2 of 2

৬২. ভারতবর্ষ থেকে কিছুদিন দূরে থেকে

ভারতবর্ষ থেকে কিছুদিন দূরে থেকে নিবেদিতা ভারতবর্ষকে ভালভাবে চিনতে পারলেন। স্বামী বিবেকানন্দর কাছ থেকেও কিছুদিন তাঁর দূরে থাকার প্রয়োজন ছিল। স্বামীজির প্রবল ব্যক্তিত্ব হিমালয় পর্বতকেও আড়াল করে দিতে পারে।

প্রথমবার নিবেদিতা ভারতে এসেছিলেন ধর্মীয় তৃষ্ণায়। ব্যর্থ প্রেমে বিদীর্ণ হৃদয়ে সহসা স্বামী বিবেকানন্দর মতন এক অসাধারণ পুরুষের সান্নিধ্যে এসে ভেবেছিলেন, ইনিই তাকে সারা জীবনের পথ নির্দেশ করবেন। ভারতে অবস্থানের সময় দেখেছিলেন, এ দেশের মানুষের অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অসহায়তার মধ্যেও কত সরলতা, কত সহৃদয়তা। তিনি ঠিক করেছিলেন, স্বামীজির দূতী হিসেবে এইসব মানুষদের সেবা, এখানে শিক্ষাবিস্তারই হবে তাঁর জীবনের ব্রত। তারপর আরও কিছু মানুষের সংস্পর্শে এসে, ভারত ভ্রমণের সময় নিজেরও কিছু কিছু অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা করে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, ভারতের কোটি কোটি মানুষের মুখে লেখা রয়েছে পরাধীনতার জ্বালা, বেদনা, অপমান। এ দেশের দারিদ্র্য, অশিক্ষা ইত্যাদি সব কিছুর মূলে আছে পরাধীনতা। একটা ইস্কুল খুলে পনেরো, কুড়িটা মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে কিংবা রোগ-মহামারীর সময় দুচারটে বস্তিতে সেবাকর্ম চালিয়ে সেই মূল সমস্যার গায়ে একটি আঁচড়ও কাটা যাবে না। বিদেশি শাসকদের দূর করে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনই এখন প্রথম ও প্রধান কাজ।

কিন্তু বেদান্তের চর্চায় কিংবা হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান প্রচেষ্টায় কি স্বাধীনতার পুনরুদ্ধার সম্ভব? সে কি ঝড়ের সময় উটপাখির বালিতে মুখ গুঁজে থাকার মতন নয়? তলোয়ারবন্দুক কামানে সশস্ত্র শাসকশ্রেণী এই মূর্তিপূজকদের ধর্মের উত্থান-পতনের তোয়াক্কা করে না। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে। হিন্দুদের যুদ্ধ ক্ষমতার কোনও ইতিহাস নেই, তারা অস্ত্র ধরতেই ভুলে গেছে। মুসলমানরা যোদ্ধৃজাতি হলেও তারা এখন নিরস্ত্র ও অবদমিত, যেন অনেকটা নেশার ঘুমে আচ্ছন্ন, তাই শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা নিশ্চিন্তে এই সাম্রাজ্য শোষণ করে চলেছে।

নিবেদিতা একসময় দেবী কালীর মাহাত্ম বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। কালী দা মাদার নামে পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। এবারে বিলেতে অবস্থানের সময় তার উপলব্ধি হল, ওসবের এখন প্রয়োজন নেই, এখন তার একটা নতুন বই লেখা উচিত, সেই বইয়ের নাম হবে স্বাধীনতা।

স্বাধীনতা! স্বাধীনতার রূপ যে কী রকম তাই-ই যে অধিকাংশ ভারতবাসী জানে না। বহু বছর ধরে পরাধীনতার অপমান সইতে সইতে তারা স্বাধীনতার স্বাদই ভুলে গেছে। শিক্ষিত লোকেরাও মনে করে, ইংরেজরা যেন দেবতাদের মতন অপরাজেয়, তাদের বিতাড়ন করার কোনও প্রশ্নই ওঠে। না। বরং ইংরেজি ভাষায় তাদের কাছে আবেদন-নিবেদন-ভিক্ষা চেয়ে কিছু সুযোগ-সুবিধে আদায়ের চেষ্টা করাই শ্রেয়।

স্বাধীনতা বিষয়ে ভারতীয়দের এই নিস্পৃহ ভাবটা নিবেদিতাকে ব্যথিত করে। আত্মমর্যাদা জ্ঞান না থাকলে কোনও জাতি কি বড় হতে পারে? একটা ঘটনা মনে পড়লে নিবেদিতার শুধু দুঃখ বেশি নয়, রাগও হয়।

ইংল্যান্ডে এখন বেশ কিছু ভারতীয় আছে, তাদের কয়েকটি সমিতিও আছে। কয়েক বছর আগে কেমব্রিজের ইন্ডিয়ান মজলিস নামে একটি সমিতি সভা ডেকে দুজন ভারতীয়কে সংবর্ধনা জানিয়েছিল সাড়ম্বরে। সেই দুজন ভারতীয় কে কে? অতুল চ্যাটার্জি ও রণজিৎ সিংজি! অতুল চ্যাটার্জি আই সি এস পরীক্ষায় সমস্ত ইংরেজ পরীক্ষার্থীদের ডিঙিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে, আর ভারতের এক দেশীয় রাজ্যের রাজকুমার, বিলেতেই প্রতিপালিত রণজিৎ সিংজি ক্রিকেট খেলায় শত রান করেছে। এই এঁদের কৃতিত্ব! ভারতীয় আই সি এস-রা ইংরেজদের উচ্চ বেতনের ভৃত্য, আর রণজিৎ সিং ক্রিকেট খেলায় নিজের দেশের কিছুমাত্র গৌরব বৃদ্ধি করেননি, তিনি ইংলন্ডের দলের একজন ভাড়াটে খেলোয়াড়মাত্র। সে যাই হোক, ওই দুজনের গলায় মালা পরানো হয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু সেই সময় লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ ও জগদীশচন্দ্র বসু এসে রয়েছেন, দেশের মুখোজ্জ্বলকারী এই দুই সন্তানকে সংবর্ধনা জানাবার কথা ওই ইন্ডিয়ান মজলিসের একবারও মনে পড়েনি! এমনকী স্বামী বিবেকানন্দ সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন, তবু কেউ তার কণ্ঠে মালা দেয়নি। সংবর্ধনার ভাষণে ইংরেজ তোষণের সুর ঝরে পড়ছিল।

পরাধীন দেশ বলে ভারতকে পৃথিবীর অন্য দেশগুলি যে কত অবজ্ঞা করে, তা কি ভারতীয়রা বোঝে না?

নিউ ইয়র্কে বিপিনচন্দ্র পাল নামে এক ব্রাহ্ম নেতার সঙ্গে নিবেদিতার দেখা হয়েছিল। তিনি একেশ্বরবাদ প্রচার করতে গিয়েছিলেন সেখানে। লোকটি বড় তার্কিক। নিবেদিতার সঙ্গে এক একদিন তার প্রায় ঝগড়া লেগে যেত। শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামী কালীপূজকদের ব্রাহ্মরা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। ঝগড়া হলেও প্রত্যেকবারই শেষের দিকে হাসি মুখেই বিদায় নিতেন বিপিন পাল, তার ভদ্রতা বোধ আছে।

এই বিপিন পালের একটি অভিজ্ঞতার কথা শুনে মনে বেশ দাগ কেটেছিল নিবেদিতার। কোনও এক স্থানে বিপিনচন্দ্র বেশ উদ্দীপনার সঙ্গে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, শেষ হবার পর এক সৌম্যদর্শন আমেরিকান তার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, ভদ্রমহোদয়, আপনি পরাধীন দেশের মানুষ, ইংরেজের দাস, আপনি এখানে ধর্মের কথা শোনাতে এসেছেন, তাতে কে গুরুত্ব দেবে? আমেরিকানরা ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করে স্বাধীন হয়েছে, তারা মনে করে, আপনাদের যেটা আসল কাজ সেটাই করছেন না। আগে আপনার দেশ স্বাধীন হোক, তারপর তত্ত্বকথা শোনাতে আসবেন।

কথাটা শুনে বিপিনচন্দ্রের মুখোনা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকান ভদ্রলোকটির বাক্যে উগ্রতা ছিল না, বন্ধুত্বের ভাব ছিল, তার বক্তব্যের স্পষ্ট সত্যতা ধাক্কা মেরেছিল বিপিনচন্দ্রের বুকে। পরাধীন মানুষের মুখে বড় বড় কথা মানায় না। এখানকার লোক আড়ালে হাসে? স্বামী বিবেকানন্দ যে এত বক্তৃতা দিয়ে গেলেন, তার ফল শেষ পর্যন্ত কী হবে বক্তৃতা সভায় কিছু কৌতূহলী ও হুজুগপ্রিয় লোকেরা এসে ভিড় জমায়। সংবাদপত্রে তাঁর বাগ্মিতা ও চেহারার প্রশংসা ছাপা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কত জন তাঁর অনুগামী হয়েছে? দশ বারো জনের বেশি নয়। তাঁর প্রধান ভক্ত তো গুটিকতক বিধবা ও কুমারী মহিলা। বিপিনচন্দ্র ঠিক করলেন, ধর্মের তত্ত্বকথা প্রচার আপাতত মুলতুবি থাক। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি রাজনীতিতে অংশ নেবেন। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে প্রকাশ করবেন নিজস্ব পত্রিকা। এ পরাধীনতার জ্বালা এবং শোষিত নিষ্পেষিত ভারতীয় জনগণের অবস্থা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ সম্পূর্ণ সচেতন। প্রথম প্রথম ভারতে গিয়ে নিবেদিতা সব কিছু দেখেই মুগ্ধ হতেন, ভারতে চুরি-ডাকাতি-নরহত্যার সংখ্যা খুব কম দেখে নিবেদিতা একদিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ভারতীয়রা কী শান্তিপূর্ণ জাতি! তা শুনে স্বামীজি শ্লেষ ও বিষাদ মিশ্রিত কণ্ঠে বলেছিলেন, মৃতের সাত্ত্বিকতা! এ জাতটা এমনই নির্জীব হৃয়ে গেছে যে ভাল করে গুণ্ডামি-ডাকাতিও করতে পারে না!

আর একদিন তিনি কথায় কথায় বলেছিলেন, আমি ফুটবল খেলা পছন্দ করি। তার কারণ তাতে লাথির বদলে লাথি দেওয়া যায়। এ কথায় কি একটা সুক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিল না? তিনি আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাতে বিশ্বাসী।

স্বামীজি আরও বলেছেন, ভারতবর্ষ জয় করা ইংরেজদের পক্ষে এত সহজ হয়েছিল কেন? যেহেতু তারা একটা সঙ্ঘবদ্ধ জাতি ছিল, আর আমরা তা ছিলাম না।…এখন জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাদের উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা। এরকম কথা স্বামীজি বারবার বলেছেন, ভারতের জনসাধারণকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে হবে।

কিন্তু সে দায়িত্ব কে নেবে? নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা স্বামী বিবেকানন্দর চেয়ে আর কার বেশি? তিনি ভাষায় আগুন ছোটাতে পারেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার অসীম ক্ষমতা রয়েছে তার। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত তার পরিচিতি, অনেক দেশীয় রাজা তার ভক্ত। তিনি যদি দেশের মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান, তবে হাজার হাজার মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবে। তার নির্দেশে ইংরেজকে তাড়াবার জন্য তারা হাতে অস্ত্র তুলে নেবে। নিবেদিতা যেন কল্পনায় এ-দৃশ্য দেখতে পান, বিশাল জনতার মাঝখানে অগ্নিশিখার মতন স্বামী বিবেকানন্দ দণ্ডায়মান, তিনি স্বাধীনতার আহ্বান জানাচ্ছেন, আর সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতন জনসমষ্টি গিয়ে ধাক্কা মারছে ইংরেজ রাজশক্তিকে।

কিন্তু এ কল্পনা দিবাস্বপ্নের মতন অলীক। নিবেদিতার গুরু এ দায়িত্ব নেবেন না। তিনি যে সন্ন্যাসী। তার মতে, জগতের সেবা ও ঈশ্বরপ্রাপ্তিই হচ্ছে সন্ন্যাসীর শ্রেষ্ঠ আদর্শ। বেলুড় মঠ স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য অন্নদান, বিদ্যাদান, জ্ঞানদান। এইসব দান সারা দেশে পৌঁছতে কত যুগ, কত শতাব্দী লেগে যাবে? নেতা-স্থানীয় অনেকেই বলেন, আগে দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, তারপর স্বাধীনতার কথা চিন্তা করা যাবে। এটা একপ্রকার পলায়নী মনোবৃত্তি নয়? পরাধীন অবস্থায় প্রকৃত শিক্ষাবিস্তার সম্ভব? শাসকশ্রেণী তা দেবে কেন? এখন ভারতে শিক্ষিতের সংখ্যা যৎসামান্য, তাতেই বড়লাট লর্ড কার্জন উচ্চ শিক্ষা সংকোচের উদ্যম নিয়েছেন। আগে দেশ স্বাধীন হলে তবেই নিজস্ব শিক্ষানীতি প্রবর্তন করা সম্ভব। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে করতেই মানুষের মনে আত্মমর্যাদাবোধ জাগবে।

ধর্মসাধনা না স্বাধীনতার জন্য সাধনা, এখন দেশের পক্ষে কোনটা বেশি জরুরি? নিবেদিতা দ্বিতীয়টির পক্ষে মনস্থির করে ফেলেছেন। এবং বুঝে গেছেন, এ ব্যাপারে তিনি তার গুরুর সাহায্য পাবেন না। জাতীয় নেতা হিসেবে যাঁকে সবচেয়ে বেশি মানায়, তিনি এখন, এমনকী মঠের নেতৃত্ব থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। কেমন যেন নির্বেদ এসে গেছে তার। মৃত্যু সম্পর্কে প্রাচ্য ধারণা ও পাশ্চাত্য ধারণায় অনেক তফাত আছে, নিবেদিতা এর ঠিক সামঞ্জস্য করতে পারেন না। হিন্দু-বৌদ্ধরা পরজন্মে বিশ্বাসী, তাই মৃত্যুকে তারা সহজভাবে নেয়, প্রকৃত মৃত্যুর অনেক আগে থেকেই নিজেকে তৈরি করে নেয়, অনেকে স্বেচ্ছায় মৃত্যু কামনা করে। পাশ্চাত্যের মানুষ মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকে, মৃত্যুর কোনও মহত্ত্ব নেই তাদের কাছে। মানুষের লোগ-ভোগ থাকেই, চিকিৎসায় তার উপশমও হয়। স্বামীজি আরও পাঁচ কি দশ বছর যে বাঁচবেন না, তা কে বলতে পারে? কিন্তু এর মধ্যেই তিনি কেমন যেন নিরুদ্যম হয়ে পড়েছেন।

ভারতে ইংরেজরা যে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য নিবেদিতা ব্যক্তিগতভাবে অপরাধ বোধ করেন। তিনি জাতে আইরিশ, আইরিশদের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ চলছেই কিন্তু ভারতীয়দের কাছে তিনি ব্রিটিশ। তিনি শাসক সমাজেরই একজন। ব্রিটিশ পতাকার প্রতি একসময় তার আনুগত্য ছিল, এখন সেই পতাকা তার দুচক্ষের বিষ। মাঝে মাঝেই তিনি আপন মনে কাতরভাবে বলে ওঠেন, হে ভারত। ভারত! আমার জাতি তোমার যে ভয়ানক ক্ষতি করেছে, কে তার অপনোদন করবে? হে ভারত! তোমার সন্তানদের মধ্যে যারা অতীব সাহসী, যারা তীক্ষ্ণ অনুভূতিসম্পন্ন, যারা শ্রেষ্ঠ, তাদের ওপর এই যে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ অপমান বর্ষিত হচ্ছে-কে তার একটিরও প্রায়শ্চিত্ত করবে, বলো?

নিবেদিতাই সে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর। ভারতে জ্ঞানী, গুণী, চিন্তাশীল মানুষের অভাব নেই, ইংরেজদের চেয়ে তারা কোনও অংশে কম নন, তবু প্রতিনিয়ত তাদের কত অপমান সইতে হয়! এবারে ইংল্যান্ডে এসে জগদীশচন্দ্র বসুর ব্যাপারেই নিবেদিতা তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ দেখলেন।

জগদীশচন্দ্র যে পৃথিবীর একজন প্রথম সারির বৈজ্ঞানিক, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। তিনি মলত পদার্থবিদ, সম্প্রতি প্রবেশ করেছেন শরীরতত্ত্বে। জীবজগৎ ও জড়ের মাঝখানের সীমারেখা লপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাঁর গবেষণায়। এরকম একজন বৈজ্ঞানিককে ভারত সরকারের উচিত ছিল সর্ববিষয়ে সাহায্য করা, তার বদলে তিনি পেয়েছেন ঔদাসীন্য, অবজ্ঞা ও প্রতিরোধ। বিদেশের বিজ্ঞান সভাগুলিতে অংশগ্রহণ ও উন্নত গবেষণার সুযোগ নেবার জন্য তাকে দেশের কয়েকজন ব্যক্তির অর্থ সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।

প্যারিস কংগ্রেসে প্রভূত প্রশংসা পাবার পর জগদীশচন্দ্র চলে এসেছিলেন লন্ডনে। এখানেও তিনি রয়াল সোসাইটিতে তার গবেষণা পাঠের আমন্ত্রণ পান। তারপরই শুরু হয়ে যায় একশ্রেণীর ইংরেজ বৈজ্ঞানিকদের ঈর্ষা, স্বার্থপরতা ও ষড়যন্ত্র। রয়াল সোসাইটি সেই গবেষণাপত্রটি ছাপিয়েও কিছু বৈজ্ঞানিকদের প্রতিরোধে তার প্রচার বন্ধ করে দিল। ভারত সরকার জগদীশচন্দ্রের ডেপুটেশন বৃদ্ধি করতে না চেয়ে তাকে চাপ দিল ভারতে ফিরে আসার জন্য। এইরকম সংকটের সময় হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন জগদীশচন্দ্র।

নিবেদিতা এই বসু দম্পতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন অনেক আগেই। তিনি লন্ডনে তাদের এই অসহায় অবস্থার মধ্যে দেখে শুধু যে সেবার জন্য এগিয়ে এলেন তাই-ই নয়, কিছুদিনের জন্য ওই দুজনকে এনে রাখলেন তার মায়ের বাড়িতে।

শুধু বৈজ্ঞানিক হিসেবেই নয়, জগদীশচন্দ্রের চরিত্রের একটি দৃঢ়তার দিকের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন নিবেদিতা। জগদীশচন্দ্র মনে-প্রাণে ভারতীয় এবং স্বদেশপ্রেমী। তিনি যা-কিছু করছেন, সবই ভারতের গৌরব বৃদ্ধির জন্য। বিদেশে তিনি একাধিক লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন, তাতে তার আর্থিক অসচ্ছলতা তো ঘুচে যাবেই, তিনি অত্যাধুনিক লেবরেটরিতে গবেষণারও সুযোগ পাবেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র একটাও গ্রহণ করতে সম্মত হননি। অন্য দেশে চাকরি নিলে তার গবেষণালব্ধ আবিষ্কার তো সে দেশেরই হবে। প্রতিরোধ, বিড়ম্বনা, দারিদ্র্য সহ্য করেও তিনি ভারত মায়ের সন্তানই থাকতে চান। এমনকী জগদীশচন্দ্রের কয়েকটি আবিষ্কারের পেটেন্ট নেবারও প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফল তো সর্বসাধারণের জন্য, তিনি নিজে তার থেকে লাভবান হতে চান না। নিবেদিতার মনে হয়, এরকম ত্যাগ শুধু কোনও ভারতীয়ের পক্ষেই সম্ভব।

ভারত স্বাধীন না হলে তার এইসব সুসন্তান পৃথিবীতে যথাযযাগ্য মর্যাদা পাবে কী করে?

বিলেতে আর একজন ভারতীয়ও নিবেদিতার মনে স্বাধীনতা অর্জনের স্পৃহা উস্কে দিল। রমেশচন্দ্র দত্ত উগ্র জাতীয়তাবাদী নন, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন না, কিন্তু তিনি ভারতের অর্থনৈতিক দুরবস্থার বিশ্লেষণ করে ইংরেজদের শোষণের রূপটি প্রকট করে দেন। ইংরেজরা ভারতে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের বড়াই করে, কিন্তু তাদের শাসনেই যে ভারতে বারবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে, সে সম্পর্কে তাদের বিবেকে কোনও আঁচড় কাটে না?

ধর্ম বিপ্লবের বদলে রাজনৈতিক বিপ্লবের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন নিবেদিতা। বিলেতে বসে থেকে কোনও কাজ হবে না, ভারতে গিয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই সময় জো ম্যাকলাউডের কাছ থেকে তিনি জাপানের দৃত ওকাকুরার সংবাদ পেলেন। দুজনের পত্র বিনিময়ে অনেক তথ্য উন্মোচিত হল। ওকাকুরা শুধু শিল্প পণ্ডিত নন, ধর্মসভার প্রতিনিধি নন, তিনি স্বাধীনতার প্রবক্তা। একটি অশ্রুতপূর্ব তত্ত্ব এনেছেন তিনি, এশিয়া মহাদেশের ঐক্য। এশিয়ার সব দেশগুলি একযোগে ইওরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশগুলি প্রস্তুত, ভারতকে সহযোগী হিসেবে পাওয়া বিশেষ দরকার। ভারত স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করলেই ওই সব দেশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে। ওকাকুরা সেই বার্তা নিয়েই ভারতে এসেছেন। প্রয়োজনে অন্য দেশ থেকে অস্ত্র আসবে, টাকাকড়ি আসবে।

এরকম স্বর্ণ সুযোগ আর কবে পাওয়া যাবে? ওকাকুরার সঙ্গে দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন নিবেদিতা। কলকাতায় ফিরে আসার পর নিবেদিতার সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় হল স্বল্পভাষী ওকাকুরার সহযোগী হয়ে গেলেন নিবেদিতা প্রথম দর্শন থেকেই।

ওলি বুলের পার্টিতে আহ্বান জানানো হল বিশিষ্ট ব্যক্তিদের, আশুতোষ চৌধুরী, প্রমথ মিত্র, বিপিন পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, সখারাম গণেশ দেউস্কর, সুবোধ মল্লিক প্রমুখ অনেকেই এলেন। ঠাকুরবাড়ি থেকে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সুরেন ও আরও অনেকে। মস্ত বড় একটি হলঘরে সমবেত হয়েছেন আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ, ঠিক মাঝখানে একটি চেয়ারে বসে আছেন ওকাকুরা, তাঁর দু’পাশে ওলি বুল ও নিবেদিতা। ওকাকুরা মাঝারি উচ্চতায় বলিষ্ঠকায় এক পুরুষ, কালো সিল্কের কিমোনো পরিহিত, তার ওপরে পারিবারিক প্রতীক চিহ্ন হিসেবে পাঁচ পাপড়ির একটি ফুল কাজ করা। গরমের জন্য তিনি একটি সুদৃশ্য পাখায় হাওয়া খাচ্ছেন, সেই পাখাতেও রক্তপিঙ্গল রঙের পল্লবগুচ্ছের অলঙ্করণ, জাপানি কাপড়ের মোজায় পা ঢাকা, পরে আছেন ঘাসের চটি। চোখের পাতা ভারী, যৎসামান্য গোঁফ, গায়ের রং লালচে, স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে আসীন। তিনি নীরবে ইজিপশিয়ান সিগারেট টেনে যাচ্ছেন, একটার পর একটা, সব কথাই বলে যাচ্ছেন নিবেদিতা। এদেশের প্রধান ব্যক্তিদের সঙ্গে ওকাকুরার পরিচয় করাবার ভার তিনি স্বেচ্ছায় নিয়েছেন। ওকাকুরা একটি বই লিখছেন ‘আইডিয়ালস অব দা ইস্ট’ নামে। তাতে তিনি দেখাচ্ছেন এশিয়ার দেশগুলির মানুষদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির কতখানি মিল, সে বিষয়ে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করলেন নিবেদিতা। এই বইয়ের তিনি পাণ্ডুলিপি সংশোধন করছেন, ইংরিজি ভাষায় সুষ্ঠু রূপ দিচ্ছেন, এই বই সম্পর্কেও তাঁর দারুণ উৎসাহ।

নিবেদিতা পরে আছেন দুগ্ধধবল সিল্কের লম্বা পোশাক, মাথার চুলগুলি চুড়ো করে বাঁধা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তার রূপ দেখলে মনে হয় যেন পাহাড়ের ওপর জ্যোৎস্না পড়েছে। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের সঙ্গে আগে তার পরিচয় হয়নি, তারা নিবেদিতাকে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত এক সন্ন্যাসিনী হিসেবেই জানত। তারা খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই অনুভব করল যে নিবেদিতা তাঁর গুরু কিংবা অধ্যাত্ম বিষয়ে কিছুই বলছেন না, এই জাপানি ভদ্রলোকটির গুণপনা সম্পর্কেই উচ্ছ্বসিত।

সভাভঙ্গের পর খাদ্য পানীয় এসে গেল। রবীন্দ্র-অবনীন্দ্ররা উঠে পড়লেন, নিবেদিতা তাদের পাশে এসে কুশল বিনিময়ের পর সুরেন্দ্রকে বললেন, তুমি আর একটু থেকে যাবে? জাপান ভদ্রলোকটি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

এত সব গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে শুধু সুরেন্দ্রর সঙ্গেই কেন তিনি আলাদা কথা বলতে চান তা বোঝা গেল না। সমাগত অতিথিদের মধ্যে সুরেন্দ্রের বয়েসই সবচেয়ে কম। নিবেদিতাও তাকে খুবই স্নেহ করেন। সুরেন্দ্র রয়ে গেল।

ওকাকুরা বড় হলঘরটা ছেড়ে উঠে গিয়ে বসেছেন পাশের একটি কাঁচ বসানো ছোট বারান্দায়। সেখানে একটি মাত্র টেবিল ও দুটি চেয়ার। একটি চেয়ারে বসে তিনি ধুমপান করে যাচ্ছেন, আগেকার মতনই অটল গাম্ভীর্যে পূর্ণ। নিবেদিতা সুরেন্দ্রর পরিচয় দিতেই ওকাকুরা বয়ঃকনিষ্ঠ সুরেন্দ্রকে সমমর্যাদায় অভিবাদন জানালেন এবং পাশের চেয়ারটিতে বসবার ইঙ্গিত করলেন। কিমোনোর ঢোলা হাতার ভেতর থেকে জাদুকরদের মতন বার করলেন এক টিন সিগারেট, তার থেকে একটি দিলেন সুরেন্দ্রর দিকে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের সামনে ধূমপান করার কোনও প্রশ্নই নেই, তাই সুরেন্দ্র তা প্রত্যাখ্যান করল। সবিনয়ে।

ওকাকুরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সুরেন্দ্রর মুখের দিকে। যেন তিনি কিছু বলতে চান, কিন্তু কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। সুরেন্দ্র নিবেদিতার দিকে মুখ ফেরাল। তখনই ওকাকুরা স্পষ্ট অথচ ধীর স্বরে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, নব্য যুবক, আপনার দেশের জন্য আপনি কী করতে চান বলুন?

প্রথমেই এমন একটি প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল সুরেন্দ্র। দেশের জন্য কে আবার আলাদা ভাবে কী করে? সবাই নিজের নিজের কাজ করে যায়।

প্রশ্নটির প্রকৃত অর্থ বোঝায় সাহায্যের জন্য সুরেন্দ্র তাকাল নিবেদিতার দিকে। নিবেদিতা মিটি মিটি হাসছেন।

ওকাকুরা আবার বললেন, আপনার এই দেশটির নাম ভারতবর্ষ। কী মহান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিসম্পন্ন এই দেশ। এখান থেকেই বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়েছে সারা পৃথিবীতে, এককালে হিন্দুরা শিল্পে-ভাস্কর্যে কত সমুন্নত ছিল। সেই দেশ আজ শৃঙ্খলিত, পরাধীন। এই ভারতবর্ষকে শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য সমস্ত যুবসমাজকে সঙঘবদ্ধ হতে হবে। সে জন্য আপনি কি কিছু চেষ্টা করেছেন?

সুরেন্দ্র ধনী বংশের সন্তান। তাদের পরিবারে সে আবাল্য স্বদেশি আবহাওয়া দেখে এসেছে। দেশের গান, দেশের সাহিত্য, শিল্পকলার উন্নতির জন্য এই পরিবার অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ইংরেজদের কুক্ষিগত, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কিছু কিছু ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যুবসমাজকে সঙঘবদ্ধ করার দায়িত্ব কে নেবে। সে রকমভাবে তো বাইরের লোকদের সঙ্গে মেলামেশাই হয় না।

সে দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, দেশের যুবকদের সঙঘবদ্ধ করার কাজ, মানে, কী করে তা হবে, ইংরেজ সরকার তা দেবে কেন? কিছু করতে গেলে নিশ্চিত বাধা আসবে। আমরা সাধ্যমতন নিজেদের কাজ করে যাচ্ছি…ভবিষ্যতে যদি কখনও, মানে, যখন সময় আসবে…

ওকাকুরা মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, বাধা আসবে? কাজ শুরুর আগেই বাধার চিন্তা। এ দেশের তরুণদের মধ্যে নৈরাশ্যের সুর দেখে আমি বড় দুঃখ পাচ্ছি। বাধা এলে প্রাণ তুচ্ছ করে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। একটা দেশের হাজার হাজার যুবক যখন নিজেদের প্রাণ বলি দেবার জন্য তৈরি হয়, তখনই স্বাধীনতা আসে।

কথা থামিয়ে সিগারেটে কয়েকটা টান দিলেন ওকাকুরা। ভেতর থেকে একজন পরিচারক তাঁর জন্য একটি পানপাত্রে সূরা এনে দিল, তাতে একটি চুমুক দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রশ্ন করলেন, আপনি কখনও আপনার চোখের সামনে একজন লোক আর একজন লোকের বুকে ছুরি বসাচ্ছে, এ দৃশ্য দেখেছেন?

সাঙ্ঘাতিক চমকে উঠে সুরেন্দ্র বলল, না। না দেখিনি!

ওকাকুরা আবার বললেন, চোখের সামনে কেউ মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে দেখেননি?

সুরেন্দ্র আবার প্রবলভাবে দুদিকে ঘাড় নাড়ল। হিন্দুরা দূগাপূজা কালীপূজার সময় পাঁঠা বলি দেয় বলে ব্রাহ্মরা ঘৃণায় সেদিকে তাকায় না। তারা দেখবে মানুষ মারার দৃশ্য!

এবারে চেয়ারে হেলান দিয়ে সহাস্যে ওকাকুরা বললেন, আপনারা ঘেরাটোপে মানুষ হয়েছেন। কঠোর বাস্তবতা দেখতে চান না। সেই জন্য আপনাদের মন নরম, দুর্বল। আমাদের জাপানে কোনও ব্যক্তি খুব অপমানিত হলে কিংবা নিজের কোনও অপরাধ বোধ করলে সর্বসমক্ষে নিজে ছুরি দিয়ে নিজের পেট ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আবার কেউ যদি তার পরিবারের অসম্মান করে, তা হলে তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। আমার ছেলেবেলায় কী একটি দৃশ্য দেখেছিলাম শুনুন। তখন আমি বেশ ছোট। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার, বাড়ি ভর্তি অনেক লোকজন। একদিন বাইরের দিকের একটি ঘরে কী নিয়ে যেন কয়েকজনের মধ্যে প্রবল বাগবিতণ্ডা শুরু হয়েছিল। জাপানিরা জানেন তো, এমনিতে কম কথা বলে, অনেক সময় উত্তেজিত বা ক্রুদ্ধ হলে খুব জোরে চেঁচায়। সেই রকম চেঁচামেচি শুনে আমি কৌতূহলী হয়ে সেই ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মারলাম। দেখি কী, একটা চেয়ারে বসে আছে আমার কাকার মুণ্ডহীন ধড়, মুণ্ডুটা গড়াচ্ছে মেঝেতে, আর গলা দিয়ে ফিনকি দিয়ে উঠছে রক্তের ফোয়ারা!

সুরেন্দ্র শিউরে উঠে হতবাক হয়ে গেল।

নিবেদিতা বললেন, জাপানিরা খুব কোমল প্রাণ, সামান্য ছোটখাটো ব্যাপারেও তাদের শিল্পরুচির পিরচয় পাওয়া যায়, কিন্তু প্রয়োজনে তারা কঠোরস্য কঠোর হতে পারে।

ওকাকুবা বললেন আপনি ভারতীয়, আমি জাপানি। কোথাও একটা মিল আছে আমাদের মধ্যে। হিমালয় পর্বত দুটি শক্তিশালী সভ্যতাকে পৃথক করে রেখেছে, এক দিকে চিনের কনফুসিয়াস-পন্থী সাম্যবাদ, আর ভারতের বৈদিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। কিন্তু সেই তুষারমণ্ডিত পর্বতও কখনও এই দুই সভ্যতার মধ্যে মৌল বিভেদ ঘটাতে পারেনি। এশিয়ার সব জাতির মধ্যেই আছে। ভালবাসার ঐক্য। আপনাকে কয়েকটা ঘটনা বলি শুনুন। জাপানের সম্রাট তাকাকুরা এক দারুণ শীতে রাতে তাঁর গা থেকে লেপ কম্বল ফেলে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন অনেক গরিব প্রজার বাড়িতে সে রাতে তুষারপাত হচ্ছে, তারা শীতে কাঁপছে। কিংবা আর একজন, তাইসো, তিনি খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কারণ দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ায় গরিব লোকদের খাবার জুটছিল না। এই যে ত্যাগের আদর্শ, যেখানে রাজা-প্রজা এক জায়গায় মিলে যায়, তা কি আমরা বোধিসত্ত্বের কাছ থেকে পাইনি? ভারতের সঙ্গে আমাদের সমভ্রাতৃত্বের বন্ধন, ভারতের পরাধীন অবস্থার দুর্দশা দেখলে আমাদের বুকে ব্যথা বাজবে!

নিবেদিতা বললেন, সুরেন, আমরা একটা পরিকল্পনা নিয়েছি, তাতে তোমাকে অংশ নিতে হবে।

ওকাকুরা বললেন, আপনার মতন যুবকদের সাহায্য চাই। অস্ত্রবিদ্যা শিখতে হবে, প্রয়োজনে চরম আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

সুরেন এবার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমার এক পিসতুতো বোন সরলা, শ্ৰীমতী সরলা ঘোষাল ছেলেদের নিয়ে একটা সমিতি গড়েছেন। সেখানে অনেকে লাঠি, তলোয়ার খেলা শেখে।

নিবেদিতা বললেন, সে কথা জানি। সরলার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। এ রকম আরও কয়েকটি ছোটখাটো দলের সন্ধান পেয়েছি। বৃদ্ধ ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রও একটি সমিতি পরিচালনা করেন। এ দেশের বেশির ভাগ ব্যারিস্টারই কংগ্রেসের মিটিং-এ গিয়ে বক্তৃতার তোড়ে গগন ফাটায়, নিজেদের জাহির করে। মিস্টার মিত্র ওসব বক্তৃতায় বিশ্বাস করেন না, নিজেকে আড়ালে রাখেন। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী। একজনের কাছে শুনলাম, অনেক দিন আগে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন আদালত অবমাননার দায়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, তখনই ওই ব্যারিস্টার মিত্র পরিকল্পনা করেছিলেন, জেল ভেঙে সুরেন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে আনবেন। সেটা তখন সম্ভব হয়নি, কিন্তু মানুষটির সাহস আছে বলতেই হবে! এখন তিনি একটি যুবক দল তৈরি করছেন। নানান জায়গায় ছড়িয়ে থাকা এইসব গুপ্ত সমিতিগুলিকে বাঁধতে হবে একতা সূত্রে।

ওকাকুরা বললেন, শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতেই এই যোগাযোগ স্থাপন করার প্রয়োজন আছে। তার আগে, আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। কাক-পক্ষীতেও যেন কিছু টের না পায়। মিঃ টেগোর, আপনি এই গোপনীয়তা রক্ষার শপথ নিতে পারবেন তো?

নিবেদিতা সুরেন্দ্রর দিকে ব্যগ্রভাবে তাকিয়ে রইলেন।

সুরেন্দ্র মাথা নুইয়ে বলল, অবশ্যই পারব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *