শরৎ নামে একজন শিষ্য একটি প্রকাণ্ড রুইমাছ নিয়ে এসেছেন কলকাতা থেকে। বেলুড় মঠের ঘাটে এসে ভিড়েছে নৌকো, শরতের ভূত্য ঝুড়িতে করে সেই মাছ মাথায় নিয়ে নামছে। ঘাটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বামী প্রেমানন্দ, তিনি সেই মাছ দেখে আঁতকে উঠলেন। এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে তিনি ফিসফিস করে শরৎকে বললেন, মশাই করেছেন কী? এত বড় মাছ এনেছেন, আপনার গুরুর শরীর কী রকম খারাপ জানেন না? মাছ খাওয়া একেবারে নিষেধ! কেউ যেন দেখতে না পায়, ফিরিয়ে নিয়ে যান, ফিরিয়ে নিয়ে যান!
শরৎ অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ভোগের নাম করে এনেছি, ফেরত নিয়ে যাব?
প্রেমানন্দ বললেন, আজ রবিবার, আজ মাছ-ভোগ দেওয়া হয় না, ও মাছ লাগবে না।
শরৎ তাঁর ভৃত্যকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেবার জন্য উদ্যত হলেন, কিন্তু এর মধ্যে যাঁর দেখার তিনি দেখে ফেলেছেন।
অদূরে একটা গাছতলায় বই হাতে নিয়ে বসে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ, তিনি চোখ তুলে বললেন, ওটা কী রে, শরৎ কী এনেছে?
কাছে এসে উৎফুল্ল বিস্ময়ে বললেন, এত বড় রুই, কী টাটকা, গা একেবারে চেকনাই দিচ্ছে, মুখের কাছটা লালমতন, এমন খাসা জাতের রুই অনেক দিন দেখিনি! রাখ রাখ, এমন মাছ ফেরত দিতে আছে!
প্রেমানন্দ সভয়ে বললেন, তুমি এই মাছ খাবে নাকি?
প্রেমানন্দের ভয় পাবার কারণ আছে। স্বামীজির শরীর মাঝে মাঝে খুব খারাপ হয়ে পড়ে বলে এখন এক বিচিত্র কবিরাজি চিকিৎসা চলছে। একুশ দিন ধরে স্বামীজিকে শুধু দুধ খেয়ে থাকতে হবে, অন্য সব কিছু খাওয়া নিষেধ, এমনকী এক ফোঁটা জল কিংবা এক বিন্দু নুনও খাওয়া চলবে না। জুন মাসের প্রচণ্ড গরম, এমনিতেই স্বামীজি ঘণ্টায় চার-পাঁচ গেলাস জল পান করেন, টানা একুশ দিন নির্জলা কাটাতে হবে! স্বামীজি রাজি হয়ে গেছেন, এখন ভুল করে জলের গেলাস তুললেও জল মুখের মধ্যে যায় না। কষের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে, এমনই তাঁর মনের জোর।
কিন্তু এমন মাছ দেখলে কি চোখ ফেরানো যায়?
স্বামীজি বললেন, আমি খাব কেন! কোনও ভক্ত যদি ভোগ দেবার সঙ্কল্প করে কিছু আনে, তা দেওয়াই উচিত।
প্রেমানন্দ বললেন, কিন্তু আজ যে রবিবার!
স্বামীজি বললেন, অত দিন মানামানির কী আছে! ভক্তিটাই আসল কথা।
মাছবাহকের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীজিও চললেন রান্নাঘরের দিকে।
প্রতিদিন শ্রীরামকৃষ্ণের নামে আলাদা ভোগ রান্না হয়। সেই ভোগের জন্য কয়েক টুকরো মাছ সরিয়ে রাখা হল, বাকি মাছ দিয়ে মঠবাসীদের মহাভোজ হবে।
স্বামীজি প্রেমানন্দকে বললেন, অনেক দিন আমি রাঁধিনি, আজ তোদের বেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। মশলাপাতির জোগাড় কর তো!
প্রেমানন্দ আবার ভয় পেয়ে গেলেন। মস্ত বড় উনুন, এত জনের জন্য রান্না কি সোজা কথা? অসুস্থ শরীর নিয়ে গনগনে আঁচের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
স্বামীজি সে আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আরে এককালে আমার রান্নার কত শখ ছিল, তোরা জানিস না। দ্যাখ না, আজ তোদের নতুন রকম মাছের ঝোল খাওয়াব। দুধ চাই, দই চাই। ভার্মিসেলি আছে না?
নবীন সন্ন্যাসীরা ভিড় করে এল স্বামীজির রন্ধনপ্রণালী দেখার জন্য। আজ তাদের কত সৌভাগ্য!
যথাসময়ে মধ্যাহ্নভোজের ঘণ্টা বাজল। ব্রহ্মানন্দ এসে বললেন, হ্যাঁ রে নরেন, তুই এত করে রাঁধলি, তুই নিজে খাবি না, এটা কেমন কথা? আমরা খাই কী করে?
চামচ দিয়ে যৎসামান্য মাছের ঝোল তুলতে তুলতে স্বামীজি বললেন, রাঁধুনিকে একটু চেখে দেখতে হয়, নুন-টুন ঠিক হল কি না। বাঃ, সব ঠিক আছে, আমার এই যথেষ্ট।
খাওয়ার ব্যাপারে সব রকম বিধিনিষেধ এখন মেনে চলছেন স্বামীজি, কিন্তু অন্যদের তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন দৃশ্য দেখতে তাঁর ভাল লাগে। নিজে না খেয়েও রান্না করে তিনি আনন্দ পান!
স্বাস্থ্যের কারণে এখন তাঁর বাইরে যাওয়া-আসা বন্ধ। বেলুড় মঠেই কাটাচ্ছেন দিনের পর দিন। কোথাও বক্তৃতার আমন্ত্রণ গ্রহণ করছেন না। সারাদিন পঠন-পাঠনেই কেটে যায়। হয় নিজে পড়ছেন কিংবা মঠের ব্রহ্মচারীদের বেদ ও গীতাভাষ্য পড়াচ্ছেন। সংস্কৃত ব্যাকরণ সম্পর্কেও তাঁর আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন।
জাপানে যাওয়া হল না। শিকাগোর মতন টোকিও শহরেও একটি বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনের আয়োজন চলছে, সেখান থেকে স্বামীজির আমন্ত্রণ এসেছে বারবার। জো ম্যাকলাউডেরও খুব ইচ্ছে, তিনি জাপানে কাটিয়েছেন অনেক দিন। ওকাকুরা নামে জাপানের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি চিঠি লিখলেন, এমনকী জাহাজ ভাড়া পর্যন্ত পাঠিয়ে দিলেন। কলকাতায় জাপানের রাজপ্রতিনিধিও একদিন ওই অনুরোধ জানাতে এলেন মঠে।
স্বামীজি প্রথমে রাজি হয়েছিলেন। জাপান ভারী সুন্দর দেশ, ফুলের দেশ, ছবির দেশ। জাপান স্বাধীন দেশ, শক্তিশালী দেশ, শিল্পোন্নত দেশ, এশিয়ার গর্ব। জাপানের সঙ্গে ভারতের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন বিশেষ জরুরি। কিন্তু মাঝে মাঝে শরীর আর বইতে চায় না বলে স্বামীজি আবার দমে যান। মৃত্যুচিন্তা মাঝে মাঝেই মনোলোকে কালো ছায়া ফেলে। যদি মরতেই হয়, তা হলে বিদেশ-বিভুইতে তিনি মরতে চান না। কেমন যেন ধারণা হয়ে গেছে, তাঁর আয়ু চল্লিশ পেরুবে না।
আবার মাঝে মাঝে শরীরটা চাঙ্গা বোধ করলেই তাঁর ভেতরের পরিব্রাজক সত্তাটি জেগে ওঠে। তখন মনে হয়, জাপানে যাওয়াটা যেন তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
এর মধ্যে জো ম্যাকলাউড সেই ওকাকুরা নামে ভদ্রলোকটিকে নিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। বেলুড় মঠে দেখা করতে এলেন ওকাকুরা, তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে স্বামীজির বেশ ভাল লাগল। ওকাকুরা জাপানের সামুরাই বংশোদ্ভূত বিশিষ্ট এক ব্যক্তি, সজ্জন, সৌজন্যমণ্ডিত, স্বল্পবাক। তিনি একজন শিল্প-পণ্ডিত, চিন্তাবিদ ও কবি। ওকাকুরার সঙ্গে এসেছে হোরি নামে আর একটি তরুণ, সে অল্প বয়েসেই ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বন করেছে, ভারতে সে বেশ কিছু দিন থেকে সংস্কৃত শিক্ষা করতে চায়। আর ওকাকুরা চান বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান, জাপানের শিল্প-সংস্কৃতির প্রেরণা এসেছে যে ভারত থেকে, সেই দেশটিকে ভাল রকমভাবে দেখতে ও জানতে।
জো ম্যাকলাউড এই ওকাকুরা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। প্রাচ্য প্রীতির টানে তিনি ভারত পরিক্রমা নে করছেনই, তারপর জাপানে গিয়ে ওকাকুরার সংস্পর্শে আসেন। এবং এঁর প্রতি মুগ্ধ হন। জোর ধারণা, ওকাকুরার সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দর যোগাযোগ ঘটলে একটা দারুণ সমন্বয় হবে।
ওঁদের দেখে স্বামীজির আবার জাপানে যাওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল। ওকাকুরা বোধগয়া ও বারাণসী দেখতে চান, স্বামীজি সদলবলে তাঁর সঙ্গী হলেন। বোধগয়ায় রাজকুমার সিদ্ধার্থ বোধি লাভ করে গৌতম বুদ্ধ হন, আর বারাণসীর সন্নিকটে এক স্থানে তিনি প্রথম তাঁর বাণী প্রচার করেন, এই দুটি স্থান বৌদ্ধদের অবশ্য দ্রষ্টব্য। বোধগয়ায় কাটানো হল সাত দিন। তারপর সেখান থেকে কাশী।
বোধগয়ার মন্দির নিয়ে হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিবাদ আছে। বোধগয়ার মোহান্ত স্বামীজিকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করলেন, ওকাকুরার সঙ্গে লর্ড কার্জনের একটা চিঠি ছিল বলে সরারি কর্মচারীরা তৎপর, সেখানে কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু বারাণসীতে এসে সারনাথ স্থূপ দর্শনে কোনও বাধা না থাকলেও কাশীর প্রধান আকর্ষণ যে বিশ্বনাথ মন্দির, সেখানে তো ওকাকুরা যেতে পারবেন না। স্বয়ং লর্ড কার্জনকেও পুরীর মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
স্বামীজির কৌতুকপ্রবণ মনটি নেচে উঠল। ওকাকুরার তিনি আড়ালে নাম দিয়েছেন অর খুড়ো। অক্রুর যেমন মথুরা থেকে কৃষ্ণকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন, সেই রকম ওকাকুরাও স্বামীজিকে জাপানে নিয়ে যেতে এসেছেন, সুতরাং নামের মিল ছাড়া এই মিলটাও আছে। এখন এই অর খুড়োকে হিন্দু সাজালেই হয়। স্বামীজি কালাপেড়ে কোঁচানো ধুতি পরিয়ে দিলেন ওকাকুরাকে, গায়ে মেরজাই, মাথায় সিল্কের পাগড়ি, আর পায়ে ঊড় তোলা নাগরা। সবাই তা দেখে হেসে বাঁচে না। হাসতে হাসতেও সবাই স্বীকার করল, মানিয়েছে ভারী সুন্দর। মনে হয় যেন নেপালের রাজবংশের কোনও প্রতিনিধি।
স্বামীজি বললেন, দেখো খুড়ো, ওখানে গিয়ে যেন আবার মুখ খুলল না!
বিশ্বনাথের গলি দিয়ে হেঁটে গিয়ে ওকাকুরা দিব্যি মন্দির দর্শন করে এলেন।
কাশীর পর ওকাকুরা ভারতের আরও মন্দির, স্থাপত্য, শিল্পকীর্তি, অজন্তার গুহাচিত্র এই সব দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। কিন্তু বারাণসীতেই স্বামীজির স্বাস্থ্য টিকল না, শরীর আবার দুর্বল, তিনি ওই দলটি ছেড়ে ফিরে এলেন কলকাতায়।
মঠের প্রাঙ্গণে বড় আমগাছটির তলায় একটি ক্যাম্প খাট পাতা থাকে। স্বামীজি বিকেলবেলা সেখানে এসে বসেন, গল্প করেন শিষ্যদের সঙ্গে। কখনও গভীর ভাবের কথা, কখনও হাস্য পরিহাস। কবিরাজি ওষুধে তাঁর খানিকটা উপকার হয়েছে, মুখের পাণ্ডুর ভাব কেটে গেছে। অনেকখানি।
কাল খুব একচোট বৃষ্টি হয়েছিল, আজ আকাশ গুমোট, সকলের গায়েই দরদর ঘাম। স্বামীজি বসে আছেন কৌপীন পরে, খালি গায়ে, হাতে হুঁকো। শিষ্যদের তিনি গ্রিক ভাস্কর্যের সঙ্গে ভারতীয় ভাস্কর্যের তুলনা করে বোঝাচ্ছেন, এমন সময় একজন এসে বলল, ও স্বামীজি, আপনার বড় হাঁসটি যেন কেমন করছে। মনে হচ্ছে আর বাঁচবে না।
স্বামীজি তৎক্ষণাৎ কথা থামিয়ে চঞ্চল হয়ে নেমে পড়ে বললেন, সে কী রে, চল তো দেখে আসি!
এর মধ্যে মঠে স্বামীজির অনেক পোয্য জন্তু-জানোয়ার জুটেছে। গরু তো আছেই, তা ছাড়া অনেকগুলি হাঁস, কুকুর, ছাগল, হরিণ, সারস। একটা মাদি ছাগলের নাম ‘হংসী’, তার দুধে সকালবেলা স্বামীজির চা হয়। এক-একদিন তিনি সেই মাদি ছাগলটিকে মিনতি করে বলেন, হংসী। মা, আমাকে একটু দুধ দিবি! আর একটি ছোট্ট ছাগলছানার নাম মটর, তার পায়ে ঘুঙুর পরানো, সে সব সময় স্বামীজির পায়ে পায়ে ঘোরে। স্বামীজি কথা বললে সে যেন ঠিক বোঝে। স্বামীজি অনেককে বলেন, এই মটরুটা আগের জন্মে নিশ্চয়ই আমার কেউ হত! হরিণটাকে নিয়েও প্রায়ই দুভোগ হয়, মাঝে মাঝেই সে মঠের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যায়। একবার তো দিন তিনেক তাকে পাওয়া গেল না, স্বামীজির দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে ধরে আনা হল।
স্বামীজি গিয়ে দেখলেন, রাজহংসটি কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে, মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকিয়ে ঠিক সর্দি ঝাড়ার মতন শব্দ করছে।
স্বামীজি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বললেন, ইস, কাল সারাদিন বৃষ্টির মধ্যে বাইরে ছিল, তাই ঠাণ্ডা লেগে গেছে বোধ হয়!
একজন বৃদ্ধ সাধু তা শুনে বললেন, হায় রে, কী দিনকালই পড়েছে। ঘোর কলি! বৃষ্টি ভিজলে যদি হাঁসেরও সর্দি লাগে, ব্যাঙও হাঁচতে শুরু করে, তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কী!
স্বামীজি হেসে উঠলেন।
কিন্তু অনেক সেবা-যত্নেও রাজহংসটিকে বাঁচানো গেল না। তার শেষ মুহূর্ত আসার পর স্বামীজি চুপ করে ঠায় বসে রইলেন। এই মৃত্যুদৃশ্য তাঁকে উদাস করে রাখল অনেকক্ষণ।
স্বামী অদ্বৈতানন্দ মঠের ব্যবহারের জন্য একটি তরিতরকারির খেত করেছেন, স্বামীজির ছাগল-হাঁস-হরিণেরা তা নষ্ট করে দেয়, সে জন্য সেখানে একটা বেড়া বাঁধতে হবে। মঠের জমি সাফ করা ও মাটি কাটার কাজ করে একদল সাঁওতাল নারী-পুরুষ। তাদের কয়েকজনকে বেড়া বাঁধার কাজ দেওয়া হল, স্বামীজি নিজে তদারকি করতে লাগলেন। পোয্য প্রাণীগুলির ওপর কেউ রাগারাগি করলে তাঁর সহ্য হয় না।
সাঁওতালরা কাজে ফাঁকি দিতে জানে না। সকাল থেকে একটানা কাজ শুরু করে, দুপুরে একটুক্ষণের বিরতিতে কিছু খাবার খেয়ে নেয়, আবার কাজ। ওরা নিজেদের খাবার সঙ্গে নিয়ে আসে। পুটুলিতে বাধা শুধু চিড়ে আর খানকয়েক বাতাসা। স্বামীজি ওদের খাওয়া দেখতে দেখতে ভাবেন, পোলাও-মাংস, লুচি-পরোটা, সন্দেশ-রসগোল্লা, আর কত রন্ধন শিল্পের উৎকৃষ্ট সব নমুনা আছে এ দেশে, এই মানুষগুলো কোনও দিন তার স্বাদও পেল না। অথচ এরাই প্রকৃতপক্ষে দেশটা চালায়। এরা চাষ করে, কল-কারখানায় খাটে, পথ তৈরি করে, সেতু বানায়। প্রতিদিন এরাই ঘাম ছড়াচ্ছে ভূমিতে। এমনকী মেথর-মুফরাসরাও দু-এক দিন কাজ বন্ধ করলে শহরগুলিতে হাহাকার পড়ে যাবে। অথচ এরা চিরকালের গরিব। যারা জাতির মেরুদণ্ড, তারাই কিনা নিচু জাত, পতিত, অচ্ছুৎ! অদ্ভুত এই দেশ। এদের উন্নতি ঘটাতে না পারলে গীতা, বেদ, বেদান্ত-ফেদান্ত সব মিথ্যে
স্বামীজি ভাবলেন, একদিন এদের উত্তম সব সুখাদ্য বেঁধে খাওয়ালে কেমন হয়?
ওদের সদারের নাম কেষ্টা, তার সঙ্গে স্বামীজির বেশ ভাব হয়ে গেছে ক’দিনে। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদের ঘর-সংসার ও সমাজের কথা জিজ্ঞেস করেন। কাজের সময় গল্প করা অবশ্য কেষ্টার পছন্দ নয়, সে কখনও আপত্তি করে বলে, ওরে স্বামীবাপ, তুই আমাদের কামের সময় এখানকে আসিস না। তোর সঙ্গে কথা বললে কাজ বন্ধ হয়ে যায়, পরে বুড়ো বাবা আমাদের বকবে।
স্বামীজি হাসতে হাসতে বলেন, না রে, আমি থাকলে বুড়ো বাবা বকবে না!
একদিন ওরা যখন চিড়ে বাতাসা ভোগ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারছে, তখন স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন, কেষ্টা, আমি একদিন রান্না করব, তোরা খাবি!
কেষ্টা একটুক্ষণ চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলল, না, তা তো পারব না। আমরা তোদের মতন সাধুদের ছোঁওয়া খাই না। এখন বিয়ে হয়ে গেছে, তোদের ছোঁওয়া নুন খেলে আমাদের জাত যায় রে বাপ!
এ কথা শুনে স্বামীজি যেমন চমকে উঠলেন, তেমন মজাও পেলেন। দুর্গের তা হলে একটা অন্য দিকও আছে! জাত্যভিমানী বামুনকায়েতরা এদের নিচুবর্ণ মনে করে, এদের হাতের ছোঁওয়া খায় না। এরাও আবার তথাকথিত সেইসব উঁচু জাতের হাতের ছোঁওয়াকে অপবিত্র বোধ করে! বেশ হয়েছে! এদেরও আত্মসম্মান বোধ প্রবল।
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, তাই তো, নুন খেলে তোদর জাত যায়! নুন ছাড়া কোনও খাবার খেতে পারিস!
কেষ্টা তাতে সম্মতি জানাল। কিন্তু বিনা নুনে কিছু রান্না করা কী করে সম্ভব? তাই স্বামীজি আর সে দিকে গেলেন না, তিনি ওদের জন্য লুচি, মিহিদানা, রাজভোগ, সন্দেশ, দই আনালেন প্রচর সবাইকে পাত পেতে বসিয়ে বললেন, একেবারে পেট ভরে খেতে হবে, যে-যত পারবি।
স্বামীজির এই নতুন খেয়াল দেখার জন্য অনেকে ভিড় করে এল। সেই সাঁওতাল শ্রমজীবীরা অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে, আর একটা একটা খাবার মুখে তুলছে। বেশির ভাগগুলিরই তারা নাম জানে না, কখনও চোখেও দেখেনি। কিন্তু তারা লোভী, বুভুক্ষুর মতন হাপুস-হুঁপুস করে। খাচ্ছে না, এক-একটা বস্তু মুখে তুলে আগে স্বাদ নিচ্ছে, তারপর মাথা নাড়ছে।
স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, ভাল লাগছে? কোনওটাতেই নুন নেই।
কেষ্টা বলল, হাঁ রে বাপ, নুন ছাড়াও ভাল জিনিস হয় বটে!
স্বামীজি আপনমনে বললেন, নারায়ণ, নারায়ণ! আমার জীবন্ত নারায়ণের ভোগ হল আজ!
সাঁওতালরা চলে যাবার পর একজন শিষ্য বলল, লোকগুলি কেমন আনন্দ করে খেল। দেখে বড় ভাল লাগল।
স্বামীজি বললেন, এক-এক সময় ইচ্ছে করে মঠ-ফঠ সব বিক্রি করে দিই, এই সব গরিব-দুঃখী-দরিদ্র নারায়ণদের সব বিলিয়ে দিই। আমরা সন্ন্যাসী, আমাদের তো গাছতলাই ভাল, দেশের লোক খেতে পরতে পাচ্ছে না, আমরা কোন প্রাণে মুখে অন্ন তুলছি? দেখ, এরা কেমন সরল, এদের কিছু দুঃখ দূর করতে পারবি? নতুবা গেরুয়া পরে আর কী হল?
দু-চারটে দিন শরীর ভাল থাকার পরেই আবার হঠাৎ হাঁপানির টান ওঠে। একটু হাঁটতেও কষ্ট হয়। বহুমূত্রের প্রকোপে একটা চোখের দৃষ্টিশক্তি প্রায় গেছে। এই সময় চক্ষুকে বিশ্রাম দেওয়া উচিত, কিন্তু স্বামীজির পাঠের নেশা দিন দিন বাড়ছে। মঠের গ্রন্থাগারের জন্য এক সেট এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা কেনা হয়েছে, তাই তিনি পড়ে যাচ্ছেন খণ্ডের পর খণ্ড। শিষ্যদের নিয়ে যখন শাস্ত্র পড়াতে বসেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। ছাত্ররা অস্থির হয়ে উসখুস করে, শিক্ষকের হুঁশ নেই।
উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অনেকগুলি স্থান সফর করে জো ম্যাকলাউড ও ওকাকুরা ফিরে এসেছেন কলকাতায়। প্রায়ই মঠে আসেন দুজনে, ইংরিজি জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য ওকাকুরা বিশেষ কথা বলেন না, জো ম্যাকলাউডই বাক্যালাপ চালান, এই জাপানি বন্ধুটি সম্পর্কে জো উচ্ছ্বসিত। প্রায় সমবয়েসী এই মানুষটিকে স্বামীজিরও ভাল লাগে, মঠে সকলের সঙ্গে সাধারণ আহার তিনি তৃপ্তি করে খান, কাছাকাছি জায়গাগুলি ঘুরে ঘুরে দেখেন। একদিন তো এক কাণ্ডই হল। গঙ্গাবক্ষ দিয়ে সদলবলে বেলুড় মঠে আসছিলেন ওকাকুরা। হঠাৎ সেই নৌকো উল্টে গেল। খবর পেয়ে স্বামীজি হন্তদন্ত হয়ে ঘাটের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে সবাইকে বললেন, ‘ওরে শিগগির দ্যাখ দ্যাখ ওকুরখুড়ো ডুবে গেল কি না, সাঁতার জানে কি না তাই বা কে জানে!’
কিঞ্চিৎ হাবুডুবু খেয়ে ওকাকুরা বেঁচে গেলেন সে যাত্রা। তাঁর মুখমণ্ডলে অবশ্য আতঙ্কের লেশমাত্র নেই। আগের মতনই গম্ভীর, যেন কিছুই ঘটেনি। স্বামীজি তাঁর ভিজে পোশাক ছাড়িয়ে, নিজের একপ্রস্থ পোশাক পরিয়ে দিলেন।
জাপানে আর যাওয়া হবে না, এ বিষয়ে স্বামীজি এখন মনস্থির করে ফেলেছেন। ওকাকুরা তবুও অনির্দিষ্টকাল ভারতে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। মাঝে মাঝে স্বামীজির খটকা লাগে, শুধু তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো কিংবা ভারতের শিল্প পুরাকীর্তিগুলি দর্শনই নয়, ওকাকুরার আরও যেন কিছু একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা তিনি খুলে বলেন না। ওকাকুরার জীবনযাত্রা ভোগী পুরুষদের মতন, দামি ইজিপশিয়ান সিগারেট খান অনবরত, স্বামীজিকেও খাওয়ান, স্বামীজির অনুরোধে একদিন হুঁকো টেনে দেখতে গিয়ে কাশতে কাশতে দম আটকে যাবার উপক্রম, সেটা তাঁর সহ্য হয়নি। স্বামীজি শুনেছেন, ওকাকুরার মদ্যপানের অভ্যেস আছে। জাপানে অবশ্য বৌদ্ধ মঠের সন্ন্যাসীরাও মদ্যপান করেন, সেখানে এটা কিছু দোষের মনে করা হয় না। ওকাকুরার সাজপোশাকও খুব দামি, সেই জন্য কেউ কেউ তাঁকে প্রিন্স ওকাকুরা, কিংবা কাউন্ট বা ব্যারনও বলে। এমন মানুষ বেলুড় মঠে এসে কী পাবেন, এখানে তো শুধু ত্যাগ। জো ম্যাকলাউডের উৎসাহের আতিশয্যই কি এখানে ঘন ঘন আসার কারণ?
প্রায় পৌনে দু বছর বাদে দেশে ফিরে এলেন নিবেদিতা। ব্রিটানিতে স্বামীজির সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা হয়েছে, তারপর নিবেদিতা ফিরে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে, স্বামীজি বেরিয়ে পড়েছিলেন ইউরোপ পরিভ্রমণে। এর মধ্যে নিবেদিতার মনজগতে যে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে, তার অল্পই আভাস পেয়েছেন স্বামীজি। এ নিবেদিতা আর স্বামী বিবেকানন্দর সেই ছায়া-অনুগামিনী নন। এখনও এই নিবেদিতা অবশ্যই স্বামীজির ভক্ত এবং শিষ্যা, কিন্তু আগে যিনি ছিলেন নিবেদিতার রাজা, যিনি ছিলেন প্রভু, এখন তিনি গুরু, এখন তিনি পিতার মতন।
স্বামীজিকে এতদিন পর দেখে নিবেদিতার চক্ষে জল এসে গেল। যাঁর ছিল দেবদূর্লভ রূপ, তাঁর এ কী চেহারা! এক চক্ষু প্রায় কানা, পা দুটো ফোলা ফোলা, গায়ের চামড়া খসখসে হয়ে গেছে, শরীরের আকৃতি কেমন যেন বেটপ।
স্বামীজি শিষ্যার অবস্থা দেখে কৌতুক করে বললেন, কী, আমাকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মতন দেখাচ্ছে না?
নিবেদিতা কিছু বলতে পারলেন না।
স্বামীজি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বললেন, আবার স্কুলটা চালু করো, কবে থেকে পড়াতে শুরু করবে?
নিবেদিতা মৃদুস্বরে বললেন, সামনেই সরস্বতী পুজো। ভাবছি, স্কুলে সরস্বতী পুজো করে সবাইকে ডাকব।
স্বামীজি বললেন, খুব ভাল, খুব ভাল, ধুমধাম করে পুজো লাগিয়ে দাও! জানো তো, আমরা গত বছর বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা করেছি ঢাক ঢোল পিটিয়ে। এখন আর কেউ সহজে আমাদের ম্লেচ্ছ-ঘেঁষা বলতে পারবে না।
কথা বলতে বলতে ওকাকুরা ও জো ম্যাকলাইভ এসে গেলেন। স্বামীজি ওকাকুরার সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন নিবেদিতার। ওকাকুরা বিশেষ শিষ্টতার সঙ্গে মাথা ঝুঁকিয়ে নিবেদিতার একটি হাত গ্রহণ করে অভিবাদন জানালেন।
নিবেদিতা মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে রইলেন ওকাকুরার দিকে। যেন তিনি তাঁর স্বপ্নের পুরুষকে দেখছেন।
নিবেদিতার সঙ্গে ওকাকুরার এই প্রথম সাক্ষাৎকার। তবু নিবেদিতার এমন ভাবাবিষ্ট অবস্থা দেখে কৌতূহলী হয়ে স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, তোমাদের আগে দেখা হয়েছে নাকি?
নিবেদিতা বললেন, না। আগে দেখিনি, তবে ওঁর বিষয়ে আমি অনেক কিছু পড়েছি। জো আমাকে জাপান থেকে অনেক কাগজপত্র পাঠিয়েছে বিলেতে। ওঁর কর্ম পরিকল্পনা বিষয়ে আমি জানি।
স্বামীজি অনুভব করলেন, তাঁর জানা ও নিবেদিতার জানার মধ্যে যেন অনেক তফাত।
জো বলল, স্বামীজি, আমাদের ধীরামাতা, শ্রীমতী ওলি বুলও ফিরে এসেছেন, তিনি পরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তিনি উঠেছেন আমেরিকান কনসুলেটে। সেখানে এই সপ্তাহের শেষে তিনি একটা পার্টিতে মাননীয় ওকাকুরার সঙ্গে কলকাতার বিশিষ্ট মানুষদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান। অনেককে ডাকবেন। আপনাকে তিনি বিশেষ করে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
স্বামীজি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, না, আমি আর কোথাও যাই না। যদি বা কখনও গঙ্গা পেরোই, তা হলে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে আর আমার যেতে ইচ্ছে করে না।
জো বলল, এটা তো ঠিক সামাজিক অনুষ্ঠান নয়। ভারত ও জাপানের মৈত্রী বন্ধনের জন্য, আপনি মধ্যমণি হয়ে থাকবেন।
স্বামীজি বললেন, এ দেশে অনেক বড় বড় মানুষ আছেন, তাঁদের ডাকো। আমাকে বাদ দিলেও চলবে। আমি তো আর বেশিদিন নেই!
জো বলল, আপনার মুখে এই কথা শুনতে চাই না।
নিবেদিতা জো’র দিকে তাকালেন। স্বামীজি একবার না বললে তাঁকে আর রাজি করানো প্রায় অসম্ভব, তা তিনি জানেন। ওকাকুরা গঙ্গার দিকে চেয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন আপনমনে, যেন এ আলোচনায় তাঁর কোনও অংশ নেই।