2 of 2

৬৩. বাদল বাইরের ঘরে

বাদল বাইরের ঘরে তার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। আজ সারা দুপুর বৃষ্টি হয়েছে, এখন একটু থামলেও আকাশ মেঘলা অন্ধকার। আজ আর বিকেল হল না, দুপুরের পরই সন্ধ্যা। এই বৃষ্টির মধ্যেই এসে হাজির হয়েছে পঙ্কজ, ভাস্কর আর বিষ্ণু।

বিষ্ণু শিগগিরই বিলেত যাচ্ছে, অক্সফোর্ডে ভরতি হবার সুযোগ পেয়েছে। তারপর ব্যারিস্টারিও পাস করে আসবে। বিষ্ণু পড়াশুনোতে বরাবরই ভালো, কলেজে ঢোকার পর একেবারে বইয়ের পোকা হয়ে গেছে। ছেলেবেলায় তার যে শখ ছিল আবিষ্কারক হওয়ার–সেসব ঘুচে গেছে কবেই, এখন সে ছাপার অক্ষরের মধ্যে বিশ্ব পরিভ্রমণ করে। ভাস্কর চেষ্টা করছে খড়্গপুরের আই আই টি-তে ভরতি হওয়ার–পঙ্কজই শুধু বাদলের সঙ্গে এম এ পড়বে। বি এর রেজাল্ট এখনও বেরোয়নি।

বন্ধুরা এখন অনেকটা বিচ্ছিন্ন–এই রকম ছুটিছাটার দিনেই আজ্ঞার টানে এসে এক জায়গায় জড়ো হয়। বাদল আর ভাস্করের হাতে সিগারেট জ্বলছিল, এই সময় বড়বাবু বাইরে থেকে ফিরলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওরা জ্বলন্ত সিগারেট দুটো ছুঁড়ে দিল সোফার নীচে।

বড়বাবুর মুখখানা পরিশ্রান্ত ও বিষণ্ণ। কিছু দিন ধরেই তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তবু এই ঝড়-বাদলার দিনেও তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলেন। প্রত্যেক দিন বিকেলবেলা বাগবাজারের অনাথ আশ্রমটিতে তার যাওয়া চাই। অনাথ আশ্রমের একটি ছেলে এবছর স্কলারশিপ পেয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হয়েছে, এ-নিয়ে বড়বাবুর কী গর্ব! কত লোককে যে শুনিয়েছেন একথাটা–তার ঠিক নেই। যেন ছেলেটি তার নিজের হাতের সৃষ্টি।

বড়বাবু বললেন, বাদল, তোর কাছে খুচরো পয়সা আছে? রিকশাওয়ালাকে পাঁচ আনা পয়সা দিতে হবে–

চার বন্ধুই পকেটে হাত দিল। এদিকে সোফার তলা থেকে জ্বলন্ত সিগারেটের ধোঁয়া উঠে আসছে কুণ্ডলী পাকিয়ে, ওরা দারুণ সন্ত্রস্ত। বাদল পয়সা দিতে বেরিয়ে গেল। বড়বাবু প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী? রেজাল্ট বেরোচ্ছে কবে?

ভাস্কর বলল, এই তো, জুনের সেকেন্ড উইকেই–

বড়বাবু একটু দাঁড়িয়ে ওদের সঙ্গে টুকিটাকি দু-একটা কথা বলে ভেতরে চলে গেলেন। সূর্যর কোনও বন্ধু কোনও দিন এ বাড়িতে আসে না। বাদলের বন্ধুদের তিনি চেনেন।

বাদল ফিরে আসার পর ভাস্কর বলল, উঃ, তোর পিসেমশাইকে দেখলেই কী রকম ভয় ভয় করে রে!

বাদল বলল, কেন? বড়বাবু তো কোনও দিন বকুনি টকুনি দেন না!

পঙ্কজ বলল, তা দেন না বটে! কিন্তু এমন একটা ব্যক্তিত্ব আছে যে সামনে দাঁড়ালেই কী রকম যেন কুঁকড়ে যেতে হয়।

ভাস্কর বলল, ওঁর চেহারা কিংবা ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায় বনেদি লোক।

বাদল বলল, বড়বাবু কিন্তু মোটেই বনেদি বাড়ির ছেলে নন। ওঁর লাইফ হিস্ট্রিটা যদি শুনিস, দারুণ ইন্টারেস্টিং! উনি নিজের বাবা-মা-কে কখনও চোখেও দেখেননি, অনাথ ছেলে যাকে বলে–সারা জীবন স্ট্রাগল করে–

ভাস্কর বলল, তুই বড়বাবুর লাইফ হিস্ট্রিটা লিখে ফ্যাল না!

আমি কী করে লিখব! আমি নিজেও তো সব ঘটনা জানি না–মার মুখে যেটুকু শুনেছি–বড়বাবুকে তো সব কথা জিজ্ঞেস করতে পারি না সবচেয়ে ভালো হত, উনি নিজে যদি একটা অটোবায়োগ্রাফি লিখতেন–

ওঁর কি লেখাটেখার হ্যাবিট আছে?

মাঝে মাঝে ডায়েরি লেখেন। ইচ্ছে আছে একদিন লুকিয়ে পড়ে ফেলব–এখনও চান্স পাইনি।

বিষ্ণুর পছন্দ হল না এই কথাটা। সে একটু দুঃখিত ভাবে তাকাল বাদলের দিকে। বিষ্ণুকে আরও দুঃখিত করে ভাস্কর জিজ্ঞেস করল–হ্যাঁ রে, সূর্যদার মা নাকি বাইজি ছিল?

এই প্রশ্নে বাদল হঠাৎ একটু রেগে উঠে বলল, তোকে কে বলেছে?

এসব কথা বেশি দিন চাপা থাকে না।

যদি তা সত্যিও হয়, তাতে কী আসে যায়?

সে কথা কি আমি বলেছি? আমি জিজ্ঞেস করছি, সত্যি কি না!

সূর্যদার মা একজন আর্টিস্ট ছিলেন।

বড়বাবু তাকে বিয়ে করেছিলেন? না এমনিই—

বিষ্ণু বলল, ছিঃ, এসব কী হচ্ছে কী? এই ভাস্কর, চুপ করবি?

বাদলের মুখখানা লালচে হয়ে গেছে। তার সূর্যদা সম্পর্কে সে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সূর্য সম্পর্কে কেউ সামান্য অপমানজনক ইঙ্গিত করলেই সে দারুণ রেগে যায়। চড়া গলায় বলল, আমি লক্ষ করছি, ভাস্করটা আজকাল সব সময় খারাপ কথা বলতে ভালোবাসে।

ভাস্কর রীতিমতন অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, যা বাবা! আমি কী করলাম? যা শুনেছি, সেটাই সত্যি কিনা জিজ্ঞেস করছি।

তোর অত সত্যি-মিথ্যে নিয়ে মাথা ঘামাবার কী দরকার?

ভাস্কর কারওর বকুনি সহ্য করার পাত্র নয়। যখন সে দেখল, অন্য তিন বন্ধু তাকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে, তখন সে রুখে দাঁড়াল। বিদ্রুপের ভঙ্গি করে বলল, যা, যা, ন্যাকামি করিস না! যা ট্রুথ, তা গোপন করে লাভ কী? এ কথা আজ সবাই জানে যে সূযদার জন্মের ঠিক নেই বলেই এই রকম সব যা-তা কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে।

কী যা-তা কাণ্ড করছে?

দীপ্তি সরকারের সঙ্গে কী স্ক্যান্ডাল করছে তোরা শুনিসনি? আমার ছোড়দা বলছিল, সূর্যদাকে আগে যারা চিনত–তারা কেউ ওর সঙ্গে দেখা হলেও আজকাল কথা বলে না।

বাদল দৃপ্ত গলায় বলল, তার কারণ পৃথিবীতে বেশির ভাগই বোকা লোক। তারা কথা না বললেও সূর্যদার কিছু যায় আসে না। কারোকে ভালোবাসা কোনও পাপ নয়।

এর নাম ভালোবাসা?

নিশ্চয়ই! তুই ভালোবাসার কী বুঝিস?

ভাস্কর বাঁকা ভাবে বাদলকে বলল, তুই এর মধ্যেই ভালোবাসার অনেক কিছুই বুঝে গেছিস দেখছি! তাই আজকাল সব সময় তোর উড়ু উড়ু ভাব।

দ্যাখ ভাস্কর, আমি সূর্যদা সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা শুনতে চাই না। তুইও তো একসময় সূর্যদার দারুণ ভক্ত ছিলি–

সেই সূর্যদা আর এখনকার সূর্যদা এক নয়। আই ফিল সরি ফর হিম। কত সম্ভাবনা ছিল–শুধু শুধু একটা মেয়ের জন্য–

বিষ্ণু বলল, সূর্যদাকে দেখলে আমার কেন জানি না ওয়েদারিং হাইটস-এর হিথক্লিফ-এর কথা খুব মনে পড়ে। সূর্যদা যেন একটা প্রতিশোধ নিতে চাইছে–

কীসের প্রতিশোধ?

তা আমি জানি না।

পঙ্কজ বলল, ভাস্কর, তুই কী বলতে চাস, ঠিক খুলে বল তো!

ভাস্কর আর একটা সিগারেট ধরিয়ে শান্ত মেজাজে বলল, আসলে ব্যাপার কী জানিস, আমরা সবাই সূর্যদাকে হিংসে করি। যে-লোক সমাজের কোনও নিয়ম মানে না, যা খুশি তাই করে–আমরা তাকে নিন্দে করি। আমরাও কিন্তু মনে মনে ওই রকমই হতে চাই আমাদের সাহস নেই।

বাদল বলল, সাহসের প্রশ্ন নয়। একলা একা নিয়ম ভাঙাই বড় কথা নয়। এই সমাজের নিয়মগুলোই পালটানো দরকার।

পঙ্কজ বলল, অষ্টম এডোয়ার্ড একটা মেয়ের জন্য ইংলন্ডের সিংহাসন ছেড়েই চলে গেল।

ভাস্কর হাসতে হাসতে বলল, আমার সিংহাসন নেই, তাই ছাড়ার কোশ্চেনই ওঠে না। তা ছাড়া শালা, এ-পর্যন্ত সে রকম কোনও মেয়েরই দেখা পেলাম না।

বাদল একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বাকি তিন জন কথা বলতে বলতে চলে গেল প্রসঙ্গান্তরে।

.

একটু বাদেই আড্ডা ভাঙল। বিষ্ণুকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। বাদলও ওদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল একটুখানি এগিয়ে দিয়ে আসতে।

মোড়ের মাথায় এসে আবার আড্ডা। এক একটা বাস এসে চলে যাচ্ছে, তবু ওরা বিষ্ণুকে উঠতে দিচ্ছে না। আর একটু দাঁড়া, আর একটু দাঁড়া! গাড়িবারান্দাটার নীচে একটা লোক খুব চমৎকার আলুর বড়া আর বেগুনি ভাজে-তাই কিনে খাওয়া হল। এবার একটু চা খেলে কেমন হয়?

বিষ্ণু হাসতে হাসতে বলল, এলগিন রোড থেকে আমার মাসিমারা আসবেন। মা-কে বলে এসেছি ছ’টার সময় বাড়ি ফিরব! এখন সাড়ে সাতটা বাজে যে রে!

ভাস্কর বলল, ধুৎ! তুই ক’দিন বাদেই লন্ডন চলে যাবি–তারপর তোর সঙ্গে কবে আবার দেখা হয় কি না হয়!

কেন দেখা হবে না? আমি কি সারা জীবন থাকব নাকি?

কী জানি ভাই! দেখছি তো, যে যায়, সে আর ফেরার নামটি করে না।

আমি ফিরবই!

তা হলে যাচ্ছিস কেন? এ-দেশে কি পড়াশুনো হয় না?

চার-পাঁচ বছরের বেশি থাকব না, দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

পঙ্কজ বলল, চল, আমরা সবাই মিলে বিলেত যাই! একটা নৌকো ভাড়া করে—

বাদল বলল, সে রকম ভাবে যদি যেতেই হয়, তা হলে বিলেত কেন, তাহিতি দ্বীপে যাব–

বন্ধুদের বাসে তুলে দিয়ে বাদল বাড়ির দিকে ফিরে আসছে–এমন সময় তাদের বাড়ির চাকর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, ছোড়দাবাবু, শিগগির আসুন। আপনাকে সবাই খুঁজছেন।

কেন রে, কী হয়েছে?

বড়বাবু সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছেন। অজ্ঞান হয়ে আছেন।

বাদল তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে তাকাল। বাসটা অনেক দূর চলে গেছে, বন্ধুদের আর ফেরাবার উপায় নেই। যে-কোনও উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতেই বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। বাড়িতে এই বিপদ–বন্ধুরা থাকলে অনেক সাহায্য করতে পারত–বিশেষত ভাস্কর সব ব্যাপারে এত এক্সপার্ট..

তার পরেই বাদল দৌড়োল বাড়ির দিকে।

বড়বাবুকে শোওয়ানো হয়েছে সূর্যর ঘরে খাটের ওপর। দু চোখ বোজা। কপালে ঘাম। চিররঞ্জন তার নাকের সামনে ধরে আছেন স্মেলিং সল্টের শিশি, হিমানী হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছেন।

বাদল ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

চিররঞ্জনের মুখখানা ফ্যাকাশে রক্তশূন্য। তিনি দূর্বল স্নায়ুর মানুষ, কোনও রকম বিপদের সম্মুখীন হলে তার মাথা আরও গুলিয়ে যায়। কম্পিত গলায় বললেন, ডাক্তার ডাক। শিগগির–

বাদল খুব একটা বিচলিত বোধ করল না। বড়বাবুর হাত-পা কিছুই কাটেনি, শরীরের কোনও জায়গা থেকে রক্তপাত হয়নি, তা হলে বিশেষ কিছু না–আচমকা পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

সে বলল, কী হয়েছে? সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছেন? মাথায় জল দাও—

চিররঞ্জন বিমূঢ় ভাবে তাকিয়ে বললেন, না না, এমনি এমনি পড়ে যাননি। আমি নিজের চোখে দেখলাম বড়বাবু তিনতলা থেকে নেমে আসছিলেন…আমি তখন বারান্দায়–উনি হঠাৎ থেমে পড়লেন, হাত তুলে আমায় ডাকলেন, চিরু চিরু–আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছি–এই সময় পড়ে গেলেন ঝুপ করে, তারপর গড়াতে গড়াতে–

হিমানী বললেন, এখনও জ্ঞান ফিরছে না–তুই শিগগির যা, অপূর্ব ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয়—

বড়বাবু যদি রাগ করেন পরে?

তুই যা তো! শুধু শুধু দেরি করছিস–

বড়বাবু সাধারণত ডাক্তারদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেন। তিনি সারা জীবনে খুব কম ওষুধ খেয়েছেন। ছোটখাটো অসুখ হলে তিনি নিজেই নিজের চিকিৎসা করেন। তাঁর ধারণা, যখন তখন ওষুধ খাওয়া মানেই শরীরের একটু ক্ষতি করা। বাদল সেই কথাই ভাবছিল–হঠাৎ বড়বাবুর বুক থেকে একটা অস্বাভাবিক ঘরঘর শব্দ হতেই সে ভয় পেয়ে গেল। বড়বাবুকে এ রকম অসহায় অবস্থায় তো সে কখনও দেখেনি। সে ছুটে বেরিয়ে গেল ডাক্তার ডাকতে।

সন্ধ্যার সময় অপূর্ব ডাক্তারের চেম্বারে বেশ ভিড় থাকে। বাদল সরাসরি ভিড় ঠেলে তার সামনে উপস্থিত হয়ে বলল, এক্ষুনি আসুন!

ডাক্তারবাবু মুখ তুলে বললেন, কী হয়েছে কী?

বাদলের অত কথা বুঝিয়ে বলার সময় নেই। সে ততক্ষণে ডাক্তারের ব্যাগ নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। বলল, অন্যদের একটু বসতে বলুন, আপনাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

আরে কী হয়েছে বলো না! অত ব্যস্ত হলে কি হয়?

আপনি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। আপনাকে এবার জোর করে টেনে নিয়ে যাব। কিন্তু। বড়বাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।

বড়বাবু!

অপূর্ব ডাক্তার আর দ্বিরুক্তি করলেন না, উঠে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে। বড়বাবুকে এ-পাড়ার অনেকেই চেনে এবং মান্য করে। বাদল অপূর্ব ডাক্তারকেও প্রায় দৌড় করিয়েই নিয়ে এল বাড়িতে।

হিমানী ততক্ষণে বুদ্ধি করে বড়বাবুর পায়ের তলায় গরম জলের সেঁক দিচ্ছেন। ডাক্তারবাবু খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে গম্ভীর ভাবে বললেন, হাসপাতালে পাঠাতে হবে, এখানে চিকিৎসা করা যাবে না।

কী হয়েছে কী?

এখন বলা শক্ত। হার্ট কিংবা ব্রেনে–অনেক কিছু পরীক্ষা করে দেখতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সে খবর পাঠান–আমি সঙ্গে যাব–

হাসপাতালে পাঠাতেই হবে? এখানে কিছু হবে না?

চিররঞ্জন তাকালেন স্ত্রীর দিকে। তিনি নিজে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। হাসপাতালের নাম শুনলেই মনে হয়, সেখান থেকে আর কেউ ফেরে না। হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারটা বড়বাবু নিজে কি পছন্দ করবেন? নিজের জীবনের ব্যাপারে বড়বাবু কখনও কারওর পরামর্শ নেননি, নিজেই সব ঠিক করেছেন হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার। পর তিনি যদি চিররঞ্জনকে ভর্ৎসনা করে বসেন, তুমি শেষকালে আমায় হাসপাতালে ঠেলে দিলে?

চিররঞ্জন বিভ্রান্তের মতন এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, সূয্যি কোথায়? এই বাদল, দেখ না, সূয্যিকে পাস কিনা কোথাও!

সূর্য বাড়ি নেই। সুতরাং তাকে এখন কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে! চিররঞ্জন ভাবছিলেন, সূর্য যদি নিজের বাবার চিকিৎসার উপায় ঠিক করে, তা হলে তার আর কোনও দায়িত্ব থাকে না।

হিমানী বললেন, হাসপাতালে কেন! বাড়িতে যন্ত্রপাতি আনা যায় না?

অপূর্ব ডাক্তার বললেন, আমি সে দায়িত্ব নিতে পারি না। অবস্থা খুব ভালো মনে হচ্ছে না।

চিররঞ্জন ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, এখনকার মতন একটা কিছু ব্যবস্থা করুন। কোনও মতে যদি একবার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা যায় বুঝলেন না, ওঁর মত না নিয়ে হাসপাতালে পাঠাতে…

অপূর্ব ডাক্তার ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ বার করতে করতে বললেন, তা তো বুঝলাম, কিন্তু…

ইঞ্জেকশন শেষ করে তিনি আবার বললেন, আধ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফেরার কথা। আমি এখন একটু যাচ্ছি, জ্ঞান ফিরলেই আমাকে আবার খবর দেবেন।

আধ ঘণ্টার আগেই বড়বাবুর জ্ঞান ফিরল। খুব ক্লান্ত ভাবে চোখ খুললেন। চিররঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঝুঁকিয়ে বললেন, বড়বাবু, বড়বাবু

বড়বাবু শুধু তাকিয়ে রইলেন, কোনও কথা বললেন না।

এখন কেমন আছেন?

বড়বাবু শুধু বললেন, চিরু—

কষ্ট হচ্ছে? কোথায়?

বড়বাবু আর কোনও উত্তর দিলেন না। একটা হাত উঁচু করার চেষ্টা করলেন, সেটা আবার ধপাস করে পড়ে গেল।

চিররঞ্জন আবার ব্যগ্র ভাবে বললেন, ডাক্তার এসেছিল, বলছিল, হাসপাতালে গেলে চিকিৎসার সুবিধে হবে–

বড়বাবু যেন এ কথাটা বুঝতেই পারলেন না। ক্লিষ্ট ভঙ্গি করে পাশ ফিরে আবার চোখ বুজলেন।

ডাক্তারবাবু আবার এলেন একটু পরেই। তিনিও বড়বাবুকে অনেক বার জিজ্ঞেস করলেন হাসপাতালের কথাটা। কোনও উত্তর পেলেন না। তখন আবার ইঞ্জেকশন ও ওষুধ দিয়ে বললেন, আজকের রাতটা অন্তত দেখা যাক। কাল সকালে যা হয় ঠিক করা যাবে। ভয়ের কিছু নেই।

তবু যাবার সময় তিনি চিররঞ্জনকে আলাদা করে ডেকে বললেন, রাত্তিরে যদি খারাপ কিছু হয়, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দেবেন, যত রাত্তিরই হোক–

ডাক্তারের মুখে চিন্তার ছাপ দেখলে বাড়ির লোকের বুক কাঁপে।

রাত সাড়ে নটা বাজে, সূর্য তখনও ফেরেনি। কোনও কোনও রাত্রে সূর্য বাড়ি ফেরে না, আজও যদি সে রকম হয়? এই কথা ভেবে বাদল অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করছে। একসময় সে বলল, বাবা, আমি সূর্যদাকে একটু খুঁজে আসব?

দীপ্তিদির বাড়ি বাদল একবার দেখেছিল দূর থেকে, সেখানে যেতে তার একটু একটু লজ্জা করছে। কিন্তু ওখানে ছাড়া সূর্যর খোঁজ করবে আর কোথায়?

একতলার অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে বাদল উঠে এল দোতলায়। ঘরের দরজা ভেজানো, ভেতরে আলো জ্বলছে। দরজায় কলিং বেল নেই। আঙুলের গাঁট দিয়ে ঠুকে ঠুকে আওয়াজ করল বাদল।

দীপ্তি দরজার এক পাল্লা খুলে বললেন, কে?

দরজার ফাঁক দিয়ে বাদল দেখল একটা চেয়ারে সূর্য বসে আছে মুখ গোঁজ করে। ঠিক অভিমানী শিশুর মতন তার বসে থাকার ভঙ্গি। দরজা খোলার পরেও সে মুখ তোলেনি।

দীপ্তি আগে কয়েক বার দেখেছেন বাদলকে। সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পেরে বললেন, বাদল না? কী ব্যাপার!

সূর্য এবার মুখ তুলল। বাদল ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, সূর্যদা, তোমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে।

সূর্যর মধ্যে একটুও চঞ্চলতা দেখা গেল না। সে বলল, এত রাত্তিরে এসেছিস কেন? কী হয়েছে?

বড়বাবুর খুব অসুখ।

দীপ্তি উৎকণ্ঠিত ভাবে বললেন, কী হয়েছে কী? বাদল, তোমার মুখ এত শুকনো কেন?

বাদল বলল, সূর্যদা, তাড়াতাড়ি চলো। বড়বাবু সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছেন, অনেকক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলেন–

আমাকে ডাকতে বললেন?

কোনও কথা বলতে পারছেন না।

দীপ্তি তাড়া দিয়ে বললেন, সূর্য, তুমি এক্ষুনি চলে যাও।

সূর্য মন্থর ভাবে উঠে দাঁড়াল। তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ার কোনও লক্ষণ না দেখিয়ে বাদলকে জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার এসেছিল?

ডাক্তারবাবু বললেন, ওঁকে হাসপাতালে পাঠানো দরকার—

দীপ্তি বললেন, সূর্য, আর দেরি কোরো না তা হলে–

সূর্য বলল, যাচ্ছি। বাদল, তুই নীচে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ডাক তো–আমি যাচ্ছি এক্ষুনি।

বাদল বেরিয়ে যাবার পর সূর্য গম্ভীর ভাবে বলল, দীপ্তিদি, চট করে তোমার দু-একটা জামাকাপড় গুছিয়ে নাও–তুমিও যাবে আমাদের সঙ্গে।

আমি?

হ্যাঁ। বাবার অসুখ যদি গুরুতর হয়, তা হলে আমি কদিন আসতে পারব না। তুমি ওখানেই আমাদের সঙ্গে থাকবে।

তা হয় নাকি? পাগল হয়েছ?

নিশ্চয়ই হয়!

দীপ্তি এগিয়ে এসে সূর্যর বাহু ছুঁয়ে মিনতি করে বলল, এখন এ রকম পাগলামি কোরো না। তাড়াতাড়ি চলে যাও–আমি কাল সকালেই একবার খবর নেব

সূর্য বলল, আমি অন্য কিছুর জন্য বলছি না। আমি এখানে না এলেই অন্য লোকেরা তোমাকে আজেবাজে কথা শোনাতে আসবে।

তাতে আমার কিছু হবে না। একটা কথা মনে রেখো, আমি তোমার সঙ্গে না গেলেও, আমি সব সময় তোমার সঙ্গে আছি। তুমি যেখানেই যাও, আমি তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি চোখ বুজলেই দেখতে পাবে, আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।

সূর্যর মনে হল, এই কথাটা সে যেন আগে কোথাও শুনেছে। জেলে থাকার সময় শ্রীলেখা চিঠিতে এই রকমই কিছু লিখেছিল।

সে বলল, চোখ বুজে নয়, চোখ খুলেই আমি তোমাকে সব সময় দেখতে চাই আমার কাছাকাছি। কাল সকালে তুমি ঠিক আসবে তো?

আসব।

সূর্য আর কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ল। বাদল ততক্ষণে ট্যাক্সি ডেকে ফেলেছে।

সূর্যকে এত সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্যই বাদল আরও বেশি উত্তেজিত বোধ করছে।

খোঁজাখুঁজির জন্য সময় নষ্ট হলে সে-কথা মনে পড়ত না, এখন মনে পড়ছে সেই কথা– খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি তো! যদি এর মধ্যেই–

মাড়োয়ারিদের বিয়ের একটা আলো-বাজনার বিরাট জুলুস বেরিয়েছে বলে ট্যাক্সিটা আটকে পড়েছে। বাদল চেঁচিয়ে বলল, আঃ, এদের জ্বালায় আর পারা গেল না। সর্দারজি, আপ ডাইনে ঘুমাকে জলদি চালাইয়ে, বহুত জলদি!

সূর্য বাদলের পিঠে হাত দিয়ে বলল, তুই এত চঞ্চল হচ্ছিস কেন?

একটানা আট দিন বড়বাবু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। ঘুম ও জাগরণের মাঝখানের একটা অবস্থা। কখনও তিনি তাকিয়ে থাকেন তোকজনের মুখের দিকে, কেউ কথা বললে শুনতে পান-ও মনে হয়, কিন্তু কোনও উত্তর দিতে পারেন না। আবার এক এক সময় নিজে থেকেই একটা-দুটো কথা বলে ওঠেন–সেসব কথার মর্মোদ্ধার করাও সহজ নয়।

ধন্বন্তরি হিসেবে বিখ্যাত ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সদ্য প্র্যাকটিস করা বন্ধ করেছেন, বাড়িতে শুধু সকালে এক ঘণ্টা বিনা পয়সায় রোগী দেখেন। মন্দাকিনীর ছেলে সুরেশ্বরের সঙ্গে ডাঃ বিধান রায়ের পরিচয় আছে। সুরেশ্বর বিশেষ চেষ্টা করলেন তাকে আনবার জন্য। কিন্তু ডাঃ রায় অত্যন্ত ব্যস্ততার জন্য বাড়িতে আসতে পারলেন না, চেম্বারে আনতে বললেন। সেখানে বড়বাবুকে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই এখন ওঠে না, তাই ডাক্তার নলিনীরঞ্জন সেনকে কল দেওয়া হল।

বাড়িতে সব সময় লোকজনের ভিড়। নানা সূত্রে বড়বাবুকে অনেকেই চেনে। খবর পেয়ে সবাই ভিড় করে আসছে। সকলেই একবার অন্তত রোগীর কাছে গিয়ে জানাতে চায়, আমি এসেছি, আমাকে চিনতে পারছেন তো? ভিড় সামলানোই মুশকিল। সূর্য একদিন এক বারও বাড়ি থেকে বেরোয়নি। বাদলও সব সময় তার সঙ্গেই থাকে। বাড়িতে একটা থমথমে ভাব। সকলেই বড়বাবুর ঘরের মধ্যে বা কাছাকাছি থাকে সব সময়। দু’জন নার্স রাখা হয়েছে দিনে ও রাত্রে পালা করে থাকার জন্য, পাড়ার ডাক্তার প্রত্যেক দিন তিন-চার বার করে আসেন।

নবম দিন দুপুরের দিকে বড়বাবু চোখ খুলে দু’বার বললেন, মা, মা–

চিররঞ্জন বারান্দায় ছিলেন, ছুটে এলেন। বড়বাবু অনেকটা পরিষ্কার ভাবেই বললেন, চিরু, আমি ভালো আছি।

চিররঞ্জনের শুকনো মুখে বিদ্যুতের মতন আলো ফুটে উঠল। কয়েক দিনেই চিন্তা ভাবনায় চিররঞ্জন অনেক রোগা হয়ে গেছেন।

কাছে এগিয়ে এসে বললেন, আপনাকে অনেক ভালো দেখাচ্ছে। যন্ত্রণা টণা আছে?

বড়বাবু বললেন, না। এবার বোধহয় ধাক্কাটা সামলে উঠব। আমাকে একটু তুলে ধরো তো!

পাশ থেকে নার্স বলল, না, না, এখন উঠবেন না।

বড়বাবু বললেন, এ মেয়েটি কে?

বাড়ির সকলেই অবিলম্বে উপস্থিত হল সেখানে। বড়বাবুকে কয়েকটা বালিশ উঁচু করে ঠেস দিয়ে বসানো হয়েছে। এতদিন পর তাঁর চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ প্রকট। চামড়া ঝুলে গেছে, চোখদুটি কোটরাগত। গলার আওয়াজে সেই দৃঢ়তা আর নেই। দেখে যত না অসুস্থ মনে হয়, তার চেয়েও বেশি মনে হয়, মানুষটা খুবই ক্লান্ত।

ভালো মতন জ্ঞান ফেরামাত্রই ডাক্তারকে খবর দেবার কথা ছিল, তাই সূর্য চলে গেছে। ডাক্তারকে ডাকতে।

চিররঞ্জন বললেন, আমি এমন বিপদে পড়েছিলাম…ডাক্তাররা বলছিলেন হাসপাতালে পাঠাতে–কিন্তু আপনার মতামত না নিয়ে…

হাসপাতালে কেন?

হার্টের চিকিৎসা বাড়িতে ভালো মতন—

হার্টটাই গেছে বুঝি?

গুরুতর কিছু নয়, সামান্য অ্যাটাক—

হুঁ। হাসপাতালে না পাঠিয়ে ভালো করেছ—

হিমানী বললেন, একদিন তো আপনি কিছুই খাননি। শুধু গ্লুকোজ ইঞ্জেকশন দিয়ে..আজ কিছু খাবেন?

ক’টা দিন কেটেছে বলো তো?

সবাই তখন দিনের হিসেব মেলাতে বসল। তারপর সেই সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার বর্ণনা।

বড়বাবু চুপ করে শুনলেন সব। তারপর হঠাৎ ছেলেমানুষের মতন বললেন, আমাকে

একটু মুগের ডাল খাওয়াতে পারো? আমার মায়ের হাতের রান্না খেয়েছিলাম–

সকলে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। এত কঠিন অসুখের রোগীকে কি মুগের ডালের মতন গুরুপাক কিছু খাওয়ানো উচিত? তা ছাড়া, বড়বাবু আবার নিজের মায়ের রান্না খেলেন কবে? কোনও দিন তো ওঁর মায়ের কথা শোনা যায়নি।

হিমানী একটা স্তোকবাক্য দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। রান্নাঘরে গিয়ে মুগের ডাল বার করে রাখলেন–তবে, ডাক্তারকে জিজ্ঞেস না করে রান্না চাপাবেন না।

ডাক্তার এসে বড়বাবুর অবস্থা দেখে খুব খুশি হলেন, কিন্তু মুগের ডাল খাবার অনুমতি দিলেন না। অসুখ হলে–এত বড় একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গেও সবাই শিশুর মতন ব্যবহার করে। ডাক্তারও বললেন, আর কয়েকটা দিন বাদেই তো পুরো ভালো হয়ে যাবেন–তারপর যা খুশি হয় খাবেন, কেমন?

সন্ধ্যাবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর বড়বাবুর অবস্থা আরও অনেক ভালো মনে হল। নিজে দুধের বাটি হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন। বললেন, রেডিয়োটা খোলো তো, একটু খবর শুনব–

কিন্তু সকলেরই মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি রয়ে গেল। আর সব দিক ভালো হলেও বড়বাবুর কথাবার্তা একটু যেন অসংলগ্ন। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলছেন, যার মানে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মনে হয়, তার চৈতন্যের জগতে একটা কিছু উলোটপালোট চলছে। মায়ের কথা বলছেন বার বার। এককালে তিনি গান শিখতেন ওস্তাদ সৈফুদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে, হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, খাঁ সাহেব কি এসেছিলেন কাল?

সবাই জানে, সৈফুদ্দিন খাঁ সাহেব মারা গেছেন সাত-আট বছর আগে।

কেউ কিছু উত্তর না দিলে বড়বাবু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, এখন কলকাতায় গানবাজনার জলসা হচ্ছে না কোথাও? আমাকে একটু নিয়ে যেতে পারো?

চিররঞ্জন বিষণ্ণ ভাবে বললেন, শরীরের এই অবস্থা। আপনি এখন কী করে যাবেন?

শরীরটা কি আমার একেবারেই গেছে?

আজ তো বেশ ভালো আছেন!

বড়বাবু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। চিররঞ্জন ও নার্স এসে দু’পাশ থেকে ধরল তাঁকে। দু-তিন পা হেঁটেই বড়বাবু বললেন, আমার মাথা ঘুরছে!

আপনি বিছানায় এসে বসুন।

না, আমি আর একটু হাঁটব। শরীরকে বেশি প্রশ্রয় দিলেই পেয়ে বসবে।

চিররঞ্জন ও নার্সের কথা অগ্রাহ্য করেই বড়বাবু ঘর থেকে বেরোবার চেষ্টা করছিলেন। তখন সূর্য এসে বলল, বিছানা থেকে নামা আপনার একদম বারণ।

বড়বাবু বললেন, ডাক্তার-বৈদ্যর কথা শুনে আমি কখনও চলিনি। সূর্য, চল সমুদ্রের ধারে কোথাও বেড়াতে যাবি?

যাব। আপনি আগে একটু সেরে উঠুন।

সূর্য তার বাবাকে ধরে ধরে আবার বিছানার কাছে নিয়ে এল।

বড়বাবু বললেন, আমার এ-জায়গাটা আর ভালো লাগছে না। আমি অন্য কোথাও যাব।

পরদিন বড়বাবু চিররঞ্জনকে একটা চেক সই করে দিলেন পর্যন্ত। এর আগে তিনি হাতও নাড়াতে পারতেন না। হাসতে হাসতে বললেন, আমি ঠিক সেরে উঠব। এত সহজে মরতে রাজি নই হে!

তারপর হঠাৎ আবার অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, বেঁচে থেকে কী হবে, তাও তো জানি না!

একটু বাদেই বৃষ্টি হবে, আকাশ অন্ধকার। ঘরের মধ্যে একটা থমথমে ছায়া। চিররঞ্জন উঠে গিয়ে জানলা বন্ধ করতে যেতেই বড়বাবু বললেন, থাক, খোলাই থাক।

বাদল সূর্যকে বলল, সূর্যদা, আমরা তো আছি, তুমি আজ একটু বাইরে থেকে ঘুরে এসো না!

এর আগে সূর্য বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে কাটাত। এই ক’দিন সে একটানা বাড়িতে থেকে যে ভাবে কাজকর্ম করেছে–তা দেখলে অন্যদের মায়া লাগে। বাড়ির কাজ করা যে-সব ছেলের স্বভাবে নেই–তারা কিছুতেই নিজেদের এসব ব্যাপারে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না।

সূর্য বলল, আজকের দিনটা যাক। কাল বেরোব।

বাদল উৎসাহের সঙ্গে বলল, লরেন্স অলিভিয়ার-এর হ্যামলেট এসেছে, তুমি দেখবে না?

সূর্য অন্যমনস্ক ভাবে বলল, হ্যাঁ রে, আমি যখন ডাক্তার টাক্তার ডাকতে গেছি, তার মধ্যে কি কখনও দীপ্তিদি এসেছিলেন?

না তো। এলে ঠিক বসিয়ে রাখতাম।

এল না কেন? আশ্চর্য! ওর একটা খবর নেওয়া দরকার।

আমি যাব?

দেখি আজকের দিনটা।

সূর্য জানলার কাছে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঝুপ ঝুপ করে, সমস্ত শহরটা নিস্তব্ধ মনে হয়। এই কদিন বাবার অসুখের চিন্তার মধ্যেও সে দীপ্তির কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভোলেনি। দীপ্তি এক বারও খবর নিতে এল না কেন? দীপ্তি এ বাড়িতে তো আগে একদিন এসেছিল। দীপ্তির কোনও বিপদ হয়নি তো?

সূর্যর মনে হল, বৃষ্টির মধ্যেও সে যেন দীপ্তির শরীরের সুগন্ধ পাচ্ছে। দীপ্তি যেন কোনও একজন নারী নয়–সূর্যর মুখ লুকোনোর জায়গা।

দীপ্তি আসেনি, দীপ্তির সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি–কেন সে এ রকম কৃষ্ট দিচ্ছে? সূর্য এর শোধ নেবে। সে তার ভালোবাসা দিয়ে দীপ্তিকে পাগল করে দেবে।

রাত্তিরবেলা ঘুমোতে যাবার আগে সূর্য এসেছে বাবাকে দেখতে। বড়বাবু তখন। চোখ বুজে আছেন।

অসুখ অনেক রকম হয়, তবু অসুস্থ মানুষ দেখলেই প্রথমে জ্বর দেখার কথাই মনে পড়ে। সূর্য তার একটা হাত রাখল বড়বাবুর কপালে। বড়বাবুকে ঘুমন্ত মনে হয়েছিল, কিন্তু তিনি চোখ খুলে তাকালেন। বললেন, বোস একটু

রাত্রির নার্স একটা বই খুলে বসেছিল শিয়রের কাছে। বড়বাবু বললেন, তুমি একটু বাইরে যাও তো মা।

নার্সের টুলে সূর্য বসে পড়ে বলল, আপনার বেশি কথা বলা নিষেধ।

বড়বাবু সে-কথা গ্রাহ্য না করে বললেন, আমার যদি হঠাৎ কিছু হয়েটয়ে যায় তোকে কয়েকটা কথা বলে রাখা দরকার। বাড়ির দলিল, কোম্পানির কাগজ…

সূর্য বলল, এসব কথা এখন থাক না। পরে হবে।

পরে যদি আর সময় না পাই?

ডাক্তার তো বলছেন।

আমি ডাক্তারি ওষুধে বিশ্বাস করি না। আজ সকাল থেকে তোর কথাই ভাবছি। তোর মায়ের কথা। তুই গোয়ালিয়ার চলে যা।

গোয়ালিয়ার? কেন?

এটা তোর জায়গা নয়।

ওখানে গিয়ে আমি কী করব? কারোকেই চিনি না।

ও। আচ্ছা যাসনি। তুই এখানে কী করবি?

ঠিক ভেবে দেখিনি। তুই বিয়ে করবি না?

সূর্য কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। নিজের বিয়ের কথাটা সে বাবাকে জানাবে বলেই মনস্থির করে রেখেছিল। কিন্তু এখন এ-কথা বলার প্রকৃষ্ট সময় নয়।

সে বলল, আপনি আগে পুরোপুরি সেরে উঠুন।

বড়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কিছুতেই কিছু আসে যায় না।

সূর্য একথার ঠিক তাৎপর্য বুঝতে না পেরে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল বাবার দিকে। তার মনে হল, বাবার বুকটা যেন একটু বেশি জোরে ওঠা নামা করছে। নিশ্বাসের কষ্ট হবার লক্ষণ কি!

সে বলল, আপনার কি কোনও কষ্ট হচ্ছে?

বড়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, না।

তারপর খুব টেনে টেনে বললেন, আমি চলে গেলেও এ-পৃথিবী এ রকমই থাকবে।

ব্যাপারটা খুব ভালো না মনে হওয়ায় সূর্য উঠে গিয়ে চিররঞ্জনকে ডেকে আনল। চিররঞ্জন হন্তদন্ত হয়ে এলেন। বড়বাবু বললেন, চিরু, বোসো, তোমার সঙ্গেও কথা আছে।

চিররঞ্জন প্রায় ধমক দিয়েই বললেন, আপনি এখন ঘুমোন তো। সব কথা কাল। শুনব।

বড়বাবু বললেন, না। নিজেই উঠে বসার চেষ্টা করলেন। নার্স তাড়াতাড়ি এসে তার গা ধরে বলল, কী করছেন কী? শুয়ে পড়ুন।

বড়বাবু বললেন, আমার শয্যাকণ্টকী হয়েছে। পিঠ জ্বলে যাচ্ছে। আমি শুয়ে থাকতে পারছি না।

সূর্য চিররঞ্জনকে জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার ডাকব?

বড়বাবু ততক্ষণে উঠে বসেছেন। খানিকটা ঘোর-লাগা গলায় বললেন, আমি সারা জীবন ধরে খোঁজার চেষ্টা করেছি, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কী? আমার মা। বলেছিলেন…এই কথাটা আমাকে জেনে যেতে হবে। আমি পারিনি। তোমরা কেউ জানো?

চিররঞ্জন কঁদো কাঁদো ভাবে বললেন, বড়বাবু, কথা বললে আপনার কষ্ট বাড়বে। ডাক্তারকে ডেকে আনছি এক্ষুনি।

বড়বাবু নার্সের দিকে মুখ ফিরিয়ে ইশারায় বললেন, এক গ্লাস জল। নার্স জল গড়িয়ে এনে খাইয়ে দিতে গেল, বড়বাবু সেটা নিজের হাতে নিলেন। ঠোঁটে ঠেকাবার আগেই গেলাসটা হাত থেকে পড়ে বিছানা জলে ভেসে গেল। বড়বাবু যেন সেই জল শুষে নিতে চান–এই ভঙ্গিতে নিজেও ঠাস করে উপুড় হয়ে পড়লেন বিছানায় তাঁর বুক দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ হতে লাগল।

সূর্য তক্ষুনি ছুটে যাচ্ছিল ডাক্তার ডাকতে। চিররঞ্জন সূর্যর হাত চেপে ধরে বললেন, তুমি না। তুমি সামনে থাকো–।

বাদলকে পাঠানো হল ডাক্তারের জন্য। চিররঞ্জন আর সূর্য ধরাধরি করে বড়বাবুকে সোজা করে শুইয়ে দিল। বড়বাবু স্থির চোখ মেলে চেয়ে আছেন, আবার তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। চিররঞ্জন আকুল হয়ে তাকে ডাকতে লাগলেন, নার্স ঘষতে লাগল পায়ের পাতা।

ডাক্তার এসে মুখ কালো করলেন। নিচু গলায় বললেন, একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু আর কোনও আশা নেই। শুধু শুধু আর কষ্ট দিয়ে কী হবে! কোমার পরের স্টেজে একটু ভালো হয়ে তারপর হঠাৎই এই রকম–

সূর্য বলল, আপনি তবু ইঞ্জেকশন দিন।

ইঞ্জেকশন দেবার পর মাত্র এক মিনিট বাদেই বড়বাবু আস্তে আস্তে এদিক-ওদিক চোখ ঘোরালেন। তারপর ঠোঁট নড়ে উঠল। কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কেউ কিছু শুনতে পেল না। শেষ নিশ্বাস বেরোবার আগে সেইটাই বড়বাবুর শেষ বার কথা বলার চেষ্টা। তার শেষ কথা কেউ বুঝতে না পারলেও বাদল দাবি করে, সে ঠোঁট নাড়া দেখেই কথাটা ধরতে পেরেছে। বড়বাবু বলতে চেয়েছিলেন, দেখে গেলাম। এবং এই দেখে গেলাম কথা দুটিরই অনেক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছে বাদল। তার মতে, বড়বাবুর সারা জীবনের চরিত্রের সঙ্গে এই কথাদুটি মিলে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *