2 of 2

৬০. ও-বাড়িতে আমার টিউশানি

ও-বাড়িতে আমার টিউশানি বেশি দিন টিকল না। কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, আমার ছাত্র-ছাত্রীর বাবা সন্ধ্যাবেলার দিকে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য পাগল হয়ে যান। তখন। সারা বাড়ি জুড়ে তাণ্ডব শুরু করেন। এমনিতে ভদ্রলোককে দেখলে তো কিছু বোঝা যায় না বটেই, তা ছাড়া, তিনি কোন এক সাহেব কোম্পানিতে ক্যাশিয়ারের কাজ করেন। রীতিমতন দায়িত্বপূর্ণ কাজ এবং বাড়িতেও তার প্রচণ্ড দাপট। তার সেই দাপটই তাকে পাগলামির সীমায় ঠেলে দেয়। এক একটি পরিবারের কর্তা বাড়িতে যে রকম। একনায়কত্ব দেখান, পৃথিবীর বড় বড় ডিকটেটাররাও তাদের কাছে লজ্জা পাবেন। আমার ছাত্র-ছাত্রীর পিতাটিও সেই রকম।

তার সেবাযত্নের ব্যাপারে পান থেকে চুন খসলেই সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে যায়। প্রত্যেক দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই তিনি কোনও-না-কোনও ব্যাপারে খুঁত ধরতে শুরু করেন। তখন থেকেই তাঁর মেজাজ চড়তে থাকে। চাকরবাকররা তটস্থ। সারা বাড়িতে একটা ছোটাছুটি পড়ে যায়। চায়ের মধ্যে দুধের সর থাকলে তিনি কাপসুদ্ধ ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং গর্জন করতে থাকেন। এবং এই তর্জনগর্জনই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় পাগলামিতে। ক্রুদ্ধ দাপাদাপি, জিনিসপত্র ভাঙা চলতে চলতে একসময় চাবুক নিয়ে স্ত্রীকে প্রহার।

এই সময়টা পড়ানো অসম্ভব। আমি চুপচাপ বসে থাকি, আমার ছাত্রী কাঁদে, ছোট ছেলেটা এত বোঝে না–এই ফাঁকে সে বাইরে খেলতে চলে যায়।

প্রথম প্রথম আমার অসম্ভব রাগ হত। আমার মনে হত, এই অত্যাচারী লোকটিকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু, কোনও স্বামী যদি তার স্ত্রীকে মারে–কোনও তৃতীয় ব্যক্তি তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারে কি না আমি জানি না। এই লোকটির পাগলামির চিকিৎসা করবারও কোনও উপায় নেই। কারণ, ইনিই বাড়ির কর্তা, ইনি নিজে তো আর পাগলামির কথা স্বীকার করবেন না–তা হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে কে?

অথচ, দিনের পর দিন এ ব্যাপার সহ্য করা যায় না। আমার মাথার ওপর চাপ পড়তে লাগল। ছাত্র-ছাত্রীর মা সাধারণত নীচে নামেন না। একদিন মাত্র তাঁকে দেখেছিলাম, দেখেই আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠেছিল। মুখোনি দুর্গা প্রতিমার মতন, অথচ অদ্ভুত, উদাসীন–যেন পৃথিবীর কোনও কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। সেই মুখখানা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই টিউশানিটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ওই বাড়িটার কথা তার পরেও অনেক দিন ভেবেছি। ছাত্র-ছাত্রীর বাবাকে কিছু একটা শাস্তি দেবার জন্য আমার হাত নিশপিশ করত। এমনকী একথাও ভাবতাম, একদিন ফাঁকা রাস্তায় লোকটিকে পেলে খুব মারব। যে-সব লোক কখনও মার খায় না–তারাই অপরকে অকারণে মারতে যায়। কিন্তু জীবনে অনেক শুভ ইচ্ছের মতন, এই ইচ্ছেটাও আমার অপূর্ণই থেকে গেল।

অন্য টিউশানি জোগাড় না করেই এটা ছেড়ে দিয়ে বেশ মুশকিলে পড়ে গেলাম। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে ছাড়া খুব শক্ত। নিয়মিত কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে টিউশানির খোঁজ করি, যে-কোনও জায়গায় গিয়েই দেখি, আমার আগেই দশ-পনেরো জন সেখানে। লাইন দিয়ে আছে। আমার হাতখরচের খুব টানাটানি, এই সময় আবার জুটল বিনে মাইনের একটা পড়ানোর কাজ।

পাড়ার কয়েকটি ছেলে একদিন এসে বলল, কমরেড, আপনার ওপর একটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এর আগে কিশোর বাহিনী বিক্রি করেছি। ধর্মতলা স্ট্রিটের পার্টি অফিসেও কয়েক বার গেছি, সুতরাং কোনও দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না। পার্টির কয়েকটি ক্যাডার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে–তাদের জন্য নাইট কোচিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে, এক এক জন এক একটা সাবজেক্ট পড়াবে। আমাকে পড়াতে হবে অঙ্ক।

ব্যবস্থা খুব সুন্দর, তখন কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনমূলক কাজে বেশ মন ছিল। পাঁচজন ছাত্র, তারা আমার চেয়েও বয়সে বড়–বেশ কিছু দিন লেখাপড়া ছেড়ে দেবার পর এখন আবার ম্যাট্রিকটা পাশ করে নিতে চায়। এ রকম বিনীত, ভদ্র ছাত্র পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তারা মনোযোগ দিয়ে শোনে, যা করতে বলি করে। যদিও তাদের অঙ্কে একেবারেই মাথা নেই, এক চাসে পাশ করার আশা খুবই কম, তবু তাদের পড়াতে খুবই উৎসাহ বোধ করি।

ইংরেজি পড়াবার জন্য ভালো লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। ওরা আমাকে বলল, একজন লোক খুঁজে দিতে। আমার মনে পড়ল সূর্যদার কথা। সূর্যদা যদিও কলেজের লেখাপড়া সম্পূর্ণ করেনি, কিন্তু ইংরেজি খুব ভালো জানে। সূর্যদা কিন্তু আমার প্রস্তাব শুনে একটুও পাত্তা দিল না। বলল, যা যা, আমার অত সময় নেই। তা ছাড়া পার্টির কাজ করতে চায় তো ম্যাট্রিক পাশ করে কী হাতি-ঘোড়া লাভ হবে? ওদের গ্রামে যেতে বল!

সূর্যদার তো কাজের মধ্যে শুধু সারা দিন বসে বই পড়া আর সন্ধ্যা হলেই বেরিয়ে পড়ে অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরা। সূর্যদার চেহারাটা এখন যা দারুণ সুন্দর হয়েছে না, মনে হয়, রাজপুত্রের মতন। মেয়েরা সূর্যদাকে দেখলেই নিজেদের মধ্যে কানাকানি শুরু করে। রাজনীতিতে সূর্যদার এখন আর কোনও আগ্রহই নেই–আমি কখনও কিছু বলতে গেলেও হাত নেড়ে উড়িয়ে দেয়। দীপ্তিদির প্রেমে পড়েই সূর্যদার বারোটা বেজে গেল। কোনও রকম পলিটিক্যাল ট্রেনিং ছিল না তো, শুধু কিছু ইমোশান আর অ্যাডভেঞ্চারের মোহে…

আমাদের নাইট কোচিংয়ের একটি মাত্র ছাত্র শেষ পর্যন্ত পাশ করেছিল। তাতেই আমরা দারুণ খুশি হয়েছিলাম। আদিনাথদা আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, গুড ওয়ার্ক। ভবিষ্যতে আরও কাজ করতে হবে।

স্থানীয় পার্টি সেলের প্রধান আদিনাথদা স্বভাব-গম্ভীর। তাঁর মুখ থেকে একটা প্রশংসা বাক্য পাওয়া কম কথা নয়।

ইতিমধ্যে আমি আরও দু-তিনটি টিউশানি জোগাড় করে ও ছেড়ে শেষ পর্যন্ত একটা খুব ভালো জায়গা পেয়ে গেছি। বস্তুত, প্রাইভেট টিউশানির জগৎ সম্পর্কে আমার যা অভিজ্ঞতা আছে, তা নিয়ে আমি একটা মহাভারত লিখে ফেলতে পারি। যাই হোক, তার মধ্যে এই বাড়িটির অভিজ্ঞতা অনন্য।

বাড়িটি ব্রিটিশ কা ধরনের। বিরাট বাগানের মধ্যে গম্বুজের মতন চূড়ওয়ালা তিন মহলা অট্টালিকা। বাগানে গেটের পাশে একটি লাল রঙের ঘর–সেখানে একজন লোক প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টাধ্বনি করে, পাড়ার লোকের ঘড়ি দেখার দরকার হয় না। যত্নে রক্ষিত বাগানটির এখানে-সেখানে পূর্ণাবয়ব নগ্ন নারীমূর্তির সাদা পুতুল, মাঝখানে একটি বিরাট ফোয়ারা। সেই বাগানে অপ্সরার মতন রমণীরা দেবশিশুদের সঙ্গে খেলা করে বিকেলবেলা।

দারোয়ান গেট খুলে দিলে আমি নতমুখে বাগানের পাশের মোরাম-বিছানো রাস্তা দিয়ে গিয়ে দাঁড়াই একটা দরজার সামনে। বাগানে যে-দিন বাড়ির মেয়েরা থাকে, সেদিন কোনও দিকে তাকাই না যে-দিন কেউ থাকে না, সেদিন আমি সাদা পাথরের নগ্ন পুতুলগুলোকে বার বার দেখি। কে বলেছে, নগ্নতা যদি শিল্পের অংশ হয়ে যায়, তবে তা যৌন উত্তেজনা আনে না? মিথ্যে কথা! আমি তো কৈশোর থেকেই ইউরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ছবির বইতে কিংবা বাগানের নগ্ন পুতুলের দিকে তাকালেই উত্তেজনা বোধ করেছি। শরীরে অতিরিক্ত উত্তাপ এসেছে। অবশ্য একা একা যৌন উত্তেজনা বোধ করা কোনও অপরাধ কিনা আমি জানি না। আমার তো তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি!

সদর দরজার সামনে দাঁড়ালে একটি বৃদ্ধ চাকর এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়। বিশাল বিশাল হলঘরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে, একটা সরু বারান্দা পেরিয়ে তারপর একটি সুসজ্জিত ছোট ঘরের সামনে এসে পৌঁছেই। চাকরটি দরজা খুলে, চেয়ার টেবিল থেকে কাল্পনিক ধুলো ঝেড়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে বলে, মাস্টারবাবু বসুন।

সারা বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ মনে হয়। মাঝে মাঝে শুধু একটা কাকাতুয়ার গলা শোনা যায়, কৃষ্ণ কোথায়? কৃষ্ণ কোথায়? পরিষ্কার উচ্চারণ।

একটু বাদে ঘোমটায় মুখ ঢাকা একজন দাসী কিছু খাবার ও জল রেখে যায়। তারপর চা। খালি পেয়ালা পিরিচ তুলে নিয়ে যাবার পর আমার ছাত্রটি আসে। ফুটফুটে গায়ের রং–দশ বছর বয়স, সে এসেই বলে, মাস’সাই, কাল অর্জুনের সঙ্গে মহাদেবের যুদ্ধ হয়েছিল। তারপর?

প্রথমে কিছুক্ষণ গল্প না বললে ছেলেটির পড়াশুনোয় মন বসে না। ওইটুকু ছেলের নাম রূপেন্দ্রনায়ণ মিত্র, আমি রূপ বলে ডাকি।

এ বাড়ির নারী-পুরুষ সকলেরই রং ফরসা, নাক টিকোলো, চোখের মণিতে সামান্য নীলচে আভা আছে। মনে হয়, বিশুদ্ধ আর্য রক্তের ধারাটি এই পরিবারে এখনও অক্ষুণ্ণ। সকলের ব্যবহার অত্যন্ত মার্জিত এবং নম্র। বাড়ির কারওর সঙ্গে যাতায়াতের পথে দেখা। হলেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে ঘাড় হেলিয়ে বলবেন, মাস্টারমশাই ভালো আছেন? এরা কলকাতার খাঁটি অ্যারিস্টোক্রাট বা অভিজাত বলতে যা বোঝায়, তারই অংশ। বেশ কয়েক পুরুষ ধরেই ধনী। বাড়িতে শিক্ষাদীক্ষার চল আছে, বিরাট গ্রন্থাগার এবং অনেক রকম শিল্প সংগ্রহ এবং মাঝে মাঝেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসে। মানব সভ্যতার যা কিছু শ্রেষ্ঠ ফসল, শিল্প-সংগীত-সাহিত্য এরা তার সমঝদার। এখানে সবকিছুই সুন্দর।

সন্ধ্যাবেলা এদের বাড়িতে এসে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সারা দিন আমি যে জীবন কাটাই তার সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে বেশ কিছুটা জড়িয়ে পড়েছি, স্টুডেন্টস ফেডারেশনের উৎসাহী কর্মী। ভূয়া স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আমরা সভায় মিছিলে সোচ্চার। নেহরু বলেছিলেন, কালোবাজারিদের ধরে ধরে ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাবেন। কিন্তু সব ল্যাম্পপোস্ট খালি পড়ে আছে, চতুর্দিকে ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার্সদেরই রাজত্ব। ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল, পুলিশ কোনও দিন আর। জনসাধারণের ওপর লাঠি-গু• চালাবে না। সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অনেক সাধারণ লোক পথেঘাটে বলে ফেলে, এর থেকে যে বাবা ব্রিটিশ রাজত্বও ভালো ছিল। বৃদ্ধ বৃদ্ধারা ব্রিটিশ রাজত্বের বদলে বলে, কোম্পানির আমল। আমরা তখন আই পি টি এর এই গানটা গেয়ে বেড়াই।

মাউন্ট ব্যাটেন সাহেব গো
তোমার সাধের ব্যাটন কার হাতে
থুইয়া গেলা হায়।

আর একটি গান:

শোনো শিশুর পরিচয়
যেমন তেমন নয়কো শিশু
মস্ত মহাশয়
হিটলার তাহার জ্যাঠা ছিল
মুসোলিনি মেসো–ও—ও
(আর) মার্কিন দেশের মার্সাল মাসি
পাঠায় খেলনা ডলার ঝুমঝুম
নাকের বদলে নরুণ পেলাম
টাক ডুমাডুম ডুম–
জান দিয়ে জানোয়ার পেলাম
লাগলো দেশে ধুম!

এই সময় সন্ধ্যাবেলার ওই মিত্তিরবাড়ি তো খাঁটি একটি বুর্জোয়া দুর্গ। ওরা পরাস্বপহারী। ওদের সাতখানা কলিয়ারি, কলকাতায় একুশখানা ভাড়াবাড়ি, দু-ডজন যাত্রী বাস ইত্যাদি। অর্থাৎ নিজেরা কিছু পরিশ্রম করে না–অপরের পরিশ্রম করা টাকা দিয়েই এদের বিলাসিতা। কলেজ ক্যান্টিনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় এদের বিরুদ্ধে অগ্নিবর্ষণ করতে পারি বটে, কিন্তু কাছাকাছি এসে কিছুতেই ঘৃণা প্রকাশ করতে পারি না। (তার কারণ অবশ্য এই নয় যে, আমি এদের বেতনভোগী।) এখানে আমি মাইনে পাই চল্লিশ টাকা, সেটা না পেলে আমি এমন কিছু অভাবে পড়ব না। কিন্তু একটা কথা বার বার মনে হয়, এদের হাতে প্রচুর টাকা ও প্রচুর সময় আছে বলেই কতকগুলি এমন জিনিসের চর্চা করতে পেরেছে, যা অত্যন্ত মোহময়। ব্যক্তিগত ব্যবহারে সভ্যতা, ভদ্রতার উচ্চ আদর্শ, সূক্ষ্ম রুচি এবং শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ–এসব তো সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। এগুলো কি খুবই নগণ্য ব্যাপার? বলাই বাহুল্য, এই সমাজের মধ্যে অনেক লম্পট, জোচ্চোর, ক্রুর এবং রুচিহীন গর্ধভও রয়েছে–তবু সভ্য সমাজে ব্যক্তিগত জীবনের যে সার্থকতা, তা এই অ্যারিস্টোক্র্যাটদের মধ্যেই দেখা যায়। যার উদাহরণ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি।

সেই সময় আমাদের ‘মার্কসবাদী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি আখ্যা দিয়ে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখা হচ্ছিল। যুক্তি দিয়ে মানতে হলে তো রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি বলতেই হবে, কিন্তু মনে মনে বুঝি, এটা হাস্যকর।

একদিন আমার ছাত্র রূপ আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, মাস’সাই, আপনি কি কবি?

আমি একটু চমকে গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হেসে ফেলে বললাম, কেন, একথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

বলুন না।

কবিতা লেখা যেন একটা লজ্জার ব্যাপার। মানুষের চরম অযোগ্যতার পরিচয়। তাই নিজের মুখে স্বীকার করতে জিভ সরে না। আবার কেউ কবিতার কথা জিজ্ঞেস করলেই বুকের মধ্যে অস্পষ্ট সুগন্ধের মতন কিছু একটা ছড়িয়ে যায়, আগ্রহ বেড়ে যায় শত গুণ।

তোমাকে কে বলেছে একথা?

ছোটমা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন, আপনি কি কবি?

ছোটমা কী করে জানলেন? ছোটমা জিজ্ঞেস করেছেন ‘দেশ’ কাগজে বাদলরঞ্জন মুখোপাধ্যায় নামে যার লেখা বেরিয়েছে–সেটা কি আপনার?

আমি লজ্জারুণ মুখে কোনওক্রমে বললাম, হ্যাঁ। তারপরই কথা ঘুরিয়ে বললাম, এবার এই অঙ্কটা করে ফেলো তো!

রূপ তার কাকিমাকে ছোটমা বলে, এটা আমি জানি।

তবে, ওর কাকিমাকে আমি কখনও দেখিনি। এবাড়ির মেয়েরা বাইরের লোকের সামনে বেরোন না। তবু সেই মহিলা আমার কবিতা সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাই তার চিন্তা কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না। কী রকম দেখতে তাকে? বাগানে কয়েক জন মহিলাকে মাঝে মাঝে দূর থেকে দেখেছি, তার মধ্যে কেউ কি? কোন জন?

একটু বাদে কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে আমি আবার রূপকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ছোটমা বুঝি অনেক বই পড়েন।

অনেক অনেক! ছোটমা ফরাসি পড়তে পারেন, তা জানেন? ছোটমা সাহেবদের সঙ্গেও ফরাসিতে কথা বলতে পারেন বাবার কাছে একজন এসেছিলেন…

শুনে আমি আরও চমৎকৃত হয়ে যাই! এত বড় ধনী পরিবারের ফরাসি জানা বিদুষী বধূ আমার কবিতার পাঠিকা? এর থেকে নোবেল প্রাইজ পাওয়া আর কী বড় কথা? আমার কবিতা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়, কেউ পড়ে বলে তো টের পাই না। বন্ধুরা মাঝে মাঝে তা নিয়ে ঠাট্টা ইয়ারকি করে, আর অনেকে কোনও রকম উচ্চবাচ্চই করে না। রেণুই আমার একমাত্র প্রত্যক্ষ পাঠিকা।

রূপের কাকিমার চেহারাটা এখন আমার তরু দত্তর মতন মনে হয়। অবশ্য তরু দত্তর চেয়ে এঁর বয়স নিশ্চয়ই বেশি হবে। আমার কবিতাটি কি ওঁর ভালো লেগেছে? মনে মনে তক্ষুনি ঠিক করে ফেলি, আমার এই অদৃশ্য পাঠিকাকে খুশি করার জন্য এরপরে আর একটা সাঙ্ঘাতিক কবিতা লিখতে হবে।

সেই সন্ধ্যাবেলা আমার মনটা এত খুশি হয়ে থাকে যে, ছাত্র পড়ানো শেষ করে তক্ষুনি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। বরং ইচ্ছে করে, আমার কবিতার এই অভূতপূর্ব সৌভাগ্যের কথা এক্ষুনি ছুটে গিয়ে কারোকে বলি। কাকে আর বলব, রেণুকে ছাড়া?

রেণুদের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে চলছে তুমুল আড্ডা। বিষ্ণুর মাস্টারমশাই, যিনি এম-এ ক্লাসের ছাত্র, সেই রজতদা রয়েছেন, সুপ্রকাশদা এবং তাঁর দু’জন বন্ধু এবং রেণুও রয়েছে। সুপ্রকাশদার এক বন্ধু দারুণ মজার মজার গল্প বলতে পারেন, সবাই তা শুনে দারুণ হাসছে।

আমি ঘরের মধ্যে ঢুকে চুপচাপ এক পাশে বসলাম, আমার দিকে কেউ মনোযোগ দিল না বিশেষ। হাসির গল্পের মাঝখান থেকে শুনলে মজা পাওয়া যায় না বিশেষ। আমি তাই বসে রইলাম বোকার মতন মুখ করে।

রেণু এত হাসছে যেন এক্ষুনি ভেঙে পড়বে। আমার চোখের দিকে ওর তাকাবারও সময় নেই। আমার যে রেণুর সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলার দরকার, ভীষণ দরকার! সুপ্রকাশদার বন্ধু বললেন, তারপর সেই খরগোশটা যার গোঁফ আশু মুখুজ্যের মতন–

আবার একদমক হাসি। হাসির পরিবেশ একবার জমে গেলে যে-কোনও রসিকতাতেই হাসি পায়–সবাই যেন হাসিতে মাতাল। আমি অন্য আবহাওয়া থেকে এসেছি বলেই মাঝে মাঝে শুধু কাষ্ঠ হাসি দিতে হচ্ছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দশটা বাজে। মনে মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল এরা। নিশ্চয়ই একটু বাদে চলে যাবে–তারপর আমি রেণুর সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ পাব। কিন্তু, হঠাৎ বুঝলাম, সুপ্রকাশদার দুই বন্ধুই সে-রাত্রে ওই বাড়িতেই থাকবেন। রেণু বলল, খেয়ে উঠে বাকি গল্পটা বলতে হবে কিন্তু। তাড়াতাড়ি ঘুমোলে চলবে না।

হঠাৎ ঈর্ষায় আমার বুকটা জ্বলে গেল। আমার জীবনে সেই প্রথম ঈর্ষা। মনে হল, মেয়েরা কী অসম্ভব নিষ্ঠুর হয়। এক এক সময় কত ভাব, আর এক এক সময় নিদারুণ অবহেলা। রেণু কি আমার মুখ দেখে বুঝতে পারছে না, আমি শুধু ওর সঙ্গে কথা বলার জন্যই এসেছি! আমার দিকে তাকাবার মতন সময়ই তো ওর নেই।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চলি।

বিষ্ণু বলল, আর একটু বোস না!

না, অনেক রাত হয়ে গেছে।

এখানকার আড্ডা ভেঙে গেল, ওরা এখন ওপরে খেতে যাবে। সবাই এসে দাঁড়াল ঠাকুরদালানের সামনের বারান্দায়। রেণু আমাকে বলল, শঙ্কুদা কী দারুণ গল্প বলেন, না? হাসতে হাসতে একেবারে খিল ধরে যাচ্ছিল। শঙ্কুদার মতন এত বুদ্ধি আমি আর কারওর দেখিনি।

আমি রেণুর দিকে দু’-এক পলক মাত্র তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলাম।

রামায়ণের সীতাও জানত না যে, ঋদ্ধিমান পুরুষ কখনও নিজের নারীর মুখে অপর কোনও পুরুষের প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। রেণু তা কী করে জানবে!

আমি শুকনো গলায় বললাম, সত্যি, শঙ্কুদা দারুণ গল্প বলতে পারেন।

শঙ্কুদা রেণুর পিঠে হাত দিয়ে বললেন, এই, চল চল, খুব খিদে পেয়েছে।

আমি তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেললাম, রেণুর সঙ্গে আর কোনও দিন দেখা করতে আসব না।

যুক্তিহীন ঈর্ষা আমাকে এমন ভাবে দগ্ধ করতে লাগল যে, আমি আর অন্য কোনও কিছু চিন্তাই করতে পারলাম না। বার বার মনে হতে লাগল, রেণু আমাকে ভালোবাসে না। আমার কবিতাও ভালোবাসে না, সব শুধু মুখেই। মেয়েদের কখনও বিশ্বাস করতে আছে?

বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়ার পরও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম। সামনে খাতা আর কলম। বার বার মনে হতে লাগল, রেণুকে একটা চিঠি লিখে জানিয়ে দিই, ওর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। দু-চার লাইন করে লিখেও ছিঁড়ে ফেলছি। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে, কপালের দু’পাশে শিরা দপদপ করছে। আজ সন্ধ্যাবেলাটা কত সুন্দর ছিল। সব নষ্ট হয়ে গেল।

তারপর ঠিক করলাম, চিঠি লেখারও আর দরকার নেই। রেণু চিন্তা করুক, কেন আমি ওর কাছে যাই না! ওকে কোনও দিন জানতেও দেব না। রেণুকে আমি একেবারে ভুলে যাব। আমি এরপর অনেক লিখব, এত ভালো লিখব যে, আমার নাম ওয়ার্ল্ড ফেমাস হয়ে যাবে। তখন রেণু বুঝবে, কাকে ও অবহেলা করেছে। ও কি ভাবে, ও ছাড়া আমার কবিতা কেউ পড়ে না?

অনেক কাটাকুটি করে আমি একটা কবিতা লিখতে আরম্ভ করলাম:

আর্টেমিস, আমি সেই ক্রীতদাস…

তিন-চার লাইন লেখবার পরই বুঝতে পারলাম, কবিতাটা আমি রেণুকে ভেবেই লিখছি। আমার চোখের সামনে ফুলের মতন ফুটে আছে রেণুর মুখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *