মানিকতলায় দ্বারিকার বাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে আছে ইরফান আর ভরত। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, দু’জনেরই শরীর বেশ লঘু, নিঃশ্বাস সাবলীল। সন্ধে থেকেই বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে, এখন রাত প্রায় আটটা, ভরতের বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা নেই, তাতে আজ রান্নাও করতে হবে না, সে আজ এখানেই খেয়ে যাবে। দ্বারিকা এই বাড়িতে প্রেসিডেন্সি কলেজের পাঁচটি ছাত্রকে আশ্রয় দিয়েছে, তা ছাড়াও অনেকে আসে, সুবিধাজনক জায়গায় এই বাড়িটি একটি প্রকৃষ্ট আড্ডাখানা।
আজ অবশ্য ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই, কয়েকজন পরীক্ষার পর দেশের বাড়িতে গেছে, দ্বারিকা বেরিয়েছে নৈশ অভিযানে। অন্যদিনের মতন আজও দ্বারিকা ভরতকে ধরে খুব টানাটানি করেছিল, ভরত অতিকষ্টে ছাড়িয়ে নিয়েছে নিজেকে। সে কিছুতেই বসন্তমঞ্জরীর কাছে যেতে চায় না, এমন কি বসন্তমঞ্জরীর নাম শুনলেই সে আড়ষ্ট বোধ করে। বসন্তামজীরী নাকি ভরতের সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যাকুল, দ্বারিকা প্রায়ই বলে এ কথা, কে জানে সে সত্যি কথা বলে কি না! বসন্তমঞ্জরী কেন ব্যাকুল হবে ভরতের জন্য, ভরত তো তার কেউ নয়, একদিন মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল। বসন্তমঞ্জরী নাকি এ কথাও বলেছে, এর মধ্যে সে আবার স্বপ্নে দেখেছে ভরতকে। একটা প্ৰকাণ্ড জলাশয়, এপার ওপার দেখতে পাওয়া যায় না, নিকষ। কালো জল, সেখানে ভরত আঁকুপাকু করতে করতে ডুবে যাচ্ছে, কাছাকাছি কেউ নেই। হুঁ, স্বপ্ন! স্বপ্নের আবার মাথামুণ্ডু আছে নাকি? আর যাই হোক, ভরত কখনও জলে ডুবে মরবে না, সে সাঁতার ভালোই জানে, এখনও মাঝে মাঝে আহিরীটোলার ঘাটে গঙ্গায় কাটতে যায়। দ্বারিকার ধারণা ভবিষ্যৎ দেখতে পায় বসন্তমঞ্জরী!
দ্বারিকা অবশ্য ইরফানকে কখনও বউবাজারের এ বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য জোর করে না।
বৃষ্টির তোড়ে নিবে গেছে রাস্তার গ্যাসের বাতি, চারদিক ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। এদিকে বড় বাড়ি বিশেষ নেই, সবই বস্তি। বেশ খানিকটা দূরে শুধু একটি বাড়ি ঝলমল করছে অত্যুজ্জ্বল আলোয়। বোধহয় ওটা বিয়েবাড়ি, ইদানীং ডায়নামো নামে কী একটা বস্তুর সাহায্যে বিজলি বাতি জ্বালানোর চল হয়েছে, ওতে বড় বেশি আলো।
মদ্যপান একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে ভরত, ইরফান কোনওদিনই স্পর্শ করেনি, তবে দু’জনেরই চুরুট সম্পর্কে দুর্বলতা আছে। দু’জনের মুখে চুরুটের আঁচ। রাস্তায় কিছুই দেখা যায় না, শুধু মাঝে মাঝে শোনা যায় মানুষের কলকলানি, ঘোড়ার গাড়ির কপাকপ শব্দ আর সহিসের চিৎকার।
পরীক্ষার পরের ছুটির সময় ভবিষ্যতের চিন্তা সব সময় মাথা জুড়ে থাকে। ভরত এম এ ক্লাসে ভর্তি হবে ঠিক করে ফেলেছে, সেই সঙ্গে আইনটাও পড়ে রাখবে। কোনও চাকরির কথা এখন সে ভাবতেও পারে না। যতদূর সম্ভব সে পড়াশুনোই করে যাবে। ইরফানকে ফিরে যেতে হবে বহরমপুরে। সে এর মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছে, তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, এখন একটা সাংসারিক দায়িত্ব এসে পড়েছে তার ঘাড়ে। ইরফানের শ্বশুর বহরমপুর আদালতের পেশকার, তিনি ইরফানের জন্য সেখানে একটা কাজ ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু ইরফান ফেরার জন্য উদগ্রীব নয়, ছাত্রজীবন ছেড়ে যেতে কার মন চায়? দ্বারিকা তাকে এ বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ায় তার ব্যক্তিগত খরচ-পত্রের সমস্যা দূর হয়ে গেছে, তা ছাড়া অধ্যাপক ব্ৰাউন সাহেব ইরফানকে বিশেষ স্নেহ করেন, তিনি ইরফানের এম এ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেবার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু নিজের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়াটাই তো যথেষ্ট নয়, বাড়িতে সে টাকা পাঠাবে কী করে?
ইরফান একটা দো-টানার মধ্যে আছে। তার বহুকালের বিশ্বাস ও সংস্কারে একটা প্ৰবল ধাক্কা লেগেছে। তার মূলেও রয়েছেন অধ্যাপক এডগার বি ব্রাউন সাহেব। অধ্যাপক ব্ৰাউন দর্শন পড়ান, খুব নম্র ও ছোটখাটো মানুষ, ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। ভদ্রলোক বিয়ে-থা করেননি, পড়া ও পড়ানোই তার নেশা। এই ধরনের শান্ত স্বভাবের মানুষরাই হঠাৎ এক একদিন সাঙ্ঘাতিক ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন, তখন আর তাঁদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এই দর্শন বিভাগেরই আর একজন অধ্যাপক জর্জ ও’কন্নোর ব্ৰাউন সাহেবের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। তাঁর লম্বা চওড়া চেহারা, সুবক্তা, পড়বার সময় তাঁর গলার আওয়াজ এমনভাবে ওঠা-নামা করে, যে তাঁকে একজন পাকা অভিনেতা মনে হয়। গোটা বাইবেলটাই তাঁর মুখস্থ, যখন তখন যে-কোনও জায়গা থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারেন। এই দুই অধ্যাপকের মধ্যে একদিন প্রবল ঝগড়া হয়েছিল, ঝগড়া করতে করতে দু’জনে অধ্যাপকদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বারান্দায়, তাদের চোখের দৃষ্টি এমনই যে, হাতে অস্ত্র থাকলে দু’জনে তখুনি ডুয়েল লড়ে যেতেন। দূর থেকে ছাত্ররা স্পষ্ট শুনেছে, ঝগড়ার মধ্যে ও’কন্নোর সাহেব দু’তিনবার স্কাউন্ড্রেল শব্দটি উচ্চারণ করেছেন এবং মৃদুভাষী ব্রাউন সাহেব দাঁত কিড়মিড় করে বলেছেন, স্টুপিড, ব্লকহেড!
প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকদের এরকম ব্যবহার কল্পনাই করা যায় না। এই ঝগড়ার সময় অন্য কোনও অধ্যাপক ওঁদের ছাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেননি, চুপ করে ছিলেন সবাই। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়েছিল।
শিক্ষা দফতরের অধিকর্তা জন রীড এসেছিলেন তদন্ত করতে। দু’জনেই যদিও গালাগালি উচ্চারণ করেছিলেন, কিন্তু বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেন অধ্যাপক ব্ৰাউন। কারণ, ও’কন্নোর নাকি স্কাউন্ড্রেল বলেছিলেন ডারউইন নামে একজন অনুপস্থিত সাহেবের উদ্দেশে, আর ব্ৰাউন গালাগালি দিয়েছেন সরাসরি তাঁর সহকর্মীকে। ব্ৰাউনকে পনেরো দিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়, তারপর তিনি লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
আসল ঝগড়াটা কী কারণে হয়েছিল, তা ছাত্রদের মধ্যে জানে শুধু ইরফান। একমাত্র সে-ই ব্ৰাউন সাহেবের বেন্টিস স্ট্রিটের বাড়িতে যাওয়া-আসা করে। ব্ৰাউন সাহেব প্রকৃত দার্শনিক, রাস্তা দিয়ে চলার সময়েও থাকেন অন্যমনস্ক, একদিন তিনি চুরুট টানতে টানতে হাঁটছেন, একটা রাস্তা পার হবার সময় মাঝ রাস্তায় তাঁর চুরুট নিবে গেল, তিনি সেখানেই দাড়িয়ে চুরুট ধরাতে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গায়ের ওপর হুড়মুড় করে এসে পড়ল একটা জুড়ী গাড়ি। বড় বড় আরবি ঘোড়ার পায়ের চাটে এই অবস্থায় মানুষ মরেও যায়, অধ্যাপক ব্রাউনেরও মারাত্মক কিছু ঘটতে পারত, কিন্তু দৈবাৎ সেই সময় ইরফানও পার হচ্ছিল সেই রাস্তা। সে বিদ্যুৎ গতিতে ব্ৰাউন সাহেবের দু’কাঁধ চেপে ধরে এনে, পাঁজা কোলা করে ছুটে চলে এসেছিল এক পাশে।
প্ৰাণে বেঁচে গিয়ে একটু ধাতস্থ হবার পর ব্ৰাউন সাহেব ইরফানের আপাদমস্তক দেখলেন, ইরফান তাঁর ছাত্র নয়, তিনি তাঁকে চেনেন না। তিনি একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। ইরফানের চোখে চোখ রেখে তিনি খানিকটা কঠোর ভাবে বললেন, ইয়ংম্যান, নিজের প্রাণ বিপন্ন করেও তুমি আমাকে উদ্ধার করতে গেলে কেন? আমি একজন ইংরেজ বলে? অন্য কোনও দিশি লোক হলে তুমি এতটা ঝুঁকি নিতে?
ইরফান বলল, আমি দেখলাম ঘোড়া দুটোর একেবারে পায়ের কাছে একজন মানুষ, আমি কিছু চিন্তাই করিনি, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আপনাকে আমি তখন চিনতেও পারিনি, স্যার।
ব্ৰাউন সাহেব মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, উহু, ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমি আগে অনেকবার দেখেছি। এ দেশের কোনও লোক যখন বিপদে পড়ে, তখন অন্য কেউ তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। আমি ইংরেজ, তুমি কি আমার কাছ থেকে কোনও পুরস্কার আশা করেছিলে?
এ ধরনের কথায় আহত বোধ করে ইরফান আর কোনও কথা না বাড়িয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করেছিল। তখন ব্ৰাউন সাহেব দ্রুত এসে তার একটা হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, তুমি যখন আমায় এতটাই সাহায্য করলে, এরপর আমাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দেবে না? দেখছ না, আমার ঘাড়ে ও পিঠে গভীর ক্ষত হয়েছে, সেখান থেকে রক্তপাত হচ্ছে।
তারপর থেকেই ব্ৰাউন সাহেবের সঙ্গে ইরফানের বন্ধুত্ব। ইরফান প্রায়ই ব্ৰাউন সাহেবের বাড়িতে যায়, তিনি নিজের হাতে নানারকম রান্না করে ওকে খাওয়ান। এক আকস্মিক দুর্ঘটনার সূত্রে এই বন্ধুত্ব, তার ফলে ইরফানের মনোজগতে এক বিপর্যয় শুরু হয়ে গেছে, সে কথা সে অন্য কারুকে বলতে পারেনি এতদিন, আজ সে একা পেয়েছে ভরতকে।
বারান্দায় রেলিংয়ে পা তুলে দিয়ে, চুরুট টানতে টানতে চুপচাপ বৃষ্টির কনসার্ট শুনছে ভরত। ইরফান এক সময় তাকে জিজ্ঞেস করল, ভরত, তুই চার্লস ডারউইনের নাম শুনেছিস?
ভরত ভুরু কুঁচকে একটু চিন্তা করে বলল, ছাপার অক্ষরে কোথাও নামটা দেখেছি। বোধহয় ইংলিশম্যান পত্রিকায়। উনি কি আমাদের কলেজে পড়াতে আসছেন?
ইরফান বলল, না, না, উনি কখনও এ দেশে আসনেনি, মারা গেছেন বছর চারেক আগে। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী।
— হঠাৎ সেই লোকটার কথা কেন?
— গত এক মাস ধরে ক্রমাগত এই নামটা আমার মাথায় ঘুরছে। ডারউইন যা বলেছেন, তা যদি সত্যি হয়, তা হলে এতকাল ধরে আমরা যা সত্যি বলে জেনে এসেছি, তা সব মিথ্যে।
— কী বলেছেন তিনি?
— ডারউইন বলেছেন, এই যে জীবজগৎ এই যে সব গাছপালা, পশু-পাখি, মানুষ, এর কিছুই আল্লা সৃষ্টি করেননি। আমরা মনে করি আল্লা, তোরা মনে করিস ভগবান আর খ্রিস্টানরা মনে করে গড়।কিন্তু ডারউইন বলেছেন, কোনও পরমেশ্বরই এসব সৃষ্টি করেননি, প্রকৃতির সব কিছুই নিজস্ব সৃষ্টিই বিবর্তনবাদ নামে উনি একটা তত্ত্বের কথা বলেছেন, মানুষ ও প্রাণিজগৎ সেই বিবর্তনবাদের মধ্য দিয়েই চলেছে, সেখানে পরমেশ্বরের কোনও ভূমিকাই নেই।
— একটা কোন ছোটখাটো বৈজ্ঞানিক কিছু একটা তত্ত্ব দিলেই তো মানতে যাব কেন?
— শুধু তত্ত্ব নয়, উনি প্রমাণ দিয়েছেন। এমন ভাবে প্রমাণ দিয়েছেন যে কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেখ ভরত, এখন সাদা লোকদের রাজত্ব। তোর-আমার মতন হিন্দু-মুসলমানদের কোনও গুরুত্ব নেই, আমরা শক্তিহীন, খ্রিস্টানরাই ছড়ি ঘোরাচ্ছে সারা পৃথিবীতে, আমাদেরও খ্রিস্টানি বিশ্বাসকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিতে হয়। সেই খ্রিষ্টানদের মধ্যেও ডারউইন তত্ত্ব নিয়ে দারুণ গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। ডারউইনের কথা মানতে গেলে বলতে হয়, বাইবেল মিথ্যে!
– অ্যাঁ!
– বাইবেল কী আছে? ঈশ্বর প্রথমে এই সৃষ্টি করলেন। তারপর ছ’দিন ধরে এই পৃথিবীর যাবতীয় তরুলতা, প্রাণী ও পোকামাকড় বানালেন, মানুষকে সৃষ্টি করলেন নিজের আদলে। তাই তো? মহা শক্তিমান এবং মহান শিল্পী এই ঈশ্বর এত কিছু তৈরি করে ফেললেন মাত্ৰ ছ’দিনে। আমাকে ব্ৰাউন স্যার বলেছেন, দু’জন পাদ্রি নাকি বাইবেল অনুযায়ী হিসেব করে দেখিয়ে দিয়েছে যে খ্রিস্টানদের ঈশ্বর নাকি প্রাণ সৃষ্টি সম্পূর্ণ করেছিলেন ২৩ অকটোবর, খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার চার সালে। তার মানে কত হল, চার হাজার চার আর এখন আঠেরো শো ছিয়াশি, যোগ করলে হয় পাঁচ হাজার আটশো নব্বই। তা হলে কি পাঁচ হাজার আট শে নব্বই বছর আগে মানুষটানুষ কিছু ছিল না? পৃথিবীরই অস্তিত্ব ছিল না?
–যত্ত সব গাঁজাখুরি কথা। অবশ্য ওই পাদ্রিদের হিসেবও ভুল হতে পারে।
—তাহলেই তো বাইবেলকে ভুল বলতে হয়। স্যার আমাকে বললেন, তোমাদের ইসলাম ধর্মের বয়েস তেরো শো বছর। হজরত মহম্মদ আল্লার বাণী প্রচার করলেন। সেই আল্লাও সর্ব শক্তিমান। মানুষের পাপ-পুণ্যের নিয়ামক। তা হলে তের শো বছর আগেকার মানুষগুলোকে সৃষ্টি করল কে, কিংবা এতদিন আল্লা কোথায় ছিলেন?
—মানুষের বয়েস যদি বাইবেলের মতে পাঁচ হাজার আটশো নব্বই বছর হয়, তা হলে তো প্রথম চার হাজার বছর কোনও খ্রিস্টান ছিল না, খ্রিস্টানদের গড়ও ছিলেন না। কোথায় লুকিয়ে ছিলেন তিনি? বৌদ্ধ ধর্ম আরও পুরনো। গৌতম বুদ্ধ জন্মেছিলেন প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, তার প্রমাণ আছে, হিন্দু ধর্ম তারও আগে, কারণ হিন্দ ধর্ম থেকে বেরিয়ে এসেই বুদ্ধ তার প্রচার করেছিলেন।
– হিন্দু ধৰ্মও বা কত আগে? বড় জোর ছ’সাত হাজার। খ্রিস্টানদের মতে যখন পৃথিবীর সৃষ্টিই হয়নি, মানুষও জন্মায়নি, তখনও পৃথিবী দিব্যি আছে, হিন্দুরা এখানে গিসগিস করছে। চিনেম্যানরা আছে। আরব-পারস্যেও মানুষ আছে, সবাই পুতুল পুজো করছে। তারও হাজার হাজার বছর আগে মানুষ ছিল, তাদের কোনও ধর্মও ছিল না, ঈশ্বরও ছিল না।
-পাহাড়ের গুহায়, বনে জঙ্গলে মানুষ বাস করত। পাথরের অস্ত্র দিয়ে পশু শিকার করে আগুনে ঝলসে খেত। তাদের কোনও ভগবান ছিল না বোধহয়! আমারও তাই ধারণা।
-এই চার্লস ডারউইন ইংল্যান্ডের এক ডাক্তারের ছেলে। প্রথমে তিনিও ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন, মন বসেনি। তারপর তাঁর বাবার ইচ্ছে হল, ছেলে পাদ্রি হোক, চার্লসকে তিনি ধর্মতত্ত্ব পড়তে পাঠালেন। এই সময়ে, ডারউইনের যখন বাইশ বছর বয়েস, তখন তিনি একটি জাহাজে ঘোরার আমন্ত্রণ পেলেন। ব্রিটিশ সরকার এই সময় বিগল নামে একটা জাহাজ-পাঠাচ্ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল আর প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু কিছু দ্বীপ সার্ভে করার জন্য। সেই জাহাজে নানা রকম লোকজন ছিল, ডারউইনকে নির্বাচন করা হল প্রকৃতি-বিজ্ঞানী হিসেবে। ডারউইনের গাছ-পালা, কীট-পতঙ্গ সম্পর্কে বরাবরই ঝোঁক ছিল, তার বন্ধুবান্ধবরা জানত। অবশ্য তুই ভাবতে পারিস, এই কাজে ডারউইনের মতন এক অল্পবয়েসী ছোকরা আর নিতান্ত শখের বিজ্ঞানীকে বাছা হল কেন? তার কারণ, জাহাজটা সমুদ্রে ভাসবে পাঁচ বছর ধরে, কোনও বিজ্ঞানীকেই মাইনে দেওয়া হবে না। বিনা মাইনেতে কে যেতে চায়! ডারউইন বড়লোক ডাক্তারের ছেলে… পাঁচ বছর ধরে, বহু দ্বীপ ঘুরে ঘুরে ডারউইন অনেক জন্তু-জানোয়ার, পোকা-মাকড়, লতা-পাতা সংগ্রহ করে আনেন। তারপর সেগুলো নিয়ে গবেষণা করতে করতে অনেক বছর পরে একটা বই লেখেন। বইটার নামটা খুব লম্বা, সংক্ষেপে বলা যায় ‘দা অরিজিন অফ স্পিসিজ’। ব্ৰাউন স্যারের কাছে এই বইটা আছে। আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। তুই পড়ে দেখবি?
-কী আছে সেই বইতে?
—সহজে বোঝা যায় না। মোট কথা, তার মধ্যেই রয়েছে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব। জন্তু-জানোয়ার, আর মানুষের চেহারা চিরকাল এক রকম ছিল না। পরিবেশ অনুযায়ী বদলেছে। অনেক প্রাণী হারিয়ে গেছে চিরতরে। তোদের ভগবান, আমাদের আল্লা, খ্রিস্টানদের গড কিংবা কোনও ধর্মেরই সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছেতে মানুষের সৃষ্টি হয়নি। বিবর্তনের ধাক্কায় মানুষ এসেছে বাঁদরের মতন এক প্রাণী থেকে। এই কথা বলাতেই তো ও’কন্নোর সাহেব আমাদের ব্ৰাউন সাহেবকে প্রায় মারতে গিয়েছিলেন।
—হ্যাঁ রে, ইরফান, ব্ৰাউন সাহেব তো দর্শন পড়ান, তিনি বিজ্ঞান নিয়ে এত মাথা ঘামান কেন!
-স্যার বলেন, এ যুগে বিজ্ঞান না পড়লে দর্শন, কাব্য-সাহিত্য কিছুই ঠিক মতন উপলব্ধি করা যাবে না। তাছাড়া ডারউইনের তত্ত্বে দর্শন নেই। এই আমাদের জগৎ থেকে ঈশ্বরের ভূমিকা তিনি উড়িয়ে দিলেন একেবারে।
—বাইবেল-বিরোধী কথা বলার জন্য গ্যালিলিওকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। জিয়ার্দানো ব্রুনো নামে আর একজন পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ডারউইন সাহেব ঈশ্বরকে উড়িয়ে দিয়েও পার পেলেন কী করে? কেউ তাকে খুন করতে যায়নি!
—দেখ, চার্চের সেই ইনকুইজিশানের যুগ তো আর নেই। এটা আধুনিক যুগ। বিজ্ঞানের যুগ। এখন কেউ কারুকে পুড়িয়ে মারে না। বিজ্ঞানে নিছক বিশ্বাস কিংবা ভয়-ভক্তির কোনও স্থান নেই, স্বয়ং ঈশ্বরের আদেশ হলেও তা মানা হবে না, চাই যুক্তি এবং প্রমাণ। ডারউইনের ওপর প্রচুর লোক খড়গহস্ত হয়েছে, গির্জার পাদ্রিরা তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। তর্কাতর্কি, গালমন্দ হয়েছে প্রচুর, অধ্যাপক ও’কন্নোর যেমন এখনও গালাগালি দিচ্ছেন, কিন্তু পৃথিবীর আশি ভাগ বৈজ্ঞানিক ডারউইনের যুক্তি-প্রমাণ মেনে নিয়েছেন। বিজ্ঞানের জগতে একটা বিপ্লব এসে গেছে বলতে পারিস! ডারউইনের বই হাজার হাজার সাধারণ মানুষও পড়ে, বাইবেল সম্পর্কে এতকালের বিশ্বাস অনেকেরই ভেঙে যাচ্ছে।
—ইরফান, তোদের কোরান সম্পর্কে যদি কেউ বলত, তার মধ্যে ভুল আছে, তা হলে সেই লোকের অবস্থা কী হতো?
-সে খুন হয়ে যেত! আমাদের মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানী কোথায়? তোদের হিন্দুদের মধ্যেও বিজ্ঞানী কতজন আছে? আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে তো আমরা শিশু। এখনও কতকগুলো অন্ধ বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে বসে আছি। দেড় হাজার দু’হাজার বছরের পুরনো ধর্মগ্রন্থের বাণীগুলোকে আমরা অমোঘ সত্য বলে মনে করি, সেই অনুযায়ী সমাজ চলে!
—এসব কথা তুই ব্ৰাউন সাহেবের কাছে শিখেছিস? সে যাই হোক, এগুলো পশ্চিমি জগতের ব্যাপার, এসব কথা নিয়ে তুই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন, ইরফান?
—কয়েকটা ব্যাপার আমার মাথায় এমন ভাবে গেঁথে গেছে যে ভুলতে পারছি না কিছুতেই। ডারউইন সাহেবের আর একটা তত্ত্ব হচ্ছে স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স। পৃথিবীতে যত মানুষ জন্মায়, পঁচিশ বছরে তার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। কোনও কোনও প্রাণীর বংশবৃদ্ধি এর চেয়েও অনেক বেশি। এইভাবে বাড়তে থাকলে সকলের খাদ্য জোটানো অসম্ভব, পৃথিবীতে পা ফেলারও জায়গা থাকত না। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প, যুদ্ধে বহু মানুষ ও প্রাণী মারা যায়। এর মধ্যে যারা বাঁচে, তারাই টিকে থাকে। সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট! সমস্ত প্রাণীর মধ্যে অবিরাম জীবনযুদ্ধ চলছে, যারা জয়ী হয়, শুধু তাদেরই অধিকার আছে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার। এটা ঠিক নয়?
— মনে তো হয় ঠিকই।
-এর তাৎপর্য বুঝতে পারলি না! তা হলে ঈশ্বর বা আল্লা যে পিতার মতন আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করছেন বলে এতকাল জেনে এসেছি, তাও ঠিক নয়? মানুষের সৃষ্টির সঙ্গেও আল্লার কোনও সম্পর্ক নেই, মানুষের বাঁচা মরার সঙ্গেও আল্লার কোনও সম্পর্ক নেই।
— নাই বা থাকল, তা নিয়ে এত উতলা হবার কী আছে?
– তুই আমার বিপদ বুঝতে পারছিস না ভরত! আমি ফিরে যাব মুর্শিদাবাদে, আমার নিজের সমাজে। সেখানে সবাই কোরান হাদিসের প্রতিটি বাক্য ধ্রুব সত্য বলে মনে করে। ভক্তি ভরে পাঁচ ওকত নামাজ পড়ে, রোজার মাসে সারাদিন মুখে এক ফোটা জল পর্যন্ত নেয় না। মৌলভি সাহেবের নির্দেশ সেখানে ইংরেজ সরকারের আইনের চেয়েও বড়। তার মধ্যে আমি থাকব কী করে? আমার যে বিশ্বাস টলে গেছে। অবিশ্বাসের কথা আমি মুখ ফুটে বলতেও পারব না। তোদের হিন্দুদের মধ্যে তবু নাস্তিকের স্থান আছে, আমাদের সমাজ নাস্তিককে একেবারে সহ্য করে না। তোকে আমি যা বললাম, এসব কথা অন্য কারুর সামনে বলার সাহসও আমার নেই! আমি এখন কী করি বল তো? নিজের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে গিয়ে সৰ্বক্ষণ মুখ বুজে থাকব!
—তোকে এবার আমার কথা বলি, ইরফান। হিন্দুর বাড়িতে জন্মেছি, চার পাশের মানুষজনকে দেখে দেখে আমার মধ্যেও সব রকম হিন্দু সংস্কার দানা বেঁধেছিল। ঠাকুর দেবতার মূর্তি দেখলে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতাম। তারপর আমার জীবনে একজন এলেন, আমার প্রথম শিক্ষক, আমার শ্ৰেষ্ঠ গুরু, পৃথিবীতে আমি তাকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি, তাঁর নাম শশিভূষণ সিংহ। তিনি আমাকে একটু একটু করে বোঝালেন যে, এই যে সব দুর্গাঠাকুর, শিব, বিষ্ণু, গণেশ, কালী এই সব মূর্তি, এর কোনও কিছুর মধ্যেই ঈশ্বরের প্রকাশ নেই। সবই মানুষের কল্পনা, সেই কল্পনা দিয়ে মানুষ কতকগুলো পুতুল বানিয়ে পুজো করে। প্রথম যেদিন তিনি বলেছিলেন যে, মা কালীর মন্দিরের মা কালী জাগ্রত নন, শুধুই একটা পাথরের মূর্তি, সেদিন সেই অবিশ্বাস আমি সহ্য করতে পারিনি, মনে হয়েছিল যেন আমার মাথাটাই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তারপর আস্তে আস্তে বুঝেছি, আন্তে আস্তে ভয় ভেঙেছে। বহু যুগের-সংস্কার এক পুরুষে ভাঙা সহজ কথা নয়।
—তোদের হিন্দুদের এই সব বিশ্বাসের থেকে কিন্তু ইসলাম অনেকখানি এগিয়ে। আমাদের পয়গম্বর এসে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পুতুল টুতুল পুজো করা অর্থহীন। আল্লা নিরাকার, বর্ণনার অতীত। তুই কিছু মনে করিস না ভরত, ছোটবেলা থেকেই হিন্দুদের এই মাটি-খড় দিয়ে মূর্তি বানিয়ে পুজো করা দেখলে আমার হাসি পেত। যেন বাচ্চাদের পুতুল খেলা। অথচ বয়স্ক মানুষরাও পূজো করতে গিয়ে কেঁদে ভাসায়।
—সব হিন্দুই পুতুল পুজো করে না। নিরাকার পরমব্রহ্মের তপস্যাও বহু যুগ ধরে চলে আসছে। এখনকার ব্ৰাহ্মরা যে পরমব্রহ্মের কথা বলেন, তার সঙ্গে তোদের আল্লা কিংবা খ্রিস্টানদের গড়ের তেমন তফাত নেই। তিনজন তিনটে আলাদা ভগবান, অথচ প্রত্যেকেই একম অদ্বিতীয়ম বলে দাবি করা হয়, এটা একটা মজার ব্যাপার না? ইরফান, আমি তোর ওই ডারউইন সাহেবের লেখা পড়িনি, কিন্তু আমারও ধারণা আমার নিজের জীবনের একটা অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি, নিরাকার, রূপ-গুণের অতীত কোনও শক্তি যদি থেকেও থাকে, তার সঙ্গে মানুষের জীবনের একটা অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি, নিরাকার, রূপ-গুণের অতীত কোনও শক্তি যদিও থেকে থাকে, তার সঙ্গে মানুষের জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই। তার জন্য মানুষের এত পুজো-আচ্চা, প্রার্থনা, কান্নাকাটির দরকার কী? আমি কোনওদিন বাইরের কারুকে বলতে যাব না, শুধু তোকেই বলছি, এই যে নিরাকার কোনও শক্তিকে বহু মানুষ ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করে, তার মধ্যে কিছুটা ভণ্ডামি থাকতে বাধ্য। সত্যিকারের নিরাকার কোনও কিছু কি মানুষের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব? নিরাকারের কাছে প্রার্থনা! আসলে এই নিরাকারেরও চোখ-মুখ-নাক আছে। সব ধর্মের এই নিরাকাররাই মাঝে মাঝে কথা বলেন, তিনি মানুষের পাপপুণ্য দেখতে পান। ব্ৰাহ্মরা তারস্বরে গান গায়, হিন্দুরা জোরে জোরে মন্ত্র পড়ে, তোরা আল্লা হো আকবার বলে চ্যাঁচাস কেন? যার কান নেই, তাকে কিছু শোনাবার জন্য কি মুখে কিছু উচ্চারণের দরকার হয়? আসলে কি জানিস, বিশ্বাসের কাছে সব মানুষই শিশু, আর শিশুদের পুতুল ছাড়া চলে না। সব ধর্মেই আছে। খ্রিস্টানদের পুতুল নেই? যিশু, মা মেরি, দেবদূত, কত রকম সন্ত… তোদেরও পুতুল আছে… অত চমকে কেন, তোরা মূর্তি বানাসনি বটে, কিন্তু মসজিদগুলো কী? এতরকম সব কারুকার্য করা মসজিদ, নিরাকারের প্রার্থনার জন্য দরকার। এগুলি কি নিরাকারের বাসস্থান, না পুতুলের খেলাঘর?
—সর্বনাশ! ভরত, তোর মুখে তো আমি এরকম কথা কখনও শুনিনি!
—হঠাৎ বলে ফেললাম। বলা উচিত না বোধহয়। বৃষ্টির দিনে কাছাকাছি কেউ নেই, আর কেউ শুনবে না, তাই মুখে এসে গেল। তবে কি জানিস, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে মেতে আছে, তাদের এই কথায় উড়িয়ে দেবার অধিকার তোর-আমার নেই! বিশ্বাসে-শ্রদ্ধায়-ভক্তিতে কেউ যখন নিমগ্ন থাকে তখন তাকে দেখতে বড় ভালো লাগে। চোখ বুজে কেউ ধ্যান করছে, এই দৃশ্যটা দেখলে আমার এখনও শ্রদ্ধা হয়, সে যারই ধ্যান করুক না কেন! নাস্তিকদের কোনও রূপ নেই, নাস্তিকরাও এক ধরনের নিরাকার।
বৃষ্টি থেমে এসেছে, এখন আর শব্দ নেই, বাতাসে উড়ছে জলকণা। রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেছে ভরতকে হেঁটে ফিরতে হবে, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, খিদে পেয়ে গেছে রে, ইরফান!
ইরফান বলল, সব কিছু রান্না করাই আছে, গরম করে নিতে হবে। চল পাকের ঘরে, দু’জনে হাত লাগালে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।
এ বাড়িতে একজন রান্নার ঠাকুর নিযুক্ত আছে, কিন্তু ছুটিতে প্রায় সবাই বাড়ি চলে গেছে বলে সেও ছুটি নিয়েছে। ইরফানই এখন কাজ চালিয়ে দেয়। ছাত্রদের হস্টেলগুলিতে জাতপাতের কত রকম বিচার, কিন্তু এ বাড়িতে সেসব নিয়ম কেউ মানে না। দ্বারিকা এমনিতে গোঁড়া হিন্দু হলেও যেহেতু ইরফান তার বন্ধু, সেইজন্য ইরফান সম্পর্কে তার কোনও শুচিবাই নেই। অবশ্য আগে থেকেই দ্বারিকা নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করে।
কয়লার উনুন জ্বলিয়ে তাতে কড়াই চাপাতে চাপাতে ইরফান বলল, আমাকে ফিরে যেতে হবে, অথচ একেবারেই ইচ্ছে করছে না রে!
ভরত হাসতে হাসতে বলল, কী কুক্ষণেই তুই ব্ৰাউন সাহেবকে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে গেলি, তারপর ডারউইন সাহেবের খপ্পরে পড়লি। বাড়িতে তোর নতুন বউ, সেখানে গেলে বিবর্তনবাদটাদের কথা তোর মাথা থেকে ঘুচে যাবে। নামাজ পড়বি, রোজা রাখবি, মিশে যাবি সকলের সঙ্গে। নাস্তিক হয়ে একা থাকতে যাবি কেন! গ্রামের জীবনের নিঃসঙ্গতা বড় ভয়ংকর।
ইরফান হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ভরতের একটা হাত চেপে ধরে বিহ্বল গলায় বলল, ভরত, ভরত, আমি যদি হঠাৎ পাগল হয়ে যাই? মাথার মধ্যে যেন আমার ঝড় বইছে সর্বক্ষণ, এক এক সময় চক্ষে অন্ধকার দেখছি!
ভরত বলল, ডারউইন সাহেবের বইখানা এনে তুই উনুনে গুঁজে দে। ব্ৰাউন সাহেবের কাছে আর কক্ষনও যাবি না। পাগল হয়ে যাওয়ার চেয়ে বিশ্বাসী, ভক্ত হয়ে থাকা অনেক ভালো। বাঁচতে হবে তো, বেঁচে থাকাটাই বড় কথা!