2 of 2

৫৮. বাসটা ছেড়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ

৫৮

বাসটা ছেড়ে দিয়েছে অনেকক্ষণ। পুবে আলো ফুটেছে সবে। আরও এগিয়ে চিল্‌পিতে গিয়ে ডানদিকে মুক্কির দিকে মোড় নেবে। তারপর মুক্কির চেক্‌নাকা, কান্‌হা টাইগার প্রোজেক্টে ঢোকবার পথকে ডানদিকে এবং রেঞ্জারের বাংলোকে বাঁদিকে রেখে বান্‌জার নদীর উপরের ব্রিজ পেরিয়ে আই টি ডি সির কান্‌হা সাফারী লজ্‌কে বাঁয়ে রেখে চলে যাবে বাইহারের দিকে। বাইহার থেকে বাঁদিকে চলে গেছে পথ ভারতের সবচেয়ে বড় তামার খনি ও কারখানা মালাঞ্জ খণ্ড-এ। পৃথু যাবে সোজা বালাঘাটের দিকে।

এতক্ষণে নিশ্চয় খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের কালো কুচ্‌কুচে যুবতী আয়া সাদা ধব্‌ধবে জোয়ান অ্যালসেসিয়ান কুকুর ও তার নববিবাহিতা লালচে রঙা স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়েছে জঙ্গলের দিকে। অ্যাল্‌সেসিয়ানের রঙ তো সচরাচর লালচে হয় না। হয়তো বিয়ে হয়েছে তার অন্য জাতের কুকুরীর সঙ্গে। বিয়ে হয়নি এখনও শুধু আয়াটির। কবে হবে, কে জানে? তবু, বিয়ে হোক কি নাই-ই হোক, প্রত্যেক মানুষ এবং জীবের প্রকৃত মুক্তি নিহিত থাকে প্রকৃতিরই মধ্যে।

কুকুররা এ কথাটা অনেক আগেই বুঝেছে; মানুষ কবে বুঝবে কে জানে?

হাটচান্দ্রার সকলে যখন শুনবে তার না-বলে চলে আসার কথা, ওরা ভাববে পৃথু ঘোষ ভীরু হয়ে গেছে। ভীরুর মতো চলে গেল। শামীম দুঃখ পাবে, ইন্তেজাম করার পরও না-খাওয়াতে। কিন্তু…জবাবদিহিও করতে চায় না কারও কাছেই। জবাবদিহি করার ভদ্রতা, শিষ্টতা, সামাজিকতার একটা সময় এবং বয়স থাকে। তার পর সবই মনে হয় বাহুল্য। কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। বড় বেশি এবং বড় বাজে কথা বলা হয় এই পৃথিবীতে। যার নব্বুই ভাগ বলা এবং শোনা না হলে এই জায়গাটি মানুষের বাসের পক্ষে অনেকই বেশি উপযুক্ত থাকত।

গিরিশদার কথা মনে হল। কাল দুপুরে ভোজ যা খাওয়ালেন তার তুলনা নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

অন্য কথা, মন খারাপের নয়, মন ভাল হওয়ার ভাবনা, ভাবতে চাইল ও।

আজ ভোরে এক অচেনা, অজানা, অনিশ্চিত জীবনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মনকে একেবারেই ভারাক্রান্ত করতে চায় না পৃথু।

ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। মাথাটা বাসের দেওয়ালে ঠুকে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। রাত বিজ্‌লীর বাড়ি থেকে ফেরার পর যতটুকু বাকি ছিল, তা তো গোছগাছ করতেই গেছে। চোখের পাতা এক করেনি একবারও। বিজ্‌লীর বাড়ি থেকে ফিরেওছে প্রায় একটার সময়। শরীরটা তো এখনও অসুস্থই! একটু জ্বর ভাবও হয়েছে। কাটা পা-টা মাঝে মাঝেই থর্‌থরিয়ে কেঁপে ওঠে। অসহ্য যন্ত্রণা হয় তখন। পা-টা যেন কী বলতে চায় পৃথুকে, যে সব কথা সে কর্তিত হওয়ার আগে বলে উঠতে পারেনি; অথচ ইচ্ছা ছিল খুবই বলার।

মুক্কিতে সামান্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই বাসটা ছাড়ল আবার। মুক্কির পরেই সান্‌জানা সাহেবের বাড়ির ঠিক সামনেই দেখে ঠুঠা বাইগা দাঁড়িয়ে আছে আর দেবী সিং পায়চারি করছে। সান্‌জানা সাহেবের কোনও কর্মচারীর পরিবারও বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দু’জন মহিলা, একটি শিশু এবং খাঁচার মধ্যে একটি ময়না পাখি। ময়না, শেখানো বুলি বলল, সারভিস্, রোক্কো! রোক্কো!

বাসসুদ্ধ লোক হেসে উঠল।

ঠুঠাকে দেখেই, পৃথু চেঁচিয়ে ডাকল। মনে হল, শুনতে পেল না ঠুঠা। পৃথু যে একদৌড়ে নামবে বাস থেকে তা তো আর হবার নয়।

দেবী সিং শুনে দৌড়ে এল। বলল, কোথায় চললেন আপনি?

সীওনী।

আজই যে আমরা আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম হাটচান্দ্রায়। ভাগ্যিস দেখা হয়ে গেল।

যেও না সেখানে। এখন থেকে আমার ঠিকানা সীওনী।

তারপর অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঠুঠার দিকে চেয়ে বলল, ঠুঠা বাইগা?

দেবী সিং বলল, সেই-ই তো কথা! ঠুঠার কী হবে? চাকরিও তো ছেড়ে দিয়ে এসেছে, প্রাণটা কোনওক্রমে বাঁচিয়েছি আমি। ও তো বলে, আপনার জন্যেই এখন ওকে বেঁচে থাকতে হবে। আপনার একমাত্র গার্জেন নাকি ও।

এখনই বাসে তুলে দাও।

পৃথু বলল।

ওর যে জিনিসপত্র আছে কিছু। সারা জীবনে, বান্‌জারা নদীর বুকের মধ্যে গড়িয়ে-চলা পাথরের গায়েও কিছু শ্যাওলা জমেই।

দেবী সিংয়ের উপমাতে চমকে উঠল পৃথু। জীবনানন্দ কি ঠিক বলেছিলেন? সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি? কবি বোধহয় সকলেই। কেউ পাতায় লেখে, কেউ কথায় লেখে; কেউ বা লেখে মনে মনে।

অন্যমনস্ক পৃথু, দেবী সিংকে বলল, তবে কালকের বাসেই তুলে দিও ওকে। আমি নিজে বাসস্ট্যান্ডে এসে নিয়ে যাব।

আপনার ঠিকানা সাহাব?

জানি না আমি।

ঠিকানা জানেন না মানে?

দেবী সিংয়ের এই কথাতে বাসসুদ্ধ লোক পৃথুর দিকে তাকাল।

সত্যি জানি না এখনও। তবে ঠিকানা একটা জুটবেই। মানুষের ঠিকানা না থাকলে যে উপায় নেই কোনও। সেজন্যে কোনও চিন্তা কোরো না। কাল ঠুঠাকে পাঠিয়ে দিও। টাকা দিয়ে যাব কিছু?

টাকা আছে। ঠুঠার নিজের টাকাই আছে। তবে…

কথা শেষ হল না। বাসটা সেই দুই মহিলা, এক পুরুষ, তাদের মালপত্র এবং ময়না পাখিকে তার পেটের খোলে ভরে নিতেই কনডাকটর বাঁ পায়ে এক লাথি মারল বাসের ঘাড়ে। বলল, ওক্কে উস্তাদ।

বাসটা ছেড়ে দিল।

কথা শেষ হবার আগেই বাহন যে ছেড়ে দিতে পারে, এমন অভিজ্ঞতায় পৃথু অভ্যস্ত ছিল না কখনও। চিরদিনই গাড়ি বা জীপেই যাতায়াত করেছে। বুঝতে আরম্ভ করল ও যে, নিজের আর্থিক জোর না থাকলে বা অন্যকে ভয় পাওয়ানোর ক্ষমতা না থাকলে জীবনের বহু ক্ষেত্রেই সেই মানুষের নিজের স্বাধীনতাকে একটু একটু করে বাঁধা দিতে হয়ই অন্যের হাতে। নিরুপায়েই। এই হঠাৎ-ছেড়ে-দেওয়া বাসটিই তার প্রথম প্রমাণ হয়ে এল একদা “সম্ভ্ৰান্ত” পৃথুর কাছে। অর্থ আর সম্ভ্ৰম এখন যে একাত্ম হয়ে গেছে।

সার্ভিসের বাস ড্রাইভারেরও কিছু করার নেই। বাসের স্টিয়ারিং-আঁকড়ে-থাকা দুটি রোমশ হাতে অনেকই মানুষকে যে একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এক বিশেষ গন্তব্যে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব সে মানুষটা স্বীকার করে নিয়েছে। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, গেঁহু-বাজরার বা ভাব-ভালবাসার আলোচনার জন্যে বাস থামালে তার চলে না। সমষ্টির স্বার্থের কারণে ব্যক্তির স্বার্থ যে সমর্পণ করতে হয়ই; এই কথাটা পৃথুকে চমকে দিয়ে, ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ-ছাড়া এই বাসটি যেন বুঝিয়ে দিল। ব্যক্তির ছোট ঘেরাটোপের জগৎ থেকে সে যে সমষ্টির জগতে তার দেড়খানা পা নিয়ে জীবনের মাঝবেলাতে এসে প্রবেশ করল, এই কথাটা জেনে শিহরিত বোধ করল পৃথু। চলেছিল বাসে বসে, ভাবতে ভাবতে পৃথু। একজন কবি অথবা কবি-ভাবাপন্ন মানুষের জীবনে বোধহয় কোনও উপলব্ধিই ফেলা যায় না। সুখ, দুঃখ, সম্মান, অপমান, অভ্যর্থনা ও উপেক্ষা সবকিছুই তার জীবনকে, তার অভিজ্ঞতাকে যে সমৃদ্ধ করেই; সেই আলখাল্লা-পরা বুড়ো যেন হঠাই বলে উঠল ওর বুকের মধ্যে থেকে, “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা, ধুলোয় তাদের যত হোক অবহেলা, পূর্ণের পাদপরশ তাদের পরে।”

ঠুঠা বাইগাকে দেখে আদৌ স্বাভাবিক মনে হল না পৃথুর। ও এমন চোখে চাইল পৃথুর দিকে, যেন তাকে সে চেনেই না আদৌ। চোখের দৃষ্টি ঘোলা। তার চারদিকের কোনও দৃশ্য, শব্দ বা গন্ধই যেন তাকে আর স্পর্শ করছে না। সে যেন তার সমস্ত অনুষঙ্গকে অগ্রাহ্য করার এক দৈবী ক্ষমতায় ঋদ্ধ হয়েছে।

চমৎকার দৃশ্য কিন্তু পথের দু’পাশের! ছোট ছোট গ্রাম। মাঝে দু’ একটি জায়গাতে কলকারখানা হয়েছে ছোটখাট। আদিবাসী এলাকা সব। পথের দু’পাশে মাথা উঁচু পাহাড়। লাল-নীল নদী। মাইলের পর মাইল জনবসতিহীন গভীর নিবিড় অরণ্য। পাহাড়চুড়োয় উঠেই আবার উপত্যকায় গড়িয়ে গেছে।

পারিহার সাহেবের হেড কোয়ার্টার্স সীওনীতেই হবে কি? পারিহার সাহেব ছাড়াও, কান্তি দিসাওয়াল আছেন এখানে। বিড়িপাতার বড় কারবারী। লাক্ষার কারবারী মুঙ্গেশ শুক্ল তো আছেনই! আজ রাতটা তাঁদেরই কারও আশ্রয়ে থেকে তারপর থেকে নিজস্ব একটা ব্যবস্থা করে নেবে। আসলে, ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, হাটচান্দ্রা ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্তটি যে কাউকে এক লাইন লিখেও জানাবে তাও পারল না আগে। আগে জানিয়ে এলে, কেউ নিতেও আসত হয়তো বাস স্ট্যান্ডে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নিল সব যাত্রীরা বালাঘাটের শেষ প্রান্তের এক দোকানে। বেলা বারোটাতে যখন বাস থামল। ভাত আর শুয়োরের মাংস ঝোল খেল পৃথু, পেঁয়াজ কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। ভুচুকে সত্যিই মিস করছে এখন। লক্ষ্মণের মতো অনুজ বোধহয় একেই বলে। ভুচু থাকলে কত আদর করত! কতবার পান খাওয়াত। খাওয়ার আগে বলত, একটা তড়কা দিই তোমাকে বানিয়ে?

খাওয়া দাওয়ার পর পাশের দোকান থেকে পান কিনল দুটো। জর্দা দিয়ে খেলও। কিন্তু ভাল লাগল না। ফেলে দিল মুখ থেকে। মনে হল পৃথুর যে, পান শুধু মিষ্টি বা কলকাতা পাত্তি হলেই ভাল হয় না, সঠিক পরিমাণে চুন খয়ের বা এলাচ জর্দা পড়লেও হয় না। আসলে, তার মধ্যে বোধহয় ভালবাসাও মুড়ে দিত ভুচু বা গিরিশদা বা সাবীর সাহেব অথবা শামীম। ওদের কথা মনে হতেই মনে হল পুরুষের গভীর সখ্যতার মতো বোধহয় আর কিছু নেই। পুরুষের সঙ্গে একমাত্র অন্য একজন পুরুষেরই নিঃস্বার্থ ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে: যদি ওঠে।

একজন মোটা-সোটা লোক এক ছড়া কলা দিয়ে খাওয়া সারছিল। চেহারা দেখে মনে হল মাড়োয়ারী। এই ভদ্রলোকেরা নিজেদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে বড়ই সাবধানী। পথে বেরিয়ে, কি ট্রেনে, কি বাসে, ফলমূল ছাড়া অন্য কিছুই খান না এঁরা। রান্না-করা খাবারের তেলে, ঘিতে, আটাতে, ময়দাতে, চালে ডালে, মশলায় যে ভেজাল থাকেই সে সম্বন্ধে এঁরা এত নিঃসন্দেহ কী করে যে হন তা জানার কৌতুহল হয় পৃথুর মাঝে মাঝেই।

দোকানটার সামনে বেঞ্চে বসে ভদ্রলোক অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে একটার পর একটা কলা খেয়ে যাচ্ছিলেন, চোখ তাতেই নিবদ্ধ করে। এমন সময় দামড়া, মাস্তান এক হনুমান লম্বা লেজ নিয়ে একলাফে উল্টোদিকের জঙ্গল থেকে লাফিয়ে এসে কলার ছড়াটা কেড়ে নিল। সম্পত্তি নাশের আশংকায় কিছু মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হন। উনিও তাই-ই হলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মধ্যে প্রকৃত দর্শন জাগাবার জন্যেই বোধহয় হনুমানটি মারল এক জব্বর থাপ্পড় তাঁর গালে। হায় রাম! বলে, গালে হাত দিয়ে বেঞ্চ থেকে পড়ে গেলেন ভদ্রলোক। একজন প্রকৃত রামভক্তর সঙ্গে হনুমানজী এমন ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের মতো ব্যবহার করবেন এটা বোধহয় তাঁর কল্পনার বাইরে ছিল।

পৃথুর সাবীর মিঞার কথা মনে পড়ে গেল। একদিন রামভক্ত দিগা পাঁড়ের হাত থেকে এমনি করেই হনুমানে কলা নিয়ে যাওয়াতে রসিক সাবীর মিঞা অধিক হতচকিত দিগাকে ততোধিক দুঃখিত করে দিগার কাছ থেকেই শেখা একটি মানসমুক্তাবলী আউড়ে দিয়েছিলেন:

“মঞ্জুল মঙ্গল মোদময় মূরতি মারুতি পুত।

সকল সিদ্ধি কর কমল তল সুমিরত রঘুবর দূত॥

অর্থাৎ, শ্রীরামচন্দ্রর দূত পবন-নন্দন হনুমানজী মনোহর মঙ্গল এবং আনন্দর মূর্তি। তাঁকে স্মরণ করতেই সমস্ত সিদ্ধি করতলগত হয়।

বাস ছাড়ল আবার। পৃথু ফাঁকা-বাসে হাটচান্দ্রাতেই ড্রাইভারের পেছনে প্রথম সীট দেখে বসেছিল। যাতে ক্রাচ-টাচ নিয়ে আরামে বসতে পারে একটু। ক্রাচ দুটো সবসময় কাঁধে রাখাতে কাঁধের হাড় টনটন করছে।

এখন পথের দুধারে কাটাং-বাঁশ আর ছোটা-বাঁশ এর জঙ্গল। জঙ্গলে জঙ্গলে ধাওয়াই ফুটেছে লালে লাল হয়ে পথের দুপাশের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ফায়ার লাইনের জন্যে কাটা নালার পাশে। লণ্ডিয়া, এখন শেষ হয়ে গেছে। বড় বড় সুপুরির মতো দেখতে। তরকারি করে খেতে বেশ লাগে। লভেরা ফোটবার সময় হয়েছে। লটকার মতো। হররাও। বাঁদরে হনুমানে আর মানুষে সমান ভালবাসায় খায় হররা। হজমির কাজ করে। কাশিরও ওষুধ। কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকে তারপর কালো হয়ে যায় পাকলে। এ দিয়ে রঙ তৈরি করে গোন্দ বাইগা কুরমি পানকারা, বাড়ি-ঘর রাঙায় হালকা হলুদ রঙে। এসব নানা ফুলফল কাজে লাগে এই গরীব-গুরবোদের বর্ষার সময়েই বেশি। তখন অন্য সবজি তো কিছু থাকে না! এই সবই খেয়ে থাকে বলতে গেলে জঙ্গলের লোক। পিহিরি বা কুকুরমুত্তায় ছেয়ে যায় শালবনের নীচের সবুজ অন্ধকার। লালচে, খয়েরী, সাদা কালো এই সব ব্যাঙের ছাতার স্বপ্নিল ফুলের মতো ফুটে থাকে তখন।

মাশরুমস।

লছমার সিং খুব ভাল স্যুপ করত, চিকেন উইথ মাশরুম-এর মনে পড়ে গেল পৃথুর। কিন্তু এই সব মাশরুম কোনওদিনও রুষা ছুঁতোও না। সে বম্বে বা জবলপুর বা ভোপাল থেকে আনাত।

বর্ষার সময় পুটপুরাও হবে। আষাঢ় শ্রাবণে। এও শালবনের নীচে নীচে হয়। খেতে ডিমসেদ্ধর মতো। যেন, মুরগির ডিম। গরীবের কাছে এই-ই কুক্কুটাণ্ড। সোর্স অফ প্রোটিন।

আকাশে মেঘ করে আসছে। ঘন কালো মেঘ জমেছে পরতের পর পরত কচি-কলাপাতা-রঙা জঙ্গলের মাথার উপরে, চাঁদোয়ার মতো। দূরাগত মাদলের আওয়াজের মতো গুগুম-গুগুম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। উর্বশীরা মেঘের গালচের উপর নাচ শুরু করবে যেন কিছু বাদে। তারই প্রস্তুতি চলেছে। বাসটা যতই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে, ততই দ্রুত পেছনে ফেলে আসছে পৃথু তার অনেক স্মৃতি, পরিচিতি, উষ্ণতা, বোবা-বোধকে। রুষা, মিলি, টুসু, গিরিশদা, ভুচু, সাবীর সাহেব, শামীম, লালু, দিগা পাঁড়ে, বিজ্‌লী, আজও কত মানুষকে। ফেলে আসছে চেনা নাম। এখন চারধারে সাজা, শাল, ধাওয়া, হাররা, বহেড়া, কাসসী, কুহমি, বেল, চাঁর, জামুন, বুনো চাঁপার গাছ। মুঙ্গরার ঝাড়।

ভোঁর আর ছিঁর ঘাসের বিস্তীর্ণ মন-উদাস করা তৃণভূমি কিন্তু এখানে নেই। সেই সবই রয়ে গেল কানহা-কিসলীর জঙ্গলে। মেমসাহেবের মতো ফর্সা বানজারের বালি রেখা, কালো মেয়ে হাঁলোর জলরাশি। সিমরাহি, খাড়ারি, ইঁনকোর, গোঁন্দলা, বাঘমার আর ঘঙ্গার নালাকে, যারা কানহা-কিসলির বিধুর বিধবার পোষাকের মতো মলিন সাদা পথটিকে কেটে কেটে বয়ে গেছে ঘন অরণ্যের গভীরে গভীরে।

ঘন কালো মেঘের পটভূমিতে এক ঝাঁক সাদা বক হাওয়ার তোড়ে দুলতে-দুলতে, উঠতে-নামতে, কাঁপতে কাঁপতে উড়ে যাচ্ছে পুব থেকে পশ্চিমে। “মেঘের কোলে যায় রে চলে বকের পাঁতি ওরা ঘর ছাড়া; ওরা ঘর ছাড়া মোর মনের কথা যায় বুঝি আজ গাঁথি গাঁথি/মেঘের কোলে কোলে যায় রে চলে বকের পাঁতি-ই-ই-ই।”

বিছিয়া, চিলপি, নাইনপুর, সোন্ধার, আওরাহী, সুফকর, সেথাডোংরি, কত চেনা নাম সব মস্তিষ্ক থেকে সরে যেতে যেতে নতুন এক জগতের জন্যে জায়গা খালি করে দিচ্ছে। চেনা জঙ্গলের গোন্দ বাইগাদের সব দেবতারাও, মারাই দেবী, ধারোয়া, সাইসাম, ইয়াম, উইক্কে। বড়াদেও, কুসুরে দেও। নাঙ্গা-বাইগা নাঙ্গা বাইগীন। বানজার-এর বুক আলো-করে ফোটা গান্ধালা আর গাংগারিয়া ফুলের হাসি, সবই যেন পিছনে মিলিয়ে যাচ্ছে, ফেড-আউট করার মতো।

কুর্চি?

কুর্চি এখন কী করছে? সীওনীর কোথায় আছে কুর্চি? পৃথু তাকে খুঁজতে যাবে না। সে যদি জানতে পেরে খুঁজতে আসে, তো খুঁজবে। অনেক অভিমান জমে আছে পৃথুর তার ওপরে। এই ইচ্ছে করে হারিয়ে যাওয়া এই বোকা-বোকা অন্ধ ভালবাসার দাম কী? এত লোকে তাকে হাসপাতালে দেখতে যেতে পারল, শুধু পারল না সেই-ই! ঠিকানা পর্যন্ত না জানিয়ে এই চিঠি-খেলার মানে পৃথুর বোঝাবুঝির বাইরে।

পৃথুর শরীরের জ্বরটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। বেড়ে, চারিয়ে যাচ্ছে মনের ভিতরে ধীরে। বেশ বুঝতে পারছে পৃথু। কর্নেল সিং বলেছিল যে, হাসপাতাল থেকে ফিরেও মাসখানেক যথাসম্ভব কম স্ট্রেইন করতে। অথচ, চূড়ান্ত করেছে ও ফেরার পর মুহূর্ত থেকেই। শরীরের জ্বরের সঙ্গে মনের জ্বরটাও বাড়ছে বাসটা যত এগিয়ে যাচ্ছে সীওনীর দিকে।

হঠাৎই মনে হল, এমনও তো হতে পারে যে, বাস থেকে নেমেই দেখা হয়ে গেল কুর্চির সঙ্গে। কুর্চি পৃথুর কনুই ধরে তাকে তার বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, অন্য কোথায় উঠবেন আপনি পৃথুদা? আপনি কি পাগল নাকি?

কুর্চিকে দেখেই পৃথুর সমস্ত চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। সেই একটা শের আছে না?

“উনকো দেখনেসে চেহেরেপে যো আ যাতি হ্যায় রওনক ও ইয়ে সমঝতে হ্যায় কি বিমার ক্যা হাল আচ্ছা হ্যায়।” ওকে দেখলেই আমার চোখেমুখে উজ্জ্বলতা আসে, আর তাই-ই দেখে ও ভাবে, আমার সব অসুখই বুঝি ভাল হয়ে গেছে!

আসীক আর মাশুক দুজনের বেলাতেই এই শের সমানভাবে প্রযোজ্য।

তাই-ই কী হবে?

স্বপ্নের পুলাউতে ঘি ঢালে পৃথু দরাজ হাতে। জ্বরে এবং পায়ের যন্ত্রণায় কাঁপতে কাঁপতে।

চারদিকে ঘনান্ধকার নেমে এসেছে। যে হাওয়াটা, বকের পাঁতিকে কুন্দফুলের মালার মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল পাহাড়চূড়ো পার করিয়ে অন্য পাহাড়চূড়োয়; সেই হাওয়াটাই মেঘপুঞ্জকে না উড়িয়ে বিন্ধ্য, এবং সাতপুরা পর্বতমালার আর মাইকাল পাহাড় শ্রেণীর বুকের সব কালিমাই যেন উড়িয়ে নিয়ে এল উড়াল মেঘ করে।

জানালার ফ্রেমে মাথা রেখে পৃথু ঘুমিয়েই পড়েছিল। তার আগেই কাচ উঠিয়ে দিয়েছিল অবশ্য। বৃষ্টির পুটুর পুটুর শব্দ আর হাওয়ার সোঁ সোঁ আওয়াজ তার জ্বরকে যেন বাড়িয়ে দিয়েছিল আরও। ঘোরের মধ্যেই ছিল পৃথু।

বাসটা কখন থেমে গেছে জানেওনি। যখন যাত্রীদের কোলাহল, ছাদের উপর দুপ-দাপ করে কণ্ডাক্টরদের দৌড়াদৌড়ি করে মাল নামানোর শব্দ এবং বাস-স্ট্যান্ডের নানা মিশ্র আওয়াজ ওর কানে পৌঁছল তখনই চোখ খুলল ও।

ড্রাইভার বলল, হ্যান্ডিম্যানকে; আররে এ শ্রীকান্ত, উও ল্যাংড়া মালুম হোতা কি বাসমেই রহ যায় গা রাত ভর। উঠাও উসকো।

পৃথু খুবই উত্তেজিত বোধ করল। ভাবল, এই অ্যারোগ্যান্ট ড্রাইভারটা কি জানে যে, কার সম্বন্ধে এ সব বলছে সে? বিলেতে লেখাপড়া-করা, সাহেবি হাটচান্দ্রা শেল্যাক কোম্পানীর ঘোষ সাহাব যে এই ল্যাংড়া মানুষটি, তা জানলে কি তার এমন সাহস হত?

পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করল। সেই ঘোষ সাহাব তো মরেই গেছে। চেয়ার নেই, উর্দি-পরা ড্রাইভার নেই, পরমা সুন্দরী উচ্চশিক্ষিতা স্ত্রী নেই, সম্পত্তি নেই কোনও। সে এখন শুধুই পৃথু। অথবা পরিচিতদের কাছে পৃথু বাবু। বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। শীত করছে বেশ। বাবার কাছে শুনেছিল যে, সীওনীর উচ্চতা প্রায় দেড় হাজার ফিট মতো হবে। তার উপর এই প্রথম বসন্তর বৃষ্টি! সঙ্গে কোনও গরম জামাও রাখেনি। জ্বর আজ ভোগাবে বলে মনে হচ্ছে।

দুজন লোকের মাথায় মালপত্র চাপিয়ে ও ভাবল প্রথমে মুঙ্গেশ শুক্লর কাছেই যাবে। হাটচান্দ্রা শেল্যাক কোম্পানীর সঙ্গে ওঁর একসময় অনেকই লেনদেন ছিল। লাখ টাকার একটা বিল আটকে রেখে ছিল ইমম্যাটেরিয়াল ম্যানেজার শর্মা। পৃথুই উধাম সিং সাহেবকে বলে সেই বিল পেমেন্টের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল মাস ছয়েক আগে। স্বাভাবিক কারণেই, মুঙ্গেশ শুক্লর কিছু কৃতজ্ঞতা থাকবেই।

মাটি ভিজে গেছে। সোঁদা-সোঁদা গন্ধ বেরুচ্ছে মাটি থেকে বহুমাস পরে বৃষ্টির সঙ্গে প্রথম সঙ্গমে। হাওয়াতে বনের স্তনসন্ধির গন্ধ। ভেজা মাটিতে ক্রাচ নিয়ে তার এই প্রথম হাঁটা। ক্রাচের সঙ্গেও বৃষ্টিরও এই প্রথম পরিচয়। অসুবিধে হচ্ছে। রাবারের তৈরি ক্রাচ-এর জুতো দুটো মাটি মাখামাখি হয়ে গেল। তা হোক।

মাল-বওয়া লোকটিই বলে দিল যে; মুঙ্গেশ শুক্লর বাড়ি কাছেই। ভালই হল। চলতে লাগল পৃথু। পেছন থেকে কে যেন হঠাৎ চিকন গলায় ডেকে উঠল, বাপু।

থমকে দাঁড়াল ও।

টুসু?

বুকের মধ্যে কী যেন গলে গেল। কী যেন যেন নয়, পুরো বুকটাই যেন গলে গেল। থরথর করে দেড়খানা পা-ই কাঁপতে লাগল। চমকে তাকাল ও পিছনে।

মাল-বওয়া লোকদের মধ্যে একজন বলল, রোক গ্যয়া কাহে ল্যাংড়াবাবু? জলদি চলিয়ে। পানিসে হামলোগোনে পরিসান হ্যায়।

পৃথু দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনে চেয়ে রইল। হ্যাজাক জ্বলছে একটা ছিট কাপড়ের দোকানের বারান্দায়। প্রথম বৃষ্টির আদর সমস্ত অরণ্যকে গর্ভবতী করে দিয়েছে। তাই অসংখ্য ছোট ছোট সবুজ পোকা এসে হ্যাজাকের অভ্রর ঘেরাটোপের উপরে আছড়ে পড়ে মাথা কুটছে আগুনে পুড়ে মরবার জন্যে। জন্মর আনন্দ; ওরা মৃত্যু দিয়েই উদযাপন করতে চায়। একমাত্র প্রকৃতিই জানে এইসব গোপন প্রেক্ষাপটের জন্ম-মৃত্যুর কথা।

একটা ছেলে, টুসুরই বয়সী, চোখে কেতুর, নাকে সর্দি, গায়ে জামা নেই, দোকানের অন্ধকার অভ্যন্তরে তাকিয়ে আবার ডেকে উঠল, বাপু!

সেই ছেলেটির বাবা অন্ধকার থেকে আলোয় এসেই এক থাপ্পড় কষাল ছেলেটির নরম গালে। বলল, আমি ক্যাশ মিলাচ্ছি এখন। তোর আর বাপু বাপু করবার টাইম হল না!

পৃথুর গলে-যাওয়া বুকে সেই দোকানির থাপ্পড়টা বর্শার ফলার মতো এসে বিঁধল।

ভাবল, বলে কিছু। তারপরই ভাবল, যে নিজের ছেলেকেই ভালবাসার জোরে নিজের কাছে রাখতে পারল না, চলে আসার আগে একবার চোখের দেখা দেখতে পর্যন্ত পারল না; তার কীই বা অধিকার আছে অন্যর অপত্য সম্পর্কে প্রবেশ করার?

মুঙ্গেশ শুক্ল নাগপুরে গেছেন। তার বড় ছেলে বলল। পৃথু পরিচয় দিয়ে বলল, আজকের রাতটা কি এখানে ও থাকতে পারে?

ছেলেটি পোষাক-আশাকে আধুনিক। এমন পাণ্ডব-বর্জিত জায়গাতেও তার পরনে টেরিলিনের দামি জামা-প্যান্ট। থ্রী-ব্যান্ড ট্রানজিস্টরে ফিল্মি গান শুনছিল ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে বসে। সে বলল, বাবা নেই, আমি আপনাকে চিনি না; তাইই সম্ভব নয়।

ওঃ। আচ্ছা। বলে, পৃথু সেখান থেকে বেরিয়ে ভাবল কান্তি দিসাওয়াল-এর কাছেই যায়। কিন্তু হল না। মুঙ্গেশ শুক্ল নাগপুর থেকে ফিরে এসে তাঁর ছেলেকে খুব একচোট শাসন যে করবেই সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই রইল না ওর। তিনি হয়তো মাপই চাইতে পাঠাবেন ছেলেকে পৃথুর কাছে।

তবু এর পরও অনেক কম-জানা দিসাওয়াল সাহেবের কাছে না-যাওয়াই সাব্যস্ত করল।

মাল-বওয়া লোকেরা বলল, দিসাওয়াল সাহেবের বাড়ি অনেকই দৃর। এই বৃষ্টিতে অতদূর যেতে পারবে না তারা। পৃথুও চিন্তিত ছিলই। আর কিছুর জন্যে নয়; ওর বইগুলোর জন্যে। বৃষ্টিতে যদি ভিজে যায় সেগুলো?

জিজ্ঞেস করল, রাতটা কাছাকাছি কোথাও থাকা যায় না?

ওরা বলল, দু কদম গেলেই এক সর্দারজীর ধাবা আছে। অনেকই জায়গা সেখানে। ট্রাক ড্রাইভাররা সার সার শুয়ে রাত কাটায়। চৌপাইয়ে শুয়ে আপনিও রাতটা কাটিয়ে দিতে পারেন আরামে। কাল সকালেই যা করার করবেন। এখন আমাদের ছেড়ে দিন।

পৃথু বলল, তাইই চলো।

তার মাথা ভর্তি চুল, দাড়ি, গোঁফ, জামা-কাপড় সবই ততক্ষণে ভিজে চুপচুপ করছিল। ওষুধও খাওয়া দরকার। জ্বরটা মনে হচ্ছে অনেকই। তার উপর পায়ের ব্যথাটাও সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে। এক জান্তব বিদ্রোহের মতো কাটা-পাটি দুলতে দুলতে চলছিল। টনটন করছিল ব্যথায়।

মালপত্র নামিয়ে দিয়ে দশ টাকা নিয়ে চলে গেল ওরা দুজনে। দরদাম করবে ভেবেছিল প্রথমে। এখন থেকে প্রতিটি পয়সা বুঝে-শুনেই খরচ করতে হবে। কিন্তু করল না। অথবা পারল না। বৃষ্টিতে অনেকই ভিজেছে মানুষ দুটি। মালও নেহাৎ কম নয়।

সর্দার ইন্দার সিং ধাবার মালিক। চোঙাওয়ালা অ্যান্টিক গ্রামোফোনে যেরকম গ্রামোফোন বহু বছর দেখেইনি পৃথু, কারও বাড়িতেই; কমলজিৎ কৌর-এর রেকর্ড বাজছিল উঁচুগ্রামে।

সর্দার বলল, কোঈ ফিক্কর মত কিজীয়ে বাবুজী। হামারা হিঁয়া আরাম জারা কম হ্যায়, মগর পেয়ার কাফি হ্যায়। ক্যা পীজিয়েগা? বীর দুঁ?

বীর?

অবাক হল পৃথু। বীর বলে কোনও পানীয় যে আদৌ আছে তা এই বীরের জাতের মুখেই প্রথমবার শুনল।

চৌপাইয়ে দেড়-পা উঠিয়ে বসে পৃথু বলল, বীর? বীর ক্যা চিজ?

বীর নেহি জানতেঁ আপ? অজীব আদমী। আরে এ ছোকরা। সাবকো বীর দিখলাও।

একটি অল্পবয়সী ছেলে বীয়ারের বোতল নিয়ে এল।

পৃথু বলল এখন বুঝলাম। কিন্তু আমার জ্বর। বীয়ার খাব না।

তব ক্যা দুঁ? মহুয়া?

কখনও খায়নি পৃথু। বলল, আর কিছু কি আছে? ব্রাণ্ডি? আমার জ্বর।

সর্দার ইন্দার সিং বলল, না নেই। আমার নিজের রাম আছে। আর্মির রাম। জওয়ান আর ঘোড়া খায়। দু পেগ খেয়ে আমার এখানের আণ্ডা-তড়কা আর তন্দুরি চিকেন সাঁটিয়ে শুয়ে পড়ুন। গোড় দেবে দেবার ছোকরাও দিয়ে দেব একটা। তাছাড়া আপনার ৩ সিকি খানা গোড়। ঝামেলা কম।

তথাস্তু। বলে পৃথু স্যুটকেস খুলে ফুলহাতা পুলোভার বের করে পরে নিয়ে ক্রাচ দুটি পাশে রেখেই শুয়ে পড়ল।

সর্দারজীর ছোকরা! রাম-এর গ্লাস নিয়ে এল দুটি সেঁকা পাঁপড়ের সঙ্গে। শরীরের ক্লান্তি, জ্বর এবং নিজের উপর এক গভীর বিতৃষ্ণায় এক চুমুকে শেষ করে দিল সেই গ্লাস।

ইন্দার সিং বলল, এ ছোকরা ফিন লাও। ঔর হিসাবভি রাখনা কিতনা দফে দিয়া।

পয়সা নেবে তাহলে সর্দার? পৃথু ভেবেছিল, ভালবেসে খাওয়াচ্ছে।

এইই ভাল। ভালবাসা, যতটুকু পয়সা দিয়ে কেনা যায় ততটুকুই থাকে। বিনা পয়সার ভালবাসার উপর জোর থাকে না একটুও।

ছেলেটি আবারও এনে দিল। ওষুধ বের করে তার সঙ্গে ক্রসিন আর রেফাগানও গিলে ফেলল রাম দিয়ে। বলল চারটে খাব। তারপর খাবার আনবে। আমি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ব। বহতই থকা হুয়া হ্যায়। আমার মাল-পত্ৰর জিম্মাদারি তোমাদেরই।

ছেলেটি কী বুঝল বোঝা গেল না। মাথা নাড়ল দুবার।

সর্দার কি বুঝল পৃথুর দিকে একবার চেয়ে তার চট-জলদি রাম গেলা দেখে হেসে বলল, “কিঁউ কৌসরত মুসাফৎ তয় করে/ম্যায়কাদা ফিরদৌসসে নজদিক হ্যায়।”

পৃথু হেসে গ্লাসশুদ্ধু ডান হাত তুলে আদাব জানাল। রসিক মানুষ, অন্য রসিককে ঠিকই চিনে নেয়। কৌসর নদী পেরোলেই নাকি ফিরদৌস, অর্থাৎ বেহেস্ত বা স্বর্গ। সব মুসলমানই জানেন। কিন্তু কৌসর নদী পেরিয়ে অত কষ্ট করে স্বর্গে যাবার দরকারটা কী? স্বর্গ বা ফিরদৌস-এর চেয়ে অনেকই আছে তো ম্যায়কাদা অথবা ম্যায়খানা, সেখানে পৌঁছে গেলেই তো হল।

হাসল বটে। আদাবও করল, কিন্তু পৃথুর শরীর মনের অবস্থা তখন এই মাতাল ও মদের স্তুতিভরা কথা নিয়ে মাতামাতি করার মতো ছিল না।

কোনও ট্রাক এসে থামছিল। কোনও ড্রাক নাগপুর বা জবলপুর বা লামটার দিকে রওয়ানা হয়ে যাচ্ছিল মার্সিডিস এঞ্জিনের ধড়ফড় আওয়াজ তুলে। কমলজিৎ কৌর-এর গানের সঙ্গে শিখ মরদদের বোলি, আর উরত ডালের তড়কার গন্ধের সঙ্গে বৃষ্টিভেজা রাতের মিলে-মিশে যাওয়া গন্ধর মধ্যে অত লোকের মাঝখানে চৌপাইয়ে বসে থেকেও বড় নির্জন বোধ করছিল পৃথু।

ও মনে মনে বলল, রাম-এর গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে, “ক্যা ইসীলিয়ে তকদিরনে চুনওয়াসে তিনকে/কি বন য্যায়ে নেশেমন তো কোঈ আগ লাগা দে”?

এই জন্যেই কি ভাগ্য একটি একটি করে তৃণ-কুটো ঠোঁটে করে এনে নীড় বানিয়েছিল? এই নেশেমন? এই নীড় গড়ে তোলবার পরে কেউ তাতে আগুন লাগিয়ে দেবে বলেই? এই জন্যেই?

ভিনোদ ইদুরকার। পৃথু বলল, মনে মনে ভেবেছিলাম পুরোপুরি ক্ষমা করতে পেরেছি তোমাকে!

পায়ের যন্ত্রণা, জ্বর, কড়া আর্মি-রাম, আর মানসিক কষ্টে মুখ বিকৃত করে পৃথু বলল, না বলেই। পারিনি ভিনোদ। পারলাম না। নিজেকে যত বড়, যত উদার, যত নৈর্ব্যক্তিক ব্যক্তি বলে ভেবেছিলাম, আসলে আমি তা নই। আমি একজন সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষ। আদমি যতই অজীব হোক না কেন; সে তো আদমিই বটে। তার পা হারানোর দুঃখও তাকে যেমন বাজে, তার নীড় তার “নেশেমন” আগুন লেগে পুড়ে গেলেও বাজে।

আবারও বৃষ্টি নামল। দমকে দমকে হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির ছাঁট আসতে লাগল। কাঁপতে লাগল পৃথু হিহি করে। সেই মুহূর্তে ওর মনে হল, হাটচান্দ্রা ছেড়ে এসে খুবই ভুল করেছে। যা ওর নিজের তাকে দাবি না করে, তাকে পুনর্দখল না করে এমন ঔদার্যর মুখোশ পরে চলে আসার মতো মুর্খামি আর হয় না। কিন্তু….

কিন্তু মুখোশ একবার পরলে মুখ দেখানোও যে যায় না আর।

চোখ দুটি জলে ভরে এল।

ছিঃ ছিঃ। পৃথু!

ধাবার সর্দার বলল, আররে এ ছোকরা, রাম লাও বাবুকে লিয়ে।

পৃথুকে বলল, পিও সাহাব। জী ভরকে পিও। গম্ম ডুবাকে পিও।

খাওয়া দাওয়ার পর শুয়ে পড়ল পৃথু। চৌপাইয়ে। পাঁচটা বড় রাম খেয়েও ওর শীত করছিল। শীতে যখন মানুষকে তেমন করে পায়; শরীরের শীতে বা মনের শীতে, তখন কিছুতেই কিছু হয় না।

একটা পথের কুকুর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কুঁয়োতলায় ফেলে-দেওয়া পাঁঠার মাংসর হাড়, মুরগির টুকরো-টাকরা, রুটি-তড়কার অবশিষ্টাংশ খুঁটে খাচ্ছিল। সে কাঁপতে কাঁপতে এসে পৃথুর আস্ত পাটিতে একবার তার কুকুর-গন্ধী ভেজা লেজটি বুলিয়ে দিয়ে চৌপাই-এর নীচে শুয়ে পড়ল সশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

শব্দ মরে গেছে এখন চারদিকে। রাত গভীর। ট্রাকের চলাচল এখন নেইই বলতে গেলে। শালকাঠের খুঁটির মাথায় ঝোলানো ন্যাংটো ইলেকট্রিক বাল্বটি বৃষ্টি-ভেজা হাওয়ায় দুলে দুলে এক ভৌতিক আলো-আঁধারির সৃষ্টি করেছে। পৃথুর ঘুম নেই। চোখ দুটো জ্বালা করছে জ্বরে। ওর মনে হচ্ছে চৌপাই-এর নীচে শুয়ে-থাকা এঁটো খাওয়া উদবৃত্ত-চাটা নির্লজ্জ সম্মানজ্ঞানহীন কুকুরটারই মত হয়ে গেছে যেন নিজেও। পথ আর অনাদর আর অপমান এখন একসময়ের বিনয়-চাপা অহমিকারই মতো, তার গায়ের গন্ধ হয়ে জড়িয়ে থাকবে তাকে অনুক্ষণ। অশুচি; অভিশপ্ত হয়ে গেছে ও।

শব্দ করে হাই তুলল পাশের চৌপায়ার এক সর্দার ড্রাইভার। অন্য পাশের চৌপাইয়ে একজন ক্লিনার প্রচণ্ড শব্দ করে নাক ডেকে চলেছে। অথচ খুবই রোগা-পাতলা মানুষটি। উনুনের উপর এখন মিস্তিরি রুটি সেঁকে যাচ্ছে। আগুনে আটা পোড়ার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে জঙ্গলের গন্ধর সঙ্গে মিশে হাওয়াতে। অনেক দূরে কে যেন কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁদছে। একটি নারীকণ্ঠ। গোন্দ ভাষায় বিলাপ করছে। কে এই নারী? রুষা, তুমি? বিজ্‌লী কি?

তিনদিক খোলা ছিঁরঘাসে ছাওয়া আচ্ছাদনের মধ্যে হিমেল হাওয়ায় শুয়ে শুয়ে পৃথু আবৃত্তি করতে লাগল নিঃশব্দে শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা। তার শ্বাসের মতো।

“সবাই সতর্ক থাকে দুপুরে বা মধ্যরাতে তুলে দেয় খিল পথের ভিখারি মা-ও ভাঙে ক্রাচে ভর করে বুঝে নেয় মাছির গুনুন আমারই সহজ কোনও প্রতিরক্ষা নেই চুরি হয়ে যায় সব বাক্স বই সামঞ্জস্য অথবা শুচিতা।

তাই পথে পথে ঘুরি, ফিরে যায় গৈরিক গোধূলি

এমন মুহূর্তগুলি চিতায় তুলেছি আজ চণ্ডালের মতো তবু কেন।

আমি যদি এতই অশুচি তবে পথিকেরা আজও কেন জল চায় আমার দুয়ারে?

এই কবিতাটির বইয়ের কথা মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। তবে মনে পড়ছে, “পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ”র কবিতাগুলির কথা। পৃথুর অন্যতম প্রিয় কবিতা সেটি।

“পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে

নৌকোর গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ

জলজ গুল্মের ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর

আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই কোনোনে।”

বৃত্ত আঁকা হয়ে গেছে বৃত্তের ভিতরে জল আঁকা জলের ভিতরে আমি আমার উপরে ওঠে জল ছোটো ছোটো ঘাত লেগে বৃত্ত বেড়ে যায় আচম্বিত জলস্রোতে সমস্ত বৃত্তের অবসান।”

গায়ে কী যেন পড়ল পৃথুর। বোঁটকা গন্ধে গা-গুলিয়ে উঠল।

জ্বরে ঘোলা চোখ মেলে দেখল, সাড়ে ছ ফিট সর্দার ইন্দার সিং কাঁচা-পাকা দাড়ি নিয়ে তার চৌপাইয়ের পাশেই দাঁড়িয়ে ধাবার একটি জনপদ-কম্বল তার গায়ে সস্নেহে বিছিয়ে দিচ্ছে।

কৃতজ্ঞতায় পৃথুর গলা রুদ্ধ হয়ে এল। ওই বদ-গন্ধ কম্বলটি দু হাতে শরীরের উপর টেনে নিল। আঃ কি আরাম!

চৌপাইর নীচে ভিজে কুকুরটা কুঁই কুঁই করে উঠল। আনন্দে, কি ঈর্ষায় বুঝতে পারল না।

সর্দার বিড় বিড় করে কী যেন বলল, পৃথুর পায়ের দিকটা ভাল করে কম্বলে ঢেকে দিতে দিতে।

পৃথু শুনল সর্দার ইন্দার সিং বলছে, “দরওয়াজ বন্দ না করো কোঈ আউন্দা হোভেগী।”

বলেই, চলে গেল সর্দার।

কে জানে? সর্দার এই তিনদিক-খোলা খড়ের ছাউনির কোন দরওয়াজার কথা বলল? কার আসার কথা বলল? ঠিক শুনল কি ও?

কম্বলটা দিয়ে বুক গলা ভাল করে ঢেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল ও। এখন ঘুমোবে। এই সিক্ত, শীতার্ত, উষ্ণতাহীন পৃথিবীতে এখনও অনেক গভীর সহমর্মিতার সমবেদনার বোধ বেঁচে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *