৫. চক্ৰদহ – প্রদ্যুম্ননগর
চারক্রোশ দক্ষিণে চক্ৰদহ।
আদি নাম : চক্রদ্বীপ; অন্তিম নাম : চাক্দা।
এমন নাম কেন হল গো? বলি শোন :
ভগীরথ রথে চেপে শঙ্খধ্বনি করতে করতে এগিয়ে আসছেন গোমুখ থেকে কপিল মুনির আশ্রমে। তাঁর পিছন পিছন আসছেন মা গঙ্গা। রওনা হয়েছিলেন অক্ষয় তৃতীয়ায়; কিন্তু পথ বড় কম নয়! রাজমহল, গৌড়, কর্ণসুবর্ণ অতিক্রম করে, কাটোয়া-নবদ্বীপ পার হতে হতেই নামল বর্ষা। এখানে প্রচণ্ড বর্ষণের মধ্যে তাঁর রথের চাকা আটকে গেল কাদার দহে। ইতিমধ্যে পশ্চাদগামী গঙ্গাও এসে উপস্থিত। ফলে আদিগন্ত জল-থৈ-থৈ! ভগীরথ হতোদ্যম হবার মানুষ নন। টেনে তুললেন রথ ও রথাশ্ব। তবে ঐখানটায় হয়ে গেল একটা প্রকাণ্ড ‘দহ’, ঘূর্ণী। তারই নাম চক্রদহ। যে ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে রথটাকে টেনে তুলেছিলেন তার নাম চক্রদ্বীপ।
তোমরা হয়তো এসব কথা বিশ্বাস করবে না; কিন্তু সে-আমলের লোকে তা অন্তর থেকে বিশ্বাস করত। এখন হয়তো চাকদার মানুষ—ঐ যারা ওপার-বাঙলা থেকে এসে নয়া-বসত গড়ে তুলেছে—তারা জানেই না—তিন চারশ বছর পূর্বে চক্রদহ ছিল এক মহাতীর্থ! ঐ যেমন আজ মায়াপুরের রব্রবা! চাকদহ থেকে বনগ্রাম হয়ে শহর চণ্ডীকান (যশোহর) পর্যন্ত ছিল বাদশাহী পাকা সড়ক। চাকদহে খুঁজলে আজও দেখতে পাবে গঙ্গার মরা-খাত। অবশ্য বিগত বিশ ত্রিশ বছরে সেই মরা খাতের বুকে শালবল্লার পিন্ পুঁতে বৃত্তচ্যুত মানুষগুলো নতুন বসতি গড়ে তুলেছে। আহা, তারা সুখে থাকুক। কিন্তু ঐ মরা খাতে ভিত খুঁড়তে গিয়ে যদি শিশুর কঙ্কাল খুঁজে পাও তাহলে ঘাবড়ে যেও না। অমঙ্গলের কিছু নয়। ওগুলি শুভ প্রতীক। ঐ কচি কচি হাড়গুলো অক্ষয় স্বর্গলাভকামীর কিছু পার্থিব অবশেষ মাত্র। স্থানীয় পুণ্যকামীরা তো বটেই এমনকি যশোর-খুলনা থেকেও ঐ সড়ক ধরে আসত পুণ্যকামীরা—যাদের গঙ্গাসাগরে তীর্থযাত্রা করার সঙ্গতি নেই। ঐ চক্রতীর্থের পূতসলিলে শিশু সন্তানকে নিক্ষেপ করে মহাপুণ্য অর্জন করত তারা। কোন কোন হতভাগিনী ‘দিবি না ফিরায়ে?’ বলে শিউরে উঠত কি না, ঠিক জানি না। সে-কথা আর কে লিখবে বল? রবি-বাউলের ঠাকুর্দাই যে তখনো জন্মাননি!
পুরাণ-টুরান তোমরা বিশ্বাস করতে চাও না—ইতিহাসকে তো মানবে? তাতেও চক্রদহের মহিমার হদিস পাবে। এখানেই মহারাজ মানসিংহ তাঁর বিরাট মুগল বাহিনী নিয়ে আটকে পড়েছিলেন বর্ষার প্রকোপে। সে কিসসা আগেই শুনিয়েছি ভবানন্দ মজুমদারের প্রসঙ্গে।
এন-এইচ থার্টিফোর ধরে ঐ বিপদজনক এলাকাটা পাড়ি দেবার বাসনা যদি চাগে, তাহলে দেখে নিও বাপু, গাড়িতে বাড়তি স্টেপনি আর জ্যাক আছে কি না।
আধক্রোশ দক্ষিণে পালপাড়া। সে-কালের প্রদ্যুম্ননগর।
এখন তো ইস্টিশনও হয়েছে। রেলগাড়ির কামরায় বসেই দেখতে পাবে পালপাড়ার মন্দির। গাড়িতে বসে হয়তো নজর হবে না, মন্দিরটি যে ভূখণ্ডে অবস্থিত তা নিকটবর্তী জমির তুলনায় অনেকটা উঁচু জমিতে। ছোট ছোট লাল পাথরে গাঁথা মন্দিরটি ভারী সুন্দর। আমার তো মনে হয়েছে তার বয়স অন্তত পাঁচ শ’ বছর! কে কবে এটি নির্মাণ করেছিলেন তার হদিস নেই। কাছেই একটি দীঘি—প্রদ্যুম্ন সরোবর।
প্রদ্যুম্ননগরের দেউল, চক্রদহ
আবার পুরাণ কাহিনী শোনাই : শ্রীকৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্ন এই জনপদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি চক্রতীর্থে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, এ-কথাটা নিশ্চয়ই শুনেছ! বিশ্বাসী মানুষের ধারণা—সেই চক্রতীর্থ হচ্ছে ঐ চক্রদহ বা চাদা। সাফল্যলাভ করে সেই তীর্থেই বসবাস শুরু করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণতনয়। তাঁরই নামে জনপদটির নাম হয়ে যায় : প্রদ্যুম্ননগর
আবার সেই একই কথা বলি—তোমরা, আজকালকার ছেলেমেয়েরা, পুরাণে বিশ্বাস কর না। বলি পুরাতত্ত্ব আর ইতিহাস তো মানবে? মন্দির সংলগ্ন ভূভাগের ঐ উঁচু জমি কি ইঙ্গিত করে না যে, ওখানে ছিল এক বর্ধিষ্ণু জনপদ? আর ইতিহাস? স্মার্ত রঘুনন্দন ‘তীর্থযাত্রাবিধি ‘ গ্রন্থে ষোড়শ শতাব্দীতে এই প্রদ্যুম্ননগরের উল্লেখ করেছেন ‘মুক্তবেণী’র স্থান নির্দেশ করতে।