৫.০৮ দুশমন – আবুল ফজল সিদ্দিকি

দুশমন – আবুল ফজল সিদ্দিকি

সকাল থেকে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে দুপুর হয়ে গেল। বসন্তের রোদ্দুরে রীতিমতো কড়া আমেজ লাগছে এবার। পরনে কাপড়-চোপড় নেহাত কম নয়। তা-ও বোঝা হয়ে উঠছে। সেতারার পা দু’খানাও ভারি হয়ে এসেছে। ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে এখন সেতারা। যা অবস্থা, তাতে জানটা এমনিতেই ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়। মনে চেপে বসে ক্লান্তির বোঝা। তার ওপরে আবার এদিকে আর-এক কাণ্ড। ভারি চমৎকার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল একটা কিন্তু সবই ফসকে গেছে। আর তারপর শুরু হয়েছে গরম। গলাটা শুকিয়ে আসছে।

বসন্তের রং-লাগা দূরবিসারী বনরেখাটা স্বচ্ছ নীল আকাশের নিচে নির্বাক আলোর ঝরনায় নেয়ে ঝলমল করছে। বারবার চোখ দুটি দূর দূর প্রান্তে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আশা এই, সঙ্গীদের দেখা পেলে হয়তো কাছাকাছি একটা রাস্তার সন্ধান মিলবে। কিন্তু সামনে আমার বিজন তেপান্তর। যতদূর চোখ যায়, ভেজা, কালো কাদাটে পলির বিস্তার। পথের রেখা পড়াই সম্ভব নয় এ-মাটিতে। সেতারার খুরের ছাপটা পর্যন্ত এই কাদাটে ভেজা মাটিতে পড়তে না-পড়তে ভেঙে-চুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার ডান পাশ আর পেছন দিক ঘিরে গঙ্গার চকচকে জলধারা। সদ্য-গলা বরফের জলে থই থই করছে নদী। গতিভঙ্গে বসন্তের এক অদ্ভূত মদিরতা মাখানো। বাঁ-দিকে মাইল দুই-তিন দূরে মানুষ-সমান ঝাউ আর ফণিমনসার ঘন জঙ্গল। দেখে বোঝা মুশকিল, কতখানি জায়গা জুড়ে আছে। এদিকে সামনের মাঠখানা দিগন্তের কোলে গিয়ে মিশেছে। কোন দিক দিয়ে এগালে যে উদ্ধার পাব, কিছুই মাথায় ঢুকছে না।

এহেন অবস্থায় সওয়ারির পক্ষে সবচেয়ে ভালো পন্থা হল সওয়ারের প্রাণীটির প্রকৃতির হাতেই আত্মসমর্পণ করা। আমিও লাগাম ঢিলে করে দিয়েছি। নিশ্চিন্ত আছি, সেতারা সামান্য একটু এগোলেই আস্তানায় পৌঁছে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে এ-আশাও আছে যে, প্রকৃতি এবং ঘ্রাণশক্তির গুণে জঙ্গলে হারিয়ে ফেলা আমার সঙ্গীদের সন্ধান করতে করতেও এগোতে পারবে সে।

জায়গাটা আমার অপরিচিত। জীবনে এই প্রথম বড় সাহস করে শিকারের ছলে একটা কূট উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছি। এমনিতে জায়গাটা আমার এক দূর সম্পর্কের নিঃসন্তান চাচার কাছ থেকে উত্তরাধিকারের সিঁড়ি ভেঙে পাওয়া। এই সঙ্গে উত্তরাধিকার সূত্রে ঝগড়া-বিবাদ এবং মামলাবাজিও পেয়েছি। পথের কাঁটা সিং বাবু। এ-তল্লাটের এক জাঁদরেল গেঁয়ো রাজপুত। নদীর পার বরাবর একটুখানি জমির স্বত্বকে শিখণ্ডী করে তিনি এই এলাকার জবর-দখল নিয়ে জমিয়ে বসেছেন। প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে দেওয়ানি আদালতে একাধিক রায় এবং মাপ-জরিপের দুই-তিনটি প্রস্তাবও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। পুলিশ পর্যন্ত আমাদের সাহায্য করতে বা তাঁকে ভাগাতে পারেনি।

সিং বাবু দল পাকাতে ওস্তাদ এবং খুনি কিসিমের মানুষ। শিকারের বড় ভক্ত। জানে ভয়-ডর এতই কম যে, বে-আইনিভাবে লাইসেন্সহীন হাতিয়ার নিয়ে দিন-দুপুরে শিকার করে বেড়ান। এ-এলাকার আশপাশে বহুদূর তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী প্রমাণ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সারা তল্লাটে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেমন-তেমন সরকারি হুকুমটা প্রচারেরও উপায় নেই। মুশকিলের ব্যাপার হল, জবাবদিহি করতে বা ওজর-আপত্তি জানাতে আদালতেও তিনি কদাচিৎ আসেন। উকিলের মারফত উল্টো-সিধে একটা মামলা রুজু করে দিলেন তো দিলেন। নতুবা রইলেন মওকার অপেক্ষায়। মরহুম চাচাজান কয়েকবার আদালত থেকে আইন মোতাবেক দখল পেয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিকারের দখল আর তিনি নিতে পারলেন না। আর এক দফা নালিশ করলেন তিনি এবং আর এক দফা ডিক্রিও পেলেন। কিন্তু ফল যে-কে সেই। এমনি করে করে বারো বছর পার হয়ে গেল এবং এইভাবে জবরদখলই সিং বাবুর স্বত্বের নির্ভর হয়ে উঠল।

চাচাজান মামলা করে যা ফল পেয়েছিলেন, দু’বছর মামলা করে আমিও তাই-ই পেলাম। তিনবার দখল পেলাম, কিন্তু একবারও স্বত্ব ভোগ করতে পারলাম না। শেষকালে আর ফৌজদারি-মারামারি আয়োজন না-করে এক বন্ধুর পরামর্শ মাফিক ধরলাম ভিন্ন পন্থা। এর প্রথম লক্ষ্য হল এলাকার সবচেয়ে উর্বর অংশে পাসিদের (পাখি-শিকারি উপজাতি) একটা গ্রাম বসিয়ে দেওয়া। কাজটা করতে হবে ধীরে ধীরে বিষ দেওয়ার মতো অব্যর্থ উপায়ে, অতি সুন্দর করে এবং ধীরে-সুস্থে। নইলে গ্রাম বসানো দূরে থাক, মহলে আমার লোকজন নিরাপদে আসতেই পারবে না। তাছাড়া, এত সহজে গ্রাম বসাতে তিনি দেবেনই-বা কেন?

কিন্তু পাসিরা আধা-যাযাবর জাত। ওদের অনেকগুলো দলের ওপর শিকারের সূত্রে আমার প্রভাবও আছে। ওদের ঝোঁক শিকার আর বন্য জীবনের দিকেই বেশি। হঠাৎ কখনো চাষ-আবাদের কাজও করে বসে। অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু সাহসী এবং শক্তিধর জাত। একটুখানি উপলক্ষ পেলেই অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। শিকারে বেরোয় জানপ্রাণ কবুল করে। প্রাণ দেয়া-নেয়াকে মনে করে মামুলি ব্যাপার। এ-পথে আসতে হল আমায় উপায়ান্তর না দেখে। আমার কানে এমন ধরনের গুজবও এসেছিল যে, সিং বাবু আমায় খুন করাবার তাকে আছেন। কাছারিতে দুই-একবার চেষ্টা করেছিলাম, সিং বাবুর মুখখানাও যদি একবার দেখতে পাই। তাছাড়া, একটুখানি কৌতূহল ছিল। আমার মোকাবেলায় তাঁর প্রভাব- প্রতিপত্তির কথা তো ভালো করেই জানি। আরো শুনেছি, তিনি বড় বিলাসী শিকারিও। কিন্তু কাছারিতে, বিশেষ করে, আমার সঙ্গে মামলা চলবার সময় শুনেছি, এক-আধবার এমনিই কিছুক্ষণের জন্য এসেছেন। অথচ আমি তাঁকে দেখতেও পাইনি।

মহলের সবচাইতে উর্বর অংশে জায়গায় জায়গায় প্রতিবছরই নতুন নতুন সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যায়। পরিকল্পনা মোতাবেক পাসিদের একটা শক্তিশালী, উদ্যমশীল দল অঞ্চলটা সুকৌশলে দখলে আনার উদ্দেশ্যে ওখানে গিয়ে আস্তানা গাড়ল। সিং বাবুর এতে চমকে ওঠার কোনো কারণ নেই। পরিকল্পনায় ছিল, প্রথম বছরে দখল নেয়া হবে। আর দ্বিতীয় বছরে হবে সিং বাবুকে খুন করা। কাজটা সারতে হবে একেবারে চুপ-চাপ করে। যাতে কাক-পক্ষীটিও টের না পায়। পাসিদের আর কী চাই!

উর্বর জমি আর শিকারের জীব-জানোয়ার, পাখ-পাখালিতে ভরা জঙ্গল। প্রথম বছরেই শীতের সময় আস্তানার চারপাশে গোপনে গোপনে মাটির দেয়াল মাথা তুলে দাঁড়াল। সিং বাবু ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারলেন না। গরম পড়বার সঙ্গে সঙ্গে এবং খড়কুটো শুকোতেই চালা উঠে গেল। তারপর সিং বাবুর বিস্ময় কাটতে না-কাটতেই, বর্ষা নামবার সঙ্গে সঙ্গে চালার আশেপাশে মোষের লাঙল চলা শুরু হল। পরের বর্ষাতেই শ্যামল গ্রামখানা পাকাপোক্ত হয়ে উঠতে দেখা গেল।

কিন্তু গ্রাম পাকাপোক্ত হওয়ার পরও সিং বাবু চুপ করে বসে রইলেন। ফসল ওঠার সময় তক্ সবকিছু মুলতবি রাখলেন। কিন্তু যখন ধান আর জোয়ারের ভাগ-বাঁটোয়ারার জন্যে তাঁর লোকজন এসে হাজির হল, তখন পাসিরা তাদের হাঁকিয়ে দিল। এতদিনে তিনি বুঝতে পারলেন, কোন পরিকল্পনা মোতাবেক গ্রাম হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একথাও বুঝলেন, লড়াইটা সহজ নয়। পাঁচ হাজার বছরের পুরনো কেচ্ছার পুনরাবৃত্তি না-হয় শেষকালে।

পাসিদের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল, প্রথম বছরে যতখানি জায়গা ওরা ভোগদখলে আনতে পারবে তার জন্যে চিরকালের মতো খাজনা মাফ এবং এই দানের কথার মধ্যেই সিং বাবুকে খুন করার ব্যাপারটা গোপনে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। দু’বছর পার হয়ে তৃতীয় বছর এল। এই তিন বছর ধরে আমি আমার গোয়েন্দা বিভাগটা ক্রমেই সক্রিয় করে তুলেছি। খবরাখবরও বরাবরই পেয়েছি। সিং বাবু আমায় খুন করবার ষড়যন্ত্র করছেন, এমন আভাসও পেয়েছি দুই-একবার। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার।

আমি থাকি এখান থেকে একশো-সোয়াশো মাইল দূরে এবং গ্রামে। এ-জায়গাটা থেকে পাকা রাস্তা এবং রেললাইন পনেরো-বিশ মাইল। তবু মাঝে মাঝে একটু গোলমেলে খবর কানে আসে বলে বাড়িতে রাত্রিবেলা আত্মরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হয়। কিন্তু ‘পাস-গাঁও’ বসবার দু’বছর পর চৈতালি ফসল ওঠার আগে আমার একবার কূট উদ্দেশ্যে মহালে আসতে হল। আমার লোকজন খবর দিয়েছিল, পাসিরা অনেক বেশি জমি আবাদ করে নিয়েছে। এদিকে দু’বছর ফসল হয়েছে প্রচুর। এ কয় বছরের আবাদি জমির খাজনা আদায় করা দরকার এবার। কিন্তু পাসিরা ভাবছে, বাছাধন ভয়ের চোটে এ-এলাকায় ঢুকতে পারছে না। সিং বাবুকেও তাই তারা মেরে ফেলেনি এখনো। তাঁকে মেরে ফেললে তো আমার আর ভয়ের কিছুই থাকবে না। আমি তখন আইন-মাফিক খাজনা উসুল করতে শুরু করে দেব। এমন করলে যা হয়ে থাকে পাসিরা পাস-গাঁওকে স্বাধীন লাখেরাজ রাজ্য করে নিয়েছে। আর, প্রতি বর্ষায় এই রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে চলেছে।

সিং বাবুর ভয়ে আমি মহালে ঢুকতে পারিনে, পারসিদের এই ভুল ধারণাটা ভেঙে দিয়ে যাব, শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যে এখানে আসতে আমার ভালো লাগেনি। যদিচ ধারণাটা না-পাল্টালে আমার একটু বিপদও ছিল। আশঙ্কা করছিলাম, এই পাসিরাই-না শেষটায় চেপে বসে। মাপ-জরিপ, খোঁজ-খবর আর উসুল-পত্তরের নাম করে তাই চলেই এসেছি। এবং থেকেও গেছি কয়েকদিন। জানি, সিং বাবুর পথের সবচেয়ে বড় কাঁটা আমিই এবং এই কাঁটা সরিয়ে তিনি পাসিদের সাজানো-গোছানো গাঁওখানা অতি সহজেই অধিকারে আনতে পারেন। তিনি তো এমনিতেই আমায় সাবড়ে দেওয়ার মতলবে ছিলেন। এখন আবার তার ওপর নতুন প্রলোভন জুটেছে। কিন্তু পাসিদেরও তো খুব বেশি প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। চুক্তি যা ছিল, তাতে দ্বিতীয় বছরের শেষেই খাজনা-পত্তর আদায় করা উচিত ছিল। এখন তো তৃতীয় বছর চলছে। সুতরাং উপায় নেই। প্রাণ বিপন্ন করেও আসতেই হল। ভেবে রেখেছিলাম দু’সপ্তাহ থাকব। মহালের পাসিরা বড় আদর-আপ্যায়ন করল। পরদিনই আমার মন থেকে ভয়ও কেটে গেল।

পাসিরা আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটারও খবর রাখে। তিন বছরে স্বভাবটা একটুখানি চাষি-মার্কাও হয়েছে বটে। তারা খুব ভালো করে জানে, আমি শিকারের ভক্ত। হাজার হলেও পুরনো সঙ্গী তো তারা। অত্যন্ত গর্বভরে জানাল, দু’বছরের মধ্যে সিং বাবু আমাদের এলাকায় শিকারেও আসতে পারেননি। তেল ঢেলে ঢেলে তোষামোদের সুরে বলল, আপনি আসবেন, তাই এ-দু’বছর জঙ্গলের মাত্তর বিশেষ বিশেষ এলাকায় পশুপাখি শিকার করে খেয়েছি আমরা। আপনি শিকারে গেলে ভারি চমৎকার হবে।

মহালে আসার দিন তিনেক পরই শিকারের উত্তেজনায় ডুবিয়ে আমায় জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিল তারা। এমনিতে তো আমি জানিও, আমার ‘পিগ্ স্টিকিং’-এর শখ এইখানেই মিটতে পারে। পাঁচ হাজার বছরের পুরনা জিনিস এই ‘পিগ্ স্টিকিং’। মানুষ যখন ঘোড়া আর কুকুরকে পোষ মানিয়েছে, তার সংস্কৃতির কাফেলা যখন পর্বতগুহার আশ্রয় ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে কুঞ্জকুটিরের দিকে ছুটেছে, পশুপালনের মধ্যে যখন দেখা দিচ্ছে অর্থনীতির আদিমতম সূত্র, সেই তখনকার। আজ, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, কৃষ্টি ও সভ্যতার সৃজনের ভিড় থেকে পালিয়ে আমরা মাঝে মাঝে ফ্রি স্টাইল কুস্তি আর ‘পিগ্ স্টিকিং’-এর মতো খেলা শুরু করে দিই। হাল্কা একখানি বর্শা, শিক্ষিত এবং দ্রুতগতির একটা ঘোড়া আর নিজের হাত-পা নিয়ে পাথরের মতো বুনো শুয়োরের সঙ্গে লড়াই জুড়ি। ‘পিগ্‌ স্টিকিং’ শিকারের জবরদস্তির স্তরের চূড়ান্ত। নির্ভেজাল শিকার।

পাসিরা ফণিমনসা আর ঝাউবনের কয়েক জায়গা থেকে হই-হই করে মাঠের মধ্যে শুয়োর বার করে নিয়ে এল। কিন্তু আমার বরাতে প্রত্যেক বারই ফস্কা গেরো। সকাল ছ’টা থেকে দুপুর বারোটা তক্ ঠায় ঘোড়ার পিঠে বসে থেকে থেকে সর্বাঙ্গ ব্যথা হয়ে গেল। সেতারাও ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আর, সেই ক্লান্তির বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়াল একটা ব্যর্থতা। মাইলের পর মাইল এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করবার পর এখন ফিরে চলেছি। প্রচণ্ড তেষ্টায় মনে হচ্ছে, গলা থেকে পেটের তলা তক্ কাঠের একটা ছুঁচল ডাণ্ডা ঢুকিয়ে রেখেছে যেন কেউ। মাথায় রুমাল বাঁধা কিন্তু তার মধ্যে দিয়েই সুচের ডগার মতো রোদ বিঁধছে যেন মাথায়। পয়লা দিনেই চার-পাঁচটা গুলি ফসকে গেল। এদিকে কতকালের নিঝুম বন এখন সরগরম। কাল যে কিছু হবে সে-আশা বড় কম। সঙ্গীরা কোথায় উধাও হয়ে গেছে। ছুটোছুটি করতে করতে সীমা-সরহদ্দের খেয়ালও রাখিনি।

সেতারার সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নিশ্চিন্ত নির্ভর করে তার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া বোঝার মতো হয়ে ঢিমে তেতালে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। চোখ তুলে দেখি, চারদিক একেবারে নির্জন। জায়গাটা একান্তই অজানা-অচেনা লাগে যেন। সেতারা আমায় কোথায় নিয়ে চলেছে, কে জানে। আমারই মতো ও-ও তো এই প্রথম এসেছে এখানে। হতভাগা ব্যাধগুলোই-বা কোথায় গায়েব হয়ে গেল?

সকাল থেকে এতক্ষণ অবধি যে-পথে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মনে মনে আবার তার একটা নকশা আঁকার চেষ্টা করলাম। সেই সাথে পাস-গাঁওয়ের সঠিক সীমানা-সরহদ্দের একটা আন্দাজও। আশেপাশে দূর-দূরান্তে নজর বুলিয়ে বুলিয়ে ভালো করে দেখে নিলাম জায়গাটা, কিন্তু কোনো তাল-মানই পাওয়া গেল না তবু। এই তেপান্তরে আমি একলা। পরিবেশ অপরিচিত। এবার ভয়-ভয় করতে লাগল আমার। মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, কোথায় চলেছি?… তিনি তো এ-অঞ্চলের বাঘ। আমায় নিশ্চয়ই চেনেন। অথচ আমি তাঁকে চিনিও না। তিনি পেছনে-না লাগেন! সারাটা গা শিউরে উঠল আমার।

চোখ দুটি দূর-দূরান্তে ছুটে বেড়াতে লাগল এবার। ডান হাতে ঝোলানো বর্শাখানা আপনা থেকেই শক্ত মুঠোর মধ্যে খাড়া হয়ে উঠল। বাঁ হাতে লাগাম ধরা। কিন্তু কনুইটা হান্টিং কোটের পকেট হাতড়াতে লাগল। পকেটে ন’টা গুলিভরা রিভলবার পড়ে রয়েছে। আবার মনে পড়ল, সিং বাবুও তো শুনেছি পাঁড় শিকারি। এ-এলাকায় সর্বত্র তাঁর বাহাদুরির অপ্রতিহত প্রশংসা। তাঁর সাথে শিকারে নামব, এমন সুযোগ আর পাই কী করে? কিন্তু খোদা বাঁচিয়ে রাখলে একদিন তাঁর সাথে মোকাবেলাই হয়ে যাবে। মনে মনে ভাবতে থাকি, তিনি তো গোঁয়ার আনাড়ি কিসিমের শিকারি। আর আমি রীতিমতো বৈজ্ঞানিক কায়দায় লক্ষ্যভেদ করতে শিখেছি। কিন্তু বন্দুকের মুখোমুখি হওয়াটা বড় খারাপ জিনিস। এ-লড়াইয়ে তাকেই বলা হয় বাহাদুর, যার হাত প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতের আগেই ইঞ্চিটাক উপরে উঠে যায়। তারপর সে-হাত ফেরবার পথে পয়লা চোটেই সামনে যা-ই পাক, তার বুক ফুঁড়ে গুলি পার করে দেয়।

আর একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। আমার একাকিত্ব আর আশপাশের নির্জনতা আরো ভয়ঙ্কর মনে হল এবার। আচ্ছা, এই ব্যাধ শালারা রয়েছে কী করতে? আজই গিয়ে ঘোষণা করে দেব, দু’বছরের খাজনাই মাফ। শর্ত শুধু এই যে, এবারের ফসল উঠতে উঠতে সিং বাবুকে সাবাড় করে ফেলতে হবে। মহালটা এবার ঘুরে-ফিরে দেখতেও যাচ্ছি। পাসিদের সাহসটা এতে বাড়বে। সিং বাবুকে দেখে এখনো যে এক-আধটু ভয় আছে তাদের, তা-ও কেটে যাবে। খবর পেয়েছি, গোটা মহলে আমার সফরের কথাটা খুব ছড়িয়েছে এবং তাতে করে আমার পথের কাঁটার সম্মানেরও যথেষ্ট হানি হয়েছে।

.

একটুখানি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে না-ফেলতেই হঠাৎ সেতারা মোড় ফিরতে শুরু করল। সেতারার দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরুচ্ছে যেন এবার। চোখ দুটি তেপান্তরের দূর-দূরান্তে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওর চোখ বরাবর চোখ তুলতেই দেখি, অনেক দূরে মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা শুয়োর হেঁটে যাচ্ছে। অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে, ঢিমেতেতালে পা ফেলে ফেলে। দেখেই বোঝা যায়, ‘ইকড়া’ শুয়োর শুয়োর যূথচারী বুনো জানোয়ার। একলা যে থাকে, তাকে অত্যন্ত বিব্রত দেখায়। একা দেখলেই বুঝতে হবে, সে ‘ইকড়া’ শুয়োর। ‘ইকড়া’ সাধারণ শুয়োরের দল থেকে আলাদা হয়ে নিজের জুটি নিয়ে থাকে। তার কাজ দলের শুয়োরের সঙ্গে লড়াই করা, আর সবার খাবারে পোদ্দারি করা। গায়ে তার অসুরের বল, মনে মনে সে স্ফূর্তিবাজ। শিকারিকে সে দেখলেই চিনতে পারে। আর কিছু না-হোক, ষোলো আনা প্রকৃতি তার শুয়োর প্রকৃতির বিপরীত। গ্রামবাসী, জংলি চাষি আর শিকারির ভাষায় তার নাম ‘ইকড়া’। সব জঙ্গলেই দুই-একটা ইকড়া থাকে। সীমানা-বাঁধা এলাকায় তারা একচ্ছত্রাধিপতি। সেখানে আর কারো মাথা গলানোর উপায় নেই।

সেতারার চোখ বারবার ওঠানামা করছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও দেখলাম শুয়োরটাকে। সঙ্গে সঙ্গে আপনা থেকেই সামলে বসে ‘পজিশন’ নিলাম। সেতারার ইতি-উতি ছোটাছুটিতে এখন আর সে-তেজ নেই। চোখ দুটি বারবার ওঠানামা করছে। চোখে তীব্র দৃষ্টি, কিন্তু কোণে কোণে হরিণীর ভয় চিক্ চিক্ করে। লাগামটা একটু ঢিলে করে দিয়ে আমি ‘পজিশন’ নিতেই দেহে তার বিদ্যুতের শিহরণ খেলে যেতে লাগল। ‘পিগ্‌ স্টিকিং’ আর পোলোর ঘোড়া ভারি বুদ্ধিমান হয়। শিকারে সে সওয়ারের থেকে কম মনোযোগী নয়।

আস্তে আস্তে পিঠ চাপড়াতে লাগলাম সেতারার। সেতারা অত্যন্ত মিষ্টি সুরে হি-হি করে জবাব দিল তার। বর্গাখানি একটু শক্ত হাতে সোজা করে ধরতেই উৎসাহের আতিশয্যে লাফিয়ে উঠল সেতারা। এই বুঝি দৌড় শুরু করে দেয় সে। আমি ক্লান্ত। কিন্তু আমার চেয়েও বেশি ক্লান্ত সেতারা। দুজনেরই সে ক্লান্তি এবার হয়ে উঠল স্ফূর্তি। সকালবেলা প্রথম শিকার দেখে যে জোর আর উৎসাহ এসেছিল সেতারার সেই জোর আর উৎসাহই নেচে উঠল আবার তার দেহের শিরায় শিরায়।

কিন্তু শুয়োরটা এখনো অনেক দূরে। বিপদের গন্ধটুকুও পায়নি শুয়োরটা। এখনো পরম নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছে সে। সুতরাং সেতারার লাগামটা টেনে ধর। দস্তুরমতো জোরে অবাধ গতিতে ছুটতে থাকুক সেতারা। মাঠের দুই দিকে নদী। শুয়োরটা আমার উল্টো দিকের পথ দিয়ে মাটি শুঁকতে শুঁকতে আস্তে আস্তে নদীর দিকে এগিয়ে চলেছে। ইঙ্গিত করতেই সিতারা বিদ্যুৎবেগে লাফ দিয়ে কদম তুলে তীরবেগে শুয়োরের দিকে ছুটে চলল।

শুয়োরটাও দৌড় ধরল এবার। কিন্তু সেতারার পায়ে শুয়োরের পায়ের থেকেও তীব্রতরো ঝড়। ব্যবধানটা এক মিনিটে মিলিয়ে গেল। চার পায়ে ভর দিয়ে শুয়োরের মাথায় চড়ে বসল যেন সেতারা। ‘পিগ্ স্টিকিং’-এর ঘোড়া সে। শিকারের সময় শিকারির চেয়ে বেশি রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে ওরা। শিকারি তখন ওদের কাছে হাতিয়ারের মতো। আসল শিকারি ওরাই। বর্শার ফলা আর শুয়োরের চাকির ওপর একবার নজর বুলিয়ে নিয়েই গতি নিয়ন্ত্রিত করে চলতে থাকে। তারপর শিকারির একটুখানি ইঙ্গিতের অপেক্ষা মাত্র। ইঙ্গিত পেলেই সে গতি এক ঝটকায় রূপ পালটে ফেলে। সে বড় অদ্ভুত ঝট্‌কা। চোখের পলকে ছুটতে থাকে তখন ওরা। আবার, চোখের পলকেই দৌড় বন্ধ করে ঢিমে- তেতালে হাঁটতে তাকে। ঝঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে বর্শার ফলাখানাও শুয়োরের পাঁজরের মধ্যে বিঁধে কলজে ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। শিকারির মনে হতে থাকে ঘোড়ার সমস্ত শক্তি বুঝি রূপান্তরিত হয়ে তাঁর হাতের মধ্যে এসে জমা হয়েছে। রেকাব, আসন, তাঁর হাত এবং লম্বা বর্শাখানা পর্যন্ত কী যেন যান্ত্রিক কৌশলে ঘোড়ার দেহের অংশ হয়ে যায় তখন। শিকারির ডান পাঁজর থেকে শুরু করে বাহু আর কব্জি হয়ে হাতের মুঠো তক্ মদির শিহরণ বয়ে যায় একটা। তখন একান্তভাবেই মনে হতে থাকে ঘোড়ার ঝট্‌কা বুঝি তাঁরই হাত থেকে বেরিয়ে আসছে, একেবারে তাঁরই দেহের মধ্যে জেগে উঠছে। শিকারি বা ঘোড়া এর কিছুই বুঝতে পারে না। এ জিনিস বুঝতে পারে শুধুমাত্র জহুরি।

এ-ঝট্‌কা লক্ষ্যচ্যুত হলে শিকারি মাঝে মাঝে সম্মোহিতের মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। তাকিয়ে দেখি, সেই কাণ্ডই। সোয়া তিন-মণি ধূসর শিলা বর্শার ফলার ধাক্কায় ঘোড়ার সামনে থেকে চার-পাঁচ গজ দূরে ছিটকে পড়ল। ঘোড়াকে হয়তো-বা সাবধান করতে ভুলই হয়েছে। দৌড় আর ঝঙ্কার মধ্যে তাল রক্ষা করতে পারল না সেতারা। জানি এমন প্রচণ্ড, এমন মাথা-ঘোরানো দুর্ঘটনায় হালকা বর্শাখানা এত শক্ত করে ধরবার ক্ষমতা শিকারির দুর্বল হাতখানায় থাকে না, যার জোরে তিন মণ ওজনের বস্তুটি ছিটকে গিয়ে পড়বে। এ হল শক্তি আর কৌশলের যাদুমন্ত্র। অমন ভেল্কিবাজি সম্ভব শুধুমাত্র ঘোড়ার শক্তি থেকেই। ঘোড়া যখন আর দৌড়ায় না, অথচ বিশেষ ঝট্‌কাও দেয় না, তখনই হয়তো-বা এমন কাণ্ড ঘটে।

ট্রেনিং পাওয়া ঘোড়া আক্রমণের জায়গা থেকে লাফ দিয়ে সরে যায় একটুখানি। তারপর চোখের পলকে থমকে দাঁড়িয়ে আক্রণের ফলাফলটা দেখে নেয় একবার। দরকার হলে আবার আক্রমণ করবে সেতারা, কিন্তু ভালো করে দাঁড়াবার অবসরও পেল না সে। তার আগেই দেখে হামলা হয়েছে তার উপর। স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করে বসল শুয়োরটা। একটুখানি বাঁকা হয়ে দাঁড়াল একবার, তারপরই কামানের জ্বলন্ত গোলার মতো লাফিয়ে পড়ল। শুয়োর তো নয়, মৃত্যু। মূর্তিমান যম। পাথরের মতো মুখ আর ধারালো দাঁত খাড়া করে সেতারার সামনের পা দু’খানার ফাঁকে বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শুয়োরটা।

আর একটু হলে চাকি আর দাঁত দুটো ঝড়ের বেগে বুকে বিঁধে যেত সেতারার। কিন্তু বাহাদুর ঘোড়া বটে সেতারা! চোখের পলকে একেবারে লাঠির মতো খাড়া হয়ে দাঁড়াল। দ্বিতীয় হামলা হল ফিট দুয়েক পিছিয়ে। সেতারা এবার সামনের পায়ে ভর দিয়ে লাথি ঝাড়ল বার দুয়েক। আর একটু হলেই নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে যেত সেতারার। কিন্তু কিছুই হল না। শুধু সেতারার কানের ডগা থেকে লেজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ-সৃষ্টের শিহরণ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল একটা। উল্টোমুখো এই ধাক্কার তাল সামলায় কার সাধ্য। ওপরে একটা ডিগবাজি, একটা তলায়। তারপরই আমি একেবারে মাটিতে। দ্বিতীয়বারের ডিগবাজিতে শরীরের খানিকটা ঘোড়ার গায়ে ধাক্কা খেয়ে শুয়োরের উপর এসে পড়ল। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। শুয়োর হয়তো বুঝতেই পারল না, শিকারি এসে পড়েছে ঘাড়ে, না ভূত এসে পড়েছে। আর একটা লাফ দিয়ে ছিটকে উপরে উঠে গেল শুয়োরটা। ভালোয় ভালোয় কেটেছে বটে। জখম সামান্যই। একটা আছাড় খেয়ে উঠেই দে ছুট।

মজার ব্যাপার ঘটল এবার একটা। জীব-জানোয়ার কোনোদিন যা করে না, শুয়োরটা দেখি তাই করেছে। আমি যেদিক থেকে অনুসরণ করেছিলাম, সেই দিকেই ছুটছে। কিন্তু আমিও এক নিমেষে উঠে দাঁড়ালাম। ডিগবাজি খেয়ে যেমন প্রচণ্ড বেগে ছিটকে পড়েছিলাম, বুঝি-বা তেমনি জোরেই। বর্শাখানা পাশেই মাটিতে বিঁধে রয়েছে। সেতারা দৌড়ের ঝোঁকে আমার কাছ থেকে পঞ্চাশ-ষাট গজ দূরে গিয়ে পড়েছে। বর্শা তুলে নিয়ে সেতারার দিকে ছুটলাম। সেতারাও আমার দিকে ছুটতে শুরু করল।

.

সঙ্গিন মুহূর্ত। এইমাত্র একটা প্রচণ্ড দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু শিকারি এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যে-শিকারি আজ এই প্রথম সাফল্য লাভ করেছে। কয়েক সেকেন্ড আগের দুর্ঘটনা থেকে যে বেঁচে বেরিয়েছি, তার গুরুত্বের কোনো ধারণাই মনের ভেতর নেই। ধারণা নেই, ‘পিগ্ স্টিকিং’-এর চেষ্টাটা মূর্খতা। যে-মূর্খতা মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে প্রকাশ করে আসছে। সামনে আধ মাইল দূরে শুয়োরটা পালিয়ে যাচ্ছে। রেকাবেও আর পা ছোঁয়ালাম না আমি। সেতারার কেশরগুলো একটু হাতের মুঠোয় নিয়ে বানরের মতো এক লাফে তার পিঠে উঠে বসলাম।

শুয়োরটাকে ধরে ফেলতে সেতারার দু’মিনিটও লাগল না। বর্ণা বাগিয়ে ঘোড়া নিয়ে ছুটেছি। শুয়োরটা ফার্লং খানিক আরো ছুটল। তারপর বর্শাখানা শুয়োরের কাঁধ লক্ষ্য করে বিশেষ এক তাকে বাগিয়ে ধরে ঘোড়াটাকে হুঁশিয়ার করতে যাচ্ছি। এমন সময় শুয়োরটা আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে হামলা করল। কিন্তু এবার বোধহয় সেতারা আগের থেকেই সজাগও ছিল এবং এমন অবস্থায় চলাও বন্ধ করেনি। দৌড়াচ্ছিল সেতারা। শুয়োরটা পা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আশ্চর্য কৌশলে সে দৌড় হয়ে গেল লাফ। চট্‌পটে খেলোয়াড়ের মতো পাঁয়তারা ভেঁজে একেবারে শুয়োরের পেছন দিকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেতারা। শিকারিকে কৌশলের ঘাঁটিতে পৌঁছে দিয়ে আবার শিকারের লক্ষ্য ঠিক করে নিতে চাইল বুঝি সে। কিন্তু পড়ে গিয়ে সামলে ওঠারও সময় পেল না। শুয়োরটা সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়াল। সেতারাও এক মুহূর্তেই কাটিয়ে দিল আক্রমণটা।

দুই-তিনটি হামলা তক্ আমার শিকারি স্পিরিট বজায় রইল। প্রতি মুহূর্তেই অপেক্ষা, শুয়োরটা পালাতে গেলেই বর্শা গেঁথে দেব। কিন্তু একবার হামলা হয় আর একবার হামলা কাটাই, এই করতে করতে মনটা কখন যে প্রতিরোধের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, টেরও পেলাম না। সেতারা কিন্তু সাপ-নেউলের খেলা খেলছে। প্রতিটি হামলা সে বাহাদুরের মতো পাঁয়তারা ভেঁজে কাটিয়ে দিচ্ছে। হামলায় তেজ ক্রমশই প্রচণ্ডতরো হয়ে উঠেছে। সেতারা দক্ষ ব্যায়াম-বীরের মতো ডাইনে-বাঁয়ে-পিছনে ঘুরে ঘুরে দশ-বারো মণের শরীরটা লাঠির মতো দুলিয়ে দুলিয়ে এদিক থেকে ওদিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। পাথরের চাঁইয়ের মতো বিশাল-দেহ ‘ইকড়া’ শুয়োরটাও সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে লাফিয়ে লাফিয়ে কেবলই আক্রমণ করে চলেছে।

এতক্ষণ সেতারা শুধু প্রতিরোধই করেছে। শিকারের কথা যেন আর মনে নেই। গোড়াতেই বুঝেছিলাম, ব্যাপার বড় সুবিধের নয়। শুয়োরটাও জানে, শেষ পর্যন্ত লড়াই না-করলে তার বাঁচোয়া নেই। মিনিট তিন-চার মাত্র সময় গেছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যেন কত যুগ। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে ধাক্কা খেয়ে বেড়াচ্ছি। হতভাগা শুয়োরটা একটানা হামলা করে চলেছে। ঘোড়াটাকে এক পলকে সামলে নিয়ে মাঠ থেকে পালিয়ে যাব, সে ফাঁকটুকুও পাচ্ছিনে। স্রোতের মতো আক্রমণে ফাঁক যেটুকু পড়ছে, তা-ও একটানা লাফ-ঝাঁপে ভরা। আক্রমণের ফাঁকে-ফাঁকে সেতারা অতি কষ্টে নড়েচড়ে প্রতিরোধের জন্যে তৈরি হচ্ছে। একবার ভাবলাম বর্শা ফেলে দিয়ে রিভলভার বার করি। কিন্তু লাভ নেই তাতে, মাঝখান থেকে বর্শাটাও হাতছাড়া হবে।

আক্রমণের প্রচণ্ডতা বেড়েই চলেছে। প্রতিটি হামলায়ই সেতারা কানের কাছ দিয়ে বেঁচে যাচ্ছে, আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মাটিতে রাশ হয়ে পড়া সেতারার নাড়ি-ভুঁড়ি। সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিণামটাও দেখতে পাচ্ছি যেন ছায়াছবির পর্দায়।

আরো মিনিট তিন-চার কাটল। মৃত্যু এখন মিনিটে দু’বার করে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। সেতারা গুছিয়ে দাঁড়াতে না-দাঁড়াতেই দানবটা হামলার জন্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে। মাটিও এখানে শুকনো। শুয়োরের প্রতিটি আক্রমণ আর ঘোড়ার প্রতিটি পাঁয়তারার সাথে সাথে ধুলোর ঝড় উঠছে। কত বালি যে আমার নাক-কান-গলায় ঢুকে গেছে, কে জানে। মাঝে মাঝে বালিতে প্রতিরোধেও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এবার সেতারাও দমে গেল। সে যেন আর ইতিকর্তব্য খুঁজে পাচ্ছে না। লাফ-ঝাঁপ করছে, দেখছি, অবিবেচকের মতো। শুয়োরটা দুই-একবার ধরেও ফেলতে যাচ্ছিল। কিন্তু কী করে জানি বেঁচে গেল সেতারা। শুয়োরটা যেন গতি আর দৈহিক আক্রমণের স্রোত। আর, সেতারা কেবলই পাঁয়তারা। লাফ-ঝাঁপ আর লাফ-ঝাঁপ। প্রতিটি হামলায় যম হাঁ করে দাঁড়াচ্ছে চোখের সামনে, আর সেতারার প্রতিটি পাঁয়তারার সঙ্গে সঙ্গে নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছি। ক্রমে নতুন জীবন লাভের কথাটা মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠার অবসরও আর পাচ্ছে না। তার আগেই আবার মৃত্যুর ছবি ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

এমনিতে চোখ সরাবার অবসর নেই। কিন্তু বুঝি-বা কী একটা শব্দ শুনেই আমার অনিচ্ছুক চোখ দু’টি এক মুহূর্তের জন্যে ওপরে উঠল। একটু দূরে ফণিমনসার ঝাড়। এখানে কোথায় জানি মানুষের মতো একটি মূর্তির ওপর গিয়ে পড়ল চোখ দুটি। কানে ভেসে এল একটা উৎসাহের আওয়াজ। চোখ দুটি এবার এক নিমিষে মৃত্যুর জগৎ থেকে বাঁচার পথের সন্ধানে ফিরে এল। কান দু’টি কিন্তু ওই শব্দেই মগ্ন হয়ে রইল। বোধহয় আরো দুই-তিনটে হামলা আর প্রতিরোধের পালা গেল। তারপর দেখি, কে যেন ঝড়ের বেগে আমার দিকে ছুটে আসছে। লম্বামতো একটা মানুষ বর্ণা বাগিয়ে আমাদের লড়াইয়ের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুয়োরটাকে প্রচণ্ড একটা ধমক দিল লোকটি। সে-গর্জনে সেতারার সাহস ফিরল। আমার বুকখানাও যেন শান্ত হয়ে এল।

এবার শুয়োরটা প্রচণ্ড জোরে লোকটির ওপর হামলা করল। কিন্তু আগন্তুক অতি সংক্ষেপে একটুখানি নড়াচড়া করেই হামলাটা ব্যর্থ করে দিল। লড়াইয়ে এবার সে আধা-শরিক। আমার পালাবার পথ পরিষ্কার! কিন্তু এখন একথা মনে আসাও তো সম্ভব নয়। লোকটির মুখ দেখেই আমার ভাবনা দূর হয়ে গেছে। সে দুই-একবার চিৎকার করে আমায় সঠিক পন্থা বাতলে দিল। দেখা গেল, লোকটি আমায় চেনে। বড্ড চ্যাঁচামেচি করছে লোকটি। ধমকে শুয়োরটার মন তার দিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। বারবার ধমক দিয়ে দিয়ে সেতারাকে পথ বাতলাচ্ছে আর সাহস দিচ্ছে, আর আমায় আক্রমণ আর প্রতিরোধের উপায় শেখাচ্ছে। নিজে আত্মরক্ষা করছে সে নিপুণভাবে, অতি সুন্দর কৌশলে। তাকিয়ে দেখি লোকটির কাঁধে রাইফেল ঝুলছে। কিন্তু এ-অবস্থায় রাইফেলও আমার রিভলভারের মতোই বেকার।

তবু আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল একটা শেষ পর্যন্ত। শুয়োরটা আমার ওপর হামলা করছিল। এই সুযোগে লোকটি ঘায়েল করে ফেলল তাকে। কিন্তু বর্শার ফলাটা পড়েছিল শরীরের পেছন দিকে। বর্শার আঘাতে উত্তেজিত শুয়োরটা একটুও বিচলিত হল না। এবার আগুনের শিখার মতো লাফাতে শুরু করল সে। কিন্তু লোকটি তেমনি নিশ্চিন্ত, তেমনি শান্ত। জঙ্গলের দিক মুখে করে বারবার ডাক ছাড়ছে সে। কাকে যেন ডাকছে লোকটি।

দূরে মাঠের মধ্যে একটা বান্ডিলের মতো দেখা গেল। কিন্তু না, বান্ডিল নয়। এক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল, একঝাঁক কুকুর। তীর বেগে ছুটে আসছে। লোকটি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বাড় দিয়ে উঠল। বাহ্ বেটা! মার ওস্তাদ!

বিশাল দেহ একটি কুকুর বিদ্যুৎবেগে দল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল। নিমেষে কালো কম্বলের মতো মেঘ উড়ে উঠল একবার। তারপরই লাল-সাদা জলের মতো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কুকুরটা কিন্তু তক্ষুনি আছাড় খেয়ে তেমনি জোরেই লুটোপুটি খেতে লাগল। কুকুরটা সোজাসুজি শুয়োরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। কিন্তু শুয়োরটা দাঁতের ওপর তুলে আছাড় মেরে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বার করে দিল। রক্তের গরম আর উৎসাহের আতিশয্যে ওস্তাদ তবু নাড়ি-ভুঁড়ি ঘটাতে ঘটাতেই উঠে গিয়ে শুয়োরের টুটি চেপে ধরল। এদিকে, ওস্তাদ কামড় বসাতে না-বসাতেই বাকি সব ক’টি কুকুর লেলিয়ে-দেওয়া নেকড়ের মতো শুয়োরটার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। লোকটি এবার এক-একটি কুকুরের নাম ধরে ধরে জোর গলায় উৎসাহ দিয়ে যেতে লাগল। চোখের পলকে চাপা-কলের মধ্যে পড়ে গেল যেন শুয়োরটা। তারপরই এগারটা কুকুরের দাঁতের তলায় পাথরের মতো দেহ তার তুলো-তুলো হয়ে গেল।

.

চারদিকে এবার মৃত্যুর নীরবতা। আরো কয়েকজন লোক এগিয়ে এল। আর এল একটি মাদি ঘোড়া। পৃথিবী বুঝি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নতুন জীবনে চোখ মেলল একবার। আমি ঘামে নেয়ে উঠেছি। সেতারার গা বেয়েও ঘামের স্রোত বইছে। ওস্তাদের প্রাণ হয়তো প্রথম ধাক্কাতেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু উহ্, হিংস্র শিকারি শরীরটা এখনো টুটি কামড়ে যেখানকার সেখানেই পড়ে রয়েছে।

পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখখানা মুছে ফেললাম। সামনে কয়েক হাত দূরেই ওস্তাদের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। দেখে বড় দুঃখ হতে লাগল। ক্লান্তিতে অবশ, ব্যথায়- বেদনায় জীর্ণ শরীরটা হেঁচড়ে ঘোড়া থেকে নেমে, বর্শাখানা ফেলে দিয়ে সোজা লোকটার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু লোকটি একটু নড়লও না। একবার আমার দিকে চেয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বর্শাখানা খাড়া করে ধরল সে। চোখে-মুখে ফুটে উঠল অপরিচিতের ভাব। চাল-চলনে কেমন যেন একটা বন্যতার ছাপ।

আরো একটু এগিয়ে সাগ্রহে হাত দু’খানা বাড়িয়ে দিলাম। ভারি ইচ্ছে হচ্ছিল লোকটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করি, তার হাতে চুমো খাই। আর খাঁটি শিকারিসুলভ মানসিকতা আর বীরত্বের উদ্দেশ্যে দুটি প্রশংসার কথা উচ্চারণ করি। সামনা-সামনি গিয়ে দাঁড়াতেই লোকটি সহজ হয়ে এল। বর্শাখানা হাত থেকে ঝুলে পড়ল। কিন্তু আমি হয়তো শিকারি পরিভাষায় কিছু প্রশংসার কথা বলেছিলাম– পরমুহূর্তেই তাচ্ছিল্যভরে সরে দাঁড়াল সে। মুখখানা ঘৃণাভরে ফিরিয়ে নিল যেন। তারপর পেছন ফিরে ঘোড়ায় উঠে রওয়ানা হয়ে পড়ল।

আমি ডাক দিলাম, একটু শুনুন।

কিন্তু লোকটি যেন শুনতে পেল না। আস্তে আস্তে ঘোড়া চালিয়ে ফিরে গেল সে।

বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, এ-কী করল লোকটা? অ্যাঁ!

আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু লোকটা আর ফিরল না।

এদিকে লোকগুলো শুয়োরটার খাল-মাংস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে?

: অ্যাঁ! আপনি চেনেন না? উনি তো আপনার গলা শুনেই এসেছিলেন! সিং বাবু।

: সিং বাবু!

কথাটা আমার কানে যেতেই হঠাৎ যেন বিশ্বজগৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। পৃথিবীটা যেন এতক্ষণ জ্বলছিল। এবার আকাশ-বাতাস শিকারি-মানসের মহত্ত্বে ভরে উঠল। তাঁর দিকে ফিরে তাকালাম। মনে হল তিনি যেন ঘোড়া নিয়ে অনেক-দূর এগিয়ে গেছেন। আমি তাঁর ধারে-কাছেও পৌঁছুতে পারব না।

অনুবাদ : আতোয়ার রহমান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *