2 of 3

৬৫. জ্যোৎস্না রাতে ছাদের রেলিং-এর ধারে

৬৫

জ্যোৎস্না রাতে ছাদের রেলিং-এর ধারে পাশাপাশি দুজন দাঁড়ানো। দৃশ্যটা আপাতদৃষ্টিতে বেশ রোমান্টিক। চয়ন তত বয়সে একজন যুবকই। এবং অনিন্দিতাও কি যুবতী নয়?

যদিও এটা শীতকাল। তবু আজ কলকাতায় শীত একদম নেই। একটু আগে চয়ন ফিরেছে। নিচে গিয়ে চৌবাচ্চায় হাতমুখ ধুয়ে যখন ওপরে আসছে তখন অনিন্দিতা পিছু পিছু এল।

ছাদে পা দিয়েই বলল, কাল একটা থিয়েটার দেখবেন?

থিয়েটার।

কেন, থিয়েটার দেখেন না?

চয়ন খুবই বিব্রত বোধ করল। সিনেমা থিয়েটার জলসায় সে কখনও যায় না, যাওয়ার কথা মনেই হয় না। এন্টারটেনমেন্ট জিনিসটাই তার মধ্যে নেই।

সে মাথা নেড়ে বলল, না। সময়ই হয় না।

কেন, আপনার এত সময়ের টানাটানি কেন হয়? টিউশনি আর এমন কী একটা কাজ?

চয়ন মৃদু একটু হাসল। কিছু বলল না। সত্যি কথাটা বললে মেয়েটা খুব অবাক হবে। সে মৃদু। স্বরে বলে, অনেকদিন আগে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখেছি। এখন কেন যে ইচ্ছে হয় না।

আপনি অদ্ভুত মানুষ। বাঁচতেই জানেন না। বড্ড শুকনো।

চয়ন মাথা নেড়ে বলে, তা ঠিক।

কেন এরকম আপনি? আমার তো থিয়েটারের ভীষণ নেশা। কিছু বাদ দিই না। কাল যাবেন? আমার কাছে দুটো কমপ্লিমেন্টারি টিকিট আছে।

এইসব প্রস্তাব মোটেই সুখাবহ নয় চয়নের কাছে। সর্বদাই তার একটা ত্রাস, বউদি বা দাদা যদি রেগে যায়? এ মেয়েটা ইদানীং প্রায়ই ছাদে আসে আড্ডা মারতে, মাঝে মাঝে ওদের ঘরে ডেকেও চা খাওয়ায়। ওদের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতাটা চয়ন বজায় রাখতে চায় না। বউদি হয়তো ভাল চোখে দেখছে না। সে চিলেকোঠায় উঠে আসায় এবং ঘরের ভাড়া বাবদ মাসে মাসে বউদিকে কিছু টাকা দিতে শুরু করায় সম্পর্কটা ভাল আছে। কতদিন থাকবে তা বলা কঠিন।

চয়ন একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলে, কাল তো সময় হবে না। ছাত্রীর পরীক্ষা চলছে।

অনিন্দিতা গম্ভীর হয়ে বলে, আসলে আপনি আমাকে অ্যাভয়েড করতে চান।

তা নয়। বিশ্বাস করুন।

অনিন্দিতা বিশ্বাস করল না। একটু ম্লান হেসে বলল, এ যুগে এত লজ্জা সংকোচ আর ভয় থাকলে চলে না। ওসব ঝেড়ে না ফেললে বাঁচবেন কি করে?

চয়ন চুপ করে রইল।

অনিন্দিতা কি একটু সেজে এসেছে? ঘরের আলোর আভায় তাই যেন মনে হল চয়নের। চুল পরিপাটি করে বাঁধা, মুখে একটু পাউডার এবং হয়তো বা কাজলও। কপালে একটা বড় আর একটা ছোট টিপ। কে জানে কেন, ব্যাপারটা লক্ষ করে সে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল।

আসুন, একটু গল্প করি।

এ প্রস্তাবের মধ্যে প্রত্যাখ্যানের কিছু নেই। অনিচ্ছুক চয়ন তাই বাধ্য হয়ে রেলিঙের ধারে অনিন্দিতার পাশে দাঁড়াল। বেশ একটা সুগন্ধ আসছে অনিন্দিতার গা থেকে।

খুব দুঃখ পেলাম জানেন, একটু ইনসাল্টেড ফিল করছি।

তটস্থ হয়ে চয়ন বলল, কেন?

আপনি রিফিউজ করলেন বলে। ইচ্ছে করলেই যেতে পারতেন। কী এমন টিউশনি করেন শুনি! তারা তো আর মাথা কিনে নেয়নি।

চয়ন কি বলবে তা ভেবেই পেল না। সে কাউকে তোয়াজটাও করতে শেখেনি।

অনিন্দিতা একটু বিষণ্ণ গলায় বলল, আপনার কথা ভেবেই দুটো টিকিট চেয়েছিলাম। অবশ্য আপনার মতটা আগেই জেনে নেওয়া উচিত ছিল।

চয়ন মেয়েটাকে খুশি করতেই বলল, আচ্ছা, আর একদিন যাবো।

অনিন্দিতা মাথা নেড়ে বলে, আপনি যে কখনও যাবেন না তা আমি জানি। আপনার অনেক অজুহাত বেরোবে। আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে তো কোনওদিন টিউশনি ছাড়া আর কিছু করতে দেখি না। বড্ড ড্রাই জীবন কাটাচ্ছেন। তাই ভাবলাম, একটা নাটক দেখাই আপনাকে। হয়তো ভাল লাগবে।

চয়ন এ কথায় যথেষ্ট কৃতজ্ঞ বোধ করল। একটা মেয়ের সঙ্গে থিয়েটার দেখতে যাওয়া দোষেরও কিছু নয়। কিন্তু এই ঘটনা থেকে নানা রকম ব্যাখ্যা বেরোতে পারে। ভয়ের সেইটাই।

একটা কথা বলবেন? আপনি সব ব্যাপারেই এত ভয় পান কেন?

আমি ভীষণ ভিতু।

থিয়েটারে যাওয়ার মধ্যে ভয়ের কী আছে? কেউ খারাপ ভাববে? আজকাল আর ওসব কেউ ভাবে নাকি?

সে কথা নয়।

অথচ আপনার কত ফ্রিডম দেখুন। একে তো আপনি পুরুষমানুষ। মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের ফ্রিডম অনেক বেশী। আপনার মাথার ওপর কোনও গার্জিয়ান নেই, কেউ শাসন করবে না। এত ফ্রিডম থাকা সত্ত্বেও কেন যে লজ্জা সংকোচ ভয়ে এমন কুঁকড়ে থাকেন।

খুব নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল চয়ন। তারপর বলল, আমার জীবনটা ঠিক আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক নয়।

অনিন্দিতা তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। বলল, কেন বলুন তো! আপনার এপিলেপসি আছে। বলে? ওটা তো অনেকের থাকে। তা বলে সব বিসর্জন দিয়ে বিধবার মতো থাকতে হবে নাকি?

চয়ন বিষণ্ণ নরম গলায় বলল, এই অসুখটা আমার মনের জোর নষ্ট করে দিয়েছে। সব সময়ে একটা অস্বস্তি থাকে মনে।

তাই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন?

চয়ন মাথা নেড়ে বলল, তাই। হয়তো ওটা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স।

অসুখের চিন্তা করেন কেন? এপিলেপসি একটা পাজি অসুখ। কিন্তু ফ্যাটাল তো নয়। আপনার কতদিন পর পর ওটা হয়?

তার কিছু ঠিক নেই। গত তিন মাস হয়নি। আবার হয়তো পর পর তিন চারদিন হবে। দিনে দু-তিনবারও হয়েছে। রাস্তাঘাটে বিপদে পড়তে হয় মাঝে মাঝে।

গত তিন মাস হয়নি বলছেন। এটা তো ভাল লক্ষণ। হয়তো সেরেই গেছে।

চয়ন হঠাৎ একটু যেন সচকিত হয়ে বলল, সারেনি।

কি করে বুঝলেন?

চয়ন হঠাৎ নাটকীয়ভাবে টের পেল তার চারদিকে একটা কুয়াশার ঘেরাটোপ তৈরি হচ্ছে। চোখে একটা অস্পষ্ট সিগন্যাল দেখতে পায় সে। কুয়াশা ভেদ করে একটা রেলগাড়ি ঝিকঝিক করে এগিয়ে আসছে। তার বুড়ো আঙুল কেঁপে উঠল হঠাৎ।

অস্ফুট গলায় চয়ন বলল, ওই যে!

কী ওই যে! কী হল আপনার?

প্লিজ! বলেই চয়ন দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে কোনওরকমে ছুঁড়ে দিল নিজেকে বিছানায়।

অনিন্দিতা ঘাবড়ে গেল না। দ্রুত পায়ে এসে তার কাছে দাঁড়াল। চয়নের হাত কাঁপছে। শরীর কাঁপছে। ধীরে ধীরে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে আঙুল। সে প্রাণপণে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, কাউকে ডাকবেন না কিন্তু, প্লিজ!

অনিন্দিতা ঘরে রাখা ছোটো প্লাস্টিকের বালতিটা থেকে আঁজলায় জল তুলে নিয়ে চয়নের চোখে ঝাপটা দিল একবার। এটুকু চয়ন টের পেল। তারপরই তলিয়ে গেল তার নিজের ভিতরে এক অন্ধকারে।

যখন চোখ মেলল তখন তার বুক, মুখ, জামা সব জলে ভেজা। খুব শীত করছে। শরীর অসম্ভব দুর্বল। বিছানার পাশে অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে, কিন্তু তাকে সে কয়েক সেকেন্ড চিনতেই পারল না।

কেমন লাগছে এখন?

চয়ন শুধু চেয়ে রইল। মাথা এত সাদা যে কথাটা ভাল করে বুঝতেই পারল না। জবাব দেওয়ার ভাষাটাও খুঁজে পেল না কিছুক্ষণ। অবোধ চোখে শুধু চেয়ে থাকল।

চয়নবাবু! কেমন লাগছে?

চয়নের মাথার অস্পষ্টতা সরছে। মনে পড়ছে। সৌজন্যবোধ তার বড়ই বেশী। মৃদু একটু হাসার চেষ্টা করে সে বলল, ভাল।

করুণা আর মায়ায় নরম হয়ে আছে অনিন্দিতার মুখখানা। ছলোছলে চোখে সে বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে?

চয়ন তার ঠাণ্ডা দুর্বল শরীর আর ভারী মাথা নিয়ে পাথরের মতো শুয়ে থেকেও মৃদু একটু হেসে বলল, আমার অভ্যাস আছে। এ তো আমার পুরনো বন্ধু।

একটু দুধ এনে দিই? গরম দুধ?

চয়ন আত্মধিক্কার এবং নিজের ওপর ঘেন্নায় মুখখানা সামান্য বিকৃত করল। তারপর খুব মদস্বরে বলল, না। দুধ আমার সহ্য হয় না।

অনিন্দিতা তার মুখের ওপর একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, এ সময়ে দুধ খেতে হয়। আমি নিয়ে আসছি।

অনিন্দিতা চলে গেল। আবার আসবে। চয়ন তার ঘরের সিলিঙের দিকে চেয়ে চুপ করে শুয়ে থাকে। উঠবার সাধ্যই নেই এখন। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সে উঠতে পারবে। কিন্তু শরীরটা অনেকক্ষণ দুর্বল আর অবশ থাকবে। অনেকক্ষণ ধরে তার শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজবে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। এই শরীর নিয়ে কি বাঁচা যায়?

হাঁ করে খুব বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিল চয়ন। ভীষণ শীত করছে তার। গায়ের ভেজা জামাটা বদলানো দরকার। মুখ মাথা আর ভেজা বুক ভাল করে মোছা দরকার। খুব ধীরে ধীরে সে উঠবার চেষ্টা করল। এই চেষ্টাই তার যাবতীয় জীবনসংগ্রাম। লোকে কিছুতেই বুঝবে না, তার শুধুমাত্র বেঁচে থাকা আর শরীরটাকে টেনে শেষ অবধি নিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে বড় কথা।

সে উঠে বসল। দেখল, জলের ঝাপটায় তার বালিশ আর বিছানাটাও অনেকটা ভিজে গেছে। চাদরটা পালটালে ভাল হয়। চৌকির নিচে একটা পুরনো সুটকেসে চাদর আছে। কিন্তু উবু হয়ে বসে সুটকেস খুলতে এই ছোট ঘরে যে কসরত করতে হয় তা করার সাধ্যই তার নেই। শুধু বালিশটা উল্টে দিল সে। এতেই আপাতত হবে। জামা বদলানো থেকে গা মোছা প্রত্যেকটা কাজই মনে হচ্ছে বেদম পরিশ্রমের ব্যাপার। তার বড় ঘুম পাচ্ছে। আজ রাতে রান্না বা খাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু অনিন্দিতা আসবে বলে সে ঘুমোতেও পারবে না এখন। অপেক্ষা করতেই হবে।

শুয়ে গায়ে কম্বলটা টেনে জেগে থাকার একটা অক্ষম চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু অনিন্দিতা আসতে দেরি করছে। ঘুম তাকে টেনে নিল চুম্বকের মতো।

মাথায় হাতের স্পর্শে ফের জাগল চয়ন। পাশাপাশি অনিন্দিতা আর তার মা দাঁড়ানো।

অনিন্দিতার মা জিজ্ঞেস করল, ঘুমিয়ে পড়েছিলে বাবা? নাকি আবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে?

চয়ন মৃদু হেসে উঠে বসবার চেষ্টা করতেই উনি বাধা দিয়ে বললেন, শুয়ে থাকো। উঠতে হবে না।

সে দুধ খায় না। কারণ দুধটুধ খাওয়ার কথা তার মনেও হয় না। তবে প্রতিবাদ করতে গেলে যে শক্তি ক্ষয় হবে তার চেয়ে বিনা প্রতিবাদে খেয়ে নিলে ধকলটা হবে কম। অনিন্দিতার হাতে কাচের গেলাসে দুধটা দেখে ভিতরের অনিচ্ছা চেপে সে ফের উঠতে গেল।

অনিন্দিতা বলল, উঠবেন না। হাঁ করুন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

চয়ন হাঁ করে এক ঢোক দুধ খেল। সামান্য একটু ঝাঁঝ টের পেল সে।

অনিন্দিতা মৃদু স্বরে বলল, একটু ব্র্যান্ডি মেশানো আছে। তাতে দুর্বলতা কেটে যাবে।

দুধটা খাওয়ার পর সত্যিই তার শরীরটা একটু গরম হল। সে মৃদু স্বরে বলল, আপনাদের কষ্ট দিলাম। এত কিছুর দরকার ছিল না। খানিকটা ঘুমোলেই উইকনেসটা কেটে যায়।

অনিন্দিতার মা তার মাথার কাছটিতে একটু কষ্ট করেই বসলেন। বললেন, কষ্ট কিসের? এটুকু আবার কষ্ট নাকি? তোমাকে তো দেখার কেউ নেই। অসুখ নিয়ে পড়ে থাকো। তোমার তো দেখছি বড় কষ্ট।

এই সহানুভূতি চয়নকে একেবারে কাদামাটির মতো নরম করে ফেলে। সে কৃতজ্ঞ গলায় বলে, কষ্ট করাই যে আমার অভ্যাস। আমার কোনও অসুবিধে হয় না।

তার চারদিকে কত দয়ালু লোক। রাস্তায় ঘাটে কতবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে সে। প্রতিবারই। অচেনা মানুষেরা তাকে সেবা দিয়েছে। কেউ কেউ নিজের পয়সায় ট্যাক্সি ভাড়া করে বাড়ি পৌছে দিয়ে গেছে। সে তাই সকলের প্রতিই একটা বিশ্বজনীন কৃতজ্ঞতা বোধ করে।

অনিন্দিতার মা তার কপালে হাত রেখে বললেন, আমাদের পর ভেবো না বাবা, তোমার বয়সী আমার একটা ছেলেও তো থাকতে পারত!

এধরনের কথা চয়ন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসেই হয়তো পড়েছে। হয়তো এধরনের কথা বাংলা সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়। কথাটা অর্ধসত্য। ছেলের সঙ্গে ছেলের মতো মনে করেও একটা পার্থক্য থাকেই। পরত্বটা ঘুচতে চায় না। তবু চয়নের বড় ভাল লাগল কথাটা।

তুমি রাতে কী খাও বাবা? ভাত না রুটি?

চয়ন সসংকোচে বলে, ভাতই খাই। কেন জিজ্ঞেস করছেন?

আমি আজ তোমার জন্য ভাত রাঁধবো।

চয়ন খুবই বিব্রত হয়ে বলল, না না, আমি আজ আর কিছু খাবো না।

পাগল! তাই কি হয়? না খেলে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। তুমি ভাল করে খাও না বলেই তো এরকম হয়।

চয়ন বড়ই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। তার প্রতি এত সহানুভূতি, এই যত্নআত্তি কিছুই বউদির কাছে গোপন থাকবে না। ব্যাপারটা বউদি ভাল চোখে দেখবে না কিছুতেই। সে বউদিকে চেনে।

মাথা নেড়ে সে বলল, আমার আর খিদে নেই যে। দুধ খেয়ে পেট ভরে গেছে।

ও মা! খিদের জন্য তো গোটা রাত পড়ে আছে। এখন তো মোটে সাড়ে আটটা বাজে। অনিন্দিতা রইল এখানে, গল্পটল্প করো। সাড়ে নটায় খেও।

গোটা ঘটনাটা ঘটছে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সে উদ্বেগে, অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে আছে। অথচ প্রতিরোধের কোনও ক্ষমতাও তার নেই।

অনিন্দিতার মা চলে যাওয়ার পর জায়গাটা নিল অনিন্দিতা নিজেই। বলল, ডাক্তার দেখাবেন?

চয়ন মৃদু হেসে বলে, অনেক দেখিয়েছি। এর তো কোনও চিকিৎসা নেই।

তা জানি। কিন্তু আপনার শরীরটা যদি এমনিতে ভাল হয়ে ওঠে তা হলে অ্যাটাকটা হয়তো কম হবে। আপনাকে এক ফাইল ভিটামিন ক্যাপসুল দেব, রোজ একটা করে খাবেন তো।

তার দরকার নেই।

অত সংকোচ করছেন কেন? আমাকে তো কিনতে হয় না। নার্সিংহোম-এ দেদার ফিজিসিয়ানস্‌ স্যাম্পল আসে। আমরা ফ্রি পাই।

ও, ভিটামিন খেলে কিছু হয়?

হয়। জীবন থেকে নিজেকে অত সরিয়ে রাখবেন না। নিজের ওপর বিশ্বাস এত কম কেন?

চয়ন চুপ করে রইল। ঘরে একটা ষাট পাওয়ারের বাল জ্বলছে। সেই আলোয় অনিন্দিতাকে তার এখন হঠাৎ দেবী বলে ভ্রম হচ্ছে। শোয়া অবস্থায় এই অ্যাঙ্গেল থেকে সে আগে তো কখনও অনিন্দিতাকে দেখেনি।

কী ভাবছেন?

চয়ন সলজ্জ একটু হেসে বলল, আপনারা আমার জন্য এত করছেন বলে আমার ভীষণ লজ্জা করছে। অভ্যাস নেই তো। যতদিন মা ছিল ততদিন—

কথাটা শেষ করতে পারল না চয়ন। মা যতদিন ছিল ততদিন কি সে মায়ের কাছ থেকে অনেক পেয়েছে? না। শেষদিকে মা তো কিছুই পারত না। শুধু শুয়ে থাকত। স্ট্রোকের পর তো সে মনে মনে চাইত, মা তাড়াতাড়ি মরে যাক। এত কষ্ট পাওয়ার চেয়ে সেটাই ভাল। তবু মা যে ছিল সেই থাকাটাই যেন অনেক ফাঁকফোকর, অনেক শূন্যতাকে ভরে রাখত। তখন টের পেত না চয়ন। এখন পায়।

মাকে খুব ভালবাসতেন বুঝি?

চয়ন বলল, সেটা বড় কথা নয়। মা ছাড়া আর কেউ তো ছিল না আমার।

আপনার এক দিদি আছেন না?

আছে। সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

দাদা বউদিকে তো দেখছি। ছিঃ ছিঃ।

চয়ন সতর্কভাবে চুপ করে থাকে।

অনিন্দিতা তার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলে, বাতিটা নিবিয়ে দেব? চোখে লাগছে না তো।

চয়ন আতঙ্কিত বোধ করে বলল, না না, থাক। আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না।

ও তাই তো! আপনার তো শুচিবায়ু আছে। ভুলেই গিয়েছিলাম।

বলেই হাসল অনিন্দিতা। সেই সুন্দর দাঁতের চমৎকার হাসি। মেয়েটা সুন্দরী নয়, কিন্তু ওই হাসিটা যেন অন্য জায়গা থেকে আসে। একটা শুকনো, শ্রীহীন মুখকে ক্ষণিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত করে দিয়ে কোথায় চলে যায়।

চয়ন লজ্জা পেয়ে চোখ বুজে ফেলে বলে, আপনি আমার সম্পর্কে খুব খারাপ ভাবেন, না?

ভাবলে কি বসে আছি এভাবে?

চয়ন করুণ গলায় বলল, আমাকে নিয়েই আমার যত সমস্যা। আর কেউ নয়, নিজেকে সামলাতেই আমার সমস্যা হয়।

তাই তো বলছিলাম, আপনার মনের জোর নেই।

তা তো নেই-ই।

কেন নেই?

কখনও ভেবে পাই না।

আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? কিছু মনে করবেন না?

না না, আমার মনে করার কিছুই নেই।

আপনার আর্নিং কত?

চয়ন একটু হাসল, তারপর একটু হিসেব করে বলল, হাজার দেড়েক হবে।

খুব খারাপ তো নয়!

না। তেমন খারাপ নয়।

তা হলে এখানে পড়ে আছেন কেন? একটা ছোট ঘর ভাড়া করলেই তো হয়।

চয়ন মাথা নেড়ে বলল, হয়। কিন্তু ইচ্ছে করে না। এখানে অনেকদিন ধরে আছি তো।

মায়ের স্মৃতি?

তাও হবে হয়তো। আর বউদিকে আমি সামান্য টাকাই তো দিই ভাড়া হিসেবে।

অনিন্দিতা হঠাৎ চোখ বিস্ফারিত করে বলে, ভাড়া দেন?

হঠাৎ চয়ন বুঝতে পারল, ভাড়ার কথাটা বলা তার ঠিক হয়নি। সে তাড়াতাড়ি বলল, বউদি বা দাদা ভাড়া চায়নি কখনও। আমি ইচ্ছে করেই দিই। বউদি নিতে চায়নি।

অনিন্দিতা অবাক হয়ে বলল, নেবেই বা কেন? নেওয়ার তো কথাই নয়।

প্লিজ! আপনি কথাটা ভুলে যান। কাউকে বলবেন না।

অনিন্দিতা আবার হাসল। তারপর বলল, অত ভিতু বলেই আপনার কিছু হয় না। এত ভয় পান কেন?

আমার সব কিছুকেই ভয়।

তার কপালে একটা হাত রেখে অনিন্দিতা বলল, ভাড়ার একটা রসিদ চেয়ে নেবেন এবার থেকে।

রসিদ! রসিদ দিয়ে কী হবে?

ওটা তো আপনার পাওনা।

চয়ন একটু হাসল। বলল, ওরকম সম্পর্ক তো নয়! আমি দাদার সংসারে একটু সাহায্য করি মাত্র।

অনিন্দিতা মাথাটা হেলিয়ে তাকে মায়াভরা চোখে একটু দেখে নিয়ে বলল, আপনি পারবেন না।

কী পারব না?

আপনি কোনও লড়াই জিততে পারবেন না। বড় বোকা।

এটা আদুরে গলায় বলা। চয়ন আদরটা টের পেল। খারাপ লাগল না। কিন্তু তার কেন যেন মনে হল, সে ছোট্ট একটা পোকার মতো একটা মাকড়সার জালের মধ্যবিন্দুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

অনিন্দিতা একটু বাদে নিচে গিয়ে তার জন্য ভাত নিয়ে এল। এবং আশ্চর্যের বিষয় ভাতের থালা দেখে চয়নের ভীষণ খিদে জেগে উঠল। চেটেপুটে খেল সে। রান্না চমৎকার।

অনিন্দিতা খুশি হয়ে বলে, এবার দরজা বন্ধ করে ঘুমোন।

ঘর অন্ধকার করে ঘুমোবার চেষ্টা করতে গিয়ে চয়ন টের পেল, তার মাথাটা গরম। কেমন একটা অস্থিরতা আর উদ্বেগ। অনিন্দিতা কি কিছু বলতে চাইছে? তাও কি সম্ভব? সে যুবক বটে, কিন্তু যুবকের মতো তো নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *