2 of 3

৬২. একটা নদী কত কী করতে পারে

৬২

একটা নদী কত কী করতে পারে! পালটে দেয় ভূ-চিত্র, পালটে দেয় জীবনের দর্শন, বদলে দেয় মনের অবস্থা। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে চয়ন যে আদিগন্ত বিস্তারকে দেখছিল তেমনটি কলকাতার গলিতে বন্ধ তার আশৈশব জীবনে সে দেখেনি। তার রোগক্লিষ্ট, অভাবতাড়িত জীবনে প্রকৃতির শোভার কোনও স্থানই ছিল না। এক থালা ভাতের শোভা অনেক বেশী প্রয়োজন ছিল তার। একখানা বাড়তি টিউশনি পাওয়াই ছিল জীবনদর্শন। চারুশীলার কল্যাণে এই আঘাটায় এসে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পৃথিবীর মহত্ত্ব উপলব্ধি করে সে বুঝল, কলকাতায় এতকাল ধরে যে জীবন সে যাপন করে এসেছে তা হল এক পশুর জীবন।

হেমাঙ্গর ঘরে একটা পারিবারিক মিটিং বসেছে। তার সেখানে থাকা উচিত নয় মনে করে সে এক ফাঁকে বেরিয়ে এসেছে। নদীর ধারে আত্মবিস্মৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদি রুজিরোজগার, জীবন ধারণের সমস্যা ইত্যাদি না থাকত, যদি মাত্র দুটি ভাতের ব্যবস্থা থাকত দু’বেলা, তাহলে সেও এরকম একটা জায়গায় বাস করত এসে।

খুব নরম গলায় কে যেন ডাকল, চয়নবাবু!

চয়ন ফিরে তাকিয়ে ঝুমকিকে দেখে তটস্থ হয়ে বলল, আজ্ঞে।

বেরিয়ে এলেন যে!

চয়ন লজ্জিত হয়ে বলে, ওঁদের সব পারিবারিক কথা হচ্ছে, তাই বেরিয়ে এলাম। আমি বাইরের লোক।

ঝুমকি ঠোঁটের একটি ভঙ্গিমা করল, বোধহয় তাচ্ছিল্যের। বলল, বাইরের লোক তো আমিও। চারুমাসি জোর করে নিয়ে এল বলে এলাম। ওদের কী ব্যাপার বলুন তো! প্রবলেমটা কী?

চয়ন সতর্ক হয়ে নিস্পৃহ গলায় বলে, আমি ঠিক জানি না।

ঝুমকির মুখে যথেষ্ট বিরক্তি ফুটে আছে। সে হঠাৎ বলল, আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে। আপনার পায়নি?

চয়ন একটু হাসল। তার কত খিদে পায় এবং খিদে মরে যায়। সে মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে না।

ঝুমকি খিদে ভুলে হঠাৎ নদীর দিকে, পরপারের দিকে চেয়ে থেকে বলল, কী সুন্দর জায়গা, না?

যে আজ্ঞে। খুবই সুন্দর।

হেমাঙ্গবাবু বেশ জায়গাটি খুঁজে বের করেছেন। কিন্তু এখানে খুব শীত।

ঝুমকি তার টমেটো রঙের মাফলারটা গলায় ফের ভাল করে পেঁচিয়ে নিল। বলল, আমার খুব ব্রংকাইটিসের ধাত। জোলো বাতাসকে ভীষণ ভয় করে।

চয়ন ব্যস্ত হয়ে বলে, আপনি তাহলে ঘরে গিয়ে বসুন না!

ঝুমকি ঠোঁটটা তেমনি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে উল্টে বলল, ঘরে যা সব ন্যাকামি চলছে। অসহ্য, দুজনেরই যদি দুজনকে পছন্দ তো বিয়ে করে ফেললেই হয়।

চয়ন সতর্কভাবেই চুপ করে রইল।

উঁচু পাড় থেকে ঘাটে নামবার পথটা খুবই ভাঙাচোরা। অনবরত লোজন উঠে আসছে নৌকো বা ভটভটি থেকে। আবার যাচ্ছেও।

চুপচাপ কিছুক্ষণ লোক চলাচল দেখার পর ঝুমকি হঠাৎ স্বগতোক্তির মতো বলল, অথচ দুজনেই ম্যাচিওরড্‌ শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু বিহেভ করছে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মতো।

চয়ন এ কথাটারও জবাব দেওয়া সমীচীন মনে করল না।

চয়নবাবু, আপনার খিদে পেলে খেয়ে নিতে পারেন কিন্তু। দেখলাম, মুড়ি, শশা, নারকোল, চানাচুর সব এসেছে। বাইরের টেবিলে সব সাজানো।

চয়ন বলল, আপনি খাবেন না? খিদে পেয়েছে বললেন তো।

ঝুমকি একটু রাগের সঙ্গে বলল, কেউ না খেলে খাওয়া যায়? ওরা কথায় এত ব্যস্ত যে কেউ খাচ্ছে না। তাছাড়া মুড়ি চিবোতে আমার একদম ভাল লাগে না।

চয়ন একটু ব্যস্ত হয়ে বলে, তাহলে কি হবে?

কিছু হবে না। ভাবছি ব্রেকফাস্টটা আজ স্কিপ করব। আচ্ছা, আপনি সাঁতার জানেন?

আজ্ঞে না।

আমিও জানি না। নৌকো না ভটভটি কি যেন, ওটাতে উঠতে খুব ভয় করছিল। কিন্তু বেশ মজাও আছে, না?

আজ্ঞে তা আছে।

ঝুমকি একটু হেসে বলল, আচ্ছা আপনি আমাকে অত আপনি-আজ্ঞে করছেন কেন বলুন তো! আমি কি আপনার খুব সম্মানের পাত্রী?

চয়ন লজ্জা পেল। আপনি-আজ্ঞে সে করে অভ্যাসবশে। পৃথিবীর সব মানুষকেই সে অল্প-বিস্তর সমীহ করে। কেন যে করে তা সে ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারবে না। মাথা নিচু করে সে বলল, আমার ওটা একটা অভ্যাস।

ঝুমকি বলল, আচ্ছা নৌকো করে একটু বেড়িয়ে আসা যায় না? যাবেন?

চয়ন আবার তটস্থ হয়, বেড়াবেন?

চলুন না! ততক্ষণে ঘরের নাটক শেষ হোক।

একটু দোনোমোনো করল চয়ন। ঝুমকিকে সে সামান্যই চেনে। এই শ্রীময়ী মেয়েটি চারুশীলার খুবই প্রিয়পাত্রী। ওদের বাড়িতে প্রায়ই আসে। শান্ত স্বভাবের রিজার্ভ মেয়ে। এ যখন বেড়াতে চাইছে তখন তারও সঙ্গ দেওয়া উচিত বলেই তার মনে হল।

চয়ন বলল, একবার বলে এলে ভাল হয়। ওরা যদি খোঁজেন?

আমি বাঁকা মিঞাকে বলে এসেছি। ভয় নেই, খুঁজবে না। চারুমাসি এখন নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। চলুন তো, অত ভাবতে হবে না।

চয়ন ফের লজ্জা পেল। তার অভ্যন্তরে এক জন্ম-কৃতদাস বাস করে। যে যা বলে, সে তৎক্ষণাৎ তাতে সায় বা সম্মতি দেয়। যে যা হুকুম করে, সে প্রায়শই তা তামিল করতে রাজি থাকে। এই বশংবদ স্বভাবকে সে কিছুতেই ঢিট করতে পারেনি।

ঘাটে কয়েকটা ডিঙি নৌকো আছে। খেপ মারবে কি না কে জানে!

সামনে যেটা পেল তাতে একটা সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে বৈঠা নিয়ে বসে আছে। ঢেউয়ে টগবগ করছে তার ছোটো নৌকো। সে আধঘণ্টা ঘুরিয়ে আনতে পাঁচটা টাকা চাইল।

টাকাটা কি তারই দেওয়া উচিত? একটু ভাবল চয়ন। আগের বার চারুশীলা তাকে হেমাঙ্গর কাছে আসার বাবদে হাজার টাকা দিয়েছিল। চয়নের খরচ হয়েছিল কুড়ি টাকার মতো। বাকি টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সে, চারুশীলা নেয়নি। সুতরাং এ টাকাটা সে দিতে পারবে।

নৌকোয় ওঠার পর্বটা বেশ ঝামেলার হল। ঝুমকি যত বার উঠতে যায় ততবার দুষ্টু নৌকো একটু টাল খায় এবং সরে যায়। আতঙ্কে ঝুমকি চেঁচায় আবার হাসেও, অবশেষে মাঝি ছেলেটা নেমে নৌকো টেনে ধরে রইল, তারপর ঝুমকি উঠল। কিন্তু ওঠাটাও আর এক পর্ব। ছোটো নৌকো, একটুতেই টাল খায়।

মাঝি ছেলেটা অবশ্য বেশ চালাক-চতুর। ঝুমকি যতক্ষণ না বসল ততক্ষণ নৌকো ধরে রইল। চয়নের অবশ্য তেমন অসুবিধে হল না। সব অবস্থায় মানিয়ে নেওয়াই তার অভ্যাস।

ডিঙিতে পাটাতন বলে কিছু নেই। প্রায় সবটাই খোল। দুটো আড় কাঠ পাতা আছে। দুটোতে মুখোমুখি বসল তারা। ঝুমকির মুখে আতঙ্ক মেশানো হাসি।

কী রিস্কি জিনিস, তাই না?

চয়ন মৃদু স্বরে বলে, তা বটে। তবে সহজে ডোবে না। ভয় পাবেন না।

ঝুমকি হিহি করে হেসে বলে, একটু ভয় না করলে মজাই হয় না।

নৌকোটা বড় গাঙের দিকে গেল না। খালের ভিতরে ঢুকে এগোতে লাগল। চওড়া নয়, বেশী ঢেউও নেই। মাঝি ছেলেটা চালাক। আনাড়ি দেখে বড় গাঙের দিকে নেয়নি।

ঝুমকি কিছুক্ষণ এই জলযাত্রাকে উপভোগ করল বটে, কিন্তু কেমন যেন শান্ত হতে পারছে না মেয়েটা। হঠাৎ চয়নের দিকে চেয়ে বলল, মেয়েটা একটু কেমন যেন, না?

চয়ন অবাক হয়ে বলে, কোন মেয়েটা?

রশ্মির কথা বলছি।

ও। বলে চয়ন সতর্কতা অবলম্বন করল। বলল, আমি ওঁকে সামান্যই চিনি।

বড্ড গায়ে-পড়া।

তাই নাকি?

হেমাঙ্গবাবু যখন বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন না তখন হামলে পড়ার কী আছে বলুন! তাই না?

তা তো বটেই। সঙ্গে সঙ্গে চয়ন একমত হয়।

মেয়েদের আর একটু সেলফ্‌ রেসপেক্ট থাকা উচিত।

তা তো ঠিকই।

ঝুমকি আবার কিছুক্ষণ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখল। খালের ভিতরে অবশ্য দৃশ্য বিশেষ নেই। দুদিকে উঁচু পাড়। দীন-দরিদ্র চেহারার কুটির, কিছু বাড়িঘর আর অজস্র আগাছার জঙ্গল।

ঝুমকি হঠাৎ বলল, আপনার কি মনে হয় ওদের বিয়ে হবে?

চয়ন কঠিন সমস্যায় পড়ে গেল। বিয়ে হবে কি হবে না, তা সে জানে না। কিন্তু কোনটা বললে ঝুমকি খুশি হবে সেটা নির্ধারণ করাই কঠিন।

সে বলল, কিছু বলা যায় না।

আমার মনে হয়, হবে না।

সেটাও সম্ভব।

সম্ভব নয়। হবেই না। যদি হয় তাহলে ডিভোর্স হয়ে যাবে।

তাই নাকি?

ঝুমকি বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, লোকটা যে বিয়ের ভয়ে পালিয়ে আছে সেটা তো আর বুঝতে কারও বাকি নেই। না?

চয়ন একটু ভীত হয়ে বলে, আমি অত ভেবে দেখিনি।

ঝুমকি তার মস্ত খোঁপা ঠিক করল। তারপর হঠাৎ একটু হাসল। ভারী সুন্দর দাঁতের পাটি তার। বলল, রংটাই যা ফর্সা। মুখখানা এমন কিছু নয়।

চয়ন সভয়ে চুপ করে থাকে। তার কিছু বলার নেই।

ঝুমকি এর পর সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নৌকাযাত্রা বা প্রকৃতি কোনওটাই তাকে আর স্পর্শ করল না অনেকক্ষণ। কথা যত না বলে ততই বোধহয় চয়নের পক্ষে ভাল। কারণ সে এসব বিপজ্জনক কথাবার্তার শরিক হয়ে থাকতে চায় না।

ঝুমকি দেবী, ঘাট এসে গেছে।

ঝুমকি ঘোর অন্যমনস্কতা থেকে জেগে উঠে বলল, ও মা!

যখন তারা ফিরল তখন ঘরে পারিবারিক মিটিং শেষ হয়েছে। বারান্দায় চারুশীলা আর সুব্রত বসে চা খাচ্ছে। তাদের দেখে চারুশীলা বলল, একি, তোমরা আবার কোথায় গিয়েছিলে?

ঝুমকি বলল, একটু ঘুরে এলাম মাসি। তোমরা যা ব্যস্ত ছিলে!

চারুশীলা অসহায় মুখ করে বলল, যা একখানা পাগল ভাই আমার। ওকে নিয়ে আমিও পাগল হয়ে গেলাম। এই তো দুটিকে পাঠালাম একটু ঘুরে আসতে। কী কাণ্ড বলো তো! সব ঠিক আছে, তবু কোথায় যেন আটকাচ্ছে।

মৃদুভাষী সুব্রত কথার চেয়ে হাসে বেশী। মুখখানা সবসময়েই হাসিতে মাখানো। চায়ের কাপ থেকে মুখ তুলে বলল, ওদের আর একটু সময় দেওয়া উচিত ছিল। তুমি বড্ড তাড়া দিচ্ছো ওদের।

চারুশীলা কেন কে জানে, তার মৃদুভাষী স্বামীটিকে একটু সমীহ করে। অন্য কেউ কথাটা বললে চারুশীলা পাত্তাই দিত না। কিন্তু সুব্রত বলায় চারুশীলা তার দিকে চেয়ে বলল, কী করব বলো তো! আমাদের হাতে কি সময় আছে?

সুত্ৰত একটু মাথা নেড়ে বলল, ওরা খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু বন্ধুত্বকে ম্যাট্রিমনিতে কনভার্ট করাটাই প্রবলেম হচ্ছে বলে আমার ধারণা। মানসিক চেঞ্জটার জন্য সময় দরকার ছিল।

না সুব্রত। ও প্রবলেমটা শুধু হেমাঙ্গর। রশ্মির কিন্তু ওটা নেই। ও বিয়ের কথা ভেবেছে, মনকেও তৈরি করেছে। হেমাঙ্গর আরও একটা প্রবলেম হল, ও ইংল্যান্ডে থাকতে চাইছে না।

ওয়াইজ অফ হিম।

তার মানে?

ইংল্যান্ডে থাকতে যাবে কেন?

করুণ গলায় চারুশীলা বলে, তাহলে বিয়ে হবে কি করে?

কেন, তোমরা রশ্মিকেই এদেশে থাকতে রাজি করাও।

তাই কি হয়? ওর কত প্রসপেক্ট ওখানে।

সুব্রত মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। তারপর বলল, তাহলে চালমাত।

তার মানে?

কোনও হেডওয়ে হওয়া মুশকিল।

চারুশীলা বলল, আহা, দেখলে তো, দুজনেই দুজনের প্রতি বেশ ইন্টারেস্টেড। ওদের মধ্যে ভাব ভালবাসা খুব আছে।

তাহলে ঘটকালির দরকার হচ্ছে কেন?

কি করব বলো, হেমাঙ্গটা যে পাগল।

সুব্রত মৃদু মাথা নেড়ে বলে, একটুও পাগল নয়। মেন্টালি হয়তো স্ট্রং নয়। বাট হি ইজ এ পারফেক্ট জেন্টেলম্যান।

চারুশীলা হতাশা মাখা মুখে ঝুমকির দিকে চেয়ে বলল, কি যে হবে!

কেন ভাবছে মাসি? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।

ওমা! খাবারের অভাব নাকি? কত মুড়ি রয়েছে, শশা, নারকোল। এসো, বসে যাও। চয়ন, আপনিও আসুন তো! আমার মনের যা অবস্থা, কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

ঝুমকি এক মুঠো মুড়ি-মাখা আর শশার টুকরো নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল, একটা লোক ব্যাচেলর থাকলে কী এমন ক্ষতি হত বলো তো!

ব্যাচেলর থাকবে? তাই কি হয়!

কেন হয় না?

দূর পাগল! এখন আমার তর্ক করতে ইচ্ছেই করছে না। তবে ব্যাচেলর থাকা ভাল নয়।

এ সবই অনুধাবন করে চয়ন, কিন্তু অংশ নেয় না। কত মানুষের কত বড় বড় সমস্যা থাকে, কত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। তার তো তা নয়। তার সমস্যা সবই সাদামাটা। টিকে থাকা, শুধুমাত্র বেঁচে থাকা ছাড়া আর তো কোনও সমস্যার কথা মনে হয় না তার।

অনেকক্ষণ বাদে যখন রশ্মি আর হেমাঙ্গ ফিরল তখন দুজনকে অনুধাবন করল চয়ন। এদের সমস্যাটা কী? একজন সুদর্শন পুরুষ, আর একজন সুন্দরী রমণী। দুজনের কারোই ভাত-কাপড়ের অভাব নেই। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশীই হয়তো আছে। এদের সমস্যা কি এদের এই প্রাচুর্যই?

দুজনের মুখই বেশ হাসিখুশি। দেখে মনে হয় যেন, দুজনের সমস্যা কিছুই আর নেই। সব মিটে গেছে। কিন্তু চয়ন তার মধ্যেও একটু ছায়া দেখতে পায়। মুখে হাসি, কিন্তু হেমাঙ্গর চোখে যেন ক্লান্তি!

দুপুরে বাঁকা মিঞা গন্ধমাদন এনে ফেলল। ভাত, ডাল, তরকারির সঙ্গে দুরকম মাছ আর মুরগি। এলাহি ব্যবস্থা। “গরম গরম খেয়ে নিন, গরম গরম খেয়ে নিন” বলে তাড়া দিতে লাগল সবাইকে। সেই তাড়া খেয়ে ঝুপঝাপ বসেও পড়ল সবাই। টেবিল সরিয়ে বারান্দায় টানা শতরঞ্চি পাতা হল। শাল পাতার ওপর কলাপাতা বিছিয়ে দিব্যি ব্যবস্থা।

চয়ন এমন সুখাদ্য জীবনে খুব কমই খেয়েছে।

খাওয়ার পরই ফেরার পালা। তাড়াতাড়ি না ফিরলে অন্ধকার হয়ে যাবে। প্রচণ্ড শীত পড়বে। কলকাতায় চারুশীলার বাচ্চারা অস্থির হবে, ঝুমকির বাবা-মা চিন্তা করবে।

হেমাঙ্গও ফিরল তাদের সঙ্গে। একটু চুপচাপ, একটু লজ্জিত।

এদিকের ঘাটে দুটো গাড়ি ছিল। দ্বিতীয় গাড়িটায় উঠল হেমাঙ্গ আর রশ্মি। ওদের বাড়ি কাছাকাছি। কি কারণে কে জানে হেমাঙ্গ হঠাৎ বলল, চয়ন, আপনি এ গাড়িতেই উঠুন। ও গাড়িটা একটু ক্রাউডেড।

সংকোচে চয়ন এতটুকু হয়ে গেল। সে উঠলে ওদের প্রাইভেসি থাকবে না।

চারুশীলাও বলল, না না, এ গাড়িতে অনেক জায়গা। আমরা তো মোটে তিনজন। আমি ঝুমকি আর সুব্রত। তোরা যা না।

না, আমি চয়নকে ওর বাড়িতেই ছেড়ে দিয়ে আসব। উঠুন তো।

চয়ন বলল, আমি বরং বাসে বা ট্রেনে—

দুর পাগল! উঠুন।

চয়ন উঠে ড্রাইভারের পাশে সসঙ্কোচে বসল। তার মতামতের কোনও দাম নেই। সে আর কীই বা করবে?

গাড়ি হু হু করে যখন কলকাতার দিকে এগোচ্ছিল তখনও ফটফটে দিনের আলো। চয়ন নিবিষ্ট মনে সামনের দিকে চেয়ে প্রকৃতি এবং দৃশ্যে শতকরা একশ’ভাগ মনোযোগী থাকতে চেষ্টা করছিল। তবু দু’একটা কথা উড়ে আসছিল কানে। পিছন থেকে।

কথাটা জানতে পারলে চারুদি শকড্‌ হবেন।

হেমাঙ্গ হাসল, তা হবে।

তুমিও একটু অদ্ভুত। কেন যে সহজ হতে পারো না।

হেমাঙ্গ ফের হাসল।

অনেকক্ষণ চুপচাপ রইল ওরা।

তারপর রশ্মি হঠাৎ বলল, সামারে এসো কিন্তু। আমি গ্রীনফোর্ডের বাড়িটা কিনে ফেলছি। আমার ওখানেই উঠবে। মা তো থাকবেই এখন কিছুদিন।

ঠিক আছে।

এলে পরে একটা প্যারিস ট্রিপ করা যাবে।

হু হু করে বাতাস আসছে বলে জানালার কাচ তুলে দিতে হয়েছে। তাই কথাগুলো স্পষ্ট কানে আসছে চয়নের। সে এমন কিছু জেনে যাচ্ছে যা আর কেউ জানে না।

সারা রাস্তা ওরা আরও নানা বিষয়ে কথা বলল। তার মধ্যে পেইন্টিং, মিউজিক, সিনেমা এবং সাহিত্যও ছিল। কিন্তু আর বিশেষ কিছু নয়।

কলকাতায় পৌছোনোর আগেই অন্ধকার হয়ে গেল। কুয়াশা জমল। মনটা কেমন নির্বিকার হয়ে গেল তার।

রশ্মিকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের বাড়িতে এসে গাড়িটাকে ছেড়ে দিল হেমাঙ্গ। বলল, চলুন আপনাকে আমার গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসি।

চয়ন আতঙ্কিত হয়ে বলল, এখন মোটে সন্ধে। কলকাতায় গাড়িঘোড়া চলছে। আমি ঠিক চলে যাবো।

আমার যে কথার খেলাপ হবে।

একটুও না। তাছাড়া আমি এখনই বাড়ি ফিরব না। ভাবছি, এক ছাত্রকে একটু পড়িয়ে যাবো।

তা হলে আসুন, এক কাপ চা খেয়ে যান।

চয়ন রাজি হল।

গরম চা নিয়ে দোতলার ঘরে মুখখামুখি বসে হেমাঙ্গ বলল, আপনার নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে কৌতূহল হচ্ছে?

চয়ন সংকুচিত হয়ে চুপ করে রইল।

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলল, যেটা হওয়ার নয় সেটা আঁকড়ে থেকে লাভ নেই। আমি যে বনবাসে গিয়েছিলাম তার কারণ ছিল ওই একটাই। ভাল করে ভাবলাম। ভেবে দেখলাম, আমি কারও প্রেমে পড়িনি। কাজেই আজ রশ্মির সঙ্গে একটা মীমাংসা হয়ে গেল। আমরা বিয়েটা করছি না।

ও।

তবে আমরা বন্ধু থাকব, যেমন ছিলাম। আমি রশ্মিকে নানা কারণে পছন্দ করি। শী ইজ এ নাইস পারসন।

চয়ন মাথা নেড়ে জানাল, সে বুঝেছে।

হেমাঙ্গ হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আজ খুব রিলিভড্‌ বোধ করছি। কিন্তু একটা কথা।

বলুন।

এখনই চারুদিকে ব্যাপারটা জানাবেন না। প্লীজ।

আচ্ছা।

ও কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞেস করবে।

কী বলব তাহলে?

বলবেন আমরা গাড়িতে খুব গল্প করছিলাম। বেশ ঘনিষ্ঠভাবে। ওকে এখনই হার্ট করতে চাইছি না। রশ্মি চলে যাক, তারপর জানতে পারবে।

ও। বলে চুপ করে থাকল চয়ন। এ তার গল্প নয়। এ তার জীবনের ঘটনা নয়। এ বড় দূরের কাহিনী। হৃদয় বিনিময়ের দুরূহ কথা। এ সবের সঙ্গে তার সম্পর্কই নেই। তবু সে চুপ করে গম্ভীর মুখে বসে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *