কোনও মহিলা যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চায় তবে তাতে বাধা দেওয়ার কী আছে?—বোস সাহেব খুব ক্লান্ত চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে।
দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, মিসেস বোসকে আপনিও চেনেন, আমিও খানিকটা চিনি। প্রপার গাইডেন্স না থাকলে উনি সব টাকা-পয়সা নষ্ট করে ফেলবেন। ব্যাবসা বা দোকান চালানোর জন্য যে মন দরকার তা ওঁর নেই।
গাইডেন্স ও নেবে না।
আমাকে উনি পার্টনার করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এখন ও আপনার নামটাও সহ্য করতে পারছে না।
কেন বলুন তো!
ও জানে ওর চারশো টাকা অ্যালাউন্স আপনি ঠিক করে দিয়েছেন এবং ও যাতে সব টাকা ওড়াতে না পারে তার জন্য আপনিই নানারকম প্রিকশন নেওয়ার অ্যাডভাইস আমাকে দিয়েছেন।
কথাগুলো ওঁকে বলে ভাল করেননি।
বোস ক্লান্ত স্বরে বলে, আই অ্যাম টায়ার্ড অফ হার। আর কত অভিনয় করা যায় বলুন তো!
অভিনয় না করতে চাইলে কোর্টে যেতে হয়। সেটাও কি ভাল?
আমি এখন কোর্টে যেতে রাজি।
গেলে আপনি সহজেই ডিভোর্স পেয়ে যাবেন। কারণ মিসেস নোম মামলা লড়বেন না। কিন্তু তারপরে ওঁর অবস্থাটা কী দাঁড়াবে ভেবেছেন? ওঁর বাপের বাড়ির অবস্থাটা ভাল নয়, আত্মসম্মানবোধ বেশি বলে উনি নিজেও সেখানে যাবেন না। যতদূর খোঁজ রাখি ওঁকে আশ্রয় দেওয়ার মতো কেউ নেই।.চাকরি যে চট করে পাবেন তারও নিশ্চয়তা নেই।
সেইজন্যই ওর দোকানের স্কিমটা আমি সাপোর্ট করছি।
দীপনাথ ম্লান হেসে বলে, উনি তিন মাসও দোকান চালাতে পারবেন না।
আচমকাই বোস সাহেব বলে, লেট হার ম্যারি এগেন। আবার বিয়ে করুক। সেই স্কাউন্ড্রেলটাকেই করুক, কী নাম যেন, স্নিগ্ধদেব না কি!
দীপনাথ থমথমে মুখে বলে, স্নিগ্ধদেব ম্যারেড ম্যান। তাছাড়া একটা বেশ বড়সড় স্কলারশিপ নিয়ে উনি এখন আমেরিকায়।
আমি তো এতসব জানিও না।
আমি জানি। স্নিগ্ধদেব বোধহয় এসব সমস্যায় জড়াতে চাইত না। বিয়ের কথা বলছেন? এ দেশে এখনও ডিভোর্সি মেয়েদের অত সহজে বিয়ে হয় না।
ফাইন্ড এ ওয়ে, চ্যাটার্জি। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডিচ হার। কিন্তু ওকে আটকে রাখা মানে আমার নিজেরও আটকে থাকা। ইউ নো মাই প্রবলেমস।
দীপনাথ স্থির চোখে বোস সাহেবকে দেখছিল। উত্তরবাংলা থেকে ফিরে আসার কিছু পর থেকেই সে বোস সাহেবকে অত্যন্ত ক্লান্ত ও অধৈর্য দেখছে।
দীপনাথ মৃদু স্বরে বলে, আচ্ছা, আমি ভেবে দেখছি। দু’-একদিন সময় দিন।
বোস সাহেব জবাব দিল না।
দীপনাথ বোসের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের টেবিলে ফিরে এল। অন্য তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের জন্য আলাদা তিনটে প্লাইউডের খুপরি তৈরি হয়েছে। শুধু দীপনাথই খুপরিতে যেতে রাজি হয়নি। তাই সে এখনও মস্ত হলঘরটার একপাশে খোলামেলা জায়গায় বসে।
টেবিলের কোণটার দিকে ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে দীপনাথ। উত্তরবাংলা থেকে ফিরে এসে বার দুই মণিদীপার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছে। মণিদীপা কথা বলেইনি। ক্রুদ্ধ অপমানকর গলায় বলেছে, আই হেট টু টক উইথ ইউ। অথচ মণিদীপার সঙ্গে এখন কথা বলার দরকার। বোকা মেয়েটা জানেও না, বা জানলেও বোঝে না যে, তার বিপদ ঘনিয়ে আসছে। দীপনাথ বাইরে থেকে কতদিন বালির বাঁধ দিয়ে রাখবে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপনাথ কাজে মন দেয়। কিন্তু আবার আনমনা হয়ে যায়। নিজের ভেতরকার এক পাপবোধ তাকে বড় অস্থির করছে, কুঁকড়ে দিচ্ছে, কাজে মন দিতে দিচ্ছে না। মণিদীপাকে কি সে-ই নষ্ট করেনি? স্নিগ্ধদেব হয়তো মণিদীপার নেতা ছিল, প্রেমিক ছিল না কিছুতেই। কিন্তু দীপনাথ জানে, মণিদীপাকে যদি সত্যিকারের বিভ্রান্ত কেউ করে থাকে তবে সেই ব্যক্তি সে নিজেই। এখন সে মণিদীপার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও লাভ নেই। তাতে ভাঙা সংসার জোড়া লাগবে না। দীপনাথ নিজেও দুর্বল। বড় দুর্বল। মণিদীপার কথা সে খুব কম সময়েই না ভাবে! এখনও এক তীব্র অদ্ভুত আনন্দ রয়েছে মণিদীপাকে মনে করার মধ্যে।
থাকতে না পেরে দীপনাথ, বোস সাহেবদের বাড়িতে রিং করল। বাবুর্চি ফোন ধরে জানাল, মেমসাহেব বাড়ি নেই। লাঞ্চেও ফিরবে না বলে গেছে।
একা বেরিয়েছে?
না, একজন দালাল এসেছিল।
দালাল কিসের?
মনে হয় বাড়ির দালাল। মেমসাহেব একটা দোকানঘর খুঁজছে।
দীপনাথ ফোন রেখে দেয়।
বিকেল পর্যন্ত অনেক ফোন এল। অনেক কাজ করল দীপনাথ। কিন্তু মন কান সবই উৎকণ্ঠ রয়েছে অন্যদিকে।
বেলা চারটে নাগাদ ফোন বাজতেই তুলে মেয়েলি গলায় ‘হ্যালো’ শুনে সে প্রায় চেঁচিয়ে বলল, মণিদীপা?
মণিদীপা? মণিদীপা আবার কে বললো তো সেজদা!
ওঃ, তুই বিলু? কবে ফিরলি?
আজই।
প্রীতম কেমন আছে?
ভালই তো। নিজের আপনজনদের কাছে ভাল থাকারই তো কথা।
ওভাবে বলছিস কেন? কিছু হয়েছে?
এসো, সব বলব।
আজ আসার সময় হবে না রে।
হয় কাল অফিসের পর এসো। আসবে?
চেষ্টা করব।
মণিদীপাটা কে বলল তো!
ওঃ, বসের বউ। টেলিফোন করার কথা ছিল, তাই হঠাৎ মেয়েলি গলা শুনে ভাবলাম সে-ই।
তোমাকে আর তোমার বসের বউকে নিয়ে কিন্তু অনেক কথা রটেছে। জানো?
দীপনাথ ভীষণ চমকে গিয়ে বলে, সে কী?
এমনকী আমি শিলিগুড়িতেও শুনে এসেছি।
কে বলল?
এলে বলব। ফোনে কি সব বলা উচিত?
কোথা থেকে কথা বলছিস?
মাদ্রাজিদের ফ্ল্যাট থেকে। ছাড়ছি। কাল এসো।
বাকি সময়টা দীপনাথ গাড়লের মতো হতবুদ্ধি মুখে বসে রইল চেয়ারে। কিছুই করতে পারল না।
একসময়ে উঠে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। চারদিকে রথযাত্রার ভিড়। গায়ে গায়ে লোক। বাস ট্রাম ট্যাক্সিতে বাদুড়ঝোলা মানুষ। দীপনাথ পথে পথে অনেকক্ষণ হাঁটল। হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্স পেরিয়ে এল। ডাইনে, কখনও বাঁয়ে মোড় নিয়ে এ-রাস্তা ও-রাস্তা ধরে অবিরাম হেঁটে সে যখন নিউ আলিপুরে বোস সাহেবের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছল তখন তার ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু মানসিক বিকলতায় সে দেহের ক্লান্তি টের পাচ্ছিল না।
সন্ধের গাঢ় অন্ধকার নেমে গেছে। শীতশেষের ঠান্ডার অন্তিম কামড় এবার বেশ তীব্র। দীপনাথ অবশ্য মাইল মাইল হেঁটে ঘেমে গেছে। আকণ্ঠ জলতেষ্টা পেয়েছে তার। তবে ক্ষুধাবোধ নেই। লোকে তার আর মণিদীপার কথা বলাবলি করে। সত্যিই করে। নইলে বিলু জানল কী করে? লজ্জা! লজ্জা!
কলিং বেল টিপতে হল না। দরজা খোলা ছিল। আর খোলা দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল, বাইরের সাজ পরা মণিদীপা বসার ঘরে কিছু কাগজপত্র আর একটা ডটপেন নিয়ে কিছু করছে। টেবিলে এককাপ কফি।
এবার বেশ কিছুদিন পর মণিদীপার সঙ্গে দেখা হল দীপনাথের। অনেক রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা। চোখে-মুখে কিছু রুক্ষতা। সাজগোজে বেশ একটু অমনোযোগ।
দীপনাথকে দেখে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর বলল, এত ঘেমেছেন কেন?
আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
কথা!—বলে ঠোঁট ওলটায় মণিদীপা, কথা তো অনেক হল। কথায় কিছু হয় না।
দীপনাথ একটা ক্রুদ্ধ শ্বাস ফেলে বলে, জরুরি কথা আছে। এটা ইয়ারকি নয়।
মণিদীপা এই ধমকটা আশা করেনি। তার স্বাভাবিক সতেজ অহংকারী ভাবটা সম্প্রতি নানা ঘটনায় বড় বেশি মার খেয়েছে। এসেছে ভয়, জীবনের অনিশ্চয়তা, ডাঙা জমির অভাববোধ।
মণিদীপা দীপনাথের সামনে একটু বিবর্ণ হল, একটু কুঁকড়ে গেল। এতই চোখে পড়ার মতো ব্যাপার যে, উদভ্রান্ত দীপনাথেরও চোখ এড়াল না।
মণিদীপা হঠাৎ উঠে সিলিং পাখাটা আস্তে চালিয়ে দিয়ে এসে বলল, বসুন। কফি বলে আসি।
তার আগে কথাটা।
কথাটা তার পরে। আপনি বসুন।
দীপনাথ বসে চোখ বুজল। সিলিং পাখার হাওয়াটা এত মিষ্টি লাগল যে বলার নয়। মণিদীপার গায়ের সুগন্ধ বাতাসটাকে ভারী ঘন করে রেখেছে।
চোখ বুজে বেশ কিছুক্ষণ শুন্য মাথায় বসে থাকার পর মণিদীপা ফিরে এল। বাবুর্চি নয়, নিজেই ট্রেতে কফি আর গোটা দুই চকোলেট কেক-এর টুকরো নিয়ে এসেছে।
দীপনাথ তাকিয়ে দেখল। তারপর হাত বাড়িয়ে কফির কাপটা তুলে নিয়ে বলল, টেলিফোনে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাননি কেন বলুন তো!
মণিদীপা জবাব দিল না। চুপ করে ফুলদানি থেকে ফুল তুলে তুলে আবার সাজাতে লাগল দীপনাথের দিকে পিছন ফিরে।
কথা বলবেন না?
মৃদু শান্ত স্বরে মণিদীপা বলে, কথা ঢের হয়েছে। আর আমার কথা ভাল লাগে না।
কথা ছাড়া কমিউনিকেট করার আর কী উপায় বলুন।
মণিদীপা মরালীর মতো শরীর বাঁকিয়ে একবার তাকায়। তারপর বলে, লাভ হ্যাজ ইটস ওন। ল্যাঙ্গুয়েজ।
দীপনাথ মূক হয়ে থাকে। অনেকক্ষণ বাদে বলে, আপনি কী চান একটু খুলে বলবেন?
একটা দোকান। খুব সুন্দর জায়গায়, ভদ্র পরিবেশে চালু একটা দোকান। আপাতত আর কিছু নয়।
আপনার মাথায় দোকানটা কে ঢোকাল বলুন তো?
দ্যাট ইজ নান অফ ইয়োর বিজনেস।
দীপনাথ নীরবে আঘাতটা সহ্য করে শান্ত স্বরেই বলে, দোকান যদি একান্তই দিতে হয় তবে আমার অ্যাপ্রুভ্যাল ছাড়া তা হওয়ার নয়। আপনি তো তা জানেন।
জানি। তাই আমি বোস সাহেবের কাছ থেকে কিছুই আর প্রত্যাশা করি না। আই অ্যাম অ্যারেঞ্জিং এ ক্যাপিট্যাল ফ্রম এলহোয়ার।
আপনি ভুল করেছেন মণিদীপা। ব্যাবসা আপনার ধাতে নেই।
দ্যাট ইজ অলসো নান অব ইয়োর হেডেক। বোস সাহেব যে ছুকরিটির সঙ্গে ঘোরাফেরা করছেন এখন থেকে আপনি তাকেই অ্যাডভাইজ দিতে শুরু করুন না!
দীপনাথের সংশয়টা ছিলই। খুব অবাক হল না। বলল, ছুকরিটি আবার কে?
ন্যাকামি করবেন না দীপনাথবাবু। ইউ নো।
বোস সাহেব কোথায়?
এ সময়ে বাড়ি থাকেন না। এই বয়সে টিন-এজারকে হাত করতে হলে একটু বেশি লেবার দিতে হয়। হি ইজ ড়ুয়িং একজ্যাক্টলি দ্যাট। আপনি তো সবই জানেন। উনি হয়তো এটাও আপনার পরামর্শেই করছেন।
দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য দীপনাথ হঠাৎ উঠে মণিদীপার কাছে এসে এক ঝটকায় তার কাধ ফিরিয়ে মুখোমুখি দাঁড় করাল। বলল, আমি কিছু জানি না। এখন আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দিন।