2 of 2

৬১. কলেজের সোস্যাল ফাংশান

কলেজের সোস্যাল ফাংশান হবে আগামী শনিবার, আমরা ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক শাখা থেকে একটা গীতিআলেখ্য করব, তার রিহার্সাল চলছিল। কয়েক দিন আগে ইউনিয়নের। ইলেকশানে আমি ম্যাগাজিন এডিটর হবার জন্য দাঁড়িয়েও ভোটে হেরে গিয়ে একটু অপমানিত ও দুঃখিত হয়েছিলুম তারপর আবার এই গীতিআলেখ্যটা পরিচালনার ভার আমাকে দেওয়ায় আবার জীবনের স্বাদ ফিরে আসে।

গদ্য অংশটা মাইকে আমাকেই পড়তে হবে, তাই রিহার্সালের সময় আমি যতদূর সম্ভব গলাটা মোটা করার চেষ্টা করছি, এই সময় একজন এসে খবর দিল, আদিনাথদা আমাকে ডাকছে।

খবরটা দিয়ে ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, এক্ষুনি!

রিহার্সাল বন্ধ রেখে আমাকে উঠে যেতে হল। আদিনাথদা আমাদের কলেজের ছাত্র নন, কিন্তু কলেজের উলটো দিকের রতন কেবিনে তিনি প্রায়ই এসে বসেন। শুধু আমাদের কলেজ নয়, কলকাতার অনেক কলেজের কাছাকাছি চায়ের দোকানেই আদিনাথদাকে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি এলেই কলেজ ইউনিয়নের সদস্যরা তাকে ঘিরে গোল হয়ে বসে।

আদিনাথদা পাজামা ও গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে থাকেন, কাঁধে একটি ঝোলা। এই পোশাক ছাড়া আদিনাথদাকে আমি কখনও দেখিনি–মনে হয় এগুলো তিনি গা থেকে খোলেন না। মাথা-ভরতি ঘন চুল, গায়ের রং কালো, নাকটি খঙ্গের মতন উদ্যত–তার চেহারায় একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে–দেখলেই মনে হয় এ আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতন নয়। আদিনাথদা সব সময়েই গম্ভীর, হাস্য পরিহাস পছন্দ করেন না, সব। সময়েই কথাবার্তা এমন গুরুত্ব দিয়ে বলেন, যাতে মনে হয় এই পৃথিবীর ভালো-মন্দ দেখার গুরু দায়িত্ব তার ওপরেই ন্যস্ত।

আদিনাথদার হাতে একটা চুরুট, তার ডগায় এতখানি ছাই জমে আছে যে দেখলে অস্বস্তি হয়। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করলেন, এরপর তোর ক্লাস আছে?

আমি বললাম, ক্লাস শুরু হয়ে গেছে–আমি আজ আর যাচ্ছি না।

ভালো। কী করছিলি?

সোস্যাল ফাংশানে আমরা একটা…রিহার্সাল দিচ্ছিলাম।

গীতিআলেখ্য? কথাটা শুনলেই কী রকম ন্যাকা ন্যাকা মনে হয়। আজকাল খুব চলছে। যাই হোক, ওই গীতিআলেখ্যর থিমটা কী?

গ্রামের একটি চাষি পরিবারের জীবন, সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত।

কে লিখেছে?

কেউ ঠিক লেখেনি, মানে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তর গান–আর গদ্যটা আমিই–

রবীন্দ্রনাথের গান? রবীন্দ্রনাথ কোনও দিন গ্রামে গেছেন? চাষিদের জীবনযাত্রা দেখেছেন?

আদিনাথদার কথার উত্তরে আমি ঠিক যুক্তি খুঁজে পাই না–তবে, এমনিতে গান খুঁজতে গেলে ঠিকমতন গান পাওয়া এতই মুশকিল যে, রবীন্দ্রসংগীতের কথাই মনে পড়ে যায়। বৃষ্টির দৃশ্যে আমি ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে’ গানটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।

আদিনাথদা বললেন, যাকগে, রিহার্সাল দেবার আর দরকার নেই–সোস্যাল ফাংশান এবার হবে কিনা বলা যায় না।

আমি এবং আরও তিন-চার জন আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, সোস্যাল হবে না? কেন?

আদিনাথদা গম্ভীর ভাবে বললেন, দেশের যা অবস্থা, তাতে এখন কি নাচ-গান। হইহল্লা করার সময়? চালের দাম কত?

সেই মুহূর্তে চালের দামের জন্য চিন্তা করার বদলে সোস্যাল বন্ধ হবার আশঙ্কাতেই মনটা বেশ দমে গেল। আর একটি ছেলে জিজ্ঞেস করল, আদিদা, সোস্যালের জন্য ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে হল বুক করা হয়ে গেছে যে!

হোক। ওসব নিয়ে এখন চিন্তা করার দরকার নেই। পরশু দিন স্ট্রাইক কল করা হচ্ছে। সিনেট হলের সামনে থেকে র‍্যালি হবে। পুলিশ যদি সেকশন হান্ড্রেড ফরটি ফোর ্না তোলে তা হলে গোলমাল হতে পারে। তা হলে স্ট্রাইক কনটিনিউ করবে। এই অবস্থায় তোমরা সোস্যাল ফাংশানের কথা চিন্তা করছ কী করে সেটাই আশ্চর্য ব্যাপার। শোনো, আমাদের পার্টি লাইন এখন থেকেই ঠিক করা দরকার। স্ট্রাইক মানে শুধু মিছিল করে যাওয়াই নয়। এই প্রতিক্রিয়াশীল সরকার…

আদিনাথদা আমার দিকে ফিরে বললেন, বাদল, এখানে বোস। কালকের মিছিলের জন্য কয়েকটা নতুন স্লোগান তৈরি কর। আমি সাবজেক্ট বলে দিচ্ছি।

যে-কোনও কারণেই হোক, তখন পর্যন্ত সরকার বিরোধী স্লোগান অধিকাংশই ছিল হিন্দিতে বাংলা স্লোগান শাখাঁটি তখনও তেমন উন্নতি করেনি।

স্ট্রাইকের আগের দিন রাত্তিরে বাড়িই ফিরলাম না। মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না, অনেক বুঝিয়ে, অনেক মিথ্যে কথা বলে অনুমতি আদায় করলাম। পঙ্কজ এক রাত্তিরে আমাদের বাড়িতে ছিল, সুতরাং আমি পঙ্কজের বাড়িতে কি এক রাত্রি থাকতে পারি না? যদিও পঙ্কজরা তখন কলকাতায় নেই।

সারা রাত জেগে চলল আমাদের পোস্টার লেখা এবং দেওয়ালে সাঁটা। শীতের রাতে নিস্তব্ধ কলকাতা। রাস্তাঘাট খাঁ খাঁ করছে। এত রাতে কখনও এই শহরের দৃশ্য দেখিনি। যে-সব রাস্তা সারা দিন মানুষভরতি দেখি, এখন সেখানে একটাও লোক নেই–এটা কেমন অদ্ভুত লাগে। মনে হয় যেন একটা শুকনো নদী–একসময় উত্তাল জল ছিল। না, এ উপমাটা ঠিক নয়। কারণ রাত্রির রাজপথ বড় সুন্দর দু’পাশের আলোগুলো জ্বলছে, চকচক করছে কালো পিচ বাঁধানো রাস্তা বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। অনেক রাস্তাতেই এখনও গ্যাসের আলো আছে।

ভোর হবার পর আমরা আঠার বালতি ও কাগজপত্র এক জায়গায় জমা করে রেখে নিমতলার দিকে চলে এলাম। এখানে অনেক দোকানেই এর মধ্যে কচুরি ও জিলিপি। ভাজা হয়ে গেছে। গঙ্গাস্নান যাত্রীদের জন্য এ-পাড়ার দোকান সবচেয়ে আগে খোলে, সুজিত আমাদের এ-খবর দিয়েছিল। মাত্র ছ’ মাস আগে সুজিতের বাবা মারা গেছে সেই সময় শ্মশানে এসে সে এ-দিকে ভোররাতের দৃশ্য দেখেছিল। হরিধ্বনি দিয়ে একদল লোক একটা মড়া নিয়ে যাবার সময় আমাদের মধ্যে একমাত্র সুজিতই সেদিকে তাকিয়ে প্রণাম করে।

মা বলেছিলেন, সকাল হতেই বাড়ি ফিরে যেতে। তবু ফেরা হল না। বন্ধুরা সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া শুরু করলে সেই আড্ডা প্রথম ভেঙে দেবার দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না। একজন বাড়ি ফেরার নাম করলেই, আর সকলে তখন বাড়ি ফিরবে, সেই জন্য কেউই বাড়ি ফেরার কথা উচ্চারণ করল না। কচুরির দোকানের ঠিক উনুনের পাশটাতেই বেঞ্চি টেনে গুটিশুটি মেরে বসে গল্প করতে করতে আর সময় জ্ঞান থাকে না। মাঝে মাঝে চা আসে।

একসময় হঠাৎ দেখি ন’টা বাজে। তা হলে তো আর বাড়ি ফেরার প্রশ্ন আসে না। দশটা থেকেই কলেজের গেটে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ফরোয়ার্ড ব্লকের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ব্লক তখন আমাদের স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সঙ্গে খুব প্রতিযোগিতা করার চেষ্টা করছে। ওদের ছেলেদের কিছুতেই লিড নিতে দেওয়া হবে না।

সুতরাং মিছিলটিছিল সেরে বিকেল বা সন্ধ্যাবেলার সময় বাড়ি ফেরা যেতে পারে। মা ভীষণ চিন্তা করবেন। দুপুরে না খেতে গেলে মা নিজেও দুপুরে খাবেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু বন্ধুদের কি এই কথা বলা যায়? ওরা নিশ্চয়ই আমাকে মায়ের আদুরে ছেলে বলে ঠাট্টা করবে। বিষ্ণুকে যেমন অনেকেই বলে। এক ছেলে হবার এই ঝামেলা! দিদির বিয়ে হয়ে গেছে–মা সেই জন্যই সব সময় আমার ব্যাপারে পুতুপুতু করেন। যাই হোক, কী আর করা যাবে! পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মাকে মাঝে মাঝে এ রকম কষ্ট দেওয়া যায়। যতই আমার ওপর রাগ করুন, আমি একসময় বাড়ি ফিরে গেলেই মা খুশি। সারাদিন দুশ্চিন্তার পরও তখন আর বকুনিতে জোর থাকে না।

যদি আর না ফিরি? কেন হঠাৎ এই কথাটা আমার মনে এল, জানি না। তবু বার বার মনে হতে লাগল, যদি আমি আর কোনও দিনই বাড়ি না ফিরি, তা হলে আজ আমার বাড়ির অবস্থা, আমার মায়ের অবস্থা কী হবে?

যদি আর না ফিরি, তা হলে রেণুর সঙ্গেও আর দেখা হবে না। আমার পকেটেই রয়েছে রেণুর একটা চিঠি। রেণু বেশির ভাগ চিঠি লেখে রাত্তিরবেলায়। এ-চিঠিতে ও লিখেছে, ‘তুমি এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে? একবার চোখ চাইলেই দেখতে পাবে আমি তোমার পাশেই আছি।’…আমি মরে গেলেও কি রেণু আমার কথা ভাববে?

সেই সময় কিন্তু আমরা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি যে সেদিনকার স্টুডেন্টস র‍্যালিতে কোনও গোলমাল হবে। আদিনাথদা বোধহয় জানতেন একথা, কিন্তু আমরা জানতাম না।

বিভিন্ন কলেজ থেকে ছাত্ররা এসে জমায়েত হয়েছে সিনেট হলের সামনে–একদল পুলিশ গোলদিঘির এক কোণে ব্যারিকেড করে দাঁড়িয়ে আছে। একশো চুয়াল্লিশ ধারা। জারি করা হয়েছে, আমাদের আর এগোতে দেওয়া হবে না। কয়েক জন ছাত্রনেতা কথা বলছে পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে। আমরা মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছি, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মাত্, ভুলো মাত্! ছাত্র সমাজ দিচ্ছে ডাক, কায়েমি স্বার্থ নিপাত যাক!

কে প্রথম ইট ছুড়ল, আমি লক্ষই করিনি। হঠাৎ দেখলাম, দারুণ ইট ছোঁড়া শুরু হয়ে গেছে। ইটের সঙ্গে অনেকের চটিজুতোও। পুলিশ লাঠি চার্জ করল। আমরা একটু পেছনে ছিলাম, হুড়োহুড়ি শুরু হতে দেখে মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল–প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে রাস্তা সারাই হচ্ছিল–সেখানকার খোয়া তুলে নিয়ে মারতে লাগলাম পুলিশের দিকে। ফট ফট করে আওয়াজ হতে লাগল টিয়ার গ্যাস সেলের–আমি তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কে একজন আমার হাত ধরে বলল, এই, ইডিয়েট, দৌড়ো–

তাকিয়ে দেখি জীমূত। জীমূতের সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি, এর মধ্যে ও একমুখ দাড়ি রেখেছে। ততক্ষণে আমার সাঙ্ঘাতিক চোখ জ্বালা করতে শুরু হয়েছে–চোখ খুলে তাকাতেই পারছি না–জীমূত আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। রাস্তার চাপাল থেকে রুমাল ভিজিয়ে এনে আমার চোখে চেপে ধরল।

সারা রাত রাত্রি-জাগরণের ক্লান্তি, তারপর চোখে টিয়ার গ্যাসের ঝাঁপটা একটু বেশি লেগেছে, মনে হল, আমি অন্ধ হয়ে গেছি। জীমূতের হাত জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল ভাবে। বললাম, আমার চোখ, আমার চোখ!

জীমূত ফের রুমাল ভিজিয়ে এনে বলল, ভালো করে চেপে ধরে থাক, একটু জ্বালা করবে, আর কিছু ভয় নেই–

তখন ছাত্র-পুলিশে খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেছে। গোলদিঘির এ-পাশে আর পুলিশ এগোতে পারছে না। পুলিশকে এক জায়গায় আটকাতে পারাটাই ছাত্রদের কাছে বিরাট জয়ের ব্যাপার মনে হচ্ছে দলে দলে ছেলে ছুটে যাচ্ছে সেদিকে।

আমার চোখটা একটু ভালো হবার পর জীমূত বলল, বাড়ি যাবি? আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে রাস্তা ফাঁকা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর তুই?

আমার কিছু ঠিক নেই। তুই এখানে থাকবি? আরও গোলমাল বাড়বে মনে হচ্ছে। এখন বাড়ি চলে গেলে সেফ সাইডে থাকা যাবে।

তুইও বাড়ি চল তা হলে।

তুই যদি থাকিস, আমিও তা হলে থাকতে পারি।

সিদ্ধান্ত নিতে আমার এক মুহূর্তও দেরি হল না। তখন সেখানে যুদ্ধক্ষেত্রের মতন উত্তেজনা। এ ছেড়ে জীমূত যদি না যেতে চায়, আমি একা যাব?

বললাম, চল, সামনে এগিয়ে দেখি।

একদল ছেলে ইট ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুলিশ বাহিনীকে তাড়িয়ে প্রায় মেডিক্যাল কলেজের গেটের কাছে নিয়ে গেছে। জীমূত আর আমি রণ-উন্মাদনায় তাদের সঙ্গে যোগ দিতে গেলাম।

বেশি দূর এগোনো গেল না। কয়েকটা ট্রাম অনেকক্ষণ থেকেই থেমে ছিল, ইট ছোঁড়ার সময় আমরা ট্রামের আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছিলাম–হঠাৎ একটা ট্রাম থেকে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। তারপরই জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে আগুন। স্বাধীনতার পর কলকাতার রাস্তায় সেই প্রথম ট্রাম পুড়ল।

বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই দেখলাম, আমাদের চতুর্দিকেই পুলিশ। উলটো দিক থেকেও যে পুলিশের গাড়ি আসতে পারে, এটা আমরা কেন ভাবিনি, কে জানে!

জীমূত বলল, ক্যান্টিনের দিকে চল–

সঙ্গে সঙ্গে দু’জনে দৌড়োলাম। কলুটোলার কাছে একদল ছাত্র দু’দিকের পুলিশের মাঝখানে একেবারে ফাঁদে পড়ে গেছে–আমরা সিনেট হলের সিঁড়ির নীচে ডান পাশ। দিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যাবার চেষ্টা করলাম–কারণ, এইটুকু জানি, পুলিশ ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢুকবে না।

ক্যান্টিনের দিকে যাবার জন্য লোহার লাল গেটটা কে যেন বন্ধ করে দিয়েছে। এ-সময় কোনও দিন তো এই গেট বন্ধ থাকে না। আমরা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে চিৎকার করতে লাগলাম, এই খুলে দাও, শিগগির খুলে দাও–

এমন সময় দড়াম করে একটা শব্দ হল। আমি ভেবেছিলাম, লোহার গেটটা উলটো দিক থেকে কেউ খুলছে বুঝি, সেই শব্দ। তারপরই দেখি, লোহার গেটে একটা গোল গর্ত–আমার থেকে বিঘত খানেক দূরে।

জীমূত আছড়ে মাটিতে পড়ে আমার পা ধরে টেনে বলল, শুয়ে পড়! শুয়ে পড়!. ফায়ার করছে!

আমিও নীচে শুয়ে পড়লাম সঙ্গে সঙ্গে। আরও কয়েকটা গুলির শব্দ।

জীমূত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শালারা এলোমেলো ফায়ার করছে।

আমি আস্তে আস্তে ওপর দিকে তাকালাম। কোনও সন্দেহ নেই, একটা গুলি ওই লোহার দরজা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। আমার এত কাছ দিয়ে! মৃত্যু এত কাছে এসেছিল? মনে পড়ল সকালবেলার চিন্তাটা। যদি আর বাড়ি না ফিরি? গুলিটা আর মাত্র এক বিঘত ডান দিক দিয়ে এলে আমার আর কোনও দিন বাড়ি ফেরা হত না।

জীমূত ফিসফিস করে বলল, পড়ে যাবার সময় আমার হাঁটুতে দারুণ জোর লেগেছে, দৌড়োতে পারব কিনা সন্দেহ।

আমি বিবর্ণ মুখে বললাম, সত্যি গুলি ছুড়ছে?

তুই কি ভেবেছিলি, স্বদেশি পুলিশ বলে বন্দুকে গুলির বদলে লজেণ্ডুস ভরে ছুড়বে?

আমি আর কোনও কথা বলতে পারলাম না। আমার শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে। এত ভয় আমি জীবনে কখনও পাইনি। মৃত্যুর এত কাছাকাছি এসে আমি সাহসের সঙ্গে দাঁড়াতে পারি না। এ ভাবে কেন মরব? আমি কি শুধু একটা সংখ্যা?

মাটিতে পড়ার সময় আমার বুকপকেট থেকে অনেক কাগজপত্রও পড়ে গেছে। তার মধ্যে রয়েছে রেণুর চিঠিটা। খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আমি কাগজপত্রগুলো তুলে নিই।

আমি কোনক্রমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও জীমূত ধরা পড়ে যায়। সব সুষ্ঠু একশো চুয়ান্ন-জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, এ ছাড়া দু’জন নিহত ও। এগারোজন আহত। পরের দিন আবার ধর্মঘট ডাকা হল, আবার গোলমাল। এই রকম। ভাবে চলল পাঁচ দিন। ততদিনে আমরা জেনে গেছি, আদিনাথদা প্রমুখ ছাত্রনেতাদের এ রকমই পরিকল্পনা ছিল। ধর্মঘট ডেকে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে জনজীবনকে স্তব্ধ করে দিতে হবে। পুলিশ যদি অত্যাচার চালায়–সেটাও এক হিসেবে লাভ–তা হলে জনসাধারণের মন এই প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে বিষিয়ে উঠবে, এই সরকারের পতন ঘটাতে তা হলে আর দেরি হবেনা-ও-দিকে গ্রামে গ্রামেও মুক্তাঞ্চল তৈরি করার প্রস্তুতি চলছে। আমরাও এই নীতিকে সঙ্গত মনে করেছিলুম।

পাঁচ-দিন পর যখন মনে হল সাময়িক ভাবে আমাদেরই জয় হয়েছে, সংবাদপত্রগুলি সরকারের সমালোচনায় মুখর, রাস্তার লোকেরাও বিরক্তি প্রকাশ করছে, তখন আপাতত আমরা বিরতি ঘোষণা করলাম। চাপে পড়ে সরকার ছাত্র বন্দিদের মুক্তি দিল, আমাদের পক্ষ থেকে তুলে নেওয়া হল ধর্মঘট। নিহতের সংখ্যা শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল তিন জন।

যারা মারা গেছে, তাদের কারোকেই আমি চিনি না। কিন্তু যখনই মনে পড়ে যে আমিও ওদের একজন হতে পারতাম, তখনই আমার শরীরে একটা শিহরন খেলে যায়। রোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে। মাথায় গুলি লাগা অবস্থায় আমি পড়ে থাকতাম ক্যান্টিনের গেটের সামনে পুলিশের গাড়ি আমার শরীরটা হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যেত, তারপর কাটাকুটি করে পাঠিয়ে দিত মর্গের বরফঘরে। একসময় মুখ থেকে চাঁদরের ঢাকা সরিয়ে দেখে মা কিংবা বাবা বলতেন, হ্যাঁ, এরই নাম ছিল বাদল।

মৃত্যু সম্পর্কে আমার মধ্যে একটা রোমান্টিক মোহ আছে, কিন্তু এর সঙ্গে তার কিছুই মেলে না। কেন এই মৃত্যু? কবে দেশের অবস্থা বদলাবে কি বদলাবে না, তার জন্য আমি গুলি খেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকব? জন্মেছি যখন, তখন এত সহজে এ-পৃথিবী ছাড়ব না। লেনিন যদি উনিশশো পাঁচ সালের প্রথম বিপ্লবে গুলি খেয়ে মরে যেতেন, তা হলে তার নামও কি আমরা কেউ মনে রাখতাম এখন!

মাঝে মাঝে আত্মহত্যার চিন্তা এখনও আমার মাথায় ঘোরে। কিন্তু সেই মৃত্যু যেন একটা শিল্পের মতন। মৃত্যু যেন একটি নারী, যেমন রেণু, তার কাছে আমি চিরকালের মতন আশ্রয় পেতে চাই, যাতে আমাকে আর কেউ বিরক্ত না করে। রেণুকেও যা বলতে পারি না, মৃত্যুকে তাই বলব, তুমি আমাকে নাও। সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে।

আসলে এসব কল্পনাবিলাস। আমি একটি কাপুরুষ ছাড়া কিছুই নয়। যখনই মৃত্যুর খুব কাছাকাছি যাই, অমনি দারুণ ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসি। তবু মনে মনে ঠিক করে ফেললুম আমি এ রকম কাপুরুষই থাকব-অকারণে পুলিশের গুলি খেয়ে মরা ঠিক কাজের কথা নয়। আরও ঠিক করে ফেললুম, রাজনীতি করতে গেলে আমাকে খুব শিগগির শিগগির নেতা হয়ে উঠতে হবে। নেতারা চট করে মরে না। জেলটেল খাটা যেতে পারে, কিন্তু গোলমালের সময় সাধারণ ছেলেদের খেপিয়ে পাঠাতে হবে সামনের দিকে। চিরকালই এ রকম কিছু সাধারণ ছেলে মরে–কিন্তু আমি এদের থেকে আলাদা। সূর্যদাকে দেখলুম তোকত কষ্ট সহ্য করেছে, কতবার লাইফ রিস্ক করেছে–অথচ এখন তাকে কেউ চেনেই না। নেতা হতে পারেনি কিনা। ওদিকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের এক বিখ্যাত নেতা এখন র‍্যাশনিং ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ হয়ে ঘুষের টাকায় লাল হচ্ছেন–তবু কেউ তাঁকে কিছু বলছে না, কারণ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যে!

কলেজের সোস্যাল ফাংশান বন্ধ হয়ে গেল, তার বদলে এই আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে এবং বন্দি-মুক্তি উপলক্ষে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে একটা সভা হল। সেই সভায় আদিনাথদার অনুরোধে আমি একটি ছোট্ট বক্তৃতা দিলাম। আমার পা ঠকঠক করে কাঁপছিল এবং সামনের সারির কমরেডদের চোখের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না তবু কোনও রকমে উতরে গেলাম প্রথম পরীক্ষায়।

আমাদের কলেজের পাঁচ জন ছাত্র ধরা পড়েছিল, তারা কলেজে এসে এমন রোমহর্ষক গল্প বলতে লাগল যে রীতিমতন হিংসেই হতে লাগল আমাদের। পুলিশের। মারটার না খেয়ে শুধু একবার জেলটা ঘুরে আসতে পারলে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হতে। পারত।

কয়েক দিন ধরেই এইসব গল্প এবং আলোচনা চলছিল, ক্লাস করার দিকে একটুও মন নেই, বইখাতা নিয়ে সোজা নরেন কেবিনে এসে উপস্থিত হই। ক্লাসে প্রক্সি দেবার ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে। এর মধ্যে নির্মল একদিন এসে আড্ডার সুর কেটে দিল। নির্মলের ডান হাতখানা প্লাস্টার করা, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি।

আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কীরে, তোর হাত ভাঙল কী করে?

নির্মল গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল, আমি সাত দিন হাসপাতালে পড়েছিলাম, তোরা কেউ একবার দেখতেও গেলি না।

আদিনাথদা সেদিন হাজির ছিলেন নরেন কেবিনে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় হাত ভাঙল? পাড়ায়?

নির্মল হঠাৎ খিঁচিয়ে উঠল আদিনাথদার মুখের ওপর। আদিনাথদার সঙ্গে এই ভাবে কথা বলার কথা আমরা কেউ কল্পনাই করতে পারি না। তা ছাড়া নির্মল বলতে গেলে

আদিনাথদার ঘনিষ্ঠতম শিষ্য।

নির্মল বলল, কোথায় ভেঙেছে আপনি জানেন না? ধর্মঘটের প্রথম দিন আমি আপনার পাশে ছিলাম না?

আদিনাথদা মৃদু গলায় বললেন, তা ছিলে। কিন্তু শেষের দিকে তোমাকে দেখতে পাইনি।

দেখবেন কী করে? আমি তো দেখলাম, পুলিশ ঘিরে লাঠি তুলতে-না-তুলতেই আপনি খেচে রড দিলেন। পেছন ফিরে আর একবারও তাকিয়ে ছিলেন?

সবাই অপ্রস্তুত অবস্থায় চুপ করে গেল। আদিনাথদার নামে এ রকম অভিযোগ দেওয়ায় কে কী বলবে ভেবে পেল না। আমি নিজেও সেদিন পালিয়ে ছিলাম বলে মনে মনে আদিনাথদাকেই সমর্থন করলাম। খামোকা পুলিশের লাঠির নীচে পড়ে পড়ে মার খাবার দরকারটা কী? যারা বোকা, তারাই মার খায়।

আদিনাথদা ঠান্ডা চোখে নির্মলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার হাতে কি ফ্র্যাকচার হয়েছে?

নির্মল সে-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফের চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমাদের তাতিয়ে সামনে ঠেলে দিয়ে আপনারা সবাই কেটে পড়লেন, আঁ? গৌতমদাদের তো তবু অ্যারেস্টেড হতে দেখলুম–আপনাকে তো কোনও দিন পুলিশের ধারে কাছেও যেতে দেখিনি।

আদিনাথদা বললেন, নির্মল চুপ করো। এসব কথা এখানে আলোচনা করা চলে না। শুধু এইটুকু বলে রাখছি, আমাকে শিগগিরই আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হবে, তাই আমি ধরা দিইনি।

নির্মল তবু চিৎকার করে বলল, ও তো গত এক বছর ধরে শুনছি! কিন্তু আমার যে হাত ভাঙল, আবার পুলিশের খাতায় নামও উঠে গেল, তার কী হবে?

নির্মল সকলের দিকে ফিরে বলল, জানিস মাইরি, আমার বাবা হাউহাউ করে কাঁদছেন! বাবার অফিসে আমার চাকরি পাবার কথা ছিল–আর আমাকে কেউ চাকরি দেবে?

কমিউনিস্ট হিসেবে একবার কেউ মার্কামারা হয়ে গেলে পুলিশ রিপোর্টে তখন কারওর চাকরি হয় না। চাকরি পেলেও চলে যায়। কিন্তু নির্মল কলেজ থেকে বেরোবার আগেই চাকরি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে বলে ওর সম্পর্কে আমাদের একটু করুণা হল। যদিও শুনেছি, নির্মলের বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ, ওর বাবা শিগগিরই রিটায়ার করবেন, তবু চাকরির মতন একটা সামান্য ব্যাপারের জন্য ভয় পেয়ে নির্মল আজ এখানে এসে এ রকম চঁচামেচি করছে–এটা আমাদের মোটেই পছন্দ হয় না।

যত সময় যাচ্ছে, ততই নির্মল বেশি মাথা গরম করছে। রাগলে ও যে এত মুখোরাপ করে, আমরা জানতাম না। নির্মল কিছু না বললে ওর নির্যাতনের জন্য আমরা ওকে সহানুভূতি জানাতাম–তার বদলে ও সকলের বিরক্তি আকর্ষণ করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত নির্মল যখন শালা, হারামির বাচ্চা ইত্যাদি শুরু করল, তখন আদিনাথদা উঠে, পড়লেন। আমাদের কয়েক জনকে বলে গেলেন, ওর মাথা ঠান্ডা হলে আমার সঙ্গে পার্টি অফিসে দেখা করতে বোলো।

আদিনাথদা চলে যাবার পর বীরেশ্বর ও আর কয়েকটি ছেলে নির্মলের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, এই একটু বাইরে চল, কথা আছে। এখানে চঁচামেচি করে লাভ কী?

আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা গলির মধ্যে ডেকে নির্মলকে একটা দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে দাঁড় করিয়ে বীরেশ্বর জিজ্ঞেস করল, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুই আদিনাথদাকে চ্যালেঞ্জ করছিস?

নির্মল বলল, কেন, আদিনাথদা কোন লাটের বাঁট যে তাকে কিছু বলা যাবে না? আমি মাটিতে পড়ে গেলুম, তা দেখেও পালাল–

বীরেশ্বর প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল নির্মলের মুখে। ভাঙা হাতখানা উঁচু করেই নির্মল আটকাতে গেল, পারল না, রক্ত গড়িয়ে এল ওর কষ বেয়ে। আর একখানা ঘুষি খেয়ে নির্মল মুখ নিচু করল। তারপরই আবার লাল টকটকে চোখ তুলে বলল, তোদের আমি দেখে নেব!

ঠিক আছে, দেখে নিস!

এর পরের মাস থেকেই নির্মল একটা আলাদা পার্টি খুলে ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে কংগ্রেসের দালাল হয়ে পড়াশুনোই ছেড়ে দিল নির্মল, আমরা ওকে দেখলেই এড়িয়ে যাই।

.

আমার ছাত্র রূপ একদিন আমাকে বলল, মাস’সাই, আজ কিন্তু পড়ানো হয়ে গেলেই চলে যাবেন না। ছোটমা আপনাকে বসতে বলেছেন।

কেন?

ছোটমা আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।

সেই কথা শুনে প্রথম থেকেই এমন উত্তেজনা বোধ করতে লাগলুম যে পড়ানোতে আর মন বসাতেই পারি না। ঘন ঘন ঘড়ি দেখি। আজ কি একটু তাড়াতাড়ি পড়ানো শেষ করলে খারাপ দেখাবে? এ বাড়িতে সময়ের কড়াকড়ি কিছুই নেই। অনেকদিন আমার ব্যস্ততা থাকলে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট পড়িয়েও চলে যাই। তবু আজ আমি কিছুতেই নিজের মুখে বলতে পারলাম না, এবার পড়া শেষ।

একসময় দরজার পাশ থেকে এক মহিলা বললেন, আসতে পারি?

আমি এমন শশব্যস্ত হয়ে উঠলাম যে টেবিল থেকে একটা বই ও কলম পড়ে গেল, তক্ষুনি সে-দুটো তুলব না উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করব বুঝতে না পেরে একটা হাস্যকর না যযৌ ন তস্থে অবস্থায় রইলাম।

রূপের ছোটমা বললেন, আপনি বসুন।

তিনি নিজেও বসলেন একটি চেয়ারে, হাত দিয়ে কোলের কাছের শাড়ি প্লেন করলেন, তারপর হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।

এ বাড়ির কোনও মহিলাকে আমি এত কাছাকাছি থেকে আগে দেখিনি। শুনেছি, এখানে এখনও পরদা-প্রথা মানা হয়, মেয়েরা বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলেন না। সেই জন্যই আমি অত্যন্ত বেশি সংকুচিত হয়ে রইলাম। মহিলা কিন্তু অত্যন্ত সাবলীল, এমনকী কলেজের মেয়েরাও নতুন কারওর সঙ্গে আলাপের সময় যেটুকু জড়তা প্রকাশ করে–এঁর মধ্যে তার চিহ্নমাত্র নেই। ধনী পরিবারের বধূদের সাজগোজের আতিশয্য সম্বন্ধেও আমার মনে মনে একটা ধারণা ছিল কিন্তু এঁর সঙ্গে তার কিছুই মেলে না। ইনি পরে আছেন একটি লাল পাড় সাদা শাড়ি, হাতে দু’গাছা চুড়ি, বাঁ হাতের অনামিকায়। একটি আংটি, গলা ও কান খালি। মাথার চুল ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপরে। সব মিলিয়ে কী সুন্দর রে বাবা! দম আটকিয়ে আসে যেন। গায়ের চামড়া মোমের মতন নরম ও মসৃণ, টলটলে চোখদুটির দৃষ্টি কী আশ্চর্য কোমল।

মনে মনে আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে আছি অপলক, আসলে আমি সৌজন্যবশত ঈষৎ মুখ নিচু করে রয়েছি। একবার মাত্র দেখলেই এ রকম মুখ আমার মনের চিত্রশালায় সংগৃহীত হয়ে যায় তখন আমি না তাকিয়েও দেখতে পারি। আমার ভেতরটা বড় বেশি রূপের জন্য কাঙাল। হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায়, আমার জামার একটা বোতাম নেই। সারা দিন চটি পরে ঘোরার জন্য আমার পা দুটো ধুলোময়, আমি এত সৌন্দর্যের কাছাকাছি বসে থাকার অযোগ্য। কেন মুখের ঘামটুকু অন্তত একটু আগে মুছে নিইনি? এখন কি মোছা যায়?

আমি নিজে থেকে কোনও কথা বলতে পারলাম না। উনি নিজেই বললেন, আপনাদের ব্যাঘাত সৃষ্টি করলাম না তো?

আমি বললাম, না, না—

আমার ছাত্র বলল, আমাদের পড়া হয়ে গেছে। ছোটমা, আমি যাই?

উনি বললেন, যাও। চন্দনের মাকে বলে দিয়ো, ঠিক সাড়ে আটটায় দাদাবাবুর ওষুধ। দিতে হবে।

তারপর উনি আমার দিকে হাসিমুখে আবার চেয়ে রইলেন। পূর্ণ চোখ মেলে বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।

কিন্তু আলাপ তো এক তরফা হয় না। রাজ্যের লজ্জা এসে আমার জিভের ডগায় ভর করেছে। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মিটিংয়ের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বলতেও আমি এত নার্ভাস হইনি। তা ছাড়া কী কথা বলব, আমি তো ওঁর সম্পর্কে কিছুই জানি না।

উনি বললেন, আমি কখনও কোনও কবিকে দেখিনি। খুব ছেলেবেলায় একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম, তখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথাও বলেছিলাম–কিন্তু আমার ভালো করে সেসব কথা মনে পড়ে না। বিয়ের পর অনেক দিন লক্ষ্ণৌতে ছিলাম তো। তারপর এই সে-দিন যখন শুনলাম, খোকার মাস্টারমশাই একজন কবি

আমি মরমে মরে গিয়ে বললাম, না, না, আমি বিশেষ কিছুই লিখিনি, এই সামান্য দু’-একটা—

আমি কবিতা লিখি বটে, কিন্তু আমি কি কবি! কবি বলতে যাদের বোঝায়–যেসব উচ্চ আদর্শের মানুষ ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ–তাঁরা কোথায় আর আমি কোথায়?

আমি আপনার দুটো কবিতা পড়েছি। আপনার কোনও বই আছে?

না।

আচ্ছা, আপনি যে লিখেছেন, ‘মুক্তিপিপাসু এক অরণ্য’ এর ঠিক মানেটা কী?

অতিরিক্ত লজ্জা হঠাৎ আমার সব লজ্জা কাটিয়ে দেয়। অসহায়তার শেষ সীমায় এসে মানুষ যেমন আচমকা সাহসী হয়ে ওঠে। আমি মুখ তুলে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম, দেখুন, নিজের কবিতা বিষয়ে কোনও কথা বলতে আমার খুব লজ্জা করে। তা। ছাড়া আমি জানি, আমি এখনও কিছুই লিখতে পারিনি।

খোকার মতন আপনি আমাকেও পড়াবেন? আমি শুধু কবিতা পড়ব।

আমি?

হ্যাঁ। ধরুন, সপ্তাহে তিন দিন। আমি বাংলা ভালো করে কখনও পড়িনি।

আমি কি আপনাকে পড়াতে পারব?

কেন, আপনার সময় নেই? আপনি আমাকে কবিতা পড়ে পড়ে শোনাবেন, তাই নিয়ে আলোচনা করবেন সারা দিন আমার তো কোনও কাজ নেই। দেখুন না, এত বড় বাড়ি, সব সময় নিঝুম হয়ে থাকে–আমি কী যে করব এত সময় নিয়ে আমি কবিতা পড়তে খুব ভালোবাসি, কিন্তু নিজে নিজে সব তো বুঝি না।

আপনি তো ফরাসি ভাষা জানেন?

সেও খুব সামান্য। চর্চা নেই তো–

আপনি যদি চান, আমি আপনাকে পড়াবার জন্য একজন খুব ভালো লোক ঠিক করে দিতে পারি। আমাদেরই কলেজের একজন প্রফেসার–

উনি মুচকি হেসে বললেন, কেন আপনার বুঝি আমাকে পছন্দ হচ্ছে না? ছাত্রী হিসেবে আমি বুঝি–

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, না, না, সে কথা নয়। আমি আমার অযোগ্যতার কথা ভেবে বলছিলাম!

আমি তো পরীক্ষা পাস করার মাস্টারমশাই চাইনি। এ বাড়ির মেয়েরা বা বউরা অনেকে ওস্তাদজির কাছে গান বা বাজনা শেখে। মাস্টারমশাই রেখে পড়াশুনো করার রেওয়াজ নেই। কিন্তু আমার তো গানের গলা নেই–

আমি বললাম, আপনার গলার আওয়াজ ভারী সুন্দর।

সুন্দর কথাটা উচ্চারণ করতে পেরে আমার বুকটা অনেক হালকা হয়ে গেল। অনেকক্ষণ থেকেই আমার বুকের মধ্যে এই শব্দটা বেরিয়ে আসার জন্য আকুলিবিকুলি করছিল। আসলে আমি বলতে চাইছিলাম, আপনার সবকিছুই সুন্দর।

সহজাত আভিজাত্যে উনি এই প্রশংসাবাক্যের কোনও প্রতিবাদ করলেন না। একটুক্ষণ সময় নিয়ে তারপর বললেন, আপনি আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি, আমার নাম সুদেষ্ণা। আমি বোধহয় আপনার সমবয়সিই হব। সারাদিন কথা বলার মতনও কারোকে পাই না। আপনি আমাকে পড়াতে চান না?

আপনি যদি বলেন–

আজ নিশ্চয়ই আপনার অনেক দেরি করিয়ে দিলাম। কাল আবার আপনার সঙ্গে কথা বলব? আপনি বিরক্ত হননি তো?

না, না, কী আশ্চর্য!

এই ঘটনাটা বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করলাম, তার একমাত্র কারণ, এটা একটা মরীচিৎকার মতন। সব মানুষের জীবনেই নিশ্চয়ই এ রকম দু-একটা দুর্বোধ্য মরীচিকা আসে। এতে জীবনের পরিচিত নিয়মগুলো উলটেপালটে যায়।

তার পরের দিন তো দূরের কথা, ওই বাড়িতে আমি আরও ছ’সাত মাস পড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু আমার ছাত্রের ছোটমা, ওই সুদেষ্ণা দেবীর সঙ্গে আমার আর কোনও দিন কথা হয়নি। উনি আর নেমে আসেননি নীচে, একটা খবরও পাঠাননি। এমন হতেই তো পারে যে অল্পবয়স্ক মাস্টারের কাছে ওঁর পড়াশুনো করার প্রস্তাবটা বাড়ির কারওর মনঃপূত হয়নি। কিন্তু আমাকে একটা খবর দেওয়া কি উচিত ছিল না? তাতে অসুবিধে ছিল? অবশ্য, এর পরে বাড়ির কারওর ব্যবহার আমার প্রতি একটুও পালটায়নি। মাঝে মাঝে আমি আমার ছাত্রের দিকে উৎসুক ভাবে তাকিয়ে থাকতাম, যদি সে কিছু বলে। বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি।

সুদেষ্ণা দেবীকে আর একদিন মাত্র দূর থেকে দেখেছিলাম বাগানে। আরও কয়েক জন মহিলা ছিলেন সেখানে। স্পষ্ট মনে হল, আমাকে দেখেই যেন উনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন–চলে গেলেন মর্মর মূর্তির আড়ালে।

আমি সেদিন অত্যন্ত আহত ও অপমানিত বোধ করেছিলাম। এ রকম ব্যবহারের মানে কী! একবার আমাকে স্বর্গে তুলে আবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া। আমার মনে হল, পৃথিবীর যেখানে যা সৌন্দর্য, সবকিছুরই সৃষ্টি হয়েছে শুধু আমাকে কষ্ট দেবার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *