পরদিন সকালেও তেমন কিছু বোঝা যায় নি, দ্বিপ্রহরের পর রোমহর্ষক সব সংবাদ আসতে লাগলো। ঝড় প্রশমিত হলেও বৃষ্টির বিরাম নেই, তারই মধ্যে লোকজন এসে পৌঁছতে লাগলো এ গৃহে। এক একজনের মুখে এক এক রকম চমকপ্ৰদ বিবরণ।
সত্যিই বুঝি এক প্রলয়ের মহড়া হয়ে গেছে গত রাত্রে এই শহরের বুকে। যে-ই আসে, সে-ই বলে, কী কাণ্ড গো বাবু, একটাও বুঝি বাড়ি আস্ত নেইকো! রাস্তাঘাট কিছুই চেনা যায় না, শতেক বছরের পুরোনো গোচও উপড়ে পড়েচে। অতবড় বাড়ি মিত্তিরদের, যেন দৈত্যে তুলে নিয়ে গ্যাচে, সেখেনে এখন ফাঁকা মাঠ। একজন বললো, আমি কাল রেতের বেলা আকাশ দিয়ে একটা নৌকো উড়ে যেতে দেকিচি, হাঁ গো, ঝুটো কতা নয়, সত্যি বলছি–।
স্মরণকালের মধ্যে এরকম ঝড় এ দেশে আঘাত হানে নি। গুজব ও ঘটনা, সত্যমিথ্যে রটনার মধ্য থেকে প্রকৃত চিত্রটি ফুটে উঠতে লাগলো ক্ৰমে ক্ৰমে। কলকাতা শহরের শত শত গৃহ ভূপাতিত, মৃতের সংখ্যা সঠিক কত কেউ জানে না এখনো, গোলপাতা, খড় ও টিনের চালের ঘরগুলির অধিকাংশেরই চাল উড়ে গেছে, পান্তির মাঠে মারে পড়ে আছে বহু গরু-মহিষ, আমেনি ঘটের জাহাজবন্দরে এমনই ধ্বংস কাণ্ড হয়েছে যে, একটি জাহাজও অক্ষত নেই। আকাশে নৌকো উড়ে যাবার কাহিনীও অলীক নয়, বাগবাজারের ঘাট থেকে একটি ডিঙ্গি নৌকো উড়তে উড়তে গিয়ে উল্টোডিঙ্গিতে পড়ে সে স্থানটির নাম সার্থক হয়েছে। আকাশ পথে ডালপালা শিকড়সুদ্ধ উড়ন্ত বৃক্ষেরও অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আছে।
ভদ্রশ্রেণীর ব্যক্তিরা কাল সন্ধ্যার পর থেকে আর কেউ পথে বার হয়নি, কিন্তু দাস-দাসী, ফিরিওয়ালা এবং নিত্য রোজগোরেদের তো উপায় নেই, তারা আজও বৃষ্টি মাথায় করে ঘোরাঘুরি করছে। তাদের মুখ থেকেই শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকার সংবাদ।
এক আনাজওয়ালী স্ত্রীলোক এসে হাউ হাউ করে কেঁদে পড়লো। তার চার বছরের খোকাটিকে পাওয়া যাচ্ছে না, সর্বনেশে ঝড় খোকাটিকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঝটিকার বেগ কত প্রবল হলে মানুষ পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে, তা চিন্তা করে সকলে তাজ্জব। এমন আর কখনো শোনা যায়নি। তার কান্না কেউ থামাতে পারে না। এছাড়া দুধওয়ালা, ছোলাওয়ালা, তেলের কলু, বাজারের মেছুনি ইত্যাদি সকলেরই বাড়ি-ঘর নিশ্চিহ্ন, সকলেই দুঃখের কথা বলতে চায়, কিন্তু কে কার কথা শুনবে!
নবীনকুমারদের প্রাসাদটি তিন পুরুষের, বেশ মজবুতভাবে গড়া। তাই বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। একটি মহলের দেয়াল ভেঙে পড়েছে, পিছন-বাড়ির ভৃত্যদের গোলপাতার ঘরগুলি নিশ্চিহ্ন। গঙ্গানারায়ণ বড় বাঁচা বেঁচে গেছে গত রাত্রে, ঐ দুর্যোগের মধ্যে অতখানি পথ এসে… সে খুবই ঝুঁকি নিয়েছিল। অবশ্য ঝড় সবচেয়ে বেশী রুদ্ররূপ ধারণ করেছিল মধ্যরাত্রির পর।
নবীনকুমারের দান-খ্যাতি অনেকদূর পৌঁছেছে বলে বহু বিপন্ন মানুষ এসেছে সিংহ-ভবনে সাহায্য প্রার্থনা করতে; এক সঙ্গে অনেকের আর্ত-আকুল প্রার্থনায় কারুর কথাই ঠিক মতন বুঝতে পারা যায় না। বার, মহলের দ্বিতলের একটি কক্ষের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নবীনকুমার চেয়ে আছে সেই জনতার দিকে। সদরের ঠিক বিপরীত দিকে ছিল পুরোনো আমলের আস্তাবলাখানা, নবীনকুমার চেয়ে আছে বটে, কিন্তু দেখছে কিনা সন্দেহ, তার দৃষ্টি উদাসীন। একভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্ৰায় এক ঘণ্টা কিন্তু কোনো রকম প্রতিক্রিয়া নেই। তাদের বাড়ির সদরের ঠিক বিপরীত দিকে ছিল পুরোনো আমলের আস্তাবলখানা, নবীনকুমারের পিতামহ কিছুদিন কোম্পানির ফৌজে ঘোড়ার জোগানদারের কাজ করেছিলেন। তারপর সেখানে কয়েকটি ছোট ছোট ঘর নির্মিত হয়ে রাজমিস্তিারিদের একটি আস্তানা গড়ে উঠেছিল। সেই সব কটি ঘরের ওপর পড়ে আছে বিশাল একটি আম গাছ। ঐ আম গাছটিকে নবীনকুমার তার জন্ম থেকে দেখছে। তার পিতামহের আমলের গাছ, আর ওকে দেখা যাবে না।
এক সময় গঙ্গানারায়ণ এসে বললো, ছোটকু তুই এখেনে? আর আমি তোকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচি।
নবীনকুমার জ্যেষ্ঠভ্রাতার দিকে ফিরে দাঁড়ালো, কোনো কথা বললো না।
গঙ্গানারায়ণ বললো, এদের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে তো আর কান পাতা যায় না! কী করা যায় বল তো?
নবীনকুমার গঙ্গানারায়ণের চোখে চোখ রেখে এখনো নিঃশব্দ রইলো।
—তুই কী বলিস? এদের কিচু দেওয়া হবে?
এবার নবীনকুমার বললো, সে তুমি যা ভালো বুঝবে!
—তবু তোর একটা মত না নিয়ে তো কিচু কত্তে পারি না!
—আমার আর মত কি?
—এরা এসে কেঁদে পড়েচে, কিচু না দিয়ে চক্ষু বুজে রইলে এ বাড়ির সুনাম হানি হয়। জনা তিরিশ-চল্লিশেক এসেচে, আমি বলি কী, ওদের দশটা করে টাকা অন্তত দিয়ে দেওয়া হোক।
–বেশ তো।
—তুই মত দিচ্চিস তো? তা হলে এখুনি দেওয়া শুরু করি?
নবীনকুমার ঘাড় হেলন করলো।
গঙ্গানারায়ণ যেতে গিয়েও ফিরে এসে বললো, ও, আর একটা কতা! কোচোয়ান কলিমুদ্দিন সাঙ্ঘাতিক খবর এনেচে! ও বাড়িতে নাকি ভীষণ অবস্থা, ছাত ভেঙে পড়েচে এক দিকে…
–ও বাড়ি?
—বিন্দুদের বাড়ি…মানে, জ্যাঠাবাবুদের বাড়ি! একবার তো সেখেনে যেতে হয়?
—তুমি যাবে? যাও!
—তুই যাবি না?
–নাঃ!
—সেটা কি ভালো দেকায়? জ্যাঠাবাবু ভাববেন, এই বিপদের সময় আমরা কেউ গেলুম না।
—লোকজন পাঠিয়ে দাও, সত্যিকারের কতটা বিপদ হয়েচে, জানো আগে!
—ঠিক বলিচিস। তাই করা যাক বরং! গঙ্গানারায়ণ এবার ব্যস্তভাবে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই নবীনকুমার বললো, দাদা, শোনো, তুমি যখন এই লোকগুলোকে কিচু সাহায্য কত্তেই চাইচো, তখন দশ টাকা দিও না!
—দশ টাকা দেবো না? তবে কত দোবো, পাঁচ?
—অন্তত এক শো টাকা করে দাও!
—এ—ক—শো? তুই বলিস কি? আরও কতজন আসবে তার ঠিক আচে? পাঁচ টাকায় ঘরের ছাউনি হয়ে যায়। আর পাঁচ টাকায় মাসখানেকের খোরাকি
—তুমি আমাদের বাড়ির সুনামের কতা বলছিলে, একশো টাকা না দিলে কি সে সুনাম থাকে?
—খবর পেয়ে যদি আরও দলে দলে লোক ছুটে আসে?
—সবাইকেই দিও। কেউ যেন ফিরে না যায়।
কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রস্তাবে গঙ্গানারায়ণ একেবারে বিমূঢ় হয়ে গেল। এ ছেলেটা বলে কী! এ রকম দানছত্র খোলা কি সম্ভব? একশো টাকা হাতে হাতে পাওয়া যাচ্ছে শুনলে শহরসুদ্ধ লোক ধেয়ে আসবে না?
—তুই কি ঠিক মতন ভেবে বলচিস, ছোটকু।
—দাদা, তুমি আমার মত জিজ্ঞেস করলে কেন? তুমি তো নিজের ইচ্ছে মতন যা খুশী করতে পারতেই!
—তবিলে যদি অত টাকা না থাকে তখন?
—যতক্ষণ কুলোয়, ততক্ষণ দিও!
এর ওপর আর কথা হয় না। গঙ্গানারায়ণ আর দ্বিরুক্তি না করে চলে গেল।
এ যেন টাকা পয়সা হরির লুঠ দেবার মতন। অকারণে অপব্যয়। যে লোকগুলি সাহায্য চাইতে এসেছে, তারাও এতটা আশা করে না। এদের মধ্যে অনেকেই এক সঙ্গে একশো টাকা চক্ষেই দেখেনি কখনো! যারা মাস মাইনের কাজ করে, তাদের বেতন বড় জোর পাঁচ দশ টাকা, আনাজপাতির ব্যবসা করেও কেউ মাসে পনেরো বিশ টাকার বেশী মুনাফা করতে পারে না।
একটু বাদে গঙ্গানারায়ণ আবার ফিরে এসে বললো, টাকা পয়সা বিলির কাজটা তুই নিবি, ছোটকু?
নবীনকুমারের সে ব্যাপারে কোনো উৎসাহ নেই। সে সরাসরি বলে দিল, গঙ্গানারায়ণের সময়াভাব হলে কর্মচারীদের দিয়ে ও কাজ চালানো হোক।
এত টাকার ব্যাপার, কোনো কর্মচারীকে বিশ্বাস করা যায়? গঙ্গানারায়ণ প্রথমেই প্রার্থীদের সকলকে দেউড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে লৌহ দ্বার বন্ধ করে দিল। তারপর স্বহস্তে সে একটি খেরো খাতায় লিখে নিল সকলের নাম ঠিকানা। সেই নামের পাশে বসিয়ে নিল প্রত্যেকের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের টিপ ছাপ। এবার সে দিবাকরকে বসিয়ে দিল বিলি-বন্দোবস্তের ভার দিয়ে। টাকা পয়সা নাড়াচাড়া করতে গঙ্গানারায়ণ নিজেও পছন্দ করে না। সে জানে, দিবাকর এই লোকগুলির কাছ থেকে দস্তুরি আদায় করবে, সেই জন্য দুলালকে দাঁড় করিয়ে দিল পাশে। এবং তার কাছে নির্দেশ দেওয়া রইলো, আর কোনো লোককে যেন দেউড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়।
তারপর সেই বৃষ্টির মধ্যেই সে চলে গেল বিধুশেখরের বাড়ি।
সেখানে ক্ষতি হয়েছে খুবই, কিন্তু বাড়ির কেউ আহত বা নিহত হয়নি। গোয়াল ঘরের ওপর গাছ পড়ে দুটি দুধেলা গাভী মারা গেছে। বিধুশেখর যে কক্ষে শয়ন করেছিলেন, ছাদ ভেঙে পড়েছে তারই পাশের ঘরে। গঙ্গানারায়ণ দেখে চমৎকৃত হয়ে গেল যে অশক্ত শরীর নিয়ে বিধুশেখর আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং স্বয়ং তদারক করছেন সব কিছু। বিশেষ বিচলিতও মনে হলো না তাঁকে। গঙ্গানারায়ণের দিকে একচক্ষু দিয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাড়ির খবর কী? আমি নিজেই যাচ্চিলুম একটু পরে—।
পরদিন সংবাদপত্রগুলিতে ফলাও করে প্রকাশিত হলো এই দুর্যোগের বিবরণ। ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ যে কত, তার ইয়ত্তা নেই। ইংরেজি সংবাদপত্রগুলিতে শুধু সাহেব পাড়ার ধবংসচিত্রই ছাপা হয়েছে, কোথায় কোন সাহেবের বাড়ির বাগান নষ্ট হয়েছে, কতগুলি জাহাজ ড়ুবি হয়েছে, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে কত, সেইসব কথাই সাত কহন। যেন এ দেশটি সাহেবদেরই। নেটিভদের বাড়ি ঝড়ে উড়ে গেল কিংবা কয়েক শো মানুষের অপঘাত মৃত্যু হলো, তাতে কিছু যায় আসে না।
বাংলা মাসিক-সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলিও অতি দ্রুত বিশেষ সংস্করণ বার করলে, কিন্তু শুধু হা-হুতাশে ভরা। ইংরেজদের মতন রিপোটিং-এর ধারায় তারা রপ্ত নয়, পরিসংখ্যান কিংবা প্ৰত্যক্ষদশীর বিবরণ দেওয়ার বদলে তারা শুধু উচ্ছ্বাস প্রকাশেই বেশী পারঙ্গম। দু-একটি পত্রিকা আবার মুদ্রিত করেছে। জ্যোতিষীদের ভাষণ; আমরা পূর্বেই তো কহিয়াছিলাম যে ইং ৬৪ সনে এক প্রলয়ংকরী ঝঞ্ঝাবাত আসিবে তাহাতে মানুষ-গবাদি পশু যে কত প্ৰাণ হারাইবে তাহার সীমা পরিসীমা নাই-এ বৎসরে দুঃসময়ের করাল ছায়া ঘনাইয়াছে এই জাতির ভাগ্যাকাশে-শনি বক্রী হইয়াছেন, অশ্লেষা ও মঘার যোগাযোগে…আমরা পূর্বেই কহিয়াছিলাম যে এইসব কলির পাঁচ পোয়া পূৰ্ণ হইবার লক্ষণ…
অসীম বিরক্তিতে সব পত্রিকাগুলি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল নবীনকুমার।
সে পরিদর্শক নামে ভূতপূর্ব দৈনিক সংবাদপত্রের ভূতপূর্ব সম্পাদক। জেগে উঠেছে তার ভিতরের সাংবাদিক চরিত্রটি। এখন পরিদর্শক পত্রিকা চালু থাকলে সে দেখিয়ে দিত রিপোটিং কাকে বলে। কিন্তু এই পোড়া দেশ তার পত্রিকা পছন্দ করলো না, কেউ গ্ৰহণ করলো না। ঐ পত্রিকার জন্য সে কত অর্থ বায় করেছে বলে সকলে তাকে মনে করে নির্বোধ। চলে। কিন এই সব পত্ৰিকা! এরা সকলেই হয় সাহেবদের পা-চাটা অথবা নিয়তিবাদী!
তার মনে পড়লো হরিশের কথা। শহরবাসীর এই দুঃসময়ে হরিশের লেখনীর কত প্রয়োজন ছিল। কেউ হরিশের শূন্য স্থান পূর্ণ করতে এলো না। হিন্দু পেট্রিয়ট এখনো চলছে, নবীনকুমারই তার স্বত্বাধিকারী, কিন্তু সে নিজে কিছু আর দেখে না। মধুসূদন ইওরোপে চলে যাওয়ার পর কৃষ্ণদাস পালই ঐ পত্রিকার পুরো দায়িত্ব নিয়েছে।
কয়েক মাস নবীনকুমারের মনে যে ক্লৈব্য জন্মেছিল এই ঝড়ে যেন তা উড়িয়ে নিয়ে গেল। দিনের পর দিন সে নিজের পালঙ্কে শুধু শুয়ে থেকেছে, কারুর সঙ্গে বাক্য বিনিময় করতে চায়নি। বসত বাটিতেই মদ্য পান চালু করে দিয়েছিল পুরোপুরি, যেন জীবন সম্পর্কে তার আর কোনো আগ্রহ নেই।
আবার সে জেগে উঠলো। বেলা দশটায় সে হাঁক দিয়ে বলল, দুলাল! গাড়ি জুততে বল!
দুলাল জানালো যে, এখনো পথঘাটে গাড়ি চালাবার কোনো উপায় নেই। বৃষ্টি প্রশমিত হয়েছে বটে, কিন্তু সব পথই ভাঙা বাড়ি আর উৎপাটিত বৃক্ষে পরিপূর্ণ। সে নিজে অনেকখানি ঘুরে দেখে এসেছে।
নবীনকুমার বললো, বেশ, আমি তবে পায়ে হেঁটেই বেরুবো। তুই তৈরি হয়ে নে!
দুলাল সভয়ে জিজ্ঞেস করলো, এমন দিনে কোতায় যাবেন, ছোটবাবু? নবীনকুমার বললো, যাবো বরানগরে। কাজ কম্মো কত্তে হবে না? সব কিছু দিনের পর দিন ফেলে রাখলে চলবে?
—বরানগর? পায়ে হেঁটে?
—কেন? যাওয়া যাবে না? কেউ যাচ্ছে না? সবাই কি ঘরের মধ্যে সেঁদিয়ে বসে আচে?
যাওয়া যাবে না কেন, অনেকেই যায়। কিন্তু এ বাড়ির কোনো মানুষ কোনোদিন দিবাকালে পায়ে হেঁটে বেরিয়োচে নাকি? জোড়াসাঁকো থেকে বরানগর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাবেন ত পথের লোকজন চক্ষু কপালে তুলে বলবে না, ঐ যাচ্চেন রামকমল সিংগীর ছেলে নবীনকুমার সিংগী! এই জলকাদা আর আদাড় পগারের মধ্য দিয়ে উনি হেঁটে হেঁটে যাচ্চেন কি গো, বৈরিগী হয়েচেন নাকি?
কারুর নিষেধই গ্রাহ্য করলো না। নবীনকুমার। তার চোখ-মুখের চেহারাই সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সে আবার আগেকার মতন জেদী ও চঞ্চল যুবা। ধুতিতে মালকোঁচা মেরে নিল, তার ওপর সাধারণ একটি কুতা, হাতে ছড়ি, পায়ে কালো বানিস করা পাম্প শু। নিচে নেমে এসে সে দুলালকে বললে, চ!
লোকের মুখে শোনা কিংবা সংবাদপত্রের বিবরণ পাঠের সঙ্গেও চাক্ষুষ দেখার অনেক তফাত! যতটা সে কল্পনা করেছিল, ধ্বংসের রূপটি তার চেয়েও ভয়াবহ। একটি গৃহও বুঝি অক্ষত নেই। একটি বৃক্ষও হয়তো পুরোপুরি অটুট নয়। পথ চলা সত্যিই দুষ্কর। অতি প্রয়োজনে কোনো কোনো ভদ্র গৃহস্থ পাল্কী নিয়ে বার হয়েছিল, এরকম পথ দিয়ে চলা পাল্কী বেহারাদেরও অসাধ্য, মাঝপথে তারা সওয়ারি নামিয়ে দিয়েছে।
পথ পরিষ্কার করা কিংবা আর্ত বিপন্নদের সাহায্য করার কোনো উদ্যোগই নেই সরকারের। কিংবা কে জানে, যাবতীয় উদ্ধারকার্য বুঝি চলছে সাহেব-পল্লীগুলিতে, নেটিভ টাউন বিষয়ে চিন্তা করার এখনো সময় আসেনি।
নবীনকুমারের মনে হলো সমস্ত নগরীটিই একটি ধ্বংসস্তুপ। তার মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে করতে তার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো অন্য একটি চিত্র। যা কিছু প্রাচীন, যা কিছু ঠুনকো সব খসে গেছে। আবার গড়ে উঠেছে এক নতুন দেশ, সুন্দর উজ্জ্বল। মানুষের মনে নতুন আশা। সব কিছুর সঙ্গে মানানসই করে নিতে হলে জীবনটাকেও তো নতুন করে নিতে হবে!