2 of 2

৬৪. এ রবিবার সকাল থেকেই

৬৪

এ রবিবার সকাল থেকেই আছে পৃথুর বাংলোয়। কুন্তীকে ছুটি দিয়েছে একদিনের জন্যে। ব্রেকফাস্ট হাওয়ার পর বারান্দায় বসে ছিল পৃথু আর কুর্চি। অনেকদিন পর পরোটা, মেটে-চচ্চড়ি আর পায়েস দিয়ে ব্রেকফাস্ট করল পৃথু। কুর্চি নিজে রান্নাঘরে গিয়ে নিজে হাতে বানিয়েছিল। শুধু পায়েসটা গত রাতে রেঁধে রেখেছিল বিগু। রান্না যে মেয়েদের কতবড় গুণ তা একালের অনেক মেয়েরাই জানেন না। শুধুমাত্র ভালবেসে রেঁধে ও খাইয়েই যে একজন পুরুষের হৃদয় জয় করা যায় সহজে, অন্য কোনও গুণ ব্যতিরেকেই, সে কথাও বোধহয় রুষার মতো অনেক আধুনিকা জানেন না। কুর্চি ঘুরে ঘুরে প্লান্টস, ফার্ন, ব্ৰমেলিয়াডসগুলো দেখছিল। রুষার মতো ইকেবানা বা প্লান্টস বা ক্যাকটাই সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান নেই কুর্চির কিন্তু স্বাভাবিক ভালবাসা আছে। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের এই সব শখে নিজেদের নিয়োজিত করার সুযোগ খুব একটা থাকে না। তাই বলে ভালবাসাও যে থাকে না এমন নয়। যেখানে নারী, সেখানেই গাছ, ফুল, প্রজাপতি, কাঁচপোকা। ভ্রূণ এবং বীজও।

পৃথু, কুর্চির অনবরত প্রশ্নর উত্তরে হেসে বলল, এডওয়ার্ড লীয়রের ননসেন্স বটানী পড়েছ?

কুর্চি চোখ তুলে বলল, না তো! ইংরিজি। আমি কতটুকুই বা পড়েছি!

রুষার খুবই প্রিয়, লীয়র।

পৃথু বলল।

ননসেন্স কেন?

কুর্চি বলল।

সেইই তো মজা!

কী রকম?

ধরো, বটলফোরিকা স্থনিফোলিয়া। অথবা স্মলটুথকম্বিয়া ডমেস্টিকা।

কুর্চি হেসে ফেলল। বলল, আরও আছে?

অনেক। পলীবার্ডিয়া সিঙ্গুলারিস, কক্কাটুকা সুপার্বা অথবা পিগিয়াউইগিয়া পীরামিডালিস।

কুর্চি হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর বারান্দার মোজাইক-করা চওড়া ঘেরার উপর থেমে হেলান দিয়ে বসে বলল, অন্যদের লেখা তো অনেকই পড়লেন। সারা জীবন ধরে। নিজে এবারে একটা বড় লেখায় হাত দিন পৃথুদা। আপনি কিছুই না করে নিজেকে নষ্ট করলেন।

নষ্ট হয়ে যাবার মধ্যেও একধরনের বোধ কাজ করে গভীরে। জেনেশুনে নষ্ট, সকলে হতে পারে না। “প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই” এমন কথা কি সকলে জানে? না বলতে পারে?

আপনার মতো করেই লিখুন। কেমন হয় দেখাই যাক না।

আমি লিখলে, বড় জোর মণি চাকলাদারের মতোই লেখা হবে হয়তো। পাতা তো কত লোকেই ভরিয়ে চলেন। সেই সব ভরা-পাতার কতটুকু সাহিত্য বলে বিবেচিত হবে ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে আর কতটুকু পাঠকের পরম অবহেলায় মুদির দোকানের ঠোঙাতে পরিণত হবে, তা জানে একমাত্র মহাকাল। বেশি পড়লে, বেশি ভাবলে, বোধহয় কিছু লেখা যায় না। সবাই যদি কবি বা লেখক হয়ে পড়েন তবে পড়ুয়া হবেন কারা?

আপনি ভীষণ কুঁড়ে। তাইই এসব বলে নিজেকে বুঝ দেন।

কুঁড়েমির মতো গুণও কি বেশি আছে? বারট্রান্ড রাসেলের “ইন প্রেইজ অফ আয়ডলনেস” বইটা তোমাকে পড়তে দেব। পড়ে দেখো।

ইংরিজি তো আমি জানি না তেমন ভাল।

যে একটি ভাষাকে ভালবাসে তার কাছে সব ভাষাই সহজে আপন হয়। সব বোঝার দরকারই বা কি। মূলভাবটুকু বুঝলেই যথেষ্ট।

কী জানি! রুষা বৌদির যে চিঠিটা আপনি আমাকে আজ সকালে পড়ালেন তা অবশ্য বুঝেছি। উনিও কিন্তু সহজেই লেখিকা হতে পারতেন। কী চমৎকার ইংরিজি লেখেন। অথচ লিখলেন না।

আমার মনে হয় যাঁরা লেখেন, তাঁদের চেয়ে অনেক বড় লেখক-লেখিকা রয়ে গেলেন চিরদিনই সকলের চোখের আড়ালে পড়ুয়া হয়েই। সেই মুষ্টিমেয় পড়ুয়ারাই যুগে-যুগে সাহিত্যের মান নির্দ্ধারণ করেন। সাহিত্যর প্রকৃতির প্রকৃত বিচার করেন। তাঁরা যে কারা, জনসাধারণের ভিড়ের মধ্যে কোথায় যে নিজেদের গোপন করে তাঁরা জীবন কাটিয়ে দেন, তা লেখকরা জানেনই না। অথচ তাঁদের দেয় পুরস্কারই আসল পুরস্কার। তাঁদের বিচারে যাঁরা বড় তাঁরাই থেকে যান শেষ পর্যন্ত।

কথাটা কিন্তু উঠিয়েছিলাম আমি আপনার লেখা নিয়েই।

আমার কথা ছাড়ো। সাহিত্য ভালবাসলেই সাহিত্যক হওয়া যায় না। বললাম না, সরস্বতীর কৃপা থাকা চাই। আমি একটা ফালতু লোক। নির্গুণ। কিছু হওয়ার জন্যে এখানে আসিনি এ জন্মে, যাঁরা হয়েছেন তাঁদের গুণগ্রাহী হওয়ার জন্যেই এসেছি। তাছাড়া, সবাইকেই যে বিরাট কিছু হতে হবেই তারই বা মানে কি? বেশ তো আছি। একখানা পা, সীওনীর এই নির্জন শান্ত নিরুপদ্রব নির্লোভ জীবন, একজন কুর্চি, একজন ঠুঠা বাইগা আর আদিগন্ত প্রকৃতি এই সব নিয়ে। এই তো কত! এর চেয়ে বেশির যোগ্যতা আমার নেই, প্রত্যাশাও নয়।

কুর্চি উঠে এসে পৃথুর পেছনে দাঁড়িয়েই ওর হাত দুটি নামিয়ে পৃথুর বুকের কাছে মালা গড়ল একটি। বলল, আপনি তাহলে আপনারই মতো থাকুন। বলছি বটে এত কথা, আপনি বিখ্যাত হয়ে গেলে, বড় হয়ে গেলে আপনার অনুরাগী আর অনুরাগিণীদের ভিড়ে আমিই হয়তো কাছে পাবো না আপনাকে। আমরা দুজনেই যে অনেকই দাম দিয়ে দুজনকে পেয়েছি পৃথুদা। হারাবার কথা ভাবলেও বুক কাঁপে ভয়ে। পেয়ে হারানোর দুঃখ হয়তো সইবে না। যতদিন পাইনি, ততদিন অন্য কথা ছিল।

পেলে আর কোথায়? আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হওয়া আমাদের সম্ভব নয়। রুষার আধুনিকতায় ও তো এসব ব্যাপারকে আমলই দেয় না। যে কারণে ডিভোর্স-এর কথা উচ্চারণপর্যন্ত করেনি একবারও।

ভাঁটু তো দেয়। দুজনের আইনের সম্পর্ক না চুকালে নতুন সম্পর্ক আমরা ভাবি কী করে?

কুর্চি এসে পৃথুর সামনে চেয়ারে বসল। বলল, কারণ যে কী, তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। স্পষ্ট করে আমি নিজেও তা জানি না। তবে, মনই বলে এরকম কথা। কিছু কিছু পুরুষ বোধহয় থাকে যাদের কোনও মেয়েই পুরোপুরি পায় না। তাদের যোলো-আনা কোনও একজন বিশেষ নারীর জন্যে নয়। টুকরো টাকরা নিয়ে যারা খুশি হতে পারল, তারা হল; যারা পারল না, তারা পেলই না তাকে। অবশ্য, প্রকৃতই যারা পুরুষ তাদের পক্ষে এরকম বিধিবদ্ধ খাঁচার-পাখির জীবন হয়তো অভিপ্রেতও নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ কথা’র অচিরার কথা বলছিলাম সেদিন! তার সবই ছিল। রূপ, গুণ, মেধা, তবু তার সর্বস্ব দিয়েও সে নবীনকে পুরোপুরি পেল না। অথচ কেন যে পেল না সে সম্বন্ধেও তার এক স্পষ্ট ধারণা ছিল। কে জানে, পেতে চাইলও না হয়তো শেষ পর্যন্ত।

‘শেষ-কথা’ আমার ভাল মনে নেই। ল্যাবরেটরী আর রবিবার মনে আছে।

সেই যে, নবীন বলল না; অচিরা কচ ও দেবযানীর কথা তোলাতে? “দেখুন, আমি হয়তো ভুল করেছিলুম। মেয়েদের নিয়ে পুরুষের কাজ যদি না চলে তা হলে মেয়েদের সৃষ্টি কেন?”

তখন অচিরা বলল: “বারো-আনার চলে, মেয়েরা তাদের জন্যেই। কিন্তু বাকি মাইনরিটি যার। সব-কিছু পেরিয়ে নতুন পথের সন্ধানে বেরিয়েছে তাদের চলে না। সব-পেরোবার মানুষকে মেয়েরা যেন চোখের জল ফেলে রাস্তা ছেড়ে দেয়। যে দুর্গম পথে মেয়ে-পুরুষের চিরকালের দ্বন্দ্ব সেখানে পুরুষরা হোক জয়ী।”

পৃথু বলল, রবীন্দ্রনাথের সময়ে হয়তো এইসব কথার দাম ছিল। আজকে মেয়েরা তো লিবারেটেড হয়েছে। মেল-শভিনিজম-এর দিন তো আর নেই। এখন মেয়েরা কোন অংশে পুরুষদের থেকে কম। এমন কথা অন্য আধুনিকারা শুনতে পেলেও তোমাকে দুয়ো দেবেন।

তা দিন। মেয়েরা যতই স্বাধীন হোক, যতই লিবারেটেড হোক, তারা তো মেয়েই থাকবে। বড় ছোটর কথা বলছি না, মেয়েরা পুরুষের মধ্যেই সার্থক, হয়তো পুরুষরাও মেয়েদের মধ্যে। দুজনের মধ্যে তো কোনও বিরোধ নেই। তেমন তেমন মেয়েরা চিরদিনই লিবারেটড। পুরুষের দুয়ারে পতাকা আর পোস্টার নিয়ে স্বাধীনতা ভিক্ষে করতে বিদেশের মেয়েরা যায় যাক, আমি যাব না। স্বাধীনতা তো সামান্য কথা, তার চেয়েও অনেক বড় আসনে এদেশের শিক্ষিত, যথার্থপুরুষরা চিরদিনই আমাদের বসিয়ে এসেছেন। আর তাইই যখন ঘটনা; তখন নিজেদের এমন করে ছোট করতে যাবই বা কেন?

বলো কী তুমি? শরিয়তী আইনের ওপর সুপ্রীম কোর্টের রায় নিয়ে দেশের অধিকাংশ মুসলমান পুরুষরা কেমন লম্ফ-ঝম্ফ করছে দেখছ না!

তা তাঁরা যা খুশি তাইই করুন। যে জাত, যে দেশ, যে ধর্ম, মেয়েদের মর্যাদা না দেয়, তারা কখনওই শিক্ষিত বলে পরিচিত হবে না। বর্বরতা আর আধুনিকতা তো একই বোরখার নীচে সহাবস্থান করতে পারে না।

দোষ কি মুসলমানদেরই শুধু? রোজই কাগজে তুমি হিন্দুদের মধ্যে পণের ব্যাপার নিয়ে অত্যাচার, হত্যা, আত্মহত্যার খবর কি পড় না?

পড়ব না কেন? যে সব সমাজে এবং বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে এসব এখনও ঘটে, তারা বড়লোক হতে পারে, ব্যবসার নিয়ন্ত্রক হতে পারে, মানুষ হয়ে উঠতে তাদের এখনও অনেকই দেরি আছে। রবীন্দ্রনাথের অচিরা আর নবীনরাও সেদিন তো ছিলই। আজ তাদের সংখ্যা অনেকই বেড়েছে। আপনি তো আমাকে পুরোটা বলতেই দিলেন না। সবই গোলমাল করে দিলেন তার আগেই।

সরি! বলো বলো, তোমার অচিরার কথাই শুনি।

অচিরা আরও বলেছিল: “যে মেয়েরা মেয়েলি, প্রকৃতির বিধানে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, তারা ছেলে মানুষ করে, সেবা করে ঘরের লোকের। যে পুরুষ যথার্থ পুরুষ, তাদের সংখ্যা খুব কম। তারা অভিব্যক্তির শেষ কোঠায়। মাথা তুলছে একটি দুটি করে।” মানে, আপনারই মতো আর কী!

তারপর?

“মেয়েরা তাদের ভয় পায়, বুঝতে পারে না, টেনে আনতে চায় নিজের অধিকারের গণ্ডীতে।”

যাইই বলো, সেই আলখাল্লা পরা বুড়োর অনেক গুণ ছিল, কিন্তু তর্কশাস্ত্রে যে বিশেষ দখল ছিল তাঁর তা কিন্তু আমার মনে হয় না। আমার দোষেই দোষী তিনি। যখনই কিছু বলতে চান, তখন তাঁর বক্তব্য ছাপিয়ে তাঁর ভাষার কাব্যময়তা তাঁর পাত্র-পাত্রীকে একেবারেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বলা শেষ হলে দেখা যায় নায়ক এবং নায়িকা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই।

পৃথুদা। আপনি ভীষণ অধৈর্য এবং উদ্ধতও।

ঠিক আছে! বল শুনি।

“পুরুষ যেখানে অসাধারণ সেখানে সে নিরতিশয় একলা। নিদারুণ তার নিঃসঙ্গতা, কেননা, তাকে যেতে হয় যেখানে কেউ পৌঁছয়নি।”

পৃথু, হাসল।

বলল, কথাগুলো ভারি সুন্দর। কিন্তু আমি তো অসাধারণ নই। ঠিক এই মাপের অসাধারণ পুরুষ তো চারপাশে দেখতেও পাই না কোথাও। বাঙালিদের মধ্যে বোধহয় অসাধারণত্বর মড়ক লেগেছে, গরু-মোষের রাইন্ডারপেস্ট মহামারীরই মতো। অসাধারণ বাঙালিদের প্রজন্ম শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধুই ইঁদুরদের দৌরাত্ম্য।

ইঁদুর মানে?

কুর্চি বলল। চোখ তুলে। বিরক্ত হয়ে।

ইঁদুররা সবসময় কাটা-কুটি করে কেন, জানো?

না তো। কেন?

ওদের একটা দাঁত আছে। সবসময় কিছু না কিছু কেটে তাদের সেই দাঁত ক্ষইয়ে না ফেললে সেই বাড়ন্ত দাঁত তাদের মগজ ফুটো করে দিত। অক্কা পেত নিজেরাই। এখনকার বাঙালিরাও ওই ইঁদুরদেরই মতো। তাও ধেড়ে ইঁদুর নয়। ইঁদুরদের মধ্যেও ধেড়েরা বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। চারপাশে এখন নেংটি ইঁদুর। কুটুর-কুটুর সর্বক্ষণ।

কাটে কী তারা?

যা কিছুই পায় তাইই কাটে। শ্রম কাটে, আশা কাটে, সম্পর্ক কাটে, সারল্য, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা নিয়মানুবর্তিতা, ভালত্ব সবকিছু কেটে কেটে ঝাঁঝরা কুটিকুটি করে দেয়। এদের মধ্যে অবিচার নবীনবাবুর মতো কাউকেই তো দেখি না!

আপনি। আপনি তো ব্যতিক্রম!

হাঃ। হাসল পৃথু। বলল: হলে, খুশি হতাম। কিন্তু নই কুর্চি।

শেষ হল কি তোমার অচিরার অশেষ শেষ-কথা? না হয়ে থাকলে, বলো।

অচিরা পরে বলেছিল তার অধ্যাপক দাদুকে। “ও তোমার বাজে কথা। আসল হচ্ছে এটা স্ত্রী জাতিদের দেশ। এখানে পুরুষেরা স্ত্রৈণ, মেয়েরাও স্ত্রৈণ। এখানে পুরুষরা কেবলই ‘মা’ ‘মা’ করছে, আর মেয়েরা চিরশিশুদের আশ্বাস দিচ্ছে যে তারা মায়ের জাত। আমার তো লজ্জা করে। পশু-পক্ষীদের মধ্যেও মায়ের জাত নেই কোথায়?

এবারে থামো কুর্চি। ‘শেষ কথা’র নায়ক-নায়িকারা কেবলই বড় বড় পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলছে। আসলে কে যে কী বলতে চায় তা বুঝে উঠতে পারছি না।

সব মানুষই পরস্পরবিরোধী। যারা নয়, তারা তো যন্ত্র, মেশিন, এমনকী জানোয়ারই, তারা মানুষ পদবাচ্যই নয়। আপনি কি জানেন না, রবীন্দ্রনাথকে একজন বিদেশি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার মতে, আপনার সবচেয়ে বড় দোষ কী?’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘ইনকনসিস্টেনসী’। উনি আবারও জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আপনার মতে আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী?’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘ইনকনসিন্টেন্সী’।

তাইই? বাঃ বেশ তো!

পৃথু বলল।

ইয়েস স্যার। তাইই।

এবারে একটু কনসিসটেন্ট হয়ে বলো, আসলে কী তুমি বলতে চাইছিলে?

পৃথু বলল।

বলেছি তো! আপনাকে চিরদিনের মধ্যে আইনানুগভাবে পাব না আমি। এরপরে বলার কি আর থাকতে পারে?

মাত্র কদিন মাঝে মাঝে দেখা হওয়াতেই যেমন ঝগড়া এবং মতবিরোধ হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে চিরদিনের মতো কোনও ভালবাসার জনকেই কাছে না পাওয়াই বোধহয় ভাল। তোমার কাছে যখন যেতাম রাইনাতে, অপলকে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তোমার হাতে হাত রাখলেই আমার শরীরে কাঁটা দিত। চোখে চুমু খেলে মনে হত ভাললাগায় গলে যাব। চোর ছিলাম তো। পরের দ্রব্য না বলিয়া গ্রহণ করার নামই তো চুরি।

আর এখন?

কুর্চি বলল।

সবই পেলাম। এতবার করে, এরকম করে, কিন্তু সেই চুরি করে চোখে চুমু খাওয়ার সিরসিরানি যে কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে। চুরি করে ভাল না-বাসলে বোধহয় ভালবাসাটা আর ভালবাসা থাকে না। পরকীয়া প্রেম বা অনাঘ্রাত প্রেম হচ্ছে চাঁদের আলো, আর বিবাহিত প্রেম বা খোলামেলা বাধাহীন শরীরী-সম্পর্ক বোধহয় সূর্যালোক। প্রখর সূর্যতাপে, ধুলোয়, আওয়াজে ভালবাসার ফুল বোধহয় শুকিয়েই যায়।

কুর্চির গাল লাল হয়ে উঠল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল ও।

কী হল?

কিছু না।

আরে। নিজের মনে নিজের সঙ্গে কথাও কি বলতে পারব না? নিজেকে নিজে প্রশ্ন যে না করে সেও কি মানুষ? এত জানো, আর এটুকু জানো না। স্বগতোক্তিও কি দোষের?

আপনি যদি এইই জানেন তাহলে অমন কাঙালপনা করতেন কেন? আমার বারো বছর বয়স থেকে আমাকে এমন করে ভালবাসলেন কেন? যা আমি আপনাকে দিয়েছি তাইই কি চাননি আপনি আমার কাছে? অদ্ভুত মানুষ আপনি। সত্যিই! যা পেয়ে ধন্য হওয়ার কথা ছিল তাইই পেয়ে মনে হচ্ছে বিরক্ত হয়েছেন আপনি। আমি…আমাকে এমন অপমান করার কোনও…

আঃ! কুর্চি! তুমি তো ছোট নও। বোকা নয়। তুমি হয়তো তোমার নিজের সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ। আমি নই। এখনও নই।

কুর্চির চোখের কোণে জল ছলছল করে উঠল।

পৃথু, ক্রাচদুটি তুলে নিয়ে, কুর্চির কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখল।

বলল, কুর্চি! আমাকে ভুল বুঝো না। নিজের মধ্যে যে মানুষটা বাস করে তাকে এতদিনেও জানা হয়নি। যেদিন চিতায় ছাই হয়ে যাব সেদিনও হয়তো পুরোপুরি জানা হবে না। নিজের ভিতরের নিজেকে পরোপুরি জানার এই খোঁজ যেদিন থামিয়ে দেব, সেদিন বেঁচে থেকেও যে মরে যাব কুর্চি! আমাকে বাঁচতে দাও লক্ষ্মীটি। তোমাকে আমি আমার অনেক স্বপ্ন আর কল্পনার কুর্চি করেই রাখতে চাই। তোমার সঙ্গে দিনরাত এক ঘরে থেকে, তোমার শরীরকে হাত বাড়ালেই বারবার পেয়ে তোমাকেও যদি আরেকজন রুষা করে তুলি, রুষা বলে ভাবতে থাকি আমি? সেইই ভয় আমার। তুমি কি বোঝো না?

হঠাৎই কুর্চি উঠে দাঁড়াল।

দু-ভুরু কুঁচকে বলল, অসম্ভব!

বিনুনি করে এসেছিল। চান করে। ছিপছিপে, ঋজু সরু কোমর বেয়ে বেণী নেমেছিল কালো প্রপাতের মতো। নীচের দিকে গোঁজা ছিল অমলতাস ফুলের স্তবক। তার পরনে হলুদ একটি টাঙ্গাইল শাড়ি, অফ-হোয়াইট ব্লাউজ, দীঘল চোখে কাজল। সকালের বারান্দাতে হঠাৎ একটি উদ্ধত অথচ নরম হলুদ ফুলের মতো ফুটে উঠেই, সারা বারান্দা হলুদ আলোয় আভাসিত করে বেণী দুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল কুর্চি। তারপর প্রায় দৌড়েই বেরিয়ে গেল বাংলোটা থেকে।

পৃথু ডাকল, কুর্চি। ও কুর্চি।

আমি যে দৌড়তে পারি না। তুমি দৌড়ে চলে গেলে আমি তোমাকে ধরতে পারব না আর কোনওদিনও। একটু দাঁড়াও আস্তে এগোও। আমি আসছি। রাগ কোরও না। প্লীজ…। কুর্চি। মনে মনে বলল পৃথু। চলে যাওয়া কুর্চির দিকে তাকিয়ে।

কুর্চি ততক্ষণে বড় বড় পা ফেলে বাঁকের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

হতাশ, হতভম্ব পৃথু ধ্বপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। তাড়াতাড়ি বসাতে একটি ক্রাচ হাত ছিটকে পড়ে গেল বারান্দার মেঝেতে। শব্দ শুনে ভেতর থেকে ঠুঠা বাইগা পর্দা সরিয়ে এসে দাঁড়াল। একবার পৃথুর দিকে চাইল, আরেকবার কুর্চির শূন্য চেয়ারটার দিকে। বেণী থেকে খসে পড়া হলুদ অমলতাসের গুচ্ছ মেঝেতে পড়ে ছিল। ঠুঠা, বাংলোর গেট পেরিয়ে বাঁক অবধি গেল। তারপর ফিরে এসে পৃথুর সামনে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা চাউনিতে দেখল পৃথুকে। পৃথুর মনে হল ঠুঠা বলছে: তুমি একটা অভিশপ্ত জীব। আমারই মতো। একটা শুধু পাইই নয়, একদিন আমারই মতো সবকিছুই হারাবে তুমি। যে ধরে রাখতে না জানে, তার কিছুমাত্রই পাওয়ার অধিকার নেই এ সংসারে। পৃথু মুখ নামিয়ে নিল। অজগরের চোখের মতো সেই চাউনি সহ্য করা কঠিন ছিল।

রান্নাঘর থেকে বিগু এল। এদিক ওদিক চেয়ে অবাক গলায় বলল, এ কী! মেমসাহেব গেলেন কোথায়?

ঠুঠা নিজের চোখ-জোড়া দিয়ে বিগুর চোখ-জোড়াকে টেনে এনে মেঝেয় পড়ে থাকা অমলতাসের স্তবকের উপর নামাল।

বিগু বলল, খাসির রেজালা বানাচ্ছি, বাসমতী চালের পুলাউ, ছোলার ডাল, কারিপাতা দিয়ে, বায়গণ ভাজা, আর মেমসাব…

পৃথু বলল, রান্না হলে টিফিন ক্যারিয়ার করে মেমসাহেবের বাড়ি খাবার পৌঁছে দিয়ে আসবি। বলবি, আমি যাব। ওখানেই খাব।

বিগু ও ঠুঠা দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ভিতরে চলে গেল। সবুজ আর সাদা ডোরাকাটা পর্দাটা দুলতে লাগল ডিফিওনবিচিয়ার অতিকায় একটি পাতার মতো।

পৃথু বৈশাখের সকালের রৌদ্রোজ্জ্বল পাহাড়ের দিকে চেয়ে ভাবছিল, কুর্চিরও তাহলে রাগ আছে রুষার মতো অতটা না হলেও বেশ বেশিই আছে। নইলে, রাগ করে এমনভাবে সীন-ক্রিয়েট করে চলে যাবার মতো কোনও ব্যাপার ঘটেনি। ওর কিছু বলার থাকলে ও ঠাণ্ডাভাবে বলতে পারত। অথচ, আশ্চর্য! এত বছরে কুর্চির সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে পৃথুর, মনে হয়েছে ও শুধু নম্রতা আর সহানুভূতি আর আদর আর ভালবাসারই প্রতীক। মানুষমাত্ররই যে রাগ থাকে, দোষেগুণে মেশা যে সব মানুষই, এ ভাবনা, যে-কুর্চিকে ও জানত সেই কুর্চি সম্বন্ধে মাথায় একবারও আসেনি। এখন বুঝছে যে আসা উচিত ছিল। কুর্চির মধ্যেও রুষা আছে।

কে জানে, হয়তো রুষার মধ্যেও কুর্চি ছিল।

তেমন করে খোঁজার চেষ্টা করেনি কখনও হয়তো পৃথু। নিজেকে নিয়ে, নিজের পুরুষবন্ধুদের জগৎ নিয়ে, রুষার প্রতি অনুযোগময় বছরগুলি কুর্চির প্রতি নরম ভালবাসা বুকে করেই কাটিয়ে দিয়ে এল। অনেকগুলো বছর। রুষার মনের সব পাপড়ি খুলে মেলে দেখার অবকাশই হয়নি। হয়তো শরীরেরও নয়। এক অন্ধ জীবন যাপন করছিল ও। যদি বা সেই বন্ধ চোখ খুলেছিল সীওনীতে এসে তাও আবার বন্ধ হবার মুখে।

অথবা, কে জানে? প্রকৃত ভালবাসার সম্পর্কে এই মান-অভিমানই হয়তো আসল। মান এবং মান-ভঞ্জন। এই নাগরদোলাই হয়তো নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখে; সঞ্জীবিত করে।

বেচারি কুর্চি। বেচারি রুষা। বিজলী বেচারি!

পৃথু ভাবছিল ও বড় নরম মনের পুরুষ মানুষ, রবীন্দ্রনাথের ‘শেষকথার’ অচিরার ভাষায় হয়তো স্ত্রৈণও। হাটচান্দ্রার অনেকেই তাকে এই অপবাদ দিত। যদিও স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বলতে এক বাড়িতে থাকা, একসঙ্গে খাওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবু, সে প্রচণ্ডরকম বিবাহিত ছিল। স্ত্রী ছেলেমেয়ের প্রতি কর্তব্য, তাদের প্রতি মমত্ব, তাদের জন্যে সব দরদ পুরোমাত্রায়ই ছিল তার। কিন্তু সেই সব বোধ প্রকাশ করার সুযোগ তাকে খুব বেশি দেওয়া হয়নি। ছেলেমেয়েরাও রুষা-চালিত ছিল, শিশুকাল থেকেই। একবেলাও তাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবার অধিকার ছিল না, ছিল না ওদের একটি চকোলেট বা কেক কিনে দেওয়ার স্বাধীনতা, রুষার অনুমতি ছাড়া। এই সবেরই জন্যে, ধীরে ধীরে নিজের সম্মানেরও কারণে ও নিজেকে সরিয়ে আনতে আনতে হয়তো বড় বেশি দূরেই সরিয়ে এনেছিল। দাম্পত্য সম্পর্কে “স্পেসেস বীটউইন টুগেদারনেস” ভাল। কিন্তু সেই স্পেসেস যদি দুরতিক্রম্য হয়ে ওঠে, তখন তা আর সাঁতরে পেরুনো যায় না, তা পেরোতে কুর্চি বা বিজলীর মতো নৌকোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

বাইরে রোদ জোর হচ্ছিল। ইদানীং একটু গরম গরম লাগে। পথের উল্টোদিকের একটি বড় অশোক গাছে মস্ত একটি মৌচাক হয়েছে। বিগু একদিন বারান্দায় আগরবাতি জ্বালিয়েছিল। অমনি সঙ্গে সঙ্গে তারা হামলে এসে পড়েছিল চাক থেকে বিগুর উপর। মৌমাছির কামড় জঙ্গলে পৃথু অনেকবারই খেয়েছে। সেটা মোটেই সুখাদ্যর মধ্যে গণ্য নয়। তাইই, কুর্চিকেও বলে দিয়েছিল কোনও সুগন্ধি মেখে যেন বারান্দায় না বসে। নিজেও ঈত্বর সম্বন্ধে সাবধান হয়ে থাকে। কী আর করা যাবে? যেখানে সুগন্ধ, সেখানেই কামড়। সুগন্ধমাত্ররই মধ্যে হুলের হোমিং-ডিভাইস থাকে বোধহয়। বীল্ট-ইন।

সামনে পাহাড়ের নরম রোমশ সবুজ গায়ে তার ত্রিকোণ চলন্ত ছায়া চক্রাকারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটি ক্রেস্টেড হক ঈগল আকাশ পরিক্রমা করছে। পশ্চিম দিকে, পাহাড়ের পায়ের কাছে একটি দহ মতো আছে। সেদিক থেকে দ্রুত উড়ে আসছে একটি ছোট্ট নীল-মাথা বাদামী-গায়ের কিং ফিশার মাছরাঙা। আর তার পেছন পেছন, যেন তাকে ধাওয়া করেই উড়ে আসছে সাদা-বুক মস্ত ঠোঁটের বড় একটি হোয়াইট-ব্রেস্টেড কিং-ফিশার। ক্রেস্টেড হক-ঈগলটা ক্রমশই উপরে উঠছে। দেখতে পাহাড়ের চূড়ো ছাড়িয়ে নীল মহাশূন্যের মধ্যে একটি বিন্দুর মতো ছোট হয়ে যাবে সে। তার দূরবীক্ষণ চোখে পাহাড়ের প্রতিটি খোঁজ-খাঁজ, মালভূমি, বুকের উপত্যকা, নদীর পেলব শুকনো খোল ফুটে উঠবে। কোথায় খাবার নড়ছে-চরছে তা দেখতে পেলেই ফাইটার মিগ জেটের মতো দ্রুত সে নেমে আসবে। জিম করবেটের বনশীর মতো অলুক্ষুণে ডাক ডাকবে কখনও। বুকের মধ্যে, হারতে-থাকা-ফুটবল টীমের কাছে রেফারীর পেনাল্টি কিক-এর হঠাৎ-বাঁশিরই মতো তীক্ষ্ণ ভয়ার্ত স্বরে বেজে উঠবে তার শুদ্ধ স্বর, তারাতে। ক্রেস্টেড হক ঈগলরা উদারা মুদারার ধার ধারে না। তারাতেই তারা স্বর-দীপ্ত।

পাহাড় চূড়োর দিকে চাইলেই বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে আজকাল। নিজের পঙ্গুতা এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান-এর উদার মুক্তির কবিতাগুলি একে অন্যের সঙ্গে নিঃশব্দ যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

অ্যালোন, ফার ইন দ্যা ওয়াইল্ডস এন্ড মাউন্টেইনস আই হান্ট,

ওয়ান্ডারিং অ্যামেজড অ্যাট মাই ওওন লাইটনেস এন্ড গ্লী,

ইন দ্যা লেট আফটারনুন চুজিং আ সেফ স্পট টু পাস দ্যা নাইট,

কিন্ডলিং আ ফায়ার এন্ড ব্রয়লিং দ্যা ফ্রেশকিলড গেম,

সাউন্ডলী ফলিং অ্যাস্লীপ অন দ্যা গ্যাদারড লীভস, মাই ডগ

এন্ড গান বাই মাই সাইড।

যখন নিজের ভাবনায় বুঁদ হয়ে যায় পৃথু তখন ওই ঈগলের মতোই উড়তে উড়তে চলে যায় নিঃসীম শূন্যে। সময়ের হুঁশ থাকে না, পরিবেশের হুঁশ থাকে না।

বিগুর গলা-খাঁকারির আওয়াজে ওর ঘোর ভাঙল।

বিগু টিফিন-ক্যারিয়ার হাতে তৈরি। জামা-কাপড়ও বদলে ফেলেছে। কাঁধে মুসলমান-বাওয়ার্চিদের মতো একটি তোয়ালে ফেলেছে। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। ছেঁড়া হলেও, ধবধবে করে কাচা।

হেসে বলল, আমি এগোলাম। আপনি কখন যাবেন বলব?

আধঘণ্টা পরে রওয়ানা হব। আমার যেতে তো সময় লাগবে। মনে হয় বারোটা নাগাদ পৌঁছব। তুই পৌঁছে দিয়েই চলে আসিস। বেলা হয়ে যাবে। ফিরেই, ঠুঠাকে দিয়ে তুইও খেয়ে নিস।

বিগু চলে গেলে একবার বাথরুমে গিয়েই, পৃথু বেরিয়ে পড়ল কুর্চির বাড়ির দিকে। আস্তে আস্তে বড় রাস্তায় এসে উঠল। কুর্চির বাড়ির দিকের রাস্তায়, বাঁদিকে মোড় নিতে যাবে যখন ঠিক তখনই মার্জিত মেয়েলি গলার আওয়াজে চমকে উঠল ও। পিপ্পুলগাছের নীচের চা আর পানের দোকানের সামনে থেকে এল সেই কণ্ঠস্বর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, স্কুলের দুজন মেয়ে টিচার। কী যেন নাম! তক্ষুনি মনে করতে পারল না।

পৃথুকে হয়তো ওরা তখনও লক্ষ্য করেনি। কিন্তু ওরা লক্ষ্য করার আগেই পৃথু হেসে বলল, কী হচ্ছে, এখানে?

ওঁরা দুজন সমস্বরে হেসে বললেন, গুটকা খাচ্ছি। ছুটি তো! এই দিকে এসেছিলাম কে. রায়ের বাড়ি। আমাদের কলিগ।

পৃথু হেসে এগিয়ে গেল। কুর্চির বাড়ির দিকের পথে মোড় নেবার সময় আরেকবার পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল মেয়েদুটি তাকে নিয়েই হাসাহাসি করছে। কুর্চির বাড়ি যাচ্ছে বলেই হয়তো।

যাকগে। যে যা বলে, ভাবে ভাবুক। এরা সকলেই আসলে ঈগল। একটু সুখ দেখলেই ছোঁ মারতে চায়। দিসাওয়াল সাহেব যেমন বলেছিলেন। মেয়ে দুটিই অবিবাহিত। অথচ বয়স যে হয়নি বিয়ের তাও না। নিজে অভুক্ত থাকলে অন্য কাউকে পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেতে দেখলে রাগ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। সকলেই সুস্থ থাকলে, সকলেরই সবরকম ক্ষিদের পরিতৃপ্তি হলে বড় সুখের হত এই কাল, এই দেশ।

একটু যেতেই বিগুর সঙ্গে দেখা হল। সে বলল, মেমসাহেব বড়ী গোসসেমে হ্যায়। খনা ওয়াপস লে যানেকে লিয়ে কহথী থী। ম্যায় জবরদস্তি ছোড়কে আয়া।

আমি যাব যে, সে কথা বলেছিস তো?

হাঁ।

বলার পরই তো রাগ আরও বেড়ে গেল মেমসাহেবের।

পৃথু একটু বিরক্ত বোধ করল। বিগুর উপরে, কুর্চির উপরে এবং নিজের উপরেও। রাগটাগ নিয়েই তো এত বছর ঘর করে এল, যদি তাকে ঘর করা আদৌ বলে। আর এসব ভাল লাগে না। একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে কুর্চি। কী সামান্য কথা থেকে কী!

বেড়ার দরজা খুলে ঢুকতেই কুন্তীর কুকুরটা কামড়াতে আসবে ভেবেছিল। কিন্তু কোনও সাড়া পেল না তার। মনে পড়ল। কুন্তী বোধহয় তার কুকুরকে সঙ্গেই নিয়ে গেছে।

অতখানি একসঙ্গে হেঁটে হাঁফ ধরে গেছিল পৃথুর। দাওয়ায় কিছুক্ষণ ক্রাচ-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিল ও। কুর্চির ঘর থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ডাকল, কুর্চি, একটু জল খাওয়াবে?

কোনও উত্তর না দিয়ে কুর্চি সামান্য পর একগ্লাস জল হাতে করে এসে দাঁড়াল।

ঢকঢক করে জল খেয়ে, পৃথু চারদিকে তাকিয়ে বসার মতো কিছুই দেখতে পেল না। কুর্চিও খালি গেলাস নিয়ে ভিতরে চলে গেল। কোনও কথা বলল না।

পৃথু ওর পেছন পেছন ঘরে গেল। গিয়ে- বিনা-আমন্ত্রণেই, কাঠের যে হাতলওয়ালা চেয়ারটাতে বসে কুর্চি সেলাই করে, তার উপরে বসে ক্রাচ দুটোকে রাখল পাশে।

কুর্চি খাটের উপর বসে পা-ঝুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। দেওয়ালে এমব্রয়ডারী করা একটি লেখা, পেরেক থেকে ঝুলছে। কাঠের ফ্রেমে কাঁচ দিয়ে বাঁধানো। লেখা আছে: “সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে।”

কী, হল কী তোমার?

পৃথু নরম গলায় বলল।

কী আবার হবে?

রুক্ষ গলায় বলল কুর্চি।

আহত হল পৃথু। এই কুর্চিকে ও কোনওদিনও চিনত না। চিনতে হবে বলে, ভাবেওনি কখনও।

তুমি কিন্তু ঠিক করছ না কুর্চি, তুমি তো ছেলেমানুষ নও।! কী আমি করেছি, যার জন্যে তুমি এমন ব্যবহার করছ আমার সঙ্গে?

তা তো ঠিকই। উ্য আর ওলওয়েজ রাইট! কী আর করেছেন!

চমকে উঠল পৃথু। কুর্চির শরীরের উপরে যেন রুষার রাগি মুখটি বসিয়ে দিয়েছে কেউ। তেমনই নিষ্ঠুর, বিবেচনাহীন, জেদী।

তুমি যদি এমন ব্যবহার করো, তাহলে আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখব না। অবুঝপনা সইবার মতো সহ্যশক্তি আমার আর অবশিষ্ট নেই। অনেকই সয়েছি আমি।

আহা! যেন, আমি কিছুই সইনি। তাচ্ছিল্যের গলায় বলল কুর্চি। তারপর বলল, বাজে মানুষ আপনি। আমার সবকিছু নিয়ে, এখন….।

কথাটা বলতে বলতে কুর্চির গলা ধরে এল।

পৃথু হতভম্ব হয়ে গেল।

বলল, সবকিছু নিয়ে মানে? আমি তো চাইনি। তুমিই তো জোর করে আমাকে কিবুরু বাংলোয় নিয়ে গেলে, তুমিই তো…

আমি? আর এতদিন ভিখিরির মতো কাঙালপনা কে করেছিল?

পৃথু গলা তুলে চিৎকার করে কুর্চির গলাকে ডুবিয়ে দেবে ভেবেছিল। কিন্তু অত্যন্ত শান্তভাবে বলল, সে এই আমি নই; সে আমি অন্য আমি ছিলাম।

হুঁ। এখন কত কিছুই বলবেন। পুরুষ মানুষ মাত্রই ঠগ। বাজে। জোচ্চোর।

কী বলছ কী তুমি? ছিঃ ছিঃ! তুমি এমন ভাষায় কথা বলছ?

বলছি। আপনি আমাকে এখানে জ্বালাতে এলেন কেন? আমি তো চলেই এসেছিলাম। আমার নিজের ঘরেও কী শান্তি পাব না আমি? কেন এলেন?

তুমি না-খেয়ে চলে এলে তাই…

থাক। অনেকেই ভালবাসা দেখিয়েছেন। আর নাইই বা দেখালেন।

হঠাৎই পৃথুর ভালবাসার নরম মনটা প্রচণ্ড ফুঁসে উঠে মনের মধ্যের পাশের দরজাটাকে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে রাগের ঘরে ঢুকে এল। ক্রাচ ছাড়াই, ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মতোও একপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে একলাফে কুর্চির উপর গিয়ে পড়ল। তারপর চিৎকৃত প্রতিবাদের কুর্চিকে চুমুতে চুমুতে কামড়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। তার অজানিতেই তার একটি হাত ওকে চেপে শুইয়ে রাখল শক্ত খাটের উপর আর অন্য হাত ওকে বিবস্ত্র করতে লাগল যন্ত্রদানবের মতো। কবিতা, রবীন্দ্রনাথ, সংস্কৃতি সব গোল্লায় গেল। কুর্চির নাকের পাটা ফুলে উঠল। ফুঁসতে ফুঁসতে ও বলতে লাগল: অসভ্য! ইতর! জানোয়ার! বাজে লোক একটা! জোর করে…

দেখতে দেখতেই রাগের ফোঁসফোঁসানি স্তিমিত হয়ে এসে তা ভাললাগার গোঙানিতে পর্যবসিত হয়ে গেল! কুর্চির মুখ কিন্তু ওই কথাগুলিই বলে যেতে লাগল; অসভ্য! ইতর! জানোয়ার! বাজে লোক! কিন্তু এখন সেই ঘৃণাবাহী শব্দটিই পৃথুর প্রতি এক গভীর ভালবাসার, তার উপর নির্ভরতার প্রতিভূ হয়েই যেন ধ্বনিত হতে লাগল। কুর্চির দুটি হাত পৃথুর পিঠের নীচে মালার মতো নেমে এসে সাঁড়াশির মতো দৃঢ় হয়ে চেপে বসল। ওর চুল এলোমেলো হয়ে গেল। হলুদ শাড়ি আর অফ-হোয়াইট ব্লাউজের খোলসের ভেতর থেকে হিসহিস করা এক বাদামি সর্পিণী বেরিয়ে এল। পৃথুর চোখমুখ গলা কুর্চির সিক্ত ছোবলে দংশিত হতে লাগল।

কতক্ষণ সময় কেটে গেল খেয়াল নেই। এখন দুজনেই দুজনের আলিঙ্গনের মধ্যে যুগল মৃতদেহর মতো শান্ত হয়ে শুয়ে রয়েছে। নগ্ন দুটি হিমেল শরীর। দু চোখ বেয়ে আনন্দধারা বইছে কুর্চির। পৃথুর দু চোখ জ্বলজ্বল করছে নিজের আবিষ্কারের লজ্জা এবং আনন্দেও। বাইরে বৈশাখের ঘোর-লাগা ছায়াচ্ছন্ন দুপুরে ঘুঘু ডাকছে ঘুঘুর-র-র-র ঘু, ঘুর-র-র-র-র, ঘু-উ-উ-উ করে। কাঁচপোকা উড়ছে খোলা জানালার সামনে বুঁ-বুঁ-বুঁ-ই-ই-ই-ই আওয়াজ করে। একটা ক্রো-ফেজেন্ট গম্ভীর স্বরে ছায়াচ্ছন্ন নদীর খোল থেকে ডেকে চলেছে ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব। অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা হাঁপিয়ে-ওঠা সময় যেন এই ঘরে এসে হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে গেছে চার দেওয়ালের মধ্যে।

কারও মুখেই কোনও কথা নেই। ঘরের মধ্যে এখন মৃত্যুর নিস্তব্ধতা। গভীর ভাললাগা এবং এক ধরনের লাগাও ঘিরে আছে দুজনকে।

হঠাৎ ওরা দুজনেই চমকে উঠে যে যার ফেলে-দেওয়া জামা-কাপড়ের দিকে হাত বাড়াল। দেখল, খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ঠুঠা বাইগা। হাতে একটি চিনেমাটির বাসন নিয়ে। তার চোখে লজ্জা নেই, রাগ নেই, অপরাধবোধও নেই। এক আশ্চর্য বিপন্ন বিস্ময়ে সে এই রুক্ষ পৃথিবীর একটি স্নিগ্ধতম দৃশ্যে বিমুগ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে।

যতক্ষণে ওদের দুজনের সম্বিত ফিরেছে, হয়তো ততক্ষণে ঠুঠারও।

যেমন চিতার মতো নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সে এসেছিল তেমনই নিঃশব্দে, ছায়ার মতো সরে চলে গেছে। তার বোবা পশুর মাথার মতো শ্লথ মস্তিষ্কে গ্রীষ্মের মধ্যদিনের পিয়াসী, মুখ হাঁ-করা তিতিরের বুকের ছটফটানিই ভরে নিয়ে ফিরে গেছে সে বেচারি। জল দাও। জল দাও। না বলেই, বলতে বলতে।

কুর্চি জামাকাপড় পরে বারান্দায় গেছিল আগে। ওখান থেকেই বলল, পৃথুদা! পায়েস দিয়ে গেছে। বিগু বোধহয় ভুলে গেছিল।

পৃথু ক্রাচদুটোর জন্যে কুর্চির কাছে হাত বাড়িয়ে হেসে বলল, পরমান্ন। যে যেমন ভাগ্য করে আসে। বেচারি ঠুঠা!

ছিঃ ছিঃ। কী লজ্জা! আর কী কখনও ঠুঠাদাদার চোখে চেয়ে কথা বলতে পারব? কী যে হল আমার? দরজাটা পর্যন্ত বন্ধ করতে ভুলে গেলাম। অবশ্য আমার দোষ কি! সময় পেলাম? অদ্ভুত বাজে লোক আপনি একটা!

ঠিক এই বাক্যটিই বলত রুষা।

একটি বাক্যই অর্থর কত বিভিন্নতা পায় বলার ধরনে! যে তা বলে, তার মুখের ভাবে!

অবাক হয়ে গেল পৃথু।

কুর্চি খাবারগুলো গরম করছিল রান্নাঘরের স্টোভে। পৃথু খাটের উপর আস্ত পা-টি তুলে দিয়ে সেই হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়েছিল।

ও শুনেছিল যে, দম্পতির যত ঝগড়া, মত মতপার্থক্য, যত বাদানুবাদ সবই নাকি নিঃশেষে গলে যায় শোবার ঘরের খাটে। আজকে জানল যে, কথাটা কত বড় সত্যি। কথাটার যথার্থ জেনে যেমন আনন্দিত হল তেমনই দুঃখিত হল এই কথা ভেবে যে, রুষার প্রতি ও খুবই অবিচার করেছে। এত বড় ঝগড়া যদি এত সহজেই মেটে তাহলে এমনি করেই তা ও মেটায়নি যে কেন! অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, রুষার ঔদ্ধত্য, দম্ভ, শীতলতা তাকে কখনওই কুর্চির প্রতি বোধের মতো কোনও বোধে উদ্বুদ্ধ করেনি। যে সাবলীল ঋতিতে এত সহজে উদ্বেলিত হয়ে সব মত-পার্থক্যকে উদ্বায়ু তরল পদার্থের মতোই মূহুর্তে অদৃশ্য করা যায়, সেই ঋতিই ছিল না রুষার। ঈশ্বর জানেন, পৃথুর দোষ নেই। দোষ নেই।

রান্নাঘর থেকে কুর্চি বলল, কি? খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে তো!

নাঃ। কত কী তো খেলাম একটু আগে।

আপনি সত্যিই ভীষণ অসভ্য!

পৃথু জবাব দিল না।

মনে মনে বলল, হইই না একটু। সভ্যতাতে সতত বড়ই নিষ্পেষিত, ক্লিষ্ট আছি গো আমি। সভ্যতার হাল্কা আবরণকে, এসো, আমরা জীবন-গন্ধী হওয়ায়, দুজনে তার দু কোণ ধরে উড়িয়ে দিই। কোনও নবীন কিশোরের অনভিজ্ঞ হাতের চাঁদিয়াল ঘুড়ির মতো ভো-কাট্টা হয়ে ভেসে যাক এই আবরণ সাতপুরা পর্বতমালার সবুজ সুগন্ধি বুকের দিকে। এত হাজার বছরেও তথাকথিত সভ্যতার আস্তরণটি যদি যথেষ্ট পুরু না হয়ে থাকে, তার দোষ তো আমার বা তোমার নয়!

মুখে কিছুই বলল না ও কুর্চিকে।

আজ সকাল থেকেই ওয়াল্ট হুইটম্যানে পেয়েছে পৃথুকে। কাউকে কাউকে যেমন ভূতে পায়, পৃথুকে এক একদিন এক একজন কবিতে পেয়ে বসে। কবির ভূত-ছাড়ানো ওঝা কোথায় যে থাকে, কে জানে?

“কাম ক্লোজার টু মী,

পুশ ক্লোজ মাই লাভারস এন্ড টেক দ্যা বেস্ট আই পজেস

ঈল্ড ক্লোজার এন্ড ক্লোজার এন্ড গিভ মী দ্যা বেস্ট উ্য পজেস।”

কুর্চি সব খাবার, দুটি প্লেট, চামচ এবং জল নিয়ে এল এ ঘরে। বলল, আপনি এই টেবলের সামনে বসে খান, আমি টুলটা নিয়ে ওপাশে বসি।

বাঃ। দারুণ রেঁধেছে কিন্তু বিগু পোলাউটা। অনেকদিন এমন মিষ্টি বাঙালি পোলাউ খাইনি। আমার মা বড়ই ভাল রাঁধতেন এই পোলাউ। খাসির রেজালাটাও খুব ভাল করেছে, তাই না? ছেলেটার রান্নার হাত ভাল। যা করে; ভালবেসে করে।

পোলাউটা আমিই ওকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। ওর মুসলমান মালিকের কাছে থেকে এই পোলাউ রাঁধতে ও জানবে কী করে? আমার ব্যবসাটা ধরে যাক। দেখবেন, আপনাকে এত ভাল ভাল পদ রেঁধে খাওয়াবে যে মোটা করে দেবে।

মোটা কাউকেই করতে হবে না। আমার বাবা মা দুজনেই মোটা ছিলেন। চল্লিশে পা দিলেই দেখবে জল খেলেই মোটা হয়ে যাচ্ছি।

কেউ কেউ যেমন হাতি খেয়েও রোগা থাকে। কনস্টিট্যুশান বলে কথা।

পৃথু যখন খেতে খুবই ব্যস্ত, কুর্চি বলল, এখন আমি ফিবে যাব কী করে আপনার সঙ্গে। ভারী লজ্জা করবে আমার। ঠুঠাদার কাছে তো বটেই, বিগুর কাছেও। রাগ দেখিয়ে চলে এলাম।

যাওয়ার দরকার কী? তুমি গেলে তো ঠুঠারও এখানে এসে বাড়ি পাহারা দিতে হবে। তার চেয়ে আমিই এখানে থাকব আজ তোমার সঙ্গে।

এত ঘন ঘন একসঙ্গে বোধ হয় না থাকাই ভাল।

কুর্চি বলল। মুখ নামিয়ে।

কেন?

কেন, তা আপনি জানেন না?

কথা ঘুরিয়ে পৃথু বলল, তুমি কিচ্ছু খাচ্ছ না, শুধু কথাই বলছ। ভাল করে খাও।

আমি কমই খাই।

তাইই তো নিজেকে এমন সুন্দর রেখেছ।

লাভ কী হল? আপনার চোখে তো আমি চিরদিনই সুন্দর। এসব ঢঙের কথা তখন কোথায় ছিল? ভাঁটুকে তো শখ করে বিয়ে করিনি।

ওসব কথা থাক।

পৃথু ভাবছিল, কুর্চি ঘন ঘন থাকার কথা ঠিকই বলেছে। ও তার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ভাবছে। যাকে ভালবাসা যায়, তাকে দূরে রাখাই ভাল। তার সঙ্গে অনেকদিন পর পর দেখা হওয়া ভাল। মনোমালিন্যটা আপাতত মিটে গেল বটে কিন্তু পৃথুর মন বলছে আর কিছুদিন কুর্চির সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা চললে সত্যি সত্যিই তার কুর্চি আর কুর্চি থাকবে না। অন্য একজন রুষা হয়ে যাবে। বড় বেশি কাছাকাছি এলে, থাকলে, কোনও মেয়েকেই ভালবাসা যায় না আর।

রুষাকে যে দেখত সেইই তার প্রেমে পড়ত, প্রেম ছিল না শুধু পৃথুরই, যে মানুষটি তার সঙ্গে ঘর করত। প্রেমও বোধহয় এক ধরনের খেলা। এই খেলা লং-পাস-এ খেলতে হয়। কাছাকাছি এলেই ফাউল হবার সম্ভাবনা।

ইদুরকার আর রুষার সম্পর্ক এখন কেমন হয়েছে কে জানে? লং-পাস-এ না খেললে ফ্রি-কিক-এ গোল খাবে ইদুর। আশ্চর্য! পৃথুর যে একটা অতীত জীবন ছিল সে কথা আজকাল প্রায় মনেই পড়ে না। কোনদিন যে সেই জীবনেরই মতো তার ডান পাটাও নিটোল, আস্ত ছিল, সে কথাও যেন মনে পড়ে না। আসলে, সব বিচ্ছেদই বোধহয় সময়ে সয়ে যায়। মানুষের মতো অ্যাডাপ্টেবিলিটির ক্ষমতাসম্পন্ন অন্য কোনও প্রাণীই বোধহয় পৃথিবীতে নেই। একমাত্র তেলাপোকা ছাড়া।

কী ভাবছেন? খেতে খেতেও এত কী ভাবেন? বেশি যারা ভাবে, তারা জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। আপনার এই অদ্ভুত স্বভাবই আপনার সব দুঃখের মূলে।

হয়তো!

হয়তো নয়, তাইই। মুহূর্তে মুহূর্তে নিজেকে এমন কনট্রাডিক্ট করতে আমি কোনও মানুষকেই দেখিনি।

পৃথু হেসে বলল, তুমিই তো বলছিলে না সকালে ইনকনসিসটেন্সী ভাইসও বটে; ভার্চুও বটে।

ইনকনসিসটেন্সী অনেকই নরম কথা। আপনি সেল্ফ-কনট্রাডিক্টরী।

হয়তো! আমারও তাইই মনে হয়।

আপনার মতো পাগলের সঙ্গে ওয়েভ-লেংথ-এর মিল খুব কম লোকেরই হওয়া সম্ভব।

অন্যদের আমার দরকার কি? তোমার সঙ্গে মিললেই হল। তোমার ওয়েভ-লেংথ-এর হদিসটা যদি দাও তাহলে মনের নব ঘুরিয়ে মিলিয়ে নেব এখন তোমার স্টেশনের সঙ্গে।

হাসল কুর্চি।

বলল, কথায় পারব না আপনার সঙ্গে। এখন খান।

পৃথু মনে মনে আবৃত্তি করল। খাওয়া থামিয়ে হুইটম্যানই:

“ডু আই কনট্রাডিক্ট মাইসেল্ক?

ভেরী ওয়েল দেন… আই কনট্রাডিক্ট মাইসেল্ফ,

আই অ্যাম লার্জ…আই কনটেইন মালটিচ্যুডস।”

একটা হাড়ের মধ্যের সুরুয়া সুড়ৎ করে চুষে হাড়টি সাইড প্লেটে রেখে পৃথু নিঃশব্দে বলল: আই রিয়্যালী ডু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *