এতগুলি স্বাস্থ্যবান, কলেজে-পড়া শিক্ষিত যুবক এক মুমূর্ষু বৃদ্ধকে ঘিরে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে মাসের পর মাস পড়ে থাকছে কেন? অনেকেরই বাবা-মায়ের প্রবল আপত্তি, তবু এদের বাড়িতে মন টেকে না, এখানে ছুটে আসে কিসের টানে? এদের কয়েকজন প্রেসিডেন্সি, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়েছে, সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে মুক্ত চিন্তার অধিকারী হয়েছে। এই যুবা বয়েস পৃথিবীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে অবলোকনের বয়েস, বাসনা-পুষ্প বিকশিত হয় সহস্ৰ পাপড়িতে, রূপ ও সৌন্দৰ্য উপভোগেরও এই তো বয়েস।যৌবনে মানায় বিদ্রোহ, যৌবনে মানায় নিজস্ব পথ খোঁজার তেজ। আর এই যুবাবৃন্দ ব্যাকুল হয়েছে ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য। ধর্মীয় সাধনায় সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগের জন্য এরা উদ্যত। বয়সোচিত সমস্ত প্রবৃত্তি এই চেষ্টা কি স্বাভাবিক? ঈশ্বর তো বহু হাজার বছরের প্রাচীন, তাঁর স্বরূপ বোঝার চেষ্টাও তো চলে আসছে বহু যুগ ধরে। নরেন-রাখাল-নিরঞ্জন-শশী-যোগীনের মতন তরুণেরা সে পথে যাবার জন্য ঘর ছাড়া হল কেন?
রাম দত্ত, সুরেন মিত্তির বুড়ো গোপাল ঘোষ, বলরাম বাস, মহেন্দ্র গুপ্ত, গিরিশ ঘোষের মতন বয়স্ক, সংসারী ভক্তরা কোন টানে আসে তা বোঝা যায়। এঁরা বিষয়ী লোক, অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসে পৌঁছেছেন জীবনের মধ্যাহ্নে, কেউ ভোগ-বিলাসে মত্ত থেকেও মাঝে মাঝে বিবেকদংশন অনুভব করেন, কেউ বা নিছক সাংসারিক পরিপূর্ণতাতে সন্তুষ্ট না হয়ে এখন পরমার্থ খুঁজছেন, কেউ বা কিছু কিছু পাপ থেকে মুক্ত হবার জন্য একজন গুরুকে অবলম্বন করতে চান। রাম দত্ত ডাক্তার, সুরেন মিত্তির সাহেব কোম্পানির বড় চাকুরে, বলরাম বোস জমিদার। গিরিশ ঘোষের মতন সুরেন মিত্তিরও মদ্যপ এবং প্রায়ই রাত অতিবাহিত করন বেশ্যালয়ে। এই উদ্ধত স্বভাবের মানুষটি বন্ধু রাম দত্তের সঙ্গে প্রথমবার দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ সন্দর্শনে যাবার আগে বলেছিলেন, গিয়ে যদি দেখি মানুষটা ভণ্ড, তা হলে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনব।
রামকৃষ্ণের বিচিত্র ব্যক্তিত্ব এবং মধুর স্বভাবে এঁরা একে একে মুগ্ধ ও পরম ভক্ত হয়েছেন। এঁরা গুরু খোঁজার জন্য ব্যাকুল ছিলেন, পেয়েছেন এক আদর্শ গুরু। রামকৃষ্ণ এঁদের যার যার পেশা, বৈষয়িক কাজকর্ম কিংবা সংসার কিছুই ত্যাগ করতে বলেননি। এমনকি সুরেন এবং গিরিশকে মদ্যপান কিংবা পরদার গমনেও নিষেধ করেননি, শুধু বলেছেন, মদ্যপানের সময় কিংবা বারাঙ্গনার কক্ষে গিয়ে মায়ের কথা স্মরণ করতে। তিনি ওদের আশ্বস্ত করার জন্য বলেছেন, এরা আরও কিছুদিন ভোগ করুক, ভোগ কেটে গেলে একেবারে খাটি হয়ে যাবে। এঁরা রামকৃষ্ণের সেবক, রামকৃষ্ণ এবং তাঁর অন্যান্য শিষ্যদের জন্য এঁরা অর্থ সাহায্য করেন, তার চেয়ে বেশি কিছু এঁদের ত্যাগ করতে হয়নি!
কিন্তু নরেন-রাখাল-নিরঞ্জনদের মনোভাব অনেকেরই বুঝতে পারে না। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা ভাবে এই ছোড়াগুলো এমন হা-হা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? এদের জীবন কত সম্ভাবনাপূর্ণ, অথচ এরা যে এরই মধ্যে সব কিছু ত্যাগ করে বসে আছে! এরা ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য ব্যাকুল, কিন্তু ঈশ্বর কি কখনও আভাসে-ইঙ্গিতেও জানিয়েছেন যে বাইশ-তেইশ বছরের যুবকেরা দেশের চিন্তা, সমাজের চিন্তা, নিজের প্রিয়জনদের চিন্তা ছেড়ে শুধু তাঁর চিন্তাতেই মগ্ন হয়ে থাকুক? ওটা কি ঈশ্বরেরই সৃষ্ট এই প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ নয়? তাহলে কি প্রকৃতপক্ষে ঠিক ঈশ্বরের টানে নয়, এরা ঘরছাড়া হয়েছে শুধু একজন মানুষের টানে? ঈশ্বরকে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু যে-মানুষকে চোখে দেখা যায় অথচ কিছুতেই যাকে বোঝা যায় না, অন্য হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে কিছুতেই যাকে মেলানো যায় না, যার জীবন জলের মতন স্বচ্ছ অথচ রহস্যময়, যার ব্যবহারে মিশে আছে নিঃস্বাৰ্থ ভালোবাসা আর মায়া, তাঁর টান বড় মৰ্মভেদী। রামকৃষ্ণ পুরোপুরি গৃহী নন অথচ গাৰ্হস্থ্যজীবনের অনেক খবর রাখেন, কোন জিনিসের কী বাজারদর তা পর্যন্ত তাঁর জানা, একটা কম্বলের দাম সিকে না দেড় টাকা হতে পারে, তাও বলে দেন ভক্তদের। কার পেটের ব্যামো, কার বাড়িতে অশান্তি তা নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি পুরোপুরি সন্ন্যাসীও নন, পরমহংস সাধুর মতন তিনি নির্জন গুহাবাসী হতে চাননি, তাঁর ছোটখাটো লোভ আছে, জিলিপি খেতে বড় ভালোবাসেন, থিয়েটার দেখতে যান, সরল মাধুৰ্যমাখা কিশোরদের কোলে বসিয়ে আদর করেন, একবার রুপো বাঁধানো গড়গড়ায় তামাক খাবার সাধ হয়েছিল তাঁর।
পরমহংস সাধু হয়েও সংসারে রইলেন রামকৃষ্ণ, অথচ নিজের প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি কিংবা বিশাল এক শিষ্য সম্প্রদায় গড়ে তোলার দিকেও যে তাঁর ঝোঁক নেই, সে কথাও ঠিক। নিজের জন্য তিনি কিছুই চান না, এখানেই তাঁর পরম বৈরাগ্য। অথচ যে-কয়েকজন ভক্ত তাঁর ব্যক্তিত্বের টানে ছুটে এসেছে, যারা তাঁকে ঘিরে থাকে, তাদের সকলেরই প্রতি রামকৃষ্ণের অসম্ভব স্নেহ-মায়া। এই মায়ার টান কিছুতেই ছিন্ন করা যায় না। বাইশ-চব্বিশ বছরের এই কয়েকজন যুবক বাবা-মাকেও ছেড়ে রামকৃষ্ণকে ঘিরে রয়ে গেল। একটা একটা করে ছিঁড়ে ফেলতে লাগলো সাংসারিক বন্ধন। ভোগ, বিলাসিত, আরাম-নারী-সান্নিধ্য ইত্যাদি সাংসারিক আসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে তারা আসক্ত হয়ে পড়ল ত্যাগ ও বৈরাগ্যে। এও একটা তীব্ৰ নেশা।
দোতলার ঘরটিতে রয়েছেন রামকৃষ্ণ, রোগের যন্ত্রণায় অধিকাংশ সময় তাঁকে শুয়েই থাকতে হয়। শরীরটা শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে, শুনতে পারা যায় বুকের পাঁজরা, জিরজির করছে হাত দুখানি। এক একদিন এত দুর্বল হয়ে পড়েন যে দুদিক থেকে দুজন ধরে না থাকলে তিনি পেচ্ছাপ-বাহ্যে করতে যেতে পারেন না। আবার এক একদিন নিজেই তুরতুর করে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ান। গলা দিয়ে মাঝে মাঝেই বমি আর পুঁজ বেরিয়ে আসে, অসহ্য ব্যথা, তারই মধ্যে গুণগুনিয়ে গান গেয়ে ওঠেন মাঝে মাঝে।
নীচের তলায় বারো-চোদ্দ জন যুবক শিষ্য অনেক সময় হুড়োহুড়ি দাপাদাপি করে। গুরুর অসুস্থতার জন্য তারা কাতর, কিন্তু সব সময় বিষণ্ণ ও মুখ ভার করে থাকা যৌবনের ধর্ম নয়, তারা চেঁচিয়ে গান গায়, কোনও একজনের রসিকতায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সবাই। কখনও ওদের সমবেত গান শুনে ওপর থেকে রামকৃষ্ণ বলে ওঠেন, ওরে ওদের থামতে বল না। আমি এদিকে মরতে বসেছি, আর ছোড়াগুলো আমোদ করছে। তার পরেই আবার ওদের ওপরে ডেকে আনতে বলেন, বকুনি দেবার বদলে ফিক করে হেসে বলেন, এক জায়গায় সুর ভুল হচ্ছিল কেন, আমার সামনে গান কর।
মহেন্দ্রলাল সরকার মূল ডাক্তার হলেও আরও বহু ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিমের আনাগোনার বিরাম নেই। কেউ বলে গলা দিয়ে ঘি ঢালতে, কেউ দেয় হরিতাল ভস্ম, কেউ বলে হরীতকী চিবিয়ে খেতে। যে যা বলে রামকৃষ্ণ মেনে নেন। তার বেঁচে থাকার বড় সাধ। ব্যাধির চরম কষ্টের সময় বোঝা যায়, মানুষের জীবনে শরীরের ভূমিকা কতখানি। ঈশ্বরচিন্তা পর্যন্ত তখন দূর হয়ে যায়। যন্ত্রণায় যখন শরীর কুঁকড়ে যায়, তখন মনে হয়, মুক্তি, মোক্ষ এ সবই তুচ্ছ, নিছক কথার কথা। হে প্রাণ, তুমি এই শরীর ছেড়ে যেও না, দোহাই তোমার। আর একটু থাকো, আর একটু থাকো!
এইরকম সময় কেউ যদি বলে, আপনি ঈশ্বরের অবতার, আপনি ইচ্ছে করলেই…তখন রামকৃষ্ণ ধমকে বলে ওঠেন, চুপ কর, ওসব শুনলে ঘেন্না করে। যেন তিনি আরও বলতে চান, আমি এত কষ্ট পাচ্ছি, আর তোমরা আমাকে অবতার সাজিয়ে মজা পাচ্ছি। কেউ শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিলেও তার পছন্দ হয় না। তিনি বলে ওঠেন, শাস্ত্রের মধ্যেও অনেক চিনি বালি মেশানো আছে!
এক একদিন মনে হয়, আজই বুঝি ঘনিয়ে আসবে শেষ মুহূর্ত, উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় সবাই বাকশূন্য। আবার পরদিনই রামকৃষ্ণ সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণা দমন করে সহাস্য সুন্দর। ঘনিষ্ঠ শিষ্যদের পরিমণ্ডলে তিনি কখনও ঐহিক কখনও পারত্রিক বিষয়ে আলোচনায় মেতে ওঠেন। তারপর গানের পর গান। গানের মধ্যেই যেন রয়েছে সমস্ত তত্ত্বের নির্যাস। বয়স্ক সংসারী ভক্তদের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই রামকৃষ্ণের। এই তরুণ ভক্তদের পবিত্ৰ ঝলমলে মুখগুলি দেখে তিনি যেন নবজীবন ফিরে পান। গান গাইতে গাইতে নরেনের চোখ জ্বালা করে ওঠে, সে বাইরে ছুটে চলে যায়। রামকৃষ্ণ যখন একটু ভালো থাকেন, তখনই নরেনের বুক বেশি করে মোচড়ায়, তখন মনে হয়, এমন মানুষটি তাদের ছেড়ে চলে যাবেন? ইনি কোনও অনাচার করলেন না, পাপ করলেন না, তবু কেন এমন কালব্যাধি ধরল এঁকে? সৃষ্টিকর্তার এ কী অবিচার!
নরেন সহজে নরম হয় না। লোকের সামনে অশ্রু বিসর্জন করার প্রশ্নই ওঠে না। রাখাল বা অন্য কেউ কান্নাকাটি করলে নরেন তাদের সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু একদিন সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। একদিন রাত্তিরবেলা নরেন বাড়ির বাইরে গিয়ে রাম রাম বলে চিৎকার করতে থাকে। ঠিক চিৎকার নয়, বুক ফাটা আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ শুনে বেরিয়ে আসে অনেকে, নরেন বাগানের চারধারে দৌড়োতে শুরু করে। কয়েকজন গিয়ে নরেনকে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু বলশালী সেই যুবাকে আটকানো সহজ নয়। নরেন রাম রাম করতে করতে দৌড়াতে লাগল ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যেন সে সেই ডাকে আকাশ ভেদ করে দিতে চায়। রামরূপী নারায়ণ তার প্রভুকে নিরাময় করে দিতে পারে না?
রাত গভীর হয়, নরেনের সেই উন্মত্ততা জানলা দিয়ে দেখতে পান রামকৃষ্ণ, তিনি ব্যাকুল হয়ে ডেকে পাঠান নরেনকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। নরেনের যেন বাহ্যজ্ঞান নেই, তার ক্লান্তি নেই, সে দৌড়োচ্ছে অনবরত। মধ্যরাত পেরিয়ে যাবার পর কয়েকজন ভক্ত চারদিক থেকে নরেনকে ঘিরে ধরে থামাল, তাকে টানতে টানতে নিয়ে এল দোতলায়। নরেনের দু চক্ষু লাল, বুক-জ্বালানো উষ্ণ নিঃশ্বাস বেরুচ্ছে। তাকে দেখে রামকৃষ্ণেরও চোখে জল এল। তিনি স্নেহ বিগলিত কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁরে, তুই ওরকম করছিস কেন? ওতে কী হবে?
নরেন বলল, রাম রাম রাম কেন আপনার রোগের কষ্ট দূর করে দেবেন না?
রামকৃষ্ণ বললেন, দেখ, তুই এখন যেমন কচ্ছিস, অমনি বারোটা বছর আমার মাথার ওপর দিয়ে ঝড়ের মতন বয়ে গেছে। তুই আর এক রাত্তিরে কী করবি?
নরেনকে কাছে এনে তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
আর একজন অন্তরঙ্গ ভক্ত কালীপ্রসাদ অনেক বেদ-বেদান্ত পাঠ করেছে, এখানে এসে সে প্রায়ই একান্তে ধ্যান করে, ধ্যানের সময় তন্ময় হয়ে যায়। সেই কালীপ্রসাদ হঠাৎ একদিন নাস্তিক হয়ে গেল। এত মানুষ থাকতে তার গুরু কেন এমন কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন, কেন তিনি এত কষ্ট পাচ্ছেন, এই প্রশ্নের সে কোনও উত্তর খুঁজে পায় না। তখন তার মনে হয়, ধর্ম, ঈশ্বর, জীবাত্মা, পরমাত্মা এসব মিথ্যে। অলীক কল্পনা। হাজার ধ্যান করলেও কিছু হয় না, জীবন চলে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে, তুই নাকি কী সব বলে বেড়াচ্ছিস? তুই ঈশ্বর মানিস না?
কালীপ্রসাদ অভিমানের উত্তর দিল। নাঃ এখন আর মানি না! ঈশ্বর আমাদেরকে কী দেয়? ঈশ্বরকে পাওয়া-না পাওয়ায় কী আসে যায়?
রামকৃষ্ণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুই শাস্ত্ৰ মানিস না? লোকাচার মানিস না?
কালীপ্রসাদ দু দিকে প্রবলভাবে ঘাড় নাড়ল।
রামকৃষ্ণ বললেন, অন্য কোনও সাধুর কাছে তুই এরকম বললে সে তোর গালে চড় মারত!
কালীপ্রসাদ বলল, আমাকে বুঝিয়ে দিন, আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিন!
যাকে চড় মারার কথা বললেন, তার দিকেই আবার কোমল মায়াবী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন রামকৃষ্ণ। কালী প্ৰসাদের অভিমানের কারণ বুঝতে তাঁর দেরি হল না, তিনি কালীপ্রসাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, বিশ্বাস কি এত সহজে হারাতে হয় রে। তিনি সব বুঝবি, সব জানবি!
গিরিশের মনে অবশ্য এরকম কোনও দ্বিধা অভিমান নেই। তিনি দৃঢ়ভাবে ধরে বসে আছেন, তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ ঠাকুর ঈশ্বরের পূর্ণ অবতার। এই ব্যাধি তাঁর লীলা, অন্যদের পাপ তিনি অঙ্গে ধারণ করেছেন, যে-কোনও দিন তিনি ইচ্ছে করলেই আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। এখন গুরু সন্দর্শনে এসেই তিনি মাটিতে শুয়ে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করেন।
রামকৃষ্ণ বলে ওঠেন, ওরে, তুই অমন করিস না, আমার লজ্জা করে।
অন্যদের সঙ্গে গিরিশের তর্ক হয়। নরেন কিংবা সুরেন মিত্তির অবতারত্ব এখনও মানে না, গিরিশ বজ্র গৰ্জনে নিজের মত জাহির করেন তাদের কাছে। নরেন আর গিরিশের বুদ্ধির লড়াই উপভোগ করেন রামকৃষ্ণ, মাঝে মাঝে উসকে দেন, তোরা ইংলিশে বল!
কিন্তু একা একা গিরিশের সান্নিধ্যে যেন অস্বস্তি বোধ করেন রামকৃষ্ণ। এক একদিন গিরিশ মাতাল হয়ে এসে বড় বাড়াবাড়ি শুরু করে দেন, তখন আর ব্যাপারটা কৌতুকের থাকে না। একদিন ঘর ভর্তি লোকের সামেন গিরিশ বর্ণনা করতে লাগলেন তাঁর ছোট ভাই অতুলের এক অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা। এই কাশীপুরেই একদিন রামকৃষ্ণের অসুখের বেশ বাড়াবাড়ি হয়েছিল। অতুল সেদিন সারা রাত জেগে পাহারা দেয় গুরুকে। পরপর কয়েকদিন রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিতে শশী বিশ্রাম নিতে গেছে, লাটুও ঘুমিয়ে পড়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহ থেকে উজ্জ্বল জ্যোতি বেরুতে লাগল, ওপরের আবরণটি হয়ে গেল স্বচ্ছ। বিস্ফারিত চোখে অতুল দেখল, শ্রীরামকৃষ্ণের অর্ধনারীশ্বর, তাৰ এক দিক কৃষ্ণের মতন, অন্য দিকটি রাধা। দক্ষিণ অঙ্গের রঙ নীল আর বাম অঙের ঢল ঢল সোনার বরণ…
কেউ কেউ এ কাহিনী শুনছে মুগ্ধ বিস্ময়ে, দু-একজন অবিশ্বাসে ফিক ফিক করে হাসছে।
রামকৃষ্ণ অধৈৰ্যভাবে বললেন, ঘরে অনেক লোক। বড় গরম!
তাঁর ইঙ্গিত পেয়ে অনেকেই ঘর ছেড়ে চলে গেল, রয়ে গেলেন গিরিশ। গাঢ় আবেগের সঙ্গে বলতে লাগলেন, আপনি ঈশ্বর, ঈশ্বর, নিশ্চিত ঈশ্বর!
রামকৃষ্ণ বললেন, এক একবার মনে হয়, তুমি যা বলছি গো, তা বোধ হয় সত্যি! অসুখ ভালো হয়ে যাবে। আবার এও মনে হয় ঠিক যে এত কষ্ট এই শরীর সইতে পারবে না!
গিরিশ বললেন, আজ্ঞে নরলীলায় এই রকমই হয়!
এই সময় মহেন্দ্ৰমাস্টার ঘরে এসে দেখলেন, রামকৃষ্ণ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। মাস্টারকে দেখে অর্ধ নিমীলিত চোখে, শুষ্ক অন্তর্ভেদী স্বরে বললেন, কষ্ট, বড় কষ্ট!
ডাক্তারদের কোনও ওষুধই কাজে লাগছে না। কী করে গুরুর এই কষ্ট কমানো যায়, তা বুঝতে পারেন না মাস্টার। গিরিশের একটা কথা মনে পড়ে। তাঁরও পেটে খুব ব্যথা হয় মাঝে মাঝে, কোনও ওষুধে কিছু কাজ হয় না, কিন্তু খানিকটা মদ্য পান করলে ব্যথা বোধ কমে যায়।
গিরিশ ব্যগ্রভাবে বললেন, খাবেন একটু একটু।
রামকৃষ্ণ বললেন, তুমি যা বল।
গিরিশ আবার বললেন, মাইরি। কালীর দিব্যি বলছি, আপনি একটু খান!
মাস্টার শঙ্কিতভাবে তাকান গিরিশের দিকে। গিরিশ কী খাওয়ার ইঙ্গিত করছেন তিনি বুঝতে পারেন না। রামকৃষ্ণ প্রস্রাব করতে চলে যান। ফিরে এসে খানিক বাদে গিরিশকে বললেন, বড় গরম লাগছে ঘরে, তোমরা তবে এসো!
শীতের পর গ্ৰীষ্ম, তারপর বর্ষাকাল চলে এসেছে। অসুখের উত্থান-পতন চলছে পালা করে। শরীর এত দুর্বল, কোনও পথ্যই রামকৃষ্ণের গলা দিয়ে নামে না। মাংসের জুসেও তাঁর অরুচি ধরে গেছে। একজন বলল, গুগলির ঝোল খেলে শরীরের বল বৃদ্ধি হয়। রামকৃষ্ণ তাও খেয়ে দেখতে রাজি হলেন, কিন্তু কথাটা শুনে শিউরে উঠলেন সারদামণি। পথ্য রান্নার ভার তাঁর ওপর। তিনি স্বামীর কাছে এসে বিহ্বলভাবে বললেন, ওগুলো তো জ্যান্ত প্ৰাণী, ঘাটে দেখি চলে বেড়ায়। আমি এদের মাথা ইট দিয়ে ছেঁচতে পারব না।
রামকৃষ্ণ মৃদু হেসে বললেন, আমি খাব, আমার জন্য বাঁধবে, তাতে কোনও দোষ নেই!
এই বাগানবাড়িতেই রয়েছে দুটো পুকুর, তাতে গেঁড়িগুগলির অভাব নেই। সারদামণিকে সাহায্য করার জন্য কালীপ্রসাদ ঘাটের পাশ থেকে গুগলি তুলে এনে খোলা ভেঙে পরিষ্কার করে দেয়। সারদামণি সেগুলি সেদ্ধ করে ভাতের মণ্ডের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াতে আসেন স্বামীকে। মশলাহীন বিস্বাদ ওই খাদ্য সুস্থ মানুষই গলাধঃকরণ করতে পারে না, রামকৃষ্ণ মুখে দিয়ে থুথু করে ফেলে দেন। তবু অসীম ধৈৰ্য নিয়ে সারদামণি একটু একটু করে খাওয়াতে চান। রামকৃষ্ণ খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েন, কিংবা আচ্ছন্নের মতন হয়ে যান। চুপ করে বসে থাকেন সারদামণি। বেশি দেরি হলে তিনি স্বামীর শরীরে আলতো ভাবে ঠেলা দিয়ে ডেকে বলেন, ওঠো, ওঠো, আর একটু খাবে না?
রামকৃষ্ণ চোখ মেলে একটু ম্লান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, কী দেখলাম জান? কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারের পোকার মতন কিলবিল করছে। তুমি ওদের দেখো!
সারদামণি কেঁপে উঠে বললেন, আমি মেয়েমানুষ। তা কী করে হবে?
রামকৃষ্ণ নিজের শরীরের দিকে দেখিয়ে বলেন, এ আর কী করেছে? তোমাকে আরও অনেক বেশি করতে হবে।
এর আগেও রামকৃষ্ণ একদিন সারদামণিকে তাঁর ভক্তদের দেখাশোনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। নিজের শরীরের এত ব্যথাবেদনা, তবু তরুণ শিষ্যদের জন্য তাঁর সর্বক্ষণ চিন্তা।
সব শিষ্যই যে বিশুদ্ধ নির্লোভ তা নয় অবশ্য। এমন একটি নির্মল, পবিত্র মানুষের সংস্পর্শে এসে সব মানুষই যে স্বভাব বদলাবে তা নয়। কেউ কেউ আসে চটজলদি কিছু সিদ্ধাই পেয়ে যাবার বাসনায়। কেউ কেউ ভাবে, পরমহংস একবার ছুঁয়ে দিলেই পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। কেউ কেউ এসে এঁড়ে তর্ক করে। এরা আসে, আবার চলেও যায় রামকৃষ্ণের সেবক হিসেবে গ্রাম থেকে এসেছিল হৃদয়। তার তো চরিত্র শোধণ হলই না। দিন দিন সে দুর্জন হয়ে উঠল। অনেক বদ দোষ ছিল তার, দক্ষিণেশ্বরে সে ভক্তদের কাছ থেকে ঘুষ নিত, একটু শাঁসালো আগন্তুক দেখলে তার কাছ থেকে টাকা না নিয়ে রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখাই করতে দিত না। কেউ কিছু উপহার আনলে নিজে হাতিয়ে নিত। একবার সারদামণিকেও দক্ষিণেশ্বর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে। রামকৃষ্ণকে ভালো করে খেতেও দেয়নি। এমনই উদ্ধত হয়ে উঠেছিল সে যে একবার মথুরবাবুর আট বছরের নাতনীকে কারুর বিনা অনুমতিতে মন্দিরের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল কুমারী পূজার জন্য। রামকৃষ্ণের সে সম্পর্কে ভাগ্নে, সে-ই বা মামার সমান হবে না কেন? দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বর্তমান মালিক ত্ৰৈলোক্যনাথ যখন হৃদয়কে তাড়িয়ে দিলেন, তখনও সে তেজের সঙ্গে রামকৃষ্ণকে বলেছিল, মামা, তুমি আমার সঙ্গে চলে এসো, তোমাকে অন্য কালীমন্দিরে নিয়ে গিয়ে বসাব, আবার তোমার অনেক ভক্ত হবে। অনেক পসার হবে, আমি সব ব্যবস্থা করব। তুমি তো একটা বোকা, আমি না থাকলে তোমার সাধুগিরি বেরিয়ে যেত! বলাই বাহুল, রামকৃষ্ণ রাজি হননি, হৃদয় এখন দেশে ফিরে গিয়ে চাষবাস করে।
প্রতাপচন্দ্ৰ হাজরাও রামকৃষ্ণের জন্মস্থানের কাছাকাছি এক গ্রাম এসেছে। এই হাজরা কম জ্বালিয়েছে রামকৃষ্ণকে! ওর ধারণা, কামারপুকুরের গরিব চাটুজ্যেদের বাড়ির ছেলে গদাধর, এক সময় পটুয়ার মতো মূর্তি গড়ত আর রাখাল ছেলেদের সঙ্গে খেলে বেড়াত, সে কলকাতায় গিয়ে হঠাৎ মস্ত বড় সাধু পরমহংস হয়েছে। এ গাঁয়ের মেধো, ভিন্ন গাঁয়ে মধুসূদন! তা গদাধর যা পারে, প্রতাপ হাজরাই বা তা পারবে না কেন? সেও দক্ষিনেশ্বরে এসে সাধুর ভেক ধরল, মুখে বড় বড় কথা বলে, কিন্তু সব সময় তার স্বার্থচিন্তা। বগলে ইট, মুখে রাম নাম। প্রকৃত ভক্তরা হাজরার ভণ্ডামি দেখে মনে করে, রামকৃষ্ণ একে সহ্য করছেন কী করে? এরকম একজন স্বাৰ্থবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়াই উচিত। রামকৃষ্ণ তবু তাকে তাড়িয়ে দেননি। মঙ্করা করে প্রায়ই বলেছেন, থাক থাক, জটিলা-কুটিলা না থাকলে লীলা পোস্টাই হয় না! অন্য সময় বলেছেন, হাজরাকে আমি কীরকম জানি, জানিস? যেমন সাধুরূপী নারায়ণ, তেমনি ছলরূপী নারায়ণ, আবার লুচ্চারূপী নারায়ণ!
নরেনের অবশ্য হাজরা সম্পর্কে দুর্বলতা আছে। নরেন অনেক বাসনা পরিত্যাগ করেছে, কিন্তু তামাক-চুরুট-পান খাওয়ার অভ্যেস ছাড়তে পারেনি। হাজরা ভালো তামাক সাজে, নরেন হাজরার এক হুঁকো-তামাকের ইয়ার। হাজরা বেশ চটপট চতুর কথা বলে হাসাতেও জানে। নরেনের প্রশ্রয়ে হাজরা রয়ে গেছে কাশীপুরের এই বাড়িতে। রামকৃষ্ণের কাছে নরেনের সাতখুন মাপ। সে যে খাপ খোলা তলোয়ার। হাজরা আছে তো থাক, সে যে নরেনের ‘ফেরেন্ড’!
যারা সংসারী ভক্ত, তারা টাকা পয়সার হিসেব কিছুতেই ভুলতে পারে না। কাশীপুরের বাগানবাড়ির সব খরচ চালাচ্ছে দু-তিনজন ভাগাভাগি করে। ভক্তদের সংখ্যা বেড়ে গেলে খাবারের খরচও বাড়ে, তাতে খরচদাতারা বিরক্ত হয়। রাম দত্ত, বলরাম বসু যত বড় ভক্ত, তেমনই কৃপণ। খরচ কমাবার উপদেশ দিতে এসে তারা এমন অপমানজনক কথা বলে যে নরেন ক্ষেপে যায় একেবারে। সে বলে উঠল, দূর শালা, ওদের পয়সায় আর খাব না। বরং ভিক্ষে করে খাব তাও ভালো, তবু ওদের পয়সা চাই না!
তরুণদের মধ্যে কয়েকজন অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। তারাও ভিক্ষের নামে হইচই করে ওঠে। সবাই ভিক্ষেয় বেরুবার জন্য ব্যস্ত। গেরুয়া কাপড় পরে নিল তাড়াতাড়ি।
প্রকৃত সন্ন্যাসী না হয়েও এরা গেরুয়া পেয়েছে এক বিচিত্র কার্যকারণে।
বুড়ো গোপাল এর মধ্যে একবার তীর্থদর্শনে গিয়েছিল। ফেরার পর সে আরও পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য বারোখানি কাপড়, রুদ্রাক্ষরে মালা ও চন্দন কিনে আনে গঙ্গাসাগর যাত্রী সাধুদের দান করবার জন্য। নিজের হাতে সে কাপড়গুলি গেরুয়া রঙে ছুপিয়েছে। তার সঙ্কল্পের কথা জানতে পেরে রামকৃষ্ণ বুড়ো গোপালকে ডেকে বলেছিলেন, তুই জগন্নাথ ঘাটের সাধুদের এইসব দান করবি? তাতে যে ফল পাবি ভাবছিস, তার হাজার গুণ ফল হবে যদি তুই আমার এই ছেলেদের দিস। এদের মতন ত্যাগী সাধু তুই আর কোথায় পাবি? এদের এক একজন হাজার সাধুর সমান। এরা হাজারী সাধু, বুঝলি? কাপড় আর মালাগুলো আন, আমি ছুঁয়ে মন্ত্র পড়ে দিচ্ছি!
গুরুর হাত থেকে গেরুয়া পাবে শুনে সবাই আহ্লাদে ডগমগ। সকালবেলা স্নান করে এসে তরুণরা দাঁড়াল রামকৃষ্ণের সামনে। সেদিন তিনি দোতলার ঘর ছেড়ে নেমে এসেছেন বাগানে। ধুতির ওপর কালো বনাতের কোটটা ঢল ঢল করছে রোগা শরীরে। তিনি এক এক করে বস্ত্র ও মালা তুলে দিলেন নরেন, রাখাল, বাবুরাম, নিরঞ্জন, শশী, শরৎ, কালী, যোগীন, লাটু ও তারক—এই দশজনকে। বুড়ো গোপাল নিজেই দান করছে, তবু সে লুব্ধের মতন হাত বাড়িয়ে বলল, গুরু, আমায় একটা দেবে না? রামকৃষ্ণ তাকেও গেরুয়া বস্ত্ৰ দিলেন, আর বাকি রইল একখানা, সেখানা কারুকে দিলেন না। হাজরা ও আরও কয়েকজন পেল না কিছুই। নরেন আনন্দে গান গেয়ে উঠল :
আমি গেরুয়া বসন অঙ্গেতে পরিব
শঙ্খের কুণ্ডল পরি
আমি যোগিনীর বেশে যাব সেই দেশে
যেখানে নিঠুর হরি…
সেই গেরুয়া বসন পরে তরুণ সন্ন্যাসীরা বেরুল ভিক্ষে করতে। প্রথমেই তারা গেল সারদামণির কাছে। একতলায় ছোট ঘরখানির সামনে ভিড় জমিয়ে তারা নানা রকম সুরে বলতে লাগল, ভিক্ষাং দেহি মে পার্বতী, ভিক্ষা দাও মা, ভিক্ষা দাও!
সোনার টুকরো ছেলেগুলির এই কাঙাল রূপ দেখে সারদামণি প্রথমে হতভম্ব। তারপর এক সময় হেসে ফেলে ওদের একটি টাকা দিলেন। দারুণ খুশি হয়ে ওরা নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করে সারা দিন পর যা পেল তা এনে নিবেদন করল গুরুর চরণে। কারুর মুখে কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই, ভিক্ষে করা যেন একটা দারুণ আনন্দের ব্যাপার।
রামকৃষ্ণ সারদামণিকে বললেন, তোমার ছেলেরা চাল জোগাড় করে এনেছে, আর না খেয়ে থাকতে হবে না। রেঁধে দাও গো।
সেই নানারকম মিশ্রিত তণ্ডুলে তৈরি হল এক রকম মণ্ডের মতন পদার্থ। রামকৃষ্ণ স্বয়ং প্রথমে তার একটুখানি মুখে দিয়ে বললেন, বাঃ অমৃত, অমৃত! ভিক্ষান্ন খুব পবিত্র, এতে কারুর কোনও কামনা মিশে নেই। খেয়ে বড় আনন্দ হল।
তার পরেই অন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই মণ্ড চেটেপুটে শেষ করে দিল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। যেন সত্যিকারের বুভুক্ষুরা বহুকাল পর অমৃতের স্বাদ পেয়েছে। খাওয়া শেষ করার পর নরেনরা হুঁকো টানতে টানতে হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগল।
রামকৃষ্ণের গলার ক্ষত এতগুলি ছেলেকে এক বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে। কাশীপুরের বাড়িতে সবাই এক সংসারের মানুষ। আগে এরা পরস্পরের সঙ্গে আপনি আজ্ঞে, অমুকবাবু তমুকবাবু এরকম সম্বোধন করত। এখন সবাই নাম ধরে তুই-তুকারি করে। সবচেয়ে বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে লাটুর। বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এই ছেলেটি এসেছিল কলকাতা শহরে ভৃত্যের কাজ করতে। প্রথমে সে ছিল রাম দত্তের বাড়ির নোকর। তারপর সে রামকৃষ্ণের সেবার কাজে লেগে যায় এবং দ্রুত রূপান্তর হয় তার। ভালো করে বাংলাই শেখেনি সে, তবু সে উচ্চাঙ্গের ভাবের কথা মন দিয়ে শোনে এবং হৃদয়ঙ্গম করে। শ্ৰীরামচন্দ্রের যেমন হনুমান, শ্ৰীরামকৃষ্ণের সেই রকম লাটু। এতদিন পর্যন্ত সে নরেন, শশী, শরৎদের সম্ভ্রমের সঙ্গে বাবু সম্বোধন করত। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ তাকেও গেরুয়া কাপড় দেওয়ায় সে হঠাৎই একদিন এ লোরেন, এ শোরোত, এ শোশী বলে অন্তরঙ্গভাবে ডাকতে শুরু করেছে। সবাই লাটুকে এখন সমান বন্ধুর মতন দেখে।
ছেলেরা গেরুয়া পরে ভিক্ষে করতে বেরিয়েছিল, এ সংবাদ ক্রমে তাদের বাড়িতে পৌঁছে যায়। জননীদের বুক কেঁপে ওঠে। কোন মা তার সন্তানকে সংসার ছেড়ে যেতে দিতে চায়? রামকৃষ্ণ সাধুর সেবা করার জন্য ছেলেরা কিছুদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে কাশীপুরের এসে আছে, এটুকু তবু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তারা গেরুয়া পরবে কেন? স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসই তো গেরুয়া পরেন না!
নরেন অনেকদিন বাড়িতে যান না। তাঁর মা আর থাকতে না পেরে একদিন ছ’ বছরের ছেলে ভূপেনের হাত ধরে দুটি এলেন কাশীপুরের বাগানে। রামকৃষ্ণ সকাশে বাইরের রমণীদের যাওয়া নিষেধ, কিছুদিন আগে এক পাগলী এসে উৎপাত করেছিল, রামকৃষ্ণের প্রতি মধুর ভাবে নিজেকে নিবেদন করতে চেয়েছিল বলে তাঁর আদেশে কারুকেই আর দোতলায় উঠতে দেওয়া হয় না, কিন্তু নরেনের জননীকে আটকায় কার সাধ্য!
নরেন মাকে দেখে তখুনি সামনে আসতে না চেয়ে আড়ালে লুকোল। তবু তাকে এক ঝলক দেখতে পেয়েছেন ভুবনেশ্বরী। ছেলের অঙ্গে সত্যিই গেরুয়া বসন।
বিছানার ওপর একটা বড় বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন রামকৃষ্ণ। মুখে ভিতু ভিতু ভাব। তামাক খেতে ইচ্ছে করছে খুব, কিন্তু গলার ব্যথার জন্য এখন হুঁকো টানা বন্ধ।
ভুবনেশ্বরী ভেতরে এসে হাত জোড় করে প্রণাম জানালেন। তারপর সরাসরি অভিযোগ করলেন, আপনি আমার ছেলেকে কেড়ে নিচ্ছেন কেন?
রামকৃষ্ণ বললেন, ডাক্তার আমাকে কথা বলতে মানা করেছে…তুমি মা তুমি এসেছ, ভালো করেছ। বসো বসে।
ভুবনেশ্বরী অভিমান ও ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আপনি অসুস্থ, বেশিক্ষণ থাকব না। শুধু একটা কথা জানতে চাই। নরেন আপনাকে ভক্তি করে, মানে, সে আপনার সেবা করার জন্য এখানে রয়ে গেছে, তাতে তো আমি আপত্তি করিনি। বাড়িতে যাওয়া ইদানীং সে ছেড়েই দিয়েছে। ছোট ছোট ভাইবোনরা কেমন আছে, দু বেলা খেতে পায় কিনা সে খবরও রাখে না। তবু সেসব আমি সামলাচ্ছি। কিন্তু তা বলে সে গেরুয়া ধারণ করবে? সংসারের সে বড় ছেলে, তাকে লেখাপড়া শেখানো হয়েছে, তবু সে কোনও দায়িত্বই নেবে না?
রামকৃষ্ণ বললেন, না গো, না, না, সে কি কথা! এই দেখ না, আমি কি গেরুয়া পরেছি? ও একখানা করে কাপড় বুড়ো গোপাল দিয়েছিল, আগে থেকে ছোপানো ছিল, ও কিছু না। গিরিশ টিরিশ বোধ হয় নরেনকে জোর করে গেরুয়া পরায়। ওসব ওদের খেলা।
শুধু স্তোক বাক্য শুনে আশ্বস্ত হওয়ার পাত্রী নন ভুবনেশ্বরী। আরও দু-চার কথার পর সরাসরি দাবি করলেন, আমি নরেনকে আজ বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
রামকৃষ্ণ ব্যস্ত ভাব দেখিয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে যাও না। আমি তো কারুকে সন্ন্যাসী হয়ে বনে-জঙ্গলে যেতে বলি না। বরং নরেনকে বলেছি, বাড়িতে তোর বিধবা মা আর ছোট ছোট ভাইয়েরা রয়েছে, তাদের দেখাশুনো করতে হবে। তোর কি সন্ন্যাসী হওয়া উচিত? নিয়ে যাও না, আজই ওকে নিয়ে যাও।
নরেনকে ডেকে পাঠানো হল। গুরুকে প্ৰণাম জানিয়ে বাধ্য ছেলের মতন সে মা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ভাড়ার গাড়িতে উঠল। মাথার চুল ছোট করে ছাটা, চোখের নীচে রাত্রি জাগরণের কালি, সারা গায়ে ময়লা, বহুদিন সাবানের ছোঁওয়া লাগেনি, গেরুয়ার বদলে কার যেন একখানা ছেড়া ধুতি পরে এসেছে। এখন দেখে কে বলবে, এ সেই সিমলে পাড়ার ব্যায়াম-বলিষ্ঠ নরেন!
প্রথম সন্তান বড় আদরের সন্তান। তার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে চোখের জল ফেলতে লাগলেন ভুবনেশ্বরী। ধরা গলায় বললেন, বাড়িতে খুদ-কুঁড়ো যা হোক আমি রেঁধে খাওয়াতে পারি, তা বলে তোকে ভিক্ষের অন্ন খেতে হবে? তোর বাবা কতবড় মানী লোক ছিলেন!
নরেন বলল, আরে না না, ভিক্ষের অন্ন খাব কেন? ও দু’একদিন শখ করে… কাশীপুরের বাড়িতে দু বেলা রান্না হয়, খিঁচুড়ি, এক একদিন লুচি…ভালো খাই। যারা খরচ দেয় তাদের সঙ্গে মাঝে বচসা হয়েছিল, মহেন্দ্র মাস্টার আবার মিটিয়ে দিয়েছেন।
ভুবনেশ্বরী বললেন, তোর গুরুদেব কী বলেছেন জানিস? এই ভূপেন তো সঙ্গে ছিল, সব শুনেছে। উনি বললেন, নরেনকে তো সন্ন্যাসী হতে বলিনি আমি। ও বাড়িতে গিয়ে থাক না।
নরেন হা-হা করে হেসে উঠে বলল, উনি এই বলেছেন বুঝি? জান মা, উনি চোরকে বলবেন চুরি করতে, আর গেরস্তকে বলবেন সজাগ থাকতে! এই সব মহাপুরুষদের কথার মর্ম বোঝা সহজ নয়!
শেষ পর্যন্ত বাড়িতে গেল না। নরেন, বাগবাজারের কাছে এসে একটা বিশেষ কাজের ছুতো দেখিয়ে নেমে পড়ল।
নেমে দাঁড়িয়ে বলল, মা, তোমাকে আমি কখনও ভুলতে পারি, তুমি বিশ্বাস করো? ভুপেন, মহিন ওদেরই বা ভুলব কী করে? আমি যেখানেই থাকি, তোমাদের যাতে কষ্ট না হয়, তা আমি নিশ্চিত দেখব। তুমি কষ্ট পেলে পৃথিবীর কোনও সুখই আমার কাছে সুখ নয়!
রামকৃষ্ণ নানাজনের কাছে খোঁজ নেন, নরেন ফিরেছে? নরেন ফিরেছে?
এক সময় যখন নরেনের প্রত্যাবর্তনের সংবাদ জানলেন, তখন প্রশান্ত হাসিতে তাঁর মুখ ভরে গেল। নরেন যে নিক্ষিপ্ত তীর, সে আর পিছু ফিরতে পারে না। নরেন তর্ক করে, নরেন অবতারত্ব মানে না, এমনকি মাঝে মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্বেও অবিশ্বাস করে, তবু নরেনই তো এখানকার সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে।
খাগের কলম কালিতে ডুবিয়ে রামকৃষ্ণ একটা কাগজে ছবি আঁকতে লাগলেন। এখন শরীর একটু ভাল থাকলে নির্জন দুপুরবেলা তিনি মাঝে মাঝেই ছবি আঁকেন। আঁকায় বেশ হাত আছে তাঁর। ছেলেবেলায় মূর্তি গড়ে বিক্রি করতেন। এখন ছেলেবেলায় কথা মনে পড়ে খুব। আঁকতে আঁকতে থেমে গিয়ে চুপ করে চেয়ে থাকেন, যেন দেখতে পান তার বাল্যকালের গ্ৰাম্য জীবন, সেই দিগন্ত বিস্তারী মাঠ, আকাশে উড়ন্ত বকের সারি।
রামকৃষ্ণের প্রিয় ছবি, একটি পাখি। বারবার পাখি আঁকেন। আর আঁকলেন শিব ঠাকুর ও বাবা তারকনাথ। একটা হাতির মুখ। যা মনে আসে, তাই-ই আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে ছবিতে। একবার আঁকা হল, হুঁকো হাতে এক বেশ্যা রমণী।
অনেকদিন আগে একদিন মেছোবাজারে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মুখে রং মাখা রঙ্গিনী মোহিনী কয়েকটি বারবনিতাকে দেখে তিনি অবাক হয়ে প্ৰণাম জানিয়ে বলেছিলেন, মা, তুই এইখানে এইভাবে রয়েছিস!
নরেন যখন দেখা করতে এল, তখন তিনি ছবি আঁকার বদলে কী যেন লিখছেন আপন মনে। নরেনকে দেখে সামান্য চমকে উঠে তিনি লিখে চললেন কাঁপা কাঁপা হাতে। তারপর নীচে দু-একটি রেখায় ছবি আঁকলেন, একটি আবক্ষ মূর্তি, তার পেছনে একটি ধাবমান ময়ূর।
কাগজটি তিনি এগিয়ে দিলেন নরেনের দিকে। এতই আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষর যে নরেন লেখাটি পড়ে ঠিক বুঝতে পারল নাঃ
জয় বাধে পৃমমোহী-নরেন সিক্ষে দেবে
জখন ঘুরে বাহিরে
হাঁক দিবে
জয় রাধে
রামকৃষ্ণের সর্বক্ষণের পাহারাদার নিরঞ্জন দেখি দেখি বলে কাগজটা হাত-থেকে নিয়ে বলল, বুঝেছি। উনি প্রায়ই বলেন এ কথা। লিখেছেন, জয় রাধ প্রেমময়ী! নরেন শিক্ষে দেবে, যখন ঘরে-বাইরে হাঁক দিবে, জয় রাধে!
রামকৃষ্ণ মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বললেন, নরেন শিক্ষে দেবে।
নরেন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না, না, আমি ওসব পারব না।
রামকৃষ্ণ বললেন, তোর ঘাড় করবে!
নরেন আবার কিছু বলতে যেতেই তিনি বললেন, আমার পশ্চাতে তোকে ফিরতেই হবে, তুই যাবি কোথায়?
তার পরই রামকৃষ্ণর কাশি শুরু হয়ে গেল।
এর পর দুদিন অবস্থার বেশ অবনতি হল রামকৃষ্ণের। খালি কাশি, অনবরত কাশি, কিছুতেই থামানো যায় না। ঘুম নেই একটুও। শিষ্যদেরও ঘুম নেই, তারা দোতলার ঘরের ভেতরে-বাইরে দাড়িয়ে থাকে, মহেন্দ্র মাস্টারও বাড়ি ফেরেননি। সকলেরই আশঙ্কা আজই বুঝি শেষ রাত্রি।
বিছানায় শুয়ে থাকতেও পারছেন না, কখনও উঠে বসছেন, কখনও খাট থেকে নেমে দাঁড়াচ্ছেন রামকৃষ্ণ। নিরঞ্জন খুব সাবধানে ধরে থাকছে তার গুরুর দেহখানি।
এক সময় কাশির সঙ্গে রক্ত পড়তে শুরু করল। গলাগলিয়ে রক্ত, ডাবর ভরে গেল।
রামকৃষ্ণ বললেন, গামলা দে।
নরেন এসে একটা গামলা পেতে ধরল। রক্তের ধারায় সেই গামলাও ভরে যাবার উপক্রম। ওই ক্ষীণ শরীরে আর কত রক্তই বা থাকতে পারে! বেঁকে যাচ্ছে তাঁর পিঠ। কয়েকজন ভক্ত মুখ ফিরিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
একসময় রামকৃষ্ণ ককিয়ে বলে ওঠেন, মা, এত যন্ত্রণা সহ্য হয় না। জ্ঞান হারিয়ে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন, নিরঞ্জন দু বাহু দিয়ে তাকে ধরে রইল।
সকলেই কয়েক মুহূর্তের জন্য চিত্রার্পিত।
নিরঞ্জনের বাহুডোরে সংজ্ঞাহীন রামকৃষ্ণ কাত হয়ে আছেন, নরেন গামলাটা নামিয়ে রেখে আস্তে আস্তে মুখ তুলল। নরেনের ঠোঁটের ঠিক ওপরেই এক দলা রক্ত আর পুঁজি লেগে আছে।
অনেকের ধারণা, এই মারাত্মক ব্যাধি অতি ছোঁয়াচে। কেউ কেউ খুব ভক্তিমান হয়েও এখন গুরুর খুব কাছে আসে না।
লাটু নরেনের মুখ থেকে সেই রক্ত-পুঁজি মোছার জন্য এগিয়ে দিতে গেল তার ধুতির খুঁটি। নরেন হাত তুলে আটকাল তাকে, তারপর জিভ দিয়ে সেই রক্ত চেটে নিতে লাগল।
মাস্টার অস্ফুট স্বরে বললেন, Lord’s super- Fresh blood!