সিটি কলেজের কাছে স্কট লেনে একটি ছোট ভাড়াবাড়িতে থাকে নবীন ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী। এ বছরই বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে ফিরেছে, এখনও পশার জমেনি, দেশের খুব বেশি লোক এই যুবকটির গুণপনার কথা জানে না। এমন মেধাবী ছাত্ৰ কদাচিৎ দেখা যায়। সে একই বছরে বি এ ও এম এ পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দুর্লভ নজির স্থাপন করেছিল। তারপর কেমব্রিজে পড়তে গিয়ে সে অঙ্কে ট্রাইপস পায় এবং পরের বছরই ব্যারিস্টার হয়।
কলকাতায় বাসাবাড়িতে তার ছোট ছোট ভাইবোনেরা থেকে পড়াশুনো করে, তাদের নিজস্ব বাড়ি কৃষ্ণনগরে। আদালত থেকে এখনও তেমন উপাৰ্জন হয় না বলে সংসার চালাবার জন্য আশুকে সিটি কলেজে আংশিক সময়ের জন্য আইন পড়বার কাজ নিতে হয়েছে। এ ছাড়া স্কুল-পাঠ্য দু-একখানা অঙ্কের বইও লিখে ফেলেছে এর মধ্যে।
অঙ্ক ও আইনে যার এত মাথা, তার কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হচ্ছে সাহিত্য। বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি, ফরাসি ভাষার শ্ৰেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তির নির্যাস সে উপভোগ করে এবং বন্ধুদের জানাতে চায়। সেই জন্যই আশুর কাছে একটা তৃষিত পাখির মতন যখন তখন ছুটে আসে রবি।
আশু প্ৰায় রবিরই সমবয়েসী, এক-আধা বছরের বড় হতে পারে। এর সঙ্গে রবির পরিচয় জাহাজে, সেই দ্বিতীয়বার ইংলন্ড যাত্রার সময়। সেবারে ভাগ্নে সত্যপ্ৰসাদের অসুখের ছুতোয় রবিকে মাদ্রাজ থেকেই ফিরে আসতে হয়েছিল, আশুর সঙ্গে সময় কাটিয়েছিল মাত্র কয়েকটি দিন। কিন্তু এক-একজনের সঙ্গে অল্প পরিচয়েই বেশি ভাব হয়ে যায়, কোথাও একটা তরঙ্গে তরঙ্গে মেলে, পারস্পরিক একটা আস্থা জন্মায়। সেই থেকেই আশুর সঙ্গে রবির গভীর বন্ধুত্ব। আশু বিলেত থেকে ফেরবার পরই রবি কৃষ্ণনগরে চলে গিয়েছিল বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবার জন্য।
আশুর সান্নিধ্যে এলে রবি এমন একটা ভরসা পায়, যেমনটি তাকে আর কেউ দিতে পারে না। নিজের কবিতাগুলি সম্পর্কে রবির মনে এখনও বেশ দ্বিধার ভাব রয়ে গেছে। কবিতার প্রকৃত রস উপলব্ধি করতে পারে ক’জন! ছাপাখানার এত চল হবার ফলে কবিতার রূপ ও ভূমিকা বদল হয়েছে অনেকখানি। আগে, মুখস্থ রাখার তাগিদে অনেক কাজের কথা, প্রয়োজনের কথাও রচিত হতো ছন্দ আর মিল দিয়ে। ছন্দ আর মিল থাকলেই যে-কোনোও বিষয় কবিতা হয়ে ওঠে না, তবু অক্ষয় সরকারের মতন সমালোচকরা নিছক স্বচ্ছ, সুবোধ্য ছন্দ-মিল দেওয়া পঙক্তিকেই কবিতা মনে করে। এর আগে আলঙ্কারিকরা কাব্য-রস ও কাব্য-তত্ত্ব নিয়ে কত সূক্ষ্ম আলোচনা করে গেছেন, কিন্তু সাধারণ লোক তো আর সেসব জানে না, তারা শুভঙ্করের আর্যা আর খনার বচনকেও কবিতা বলে ধরে নেয়। মুশকিল হচ্ছে, এই সব লোকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সমালোচক সেজে বসে।
মুকুন্দরামের যুগে যদি ছাপাখানা থাকত, তা হলে তিনি চণ্ডীমঙ্গল রচনার সময় ছন্দ-মিল যোজনার কষ্ট স্বীকার না করে সেখানা সোজাসুজি উপন্যাস হিসেবেই লিখতেন। রামায়ণ-মহাভারত সম্পর্কেও সে কথা প্ৰযোজ্য। আগেকার যুগের অধিকাংশ আখ্যানকাব্যই এ যুগের গদ্য উপন্যাসের সমধর্মী। অবশ্য কিছু কিছু কবি ও মহাকবি আখ্যান অবলম্বন করেও বিশুদ্ধ কাব্য-রাসের সৃষ্টি করেছেন। মহাভারতের শকুন্তলার কাহিনী এবং কালিদাসের শকুন্তলার তুলনা কররেই উপন্যাস ও কাব্যের তফাত বোঝা যায়।
ছাপাখানা আসার পর গদ্য ভাষা অনেক দায়-দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে, কবিতা আর ব্যবহারিক প্রয়োজনের ভাষা নয়, কাহিনীর ওপরেও তাকে নির্ভর করতে হয় না। সুদীর্ঘ কবিতার বদলে ছোট্ট একটি লিরিকে জীবন রহস্যের এক ঝিলিক অনেক মর্মস্পর্শী হতে পারে। এখন আর সব কিছু বুঝিয়ে দেবার দায় নেই কবির, শব্দের জাদু থেকে অনেক রকম অর্থ বেরিয়ে আসতে পারে।
মাইকেল কিংবা হেমবাবু বা নবীন সেনের মতন রবির ইচ্ছে করে না মহাকাব্য রচনায় হাত দিতে। তার কবিতাগুলির আকারও ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। মহাকাব্যের বদলে সে তো গদ্যে উপন্যাস লিখছেই, বউ ঠাকুরানির হাট লিখেছে, রাজর্ষি অনেকটা অসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। ইচ্ছে করলে রবি কি বউ ঠাকুরানির হাট কিংবা রাজর্ষি ছন্দ-মিল দিয়ে লিখতে পারত না! লিরিক বা গান রচনার সময়ই রবি সত্যিকারের কবিত্বের আস্বাদ পায়।
কিন্তু এই ছোট ছোট কবিতাগুলি সত্যিকারের রসোত্তীর্ণ হয়ে উঠছে কি না, তার বিচার কে করবে! নতুন বউঠান যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর বিচারবোধের ওপর রবির খুব আস্থা ছিল। নতুন বউঠান রবির অযথা প্রশস্তি করতেন না, অনেক সমালোচনা করতেন, এমন কি রবির খাতায় কাটাকুটি করে দিতেন পর্যন্ত। কী করে যে নতুন বউঠানের এমন সূক্ষ্ম কাব্যবোধ জন্মেছিল কে জানে! নতুন বউঠানের অভাব কোনও দিন পূরণ হবে না। এখন রবির কবিতার প্রধান পাঠক তার বিশাল পরিবারের লোকজন, তারা সবাই উচ্ছ্বসিত ভাবে প্রশংসা করে। বন্ধুরা পত্র-পত্রিকায় তাকে খুব উচ্চ স্থান দেয়। কিন্তু নিছক প্ৰশংসায় রবির মন ভরে না। মনে হয়, কোথায় যেন একটা ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। আবার অরসিকের সমালোচনাও সহ্য করতে পারে না সে। অক্ষয় সরকারের মতন সমালোচকরা যখন বলে যে রবির কবিতা দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট, ভাবালুতায় ভরা, তখন রবির গা জ্বলে যায়। এরা মনে করে, প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি নিয়ে লেখা অকিঞ্চিৎকর, সব কবিতাই দেশাত্মবোধ বা মহৎ আদর্শের হতে হবে। মহৎ আদর্শ প্রচারের নামে অধিকাংশ কবিতাই যে কবিতা পদবাচ্য নয়, তা এদের মগজে ঢুকবে না। এই সব সমালোচকদের উত্তর না দিয়ে ছাড়ে না রবি।
অক্ষয় সরকার একবার তির্যক ভাবে লিখলেন, আজকাল কবিতার নামে এক-একজন যা লিখছে, তা ন-পুং ন-স্ত্রী জাতীয় একপ্রকার জীব। ওগুলো ন-কাব্য ন-কবিতা, ওগুলোকে বলা যায় কাব্যি।
না মরদ, না মহিলা। কেবল কাব্যি। রবি এর উত্তরে লিখল, তবে তো ‘তুমি খাও ভাঁড়ে জল আমি খাই ঘাটে’, এই তো মহৎ কবিতা! ব্যাখ্যা করার কিছু নেই।
শুধু এইটুকুতেই ছাড়ল না রবি। অন্য একটি রচনায় অক্ষয়চন্দ্রকে খোঁচা মেরে সে আবার লিখল, ‘আর সকলে ভগ্নী বলে, রসিকবাবু বলেন ভেগ্নী, হা-হা-হা!’
আশু চৌধুরীর সান্নিধ্যে এসে রবি বুঝতে পারল, বাংলার অধিকাংশ সমালোচক কত ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ। নিছক নিন্দা বা প্রশংসায় কবিতার বিচার হয় না। একালের কবিতার রস উপলব্ধি করার জন্য পাঠককেও প্রস্তুত হতে হয়, কাব্য-সাহিত্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতাও তার মাথায় রাখা প্রয়োজন। বৈষ্ণব পদকর্তাদের রচনাগুলির স্বাদ যে পায়নি, সে কী করে একালের লিরিক কবিতা উপভোগ করবে। রবির কবিতার এক-একটি লাইন তুলে তুলে আশু দেখিয়ে দেয়, বিশ্বের বিখ্যাত কবিদের রচনার ভাব ও শব্দ ব্যবহারের সঙ্গে রবির কতখানি মিল আছে।
এরকম একজন বিদগ্ধ ও রসিক পাঠকের সমর্থন পেয়ে রবি বিশেষ শ্লাঘা বোধ করে। আশু রবির কবিতাগুলি এমনই পছন্দ করে ফেলেছে যে রবির সাম্প্রতিক কবিতাগুলি থেকে নির্বাচন করে সে নিজেই একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
আশুদের স্কট লেনের বাড়িতে রবি প্রায়ই এসে বসে থাকে। রবির মাথার চুল এখন ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, মুখে অল্প অল্প কুচকুচে কালো দাড়ি, গৌরবর্ণ মসৃণ চামড়ায় রয়েছে চিক্কণতা, চোখ ও নাক গ্রিক দেবতার মূর্তির মতন, দীর্ঘকায় সুগঠিত শরীর। গ্রীষ্মকালে রবি গায়ে কোনও জামা দেয় না, ধুতির ওপর শুধু একটা পাতলা চাদর জড়ানো ঊর্ধ্বাঙ্গে।
আশু চৌধুরীর ভাইদের মধ্যে একজনের নাম প্রমথ। সতেরো-আঠেরো বছর বয়েস, সেও ভবিষ্যতে ব্যারিস্টার হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, যদিও মনে মনে গুপ্তভাবে সে সাহিত্যসৃষ্টির সাধ পোষণ করে। কিশোর প্রমথ দাদার এই বন্ধুটির দিকে মুগ্ধ ভাবে তাকিয়ে থাকে। এই কবির মতন সুপুরুষ সে আগে কখনও দেখেনি। আশুর সঙ্গে রবি যখন কাব্য-আলোচনা করে, আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে প্রমথ, কাছে আসতে সাহস করে না।
আশু কলকাতায় ফেরার পর রবির মনে একটি বিশেষ ইচ্ছে দানা বেঁধেছিল। এমন গুণবান ছেলে আশু, তার সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না! ঠাকুর পরিবারে বেশ কয়েকটি বিবাহযোগ্যা কন্যা রয়েছে। তাদের মধ্যে হেমেন্দ্রনাথের কন্যা প্রতিভার বিয়ের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। ‘বাল্মকী প্রতিভা’র সেই প্রতিভা এখন অনেক বড় হয়েছে, বয়েস প্রায় একুশ। লেখাপড়ায় সে যেমন ভালো, তেমনই তার গানের গলা। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী এই বিশেষণ এমন মেয়েকেই মানায়। হেমেন্দ্রনাথ এই মেয়ের বিয়ে দেবার কোনও চেষ্টাই করেননি, প্রতিভাকে অনবরত লেখাপড়া শিখিয়ে যাওয়াতেই যেন শুধু তার উৎসাহ। এমন কি প্রতিভা একটু বড় হবার পর বাড়ির অন্য ছেলেদের সঙ্গেও তাকে মিশতে দিতেন না হেমেন্দ্রনাথ।
হেমেন্দ্রনাথ আর নেই, এখন তাঁর ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিতে হবে অন্য ভাইদেরই। রবির ধারণা আশুর সঙ্গে প্রতিভাকে খুবই মানাবে। কিন্তু দুটি বাধা আছে। প্রতিভা সাবালিকা হয়েছে, এখন তার পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব আছে। তা ছাড়া উভয় পক্ষই ব্ৰাহ্মণ হলেও ঠাকুররা রাঢ়ী শ্রেণীর আর চৌধুরীরা বারেন্দ্র। রাঢ়ী-বারেন্দ্রের মধ্যে বিবাহের চল নেই। রবির মতে অবশ্য জাত-পাতের এই সব সূক্ষ্ম বিভেদ অর্থহীন। কিন্তু বাবামশাইয়ের কী মত পাওয়া যাবে! আশুর বাবারও মত নেবার প্রয়োজন আছে। আরও একটা বাধা আছে। আশুর বাবা এমন সুপাত্রের জন্য নিশ্চয়ই অনেক যৌতুক ও পণ চাইবেন। দেবেন্দ্রনাথ অনেক হিন্দু রীতিনীতি মানলেও পণপ্রথার ঘোর বিরোধী। নাতনীর বিবাহে তিনি অবশ্যই দু হাত ভরে যৌতুক দেবেন, কিন্তু পাত্র-পক্ষের কোনও দাবি থাকলে বেঁকে বসবেন।
রবি একদিকে আশুকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনল। বসাল তিনতলায় নিজের মহলে। মৃণালিনী এমনিতেই বাইরের লোকের সামনে বিশেষ আসতে চায় না, এখন তার শরীরে গর্ভলক্ষণ স্পষ্ট, এখন পরপুরুষের নজরে আসার প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিভাকে ডেকে আনা হয়েছে কেক-পেস্ট্রি চা পরিবশনে সাহায্য করার জন্য। লোরেটো স্কুলে পড়া মেয়ে প্রতিভা কথাবার্তায় অত্যন্ত সপ্রতিভ, অন্য মেয়েদের মতন সে অপরিচিতদের সামনে লজ্জায় বাক্যহারা হয়ে যায় না। রবি গান-বাজনার প্রসঙ্গ তুলে প্রতিভাকেও যোগ দেওয়ালো সেই আলোচনায়। বাংলা গান তো বটেই, বিলিতি সঙ্গীতও বেশ ভালো জানে প্রতিভা।
একবার আশুদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বেশ নাকাল হয়েছিল রবি। কৃষ্ণনগরে গান-বাজনার খুব চর্চা আছে, শিক্ষিত ভদ্ৰ ব্যক্তিরা প্রায় সবাই মাৰ্গ সঙ্গীত বোঝে। সব জায়গাতেই রবিকে গান গাইতে অনুরোধ করা হয়, সেখানে গান শুরু করেছিল রবি। রামকেলি রাগে ‘জিন ছুঁয়া মোরি বেঁয়া নগরওয়া’ এই হিন্দি গান ভেঙে সে গাইছিল ‘বাঁশরী বাজাতে চাহি বাঁশরী বাজিল কই’। রামতনু লাহিড়ির ছেলে সত্য লাহিড়ির বাড়িতে বসেছিল সেই আসর। রবির গানটি শেষ হবার পর একজন হঠাৎ মন্তব্য করেছিল, হ্যাঁ, বাঁশরী তো অনেকেই বাজাতে চায়, কিন্তু বাজাতে চাইলেই কী বাঁশরী বাজে? বাঁশরী বাজাতে গেলে ভালো করে তালিম নিতে হয়! সে মন্তব্য শুনে হেসে উঠেছিল অনেকে।
ওইসব শ্রোতারা রাগ সঙ্গীতে তান কর্তব শুনতে অভ্যস্ত। মিড় নেই, গমক নেই, হলক তান নেই, সাদামাটা সুরে গান আবার গান নাকি! ওদের ধারণা হয়েছিল, রবি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কিছু না শিখেই গাইতে বসেছে।
সেই প্ৰসঙ্গ তুলে রবি বলেছিল, ভাই আশু, কলকাতার তুলনায় তোমাদের কৃষ্ণনগরের মানুষ অনেক পিছিয়ে আছে। বিশুদ্ধ রাগ সঙ্গীত ছাড়া কি গান হয় না! নানা ধরনের সুর মিশিয়েও তো কাব্য সঙ্গীত হতে পারে। কীর্তন কিংবা রামপ্রসাদী গানেও তো তানের বাড়াবাড়ি নেই, কথাগুলিই আসল। রামপ্রসাদ তো তোমাদের ওদিককারই লোক।
আশু বলেছিল, গোঁড়ারা মানতে চায় না। রামপ্রসাদী বা কীর্তন কি বড় আসরে মর্যাদা পায়! অনেকে ভাবে ওসব মাঠ-ঘাটের গান।
রবি বলল, খোলা মাঠের গানেরও কি মর্যাদা কম! বাংলার মাঝিরা যে ভাটিয়ালি গায়, রাখালরা বাঁশিতে যে সুর ধরে, তা কি আমাদের মন টানে না! রাগের বিশুদ্ধতা ধরে বসে থাকলে নতুন নতুন সুরের সৃষ্টি হবে কী করে?
কথায় কথায় এদেশি সুরের সঙ্গে বিলিতি সুরের সংমিশ্রণের কথাও উঠল। উদাহরণ হিসেবে রবি কয়েকখানা গান শোনাতে বলল প্রতিভাকে। প্রতিভা গিয়ে পিয়ানোতে বসল। তারপর প্রতিভা একটার পর একটা গেয়ে যাচ্ছে, আর আশু যেভাবে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, তাতে রবি যেন একটা ভবিষ্যতের ছবি দেখতে পেল। কয়েক বছরের মধ্যেই খ্যাতিমান ব্যারিস্টার হয়ে উঠেছে আশু, যেমন তার প্রতিপত্তি তেমনিই অর্থাগম হচ্ছে প্রচুর, আর প্রতিভা সেই ব্যারিস্টারের উপযুক্ত গৃহিণী। সান্ধ্য পার্টিতে সে আমন্ত্ৰিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এইরকম ভাবে পিয়ানো বাজিয়ে গান গেয়ে শোনাবে।
প্রতিভা ও আশু যে পরস্পরকে পছন্দ করেছে তা জানতে দেরি হল না রবির। এরপর সে চুঁচুড়ায় গিয়ে বাবামশাইয়ের কাছে কথাটা পড়ল।
দেবেন্দ্রনাথ প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন কনিষ্ঠ পুত্রের দিকে। রবি ঘটকালি করছে!
তাঁর পুত্রদের কার কী যোগ্যতা তা সঠিক বোঝেন দেবেন্দ্রনাথ। রবির ব্ৰহ্মসঙ্গীত রচনার প্রতিভায় দিন দিন মুগ্ধ হচ্ছেন তিনি। কাব্য ও সঙ্গীত রচনায় এ ছেলে যে তার অন্য সব ভাইদের ছাড়িয়ে যাবে, তাতে এখন আর কোনও সন্দেহ নেই। জমিদারির কাজও কিছু কিছু শিখছে রবি। কিন্তু ঘটকালি করাও যে রবির পক্ষে সম্ভব, তা তিনি চিন্তা করেননি। কবিরা তো শব্দের সঙ্গে শব্দের বিয়ে দেয়, অন্য কোনও বিয়ে নিয়ে কি তারা মাথা ঘামায়!
প্রতিভাকে যে এতদিন বিয়ে না দিয়ে অরক্ষণীয় করে রাখা হয়েছে, তার জন্য বেশ বিরক্ত ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি নানান প্রশ্ন করে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাত্রটির নিজের যোগ্যতা ও বংশপরিচয়ের কথা জানতে লাগলেন। তারপর অপ্রত্যাশিত ভাবে তিনি হঠাৎ বললেন, এ তো খুবই উপযুক্ত প্রস্তাব।
তিনি রাঢ়ী-বারেন্দ্রর প্রশ্ন তুললেন না, পাত্রের পিতার বৈষয়িক অবস্থা জানতে চাইলেন না, এ ছেলেটি যে পরম বিদ্বান, এটাই যেন তাঁকে আকৃষ্ট করল সবচেয়ে বেশি। তিনি রবিকে বললেন, যত শীঘ্র পার ব্যবস্থা করো। আমার আশীর্বাদ পাবে।
আশুর বাবাকে রাজি করানো অবশ্য এত সহজ হল না। সে বাড়ির লোকজনরা যৌতুক ও পণ নিয়ে দরাদরি শুরু করে দিল। রবি আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করল যে দেবেন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় যৌতুক হিসেবে যা দেবেন তা পাত্র-পক্ষের কাছে আশাতীত হবে কিন্তু প্রথা অনুযায়ী চৌধুরীরা আগে থেকে শর্ত করে নিতে চায়।
সম্বন্ধ যখন প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম, সেই সময় আশু নিজে থেকেই আর একদিন জোড়াসাঁকোয় এসে চা খেতে চাইল। আবার প্রতিভার গান শুনল সে। এতদিন সেবাড়ির লোকের কথার ওপর কোনও কথা বলেনি, এবার সে রবিকে জানাল, আমার ভাই-বোনেরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, তারা একটা তারিখ ঠিক করে ফেলতে চায়। ভাই রবি, আমার শুধু একটিই শৰ্ত আছে, বিয়ের ব্যাপারে বেশি আড়ম্বর আমি পছন্দ করি না, এ বিয়েতে কোনও যৌতুক দেওয়া চলবে না।
ঠাকুর পরিবারের রীতি অনুযায়ী বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান হল জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই। আশুর বাবা এলেন না, আর ভাই-বোনেরা বাসরঘরে আসর জমিয়ে রাখলেন। সার্থক হল রবির জীবনের এই প্রথম ঘটকালি।
আশুর পক্ষে ঘরজামাই হবার প্রশ্নই ওঠে না। নববধূকে সে নিয়ে গেল স্কট লেনের ছোট বাড়িতে। কয়েকদিনের মধ্যেই দিব্যি সংসার গুছিয়ে নিল প্রতিভা। এত ধনী পরিবারের কন্যা হয়েও এরা তেমন বেশি বিলাসিতায় অভ্যস্ত নয়। প্রতিভা বেশ মানিয়ে নিতে পারল অল্প জায়গায় মধ্যেই। রবি এখন প্রায় প্রতিদিনই আসে। ‘বালক’ পত্রিকা দেখাশুনোর ভার সে ছেড়ে দেবার পর এখন সে পত্রিকা মিশে গেছে ভারতী-র সঙ্গে। রবির ওপর এখন বিশেষ কোনও দায়দায়িত্ব নেই। আশুর সঙ্গে বসে বসে সে তার নতুন বইটির জন্য কবিতাগুলি সাজায়।
একদিন এ বাড়িতেই প্রেসিডেন্সি কলেজের দুটি ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় হল রবির। কৃষ্ণনগর অঞ্চলে মামাবাড়ির সূত্রে যাদুগোপালের সঙ্গে আশু চৌধুরীদের একটা আত্মীয়তা আছে। যাদুগোপাল তার বন্ধু ভরতকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ভরত স্বভাবলাজুক, অচেনা পরিবেশে সে বিশেষ কথা বলতে পারে না। যাদুগোপাল আবার তেমনই বাকপটু, তার মুখে খই ফোটে। তার কৌতূহলেরও শেষ নেই। রবির কবিতার সে ভক্ত, রবিকে নানান প্রশ্ন করতে লাগল সে। রবি বেশ উপভোগ করছে তার কৌতূহল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা এখন রাজনীতিতে মেতেছে, তারা তা হলে কবিতাও পড়ে!
ভরত এক সময় শুধু জিজ্ঞেস করল, রবিবাবু, বালক পত্রিকায় আপনার যে ধারাবাহিক কাহিনীটি বেরুচ্ছিল, সেটা আমি পড়েছি। আপনি কখনও ত্রিপুরায় গেছেন?
রবি বলল, না, যাইনি। যাবার ইচ্ছে আছে।
যাদুগোপাল বলল, কোন জায়গায় না গিয়েও এমন নিখুঁত বর্ণনা, সত্যি বিস্ময়কর!
আশু হাসতে হাসতে বলল, কবিরা স্বর্গ এবং নরকের বর্ণনাও লেখে, যেমন ধরো দান্তের ডিভাইন কমেডি, উনি কিন্তু ওই দুটো জায়গায় না গিয়েই লিখেছেন।
যাদুগোপাল বলল, আমার বন্ধু ভরতের বাড়ি ত্রিপুরায়।
রবি বলল, তাই বুঝি? ত্রিপুরায় বেড়াতে গেলে তোমাদের বাড়িতে থাকতে দেবে?
ভরত দু দিকে মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বলল, ওখানে আমাদের কোনও বাড়ি নেই।
কথা ঘুরিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে যাদুগোপাল নানা প্রশ্নের মধ্যে একবার জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা রবিবাবু, আপনি তো অনেক রকম কাজ করেন, আদি ব্ৰাহ্মসমাজের কাজ, জমিদারির কাজ দেখা, এত রকম লেখা, এর মধ্যে কোনটা আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?
রবি বলল, কী জানি, তা তো ভেবে দেখিনি।
মুখে না বললেও রবি জানে, কী তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। কোনও কাজ নয়, ছুটোছুটি নয়, বক্তৃতা নয়, এগুলো করতে সে বাধ্য হয়। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে একা একা শুয়ে থাকতে। আর লিখতে। কবিতা, গদ্য, গান হেঁয়ালি, চিঠি, শুধু লেখা, যে-কোনও লেখা। একটার পর একটা শব্দ খুঁজে খুঁজে নির্বাচন করে গেঁথে কোনও কিছু নির্মাণ করাই তার মনে হয় শ্ৰেষ্ঠ নির্মাণ!