‘চৈতন্যলীলা’ নাটকের জন্য স্টার থিয়েটারের জয়-জয়কারের ফলে গিরিশচন্দ্র পর পর আরও কয়েকটা ভক্তিরসাত্মক নাটক নামিয়েছিলেন। ‘প্ৰহ্লাদ চরিত্র’, ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘প্রভাস যজ্ঞ,’ ‘বুদ্ধদেব চরিত’। এই সব নাটকগুলিতে ভক্তিবাদের জোর প্রচার হতে লাগল বটে, কিন্তু গিরিশচন্দ্র টের পেয়েছিলেন দর্শকের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। রঙ্গমঞ্চ পুরোপুরি প্রচারকের ভূমিকা নিলে দর্শকরা বিমুখ হবেই। অধিকাংশ দর্শকই থিয়েটারে আসে প্রমোদ উপভোগের জন্য। রস সৃষ্টিই বড় কথা। মহৎ বিষয়বস্তু কিংবা যত বড় আদর্শের কথাই থাক না কেন, রসোত্তীর্ণ না হলে তা দাগ কাটে না মানুষের মনে।
দর্শক সংখ্যা কমতে শুরু করায় নটী-নটী-নাট্যকার-ম্যানেজার সবাই উদ্বিগ্ন। ‘চৈতন্যলীলা’র ব্যবসায়িক সাফল্যেই সবাই খুশি হয়েছিল, তারপর আর বেশি বেশি লীলা জমছে না। রামকৃষ্ণ ঠাকুরে পরম ভক্ত হবার পর থেকে গিরিশচন্দ্র এই ধরনের নাটক ছাড়া অন্য কিছু লিখতে চান না। গিরিশের ব্যক্তিগত জীবন দেখলে অবশ্য তাঁর ভক্তিবাদ বোঝা অন্যদের পক্ষে দুষ্কর। সব কিছুই চলছে আগেকার মতন। একদিন ‘চৈতন্যলীলা’ অভিনয়ের পর নবদ্বীপের কয়েকজন বিশিষ্ট, মাননীয় বৈষ্ণব পণ্ডিত এসেছিলেন গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে। ভক্তিতে গদগদ হয়ে তাদের চোখ দিয়ে তখনও প্রেমাশ্রু ঝরছে, মঞ্চের পেছনে এসে দেখেন, গিরিশের হাতে মদের গেলাস, সামনে বোতল ও মাংসের চাট। তা দেখে পণ্ডিতপ্রবরদের অশ্রু শুকিয়ে গেল, দৃশ্যটিকে যেন বিশ্বাসই করতে পারলেন না। আবেগের কথা কিছু মনে এল না, একজন আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী শরীর খারাপ? ওষুধ খাচ্ছেন বুঝি? গিরিশচন্দ্ৰ অট্টহাস্য করে বলে উঠেছিলেন, না মশাই, ওষুধ নয়, মদ মদ খাচ্ছি, মদ চেনেন না?
বৈষ্ণব পণ্ডিতরা প্ৰায় দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর গিরিশের হাসি আর থামে না। সেই হাসিতে আরও অনেকে যোগদান করেছিল বটে, দু-একজন আপত্তিও জানিয়েছিল। উপেন মিত্তির নামে একজন বলেছিল, কেন ওনাদের এমন ভয় দেখালেন? ওনারা বাইরে গিয়ে এইসব রটাবেন। মিথ্যেমিথ্যি বলে দিলেই পারতেন যে ওটা ওষুধ।
গিরিশ হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, কেন মিথ্যে কথা বলব? আমার কী দায় পড়েছে? মদ খাওয়া খারাপ, না মিথ্যে কথা বলা বেশি খারাপ?
উপেন মিত্তির বলেছিল, ওনারা ভেবেছিলেন, আপনি চৈতন্যদেব সম্পর্কে এমন ভক্তি-কাব্য লিখেছেন, তাই আপনি নিজেও বুঝি চৈতন্যদেবের ভাবশিষ্য হয়েছেন।
গিরিশ কয়েক মুহূর্ত উপেনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, দেখ বাপু, তোমাকে একটা সার কথা বলি। রাইটার বা আর্টিস্টদের কাছ থেকে এ রকম আশা করা যায় না। নাটকে আমি অনাহারী, অনাথ, মুমূর্ষু, ঘাতক এ রকম কতই না চরিত্র রচি। তা বলে কি আমাকেও অনাহারী, অনাথ মুমূর্ষু, ঘাতক হতে হবে? আমাকে আমার মতন থাকতে দাও। মদ খেলে আমার ফুর্তি হয়, তাই খাই। ওদের জন্য ছাড়তে যাব কেন? একমাত্র একজনের কথায় ছাড়তে পারতাম। আমার গুরু যদি বলতেন, তা হলে সেই দণ্ডেই মদ্যপান চুকিয়ে দিতাম। গুরু তো আমায় কিছুই ছাড়তে বলেননি। তিনি বলেছেন, আমি কলঙ্কসাগরে সাতার দিলেও আমার গায়ে কলঙ্ক লাগবে না।
আর একদিন একদল লোক গিরিশের বাড়ি হানা দিয়েছিল। ‘চৈতন্যলীলা’র স্রষ্টাকে একবার শুধু দর্শন করে তারা চক্ষু সার্থক করতে চায়। বাড়িতে তখন উটকো লোকের আগমন একেবারেই পছন্দ করেন না গিরিশ। লোকগুলিও নাছোড়বান্দা। এক সময় গিরিশ সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে বৈঠকখানায় এসে বললেন, কী দেখতে এসেছি, দেখ, দেখে নাও! আমি হচ্ছি ভৈরব!
এইসব কাহিনী ছড়ায়, তাতেও ভক্তিরসের নাটকগুলি জনপ্রিয়তার হানি হয়। ‘চৈতন্যলীলা’র পর ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নাটকটি তো একেবারেই দর্শক টানতে পারল না। মনে হল যেন আগেরটিরই পুনরুক্তি। ‘প্ৰহ্লাদ চরিত্র’ও জমল না। স্টারে ‘প্ৰহ্লাদ চরিত্র’ শুরু হবার পর প্রতিযোগি বেঙ্গল থিয়েটারে ওই ‘প্ৰহ্লাদ চরিত্র’ নামেই আর একটি নাটক চলতে লাগল, সেটি রাজকৃষ্ণ রায়ের লেখা। দুই থিয়েটারের একই নাটক মঞ্চস্থ হতে লাগল পাল্লা দিয়ে, কয়েক দিনের মধ্যেই বোঝা গেল, বেঙ্গল থিয়েটারের নাটকই দর্শকদের পছন্দ হচ্ছে বেশি। স্টারে প্রহ্লাদ সাজে বিনোদিনী, বেঙ্গল থিয়েটারে সেই কুসুমকুমারী নামে এক অভিনেত্রী। অবিশ্বাস্য হলেও সহ্য এই যে কুসুমকুমারীর কাছে যেন হেরে যাচ্ছে বিনোদিনী, তার অভিনয় পানসে লাগে। দর্শকরা বিনোদিনীর শুধু ভক্তিরসাপ্লুত ভূমিকা আর পছন্দ করছে না, তারা অন্য বিনোদিনীকে চায়। বিনোদিনীর গানের গলাও তেমন ভালো নয়, কুসুমকুমারী পাকা গায়িকা।
শেষ পর্যন্ত স্টারে ‘প্ৰহ্লাদ চরিত্র’ চালাবার জন্য অমৃতলালের ‘বিবাহ বিভ্রাট’ নামে প্রহসনটি জুড়ে দিয়ে দর্শকদের ঘুষ দিতে হল।
সহকর্মীরা অনরবত চাপ দিচ্ছে গিরিশকে জীবনী-নাটক বাদ দিয়ে অন্য কিছু লেখার জন্য। স্টারের কোনও ধনী পৃষ্ঠপোষক নেই, নিজেদের মধ্যে কয়েকজনই আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখে, টিকিট বিক্রি কমে গেলে কলাকুশলীদের মাইনে দেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এমনিতেই এক নাটক টানা বেশি দিন চালানো যায় না, দু-তিন মাস অন্তর নতুন নাটক নামাতে হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো দু-একটির পুনরভিনয় হয়। সেই জন্য গিরিশকে প্রতিনিয়ত ভাবতে হয় নতুন নাটকের বিষয়বস্তু।
‘বুদ্ধদেব চরিত’ নাটকটিও জনপ্রিয় হল না দেখে গিরিশ বেশ হতাশ হয়েছিলেন। স্যার এডুইন আনর্ল্ড-এর লাইট অব এশিয়া কাব্য অবলম্বনে গিরিশ এই নাটকটি রচনা করেছিলেন বিশেষ যত্ন নিয়ে। এতে যে শুধু উচ্চাঙ্গের দর্শনের কথা আছে তাই নয়, এর কয়েকটি গান লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই, কোথা হতে আসি কোথা ভেসে যাই’ গানখানি শ্রীরামকৃষ্ণ নরেনের মুখে বার বার শুনতে চান, নরেন গায়ও একেবারে তন্ময় হয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণ হাততালি দিতে দিতে মাতোয়ারা হয়ে যখন বলেন, আর একবার গাও না গো, আর একবার গাও, তখন গিরিশের জীবনটা ধন্য মনে হয়।
শিক্ষিত সমাজ ‘বুদ্ধদেব চরিত’ নাটকটি তারিফ করেছিল, এমনকি স্বয়ং আর্নল্ড সাহেব দৈবাৎ সে সময় কলকাতা এসে তার অভিনয় দর্শন করে প্রশংসা করে গেছেন। কিন্তু সাধারণ দর্শকরা তেমন আগ্রহ বোধ করে না, বহু আসন খালি পড়ে থাকে।
গিরিশ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে একদিন একটা গল্প শুনেছিলেন। মুখে মুখে গল্প বলায় রামকৃষ্ণ ঠাকুরের জুড়ি নেই, অনেক চরিত্র তিনি অভিনয় করেও দেখান। একদিন এক ভণ্ড সাধুর ভাব-ভঙ্গি তিনি এমন চমৎকারভাবে নকল করে দেখাচ্ছিলেন যে ভক্তরা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছিল। গিরিশ ঠিক করলেন, সেই কাহিনীটি নিয়েই নতুন নাটক রচনা করবেন। ‘ভক্তমাল’ গ্রন্থে আছে বিমঙ্গল, চিন্তামণির উপাখ্যান, তার অনেক শাখা-প্রশাখা জুড়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব রূপ দিলে গিরিশ। শেষের দিকে বৈরাগ্যের কথা থাকলেও এ নাটকের মূল রস প্রেম। এক বারবনিতা ও এক লম্পট, যাদের জীবনে প্রেমের কোনও স্থান থাকার কথা নয়, তাদের মধ্যেও আকস্মিক বন্যার মতন প্রেমের আবির্ভাব। অধিকাংশ দর্শক তো প্রেমের কাহিনীই পছন্দ করে। অমৃতলাল মিত্র বিমঙ্গল সাজলেন, আর চিন্তামণির ভূমিকায় বিনোদিনী। নাটক একেবারে জমজমাট। স্টার থিয়েটারের আবার ভাগ্য ফিরে গেল, প্রতিদিন টিকিটঘর খোলা মাত্র হাউস ফুল।
পত্র-পত্রিকাতেও উচ্চ প্ৰশংসা বেরুল এই নাটকের। কিন্তু দারুণ আঘাত পেল বিনোদিনী। কোনও সমালোচকই চিন্তামণির অভিনয়ের গুরুত্ব দিল না। বরং সবাই মুক্ত কণ্ঠে বাহবা দিল পাগলিনীর ভূমিকায় গঙ্গামণিকে। প্রতিটি শো-তে গঙ্গামণিকে দেখলেই দৰ্শকরা হাততালি দিয়ে ওঠে, তখন বিনোদিনীকে খুব স্নান মনে হয়। পাগলিনী বেশে গঙ্গামণির অনেক দৃশ্যেই হঠাৎ হঠাৎ প্ৰবেশ, তার সংলাপগুলি প্রায় সবই গানে গানে। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সম্রাজ্ঞী এই নাটকে ক্ল্যাপ পায় মাত্র দু বার আর গঙ্গামণি পায় এগারো বার! কে এই গঙ্গামণি? তার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, দেখতেও এমন কিছু নয়, অন্যান্য নাটকে সে মা-মাসি-পিসির পার্ট করে, এই নাটকে সে যে দর্শকদের নয়নের মণি হয়ে গেল, সে কৃতিত্বও গিরিশের।
একদিন নাটক শুরুর আগে ফার্স্ট বেল বেজেছে, কেউ একজন অমৃতলালকে খবর দিল, বিনোদিনী এখনও মেকআপ নেয়নি। অমৃতলাল গ্রিনরুমে উকি মেরে দেখলেন, আয়নার সামনের টুলে বিনোদিনী থুম হয়ে বসে আছে। মুখে রং মাখেনি, পোশাক পাল্টায়নি। বিনোদিনী নিজেই নিজের সাজসজ্জা করে, কোনও মেকআপ ম্যানের সাহায্য নেয় না। গ্রিনরুমে সে একা।
অমৃতলাল উদ্বিগ্ন হয়ে কাছে এসে বললেন, কী রে, বিনোদ, তুই এখনও তৈরি হসনি। শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
বিনোদিনী মুখ তুলে চেয়ে কয়েক মুহূর্ত নীরব রইল। তারপর শান্তভাবে বলল, আজ আমি নামব না। শো বন্ধ করে দাও।
অমৃতলাল এ কথা শুনে বিশেষ অবাক হলেন না। বিনোদিনী যে অসুস্থ না, তাতেই তিনি স্বস্তি পেলেন। ইদানীং বিনোদিনী প্রায়ই নানারকম বায়নাক্কা শুরু করেছে। এখন নরম-গরম কথায় তার মান ভাঙাতে হবে।
অমৃতলাল বিনোদিনীর পিঠে হাত দিয়ে বললেন, কী বলছিস রে পাগলী! হঠাৎ আজ শো বন্ধ হবে কেন? উইংসের ফাঁক দিয়ে একবার দেখে আয়, ভেতরে তিল ধারনের জায়গা নেই।
অমৃতলালের হাত টেনে সরিয়ে দিয়ে বিনোদিনী বলল, সবাইকে টিকিটের পয়সা ফেরত দিয়ে দাও। আজ আমি এক্ষুনি বাড়ি চলে যাব।
অমৃতলাল বললেন, কেন শো হবে না, সেটা বলবি তো! দর্শকদের একটা কারণ দেখাতে হবে না?
বিনোদিনী দৃপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাড়িয়ে তেজের সঙ্গে বলল, আমার ইচ্ছে, তাই শো বন্ধ থাকবে। আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাম নেই? স্টার থিয়েটারটা হয়েছে কার জন্য? এই বিনোদিনী দাসী তার শরীর বেচে সব পয়সা জুগিয়েছে। সেসব কথা ভুলে গেছ তোমরা?
অমৃতলাল বললেন, না রে, ভুলব কেন? তোর জন্যই তো সব। তোকে কি কেউ কিছু বলেছে? ঝট করে তৈরি হয়ে নে। হুট করে শো বন্ধ করলে কি চলে? দশর্করাই হচ্ছে আমাদের ভগবান। দর্শকদের নিরাশ করলে আমাদের পাপ হয়। নে, নে, আর দেরি করিনি! শো শেষ হয়ে গেলে তোকে কে কী বলেছে শুনব।
-কে আবার কী বলবে! আমি এ নাটকে আর নামব না। ‘বিমঙ্গল’ বন্ধ করে দাও।
— তুই কী বলছিস রে, বিনোদ। অনেকদিন বাদে এই পালাটা হিট হয়েছে, ঘরে পয়সা আসছে। এমন সময় নাটক কেউ বন্ধ করে?
— ‘চৈতন্যলীলা’ও হিট হয়েছিল। সেটা আবার নামাও। কিংবা ‘দক্ষযজ্ঞ’।
– লোকে পুরনো নাটক ক’বার দেখবে? ‘বিম্বমঙ্গল’ সবে সাড়া জাগিয়েছে, গ্রাম-গঞ্জ থেকে কাতারে কাতারে লোক এ নাটক দেখার জন্য ছুটে আসছে। তোকে দেখবার জন্যই আসছে।
— শোনো, ভুনিদাদা, বারবার এক কথা বলো না। ‘বিম্বমঙ্গল’ আমার পছন্দ নয়, আমি এতে পার্ট করব না। নামতে পারি এক শর্তে, এ নাটক থেকে ওই গঙ্গা হারামজাদিটাকে বাদ দিতে হবে। আজ থেকেই যদি পাগলিনীর পার্টটা একেবারে বাদ দিতে পারো, তা হলে আমি মেকআপ নিতে পারি। বল, রাজি আছে।
অমৃতলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গিরিশবাবু আজ উপস্থিত নেই, তিনি অসুস্থ রামকৃষ্ণকে দেখতে গেছেন। এখন বিনোদিনীর গোঁ কে সামলাবে! এ দিকে সেকেন্ড বেলও বাজল, এ বার দর্শকরা অধের্য হয়ে উঠবে।
তিনি ধীর স্বরে বললেন, নাটকের কোনও রোল যখন তখন বাদ দেবার মালিক কি আমি? নাট্যকার কে, পরিচালকই বা কে, তা কি তুই ভুলে গেলি? গিরিশবাবু থাকলে তার মুখের ওপর তুই এমন কথা বলতে পারতি? শোন বিনোদ, আমাদের গুরুদেবও এত ভালো নাটক খুব কম লিখেছেন। পাগলী সেজে, গঙ্গামণি বিলকি-ছিলকি বকছে আর মজার গান গাইছে বলে অত হাততালি দিচ্ছে লোকে। কিন্তু তোর চরিত্রটা কত গভীর। তোর চিন্তা মণির জন্য মানুষ তোকে চিরকাল মনে রাখবে।
বিনোদিনী বলল, ওসব কথা ছাড়ো। তোমার-আমার গুরু। ইচ্ছে করেই গঙ্গার পার্টটা অতখানি তোল্লাই দিয়েছেন। যাতে আমি ডাউন খেয়ে যাই। এইভাবে তোমরা আমাকে স্টার থেকে তাড়াতে চাও, তা আমি বুঝি না?
অমৃতলাল বললেন, কেন যে তোর মাথায় এই কথাটা ঢুকেছে। কে তোকে তাড়াতে চায়। তুই স্টার থিয়েটারের প্রধান অ্যাসেট। তোর নামে টিকিট বিক্রি হয়। আর একটা কথা শোন, নাট্যকার কোন চরিত্রটা কী জন্য কেমন ভাবে গড়েছেন, তা নিয়ে কোনও কথা বলা আমাদের সাজে না। আমাকে ছোটখাটো চোর-ছ্যাঁচোড় বা নফরের পার্ট দিলেও আমি কখনও আপত্তি করি? আমরা সবাই মিলে নাটকটাকে সার্থক করে তুলব, এইটাই হচ্ছে প্রধান কথা।
বিনোদিনী বলল, আমার টাকায় এই থিয়েটার হল, অথচ তোমরা আমার নামটা রাখলে না। আমার ইচ্ছেরও তোমরা মূল্য দাও না।
অমৃতলাল বললেন, ওসব তো পুরনো কথা। এখন কি ওসব আলোচনার সময়! তুই মুখে রং মাখবি কি না বল!
বিনোদিনী বলল, আমার শর্ত তো তোমায় জানিয়ে দিয়েছি। গঙ্গার রোল পুরো বাদ দিতে হবে, আজ থেকেই।
অমৃতলাল এ বার দৃঢ়ভাবে বললেন, গঙ্গার ডায়ালগের একটা অক্ষরও আমি বাদ দিতে দেব না। ওর রোল যেমন আছে, তেমনি থাকবে। তাতে তুই রাজি না হলে প্লে হবে না! আমি দর্শকদের জানিয়ে দিচ্ছি, নায়িকা বিনোদিনী বেঁকে বসেছে বলে বিম্বমঙ্গল বন্ধ!
অমৃতলাল গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে বকুনি খাওয়া বাচ্চা মেয়ের মতন মুখ ভার করে বিনোদিনী বলল, দাঁড়াও, ভুনিদাদা, আমার এন্ট্রেন্স একটু পরে আছে। আমি আজকের মতন করে দিচ্ছি, তুমি ড্রপসিন তুলে দাও। কিন্তু পরে এর একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে, তা বলে রাখছি কিন্তু।
যথাসময়ে এই পুরো ঘটনাটাই গিরিশের কানে গেল। তিনি জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করতে করতে বললেন, হিংসে, হিংসে! এই থিয়েটারের মাগীগুলো হিংসেতেই মালো। বিনোদিনীর কত নামডাক, তবু এই বিম্বমঙ্গলে কয়েকখানা ক্ল্যাপ কম পেয়েছে বলে গঙ্গামণির মতন এক হেঁজিপোঁজিকেও হিংসে করে। স্ত্রীয়াশ্চরিত্ৰম!
পরদিন তিনি বিনোদিনীকে নিরিবিলিতে ডেকে বললেন, শুধু হাততালিতেই যোশ না রে, বিনি। হাততালি মোহ একটা ব্যাধির মতন। নটী-নটীদের তিরস্কার বা পুরষ্কার, দুটোকেই কণ্ঠের হার করে নিতে হয়। তোকে তো বিলেতের অভিনেত্রী অ্যালেন টেরি কথা কতবার বলেছি। সেই অ্যালেন টেরি যখন লেডি ম্যাকবেথের মতন এক ভয়ঙ্করীর ভূমিকায় নেমেছিল, তখন দর্শকরা তাকে একবারও হাততালি দেয়নি। তার অভিনয় দেখে ভয়ে শিউরে উঠেছে, কিন্তু সেই অভিনয়ই তাদের মনে দাগ কেটে গেছে। সেই জন্যই সবাই তাকে এত বড় অভিনেত্রী বলে মানে। বঙ্কিমবাবু তোকে দেখে কী বলেছিলেন মনে নেই? বঙ্কিমবাবু নিজের লেখা গল্পের নাটক দেখতে এসেছিলেন একদিন। কী বইখানা যেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, ‘মৃণালিনী’, তাই না? তুই তো তখন জানিসও না যে বঙ্কিমবাবু কে কিংবা কত বড় একখানা মানুষ। বঙ্কিমবাবু তোর অভিনয় দেখে বললেন, বাঃ, আমি তো মনোরমা চরিত্রটি শুধু বইয়ের পাতাতেই রচনা করেছিলুম, কিন্তু এ যে দেখছি জীবন্ত মনোরমা! বিনি, বঙ্কিমবাবুর মুখ থেকে প্রশংসা আদায় করা সহজ নয়। আমিও তোকে বলছি, চিন্তামণি চরিত্রটা লেখবার সময় তোর মুখখানাই আমার মনে ছিল ঠিকই, কিন্তু তুই যেন সেই চিন্তামণিকেও অনেকখানি ছাড়িয়ে গেছিস। তোকে এ ভূমিকায় দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই।
গিরিশচন্দ্ৰ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অনেকটা শান্ত করলেন বটে, তবু বিনোদিনীর ওপরে সহঅভিনেতা-অভিনেত্রীরা অনেকেরই বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগল দিন দিন। গিরিশচন্দ্র যখন থাকেন না, সে সকলের ওপর খবরদারি করে। অভিনয় চলাকালীন ইচ্ছে করে দু-একটা সংলাপ বাদ দিয়ে অন্যদের বিপদে ফেলে দেয়। শো শুরু হবার একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে উপস্থিত হয়, একদিন তো অভিনয় বন্ধ করার কথা প্রায় ঘোষিত হতে যাচ্ছিল। ‘আমার জন্যই তো স্টার থিয়েটার তৈরি হয়েছে’, এই কথাটা শতবার শুনতে শুনতে সবার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। মহোত্তম পরোপকারও পরোপকাকারীর মুখ থেকে বারবার শুনলে তা তিক্ততায় পর্যবসিত হয়।
গিরিশচন্দ্ৰ সব শুনেও বিনোদিনীর ওপর রাগ করতে পারেন না। সত্যিই তো মেয়েটি এক সময় অনেক স্বাৰ্থত্যাগ করেছে! তিনি নানান ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেন ওকে।
একদিন তিনি বললেন, বিনি, এর পর যে নাটকটি লিখছি, তাতে দেখবি তুই কত ক্ল্যাপ পাস। দর্শকরা তোর নাচ পছন্দ করে, নাচ দিয়েছি অনেকগুলো। এবার আর ভক্তি-বৈরাগ্য ফেরাগ্য নয়, স্রেফ নাচ-গান হল্লা। নাম দিয়েছি ‘বেল্লিক বাজার’। ভাঁড়ামি, শ্যামটা কিছুই বাদ রাখিনি। তুই সাজবি রঙ্গিনী।
একজন বলল, সে কি মশাই, সবাই জানে, আপনি আদর্শ শিক্ষা দিচ্ছেন। কী দারুণ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে, হিন্দু ধর্ম আবার জাগছে। এখন হঠাৎ বাজারে একখানা পঞ্চ রং ছাড়বেন?
গিরিশ ধমক দিয়ে বললেন, আগে তো থিয়েটারটাকে বাঁচাতে হবে না কি? অ্যাকটর-অ্যাকট্রেসরা না খেয়ে থাকলে আদর্শ মাথায় উঠবে। বেঙ্গল থিয়েটার বেশি দর্শক টানছে। স্টারকে আবার জাগাতে হবে। লোকে লাস্যময়ী বিনোদিনীকে দেখতে চায়, সন্ন্যাসিনী দেখে দেখে টায়ার্ড হয়ে গেছে। চৈতন্যলীলায় চৈতন্যদেবের পার্ট করতে করতেই বিবাহ বিভ্রাটে বিলাসিনী কারফর্মার রোলে বিনি কেমন ফাটিয়েছিল মনে নেই? বিনি আমাদের মস্ত বড় অ্যাকট্রেস। এখন কিছু দিন আবার বিলাসিনী, রঙ্গিনী সাজুক, তারপর ওকে আমি আবার কোনও সিরিয়াস রোলে নামাব।
তারপর কৌতুকছলে বিনোদিনীর দিকে ফিরে চক্ষু নাচিয়ে বললেন, ‘বেল্লিক বাজার’ এই নতুন নাটকটায় গঙ্গামণিকে দিয়েছি মুদ্দোফরাসনির রোল, তাও দু-এক সিন, একটাও ক্ল্যাপ পাবে না।
সপ্তাহে তিন দিন ‘বিম্বমঙ্গল’ মঞ্চস্থ হতে লাগল, অন্য দিন বেল্লিক বাজারের রিহার্সাল। নাটকখানি রঙ্গ-তামাশায় ভরা হলেও প্রকৃতপক্ষে বৰ্তমান সমাজচিত্র। সমাজের দুষ্ট ফেঁড়াগুলি এতে প্রকট করে তোলা হয়েছে। গিরিশ সব রিহার্সালে হাজির থাকতে পারেন না, প্রায়ই তিনি কাশীপুর বাগানবাড়িতে তাঁর অসুস্থ গুরুর চরণসেবা করতে চলে যান। অমৃতলাল বসুই পরিচালনা করছেন অনেকটা। প্রথম দিন থেকেই রঙ্গিনীর ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করছে বিনোদিনী। নাচের দৃশ্যে তাকে মনে হয় মঞ্চের ওপর এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ। এই সময় তাকে দেখে কল্পনাই করা যায় না, এই মেয়েই কিছু দিন আগে দিব্যোন্মাদ শ্রীচৈতন্য সেজে হাজার হাজার মানুষকে কাঁদিয়েছে।
কিন্তু অমৃতলাল লক্ষ করলেন, রিহার্সালের সময় একদিনও বিনোদিনী সাদাসিধে পোশাকে আসে না, সব সময় সে খুব সাজগোজ আর মুখে রং মেখে থাকে। আগে সে আটপৌরে পোশাকে চলে আসত, রিহার্সালের সময় তো দূরের কথা, আসল অভিনয়ের সময় মুখে বেশি রং মাখা পছন্দ করত না। অমৃতলাল কানাঘুষোয় শুনেছেন যে বিনোদিনীর থুতনিতে একটুখানি শ্বেতির দাগ হয়েছে। রং মাখলে তা বোঝা যায় না, অমৃতলাল মুখ ফুটে কোনও দিন জিজ্ঞেসও করেননি।
আরও একটা ব্যাপার এই যে, গঙ্গামণি, ক্ষেত্রমণি, ভূষণকুমারীর মতন অন্য সহঅভিনেত্রীরা যে সব দৃশ্যে আছে, সেই সব দৃশ্যে বিনোদিনী রিহার্সালে ফাঁকি মারে। ইচ্ছে করে বাথরুমে অনেকটা সময় কাটায় কিংবা বাড়ি ফেরার তাড়া দেখিয়ে বলে, প্রক্সি দিয়ে চালিয়ে দাও। বিনোদিনীর প্রতিভা আছে, বেশি রিহার্সাল না দিয়েও সে আসল অভিনয়ের সময় এইসব দৃশ্যগুলি ঠিক চালিয়ে দেবে, কিন্তু অসুবিধেয় পড়বে অন্য অভিনেত্রীরা।
গিরিশচন্দ্র একদিন রিহার্সাল দেখতে এলেন, বিনোদিনী তখন বাড়ি চলে গেছে। থিয়েটারের নিয়ম হচ্ছে, যে কটা দৃশ্যেরই মহড়া হোক, সমস্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতিদিন সর্বক্ষণ হাজির থাকতে হবে। শুধু নিজের ভূমিকাটুকুই নয়, প্রত্যেক গোটা নাটকের মহড়া দেখবে। এই নিয়ম পালনের জন্য গিরিশের কড়া নির্দেশ আছে।
আজ গিরিশ কয়েক পাত্র চড়িয়ে এসেছেন, মেজাজও সেই জন্য বেশ চড়া। কয়েকবার বিনোদিনীর খোঁজ করে সাড়া না পেয়ে তিনি জানলেন, প্রায়ই বিনোদিনী আগে আগে বাড়ি চলে যায়। এই নাটকের ওপর গিরিশ অনেকখানি ভরসা করে আছেন, বিনোদিনীর অবাধ্য মনোভাব তাঁর সহ্য হল না।
চেঁচিয়ে বললেন, সে বেটি ভেবেছে কী? লাটসাহেবের বউ, যা খুশি তাই করবে? আমি কে, তা ভুলে গেছে? চল তো ভুনি, ওর বাড়ি যাই। আজ রাত্তিরটা ওর বাড়িতেই কাটাব।
অমৃতলাল গিরিশকে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, গুরু, অনেক দিন তো তুমি যাওনি। বিনির বাড়ির ধরনধারণ সব পাল্টে গেছে। যখন তখন ওর বাড়িতে আর মাল খেতে যাওয়া যায় না।
গিরিশ বললেন, কেন? সে বোষ্টুমি হয়েছে? বাড়িতে পুজো-আচ্চা করে? তা করুক না। আমরা থিয়েটারের লোক, আমরা মালও খাব, পুজোআচ্চাও করব। আমাদের সবই মানায়। চ, চ।
অমৃতলাল বললেন, না গো, তা নয়। বিনিযে আবার বাবু ধরেছে। যেসে বাবু নয়, এ বারে তো এক রাজা!
গিরিশ অবাক হয়ে থমকে গেলেন। এ রকম একটা সংবাদের জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। চৈতন্যলীলার পর বিনোদিনীর ব্যবহারে বেশ একটা পরিবর্তন এসেছিল, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য ব্যাকুলতাও ছিল আন্তরিক। আবার কোনও বাবুর রক্ষিতা হওয়ার দরকার কি ছিল তার? বিনোদিনীর অর্থের অভাব নেই। গুর্মুখ তাকে অনেক টাকা দিয়ে গেছে। থিয়েটার থেকেও সে সকলের চেয়ে বেশি বেতন পায়, তার এখন নিজস্ব বাড়ি আছে।
গিরিশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, বাবুটি কে? এ দেশে তো রাজা-গজার অভাব নেই, ইনি কোনটি?
অমৃতলাল বললেন, নাম বলে আমার মুণ্ডুটা খোয়াই আর কি! ওঁর নাম বলা নিষেধ। শুনেছি উনি মেঘনাদের মতন। আড়ালে থাকতে চান। এ পোড়া বাংলাদেশে প্রচুর বাঘ-সিংগি, ধরে নাও, ইনিও এক সিংগি!
গিরিশ উত্তরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওখানকার সিংহ?
অমৃতলাল চুপ করে মুচকি হাসতে লাগলেন।
গিরিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন, বিনি, বিনি!
একটু থেমে আবার বললেন, ছোট্ট একটা পুতুল হয়ে এসেছিল, হাত-পা নাড়ত ঠিক পুতুলের মতন …
অমৃতলাল বললেন, ‘নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে…’। আর এখন ‘চল লো বেলা গেল গো, দেখব রাধা শ্যামের বামে।’ তুমিই তো তাকে এই অবস্থায় এনেছ!
গিরিশ বলল, বিনি এখন আমাকে মানে না। আবার এক বাবুর রক্ষিত হয়েছে, আমাকে জানায়নি।
অমৃতলাল বিনোদিনীর পক্ষ সমর্থন করে বললেন, গুরু, ওকে খুব দোষ দেওয়া যায় না। তুমি এখন রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে নিয়ে ব্যস্ত থাক। বিনি একাকিনী, তুমি তো জান, এই কলকাতা শহরে একা কোনও স্ত্রীলোকের বাস করা কত কঠিন কাজ। তাও বিনির মতন এক রূপসী, গুণবতী নারী। কত বাঁদর-ভোঁদড়ে সব সময় উৎপাত করে। স্ত্রীলোকের পতি ছাড়া গতি নেই। থিয়েটারের অভিনেত্রী এক বারবনিতাকে কে বিয়ে করবে? নিরাপত্তার জন্যই বিনির একজন রক্ষক দরকার। শুনেছি, এই রাজাবাবুটি খুব সহৃদয়, বিনির সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন।
গিরিশ বললেন, আমি যাব। আজই ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই। তুই যাবি?
অমৃতলাল অনেকভাবে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন, মানলেন না গিরিশ। গিরিশের ঘোড়ার গাড়ি ছুটেটে গেল গোয়াবাগানের দিকে।
বিনির বাড়ির সামনে এখন দুজন শাস্ত্রী বসে থাকে। তারা গিরিশচন্দ্রকে চেনে না। তাদের মাথায় পাগড়ি, কোমরে ঝুলছে তলোয়ার, রাজকীয় রক্ষী যাকে বলে। তারা দরজা আগলে দাঁড়াল।
গিরিশের জন্য বিনোদিনীর বাড়ি চিরকালই অবারিত দ্বার। অমৃতলালকে সঙ্গে নিয়ে যখন তখন এসেছেন কতবার, নাটকের আলোচনা ও বিয়ার পান করতে করতে রাত কাবার হয়ে গেছে। একবার সেই যখন গিরিশের বুকে সর্দি বসে গিয়েছিল, বিয়ার পানে রুচি ছিল না, অমৃতলাল মাঝরাতে বেরিয়ে গিয়ে সারা শহর খুঁজে খুঁজে জুটিয়ে এনেছিল বী হাইভ ব্র্যান্ডির বোতল।
সে বাড়িতে এসে গিরিশ বাধা মানবেন কেন? রক্তচক্ষে রক্ষীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, হঠ, হঠে যা আমার সামনে থেকে।
অমৃতলাল প্ৰমাদ গুনলেন। একটা না সাঙ্ঘাতিক অপ্রীতিকর কিছু ঘটে যায়! রক্ষীরা কিছু বুঝবে না, রাজাবাবু যদি এখন এখানে এসে থাকেন, তাহলে বিনোদিনী বিব্রত বোধ করে দেখা করতে চাইবে না। দৈবাৎ রাজাবাবুর মুখোমুখি পড়ে গেলে গিরিশ যে কী বলবেন, তার ঠিক নেই। নেশা চড়ে গেলে তাঁর মুখের কোনও লাগাম থাকে না, পরোয়া করেন না কারুকেই, একদিন রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে পর্যন্ত বাপ-মা তুলে গালাগাল দিয়েছিলেন।
অমৃতলাল গিরিশের হাত ধরে টেনে বললেন, গুরু, চলো আজ ফিরে যাই। এই সেপাইব্যাটারা তো কোনও কথাই বোঝে না। কাল বিনিকে খবর পাঠালে সে নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে দেখা করবে।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গিরিশ ওপরের দিকে মুখ করে চ্যাঁচাতে লাগলেন, বিনি, বিনোদ! নেমে আয়!
একটু পরেই খুট করে শব্দ হয়ে সদর দরজা খুলে গেল। সাদা শাড়ি পরা একজন কৃশকায়া দাসী বেরিয়ে এসে মৃদুগলায় বলল, ওগো বাবু, আজ বাড়ি যাও। দিদিমণির অসুখ করেছে, আজ দেখা হবে না।
দাসীটি পুরনো এবং চেনা। গিরিশ তাকে দেখে বললেন, হ্যাঁরে পদী, তোর দিদিমণি জানে আমি এসেছি? আমার ডাক শুনতে পেয়েছে।
দাসী বলল, হ্যাঁ গো, বারোন্ডা থেকে দেখেছে তোমাকে। দিদিমণির অসুখ গো!
গিরিশ বললেন, আগে তার অসুখ হলে সবচেয়ে প্রথমে আমাকে ডেকে পাঠাত! এখন সে আমাকে ওপরেই ডাকল না?
অমৃতলাল এ বার প্রায় ঠেলতে ঠেলতেই গিরিশকে নিয়ে গেল ঘোড়ার গাড়ির দিকে।
গাড়ির পাদানিতে পা দিয়েও থেমে গেলেন গিরিশ। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখলেন বিনোদিনীর বাড়ির তিনতলার এক আলো-জ্বলা ঘরের দিকে। তারপর আগুনের হলকার মতন বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, ধরাকে সরা জ্ঞান, করছে। অতি দৰ্পে হতা লঙ্কা! একটা মাটির পুতুলকে আমি গড়েপিঠে মানুষ করেছি। তার চলন-বলন-হাসি-কান্না আমি শেখাইনি? ওকে যাতে মানায় সেই রকম ক্যারেকটার আমি তৈরি করেছি আমার নাটকে, সেইসব রোলে পার্ট করে ওর নাম হয়েছে। যত রাজা-মহারাজা বাবুই ধরুক না কেন, তা বলে ঠিক সময় রিহার্সালে আসবে না? এত দেমাক! থিয়েটারের একটা ডিসিপ্লিন নেই? ও এমন মাথায় চড়ে বসলে অন্য নট-নটীরা আমাকেই দুষবে না? থিয়েটারের জন্য আমরা অন্য সব কিছু ছাড়েনি? ভুনি, যাকে আমি নিজের হাতে গড়েছি, তাকে আমি আবার ভেঙে ফেলতেও পারি! আমি যদি চাই, তা হলে শুধু স্টার কেন, আর অন্য কোনও থিয়েটারেও ওর স্থান হবে না। পাদপ্রদীপের আলো ওর মুখে আর পড়বে না, এ হয়ে যাবে অন্ধকারের জীব।
অমৃতলাল বলল, ওসব কথা আজ থাক। গলা শুকিয়ে গেছে, চলো অন্য কোথাও গিয়ে মাল খাই।
গিরিশ বললেন, ভুনি, আমাকে একতাল মাটি দে। আমি আবার একটা পুতুল গড়। সেই পুতুলে প্ৰাণ প্রতিষ্ঠা করব, আমার অঙ্গুলি হেলনে সে নাচবে গাইবে। আমার শেখানো কথায় সে দর্শকদের হাসাবে কাঁদাবে। আর একটা আনকোরা মেয়ে জোগাড় করে আন, আমি তাকে বিনোদিনীর চেয়েও অনেক বড় অ্যাকট্রেস করে তুলব।