বাষট্টি
মধ্যরাত্রে গোটা আটেক মোটর সাইকেল ঝড়ের মত উড়ে এল তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরের সামনে, এসে থামল। এই রাত্রে ঈশ্বরপুকুরের ফুটপাথে কোন মানুষ ছিল না। যে যার নিজের বিছানায় ঘুমন্ত। লোকগুলো প্রথম দরজায় আঘাত করতেই ঘুমন্ত চোখে একজন বেরিয়ে এল, ‘কে? কি চাই?’
বিলু কোথায়? কোন বাড়িতে থাকে? একদম শব্দ করবি না। দেখছিস? লোকটার চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেল। থর থর করে কাঁপছিল সে। তারপর তিন নম্বরের পিছন দিকটা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল।
‘দেখিয়ে দিবি চল। কোন শব্দ করবি না। তোর বউকে বলে যা না চেঁচাতে। নইলে তোকে আর ফেরত পাবে না।’
লোকটা অসহায় চোখে ভেতর দিকে তাকাল। তারপর শ্লথ পায়ে হাঁটতে লাগল। আটজনের দলটার দুটো ভাগ হল। তিনজন রইল গলির মুখে। বাকি পাঁচজন হেঁটে এল লোকটিকে অনুসরণ করে। সরু গলির গোলকধাঁধায় বোধহয় লোকটির মানসিক শক্তি খানিকটা ফিরে আসছিল। অন্তত সে বুঝতে পারছিল বিলুর বাড়ি দেখিয়ে দেওয়া মানে ওর সর্বনাশ করা। বিলুর সর্বনাশ হলে তিন নম্বরের উপকার হবে না। কিন্তু এসব মনে হলেও সে কিছু করতে পারছিল না। তার পিছনে পাঁচজন অস্ত্রধারী। বিলুর দরজায় পৌঁছে লোকটা ইশারা করে চিনিয়ে দিতে হুকুম হল, ‘ডাক ওকে।’
লোকটা গলা খুলে ডাকতে গেল কিন্তু কোন স্বর বের হল না। পিছন থেকে চাপা গলায় ধমক খেতে সে আবার ডাকল, ‘বিলু।’
তিনবারের বার একটি মহিলা কণ্ঠ জড়ানো গলায় বলল, ‘অ্যাই বিলু, দ্যাখ দেখি তোরে কে ডাকে। আর সময় পায় না ডাকার। সারাদিন বেগার খেটে ছেলেটা যে একটু, বিলু রে!’
এরপর বিলুর গলা শোনা গেল, ‘কে? কি দরকার?’
লোকটা খোঁচা খেল কোমরে। সেই সঙ্গে ফিসফিসানি, ‘আসতে বল।’
‘একটু এসো।’
দরজায় শব্দ হল। পাজামা পরা খালি গায়ে বিলু বেরিয়ে আসতেই ওরা ওকে টেনে আনল পথে। বিলু চিৎকার করতে যাচ্ছিল কিন্তু রিভলভারটাকে দেখে থমকে গেল। ওরা ওর হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল।
‘অক্ক কোথায়?’
বিলু জবাব দিল না। ওরা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘অক্ক কোথায় থাকে?’
‘জানি না।’ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল লোকটা এবার।
‘চুপ! অক্ক কোথায়?’
‘ওই দিকে।’ লোকটা ঢোক গিলল।
ওদের নিয়ে দলটা অর্কদের বাড়ির দিকে এগোতেই বিলু চিৎকার করে উঠল, ‘খবরদার অর্ক, বের হস না। শালারা—’
বিলু ছুটে যাচ্ছিল। কিন্তু ওর পক্ষে বেশীদূর যাওয়া সম্ভব হল না। মধ্যরাত্রের নির্জনতা টুকরো করে গুলির শব্দ হল। লোকগুলো এবার প্রথমজনকে দ্রুত গলায় বলল, ‘বল শালা কোথায় অর্ক থাকে?’
লোকটা চোখের ওপর বিলুকে পড়ে যেতে দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিল। কোনরকমে হাতটা তুলে একটা দরজা দেখিয়ে দিল। চারধারে তখন হৈ চৈ শুরু হয়েছে। কোয়া থানার হাজতে, মোক্ষবুড়ি নেই, বন্ধ দরজার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকগুলো। ততক্ষণে পিলপিল করে বেরিয়ে পড়েছে তিন নম্বরের লোক। আর্তনাদ করছে তারা।
গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অর্কর। তড়াক করে উঠে বসতেই দেখল অনিমেষও উঠছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘গুলির শব্দ না?’
‘হ্যাঁ। বিলুর গলা পেলাম যেন।’
‘বিলু!’ অর্ক লাফিয়ে উঠল।
মাধবীলতারও ঘুম ভেঙ্গেছিল। জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘যাব না?’ অর্ক ঘুরে প্রশ্ন করল।
‘যা।’ ছোট্ট শব্দটা মাধবীলতার ঠোঁট থেকে ঝরে পড়তেই অর্ক দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল। তিন নম্বরের ওপর তখন অবিরাম বোমা বর্ষণ চলছে। তারপরেই পেট্রোল বোমা ফাটল পর পর কয়েকটা। দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল টালির ছাদে। মানুষজন ভয়ে চিৎকার করছে কিন্তু কেউ এক পা এগিয়ে যাচ্ছে না।
গলির মুখে এসে অর্ক ওদের দেখতে পেল। আটজনে মোটরবাইকের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার পরেই সে বিলুর শরীরটাকে দেখতে পেল। মাটিতে উপুড় হয়ে বিলু পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেহ। দুটো হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল তার। সাতটা মোটর বাইক যখন ইঞ্জিন চালু করে দৌড় শুরু করেছে তখন অষ্টমজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। লোকটা বোধ হয় এর জন্যে তৈরি ছিল না। অকস্মাৎ আঘাতে সে মোটর সাইকেল নিয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তায়। ঢালু ইঞ্জিন গোঁ গোঁ করছিল। আঘাত লেগেছিল অর্কর কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে উঠে দাঁড়াতেই লোকটা ছুরি বের করল। ঠিক তখনই গুলিটা ছুটে এল। ছুটন্ত বাইকগুলোর কেউ গুলি চালিয়েছে। অর্ক দেখল লোকটার হাত থেকে ছুরি খসে পড়ল আর ধীরে ধীরে ওর শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল। অর্ক ছুরিটা তুলে নিয়ে চারপাশে তাকাল।
ধাবমান মোটরসাইকেল-ধারীদের আর দেখা যাচ্ছিল না। তিন নম্বরে আগুন জ্বলছে। টিউবওয়েল থেকে বালতি করে মানুষ সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। চারধারে পরিত্রাহি চিৎকার। অর্ক ছুটে এল বিলুর কাছে। ছুরিটাকে ফেলে দিয়ে সে ওকে উপুড় করে শুইয়ে দিতে বুঝল কিছুই করার নেই। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল অর্ক। তারপর বিলুর বিস্ফারিত চোখ বন্ধ করে দিল আলতো করে। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে চারপাশে। আগুনের তাপ লাগছে গায়ে। কিন্তু তার মধ্যেই বিলুর মা আর্তনাদ করে আছড়ে পড়ল ছেলের বুকে। চারধারে কান্নার রব যখন তখন দমকল এল। আগুন নিভিয়ে ফেলার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল তিন নম্বরে।
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেতে মুখ তুলে তাকাল অর্ক। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কারা?’
‘জানি না।’ অর্কর গলায় কান্না পাক খেল।
‘কাউকে চিনতে পারলি না?’
‘না।’
ন্যাড়া বলল, ‘শালারা বদলা নিতে এসেছিল।’
‘তুমি চেন ওদের?’
‘না। কিন্তু বিলুদাকে খুন করেছে যখন তখন বদলা নিতে এসেছিল।’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘ওরা ধরা পড়বেই। আমি ওদের একজনকে যেতে দিইনি। বিলুকে খুন করে ওদের ফিরে যেতে দিইনি।’
দমকল আগুন নিভিয়ে ফেলার পরেই পুলিস এল। দু’গাড়ি পুলিস প্রকৃত ঘটনা জেনে দুটো মৃতদেহ নিয়ে ফিরে গেল।
সেই রাত্রে তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে শুধুই কান্না আর আর্তনাদ। যাদের ছেলে গেল তারা তো বটেই যাদের ঘর গেল তারাও অস্থির হচ্ছিল। ভোরবেলায় সুবল এল। অর্ক বসেছিল গলির মুখে অনেকের সঙ্গে। সুবলকে দেখামাত্র সে উঠে দাঁড়াল, ‘কি দেখতে আসা হয়েছে?’
সুবল মুখ নিচু করল, ‘বিশ্বাস করো আমার মুখ দেখাবার উপায় নেই। কাল থেকে নাইট গার্ডের সংখ্যা কমে গিয়েছে। আমরা ভাবতেই পারিনি ওরা অ্যাটাক করবে।’
‘কারা করেছে জানেন?’
‘মনে হচ্ছে কয়লার লোক। বিলুর ওপর ওদের রাগ ছিল।’
‘ওরা তো আমাকেও খুঁজেছিল।’
‘তাই নাকি?’
অর্ক সুবলের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নাড়ল, ‘যান আপনি, আর এখন এখানে এসে দয়া দেখাতে হবে না।’
সুবল বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। আমি আজই শান্তিকমিটির মিটিং ডাকবো। সতীশদাকে অনুরোধ করব আসার জন্যে। দ্যাখো অর্ক, তোমাদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছিল সেটা আমার ওপরও হতে পারে। তাই না?’
সুবল চলে যাওয়ার পর পরই সতীশদা এল, ‘কি আশ্চর্য। এইভাবে খুন করে যাবে ভাবতে পারিনি। আমি এইমাত্র খবরটা পেলাম।’
‘কাল রাত্রে চিৎকার শোনেন নি?’
‘না। ওরা বিলুকে খুঁজতে এসেছিল?’
‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম বিলুর চরিত্র ভাল নয়।’
‘বিলুর চরিত্র কিরকম সেটা আপনার চেয়ে আমি ঢের বেশী জানি সতীশদা। এ ব্যাপারে কথা বলবেন না।’
‘তুমি উত্তেজিত হচ্ছ।’
‘আমি শীতল হয়ে থাকব বলে আশা করছেন?’
‘কারা এসেছিল চিনতে পেরেছ?’
‘না।’
‘যে ছেলেটিকে তুমি খুন করেছ তার আইডেন্টিফিকেশন—।’
‘আমি খুন করেছি?’
‘না না এটা কোন অফেন্স নয়। মানুষ নিজের নিরাপত্তার জন্যে, আত্মরক্ষার জন্যে এটা করলে আইনের চোখে অপরাধ হয় না।
‘সতীশদা, আপনি যান। আমাদের ব্যাপারটা আমাদেরই বুঝতে দিন। যখন পারব না তখন না হয় আসবেন।’
‘অর্ক। তুমি কিন্তু তিন নম্বর বস্তির মানুষদের আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে দিচ্ছ। বিলুকে যদি প্রটেকশন না দিতে তাহলে এতগুলো মানুষ গৃহহারা হতো না। ব্যাপারটা ভেবে দ্যাখো।’
সতীশদা চলে গেলে অর্ক সবাইকে ডাকল, ‘আপনারা কি করবেন? বিলুকে ওরা খুন করে গেল। আমি জানি বিলু কোন অপরাধ করেনি। তবু খুন হল। ওরা আমাকেও খুন করত। আজ থেকে আমাদের এই বারোয়ারি সংসার চলবে কি চলবে না?’
ন্যাড়ার বাবা বলল, ‘কেন চলবে না বাবা?’
‘আপনারা কি সবাই চান এটা চলুক?’
সমস্ত মানুষ একই সঙ্গে উচ্চারণ করল, ‘চাই, চাই।’
‘বেশ। তাহলে যদি এমন হয় আমিও নেই তাহলে এটাকে বন্ধ করবেন না। আমার কেমন মনে হচ্ছে এটা চলুক তা কেউ কেউ চাইছে না। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। শুধু একটা অনুরোধ, আজ বিলু চলে গেল। অন্তত আজকের সকালটা আমরা রান্না খাবার খাব না। আজকের সকালে তিন নম্বরের উনুন জ্বলবে না। আপত্তি আছে কারো?’
জনতা সমস্বরে জানাল, না, আপত্তি নেই।
অর্ক ঘরে ফিরে এল। মাধবীলতা দরজায় দাঁড়িয়েছিল। অর্ক দেখল ঘরের মেঝেতে বিলুর মা লুটিয়ে আছে। তার পাশে আরও তিনজন মহিলা। অর্ক মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানি না কারা চাইছে না, কিন্তু আমরা এসব করি সত্যি তারা পছন্দ করছে না।’
মাধবীলতার রুগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে অর্ক অবাক হয়ে গেল। মাধবীলতার ঠোঁটে হাসি, ‘তুই ভয় পেয়েছিস খোকা?’
‘না মা। ভয় পাইনি।’
‘খবরদার। যেটা ভাল মনে করবি তাই করবি। কিন্তু কখনও ভয় পাবি না।’
হঠাৎ অর্কর মনে একটা শিহরণ বয়ে গেল। সে দুপা এগিয়ে গিয়ে দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। মাধবীলতা অবাক গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুই কাঁদছিস?’
‘বিলুটা চলে গেল মা।’
‘শক্ত হ। জীবনে অনেক কিছু চলে যাবে খোকা কিন্তু কখনও পিছনে তাকাবি না। কখনও খুঁড়িয়ে হাঁটবি না—।’ কথাটা বলতে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠল মাধবীলতা, ‘এ আমি কি বললাম!’
অর্ক ধীরে ধীরে মাধবীলতাকে সামনে আনল। তার দুটো হাত তখন মাধবীলতার কাঁধে। সেই চোখে চোখ রেখে সে বলল, ‘না মা, তুমি ঠিকই বলেছ।’
বেলা এগারটার সময় তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে দুটো জিপ এসে দাঁড়াল। স্তব্ধ মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে পুলিস অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অর্ক মিত্র কার নাম?’
অর্ক বসেছিল চোখ বন্ধ করে। এবার উঠে দাঁড়াল, ‘আমিই অর্ক। কেন?’
অফিসার ইশারা করতে দুজন সেপাই এগিয়ে গিয়ে তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল, ‘তোমাকে অ্যারেস্ট করা হল।’
‘অ্যারেস্ট? কেন?’
‘খুনের চার্জে। তুমি কাল রাত্রে এখানে একটা খুন করেছ। ছুরির হাতলে যে ছাপ পাওয়া গেছে তার সঙ্গে তোমারটা মিলিয়ে দেখা হবে। নিজেকে খুব শের ভাবছিলে এইটুকু বয়সে, না? চল।’
ততক্ষণে চারধারে হইচই পড়ে গেছে। কাতারে কাতারে মানুষ বেরিয়ে আসছে তিন নম্বরের ঘরগুলো থেকে। পুলিস অফিসার আর সময় নষ্ট করলেন না। অর্ককে টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তোলা হল। কেউ কেউ সামনে গিয়ে ভ্যান আটকাবার চেষ্টা করলেও তাদের সরিয়ে ফেলে বিজয়দর্পে অফিসার বন্দী নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।