শত্রুর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া
এ শহরে যে সামান্য ক’জন মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলতে পছন্দ করি, কবি ফরহাদ মজহার তাদের মধ্যে একজন। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, প্রাবন্ধিক, কবি, গীতিকার এবং গায়ক। তার সকল পরিচয় স্বীকার করে কবি পরিচয়টিকেই অগ্রগণ্য বলে মানি। ফরহাদ মজহার বাংলা ভাষা সম্পর্কে নিজস্ব একটি মত প্রকাশ করেন, যেমন, সাদাসিধে করে বলতে গেলে, যে বাংলা ভাষাটি পশ্চিমবঙ্গ এবং আমাদের দেশে প্রচলিত তা নিরেট পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, আমাদের নয়। বাংলাদেশের নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে আরবি-ফারসি শব্দসমৃদ্ধ আমাদের জবানের ভাষাকে লেখালেখিতে তুলে আনা দরকার বলে তিনি মনে করেন। তিনি ইসলামি সংস্কৃতিকেও বেশ নতুন চোখে দেখেন, কারণ এই সংস্কৃতি নাকি আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষা থেকে পৃথক একটি ভাষার জোগান দেবে।
ভাষার ক্ষেত্রে ফরহাদ মজহারের এই বোধ, এই যুক্তি আমি কখনও মেনে নিইনি। এর কারণ, আমি মনে করি না এ পারের বাঙালিদের কথ্য ভাষায় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের প্রয়োগ খুব বেশি। মৌখিক ব্যবহার আছে, এমন শব্দের লিখিত ব্যবহার এদেশে অপ্রচলিত নয়, যেমন নাস্তা, গোসল, পানি যা পশ্চিমবঙ্গে জলখাবার, স্নান ও জল বলে পরিচিত। আমাদের নাটকে, উপন্যাসে ‘এয়েচো, খেয়েচো, করলুম, বললুম, দোবো’ শব্দের চল নেই। এ ছাড়া বোধে ও বিশ্বাসে যে স্বাতন্ত্র্য আছে, যেমন কৃষ্ণচূড়ার লাল বলতে আমরা ফাগুনের আরেক রঙ বুঝি, ফাগুন বলতে বায়ান্ন বুঝি, রক্তপাত বুঝি। এ ধরনের দেশ, কাল, পরিবেশ, প্রতিবেশ, রাজনীতিজনিত কিছু স্বাতন্ত্র্য বাদ দিলে যা থাকে, তাকে যদি ‘পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা’ বলে অভিযোগ করা হয়, তবে খুব অন্যায় হবে। এবং এও অন্যায় যদি এই শুদ্ধ বাংলার মধ্যে অনর্থক আরবি-উর্দু শব্দ মিশিয়ে ভাষাটির খৎনা করা হয়।
প্রচলিত কোনও মৌখিক শব্দ, যে শব্দ, লিখিত ভাষায় এখনও প্রবেশ করেনি বলে মনে করা হয়, সে শব্দের চলন প্রচলনে আমার কোনও আপত্তি নেই, তবে পুরনো ঢাকার গুটিকয় উর্দুভাষীর উর্দুকে প্রচলিত জ্ঞান করা মোটেও সমীচীন নয়।
সেদিন কবি শামসুর রাহমানকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম—আপনার গদ্যে উর্দু শব্দের আধিক্য কেন?
শামসুর রাহমান বললেন—শব্দগুলো প্রচলিত।
আমি বললাম—অধিকাংশ শব্দের অর্থ আমি জানি না। অথচ আপনি বলছেন প্রচলিত, নাকি আপনার কাছে প্রচলিত মনে হবার কারণ আপনার স্ত্রী একজন উর্দুভাষী, আপনার ঘরে উর্দু-চৰ্চা চলে।
শামসুর রাহমান নম্র হেসে বললেন–ও তো এখন বাংলায় কথা বলে।
বললাম–নাকি আপনিও একটি ইসলামি বাংলা ভাষা তৈরি করতে চাচ্ছেন যা পশ্চিমবঙ্গের ভাষা থেকে আলাদা?
শামসুর রাহমান বললেন—একটা সময় ছিল যখন আমি পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলায় গদ্য লিখেছি, তখন আমাদের ওপর সরকারের নিষেধ ছিল ওই ভাষায় না লিখবার। এখন কোনও নিষেধ নেই বলে উর্দু-আরবি শব্দ মেশাচ্ছি। তা ছাড়া আমাদের অনেক শব্দই তো বিদেশি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম যে শব্দগুলো ইতিমধ্যে ঢুকে গেছে—চেয়ার, টেবিল, স্কুল, কলেজ, সোয়েটার, দাওয়াত, পোশাক, পালিশ, পেনশন—এ নিয়ে তো কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি নতুন করে যে শব্দগুলোর প্রয়োগ চাচ্ছেন এর কারণ কি ওই শব্দগুলোর বাংলা প্রয়োগ নেই বা থাকলেও খুব দুর্বল?
শামসুর রাহমান বললেন–না, তা নয়। আছে। তবে ভাষায় নতুন কিছু শব্দ এলে খারাপ কী? ভাষা আরও সমৃদ্ধ হল!
আমি শামসুর রাহমানের এই যুক্তিকেও মানতে পারি না। ভাষাকে নতুনত্ব দেবার বা সমৃদ্ধ করবার জন্যে, এই বাংলা ভাষা এত ভিখিরি হয়ে যায়নি যে অন্য ভাষা থেকে শব্দ হরণ করবার বা ধার করবার কোনও প্রয়োজন আছে। আমাদের যা আছে, তাই নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকি না কেন। বরং শব্দভাণ্ডারকে পরিমাণে সমৃদ্ধ করবার চেয়ে সাহিত্যকে গুণগত সমৃদ্ধি দেবার আগ্রহ থাকা উচিত সকল সৎ সাহিত্যিকের।
কবি শামসুর রাহমানকে আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি এবং এখনও করি, যদিও এই একটি ব্যাপারে তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করবার সাহস বা স্পর্ধা আমি দেখিয়েছি। শ্রদ্ধা করি কবি ও কলামিস্ট হুমায়ুন আজাদকেও। শ্রদ্ধা অক্ষুন্ন রেখেই আমি মনে করছি হুমায়ুন আজাদ এদেশের অশিক্ষিত মুর্খ জনগণের কাছে রবীন্দ্রনাথকে নারীবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করছেন যে জনগণ ‘রবীন্দ্রনাথ’কে একজন ‘হিন্দু’ ছাড়া আর কিছু জানে না, রবীন্দ্র-উৎসবে রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমানদের নিয়ে গল্প লিখলেন না তা নিয়ে অভিযোগ করে এবং কিছু বিশেষ শব্দের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সেই দেশের জনগণের জন্যে রবীন্দ্রনাথের নারী বিষয়ে মতবাদের নিন্দা করে হুমায়ুন আজাদ কলাম লিখছেন। তাঁর মূল্যবান রচনায় লিখেছেন–‘রবীন্দ্রনাথের সারকথা হচ্ছে নারীর রূপের মূল্য নেই, জ্ঞানের মূল্য নেই আরও, নারীর মহিমা তার গৃহকাজে বা দাসীত্বে এবং তাকে বন্দি করে রাখতে হবে গৃহে।‘
রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় গল্পে, উপন্যাসে নারী এত বিশাল স্থান অধিকার করে আছে, তখনকার সমাজে ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। তখন নারী ছিল শিক্ষা শিল্প সংস্কৃতিতে এত পিছিয়ে থাকা মানুষ যে রবীন্দ্রনাথ সেই শ্লথ সমাজকে অতিক্রম করে বেশি এগিয়ে ছিলেন বলে ‘ঘরে বাইরে’র বিমলা স্বামীর বন্ধুর প্রতি আগ্রহ প্রকাশে কোনও অন্যায় দেখেন না, ‘নষ্টনীড়ে’র চারুলতা মোটেও সঙ্কুচিত নন অমলের প্রেমে পড়তে। ‘স্ত্রীর পত্র’র মৃণাল যে যুক্তিতে ঘর ত্যাগ করেছেন, আমার মনে হয় আজ থেকে দেড়শ বছর পরও এদেশের মানুষ মনে ও শরীরে অতটা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে না, যতটা ‘স্ত্রীর পত্র’র মৃণাল অর্জন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময় ও সমাজ থেকে অনেক অগ্রসর—এ কথা রবীন্দ্রনাথের শত্রুরাও স্বীকার করবে। আমি আশঙ্কা করি এক স্বৈরাচারী সরকার এই দেশের জন্যে একটি রাষ্ট্রধর্ম তৈরি করেছে, যে ধর্ম দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মানুষ ভারত-বিরোধিতায় ভোগে এবং দেশে একটি ইসলামতন্ত্র চালু করতে চায়—তাদের এই স্বপ্নে মদত জোগাচ্ছে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি এবং একই সঙ্গে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে ফরহাদ মজহার, শামসুর রহমান এবং হুমায়ূন আজাদও তাদের অশুভ হাতকে আরও শক্তিশালী করছেন।
‘হিন্দু রবীন্দ্রনাথ’কে অবজ্ঞা করে যারা ‘মুসলমান কাজী নজরুল ইসলাম’-এর ইসলামি গজলে বুঁদ হয়ে থাকে তারা নিশ্চয়ই হুমায়ুন আজাদকে এবার আদর্শ বিবেচনা করবে এবং বুদ্ধিজীবিদের দলে ভিড়িয়ে দলকে আরও পাকাপোক্ত করবে। তারা একটি স্বতন্ত্র ইসলামি ভাষাও দাবি করে—যে ভাষা তৈরির একটি দায়িত্ব নিয়েছেন কবি ফরহাদ মজহার এবং কবি শামসুর রাহমান। এবার তাদের আর ঠেকায় কে, রাজাকার আলবদরগুলো এই নতুন ভাষায় পাকিস্তান পাকিস্তান গন্ধ পেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠবে। জামাত-শিবিরেরা বন বন করে রামদা ঘুরিয়ে প্রগতিবাদীর কল্লা কাটবে। রাষ্ট্রধর্ম তৈরি করে যারা একটি মহৎ কাজ করেছে বলে মনে করে তারা এবার দেশের শিক্ষিত সচেতন সম্মানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নিজেদের সার্থকতা প্রমাণ করবে।