৫ জুলাই, সোমবার ১৯৭১
জামী স্কুলে যায় না, আমি প্রতি মাসে একবার গিয়ে তার মাইনেটা দিয়ে আসি। হেডমাস্টার খান মুহম্মদ সালেক সাহেব ব্যস্ত না থাকলে তার সাথে, না হয় টিচার্স রুমে অন শিক্ষকদের সঙ্গে খানিক গল্প করে আসি। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে চাকরি করেছি মাত্র দুবছর। কিন্তু ঐসময় গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে যে হৃদ্যতা হয়েছিল, তা আজো অটুট রয়েছে।
আজ সালেক সাহেব একাই বসেছিলেন তার ঘরে। ফলে বেশ সুযোগ পাওয়া গেল সেন্সরবিহীন কথাবার্তা বলার। একটু পরেই ফোন বেজে উঠল। সালেক সাহেব ধরে কথা বলতে লাগলেন, আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। কোন অভিভাবকের সঙ্গেই হচ্ছে, বোঝা গেল। সালেক সাহেবের কথাগুলো এরকম :
জি হ্যাঁ স্কুল তো ভোলাই। টিচার, দপ্তরী, দারোয়ান সবাই তো হাজির।
জি, জি, রোজই আসছে। আজো তো পঁয়তাল্লিশজন ছাত্র স্কুলে এসেছে।
না, না, একক্লাসে হবে কেন? আঠারোটা ক্লাসে।
পাঠাতে চাইলে নিশ্চয় পাঠাবেন। পথের দায়িত্ব আমরা নেই কি করে বলুন? স্কুলের গেটের ভেতর ঢুকলে, তার পরের দায়িত্বটুকু আমাদের।
আরো খানিকক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনলেন, জি হ্য, জি না, হ্যাঁ হ্যাঁ- করে গেলেন। তারপর ফোন রেখে হাসলেন, বেচারী গার্জেন!কিছুতেই ডিসিশান নিতে পারছেন না। ছেলে পাঠাবেন কি পাঠাবেন না। ঘরে রাখার মতো মনের জোর নেই, স্কুলে পাঠাবার মতও দাপট নেই এ যেন সেই মাথায় রাখলে উকুনে খাবে, মাটিতে রাখলে পিপড়েয় খাবে।
সালেক সাহেবের স্ত্রী-পুত্রকন্যারা কেউ কোয়ার্টার্সে থাকেনা, একেকজনকে একেক জায়গায় রাখার বন্দোবস্ত করেছেন। ক্লাস নাইনে পড়া একটি মাত্র ছেলে ওঁর সঙ্গে থাকে। হেসে বললাম, অন্তত দেখাবার মতো একটি কুমির ছানা সঙ্গে রেখেছেন।
কি করব বলুন। সরু চুলে বাধা ডেমোস্থিনিসের খাড়া ঝুলছে মাথার ওপর। তাই একটু সাবধানে থাকতে হয়। রাতে বাসায় থাকি না। তবে কেয়ারও করি নে। হায়াত যদ্দিন আছে, কেউ মারতে পারবে না। সুতরাং আগে থেকেই মরে কি লাভ?
একটু পরে জিগ্যেস করলেন, জামী কেমন আছে? ও বাড়িতে ঠিকমতো পড়াশোনা করছে তো? দেখবেন যেন ঢিলা দিয়ে সব ভুলে খেয়ে বসে না থাকে। স্কুল বয়কট করা যেমন দরকার, বাড়িতে বসে স্কুলের পড়াটা ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়াটাও তেমনিই দরকার।
বাড়ি ফিরে দেখি সাদ আর গালেব রুমীর খাটে বসে দাবা খেলছে। জামী খাটের পাশেই মেঝেতে বসে খাটের ওপর কনুই রেখে খেলা দেখছে। বারেককে ডেকে চা নাশতার কথা বলে আমিও খাটের অন্য পাশে কনুই রেখে মাটিতে বসলাম ওদের খেলা দেখবার জন্য।