এ দেশের সমাজে বড় মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে কিছু মোসাহেব দরকার। নিজের মুখে নিজের গুণকীর্তন বার বার ভাল শোনায় না, লোকেও ঠিক বিশ্বাস করে না। চতুর, বাক্যবাগীশ মোসাহেবরা তাদের বাবুর নানান কীর্তিকাহিনী অতিরঞ্জিতভাবে ছড়িয়ে দেয়, তিনি কারুকে পাঁচ টাকা দান করলে সেটা হয়ে যায় পাঁচশো টাকা।
তা অমর দত্তও এখন বড় মানুষ হয়েছে। ক্লাসিক থিয়েটারের দারুণ রমরমা, সেই তুলনায় অন্য সব থিয়েটার প্রায় কুপোকাত বলতে গেলে। অমন গৌরবময় স্টার থিয়েটার, সেখানে যদি বা কোনওদিন ফুল হাউজ হয়, তাতে ওঠে বড় জোর আট-ন’ শো টাকা। আর ক্লাসিকের ফুল হাউজে ওঠে বাইশ-তেইশ শো টাকা। এটা নিছক বাগাড়ম্বর না সত্য, তা পরীক্ষা করার জন্য অন্য থিয়েটারের লোকেরা গোপনে টিকিট কেটে ক্লাসিকের শো দেখতে আসে। অবস্থা দেখে তাদের চক্ষু চড়ক গাছ। বর্ধিত মূল্যের টিকিটে সব আসন পূর্ণ তো বটেই, বহু দর্শক আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও রাজি।
অমরেন্দ্রর হাতে এখন প্রচুর টাকা, সে টাকা ব্যয় করতেও তার কার্পণ্য নেই। সঞ্চয়ের মধ্যে কোনও গরিমা নেই, কিন্তু যে ব্যক্তি দু’হাতে টাকা ছড়ায়, তার চরিত্র অনেক বেশি বর্ণময় হয়ে ওঠে। অমরেন্দ্র তার দলের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রায়ই বেতন বৃদ্ধি করে। নানান উৎসবে থোক টাকা দেয়, বাইরের কোনও অভাবী মানুষ এসে সাহায্য চাইলেও সে উদার হস্ত।
এক সময় বখামি-নষ্টামিতে যার জুড়ি ছিল না, যে ছিল তার বংশের কলঙ্কস্বরূপ, ইয়ার বক্সিদের নিয়ে নেশা ও ব্যাভিচারে মত্ত হয়ে বহু জনের কাছে নিন্দিত হয়েছে। আজ সে সার্থক ও ধনবান, মুছে গেছে তার পূর্বের সব কলঙ্ক। এখন সে যদিও মাত্র ছাব্বিশ বছরের যুবা, তবু সমাজের একজন মান্যগণ্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছে, শুধু জনপ্রিয় নট নয়, সে এখন সাহিত্যিক ও সম্পাদক, বিদ্বজ্জনের সভায় সে আমন্ত্রণ পায়। যে-কোনও বিষয়ে তার মতামতের বিশেষ মূল্য আছে।
অল্প বয়সে তার সঙ্গী-সাথী ছিল কিছু মাতাল ও লম্পট, এখন বিশিষ্ট ভদ্রজনেরা তার বন্ধুস্থানীয় হয়ে উঠেছে, তারা নিয়মিত তার সঙ্গে এসে আড্ডা দেয়। উত্তম পান-আহার সব অমরেন্দ্রনাথের খরচায় তো বটেই, তা ছাড়াও অমরেন্দ্র অনেকেরই যাওয়া-আসার গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত দিয়ে দেয়। চুনিলাল-মানিকলাল-মদনলাল নামের এইসব শিক্ষিত ব্যক্তিদের চাটুকারিতা অতি সূক্ষ্ম, প্রশংসার প্রলেপে থাকে তোষামোদ, পরামর্শ দেবার ছলে এরা অপরের নিন্দায় অমরেন্দ্রর কানভারী করে।
অমরেন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা কিছুতেই খর্ব করা যাচ্ছে না দেখে শত্রুপক্ষের কেউ কেউ তাকে অন্যভাবে নষ্ট করার জন্য তার মোসাহেবদের দলে ভিড়ে পড়েছে। ঠিক সময়ে দংশন করার জন্য তারা সুযোগের সন্ধানে আছে।
বাংলা রঙ্গালয়ের প্রখ্যাত নট-নটীদের মধ্যে একমাত্র অর্ধেন্দুশেখর ছাড়া আর সকলেই একে একে যোগ দিয়েছেন ক্লাসিকে। স্বয়ং গিরিশচন্দ্র চুক্তিতে আবদ্ধ, তিনি শুধু ক্লাসিকের জন্যই নাটক লিখবেন, এখানেই অভিনয় করবেন। গিরিশচন্দ্র বঙ্কিমের উপন্যাস থেকে বেছে নাট্যরূপ দিলেন তার প্রতিটিই দারুণ জনপ্রিয় হল। পরবর্তী মৌলিক নাটক ‘পাণ্ডব গৌরব আরও সার্থক, দর্শকরা যেন ছুটে ছুটে আসছে। অমরেন্দ্রনাথ একই দিনে দুটি শো-এর প্রবর্তন করলেন, দুটি শো-তেই প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ।
গিরিশচন্দ্র-অমরেন্দ্রনাথ এই যুগলবন্দী অন্য থিয়েটারওয়ালাদের আরও চক্ষুশূল হল। এই জুটি ভাঙা দরকার। চুনিলাল নামে একজন মোসাহে একদিন গিরিশচন্দ্রকে গিয়ে বলল, ও মশাই, কালে কালে হল কী? ইন্ডিয়ান মিরার পত্রিকায় কী লিখেছে দেখেছেন?
গিরিশচন্দ্র নিজ গৃহের বৈঠকখানায় তাঁর আর পাঁচজন চাটুকার নিয়ে বসেছিলেন। মুখ তুলে বললেন, না দেখিনি, কী লিখেছে?
চুনিলাল পকেট থেকে সংবাদপত্রখানা বার করে বলল, এই দেখুন, লিখেছে যে, বাবু অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, রাইটলি কল্ড বাই দা থিয়েটার গোয়িং পাবলিক, দা গ্যারিক অফ দা বেঙ্গলি স্টেজ….
অন্নদা হা-হা করে হেসে উঠে বলল, গ্যারিক অফ দা বেঙ্গলি স্টেজ, অ্যাাঁ!
এককালে ইংল্যান্ডের সুপ্রসিদ্ধ অভিনেতা গ্যারিকের সঙ্গে গিরিশচন্দ্রেরই তুলনা দেওয়া হত, তাঁকে বলা হত বঙ্গের গ্যারিক।
চুনিলাল বলল, স্টেজে লম্পঝম্প করলেই বুঝি গ্যারিকের তুল্য অ্যাকটর হওয়া যায়? অমর দত্ত কি আপনার নখের যুগ্যি?
গিরিশচন্দ্র বললেন, না, না, অমর বেশ ভালই করে। বয়েসটা কত কম, চেহারায় ছিরিছাঁদ আছে, আমাদের এখন বুড়ো হাড়ের খেলা!
এবার অন্য একজন বলল, তা বলে আপনার খেতাব ওর মাথায় কি মানায়? আপনিই বঙ্গের গ্যারিক, চিরকাল তাই থাকবেন। অমর দত্ত আজ আছে, কাল টিকবে কি না কেউ জানে!
গিরিশচন্দ্র বললেন, কাগজে এখন ছেলে-ছোঁকরারা লেখে, ওরা বিশেষ কিছু জানে না। অজ্ঞদেরই তো পণ্ডিতি করার দিন এসেছে।
চুনিলাল সঙ্গে সঙ্গে বলল, জানলেও জ্ঞানপাপী। অমর দত্ত তো বলে বলে লেখায়! এই যে চতুর্দিকে অমরবাবুর এত প্রশংসা বেরুচ্ছে, সবই তো টাকা খাইয়ে লেখানো! ক্লাসিকের যে-সব হ্যাঁন্ড-বিল বেরোয়, তাতেও বড় বড় করে নিজের নাম লেখা থাকে, আপনার নাম থাকে ছোট অক্ষরে, কোনও কোনওটায় থাকেই না–
আর একজন বলল, সেদিনকে দেখি, খুব গরমের জন্য হলের মধ্যে হাত-পাখা বিলি হচ্ছে। সেই হাত-পাখার একদিকে অমর দত্তর ছবি, আর একদিকে নয়নমণির ছবি। আপনি বুঝি কেউ না!
চুনিলাল বলল, আম্পর্ধা কেমন বেড়েছে জানেন! আমি নিজের কানে শুনেছি। অমরবাবু একদিন বলছিল, গিরিশবাবুর নাটকই হোক আর যার নাটকই হোক, টিকিট তো বিক্রি হয় আমার নামে! গিরিশবাবুকে এমনিই রেখেছি, আমি নিজে নাটক লিখলেও সমান চলত!
গিরিশের ভক্তরা হই হই করে উঠল।
একজন বলল, অতি দর্পে হতা লঙ্কা! সেই যে কথায় আছে না, অতি বাড় বেড়ো নাকো ঝড়ে পড়ে যাবে–অমর দত্তরও সেই অবস্থা হবে!
বিদায় নেবার আগে একটা মোক্ষম টিপ্পনী দিল চুনিলাল। সে গিরিশচন্দ্রের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, আপনি ক্লাসিকে সামান্য মাস মাইনেতে বাঁধা থাকবেন, এটা একটা লজ্জার কথা নয়? অমর দত্তর পকেটে টাকা ঝমঝম করছে। আপনার উচিত লভ্যাংশ দাবি করা।
কথাটা গিরিশচন্দ্রের মনে লেগে গেল।
চুনিলাল সন্ধেবেলাতেই গুটি গুটি করে যোগ দিল অমর দত্তের মজলিশে। সেখানে পারিষদরা অমরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চুনিলালও এক কাঠি ওপরে গলা তুলে দিল। বাংলা থিয়েটারে অমর দত্ত যা কীর্তি রেখে যাচ্ছে, তা ন ভূতো ন ভবিষ্যন্তি!
খানিক বাদে চুনিলাল লক্ষ করল, মানিকলাল নামে এক স্যাঙাৎ বুদ্ধিতে আর সবাইকে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে। এই মানিকলাল নিশ্চিত মিনাভা থিয়েটারের চর। কথার মারপ্যাঁচে সে অমর দত্তর মুখ দিয়ে ইংরেজ সরকার বিরোধী কোনও মন্তব্য বার করার চেষ্টা করছে।
অমর দত্ত কট্টর ইংরেজভক্ত। কথায় কথায় সে বলে, আমি রাজানুরক্ত প্রজা। আজ বুয়র যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠেছে। এখন এ আলোচনা সর্বত্র। বুয়র যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে বটে, কিন্তু দিগবিজয়ী ইংরেজের অতুলনীয় পরাক্রমের যে ভাবমূর্তি ছিল, তাতে ধাক্কা লেগেছে প্রচণ্ড।
উর্বর ভূমি ও মূল্যবান খনিজের আকর্ষণে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতি বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছে দু-তিন শতাব্দী ধরে। একদল ওলন্দাজ সেখানে যায় প্রথমে, স্থানীয় হটেনটট মেয়েদের বিয়ে করে সেখানে একটি মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়, তাদেরই বলে বুয়র। পরে কিছু কিছু দেশত্যাগী জামান, ফরাসি, সুইডিশও এদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর ইংরেজরা গিয়ে সেখানে পুরোপুরি আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। স্বাধীনতাপ্রিয় বুয়ররা ইংরেজদের অধীনে থাকতে রাজি হয়নি, তারা ইংরেজ এলাকা থেকে সরে গিয়ে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট ও ট্রান্সভাল-এ নিজেদের রাজ্য স্থাপন করেছিল। বেশ কিছুকাল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন অরেঞ্জ নদীর তীরে পাওয়া গেল একখণ্ড হিরে, আরও কিছু বছর পর ট্রান্সলে পাথুরে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে একদল দেখতে পেল ঝকঝক করছে স্বর্ণরেণু। হিরে ও সোনার লোভে সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে যেতে লাগল ভাগ্যান্বেষীরা। ইংরেজরা এবার ওইসব অঞ্চলেরও দখল নিতে চাইল। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে মহা শক্তিশালী ইংরেজ বাহিনীকে দু দুবার পরাজয় স্বীকার করে পিছু হঠে আসতে হয়েছিল। তাতেই সারা বিশ্ব সচকিত হয়ে ওঠে। জার্মানি থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছে বটে, তবু সামান্য বুয়রদের এত পরাক্রম! শেষ পর্যন্ত লর্ড কিচেনারের নেতৃত্বে বিশাল ইংরেজ বাহিনী বুয়রদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে, নারী ও শিশুদেরও হত্যা করতে করতে এগিয়েছে। বেশ কয়েক মাস গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি বুয়রেরা। অতি সম্প্রতি তারা শাস্তির আবেদন জানিয়ে সন্ধি করতে চেয়েছে।
যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে বটে ইংরেজরা, কিন্তু তাদের গৌরবে লেগেছে অনেকখানি কালির দাগ। ভারতীয় নেতৃবর্গ বরাবর সমর্থন করেছে ইংরেজদের, কলকাতায় যুদ্ধ চালাবার সাহায্য হিসেবে চাঁদাও ভোলা হয়েছে অনেক টাকা। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যারিস্টার মোহনদাস গান্ধী ইংরেজ প্রভুদের পক্ষে গঠন করেছে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কিন্তু সম্প্রতি অন্য একটি চিন্তার তরঙ্গও খেলে যাচ্ছে কিছু কিছু ভারতীয়ের মনে। সামান্য বুয়ররা যদি ইংরেজ শক্তিকে প্রতিহত করতে পারে, তা হলে এত বড় ভারতবর্ষের মানুষ তা পারবে না কেন? ভারতীয়রা এককাট্টা হয়ে ইংরেজদের এক দারুণ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলতে পারে না? এরকম চিন্তা আগে কেউ প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেনি!
মানিকলাল বলল, মশাই, এই বুয়ররা ইংরেজদের জারিজুরি ফাঁস করে দিয়েছে। খড়ের দেবতা, বুঝলেন, বাইরে এত জাঁকজমক, ভেতরে ভূষি মাল। অনেক দিন ধরে আমাদের সীমান্তে রুশ আক্রমণের কথা শুনে আসছি। রুশ জুজুর কথা উঠলেই ইংরেজরা কেমন ভয় পায় দেখেছেন? রুশদের শক্তি নির্ঘাত বেশি! ওদিকে ফরাসিদের সঙ্গে লড়ালড়ি করতে গিয়ে ইংরেজরা মাঝে মাঝেই লেজেগোবরে হয়। আর একটা নেপোলিয়ান আসুক, ইংরেজদের একেবারে দুরমুশ করে দেবে। জামানরাও মুখিয়ে আছে। আমাদের দেশে ইংরেজরা আর কতদিন লাঠি ঘোরাবে!
অমর জিভ কেটে বলল, আরে ছি ছি, অমন কথা উচ্চারণও করবেন না। ইংরেজ আমাদের লক্ষ্মী। ইংরেজ রাজত্বে আমরা শান্তিতে খেয়ে পরে বেঁচে আছি। এ রাজত্বে সুবিচার আছে। এক হতচ্ছাড়া লর্ড মেয়োকে হত্যা করল, বিচারপতি নর্মানকে একজন মারল, ভাবুন তো স্পর্ধা, রাজার জাতের গায়ে হাত! সরকার কিন্তু খুনিদের কুকুরের মতন গুলি করে মারেনি। বিচারের পর শাস্তি দিয়েছে। তা হলেই বুঝুন!
মানিকলাল বলল, ওসব ন্যায় বিচার তো দেখানেনা। গ্রামে গঞ্জে কত যে অত্যাচার চলছে, তার খবর ক’জন রাখে?
অমর বলল, রাজার জাতের কি অত খুঁটিনাটি দোষ ধরতে আছে! আমাদের জমিদাররা অত্যাচার করে না! আপনার আমার বাড়ির চাকর যদি ঠ্যাঁটাপনা করে, আমরা তাদের চাবকে, লাথিয়ে দূর করে দিই না? সেই তুলনায় ইংরেজ সরকার আর কতটা অত্যাচার করে?
অমরের মুখ দিয়ে ইংরেজ-বিরোধী কথা বার করা যাচ্ছে না দেখে মানিকলাল অন্য চাল দিল। সে পরম হিতৈষীর ভাব করে বলল, অমরবাবুর সঙ্গে তো অনেক সাহেবসুবোর আলাপ আছে। বড় বড় ইংরেজরা আপনাকে যা খাতির করে, এমনটি আর কোনও অ্যাক্টর-ম্যানেজারের ভাগ্যে জোটেনি। এটা আমাদের গর্ব। কী বলল হে, তাই না?
অন্যরা সকলেই বলল, বটেই তো, বটেই তো।
অমর বলল, একটা ভোজসভায় লাটসাহেবের পাশে আমায় বসতে দিয়েছিল। লাটসাহেব আমাকে বাংলা থিয়েটারের কথা জিজ্ঞেস করলেন। আপনারা বোধ করি জানেন না। প্রধান বিচারপতি স্যার ফ্রানসিস ম্যাকলিন বাহাদুর আমাদের অভিনয় দেখেছেন, প্রশংসা করে চিঠি দিয়েছেন?
মানিকলাল বলল, তা হলে এক কাজ করুন না। একদিন ক্লাসিক থিয়েটারে লর্ড কার্জনকে অভিনয় দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান। লর্ড কার্জন আপনার অভিনয় দর্শন করতে এলে আপনার সুনাম, ক্লাসিকের সুনাম দশ গুণ বেড়ে যাবে!
অমর আমতা আমতা করে বলল, লর্ড কার্জন! তাঁকে কখনও স্বচক্ষে দেখিনি। শুনেছি তাঁর খুব দেমাক, হবে না কেন, কত বড় বংশের মানুষ! নেটিভদের সঙ্গে তিনি দেখা করেন না। আমি লাটসাহেব বলতে বুঝিয়েছি ছোটলাট স্যার জন উডবার্ন। কী মিষ্টভাষী, কী সহৃদয় মানুষ, প্রায় তিন কোয়াটার কাল তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
মানিকলাল বলল, তা হলে ছোটলাটকেই আনার বন্দোবস্ত করুন। তিনিই তো বঙ্গেশ্বর।
অমর বলল, এক গাঁয়ে চেঁকি পড়ে, আর এক গাঁয়ে মাথা ব্যথা। হচ্ছিল রাজনীতির আলোচনা, এর মধ্যে আবার ক্লাসিককে টেনে আনলেন কেন?
মানিকলাল আর পাঁচজনের সমর্থন নিয়ে জোর দিয়ে বলতে লাগল, না, না, ছোটলাটকে আনতেই হবে। আপনি বললে তিনি অবশ্যই রাজি হবেন। ক্লাসিকে দলবল নিয়ে ছোটলাটবাহাদুর এলে অন্য সব থিয়েটারের থোঁতা মুখ আরও ভোঁতা হয়ে যাবে। আমরা তা দেখে মজা লুটব।
সকলের উৎসাহবাক্যে অমরও উত্তেজিত হয়ে উঠল।
চুনিলাল প্রথমে ঠিক বুঝতে পারেনি, মানিকলের আসল মতলবটা কী? ছোটলাটকে এনে ক্লাসিকের মান বাড়াবার জন্য তার এত গরজ কেন? একটু পরে কারণটা বুঝতে পেরে সে আড়ালে মুখ মুচকে হাসতে লাগল।
অমর একবার গোঁ ধরলে ছাড়ে না। কথা যখন উঠেছে, তখন ছোটলাটকে আনতেই হবে। ইন্ডিয়ান মিরার-এর সম্পাদককে ধরে ছোটলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হল। বেলভেডিয়ারে স্যার জন উডবার্ন অমর দত্তকে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন, পূর্ব পরিচিতের মতন অন্তরঙ্গভাবে কথা বললেন তার সঙ্গে। স্যার জন উডবার্ন ক্লাসিক থিয়েটারে শেক্সপিয়ারের নাটকের বাংলা নাট্যরূপ দেখতে যেতে রাজি।
গিরিশচন্দ্র অনূদিত ম্যাকবেথের অভিনয় হবে। একটি দিন নির্দিষ্ট হবার পর কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল বড় করে। শহরের দেওয়াল ছেয়ে গেল পোস্টারে, হ্যাঁন্ডবিল বিলি হল হাজার হাজার।
এইবার শুরু হল মানিকলালদের তৎপরতা। বেনামে গোছ গোছ চিঠি যেতে লাগল ছোটলাটের দফতরে। সেই সব চিঠি ক্লাসিকের নিন্দা কুৎসাপূর্ণ। ক্লাসিক থিয়েটারের পরিবেশ যে কত দূষিত, সেখানে অভিনয়ের নামে যে শুধু বেলেল্লাপনা চলে, কোনও ভদ্ৰশ্রেণীর দর্শক সেখানে যায় না, এইসব লেখা হতে লাগল সাত কাহন করে।
বেলভেডিয়ার থেকে স্যার জন উডরার্নের বকলমে একটা চিঠি এল। সেক্রেটারি লিখেছে, বাংলার গভর্নর অবগত হয়েছেন যে ক্লাসিক রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীগণ ভদ্র বংশস্যুতা নহে, তারা সব চরিত্রহীনা যুবতী। এই রঙ্গমঞ্চের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। এ সব সংবাদ সত্য কিনা অবিলম্বে জানানো হোক, আপাতত ছোটলাট বাহাদুরের পক্ষে থিয়েটার দেখতে যাওয়া সম্ভব নয়।
চিঠি পেয়ে অমর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। শুধু যে ছোটলাটের আগমনবার্তা বহুল-বিজ্ঞাপিত হয়েছে তাই-ই নয়, এই উপলক্ষে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, বাকি সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে তিন দিন আগে। এখন অমর দত্তর মান-সম্মান ধুলোয় লুটোবে, সকলেই মনে করবে, সে মিথ্যেবাদী। আনন্দে নৃত্য করবে তার শত্রুপক্ষ।
থিয়েটারের মেয়েরা চরিত্রহীনা! ভদ্রঘরের মেয়েরা রঙ্গমঞ্চে নাচতে আসবে নাকি? খোদ ইংল্যান্ডের থিয়েটারের মেয়েরা বুঝি সব সতীসাধ্বী? ঢের জানা আছে। নাট্যকলা ও অভিনয় দর্শনের সময় নট-নটীদের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার কী? বিলিতি সমাজেও এই একই অবস্থা।
রাগে-অপমানে একা একা ফুসতে লাগল অমর। তার চাটুকারেরা এখন আর কেউ ধারে কাছে নেই। এই বৃহস্পতিবারের অভিনয়ে ঘোটলাট যে আসবেন না, সে সংবাদ এর মধ্যেই রটনা হয়ে গেছে।
ঘরের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল নয়নমণি, সে একটি দশ-এগারো বছরের বালিকার হাত ধরে আছে। সে এসব বিষয়ে কিছুই জানে না।
নয়নমণিকে ইদানীং খানিকটা সমীহ করে অমর। এ যুবতাঁকে নিজের অঙ্কশায়িনী করার অনেক চেষ্টা করে সে ব্যর্থ হয়েছে। সে বুঝে গেছে, নয়নমণি অন্য ধাতুতে গড়া। এখন অনেকটা বন্ধুর মতন সহজ সম্পর্ক। নয়নমণি সরলা ঘোষালের কাছে নিয়মিত যাতায়াত করে, সেই সুবাদে ঠাকুর পরিবারের অনেকেই এখন ক্লাসিকে থিয়েটার দেখতে আসে।
নয়নমণি বলল, অমরবাবু, এই মেয়েটির নাম পুঁটি। একে আপনার থিয়েটারে একটা কাজ দিতে হবে।
অমর বালিকাটিকে দেখল ভাল করে। মাথার উস্কোখুস্কো চুল ধুলোমাখা, খুব সম্ভবত উকুনে ভর্তি! অতিশয় রোগা, না খেতে পাওয়া চেহারা। একটা শতচ্ছিন্ন শাড়ি শরীরে জড়ানো, শুধু চক্ষু দুটি হরিণীর মতন ডাগর, ভয়ে সে যেন কুঁকড়ে আছে।
অমরের মাথায় এখন অনেক চিন্তা, অন্য কেউ এ সময়ে তাকে বিরক্ত করতে এলে, সে ‘দূর হয়ে যা’ বলে চিৎকার করে উঠত। কিন্তু নয়নমণির সঙ্গে সে রকম ব্যবহার করা যায় না। মেজাজ দমন করে সে জিজ্ঞেস করল, একে কোথায় পেলি?
নয়নমণি বলল, রাস্তায় ভিক্ষে করছিল। আজই আসার পথে দেখে গাড়িতে তুলে নিলাম। মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে ওর বাড়ি। সাত বোন, তিন ভাই। মা নেই, ওর বাবা ওকে শিয়ালদা স্টেশনের কাছে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। তিন দিন ধরে রাস্তাতেই আছে মেয়েটা।
অমর বলল, বেড়াল পার করে গেছে। তা এরকম তো আরও কত আছে। রাস্তা থেকে কোনও মেয়েকে তুলে আনলেই কি তাকে থিয়েটারের কাজ দেওয়া যায়?
নয়নমণি বলল, আমিও তো রাস্তা থেকেই এসেছি। ওকে আমি শিখিয়ে-পড়িয়ে নেব। গলার আওয়াজ ভাল।
অমর বলল, এ মেয়েকে দিয়ে কোনও কাজ হবে না। এত রোগা মেয়ে থিয়েটারে চলে না। তোর যদি দয়া হয়ে থাকে, ওকে অন্য কাজ দিচ্ছি। আমার বাড়িতে বাসন মাজার জন্য একজন দরকার। আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দে। খেয়ে পরে থাকবে।
নয়নমণি দৃঢ় স্বরে বলল, না। একবার দাসী বাদির কাজ জুটিয়ে দিলে সেই কাজই করতে হবে সারাজীবন। ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে কি না দেখা যাক না চেষ্টা করে। যদি গুণ থাকে– একটু ভাল করে খেতে দিতে পারলেই বোগা চেহারা সেরে যাবে। আমিও এক সময় অমনি বোগা ছিলাম।
অমর জিজ্ঞেস করল, যতদিন নিজের পায়ে না দাঁড়ায়, ততদিন থাকবে কোথায়?
নয়নমণি বলল, আমার কাছে রেখে দেব। কেউ যাতে ওকে নষ্ট না করে, তা আমি দেখব।
অমর এবার হো-হো করে হেসে উঠল। অকস্মাৎ সেই হাসির মর্ম বুঝতে পারল না নয়নমণি, বিস্মিতভাবে চুপ করে গেল সে।
অমর বলল, তোর মতন মেয়েও তো আছে থিয়েটারে। তা ক’জন জানে? এই পত্ৰখানা দ্যাখ, ও তুই তো ইংরেজি পড়তে পারবি না, এতে কী লিখেছে জানিস? ক্লাসিকে ছোটলাটের আসার কথা ছিল, উনি আসতে পারছেন না, তার কারণ, উনি শুনেছেন, ওঁকে শোনানো হয়েছে, আমাদেরই বাঙালি চুকলিখোররা ওঁর কান ভাঙিয়েছে যে এখানকার সব অ্যাকট্রেসরা কুলটা। ইচ্ছে করে, তোকে নিয়ে গিয়ে একবার দেখাই। এ মেয়ে যদি কুলটা হয়, তবে সতী কে?
নয়নমণি মৃদু স্বরে বলল, থিয়েটারের মেয়েরা যদি কুলটা হয়, তবে পু রা কী? তাদের নিয়ে বুঝি প্রশ্ন ওঠে না?
অমর আবার হাসতে হাসতে বলল, পুরুষমানুষরা সব কুকুরে পেচ্ছাপ করা ধোওয়া তুলসিপাতা।
নয়নমণি বলল, পুরুষ ছাড়া কি মেয়েরা নষ্ট হতে পারে? এক হাতে তালি বাজে? এসব কথা শুনলে আমার গা জ্বলে যায়। লাটসাহেব না এলেই বা ক্ষতি কী? তাকে খাতির করে ডেকে আনবারই বা কী দরকার! আপনার থিয়েটারে কি দর্শক কমেছে?
ঘরে আরও দু’তিনজন লোক ঢুকে পড়ায় সেদিনকার মতন আর কথা হল না।
বৃহস্পতিবার দিন অভিনয় শুরু হবার আগে অমর দত্তকে মঞ্চে এসে ক্ষমা চাইতে হল। বেলভেডিয়ার থেকে পূর্বে প্রেরিত আরও দু-তিনখানা পত্র থেকে অংশ বিশেষ পাঠ করে তাঁকে প্রমাণ দাখিল করতে হল যে ঘোটলাট সত্যিই আসার জন্য কথা দিয়েছিলেন, মাত্র দুদিন আগে বাতিল করেছেন। অন্য থিয়েটারের ভাড়া করা কিছু লোক দর্শকদের মধ্যে মিশে থেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ধ্বনি তুলল।
এ রাতের অভিনয়ও তেমন জমল না। নির্দিষ্ট কয়েকটা জায়গায় হাততালি পাওয়া গেল বটে, কিন্তু যারা অভিনয় করে, তারা ঠিক বোঝে, কোথায় তাল কেটে যাচ্ছে। নিজের অভিনয় আশানুরূপ না হলেই অমর দত্তর মেজাজ খিঁচড়ে যায়।
লাটসাহেবের হুজুগ তুলে অমর দত্তকে অপদস্থ করায় মানিকলের দল খুশি। এবার শুরু হবে চুনিলালর খেলা। এখন অমরের মন দুর্বল হয়ে আছে, মেজাজ ক্ষিপ্ত, এই তো সময়!
নিজের ঘরে মদের বোতল খুলে একা বসে আছে অমর, এই সময় চুপিচুপি চুনিলাল সেখানে হাজির। গলায় মধু মিশিয়ে সে বলল, মাত, একেবারে মাত! আমি তো গেটের বাইরে দাঁড়িয়েছিলুম, দর্শকদের সব কথা শুনেছি। সবাই বলতে বলতে গেল, অমর দত্ত একাই একশো। অমর দত্তর কী রূপ, কী তেজ, কী কণ্ঠস্বর, এমনটি আর আগে কখনও দেখিনি। টিকিটের পাই-পয়সা পর্যন্ত উসুল হয়ে যায়। দু-চারজন যে গণ্ডগোল করেছিল, তারা মিনাভার ভাড়া করা লোক!
অমর ভুরু কুঁচকে বলল, মিনাভা থেকে তাদের পাঠিয়েছে?
চুনিলাল বলল, আলবাত। আমি নিজের কানে শুনেছি। অন্য দর্শকরা তাদের এই মারে কি সেই মারে। আর একটু হলে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেত। এখন সর্বত্র আপনার জয়জয়কার। কিন্তু একটা ব্যাপার দেখলেন, গিরিশবাবু আজ আসেননি?
অমর বলল, উনি তো রোজ আসেন না। এখন পার্টও করেন না।
চুনিলাল বলল, তবু আজকের দিনে, তাঁরও কি উচিত ছিল না স্টেজে আপনার পাশে দাঁড়ানো? উনি ক্লাসিকের মাইনে খান, সংকটের সময় দায়িত্ব নেবেন না? গিরিশবাবুর ভাবখানা যা দিন দিন দেখছি, উনি মনে করেন, ক্লাসিকের উঠতি-পড়তি যা হয় হোক, মাস গেলে ওঁর টাকাটা পেলেই হল। বছরে চারখানা নতুন নাটক দেবার চুক্তি, ক’খানা দিয়েছেন?
অমর বলল, দেখুন চুনিবাব, গিরিশবাবুর ভরসায় এখন আমার এই থিয়েটার চলে না। ওনাকে রেখেছি, তার কারণ, উনি বাংলা থিয়েটারের আদি গুরু, ওঁকে সম্মান দেখানো উচিত। বয়েস হয়েছে, এখন আর তেমন লিখতে পারেন না, অভিনয়েও তেমন দাপট নেই, তাতেই বা কী আসে যায়। উনি আছেন থাকুন, এই তো যথেষ্ট। ওকে টাকা দিতে আমার গায়ে লাগে না।
চুনিলাল ভাবাচ্ছন্ন হয়ে বলল, আপনি কত বড় উদার মানুষ, তাই এই কথা বললেন আহা! এমন নিঃস্বার্থ কথা এ যুগে কে বলে? তবে গিরিশবাবু কী বলে বেড়াচ্ছেন জানেন? তাঁর নামের জোরেই। নাকি দর্শক আসে। উনি বুড়ো হয়েছেন বটে, কিন্তু কুটবুদ্ধি কম নয়। আপনাকে নতুন নাটক দেন না, কিন্তু গোপনে গোপনে মিনাভাকে নাটক লিখে দিচ্ছেন ঠিকই। পাণ্ডব গৌরব-এর রিহার্সালের সময় উনি ভীমের পার্টটা ওঁর ছেলে দানিকে দিতে চেয়েছিলেন মনে আছে?
অমর বলল, এ নাটকে ভীমের পার্ট সব চেয়ে বড় পার্ট। সে পার্টে দর্শকরা আমাকেই চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
চুনিলাল বলল, উনি কিন্তু আপনাকে দমিয়ে নিজের ছেলে দানিকে এখন ওপরে ভোলার জন্য ব্যস্ত!
অমর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নেড়ে বলল, দানি রাগ করে স্টারে চলে গেছে। সেখানে গিয়ে সে যদি কেরানি দেখাতে পারে তো দেখাক। কিন্তু গিরিশবাবু মিনাভার জন্য নাটক লিখে দিচ্ছেন, আপনি ঠিক জানেন?
চুনিলাল বলল, এ আবার নতুন কথা নাকি? এক দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, অথচ গোপনে গোপনে অন্য দলের জন্য নাটক লিখে দিয়েছেন, এমন কতবার হয়েছে! আপনি খবর নিন অমরবাবু, মিনাভা অনেক টাকা ঢালছে। গিরিশবাবু সেখানে গেলেন বলে!
অমর নিজের মাথার চুল মুঠো করে চেপে ধরে বলল, বটে! আমার সঙ্গে ফেরেববাজি! ওই বুড়ো ভামকে আমি দেখাচ্ছি মজা।
পরের দিনই এলেন গিরিশবাবু। তাঁর জন্য একটি পৃথক ঘর থাকে, ইদানীং তিনি মহড়াতেও অংশ নেন না, অভিনয় শিক্ষা দেবার দায়িত্বও অমরের ওপর, গিরিশবাবু এসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে চলে যান। অমর সে ঘরে ঢুকে আরও যে তিনজন আড্ডাধারী ছিল তাদের দিকে তাকিয়ে কঠোরভাবে বলল, ওঁর সঙ্গে আমার কাজের কথা আছে, আপনারা সরে পড়ুন।
গড়গড়ার নলে মুখ দিয়ে টানতে টানতে গিরিশচন্দ্র বললেন, বসো অমর, হঠাৎ এমন কী জরুরি কাজ পড়ল?
বসল না অমর, একটা চেয়ারের পেছন ধরে দাঁড়িয়ে, বিনা ভূমিকায় জিজ্ঞেস করল, আপনি মিনাভা থিয়েটারে যোগ দিচ্ছেন?
গিরিশচন্দ্র একগাল হেসে বললেন, ও, এই কথা? কারা এসব রটায়? দেখো, যখনই কেউ নতুন করে একটা নতুন থিয়েটারের দল খোলে, তখন প্রথমেই তারা আমার কাছে এসে সাধাসাধি করে। এ রকম ভো কতকালই চলছে!
অমর বলল, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। মিনাভায় যোগ দিচ্ছেন?
গিরিশচন্দ্র হাসিটি বজায় রেখে বললেন, আমি পেশাদার থিয়েটারওয়ালা। এক দলে কাজ করছি, অন্য দল এসে যদি বেশি টাকার থলে নিয়ে চোখের সামনে নাড়ায়, তা হলে কি মাথার ঠিক রাখা যায়? একজন পেশাদারের পক্ষে তাতে রাজি হওয়াও দোষের কিছু নয়। তুমি আমায় বড় কম টাকা দিচ্ছ, অমর!
কে অমর ভুরু তুলে বলল, কম টাকা! তিনশো টাকার বেশি কোনও থিয়েটারে আর কেউ পায়? তার বিনিময়েই বা আমি কী পাচ্ছি? বছরে চারখানা নাটক দেবার কথা, কটা দিয়েছেন? পুরনো নাটক দিয়ে প্রায়ই আমাকে চালাতে হয়।
গিরিশচন্দ্র বললেন, অনেক লিখেছি। স্টেজে অনেক দাপাদাপি করেছি। এখন আর ওসব করতে হবে কেন? আমার নামটাই তো যথেষ্ট। আমার নামে দর্শকরা আসে। অমর, আমার ওই মাস মাইনেতে পোষাচ্ছে না। তুমি এখন থেকে আমাকে অংশীদার করে নাও, লাভের একটা অংশ আমার চাই।
অমর আহত বিস্ময়ে বলল, লাভের অংশ! অনেক খেটেখুটে, নিজের রক্ত জল করে আমি ক্লাসিককে দাঁড় করিয়েছি। যে-কোনও নাটক জমিয়ে দেবার ক্ষমতা আমার আছে। লোকে আমাকে দেখতে আসে। আমার জ্বরজ্বারি হলে দু-তিন নাইট অ্যাপিয়ার করতে না পারলে টিকিট বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়! আপনার নামে দর্শকরা আসে? হাঃ! এসব কে বুঝিয়েছে আপনাকে? আপনাকে আমি রেখেছি, সম্মান দেখাবার জন্য। আপনি নটগুরু, আমি সাষ্টাঙ্গে আপনার পায়ের ধুলো চাটতেও রাজি আছি। আপনি ওই সম্মানের আসনেই থাকুন, জনপ্রিয়তার খোয়াব দেখবেন না।
গিরিশচন্দ্র বললেন, সম্মান কি আমি ধুয়ে খাব? তুমি যদি লাভের বখরা দিতে না চাও, যে আমায় বেশি টাকা দিয়ে ডাকবে, আমি সেখানেই যাব।
রাগে জ্বলে উঠে অমর বলল, না, আপনি যেতে পারেন না। আমার সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি আছে, মাস মাস তিনশো টাকা ছাড়াও আপনাকে গুচ্ছের বোনাসের টাকা দিয়েছি। চুক্তি ভাঙলে আপনি আইনের ফাঁসে পড়বেন!
গিরিশচন্দ্র বললেন, ওসব আইন-টাইন আমি কখনও গ্রাহ্য করিনি।
অমর বলল, আর একটা সত্যি কথা বলব? আপনার নাটক তো অন্য থিয়েটারেও চলে, সেখানে ক্লাসিকের মতন দর্শক যায় না কেন? আপনি বরাবরই দল ভাঙাভাঙিতে ওস্তাদ। এ পর্যন্ত কতবার কত দল ছেড়েছেন, তার ইয়ত্তা আছে! আপনার অত সাধের স্টার থিয়েটার, প্রায় আপনার নিজের হাতে গড়া, সেখানেও আপনি টিকতে পারেননি কেন? অন্য কেউ মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে আপনার সহ্য হয় না। ষড়যন্ত্র করে আপনি বড় বড় দলগুলো ভেঙেছেন, কত মালিকের সর্বনাশ হয়ে গেছে, কত নটনটী পথের ভিখিরি হয়েছে, কিন্তু আপনার গায়ে কখনও আঁচড়ও লাগেনি! এখন মিনাভার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্লাসিককে চোরাগোপ্তা দিতে চান, তাই না?
গিরিশচন্দ্র বললেন, অমর, তোমার মাথা গরম হয়ে গেছে। আজকাল তুমি ধরাকে সরা জ্ঞান করো। তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ, ভুলে যাচ্ছ।
অমর বলল, না, মোটেই ভুলিনি। আপনি নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ, আমি সামান্য অভিনেতা হিসেবে আপনাকে মাথায় তুলে রাখতে রাজি আছি। কিন্তু ম্যানেজার হিসেবে আপনার অন্যায় আবদার বরদাস্ত করতে রাজি নই। ভাল কথা বলছি শুনুন, আপনাকে আর খাটাখাটনি করতে হবে না, থিয়েটারেও আসতে হবে না। বাড়িতে বসে বিশ্রাম নিন। নাটক লিখতে ইচ্ছে হয় লিখবেন, নয়তো লিখবেন না। মাস মাস আপনার মাইনের টাকা বাড়িতে ঠিক পৌঁছে যাবে। এ বুড়ো বয়েসে আর অন্য দলে যোগ দিয়ে ধ্যাস্টামো করতে যাবেন না!
গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে এভাবে কথা বলার সাহস পায়নি কেউ কখনও। তাঁর চক্ষু দুটি রক্তবর্ণ ধারণ করল, বৃদ্ধ সিংহের মতন তিনি একবার মাথা ঝাঁকালেন। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি যদি আজই চলে যাই, অন্য দলে যোগ দিই, আমাকে কেউ বাধা দিতে পারবে?
অমর দর্পের সঙ্গে বলল, তা হলে চুক্তিভঙ্গ করার দায়ে আমি আপনার নামে মামলা করতে বাধ্য হব।
গিরিশচন্দ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন, অমরের কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, ঠিক আছে, অমর, এরপর তোমার সঙ্গে আমার আদালতে দেখা হবে।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন গিরিশচন্দ্র। এতক্ষণ দু’জনেরই কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে উঠেছিল বলে সমস্ত নাট্যকর্মীরা ভিড় করে এসে শুনছিল। তারা আড়ষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইল গিরিশচন্দ্রের দিকে। যে যে-থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত থাকুক না কেন, গিরিশচন্দ্রের সামনে সকলেই শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে। আজ গিরিশচন্দ্রের এবংবিধ অপমানে তারা জড়বৎ হয়ে গেল। ট গিরিশচন্দ্র কারুর দিকে তাকালেন না, হাতের ছড়িটি ঘোরাতে ঘোরাতে রঙ্গমঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
অমরও গটগটিয়ে চলে এল নিজের কক্ষে। এ সময় তার সামনে যাওয়া আর তোপের মুখে পড়া একই কথা। এখন সে কিছুক্ষণ নিজের মনে গজরাবে। দু’এক ঢোঁক মদ্যপান করতে করতে আয়নার সামনে মুখবিকৃতি করবে নানা রকম। আজ আর কেউ কোনও কাজের কথাও বলতে যাবে না তাকে।
একমাত্র নয়নমণিরই সাহস আছে, সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। অমরের ঘরে ঢুকে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। অমর মুখ ঘুরিয়ে তাকাল, রাগে ফেটে পড়ল না, চেয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। মঞ্চে অভিনয়ের সময় ছাড়া মহড়াতেও সে সাজগোজ বা প্রসাধন করে না। একটা কস্তা ডুরে ডুরে শাড়ি পরা, আঁচলটা কাঁধে জড়ানো, মাথার চুল খোলা, চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট। হাত দুটি নিরাভরণ, একটি হাত টেবিলের ওপর রাখা, নর্তকীর লাবণ্যময় আঙুল, শুধু আঙুলগুলিই দেখতে ভাল লাগে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অমর বলল, তুই বুঝি আমাকে বকতে এসেছিস?
নয়নমণি বলল, না, আমি, আমরা সকলে কষ্ট পেয়েছি, তাই জানাতে এলাম। আপনি থিয়েটারের মালিক, যাকে খুশি রাখবেন, যাকে খুশি তাড়াবেন। কিন্তু ইনি গিরিশবাবু, আমাদের সবার পিতার মতন, তাঁকে কি এমনভাবে বিদায় করে দেওয়া যায়?
অমর কাতরভাবে বলল, আমি কিছু অন্যায্য কথা বলেছি? কিছু কাজ করবেন না, শুধু টাকা নেবেন, আরও বেশি টাকা চাইবেন, তলে তলে আমার সর্বনাশ করার চেষ্টা চালাবেন, সব আমি সহ্য করব! আর কারুর নাম-ডাক হলে উনি সহ্য করতে পারেন না। আমি নিজের চেষ্টায় এতখানি উঠেছি, এবার আমি নিজে নাটক লিখব, সেই নাটকও দেখার জন্য দর্শকরা হামলে পড়বে। দেখিস, এটা আমার চ্যালেঞ্জ।
নয়নমণি বলল, আপনার সঙ্গে ওঁর মন কষাকষি, সে সব কথা ওঁর বাড়িতে গিয়ে বলতে পারতেন। সবার সামনে ওঁকে অপমান করা কি ঠিক হল?
অমর বলল, তুই কি সবার হয়ে আমাকে ধমকাতে এসেছিস? সবাই এখন আমার বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাবে!
নয়নমণি বলল, সে রকম কিছু না। আমার নিজেরই ভেতরটা কেমন করছে, আমি কেন ছুটে গিয়ে ওঁর পায়ে পড়লুম না। ওর পা আঁকড়ে ধরে বলতে পারতাম, আপনি যাবেন না, আমাদের ছেড়ে যাবেন না!
অমর বলল, তুই পায়ে ধরলেও উনি ঠেলে দিতেন। ওঁর দয়া মায়া নেই। টাকার গন্ধ পেয়েছেন যে! ক্লাসিক থেকেও উনি টাকা কি কম পেয়েছেন? তবু ক্লাসিকের ওপর ওঁর কোনওদিনই টান হয়নি। সেদিনকে, ছোটলাট বাহাদুরের যে আসার কথা ছিল, এলেন না, আমায় কত অপমান সহ্য করতে হল, সেদিন তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়াতে পারতেন না? আমাকে দুটো সান্ত্বনা বাক্যও তো বলতে পারতেন!
নয়নমণি বলল, আপনি যে ঘোটলাটকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, সেটা হয়তো ওঁর পছন্দ হয়নি। ছোটলাটকে ডাকার আগে কি গিরিশবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন?
অমর বলল, আগে জিজ্ঞেস করিনি, কিন্তু পরে জেনেও তত উনি আপত্তি জানাননি!
নয়নমণি বলল, তখন আর আপত্তি জানিয়েই বা কী লাভ? তখন আপনি মেতে উঠেছেন, চতুর্দিকে বিজ্ঞাপন, লাটবাহাদুর আসবেন বলে কত রকম আদিখ্যেতা। আমাদের বাংলা থিয়েটারে সাহেব-সুবোদের ডাকাডাকির এ হ্যাংলামি কেন? আপনি যেচে এ অপমান গায়ে মাখলেন।
অমর একটুক্ষণ চেয়ে রইল নয়নমণির মুখের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, তুই আগের দিনও এই কথাটা বলেছিলি! ছোটলাটকে ডাকা হল, এটা তুইও চাসনি?
নয়নমণি দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, শুনেই আমার কেমন ঘেন্না ঘেন্না করছিল। কেন সাহেবদের করুণার ভিখিরি হতে হবে আমাদের?
অমর বলল, তুই বুঝি সরলা ঘোষালের কাছে যাতায়াত করে এই সব কথা শিখেছিস? কথাটা। হয়তো ঠিক। কে আমাকে উস্কে দিল, অমনি আমি নেচে উঠলাম। নয়ন, তোর সঙ্গে আগে। পরামর্শ করলে আমাকে এমন গুখুরির কাজ করতে হত না! এখন থেকে তোর বুদ্ধি-পরামর্শ নিয়ে চললে হয়তো আমার ভালই হবে। তোর তো কোনও স্বার্থজ্ঞান নেই!
নয়নমণি বলল, স্ত্রীলোকের পরামর্শ নিয়ে আবার কোনও পুরুষমানুষ চলে নাকি? আমি এক তুচ্ছ নারী, আমার আর কী বুদ্ধি আছে! আজকে আমার কথা শুনে একটু নরম হয়েছেন, কাল আপনার পাঁচজন বন্ধু আবার আপনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে!
অমর হতাশভাবে বলল, কে যে বন্ধু, কে যে শত্রু, আজও চিনলাম না! নয়ন, বলতে পারিস, যার আমি কোনও ক্ষতি করিনি, বরং যথাসাধ্য যত্নআত্তি করি, সেও কেন আমার শত্রুতা করে?
নয়নমণি চুপ করে রইল।
মদের বোতলে একটা চুমুক দিয়ে অমর জিজ্ঞেস করল, তোর সেই কুড়নি মেয়েটা কোথায় গেল? সেই পুঁটি, সে আছে এখনও?
নয়নমণি বলল, তাকে আমার কাছে রেখেছি। দুটো একটা গান শেখাচ্ছি। মনে হয় পারবে।
অমর বলল, নিয়ে আসিস, সখীদের দলে ভিড়িয়ে দেব, তুই অনুরোধ করেছিস যখন।
একটু থেমে সে আবার বলল, নয়ন, জানি কোনও দিন তোর ধরা-ছোঁওয়া পাব না। তোর মনেরও তল পেলাম না। তুই ভগবানের এক বিচিত্র সৃষ্টি।
নয়নমণি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এবার যাই।