2 of 2

৫৮. কৃষ্ণকমলের খানিকটা প্রভাব

হরিশের মতন কৃষ্ণকমলও বেশ খানিকটা প্রভাব বিস্তার করলো নবীনকুমারের মানস-জগতে, যদিও হরিশের সঙ্গে কৃষ্ণকমলের অনেক প্রভেদ। হরিশ যথেষ্ট কৃতবিদ্য হয়েও তাঁর মধ্যে সব সময় জ্বলন্ত ছিল দুবার দেশপ্রেম এবং তীব্ৰ প্ৰাণশক্তি। হরিশের কর্মচাঞ্চল্য অন্যদেরও জাগিয়ে দিত। সেই তুলনায় কৃষ্ণকমল শুধুই বুদ্ধিজীবী, তার মধ্যে কর্মের উদ্যম নেই, বরং অন্য সকলের সশ্লেষ সমালোচনা করতে সে খুব পারদর্শী।

কিছুদিন আগে কৃষ্ণকমলের দাদা রামকমল আত্মহত্যা করেছেন। সংস্কৃত কলেজের বিখ্যাত মেধাবী ছাত্র এবং রূপবান, গুণবান রামকমল স্বহস্তে নিজের জীবনের অবসান ঘটানোয় দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই বিস্মিত হয়েছিলেন। ইদানীংকালের মধ্যে এরকম ঘটনা আর শোনা যায়নি। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান এই মানব-জীবন, তা কেউ নিজের হাতে নষ্ট করে? দাদার মৃত্যুর পর থেকে কৃষ্ণকমল যেন আরও তিক্ত হয়ে উঠেছে, সব কিছুর প্রতিই তার বিদ্রূপ হাস্য। একমাত্র রমণীদের প্রসঙ্গ উঠলেই সে সরস হয়ে ওঠে।

পরিদর্শক কার্যালয়ে সে নিয়মিত আসতে লাগলো। কিন্তু তার লেখার নামটি নেই। একদিন সে হেমচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একটি যুবককে সঙ্গে করে এনে নবীনকুমারকে বললো, এ বেশ কবিতা-টবিতা লিখচে, দ্যাখো না, একে কোনো কাজে লাগাতে পারো কি না! আর একদিন সে বললো, দেবেন্দ্রবাবুর বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রকে কিছু লিখতে বল না! দ্বিজেন্দ্ৰ তোমার-আমার সমবয়েসী। হবেন বোধ করি, মগজে বিদ্যা-বুদ্ধি কিঞ্চিৎ আছে।

একদিন সন্ধ্যার পর বিদ্যাসাগর পরিদর্শক কার্যালয় দেখতে আসবেন শুনে কৃষ্ণকমল তড়িঘড়ি পায়ে চটি গলিয়ে বললো, তা হলে আমি উঠি।

নবীনকুমার অবাক হলো। সে জানতো, কৃষ্ণকমল বিদ্যাসাগরের বিশেষ প্রিয় পাত্র, শিশু কৃষ্ণকমলকে বিদ্যাসাগর নিজে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কেন, বিদ্যাসাগর মশায়ের সঙ্গে দেকা করে যাবে না?

কৃষ্ণকমল উঠে দাঁড়িয়ে বললো, না হে, উনি আমায় দেখলে ব্যাজার হবেন। কেন আর মিছামিছি ওঁর বকুনি শুনি!

—কেন, উনি তোমায় বকবেন কেন?

—কারণ আচে। তুমি জানো না, উনি চেয়েছিলেন আমি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হই। তাতে আমার রুচি হয়নি। ওঁর আদেশ আমি মানি নি!

—সে তো অনেকদিন আগের কথা। উনি তো পুরোনো রাগ পুষে রাখেন না!

—ইদানীং অন্য একটি কারণেও উনি খুব কুপিত হয়ে আচেন আমার ওপরে। বীরসিংহার ঐ ব্ৰাহ্মণটির একটা দোষ কি জানো, যার সঙ্গে নিজের মত না মিলবে, তাকেই আর উনি সহ্য করতে পারেন না।

—কিন্তু উনি তো অন্যায্য বিষয়ে রাগ করেন না। তোমার ওপর কোন কারণে রাগ করেচেন?

—সেটি এখন বলা হচ্ছে না! আমি যাই!

বেশ ব্যস্তসমস্ত হয়েই চলে গেল কৃষ্ণকমল।

একটু পরেই এলেন বিদ্যাসাগর। বিশেষ যত্ন নিয়ে তিনি দেখতে লাগলেন সংবাদপত্র-পরিচালনার কাজকর্ম। তারপর বললেন, সোমপ্রকাশে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ তোমার এই উদ্যমের খুবই প্রশংসা করেছেন। এখন দেখছি, তিনি অতিরঞ্জন করেন নি মোটেই। তবে এটিকে টিকিয়ে রাখাই দরকার।

নবীনকুমারের মাথায় কৃষ্ণকমলের কথাটাই ঘুরছিল। সে ফস করে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কৃষ্ণকমলকে পচন্দ করেন না?

বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। উদাসীনভাবে বললেন, লোকে ভাবে আমি যা বলবো কৃষ্ণকমল বুঝি তা সবই শুনবে। আসলে সে আমাকে মোটেই মানে না।

পরদিন কৃষ্ণকমল আবার আসতেই নবীনকুমার তাকে চেপে ধরলো। সে বললো, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সঙ্গে তোমার কী নিয়ে মনোমালিন্য হয়েচে, তা বলতেই হবে। ঐ চিন্তাটা কিচুতেই মাতা থেকে তাড়াতে পারাচি না।

কৃষ্ণকমল হেসে বললো, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তোমার এত কৌতূহল কেন, নবীন?

নবীনকুমার বললো, আমার কৌতূহল তোমার ব্যাপারে নয়, আমার গুরু কোন কারণে তোমার মতন প্রিয়জনের ওপরেও রাগ করেন। সেইটি শুধু আমি জানতে চাই।

কৃষ্ণকমল বললো, সেটি জানতে হলে তোমাকে এক স্থানে যেতে হবে আমার সঙ্গে। তুমি যেতে পারবে?

নবীনকুমার বললো, কোথায়?

কৃষ্ণকমল বললো, সে যে-স্থানেই হোক না কেন, তুমি যেতে পারবে কি না বলো?

নবীনকুমার বললো, কেন পারবো না? আমি পুরুষমানুষ হয়ে এমন কোন স্থান আচে, যেখোনে যেতে পারি না?

—তা হলে আগে কাজ সেরে নাও!

রাত্রি নটায় পরিদর্শক কার্যালয় থেকে বেরুলো দুজনে। জুড়ি গাড়িতে উঠেই দার্শনিক আলোচনা শুরু করে দিল কৃষ্ণকমল। ফরাসী দার্শনিক কোঁৎ-এর সে খুব ভক্ত, প্রায়ই সে কোঁৎ-প্রচারিত পজিটিভিজম তত্ত্ব বোঝাতে চায় নবীনকুমারকে। নবীনকুমারের অবশ্য দর্শনের জটিল ব্যাপার নিয়ে মস্তক ঘর্মাক্ত করার তেমন আগ্রহ নেই।

কৃষ্ণকমল বললো, দ্যাখো, ইংরেজি মাসের নামগুলি যে ঠাকুর দেবতাদের নামে, এটা আমার মোটেই পছন্দ হয় না। এ বিষয়ে কোৎ একটা চমৎকার ব্যবস্থা দিয়েছেন। তিনি বৎসর ভাগ করেছেন তের মাসে, প্রত্যেক মাসের নাম হবে মোজেস, হোমর, আরিস্টটল, আর্কিমিডিস, শেক্সপীয়র, এঁদের নামে।

নবীনকুমার বললো, তা বেশ তো। কিন্তু আমাদের বেদব্যাস, বাল্মীকি এরা কি দোষ কল্লেন?

—কোঁৎ সারা মাসটা ভাগ করেছেন আঠাশ দিনে। প্রত্যেক দিনের নামও হবে এক একজন মহাপুরুষের নামে। মনু, মুহম্মদ, বুদ্ধ, নিউটন, কলম্বাস এঁরা।

—তা আগে থেকে এই সব মহাপুরুষদের নামে মাস আর দিনের নাম ঠিক করে ফেল্লে, ভবিষ্যতেও যে এদের চেয়ে আরও বড় মহাপুরুষ জন্মাবেন না, তার কোনো ঠিক আচে? তখন আবার নাম বদলাবে? তা ছাড়া এই নাম নিয়ে পৃথিবীর সব দেশের লোক একমত হবে কেন?

—আমি কোঁৎ-এর মতটিই শ্রেষ্ঠ মনে করি।

–আমি কিন্তু ফ্রেডরিক দি গ্রেটের চেয়ে সম্রাট অশোককে বড় বলবো। আমরা এখন কোতায় যাচ্চি বলো তো?

-আমি কোচোয়ানকে বলে দিয়েছি। শোনো, জন স্টুয়ার্ট মিল এই পজিটিভিস্ট ক্যালেণ্ডার সম্পর্কে কী বলেছেন জানো? এতে পরস্পর-বিরোধী, বিভিন্ন মতাবলম্বী এমন সব ব্যক্তিদের নাম পাশাপাশি রাখা হয়েছে যারা জীবিত অবস্থায় দেখা হলে পরস্পরের গলা কাটাকাটি করতেন নিশ্চয়ই। কোঁৎ-এর এই যে বিশ্ব মানবিক উদার মনোভাব, এটি পৃথিবীর আর কোনো দার্শনিকের মধ্যে দেখেছে? ডিস্টিংকশান অফ ফাংশান, অর্থাৎ কর্মে অধিকার ভেদ কোঁৎ-এর একটা প্রধান কথা।

গাড়ি এসে থামলো এক জায়গায়। পিছন থেকে দুলাল এসে জিজ্ঞেস করলো, এবার কোন দিকে যাবো?

কৃষ্ণকমল বললো, সামনের গলিতে লাল বাড়িটির সামনে।

 

গাড়ি থেকে নেমে নবীনকুমার। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সন্দিহান হলো। এ যে রামবাগানের কু-পল্লী। কোঁৎ-শিষ্যের এখানে কী জন্য আগমন? বিশ্বের সমস্ত সতী রমণীদের সম্মানার্থে কোৎ চার বৎসর অন্তর বিশেষ একটি দিনে সারা পৃথিবীতে একসঙ্গে একটি উৎসবের প্রস্তাব দিয়েছেন, সেই কোঁৎ-এর শিষ্য হয়ে কৃষ্ণকমল অসতী নারীদের কাছে এলো কেন এত রাত্রে?

লাল রঙের বাড়িটির দ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকমল বললো, এসো, তিনতলায় যেতে হবে।

কোনো আপত্তি না জানিয়ে নবীনকুমার তাকে অনুগমন করলো।

আলো-ঝলমল কক্ষ এবং রমণীকণ্ঠের নির্লজ্জ হাস্যধ্বনি শুনে বাড়িটির চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না।

ওপরে উঠে এসে একটি বন্ধ দ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকমল ডাকলো, প্রমদা, প্রমদা।

চওড়া লালপোড়ে ধনেখালির শাড়ি পরা এক যুবতী দ্বার খুলে ওদের দেখে একটু সরে দাঁড়ালো।

ঘরের মধ্যে একটি মোটা জাজিম পাতা, আর দেয়ালের সঙ্গে ঠেসান দেওয়া কয়েকটি চেয়ার। জুতো না খুলে ধুতির কোঁচাটি বাঁ হাতে ধরে নবীনকুমার গিয়ে বসলো একটি চেয়ারে। এখনো যেন সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। পূজারী ব্ৰাহ্মণের সন্তান, পাশ্চাত্ত্য দর্শনে বিভোর কৃষ্ণকমল এরকম বাড়িতে যাতায়াত করে। অথচ নানা প্রসঙ্গে সে কৃষ্ণকমলের মুখে শুনেছে যে সে মদ্যপানের ঘোর বিরোধী।

যুবতীটির মুখ মাত্র এক ঝলক দেখেছে নবীনকুমার। এখন সে লজ্জায় সঙ্কুচিতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরের এক কোণে।

কৃষ্ণকমল বললো, একটু চা পান করবে নাকি, নবীন?

নবীনকুমার সবেগে দুদিকে মাথা আন্দোলিত করলো। বাড়ির বাইরে কোথাও সে পারতপক্ষে কোনো খাদ্যদ্রব্য গ্ৰহণ করে না।

কৃষ্ণকমল বললো, আমি একটু চা পান করবো। প্রমদা, একটু চায়ের জোগাড়ে লেগে পড়ে তো! যুবতীটি একটি দরজার পদ সরিয়ে চলে গেল পাশের কক্ষে।

কৃষ্ণকমল বললো, আমি ওকে চা প্ৰস্তুত করা শিকিয়িচি। এ বাড়ির অন্য কোনো স্ত্রীলোক চা কী দ্রব্য তাই আগে জানতো না।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে সংশোধনের ভঙ্গিতে আবার বললো, অবশ্য প্রমদাকে তুমি এ বাড়ির অন্য স্ত্রীলোকদের মতন মনে করো না। সে কোনো এক মর্যাদাসম্পন্ন ভদ্রবাড়ির মেয়ে। বাল্যবিধবা। পরিবারের কয়েকটি অমানুষের অত্যাচারে সে গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আমার এক পরিচিত লোকের সাহায্যে এখানে এসে উঠেছে। প্রমদা বিশেষ গুণবতী। আমি তাকে বিবাহ করবো ঠিক করেছি।

–বিবাহ করবে?

–কেন, তোমারও আপত্তি আছে নাকি?

–তোমার তো একটি পত্নী বর্তমান!

–তা থাক না। আমার একটি পত্নী আছেন বটে। কিন্তু তিনি আমার সহধর্মিণী নন। তাই আমি প্রমদাকে সহধর্মিণী করতে চাই। তাতেই তোমার গুরুর ঘোর আপত্তি! এইবার বুঝলে তো!

নবীনকুমার হাসলো। কৃষ্ণকমল আবার বললো, তিনি বিধবা বিবাহের প্রতিষ্ঠাতা অথচ এই বিধবা রমণীটিকে আমি গ্ৰহণ করতে চাই শুনে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন।

নবীনকুমার বললো, আমার গুরু যে আপত্তি কৰ্বেন তা জানি। তিনি বিধবা বিবাহের নামে পুরুষের একাধিক বিবাহের ঘোর বিরোধী। কিন্তু তোমার মতন ঘোর নাস্তিক এবং পজিটিভিস্ট যে হঠাৎ বামুন পণ্ডিতদের ধারা অনুসরণ করে একাধিক বিয়ে করতে চাইবে, তাতে আশ্চর্য হচ্চি। তোমার গুরু ফরাসী কোৎ সাহেব বেঁচে থাকলে কী বলতেন? তিনি একাধিক বিবাহ সমর্থন কত্তেন?

—কোঁৎ-এর জীবনেও একজন ক্লোটিলড নাম্নী রমণী ছিলেন, তা জানো না বুঝি?

—মাদাম ক্লোটিলড-কে দার্শনিক কোঁৎ কোনোদিন সামাজিকভাবে বিবাহ করেচিলেন, এমনও তো শুনিনি!

—শোনো, তাঁর মতে বিবাহ তিন প্রকার। প্ৰথম তো হলো সিভিল ম্যারেজ, যাতে বিবাহ একটা চুক্তি মাত্র, দম্পতির মনের অমিল হলে সে বিবাহ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। দ্বিতীয় হলো তোমার রিলিজিয়াস ম্যারেজ, ধর্মের নামে বিবাহ, যা চিরদিনের জন্য অবিচ্ছিন্ন। এই বিবাহের পর শুধু বিধবা নয়,বিপত্নীক পুরুষও আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে পারবে না। আর এক রকম বিবাহকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন চেইসট ম্যারেজ। এ বিবাহে স্ত্রী পুরুষের মানসিক মিল হলে তবেই তারা একত্র বাস করবে কিন্তু সহবাস করবে না। আমি প্রমদাসুন্দরীকে এই চেইসট বিবাহ করতে চাই। পারস্পরিক সাহচৰ্য্যই বড় কথা।

–তাতে বাধা কোতায়?

–মুশকিল কি জানো, এ দেশের লোককে তো চেনো তুমি, তারা এর মর্ম বুঝবে না। মনে করবে আমি বুঝি অন্য ভড়ং করে একটি উপপত্নী রেখেছি। তাই একে একটা সামাজিক বিবাহের আবরণ দিতে চাই।

নবীনকুমার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তোমার চেইসট বিবাহ মাথায় থাক, আমিও ওতে বিশ্বাস করি না। আমিও বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সঙ্গে একমত। কৃষ্ণকমল, আমি আর তোমার সংসর্গে থাকতে চাই না। চল্লুম!

–আরে, আরে, দাঁড়াও, অত চটলে কেন?

কিন্তু নবীনকুমার আর অপেক্ষা করলো না। সিঁড়ি দিয়ে জুতো মশমশিয়ে, কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করেসে নেমে এলো নিচে। তার শরীর কিরকিস করছে বিরক্তিতে! চেইসট ম্যারেজ না ঘোড়ার ডিম!

 

পরিদর্শক নিয়ে কয়েক মাস উঠে পড়ে লেগে থাকলেও নবীনকুমার কাগজটিকে ঠিক দাঁড় করাতে পারলো না। কেচ্ছা-খেউড় পড়ায় যারা অভ্যস্ত তারা পরিচ্ছন্ন সংবাদ সম্পর্কে আগ্রহী নয়। বাঙালী শিক্ষিত সমাজ কিছুতেই বাংলা কাগজ পড়তে চায় না। ইংরেজি সংবাদপত্র বাড়িতে না রাখলে তাদের মান যায়। যাদের একাধিক পত্রিকা রাখার সামর্থ্য আছে তারাও মনে করে বাংলা সংবাদপত্র পাঠ করলে অন্য লোকেরা বুঝি তাদের কম শিক্ষিত মনে করবে।

কিন্তু নবীনকুমারের জেদ, পরিদর্শক সে চালাবেই। কাগজের চাহিদা যত কমতে লাগলো ততই সে পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়িয়ে দাম কমিয়ে দিতে লাগলো। কমতে কমতে দাম হলো এক পয়সা। এর পর বোধহয় সে বিনা পয়সায় বিলি করবে। অর্থ ব্যয় হতে লাগলো জলের মতন।

এক সময় গঙ্গানারায়ণ পর্যন্ত সচকিত হলো। বেঙ্গল ক্লাব নামে সাহেবদের বিখ্যাত একটি ক্লাব আছে। সেই ক্লাববাড়িটি এবং জমির মালিক নবীনকুমাররা। খুব মূল্যবান সম্পত্তি। নবীনকুমার সেই বেঙ্গল ক্লাবের বাড়ি-জমি বিক্রয় করে দিতে চায়।

গঙ্গানারায়ণ একদিন নবীনকুমারকে ডেকে বললো, তুই এ কি ঠিক করিচিস, ছোট্‌কু? ওদিকে জমির দাম যে হু-হু করে বাড়চে। এসপ্ল্যানেড ছাড়িয়ে সাহেবরা পার্ক স্ট্রিটের দিকে বিস্তর বসতি কচে, ওদিকে যে দু চারদিন বাদে জমি হবে সোনা!

নবীনকুমার বললো, উপায় কী, দাদামণি! তোমার তবিল যে শূন্য দেকচি! আমার এখন অনেক টাকার দরকার।

গঙ্গানারায়ণ বললো, তুই যে-ভাবে টাকা ব্যয় কচ্চিস, তত টাকা আসবে কোতা থেকে! গত পাঁচ মাসে তুই এক লক্ষ টাকার ওপরে নিয়িচিস!

—আমার আরও টাকা লাগবে। তুমি দেকালে তো দাদামণি, হরিশ যেই মলো, অমনি বেমালুম সব্বাই তাকে ভুলে গেল। তার কাজ তো কারুকে না। কারুকে চালিয়ে যেতে হবে? এখন টাকার জন্য চিস্তা কল্লে চলে? তুমি বরং একবার জমিদারি দেকতে বেরোও, দ্যাকো যদি আদায় পত্তর কিচু যদি বাড়ানো যায়। দাদামণি, তুমি কি আমায় হার মানতে বলো?

অনেকদিন পরে গঙ্গানারায়ণ গেল বিধুশেখরের সঙ্গে দেখা করতে। বিধুশেখর ইদানীং প্রায়ই ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী থাকেন। কেউ সাক্ষাৎ করতে গেলে ই-হাঁ ছাড়া কিছু বলেন না। কয়েকদিন হলো তাঁর পীড়া খুব বৃদ্ধি পেয়েছে। সুহাসিনী সেই সংবাদ দিয়ে সকালবেলা লোক পাঠিয়েছিল।

কবিরাজ ছাড়া অন্য কারুকে দিয়ে চিকিৎসা করান না বিধুশেখর। গঙ্গানারায়ণ তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলো যে বহুমূত্র রোগের খুব ভালো চিকিৎসা আছে অ্যালোপ্যাথিতে, সেই একজন চিকিৎসক ডাকলে বিধুশেখরের যন্ত্রণার উপশম হবে।

বিধুশেখর উদাসীনভাবে বললেন, আর কী হবে, আমি তো এখন দিন গুণচি, আর এই শেষ সময় ম্লেচ্ছ ওষুধ গলায় দিয়ে কী হবে!

আরও কিছুক্ষণ অন্যান্য কথার পর গঙ্গানারায়ণ খানিকটা ইতস্তত করে বললো, জ্যাঠাবাবু, আপনাকে আর একটা কতাও জানানো দরকার বোধহয়। আমাদের ছোট্‌কু এক সঙ্গে অনেক বড় বড় কাজ হাতে নিয়ে নিয়েচে, এমন দু হাতে টাকা খরচ কচ্চে যে আর বুঝি সম্পত্তি রাখা দায়। আমি তো কোনো দিকে তাল সামলাতে পাচ্চি না।

জীর্ণ শরীরখানা একটু কাত করে বিধুশেখর মুখ উঁচু করলেন। তাঁর বিবর্ণ ওষ্ঠে একটু যেন হাস্যের ছায়া দেখা গেল। চোখে জ্বলে উঠলো আগ্রহ। এতদিন পরে সিংহ বাড়ির এই উদ্ধত যুবক তাঁর কাছে এসেছে বিষয়-সম্পত্তির জন্য পরামর্শ নিতে! তিনি জানতেন, আসতেই হবে একদিন না একদিন।

সমস্ত বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন তিনি। তারপর মন্তব্য করলেন, ওর ঐ দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেবার জন্য কৌশল করো। আর, নবীনকে একবার পাঠিয়ে দিতে পারো আমার কাচে? তাকে অনেকদিন দেখিনি, একবার দেকতে সাধ হয়।

কিন্তু নবীনকুমার বিধুশেখরের কাছে যাওয়ার সময় পেল না এবং সত্বর বেঙ্গল ক্লাবের সম্পত্তি বিক্রয় করে দিল।

গঙ্গানারায়ণকে কোনো কৌশল করতে হলো না। অবশ্য, তার আগেই শেষ দশা ঘনিয়ে এলো পরিদর্শক সংবাদপত্রের। শুধু অর্থব্যয় করেই তো পাঠকদের মন বদল করা যায় না। শেষ পর্যন্ত এই অবস্থা দাঁড়ালো যে ঐ পত্রিকা বিনামূল্যে পাঠানো হয় দেড়শত ব্যক্তিকে আর নগদ মূল্যের ক্রেতা মাত্র চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ জন। বাণ্ডিল বাণ্ডিল অবিক্রিত কাগজ স্তুপাকার হয়ে থাকে। এমনকি কৰ্মচারীরাও আড়ালে হাসাহাসি করে মালিককে নিয়ে। যে কাগজ পাঠকরা কিনে পড়ে না, সে কাগজের জন্য মন দিয়ে লিখতেই বা ইচ্ছে করে কার? পত্রিকার মানও কমতে লাগলো দ্রুত।

কৃষ্ণকমলের সংসর্গ পরিত্যাগ করতে চেয়েছিল, তবু আর একদিন নিজে থেকেই এসে বিদ্রূপ করে গেল। সে। পঁয়তাল্লিশ জন, অ্যাঁ? এদের নিয়ে তুমি দেশোদ্ধার করবে। আর সমাজ বদলাবে! তোমাদের এই এক মুঠো সমাজ নিয়েই যত নাচানাচি। আসল দেশটাকে তোমরা কেউ এখনো চিনলে না!

নবীনকুমার ক্ষুব্ধ ভাবে বললো, বাঙালীরা বাংলা কাগজ পড়বে না, শুধু ইংরেজি কাগজ পড়বে? এটা কী রকম কথা?

কৃষ্ণকমল হাসতে লাগলো।

পরিদর্শক যে-দিন বন্ধ হয়ে গেল সেদিন নবীনকুমার বাড়ি ফিরলো মধ্যরাত্রে। নিজের পায়ে ভর দিয়েও ফিরতে পারলো না সে। দুলাল এবং আরও দু একজন তাকে ধরাধরি করে নিয়ে এলো অন্দর মহলে। নেশার ঘোরে সে সংজ্ঞাহীন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *