমি এবার জগদীশের জন্য একটা লেবরেটরি বানিয়ে দাও। এখানে বসে কাজ করবে, বিশ্বের বৈজ্ঞানিকরা এখানে আসবে। ২০ রবীন্দ্রনাথ বললেন, আমি অবশ্যই চেষ্টা করব। তবে আমার একার চেষ্টায় তো হবে না। কাজ
মহেন্দ্রলাল বললেন, ত্রিপুরার আগের মহারাজকে আমি চিনতাম। বেশ রগুড়ে মানুষ ছিলেন। তাঁর ছেলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় নেই। শোনো, একটা মজার কথা বলি। আমি কবিতা টবিতা বিশেষ পড়িনি, সময় পেতাম না। জগদীশ নিজে বৈজ্ঞানিক হয়ে কী করে কাব্য-সাহিত্য পড়ার সময় পায় কে জানে! তোমার লেখাও আমি আগে পড়িনি। এর মধ্যে আমার এক চেলা একদিন এসে বললেন, স্যার, রবি ঠাকুরের এই কবিতাটি পড়ে দেখুন। বড় বড় অক্ষরে লিখে এই কবিতাটা সব কলেজের ক্লাসরুমগুলিতে টাঙিয়ে রাখা উচিত। আমি বলোম, হ্যাঁ হে, কবিতা পড়তে বলছ, বোঝা যাবে তো? এখনকার বেশির ভাগ কবিতারই তো মর্ম বোঝা দায়!
রবীন্দ্রনাথ বললেন, আপনার মতন ব্যস্ত লোককে আবার বিরক্ত করা কেন?
ভুরু তুলে মহেন্দ্রলাল বললেন, তোমার সে কবিতা শুধু যে বোঝা গেছে তাই নয়, দুবার পড়ে মুখস্থ হয়ে গেছে। বড় খাসা কবিতা! খুবই উপযুক্ত কথা লিখেছ। আমার মুখস্থ শুনবে?
পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে ও
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চির শিশু করে আর রাখিও না ধরে।…
একটু থেমে তিনি আবার বললেন,
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিও না ভালো ছেলে করে…
তারপর কী যেন? না, না, তুমি বোলো না। আমার ঠিক মনে পড়বে। ছাত্র বয়েসে গড়গড়িয়ে শেক্সপীয়র মুখস্থ বলতে পারতাম!
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করো
নি।
শেষ লাইনটি দুবার বলে তিনি অট্টহাস্য করে উঠলেন। রবীন্দ্রনাথের কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি! বড় খাঁটি কথা লিখেছ। গৃহছাড়া, লক্ষ্মীছাড়া না হলে এ পোড়ার জাতের কোনও আশা নেই। আহা গো, নরেন ছেলেটা মারা গেল। ওই যে বিবেকানন্দ স্বামী। তার কী চিকিৎসা হয়েছিল কে জানে!
রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তাঁকে দেখতে যাননি?
মহেন্দ্রলাল বললেন, নাঃ, আমি চিকিৎসা করা ছেড়ে দিয়েছি। মানুষের রোগভোগ আর দেখতে পারি না। চোখে জল এসে যায়। তার মানে বুঝলে, চোখটা নষ্ট হয়ে গেছে। এই চোখ নিয়ে ডাক্তারি করা যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ভাবছিলেন, তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য হোমিওপ্যাথির শ্রেষ্ঠ ডাক্তার এই মহেন্দ্রলালকে একবার ডাকবেন, কিন্তু তা আর হবে না।
ট্রেন এসে গেছে, ঝমঝম শব্দে কাঁপছে প্ল্যাটফর্ম। মহেন্দ্রলাল বললেন, কবি, এরকম আরও লেখো। দেশের মানুষকে জাগাও!
অনেকেই ফুলের তোড়া ও মালা নিয়ে এসেছে। তারা আগে ধেয়ে গেল। জগদীশচন্দ্র হাত জোড় করে স্মিতমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। মহেন্দ্রলাল ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে জগদীশকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বেঁচে থাকো, আরও অনেকদিন বেঁচে থাকো, জগদীশ। তুমি আমার স্বপ্ন সার্থক করেছ!
তারপর অবলার থুতনি ধরে আদর করে বললেন, খুকি, তুই ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়েছিলি বলে একদিন কত বকেছিলাম মনে আছে? আজ বুঝেছি, সে তোর আত্মত্যাগ। তোর মতন যোগ্য সহধর্মিণী না পেলে জগদীশ এত বড় হতে পারত না!
অবলা নিচু হয়ে মহেন্দ্রলালকে প্রণাম করে বললেন, কাকা, আপনার মুখ দিয়ে বকুনি শুনতেই বেশি ভাল লাগে।
জগদীশচন্দ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজছিলেন। দেখতে পেয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। রবীন্দ্রনাথ মুখে বেশি উচ্ছ্বাস জানাতে পারেন না, স্মিতহাস্যে কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন।
জগদীশচন্দ্র তাঁর অন্য অনুরাগীদের সরিয়ে রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে মুখ এনে বললেন, বন্ধু, নতুন গল্প লিখেছ তো? আগেই ফরমায়েশ পাঠিয়েছিলাম। তোমার কাছ থেকে লেখা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।
এতদিন পর জগদীশচন্দ্র ফিরেছেন, এখন প্রতিদিনই খাওয়া-দাওয়া, অন্তরঙ্গ গল্প, সংবর্ধনা চলতে লাগল। সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথের ডাক পড়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে দুজন রোগিণী। মাধুরীলতা স্বামীর সঙ্গে ফিরে গেছে মুঙ্গেরে। রথী সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ, তার সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগবে কেন? সে এখন একা একা বেরুতে পারে, সারা কলকাতা ঘুরে বেড়ায়। শমীকে সারা বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায় না। সে কোনও নিরিবিলি কোণ খুঁজে কিংবা ছাদে গিয়ে বই খুলে বসে থাকে। মাঝে মাঝে গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবে। এই বয়েসের এমন ভাবুক ও পড়য়া বালক খুব কমই দেখা যায়। আর মীরা তো খুবই ছোট, তাকেই বা দেখে কে! সে মায়ের ঘরে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, মা তাকে আদর করতে পারেন না। রেণুকার ঘরে গেলেও তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই বালিকাটি কারুর নাকারুর সঙ্গ চায়, কিন্তু তার দিকে মনোযোগ দেওয়ার কারুর সময় নেই।
সংসার ও বাইরের পৃথিবীর মধ্যে একটা দোটানায় পড়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ইচ্ছে করে স্ত্রীর পাশে বসে থাকতে, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু বাইরে থেকে এমন কিছু কিছু আহ্বান আসে, যা প্রত্যাখ্যান করা যায় না। রোগ পুরনো হয়ে গেলে তার গুরুত্ব কমে আসে। মৃণালিনী শয্যাশায়িনী, তাঁর শিয়রের কাছে রবীন্দ্রনাথকে সর্বক্ষণ বসে থাকতে হবে কেন? পাখার বাতাস করার জন্য কি অন্য লোক পাওয়া যায় না?
রবীন্দ্রনাথকে প্রায় প্রতিদিনই বাইরে বেরুতে হয়। বঙ্গদর্শন সম্পাদনার কাজ আছে। তাঁর নিজের কবিতাসংগ্রহ ছাপা হচ্ছে, প্রতিটি ফর্মা নিজে দেখে না দিলে তাঁর স্বস্তি হয় না। জগদীশচন্দ্র রোজই রবীন্দ্রনাথকে দেখতে চান। তাঁকে যেসব বাড়িতে বা প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, সেসব জায়গায় রবীন্দ্রনাথেরও সঙ্গে থাকা চাই। জগদীশচন্দ্রকে শোনাবার জন্য ছোটগল্পও ভাবতে হয় তাঁকে। মৃণালিনীর সেবার জন্য তাই একজন নার্স ও দাইকে নিযুক্ত করা হয়েছে।
বেরুবার সময় মৃণালিনীর পাশে বসে দুটো-একটা কথা বলে যান, ফিরে এসেই আবার স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করেন। হোমিওপ্যাথিক ওষুধেও বিশেষ ফল দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জেদ ধরে আছেন, অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের বিষগুলো আর স্ত্রীকে খাওয়াবেন না। ই এক বিকেলে রবীন্দ্রনাথ এলেন মৃণালিনীর ঘরে। শরীরটা একেবারে শুকিয়ে গেছে মৃণালিনীর, কণ্ঠার হাড় প্রকট, মুখোনি রক্তশূন্য, নির্জীবের মতন চিত হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়। রাতের পর রাত তাঁর ঘুম আসে না। পেটের যন্ত্রণার জন্য খেতেও ইচ্ছে করে না কিছু। রবীন্দ্রনাথ শিয়রের কাছে এসে পত্নীর একটি হাত মুঠোয় ভরে বললেন, চোখ চেয়ে থাকো কেন সর্বক্ষণ? চোখ বুজে থাকলে ঘুম আসতে পারে।
মৃণালিনী তবু স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে। আস্তে আস্তে তাঁর চোখ জলে ভরে গেল।
রবীন্দ্রনাথ এক আঙুল দিয়ে মুছে দিলেন সেই অণু।
মৃণালিনী ধীর স্বরে বললেন, তুমি শমীকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিলে? আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলে না?
রবীন্দ্রনাথ বললেন, স্কুল খুলে গেছে, ওর এখানে পড়াশুনোর সুবিধে হচ্ছিল না। যাওয়ার সময় তোমার সঙ্গে দেখা করে গেছে, দুবার তোমাকে ডেকেছিল, তুমি শুনতে পাওনি। তুমি তখন একটু ঘোরের মধ্যে ছিলে, তাই বেশি ডাকাডাকি করিনি।
মৃণালিনী বললেন, শমী কখনও আমাকে ছেড়ে থাকেনি। ও শান্তিনিকেতনে কী করে একা একা থাকবে?
রবীন্দ্রনাথ বললেন, একা কেন? ওখানে ওর বয়েসী আরও ছাত্র আছে, তারা যেমন থাকে, তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে শমী।
মৃণালিনী বললেন, আমি চলে যাব। শমীর সঙ্গে আর দেখা হবে না?
রবীন্দ্রনাথ বললেন, বালাই ষাট। ও কথা বলছ কেন? তুমি এবার ভাল হয়ে উঠবে। আমরা সবাই মিলে কোনও পাহাড়ে বেড়াতে যাব বরং! তাতে তোমার শরীর সারবে। এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করে দেখো না।
মৃণালিনী পাশ ফিরলেন। বেরিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ।
ফিরলেন রাত নটার মধ্যেই। তখনই মৃণালিনীর ঘরে এসে দেখলেন মৃণালিনী আগেরই মতন চোখ খুলে শুয়ে আছেন। একজন নার্স পাশের টুলে বসে হাতপাখায় বাতাস করছে। কার্তিক পেরিয়ে অগ্রহায়ণ মাস এসে গেল, তবু গরম কমার নাম নেই। এ বছর কি শীত পড়বেই না? পাশেই গগনেন্দ্র বাড়ি তুলেছেন, তাই এদিককার ঘরগুলিতে বাতাসও আসে না।
নার্সকে সরে যাবার ইঙ্গিত করে রবীন্দ্রনাথ নিজে টুলে বসে হাতপাখাঁটি তুলে নিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, আজও ঘুম এল না?
মৃণালিনী উত্তর দিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, খেয়েছ কিছু? একটুখানি গরম দুধ দিতে বলব।
মৃণালিনী শুধু চেয়ে রইলেন এক দৃষ্টে। আবার দু চক্ষু জলে ভরে এল।
রবীন্দ্রনাথ ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, কষ্ট হচ্ছে কিছু? বেড প্যান দিতে হবে?
মৃণালিনী কোনও কথারই উত্তর দিচ্ছেন না। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন, ওঁর অভিমান হয়েছে। তিনি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, শমীকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করব। শমী পারে, তুমিই ওকে ছেড়ে থাকতে পারো না। ছেলেমেয়েদের তত বেশিদিন ধরে রাখতে পারি না আমরা, তারা দূরে সরে যাবেই।
মৃণালিনী তবু নিঃশব্দ, নিষ্পলক।
রবীন্দ্রনাথ কিছুটা অনুতপ্ত স্বরে বললেন, জানি, আমার সম্পর্কে তোমার অনেক অনুযোগ আছে। পুরোপুরি স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে পারিনি সব সময়, তোমাদের জন্য সময় দিতে পারিনি। আমার অনেক ত্রুটি আছে। ওগো, আমি ক্ষমা চাইছি। এবার থেকে দেখো, তুমি সেরে ওঠো, আমি আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না—
মৃণালিনী কিছুতেই সাড়াশব্দ করছেন না দেখে রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, ওঁর অভিমান খুব গভীর। শমীকে পাঠিয়ে দেওয়া খুবই ভুল হয়েছে।
তিনি উঠে গিয়ে রথীকে ডেকে বললেন, তোর মায়ের পাশে গিয়ে একটু বস তো।
রথী এসে ডাকল, মা—
ছেলের ডাকে সাড়া দিলেন না মৃণালিনী। তাঁর দুই চোখ দিয়ে শুধু বয়ে যাচ্ছে জলের ধারা।
অবিলম্বেই বোঝা গেল, মৃণালিনীর বাক্ রোধ হয়েছে।
ডাক্তারদের ডাকার জন্য ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। তারপর সারা রাত আর সারা দিন রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর খাটের পাশ ছেড়ে নড়লেন না। বারবার মনে হচ্ছে, বুক ভরা অভিমানের জন্যই কি মৃণালিনীর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল?
অনেক দিন পর ইন্দিরা আর প্রমথ এসেছে এ বাড়িতে। মৃণালিনীর অবস্থা দেখে আশঙ্কার ছায়া ঘনিয়ে এসেছে সবার মুখে। এ বাড়ির অনেকেরই হোমিওপ্যাথিতে তেমন বিশ্বাস নেই। ইন্দিরাও বলল, রবিকা, এই অবস্থায় তো হোমিওপ্যাথিতে কাজ হয় না। একজন অ্যালোপ্যাথকে ডাকবে না।
রবীন্দ্রনাথ দুদিকে মাথা নাড়লেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা মধ্য পথে থামিয়ে দেওয়া উচিত নয়। ধৈর্য ধরতে হয়।
শমীকে আনানো হয়েছে শান্তিনিকেতন থেকে। চার ছেলেমেয়েকে এক সময় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল মায়ের খাট ঘিরে। শুধু মাধুরীলতা রয়েছে মুঙ্গেরে।
মৃণালিনী তাদের সম্ভাষণ করলেন না। তাঁর মুখ দিয়ে আর একটি শব্দও বেরুলো না। শুধু চেয়ে রইলেন অপলক। আস্তে আস্তে তাঁর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
শয্যাপার্শ্ব ছেড়ে এবার উঠে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। কারুকে কিছু না বলে উঠে গেলেন ছাদে। কেউ যাতে ডাকতে না আসে সে জন্য দরজা বন্ধ করে দিলেন। চেয়ে রইলেন তারা ভরা আকাশের দিকে। মেঘশূন্য, অমলিন, জ্যোৎস্নাময় আকাশ, ঝিকমিক করছে অজস্র গ্রহ-নক্ষত্রপুঞ্জ, সেদিকে
তাকিয়ে থাকলে আর চোখ ফেরানো যায় না।