2 of 2

৬৪. দুদিনের মধ্যে সান্ত্বনা

দু’দিনের মধ্যে সান্ত্বনা আর শ্রীলেখা তাদের স্বামী-পুত্রদের নিয়ে চলে এল এ বাড়িতে এবং ঈষৎ দমিত কান্নার রোল আবার জাগিয়ে তুলল। ওরা শেষ সময়ে বড়বাবুকে। দেখতে পেল না, এইটাই ওদের সবচেয়ে বড় দুঃখ। চিররঞ্জন কাঁদতে লাগলেন একেবারে শিশুর মতন অযৌক্তিক ভাবে।

সমস্ত বাড়িতে শোকের গন্ধ। মাঝে মাঝে কান্না থামলে হঠাৎ সারা বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঘরগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, কোনও ঘরেই কোনও মানুষ নেই। কোনও ঘরের জানলা অর্ধেক খোলা, মনে হয়–এরও যেন কোনও তাৎপর্য আছে। এক টুকরো কাগজ হাওয়ার ধাক্কায় বারান্দার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খেলে বেড়াচ্ছে মনে হয় এই দৃশ্যটাও আগে কোনও দিন দেখা যায়নি। শোকের বাড়ি এই রকম।

এবাড়িতে বড়বাবুর অস্তিত্ব এত বেশি ভাবে সব সময় অনুভব করা যেত যে এখন তাঁর স্থায়ী অনুপস্থিতি কিছুতেই যেন বিশ্বাস করা যায় না। কিংবা একজন কেউ সম্পূর্ণ ভাবে মুছে গেলেই তার পূর্বেকার উপস্থিতি আরও বেশি ভাবে মনে পড়ে। যে-কোনও প্রসঙ্গ উঠলেই মনে হচ্ছে, এই সময় বড়বাবু থাকলে কী বলতেন?

একজন মানুষ সাতষট্টি বছর এ-পৃথিবীতে কাটিয়ে চলে গেল। তার সবকিছুর শেষ এখানেই। কয়েক জন তাকে আরও কিছু দিন স্মৃতিতে রাখবে, কিন্তু তার মূল্য কিছু নেই। অনেক গল্প উপন্যাসের চরিত্রও তো মানুষ মনে রাখে। ওই লোকটির জীবনের বাস্তবতা শুধু ওই সাতষট্টি বছর। একথা জেনেও সহজে মেনে নেওয়া যায় না। মৃত্যুকে মনে হয় অবিশ্বাস্য!

হিমানীই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি সামলে নিলেন নিজেকে। বাড়ির আর সকলের স্নান-খাওয়াদাওয়ার নিয়ম চলে গেছে তিনি সেই নিয়ম ফিরিয়ে আনলেন আস্তে আস্তে। কালাশৌচের আচার-আচরণ, তিনিই ঠিক করে দিতে লাগলেন। এ-বিষয়ে তিনি সাহায্য পেলেন সান্ত্বনার বর মিহিরের কাছ থেকে। মিহির কম কথা বলে, কিন্তু সাংসারিক কাজকর্মে খুব কুশলী। সে চাকরি করে পাটনায়।

সূর্য বরাবর একা ঘরে শোয়। কিন্তু এখন তাকে একলা থাকতে দেওয়া হয় না। বাদলের বিছানা সূর্যর ঘরে পাতা হয়েছে এবং তাকে বলা হয়েছে সব সময় সূর্যর সঙ্গে সঙ্গে থাকতে–অন্তত শ্রাদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত। সূর্য এর মধ্যে কখনও কেঁদেছে কিনা কেউ জানে না, কেউ দেখেনি তাকে চোখের জল ফেলতে–কিন্তু সে অসম্ভব বিমর্ষ হয়ে গেছে। তার সেই নীরবতা ও ম্লান মুখ দেখলে অন্যদেরও মনখারাপ হয়ে যায়। হিমানীর ধারণা সূর্য নিশ্চয়ই আড়ালে কাঁদে, কিন্তু লোকের সামনে দেখায় না। তাকে অন্যমনস্ক করবার জন্যই সব সময় কারওর সঙ্গে থাকা দরকার।

সূর্যকে যা যা করতে বলা হচ্ছে, সে বিনা প্রতিবাদে সবই মেনে চলছে। শ্মশানে গিয়ে সে বাবার মুখাগ্নি করেছে, এখন সে হিমানীর নির্দেশে মাটির মালশায় নিজের হাতে হবিষ্যান্ন রান্না করে, কোরা কাপড় পরে খালি-গায়ে থাকে। তবে অন্যরা প্রশ্ন না করলে নিজে থেকে সে কক্ষনও একটাও কথা বলে না।

সূর্যর কখনও পইতে হয়নি। শ্রাদ্ধের সময় তার উপনয়নের দরকার আছে কিনা সে বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য হিমানী পুরুত ডাকালেন।

এদিকে বড়বাবুর কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে চিররঞ্জন পেয়ে গেলেন একটি নির্দেশপত্র। লেখাটা অনেক পুরনো। মহাযুদ্ধের সময় বড়বাবু যখন এ বাড়িতে সম্পূর্ণ একলা ছিলেন কিছুদিন, সেই সময়কার।

বড়বাবু লিখেছিলেন, আমার অকস্মাৎ মৃত্যু হইলে আমার পুত্রকে সে-সংবাদ তৎক্ষণাৎ জানাইবার কোনও প্রয়োজন নাই। সে যখন জানিবার হয়, জানিবে। আমার বিষয়সম্পত্তি দেখাশুনা করিবার জন্য অ্যাটর্নি নিযুক্ত আছে। বারিদবরণ চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি। তাহাদের প্রতি আমার নির্দেশ, আমার কোনও শ্রাদ্ধশান্তি করিবার দরকার নাই। আমি এ-পর্যন্ত কখনও ঈশ্বরের আশ্রয় যাজ্ঞা করি নাই। মৃত্যুর আগে যদি ভয় পাইয়া ঈশ্বরের নাম লই এবং তাহার যদি কেহ সাক্ষী থাকে–তবেই ধর্মীয় আচরণের প্রশ্ন উঠিতে পারে। নচেত শুধু দাহ করিলেই চলিবে। আমি আমার পিতাকে কখনও চক্ষে দেখি নাই, জীবনে মাতৃস্নেহ পাই নাই-সুতরাং পূর্বপুরুষের কাছে আমার কোনও দায়ভাগ নাই। শ্রাদ্ধের যজ্ঞ অনুষ্ঠান প্রভৃতি আমি অপ্রয়োজনীয় মনে করি।

চিঠিখানা পেয়ে চিররঞ্জন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। বড়বাবু শ্রাদ্ধ না করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। এবং একথাও তো ঠিক, মরার আগে তিনি ভগবানকে ডাকেননি। শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা অনেকখানি এগিয়ে গেছে–এখন কি সব বন্ধ করে দিতে হবে?

চিররঞ্জন পরামর্শ করতে গেলেন হিমানীর সঙ্গে। হিমানী এককথায় সব উড়িয়ে দিলেন। ওসব অনেক লোকের বাতিক থাকে, তা বলে সবই মানতে হবে নাকি, হিন্দুর বাড়িতে শ্রাদ্ধ হবে না-এ কি হয় কখনও?

চিররঞ্জন বললেন, কিন্তু বড়বাবু লিখে গেছেন।

ওই পুরনো কাগজের কী দাম আছে? ছিঁড়ে ফেলে দাও!

চিররঞ্জন ইতস্তত করতে লাগলেন তবু। বড়বাবুর সংস্পর্শে থেকে তিনিও অনেক বিশ্বাস ও সংস্কারকে নির্লিপ্ত চোখে দেখতে শিখেছিলেন। কিন্তু, এখন তার মনে হল, বড়বাবুর আত্মা যেন কাছাকাছি থেকে তাঁকে লক্ষ করছে। এত তাড়াতাড়ি বড়বাবুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও কাজ করার সাহস চিররঞ্জনের নেই।

তিনি বললেন, সূর্যকে একবার জিজ্ঞেস করলে হয় না?

ও ছেলেমানুষ, ও কী বুঝবে? তা ছাড়া, ও কি এসব কোনও দিন দেখেছে?

ছেলেমানুষ হলেও সূর্য এখন বড়বাবুর সবকিছুর উত্তরাধিকারী। তা ছাড়া খুব ছেলেমানুষও তো নয়! তিনি গেলেন সূর্যর কাছে।

বড়বাবুর চিঠিটা পড়ার পর সূর্য সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আপনি যা বলবেন, তাই-ই হবে।

তবু, তুমি কী মনে করো? কী করা উচিত?

সূর্য বলল, আমার মত জিজ্ঞেস করলে আমি বলব, এসবের কোনও দরকার নেই। তবে, আপনি যা ভালো মনে করবেন, সেটাই হোক।

প্রভাসকুমার উপস্থিত ছিলেন সে-ঘরে। তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে বললেন, কাকাবাবু, শ্রাদ্ধট্রাদ্ধ বাদই দিয়ে দিন বরং।

একেবারে সব বাদ দেওয়া কি ঠিক হবে?

সে-দিন একটা সংগীতের আসর বসানো হোক। উনি গানবাজনা ভালোবাসতেন।

 বাড়ির মেয়েরা তখন দরজার কাছে এসে ভিড় করেছে। হিমানীর নেতৃত্বে তারা এতে ঘোর আপত্তি তুলল। অনেক রকম যুক্তিতর্ক ওঠে। আচার-অনুষ্ঠানের আলোচনা প্রাধান্য পাওয়ায় শোক ব্যাপারটা ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, একদিকে নামমাত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান, অন্যদিকে একটা কীর্তনের আসরও বসানো হবে। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা রাখতেই হয়, মেয়েদের আগ্রহ আতিশয্যে।

শ্রীলেখার ছেলেটির বয়স চার-পাঁচ বছর। শোকের আবহাওয়া কাটিয়ে দিতে সেও অনেকখানি সাহায্য করে। ফুটফুটে চেহারার অতি দুরন্ত ছেলে–সর্বক্ষণ হুটোপাটি করে গোটা বাড়ি মাতিয়ে তুলল ক’দিনেই। তার কাণ্ডকারখানা দেখে এক এক সময় না হেসেও পারা যায় না। সে মৃত্যুর কিছু বোঝে না বলেই তার মধ্যে এত চঞ্চলতা–সে যখন এর-ওর পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন সব মনোযোগ ওর দিকেই চলে যায়।

প্রভাসকুমার রামায়ণ-মহাভারত ঘেঁটে বারো-চোদ্দটা নাম বেছে রেখেছেন ছেলের জন্য, কিন্তু কোনওটাই পাকা হয়নি। সবাই এখন ওকে বুড়ো নামে ডাকে। ছেলেকে নিয়েই শ্রীলেখার বেশি সময় ব্যস্ত থাকতে হয়–দুরন্ত ছেলে কখন যে কোথায় পড়ে যায় কিংবা কী ভাঙে না ভাঙে, সেদিকে চোখ না রাখলে চলে না। কিন্তু এরই মধ্যে শ্রীলেখা সময় করে সূর্যর সুখসুবিধের খোঁজ নেয়। দুপুরবেলা ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে সে সূর্যর ঘরে এসে বসে। বাড়ির অনেকেই এখন সূর্যর ঘরেই বেশির ভাগ সময় কাটায়।

ঠিক আড্ডা হয় না, পুরনো গল্প হয়। চিররঞ্জন যখন এলাহাবাদে বড়বাবুর বাড়িতে গিয়েছিলেন, সেই সময়কার কত স্মৃতি। তখন বড়বাবু এ রকম উদাসীন ধরনের ছিলেন না। তার বাড়িতে সব সময় লোকের ভিড়। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে তো লোকজন আসেই–তা ছাড়া বড়বাবুর একসময় এক একটা হুজুগ চাপত। একসময় যত রাজ্যের সাধুসন্ন্যাসীদের ডেকে আনতেন বাড়িতে। প্রয়াগ সঙ্গমে তো সাধুর অভাব নেই–তাঁদের বাড়িতে এনে যত্ন করে খাওয়াতেন, কেউ যজ্ঞ বা পুজোআচ্চার বায়না ধরলে সব বন্দোবস্ত করে দিতেন–আর সর্বক্ষণ নানা খুঁটিনাটি প্রশ্ন তুলে জেরা করতেন তাদের। এ ছাড়া গানবাজনার শখ তো ছিলই। বড় বড় ওস্তাদরা সব আসতেন–নিজেও গলা সাধতেন রোজ। তারপর হঠাৎ একদিন গানবাজনা বন্ধ করে দিলেন। মানুষটা অনেক ব্যাপারে কৌতূহলী ছিলেন বরাবরই।

শ্রীলেখা জিজ্ঞেস করল, সূর্যদা, তোমার গোয়ালিয়ারের কথা মনে আছে?

সূর্য বলল, খুব সামান্য।

অন্য কেউ হলে সেই সামান্য কী কী মনে আছে, সেটুকুও অন্তত বলত–কিন্তু জমিয়ে গল্প বলা ওর স্বভাবে নেই।

চিররঞ্জন বললেন, বড়বাবু শেষের কয়েক দিন বার বার বলছিলেন গোয়ালিয়ারের কথা। সূর্যকেও বলছিলেন ওখানে যেতে।

বাদল বলল, চলো সূর্যদা, তুমি আর আমি এরপর একবার গোয়ালিয়ার থেকে ঘুরে আসি। জায়গাটা দেখলে তোমার নিশ্চয়ই অনেক কথা মনে পড়ে যাবে।

প্রভাসকুমার বললেন, আমরা সবাই মিলে গেলে কেমন হয়? এসো না একটা প্ল্যান। করা যাক।

শ্রীলেখা বলল, তা হলে কিন্তু আমাদের বাদ দিতে পারবে না। আমরাও যাব—

বেশ তো যাবে। ট্রেনের একটা কম্পার্টমেন্ট রিজার্ভ করে সূর্যর জন্মস্থানও দেখা হবে, আমরাও ও-দিকটা বেড়িয়ে আসব। কী হে সূর্যকুমার, প্ল্যানটা কী রকম? তা হলে সামনের মাসে–

সূর্য বলল, আমি সামনের মাসে যেতে পারব না। আপনারা যান, আমার কতগুলো কাজ আছে এখানে–

ঠিক আছে, তোমার কাজ সেরে নাও! তা হলে পুজোর সময় যাওয়া যেতে পারে। তখন গরমটাও কম থাকবে।

শ্রীলেখা আর আগের মতন ভিতু ভিতু ছেলেমানুষ নেই। এখন সে সোজাসুজি সূর্যর চোখের দিকে তাকাতে পারে, অন্যদের সামনেও সূর্যর সঙ্গে কথা বলতে পারে সাবলীল ভাবে। সূর্যই বরং তার চোখে চোখ রাখে না। যখন তাকায়, তখন মনে হয় যেন সে শ্রীলেখাকে দেখছে অনেক দূর থেকে। কিংবা শ্রীলেখাকে সে ভালো ভাবে চেনে না।

তিনতলায় বড়বাবুর ঘরে সূর্য আর বাদল বই আর কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছিল। শ্রীলেখা সূর্যর জন্য এক গেলাস দুধ নিয়ে উঠে এল তিনতলায়। মেঝেতে সবকিছু ছড়ানো। বাদল তড়াক করে উঠে পড়ে বলল, বড়দি, তুমি এখানে একটু কাজ করো তো। এই বইগুলো গুছিয়ে রাখো–আমি একটু নীচ থেকে আসছি।

বাদলের নীচে কোনও কাজ ছিল না। কিন্তু সে বড় হয়েছে, এখন অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। বড়দি আর সূর্যদাকে এখন একটু একলা কথা বলার সুযোগ দেওয়া দরকার।

শ্রীলেখা বসে পড়ে বই গুছোতে শুরু করল। বড়বাবুর ভ্রমণ কাহিনী পড়ার বাতিক ছিল। বহু দুর্লভ সব ভ্রমণ কাহিনী রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। সূর্য বইগুলো সাজিয়ে রাখার বদলে এক একটা বইয়ের পাতা খুলে বিষয়বস্তু সম্পর্কে মনোযোগী হয়ে উঠছে।

শ্রীলেখা খুব সাধারণ ভাবে জিজ্ঞেস করল, দীপ্তিদি এলেন না একদিনও?

সূর্য শ্রীলেখার দিকে তাকাল। শ্রীলেখার মুখ দেখলে বোঝা যায়, সে দীপ্তিদির সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। মেয়েরা মেয়েদের কথা ঠিক জেনে যায়।

সূর্য সংক্ষিপ্ত ভাবে বলল, আসবার কথা তো ছিল।

ওঁকে একদিন নিয়ে এলে তো হয়। বাদলকে পাঠাবে?

নিজেই আসবে।

খবর পেয়েছেন নিশ্চয়ই। তার পরেও যখন আসেননি, তখন নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধে আছে। একটা খবর নেওয়া দরকার না?

হুঁ।

পরশুর জন্য দীপ্তিদিকে নেমন্তন্ন করেছ? তুমি নিজেই যাও না।

যাব।

আমার খুব ইচ্ছে করে দীপ্তিদিকে দেখতে।

অনেকটা তোর মতনই চেহারা।

শ্রীলেখা লজ্জা পেয়ে বলল, যাঃ, কী যে বলো! আমার থেকে অনেক বেশি সুন্দর। কে বলেছে তোকে?

আমি জানি। আমাকে বাদল বলেছে–। তা ছাড়া দীপ্তিদির কত গুণ। আমি না দেখেই দীপ্তিদিকে ভালোবেসে ফেলেছি। বড়বাবু দেখেছিলেন দীপ্তিদিকে?

না।

ইস! এর কোনও মানে হয়? উনি তো একদিন এসেছিলেন এ-বাড়িতে?

সূর্য একটু হাসল। বাদলের কোনও গল্প করতেই বাকি নেই। দীপ্তিদি কিছুতেই আসতে চায়নি–সূর্য জোর করে একদিন তাকে নিয়ে এসেছিল এবাড়িতে।

সূর্য বলল, বাবা তখন বাড়ি ছিলেন না।

অসুখের সময়েও যদি একদিন নিয়ে আসতে!

কথা ঘোরাবার জন্য সূর্য বলল, তোর ডান পাশের ওই বইটা দে। তুই এখন কেমন আছিস?

বইটা এগিয়ে দিয়ে শ্রীলেখা বলল, এই একরকম। এক এক সময় আমার কী মনে হয়। জানো সূর্যদা: সেই যে আমাদের তালতলায় বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে বলেছিলে–তোমার সঙ্গে চলে যেতে–মাঠে ঘাটে নদীর ধারে থাকতাম তোমার সঙ্গে–কেন যে সে কথাটা শুনিনি! দারুণ বোকা ছিলাম তখন।

না গিয়ে ভালোই করেছিলি!

কেন? এখন এই একঘেয়ে জীবন।

তা হোক। ওই রকম জীবনও সবার জন্য নয়। আমার জন্যও নয়।

দীপ্তিদিও তো কত সাহস করে কত কিছু করেছেন। আমরা কিছুই করিনি।

ও-সব কথা এখন থাক।

শ্রীলেখা হাঁটুর ওপর থুতনি দিয়ে সূর্যর দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। একসময় ছিল যখন নির্জন ঘরে সে সূর্যর এত কাছাকাছি বসতে সাহস পেত না। সূর্য চোখের নিমেষে দস্য হয়ে উঠত। এখন সে অন্যমনস্ক ভাবে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে।

শ্রীলেখা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি দীপ্তিদির সঙ্গে দেখা করে বলে দেব, উনি যেন তোমার ঠিক মতন যত্ন নেন! তুমি সব সময় কী এত ভাবো?

যাঃ, যত্ন নেবার আবার কী আছে?

দীপ্তিদি তোমাকে যতই ভালোবাসুক, আমার চেয়ে বেশি কেউ কখনও তোমাকে চিনতে পারবে না।

শ্রীলেখা তুই কিছুই জানিস না। দীপ্তিদি আমাকে মোটেই ভালোবাসে না। আমিই শুধু জোর করি। না হলে, এতদিন কি আমার সঙ্গে দেখা না করে থাকতে পারত?

তুমি ভালোবাসার বোঝো তো ছাই! অনেক দিন দেখা না হলেই বুঝি ভালোবাসা মরে যায়?

সূর্য এবার উঠে দাঁড়াল। শ্রীলেখার দিকে আর তাকাল না। কয়েক দিন মাথায় তেল মাখেনি বলে চুলের রং লালচে হয়ে এসেছে। গালেও সেই রঙের দাড়ি। মন্থর পায়ে গিয়ে দাঁড়াল জানলার কাছে। নীচের উঠোনে শ্রীলেখার ছেলে খুব খেলায় মেতে উঠেছে। সান্ত্বনা আর মিহিরের সঙ্গে। সূর্য সেখানে দাঁড়িয়ে শিশুর খেলা দেখতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *