2 of 2

৬১. শ্রাবণ মাসের এক দুপুরে

শ্রাবণ মাসের এক দুপুরে (১৬ আগষ্ট) নাইমুল ঢাকা শহরে ঢুকে পড়ল। তার তেমন কোনো অসুবিধা হলো না। সে ঢুকেছে নরসিংদী এলাকার গ্রামের ভেতর দিয়ে। বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে ঢুকলে চেকপোষ্টের সমস্যায় পড়তে হতো। ডান্ডি কার্ড (আইডেনটিটি কার্ড) দেখানো, নানান প্রশ্নের জবাব দেয়া হাজারো ফ্যাকড়া। সন্দেহ হলেই আটক। তার মতো রোদে পোড়া শহুরে ধরনের চেহারা হলে কথাবার্তা ছাড়াই আটক। ইসকুরুপের চাবি আঁটা।

গ্রামের ভেতর দিয়ে যাতায়াতও যে খুব নিরাপদ তা না। রাজাকারবাহিনী ভালোমতো গজিয়ে গেছে। লুটপাট করার সুযোগ থাকায় তারা বেশ উৎসাহী। শান্তি কমিটিও উৎসাহী। অচেনা কেউ গ্রামে ঢুকলেই–আপনের নাম? আপনের পরিচয়?

নাম-পরিচয় সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র নাইমুলের সঙ্গে আছে। শান্তি কমিটির এক চেয়ারম্যান সাহেব হাজী আসমতউল্লাহর চিঠি আছে। টাইপ করা এবং পিস কমিটির সীল দেয়া চিঠিতে লেখা–

বিসমিল্লা হে রাহমানের রহিম

পত্ৰবাহক সিরাজগঞ্জ নিবাসী ফরহাদ খান পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সেবক। তাহাকে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করা যাইতেছে।

নাইমুলকে সেই চিঠি একবার শুধু দেখাতে হয়েছে। ঢাকায় ঢোকার মুখে এক রাজাকার কমান্ডার গম্ভীর ভঙ্গিতে চিঠি উল্টেপাল্টে দেখেছে। তার চিঠির দিকে তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে কমান্ডার সাহেব চিঠি পড়তে পারছেন না।

আপনার পরিচয় বলেন। নাইমুল বলেছে, পরিচয় এখানে লেখা আছে। কমাণ্ডার সাহেব ধমক দিলেন–লেখা তো জানি, মুখে বলেন। মুখে তো তালা নাই। তালা থাকলে বলেন, চাবি দিয়া খুলব। আমার কাছে মুখের চাবি আছে।

আমার নাম ফরহাদ খান।

কই মেলা দিছেন?

ঢাকা।

কী জন্যে?

আমার স্ত্রী ঢাকায়, তাকে দেখতে যাচ্ছি।

স্ত্রীর নাম বলেন।

নাইমুল সত্যি কথাই বলল, মরিয়ম।

হাত তুইল্যা খাড়ান। চেকিং হবে।

নাইমুল হাত তুলে দাঁড়াল। অন্য একজন এসে গায়ে থাবা দিয়ে চেকিং পর্ব শেষ করল। নাইমুলের মনে হলো কাজটা করতে গিয়ে দুজনই মজা পাচ্ছে। এই মজার উৎস নাইমুল জানে। বন্দুকের সামনে মানুষ ভয়ে ছোট হয়ে থাকে। এই ভয়টা দেখতে ভালো লাগে।

নাইমুল বলল, ঢাকা শহরের অবস্থা কিছু জানেন?

কমান্ডার বলল, অবস্থা ভালো।

শহরে কি মুক্তি আছে?

টুকটাক দুই-একটা থাকতে পারে। আমাদের অঞ্চলে নাই।

তারপরেও সাবধানে থাকবেন। এখন নাই, হঠাৎ চলে আসবে।

কমান্ডার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, এত প্যাচালের দরকার নাই। যেখানে যাইতেছেন যান। আমাদের পান খাওয়ার খরচ দিয়া যান।

নাইমুল দশ টাকার একটা নোট দিল। কমান্ডার সাহেব সেই নোট অনগ্রহের সঙ্গে হাতে নিলেন।

 

শ্রাবণ মাসে আকাশ মেঘলা থাকবে। রোদ থাকবে না। আর থাকলেও রোদের তেজ থাকবে না। এটাই নিয়ম। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম। ঝকঝকি করছে রোদ। শহর তোতে আছে। শহর থেকে ভাপ বের হচ্ছে।

দীর্ঘদিন গ্রামগঞ্জের কাঁচা সড়ক, চাষা মাঠের উপর হাঁটাহাঁটি করার পর শহরের পাকা রাস্তায় হাঁটতে নাইমুলের চমৎকার লাগছে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার। দেয়ালে লেখা নেই। পথে ভিড় নেই। প্রতিটি বাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। রিকশার সঙ্গেও কাগজের পতাকা।

নাইমুল যাচ্ছে শান্তিবাগের দিকে। সেখানে তার পরিচিত একটা হোটেল আছে। হোটেল জিন্দাবাহার। বেশ কিছুদিন এই হোটেলের একটা ঘর (রুম নং ১৮) ভাড়া করে সে ছিল। হোটেলের লোকজন তার চেনা। সেই হোটেলে ওঠাই তার জন্যে সম্ভবত নিরাপদ। সে প্রথমে হোটেলের একটা ঘর (চেষ্টা করবে রুম নং ১৮) নেবে। বয়কে একটা টাকা দিয়ে বলবে দুই বালতি গরম পানি দিতে। দুই বালতি গরম পানি গায়ে ঢেলে আরামের একটা গোসল তাকে দিতে হবে। সে আস্ত একটা সাবান গায়ে ডলবে। অনেকদিন আরাম করে গোসল করা হয়। না। আরামের গোসলের জন্যে শরীর খাপ ধরে অপেক্ষা করছে।

গোসলের পর খাওয়া-দাওয়া। এই হোটেলের ইলিশ মাছের ডিমের তরকারি এবং কাতল মাছের মাথার মুড়িঘণ্ট তুলনাবিহীন। সে রুমে অর্ডার দিয়ে আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করবে। খাওয়ার পর একটা মিষ্টি পান। একটা সিগারেট। কিছুক্ষণ আরামের ভাতসুম।

মরিয়মের খোঁজে। সে যাবে ঘুম ভাঙার পর। তাদের কোনো খোঁজ যে পাওয়া যাবে না। এই বিষয়ে সে প্রায় নিশ্চিত। তাদের ঢাকায় থাকার কথা না। নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যাবার কথা। ঢাকা কি এখন নিরাপদ? পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নগরী কি নিরাপত্তার কথা বলে?

ঢাকা এখন কুকুর এবং কাকমুক্ত নগর। কুকুরমুক্ত হবার পেছনে যুক্তি আছে। মিলিটারিরা না-কি কুকুর সহ্য করছে না। দেখলেই গুলি করে মারছে। কিন্তু কাক গেল কোথায়? তারা নিশ্চয়ই কাকও গুলি করে মারে নি।

নাইমুল হাঁটছে আর মনে মনে কাক খুঁজছে।

কাক বলে কা কা
ঢাকা শহর খা খা।

বাহ সুন্দর মিলেছে তো! কুকুরের দেখা নাইমুল কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়ে গেল। মোটামুটি স্বাস্থ্যবান একটা ঘিয়া রঙের কুকুর ফুটপাতে শুয়ে আছে। তার শুয়ে থাকার ভঙ্গি বিষণ্ণ। নাইমুল বলল, এই তোর খবর কিরে?

কুকুর সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলো। ঢাকা শহরে এই প্রথম নাইমুলের কারো সঙ্গে কথা বলা। ডায়েরি লেখার অভ্যাস থাকলে এই ঘটনাটা সুন্দর করে লেখা যেত–

আমি ঢাকায় প্রবেশ করি ১৬ আগস্ট দুপুরে। প্রথম কথা যা বলি তা হলো–এই তোর খবর কিরে? প্রশ্নটি করা হয় একটা কুকুরকে। কুকুরের গায়ের রঙ ঘিয়া। সে পা খুঁড়িয়ে হাঁটে। এই কুকুরটা আমার সঙ্গে অনেকদূর হেঁটে হেঁটে আসে। আমি যখন শান্তিনগরের মোড় পার হই। তখনই শুধু সে থেমে যায়। তবে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। তার তাকানোর ভঙ্গি এরকম যে আমি একটু ইশারা দিলেই সে আবারো আমার পেছনে পেছনে আসবে। আমি তাকে ইশারা দিতাম। কিন্তু দেই নি, তার কারণ আমার চোখে পড়ল একটা নাপিতের দোকান। সঙ্গে সঙ্গে চুল কাটার কথা মনে পড়ল। আমি ঢুকে গেলাম নাপিতের দোকানে।

চুল কাটার সময় কথা বলা সব নাপিতের অভ্যাস। যে নাইমুলের চুল কাটছে তার মুখে কোনো কথা নেই। কচকচ করে চুল কেটে যাচ্ছে। নাইমুলের খুবই আরাম লাগছে। চুলকাটার ব্যাপারটা যে আরামদায়ক নাইমুল তা আগে কখনো টের পায় নি। তার ঘুম ঘুমও পাচ্ছে। চুল কাটাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া কোনো কাজের কথা না। নাইমুলকে বেশ কষ্ট করে জেগে থাকতে হচ্ছে। নাইমুল হাই তুলতে তুলতে বলল, আপনার নাম কী?

নাপিত চাপা গলায় বলল, তৈয়ব।

দোকান আপনার?

মহাজনের দোকান।

কারিগর কি আপনি এক?

হুঁ।

কাস্টমার কেমন হয়?

হয় কিছু।

মিলিটারিরা চুল কাটতে আসে?

তৈয়ব এই প্রশ্নের জবাব দিল না। মিলিটারি প্রসঙ্গে কোনো কথা বলা বোধহয় নিষেধ।

শহরে কি মুক্তি আছে?

নাপিত কিছুক্ষণের জন্যে কাচির ক্যাচ ক্যাচ বন্ধ করে আবার শুরু করল। এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। নাইমুল বলল, আপনারা শহরে আছেন, মুক্তির নাড়াচাড়া বুঝেন না? বোঝার তো কথা।

আছে, নাড়াচাড়া আছে। আপনে কি মুক্তি?

নাইমুল সহজ ভঙ্গিতে বলল, হুঁ।

আপনেরে দেইখ্যাই বুঝেছি।

কীভাবে বুঝলেন?

এইসব বোঝা যায়। মাথা মালিশ কইরা দিব?

দেন। আগে শেভ করেন।

মাথা মালিশ এতই আরামদায়ক হলো যে, নাইমুল সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল। ছোটখাটো ঘুম না, লম্বা ঘুম। তৈয়ব তার ঘুম ভাঙালি না। খবরেব কাগজ ভাঁজ করে পাশে বসে রইল। মাছি খুব উপদ্রব্য করছে। ঘুমন্ত লোকটার মুখে বারবার এসে বসছে। তৈয়ব খবরের কাগজ দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে।

নাইমুলের ঘুম ভাঙল বিকেলে। তখন শহরে রোদ নেই। আকাশ মেঘলা। শ্রাবণ মাসের আকাশে মেঘ মানেই বৃষ্টি। বৃষ্টি নামলে খুবই সমস্যা হবে। নাইমুল এক কাপড়ে ঢাকা এসেছে।

তৈয়ব তাকিয়ে আছে। তার মুখ ভাবলেশহীন।

নাইমুল বিরক্ত গলায় বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ডাকলেন না কেন?

তৈয়ব জবাব দিল না।

কত হয়েছে আমার? চুল কাটা, শেভ, মাথা মালিশ। কত হয়েছে বলেন।

তৈয়ব বলল, আপনের কিছু দিতে হবে না।

নাইমুল বলল, দিতে হবে না কেন?

তৈয়ব এই প্রশ্নেরও উত্তর দিল না।

নাইমুল বলল, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভাই, তাড়াতাড়ি বলেন–কত?

তৈয়ব আগের মতোই আবেগশূন্য গলায় বলল, আপনে মুক্তি। আমি মুক্তির কাছে টেকা নেই না। আমারে টেকা দেওনের চেষ্টা কইরা ফয়দা নাই। দিতে পারবেন না।

বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। নাইমুল রাস্তায় নেমে পড়ল। সে হোটেলে জায়গা পেল না। হোটেলের মালিক বদল হয়েছে। মালিকের সঙ্গে নোমও পাল্টেছে। এখন নতুন নাম পাকিস্তান হোটেল। নতুন মালিক নাইমুলকে কঠিন গলায় বলল, হোটেলে লোক নেওয়া নিষেধ আছে। রেস্টুরেন্ট আছে, খানা খাইতে পারেন। থাকার জায়গা নাই।

মিলিটারির নিষেধ?

হুঁ। মাঝে মধ্যে চেকিং হয়। বিরাট দিগদারি।

আশেপাশে কোনো হোটেল আছে?

খুঁজেন। খুঁইজ্যা দেখেন।

নাইমুল আরো দুটা হোটেলে চেষ্টা করল। একটাতে বলল, ফ্যামিলির সাথে বাচ্চাকাচ্চা থাকলে ঘর দিতে পারে। একা মানুষকে ঘর দেবে না।

নাইমুল বলল, একটা রাতের জন্যে আমার কোথাও থাকা দরকার। একটু ব্যবস্থা করে দেন।

হোটেল মালিক ক্লান্ত গলায় বলল, আত্মীয়স্বজনের বাসায় যান। এইটা ছাড়া পথ নাই। হোটেলে আপনেরে কেউ রাখব না। ঢাকা শহরে আপনের স্বজন আছে না?

নাইমুল দেরি না করে স্বজনের খোঁজে বের হলো। অপ্রত্যাশিত একটা ব্যাপার তো ঘটেও যেতে পারে। দেখা যাবে মরিয়মরা ঢাকাতেই আছে, ঐ বাড়িতেই আছে। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর মরিয়মের মার ভীত গলা শোনা যাবে–কে? কে?

এই মহিলা মেয়েদের কখনো দরজা খুলতে দেন না। নিজে আসেন দরজা খুলতে। পরিচয় দেয়ার পরেও আরো কয়েকবার বলেন, কে কে?

নাইমুল কড়া নাড়ার পর তিনিই দরজার ওপাশ থেকে ভয়ে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া গলায় বলবেন, কে?

নাইমুল গলা নামিয়ে বলবে, মা আমি। আমি নাইমুল। দরজাটা খুলুন। তবে কাউকে বলবেন না যে আমি এসেছি। আমি একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই।

তিনি দরজা খুলবেন, তবে নিজেকে নিশ্চয়ই সামলাতে পারবেন না। চিৎকার করে বলবেন, মরিয়ম, দেখে যা কে এসেছে! মরিয়ম কী করবে–দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা মচকে ফেলবে। এই মেয়ের সিঁড়িতে পা পিছলানো রোগ আছে। সে সিড়ি দিয়ে নামবে অথচ পা পিছলাবে না–এটা হতেই পারে না।

তাকে দেখে মরিয়ম কী করবে? ঝাপ দিয়ে তার গায়ের উপর পড়বে এবং তাকে সুদ্ধ মেঝেতে ফেলে দেবে। এরকম ঘটার সম্ভাবনা আছে। মরিয়ম এমনই মেয়ে যে উত্তেজনার মুহুর্তে চিন্তাই করবে না। আশেপাশে কে আছে। মা দাঁড়িয়ে আছে। বোন দাঁড়িয়ে আছে। থাকুক দাঁড়িয়ে। আমি আমার মানুষটার গায়ে ঝাপ দেবী। যার যা ইচ্ছা মনে করুক, আমার কিছু যায় আসে না। মানুষটা যখন দোতলায় উঠবে, আমি শক্ত করে তার হাত ধরে রাখব। মানুষটা যদি লজ্জা পেয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতে চায় তাতেও লাভ হবে না। আমি আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরব।

 

মরিয়মদের বাড়ির সদর দরজা তালাবন্ধ। একটা না, দুটা বড় বড় তালা। নাইমুল কিছুক্ষণ তালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। কেন দাঁড়িয়ে থাকল। সে নিজেও জানে না।

রাত নটা থেকে কারফিউ। আগে ছিল রাত এগারোটা থেকে। গত এক সপ্তাহ হলো এই সময় এগিয়ে এনে নটা করা হয়েছে। এর মধ্যেই থাকার জন্যে নাইমুলকে একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ঢাকা শহরে তার পরিচিত মানুষ নেই বললেই চলে। সে রওনা হলো আগামসি লেনের দিকে। অনেকদিন সেই অঞ্চলে থেকেছে। যে বাড়িতে ছিল তার বাড়িওয়ালা নিশ্চয়ই তাকে ফেলে দেবে না।

আগামসি লেনে ঢোকা গেল না। কোনো সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়ই। এলাকা কর্ডন করে মিলিটারি বাড়িতে বাড়িতে ঢুকছে।

কমলাপুর রেল স্টেশনে চলে যাওয়া যায়। একরাত স্টেশনের বেঞ্চিতে গড়াগড়ি করে কাটিয়ে দেয়া। কমলাপুর স্টেশনে থাকাও বিপদজনক। সেখানে কঠিন মিলিটারি পাহারা। সঙ্গে ব্যাগ সুটকেস নেই, একটা লোক ঘোরাঘুরি করছে–অতি সন্দেহজনক ব্যাপার।

রাত আটটা বেজে গেছে। আর এক ঘণ্টা পরেই কারফিউ শুরু হবে। শেষ চেষ্টা হিসেবে নাইমুল রওনা হয়েছে শাহেদের বাসার খোঁজে। কয়েকবারই সে এই বাসায় গিয়েছে, তারপরেও রাতে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। পঁচিশে মার্চের পর শহর মনে হয় নিজে নিজেই নিজেকে বদলে ফেলেছে। কিছুই চেনা যায় না। নাইমুল ঠিক করল শাহেদকে পাওয়া না গেলে দরজার ফাঁক দিয়ে আসমানীর চিঠিটা ঢুকিয়ে দেবে। এতে একটা বড় দায়িত্ব শেষ হবে। তারপর যে-কোনো একটা বাড়ির কড়া নেড়ে বলবে, আমার রাতে থাকার জায়গা নেই। আজকের রাতটা আপনাদের বাসায় থাকতে দিন। কারফিউ ভাঙলেই আমি চলে যাব।

নাইমুলের এখন মনে হচ্ছে, তার ঢাকা আসাটা ভুল হয়েছে। ঝোঁকের মাথায় সে চলে এসেছে। মাথায় একটা জিনিস কাজ করেছে–ছুটি কাটাতে যাচ্ছি। ছুটি। ভালো খাবার খাব। ভালো বিছানায় ঘুমাব। গরম পানি দিয়ে সাবান ডলে গোসল দিব। ভাগ্য ভালো হলে মরিয়মের সঙ্গে দেখা হবে।

এখন দেখা যাচ্ছে সবই এলোমেলো হয়ে গেছে। শুধু চুলটা কাটা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গোসল হয় নি। খাওয়া হয় নি। আরামের কোনো বিছানায় শোয়ার প্রশ্নই আসছে না। রাতে কেউ যদি থাকতে দেয়, তাকে ঘুমাতে হবে বসার ঘরের সোফায়। তার জন্যে নিশ্চয়ই বিছানা ছেড়ে দেবে না।

কারফিউ শুরু হবার পাঁচ-সাত মিনিট আগে শাহেদের বাসা পাওয়া গেল। ভেতরে বাতি জ্বলছে। দরজা-জানালা বন্ধ। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। শাহেদ না থাকলেও কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আছে। ঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। নাইমুল এক দৌড়ে বারান্দায় উঠে পড়ল। উঁচু গলায় ডাকল, শাহেদ, বাসায় আছিস?

দ্বিতীয়বার ডাকার আগেই দরজা খুলে গেল। শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে গভীর বিস্ময়। নাইমুল প্রথম যে বাক্যটা বলল তা হচ্ছে–ঘরে গায়ে মাখা সাবান আছে তো? সাবান দিয়ে হেভি গোসল দিতে হবে। তুই এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমাকে চিনতে পারছিস তো?

শাহেদ বন্ধুর প্রশ্নের জবাব দেয় নি। যেভাবে তাকিয়েছিল সেভাবেই তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিতে বিস্ময় আনন্দ কিছুই নেই।

নাইমুল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, দাড়ি গোফ টোফ গজিয়ে তুই তো হানড্রেড পারসেন্ট মাওলানা হয়ে গেছিস। তোকে দেখে মনে হচ্ছে দেওবন্ধ থেকে পাস করা মাওলানা। মাথায় টুপিও আছে। সবসময় টুপি পরে থাকিস?

শোবার ঘর থেকে আগরবাতির গন্ধ আসছে। মেঝেতে জায়নামাজ পাতা। জায়নামাজের পাশে আগরবাতি জুলছে। নাইমুল বলল, ঘটনা কী? আগরবাতি কেন?

শাহেদ বলল, একটা খতম পড়ছি! খতমে জালালী। এক লক্ষ পঁচিশ হাজারবার দোয়া ইউনুস।

খতম শেষ হয়েছে?

হুঁ। মাগরেবের ওয়াক্তে শেষ হয়েছে। আসমানীদের কোনো খবর পাচ্ছি না, এই জন্যেই খতম।

নাইমুল বলল, খতম যখন শেষ করেছিস তখন খবর হয়তো পাবি। কিছুই বলা যায় না। It is a strange world. গরম পানির ব্যবস্থা কর, গোসল করব। তুই খাওয়াদাওয়া কোথায় করিস?

নিজেই রাঁধি।

খাবারের ব্যবস্থা কর। প্রচণ্ড ক্ষিধা লেগেছে। কী খাওয়াবি? খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে। খিচুড়ি খাওয়াতে পারবি?

হুঁ।

ঘরে ডিম আছে?

আছে।

খিচুড়ি আর ডিম কর। আমার খাওয়া কিন্তু বেড়েছে। আগে যা খেতাম তার তিনগুণ খাই। বেশি করে রাধবি। লেবু, কাঁচামরিচ এইসব আছে?

না।

আচার নিশ্চয়ই আছে। ভাবি তো আচার পছন্দ করত।

আচার আছে।

গুড। আমার মাথায় খাওয়া ছাড়া কোনো চিন্তা নেই। অতীতে যেসব সুখাদ্য খেয়েছি তার সবগুলির কথা মনে পড়ছে।

শাহেদ রান্না বসিয়েছে। কেরোসিনের চুলায় রান্না হচ্ছে। নাইমুল ঢুকেছে বাথরুমে। বাথরুমের দরজা পুরোপুরি খোলা। শাহেদ যেখান থেকে রান্না করছে। সেখান থেকে বাথরুমের ভেতরটা পুরোপুরি দেখা যায়। শাহেদ সেদিকে তাকাচ্ছে না। কারণ নাইমুল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গোসল করছে। নাইমুল খুব আনন্দে আছে, এটা শাহেদ বুঝতে পারছে। এই প্রবল দুঃসময়ে একটা মানুষ এত আনন্দে কীভাবে থাকে সে বুঝতে পারছে না।

শাহেদ বলল, তুই মুক্তিযুদ্ধে গেছিস–তাই না?

হুঁ।

যুদ্ধ কেমন হচ্ছে?

ভালো।

ঢাকা শহরেও অনেক মুক্তিবাহিনী ঢুকেছে।

নাইমুল বলল, তুই যুদ্ধে গেলি না কেন? দাড়ি গজিয়ে দেওবন্ধের মাওলানা হয়ে বসে আছিস।

শাহেদ বলল, আসমানীদের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না বলে যেতে পারছিলাম না।

খোঁজ পেলে যুদ্ধে যাবি?

হুঁ।

খিচুড়ি থেকে তো ভালো গন্ধ বের হয়েছে। কী দিয়েছিস?

গরমমসল্লা।

ডিম কয়টা রান্না করছিস?

তিনটা। আমি একটা খাব, তোর দুটা।

চারটা ডিম দে। আমি তিনটা খাব।

আচ্ছা। তুই ঢাকায় যুদ্ধ করার জন্যে ঢুকেছিস?

না। বিশ্রাম নিতে এসেছিলাম। মরির সঙ্গে দেখা করার শখ ছিল। দেখা शला न्ग।

মরিটা কে?

আমার বউ, আদর করে মারি ডাকি। মরিয়মকে শর্ট করে মরি।

শাহেদ বিরক্ত গলায় বলল, তোর সবকিছুই উদ্ভট। আদর করে কেউ কাউকে মরি ডাকে!

একেকজনের আদরের ভঙ্গি একেকরকম। তুই ভাবিকে আদর করে কী ডাকিস?

জেপ ডাকি।

জেপ ডাকিস মানে? জোপের মানে কী?

কোনো মানে নাই।

মানে অবশ্যই আছে, তুই বলতে চাস না। না বললে নাই। ভাবির কাছ থেকে জেনে নেব। দেখা হলে আমি তাকে ডাকব জেপ ভাবি।

শাহেদের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। নাইমুলের মুখ থেকে জেপ ভাবি শোনার পরপরেই শাহেদের চোখের সামনে সুন্দর একটা ছবি ভেসে উঠেছে। সে, নাইমুল, আসমানী আর রুনি তারা চারজন যেন কোথায় বেড়াতে গেছে। অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তাদের সবারই একটু শীত শীত করছে। এর মধ্যে নাইমুল আসমানীকে খুব বিরক্ত করছে। একটু পর পর বলছে–জেপ ভাবি, জেপ ভাবি।

নাইমুল বাথরুম থেকে বলল, তোর রান্না কি হয়েছে?

একটু বাকি আছে।

শেষ হলে আমাকে বলবি, তখন বাথরুম থেকে বের হবে। স্ট্রেইট খেতে বসব। রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত গায়ে পানি ঢালতেই থাকব।

ঠাণ্ডা লাগাবি তো।

আমরা যারা মুক্তিতে আছি তারা ওয়াটারপ্রািফ ঘড়ির মতো ঠাণ্ডাপ্রািফ হয়ে গেছি। রোদবৃষ্টিতে এখন কিছুই হয় না। ভাবির হাতে হাঁসের মাংস খেতে ইচ্ছা! করছে। একবার ভাবি রান্না করেছিল, আমি একাই একটা আস্ত হাঁস খেয়ে ফেলেছিলাম। ভাবি আমার নাম দিয়েছিল হাস রাক্ষস! তোর মনে আছে?

মনে আছে।

 

খেতে বসে নাইমুল খিচুড়ি ছানাছানি করতে লাগল। শাহেদের দিকে তাকিয়ে করুণ গলা করে বলল, ক্ষিধা কেন জানি চলে গেছে। এখন শুধু ঘুম পাচ্ছে। আমার ভাগের খিচুড়ি রেখে দে। ঘুম ভাঙলে খাব।

শাহেদ বলল, কিছুই তো মুখে দিলি না।

ক্ষিধেটা ঘুমের দিকে টার্ন নিয়ে নিয়েছে। এখন না ঘুমালে মরে যাব।

নাইমুল খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোর জন্যে একটা উপহার। আমি নিয়ে এসেছি। উপহারটা শুরুতেই দিতে পারতাম। ইচ্ছা করে দেরি করলাম।

শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, কী উপহার?

একটা চিঠি।

কার চিঠি?

কোথায় ঘুমাব সেই জায়গাটা আগে দেখিয়ে দে। ঘুমিয়ে পড়লে খবরদার আমাকে জাগাবি না। তোর বাসায় মিলিটারি ঢুকে পড়লেও না। আমার প্যান্টের পকেটে চিঠিটা আছে। নিয়ে পড়।

 

শাহেদ চিঠি পড়ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে। বাড়িঘর দুলছে। শা শা। শব্দ হচ্ছে। কানের পাশ দিয়ে গরম বাতাস যাচ্ছে। প্ৰবল আনন্দের সময় এরকম অনুভূতি হয় তার জানা ছিল না। রুলটানা কাগজে ছোট্ট চিঠি–

জেপ গো,

আমি রুনিকে নিয়ে ভালো আছি! শরণার্থী শিবিরে ছিলাম, তোমার বন্ধু নাইমুল সাহেব সেখান থেকে এনে তার এক আত্মীয় বাড়িতে রেখেছেন। সেই বাড়িতে আমরা অতি যত্নে আছি। নিরাপদে আছি।

ইতি–
তোমার জেপ, আসমানী

শাহেদ চিঠি হাতে নাইমুলের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। নাইমুল শিশুদের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। আরামের গাঢ় ঘুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *