ফেয়ারলি প্লেসে ব্ল্যাকারদের সঙ্গে হাতাহাতি করে, লাইন ম্যানেজ করে এবং বুকিং ক্লার্কদের সঙ্গে বিস্তর অর্থহীন কথা বলে সরিৎ এলাহাবাদের তিনটে সেকেন্ড ক্লাস স্লিপারের টিকিট কেটে ফেলল। ঝাড়া ঘণ্টা চারেকের চেষ্টায়।
বেরিয়ে এসে টিকিটগুলোর দিকে চেয়ে চুকচুক করে একটু আফসোসের শব্দ করল। একেবারে ফালতু গচ্চা। এলাহাবাদ পর্যন্ত অনায়াসে বিনা টিকিটে যাওয়া যেত, খরচ লাগত অর্ধেকের কম। কিন্তু সেজদিকে সে কথা বলাই যায় না।
শেষবেলায় বাড়িতে ফিরে বিজয়ীর মতো হেসে সেজদির হাতে টিকিট দিয়ে বলল, ব্ল্যাকে কাটতে হয়নি। লাইনেই পেয়ে গেলাম।
তৃষা কোনও জবাব দিল না। থমথমে গম্ভীর মুখে টিকিটগুলো নিয়ে ঘরের আলমারিতে রেখে এল। বলল, সজলকে একটু ডেকে দিয়ে যাস তো। বোধহয় পুরনো গোয়ালঘরটায় আছে।
সরিৎ গিয়ে দেখে, মস্ত বালির বস্তায় হাতে ন্যাকড়া জড়িয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুসি চালাচ্ছে সজল। মুখ রক্তবর্ণ, সর্বাঙ্গে জবজবে ঘাম।
অবাক সরিৎ বলে, কী করছিস? বক্সিং?
সজল গম্ভীর মুখে বলে, হ্যাঁ।
কে শেখায় তোকে?
কেউ না। নিজে শিখছি।
সরিৎ নিজের কাজকর্ম এবং ভবিষ্যৎ তৈরি করতে ইদানীং এতই ব্যস্ত ছিল যে, সজলকে ভাল করে লক্ষই করেনি। আজ করল। এবং একটু অবাক হল।
তুই কত ফুট লম্বা রে?
পাঁচ নয়।
সজলের উচ্চতা ওরকমই হবে। বেশি ছাড়া কম নয়। তবে আরও লম্বা হবে। অনেক লম্বা। সরিতের নিজের হাইট মাত্র পাঁচ আট। কিন্তু সে আর বাড়বে না। শুধু লম্বাই নয়, সজলের কাঠামোটা আশ্চর্য রকমের মজবুত। কবজি দুখানা চওড়া, হাত দুখানা যেমন লম্বা তেমনি দ্রুতগতিসম্পন্ন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এবং সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হল, সজলের দু’খানা, চোখ।
বহুকাল বাদে হঠাৎ একটা অজানা ভয়ে বুকটা সামান্য কেঁপে উঠল সরিতের। এ ছেলেকে সামলানো মুশকিল হবে। এর ওপর আধিপত্য করা যাবে না কখনও। এসব সরিৎ এক নজরেই বোঝে।
সে তবু মুখে হাসি টেনে এনে বলল, খুব তিনঠ্যাঙা লম্বা হয়েছিস তো!
সজল ঘুসি থামিয়ে ঘরের বেড়ায় গোঁজা একটা টার্কিশ তোয়ালে দিয়ে ঘাম মোছে।
সরিৎ মস্ত বস্তাটায় হালকা দু-একটি ঘুসি মেরেই বুঝতে পারে, এই ভারী কর্কশ বালিতে ধার হয়ে ওঠা বস্তায় একনাগাড়ে ঘুসি মারা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কবজি ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, লিগামেন্ট ছিঁড়তে পারে।
সরিৎ ডান হাতটা বাড়িয়ে বলল, তোর পাঞ্জার কেমন জোর হয়েছে!
সজল একটু হাসল, তারপর হাত বাড়িয়ে সরিতের চেয়ে অন্তত দেড়গুণ বড় থাবায় চেপে ধরল হাতখানা।
সরিৎ বিস্তর মারপিট করে হাড্ডি পাকিয়ে ফেলেছে। তার হাতে ব্যথা লাগে না, তবু হাতখানা ধবে সে বুঝতে পারল, সজলের গায়ে জোর যে তার চেয়ে বেশি তাই নয়, বহু বহুগুণ বেশি। সরিৎ না হয়ে অন্য কেউ হলে সজলের আঙুলের চাপে ককিয়ে উঠত। সরিৎ ককিয়ে উঠল না, কিন্তু আবার এক অজানা ভয়ে খানিকটা বিবর্ণ হয়ে গেল।
সজলের পিঠ চাপড়ে সরিৎ বলে, ভাল তৈরি হয়েছিস। খুব ভাল। তোকে কয়েকটা শক্ত কায়দা শিখিয়ে দেব। কালিম্পং-এর একজন ব্রাউন বেল্টের কাছ থেকে শেখা।
সজল খুব উৎসাহ দেখাল না। উদাস মুখে বলল, দিয়ো।
এখন যা। তোকে সেজদি ডাকছে।
গায়ে গেঞ্জি ছিলই। বেড়ার গা থেকে জামাটা টেনে গায়ে চড়াল সজল। বলল, তুমি এগোও। যাচ্ছি।
চিন্তিত মুখে সরিৎ গিয়ে তার মোপেড চালিয়ে বাজারে গেল। ত্রয়ীতে নতুন মাল এসেছে। দাম ফেলতে হবে।
জামার ওপর হাতকাটা সোয়েটার চাপিয়ে সজল এসে মায়ের ঘরের সামনে দাঁড়ায়।
তৃষা বেরিয়ে আসে।
শেষবেলায় শীতের ম্লান রোদ পড়েছে সজলের মুখে। মুখের ঘাম সবটা মরেনি এখনও।
লম্বা, সারবান চেহারা। চোখের দৃষ্টি এই বয়সেই যথেষ্ট স্থির এবং গভীর। নির্ভুল একজনের ছাপ পড়েছে সজলের চেহারায়। কিন্তু সেই লোকটিকেও দিনকালে এ ছেলে ছাড়িয়ে যাবে। তৃষা কিছুতেই আজকাল ছেলের সামনে সহজ বোধ করে না। কেমন অস্বস্তি হয়।
ডেকেছ?
তৃষা গম্ভীর মুখে বলে, সামনের সপ্তাহে আমরা এলাহাবাদ যাচ্ছি।
আমরা মানে!
আমি, তুই আর সরিৎ।
আমি গিয়ে কী করব? স্কুল কামাই হবে না?
মামি তোকে দেখতে চেয়েছে। আমরা বেশিদিন থাকব না।
সামনেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা।—সজল ঘাড় শক্ত রেখেই জবাব দেয়।
দু-তিন দিনে কিছু হবে না!
বড়দির বিয়ের ব্যাপার, সেখানে আমাকে দিয়ে কী হবে?
কিছু হবে না। কিন্তু আমি তোমাকে একা বাড়িতে রেখে যেতে চাই না।
সজল অবাক হয়ে বলে, একা কেন? মেজদি, ছোড়দি আছে, বাবা আছে।
তাদের থাকা না-থাকা সমান। তুই কবে থেকে মুখে মুখে জবাব দিতে শিখলি?
তুমি বোকার মতো কথা বলছ বলেই জবাব দিচ্ছি।
বোকার মতো!–বলে স্তম্ভিত হয়ে তৃষা চেয়ে থাকে ছেলের দিকে। এত সাহস! এত সাহস এরা কোখেকে পায়?
কিছুক্ষণ তৃষা কথাই বলতে পারল না।
সজল অভ্যাসবশে একটু ভয় পেল। মা সম্পর্কে এখনও তার ভয়টা পুরোপুরি যায়নি। শক্ত কাঠামোর গম্ভীর ও আদরহীন তার এই মা তো গায়ের জোরে সবাইটে ঢিট করে রাখেনি। আর-একটু কিছু আছে। সেই রহস্যময় অজানা একটু কিছুকেই পেরোনো যায় না।
সজল চোখ নামিয়ে বলে, এখন আমি যেতে পারব না। তুমি মেজদি বা ছোড়দিকে নিয়ে যাও।
তৃষা কিছু বলল না। নিঃশব্দে ঘরে চলে গেল। ঘরের ঠিক মাঝখানে আবহাওয়ায় কিছুক্ষণ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। রাগ হয় না, পরাজয়ের গ্লানিও বোধ করে না। শুধু এক শূন্যতা এসে তার ভিতরটাকে ফাঁকা বোধবুদ্ধিহীন করে দেয় কিছুক্ষণের জন্য।
সজল নিজের ঘরে গিয়ে জামা-প্যান্ট পালটায়। একটু চিন্তিত, উদ্বিগ্ন।
আগে সে মায়ের কাছে থাকত। তারপর জায়গা হল দুই দিদির ঘরে। সম্প্রতি তার একটা আলাদা ঘর হয়েছে। এ ঘরে সে একা থাকে। ভূতের ভয় পেত আগে। এখন পায় না। আজকাল খুব কম জিনিসকেই ভয় পায় সজল।
চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে সে এলাহাবাদ যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল। বেড়াতে যাওয়া খারাপ নয়, কিন্তু এখন তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হয় সে চলে গেলে বাবার বিপদ হবে।
পায়ে চটি গলিয়ে সজল ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ভাবন-ঘরে এসে ঢোকে।
বাবা!
শ্রীনাথ বাগানের ধারের রাস্তায় বেড়াবে বলে গলায় কম্ফর্টার জড়িয়ে তৈরি হচ্ছিল। বলল, কী রে?
মা এলাহাবাদ যাচ্ছে।
জানি। চিত্রার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে।
আমাকেও নিয়ে যেতে চাইছে।
শ্রীনাথ ভালমানুষের মতো বলে, যা না। ঘুরে আয়।
আমি বলেছি যাব না। সামনে পরীক্ষা।
ও। তাও তো বটে। তবে তোকে নিয়ে যেতে চায় কেন?
কী জানি। মার ধারণা, এ বাড়িতে একা থাকলে আমি বদমাইশি করব।
শ্রীনাথ মুখ বিকৃত করে বলে, বাজে কথা।
মা খুব রাগ করেছে। তুমি মাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?
কী বলব বল তো?
বোলো, আমি চলে গেলে তোমার অসুবিধে হবে।
তাতেও তো তোর মা রেগে যাবে।
সে আমি জানি না। তুমি যেমন করেই হোক যাওয়ার ব্যাপারটা কাটিয়ে দাও।
শ্রীনাথ চিন্তিত মুখে চেয়ে থেকে বলে, আমার কথার কি কোনও দাম আছে ওর কাছে? তবু বলে দেখব।
তুমি বললেই হবে।
খুবই গম্ভীর মুখে সরিৎকে নিয়ে পরের সপ্তাহে এলাহাবাদ রওনা হয়ে গেল তৃষা। তিনদিনের নাম করে গেল, সাতদিনও এল না বা চিঠি দিল না।
তুষার খবরের জন্য এ বাড়ির কেউই উদ্বিগ্ন নয়। শুধু বুড়ো দীননাথ মাঝে মাঝে ডাক-খোঁজ করেন, ওরে বউমার পৌঁছন সংবাদ এল? ডাকঘরে একটু খোঁজ নে না তারা। এরা তো কত চিঠি হারিয়ে ফেলে, বিলি করে না।
প্রায় রোজই মঞ্জু আর স্বপ্নার সঙ্গে সজলের ঝগড়া হয় আজকাল। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। বাগানে প্রায়ই গোরু ঢোকে। বাড়ির গোরু দুয়ে দুধ অনেক কম হয়, গ্রাহকরা রাগারাগি করে। হাঁস মুরগিদের ডিমও কম পড়ছে আজকাল। উঠোনে শুকনো পাতা পড়ে থাকে। তৃষার ঘরের দাওয়ার নীচে বসে ইস্পাত রাতবিরেতে কেঁদে ওঠে প্রায়ই।
এই তক্কে একদিন মালাবদল সেরে নিশুতিরাতে চুপিচুপি বিনিকে এনে ঝোপড়ায় তুলে ফেলল খ্যাপা নিতাই।
পরদিন তাকে নিয়ে হইচই পড়ে গেল বাজারে। জটা নেই, টেরিকাটা মাথা। দাড়ি কামানো। প্রথমটায় লোকে চিনতেই পারেনি। গম্ভীর মুখে বাজার করছিল। একজন দু’জন করে চিনে ফেলতেই ভিড়ে ভিড়াক্কার।
নিতাই ভিড় ভালবাসে। তাকে নিয়ে লোকে হইচই করুক তাও চায়।
সে ভিড়ের দিকে হাত তুলে বরাভয় দেখিয়ে টিউবওয়েলের মাথায় উঠে দাঁড়াল। গলা ঝেড়ে বলল, ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের পরিচিত নিত্যানন্দ মহারাজ এখনও নিত্যানন্দ মহারাজই আছেন। তন্ত্রসাধনা অতি গুহ্য সাধনা। এর স্বরূপ কেউ জানে না। গতকাল গুরুদেব স্বপ্নে আদেশ করলেন, ওরে নিতাই, অনেককাল ব্রহ্মচর্য হল। এবার একটু গেরস্থ হ। গৃহস্থ না হলে সংসারটাকে টের পাবি কী করে? তোর তো পনেরো আনাই হয়ে আছে, এইটে হলেই ষোলা আনা হয়…
শুনে লোকে হাততালি দিল।
পনেরো দিনের মাথায় এলাহাবাদ থেকে কাশী আর লক্ষৌ ঘুরে তৃষা ফিরে এল। নিতাই ঝোপড়ার দরজা আর দিনমানে খুললই না সেদিন।
তৃষা ফিরে আসার পরই গোরুর দুধ বেড়ে যায়, হাঁস-মুরগিরা উচিত মতো ডিম পাড়ে, উঠোন ঝকঝক করে, মঞ্জু স্বপ্না আর সজলের ঝগড়া মিটে যায়।
তবে তৃষার মুখ একটা কাঠের মুখের মতো গম্ভীর থাকে। সহজ হয় না, স্বাভাবিক হয় না।
পরদিন সকালে শ্রীনাথের ঘরে এসে তৃষা বলল, ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে। মত দেব?
পছন্দ হলে মত দেবে না কেন?
তোমার মতও তো আছে!
আমার মত বলে কিছু নেই।
কিন্তু তুমি মেয়ের বাবা, চিঠিটাও তো তোমাকেই লিখতে হবে।
আমি আজকাল লিখতে পারি না। হাত কাঁপে। তুমি লিখে দাও বয়ানটা, আমি সই করে দিচ্ছি।
ছেলেটা কেমন তা জানতে চাইলে না?
তোমার যখন পছন্দ হয়েছে তখন ভালই হবে। সংসারের এসব ব্যাপার তুমি আমার চেয়ে অনেক ভাল বোঝে।
তৃষা চলে আসে। ঝোপড়ার বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুই জোড়া ভিতু চোখ লক্ষ করছিল তৃষাকে। এখনও টের পায়নি। বিনি যে এ ঘরে আছে তা কারও জানা খবর নয়। ধরা পড়লে কী হবে তাও ভেবে ঠিক করতে পারছে না দুজনে।
তৃষাকে কেউ কিছু বলেওনি। তবু আনমনে ভিতরবাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে তৃষা একবার আলতো দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ঝোপড়ার দিকে। তাকিয়েই ভ্রু কোঁচকাল। ঝোপড়ার উঠোনটা নিকোনো, ঘাস চাচা! একটা নতুন গামছা ঝুলছে দড়িতে।
ঘরে এসে সে মংলুকে ডেকে বলে, খ্যাপা নিতাইকে ধরে আন তো। আর দেখে আসবি ওর ঘরে কেউ আছে কি না।
বলেই পরমুহূর্তে আবার কী একটু ভেবে বলল, থাক এখন। বিকেলের দিকে ডেকে আনলেই হবে।
মংলু হাসিমুখে বলে, আজ্ঞে নিতাই জটা হেঁটে ফেলেছে। দাড়িও চেঁচেছে।
তৃষা কাঠমুখেই বলল, ও। আচ্ছা যা। সজলকে বলিস, যেন স্কুলে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।
প্লাস পাওয়ারের চশমা চোখে পাত্রপক্ষকে দেওয়ার চিঠিটা মুসাবিদা করতে বসল তুষা। খুব বেশিকিছু লেখার নেই। তা হলেও অনেকটা সময় নিয়ে সে নির্ভুল করল চিঠিটাকে।
মা!
তৃষা তাকায়। দরজায় সেই মানুষটার ছায়া। সারাজীবনে যে একটি মাত্র মানুষকে ভালবাসতে পেরেছিল তৃষা। কিন্তু তার এই ছায়াকে সে কেন ভালবাসার চেয়েও ভয় পায় বেশি?
মা আর ছেলে মুখোমুখি তাকিয়ে থাকে। দুজনেই আজ যেন স্পষ্ট বুঝতে পারে, আমরা পরস্পরের শত্রু।