2 of 2

৫৮. আমাদের বাড়ির বাজার করার ভার

আমাদের বাড়ির বাজার করার ভার ছিল বাবার ওপর। বাবা একাজে খুব দক্ষ নন, কলকাতার বাজারের ধুরন্ধর দোকানদারদের সঙ্গে পাল্লা দেবার ক্ষমতা তার ছিল না। কিন্তু যৌথ পরিবারের নিষ্কর্মা ব্যক্তিটির ওপরেই সচরাচর বাজার করার ভার পড়ে। জ্যাঠামশাই ইদানীং অত্যন্ত ব্যস্ত, এক মুহূর্ত তার সময় নেই। পয়সা রোজগারের উন্মাদনায় তার আর কোনও দিকে তাকাবার অবসর নেই। যুদ্ধের বাজারে লৌহ ও খাদ্য ব্যবসায়ীদের মতনই কাগজ ব্যবসায়ীদেরও প্রচণ্ড লাভ হয়েছে। কালোবাজার একেবারে ফলাও হয়ে উঠেছে।

।বাবা ইদানীং প্রতিদিন সকালের বাজার করার ভারটা আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছিলেন। সরাসরি দেননি, কিছু দিন অ্যাপ্রেন্টিসগিরি করতে হয়েছে আমাকে। আমার তখন যা বয়স, তাতে বাবার সঙ্গে সঙ্গে বাজারের থলি নিয়ে ঘোরার ব্যাপারটা মোটেই পছন্দসই বা সম্মানজনক নয়। কোনও বন্ধু বা সহপাঠী দেখে ফেললে অত্যন্ত লজ্জায় পড়ি। আমার বন্ধু বিষ্ণু বা ভাস্কর কোনও দিন বাজারে ঢোকেইনি। হঠাৎ কোনও দিন একলা বাজার করতে গেলে অবশ্য মন্দ লাগে না আমার, দু-চার আনা পয়সা পকেট খরচ জুটে যায়।

সেদিন সকালবেলা বাবার সঙ্গে আমাকে বাজারে যেতে হয়েছে। বাজারের কাছটায় খুব ভিড় ছিল, আমরা তা লক্ষ করিনি। গেট দিয়ে ঢুকতে যেতেই দেখি একজন বুড়ো লোক মাথায় ডিমের ঝকা নিয়ে দৌড়ে আসছে আর বাঁশ হাতে নিয়ে কিছু লোক তাকে তাড়া করেছে। অচিরেই বুড়ো লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, প্রায় দুশো-আড়াইশো ডিম ছিটকে পড়ল মাটিতে। অসম্ভব ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ির পরই লেগে গেল বড় রকমের মারামারি।

সেই গোলমালের মধ্যে আমি বাবাকে হারিয়ে ফেললাম। প্রথমে চমকে গিয়ে আমাকেও দৌড়ে রাস্তার ওপারে চলে যেতে হয়েছিল কিন্তু বাবাকে খুঁজে না পেয়ে আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, বিকট চিৎকার, লাঠি ও লোহার রডের প্রবল তাণ্ডবে ধপাধপ মানুষের দেহ পড়ে যাচ্ছে রাস্তায়। এখন আর এখানে এক মুহূর্ত দাঁড়ানো চলে না–কিন্তু বাবাকে ফেলে আমি চলে যাব কী করে! বাবাও নিশ্চয়ই আমাকে না পেয়ে দারুণ চিন্তা করছেন।

স্নেহ নিম্নগামী। পিতার পুত্রস্নেহের তুলনায় পুত্রের পিতৃভক্তি সচরাচর অনেক কম হয়। সেদিন মারামারি ব্যাপক হয়ে ওঠায় আমি বেশ কয়েক বার অনেক দূর পর্যন্ত পালিয়ে গেছি–আবার বাবাকে খোঁজবার জন্য ফিরে এসেছি একটু একটু করে। কিন্তু বাবা সেই লুঠেরা ও হত্যাকারীদের মধ্যেই পাগলের মতন খুঁজছেন আমাকে। আহত বা নিহত মুখগুলোর কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছেন–এক বারও নিজের জীবনের কথা ভাবেননি।

শেষ পর্যন্ত অক্ষত শরীরেই আমরা দু’জনকে ফিরে পেলাম। আমাকে দেখে বাবা ছুটে এসে আমার কাধ আঁকড়ে ধরলেন। তার চোখদুটি বিস্ফারিত, সারা দেহটা থরথর করে কাঁপছে। কিছু একটা বলতে গিয়ে শুধু উচ্চারণ করলেন, বাদল, বাদল। আর একটু দেরি হলেই বোধহয় উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেন। বাবা যেন তাঁর মৃত পুত্রকে ফিরে পেলেন।

বাবার তুলনায় আমি অনেক কম বিচলিত ছিলাম। অরাজকতা ও মৃত্যুর মাঝখান দিয়ে আমি ছুটলাম বাবার হাত ধরে। কোনও রকমে এসে পৌঁছে গেলাম তালতলার বাড়িতে। এ-পাড়াতেও ততক্ষণে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে, বাড়ির সবাই দারুণ উৎকণ্ঠিত হয়ে ছিল।

একটা ছোটখাটো আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বাড়ি ফিরে এই জঘন্য ও নিষ্ঠুর সব হত্যাকাণ্ডের জন্য বিমর্ষ হয়ে পড়ার বদলে আমি আমাদের পালিয়ে আসার কাহিনী যতদূর রোমাঞ্চকর ভাবে বলা যায়, সেই ব্যাপারেই বেশি উৎসাহিত বোধ করছিলুম। দু’-একটা ছোটখাটো মিথ্যে বলতেও দ্বিধা করিনি। একটা লোক আমাদের ছুরি নিয়ে তাড়া করেছিল–আমিই যে আমার বৃদ্ধ বাবাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে এনেছি, আমার কথার মধ্যে এই সুর ছিল এবং মা-জ্যাঠাইমারা বিশ্বাসও করেছিলেন।

এদিকে মৌলালি, ও-দিকে ওয়েলিংটনে দাঙ্গা এত দূর ছড়িয়ে পড়ল যে আমরা মাঝখানে আটকা পড়ে গেলাম। দিনের-পর-দিন এই রকম চলল। সব সময় একটা আতঙ্ক। বাড়ির ছাদে উঠলেই আমরা দূরে ধোঁয়া দেখতে পাই–কোথাও-না-কোথাও বাড়ি পুড়ছে। সারা রাত ধরে চিৎকার ভেসে আসে।

আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই বড়রাস্তার ওপর এগারোটা মড়া পড়েছিল। এখানে ওখানে, খুন করে খুনিরা ওই মৃতদেহ বড়রাস্তায় এনে জড়ো করে রেখেছে। কদাচিৎ পুলিশের গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যায়–মড়াগুলোর দিকে তাকায় না পর্যন্ত। তেতাল্লিশের। দুর্ভিক্ষেও রাস্তায় তোক মরেছিল, কিন্তু মৃতদেহ বেশিক্ষণ ফেলে রাখা হয়নি। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় মৃতদেহের প্রতিও কোনও সম্মান নেই।

বাবা-জ্যাঠামশাই প্রথম দিকে আশা করেছিলেন, এখনও তো দেশে ব্রিটিশ রাজত্ব আছে। ব্রিটিশ সরকার এ রকম বর্বর ব্যাপার কিছুতেই চলতে দেবে না। লিগ মিনিস্ট্রি না হয় পুলিশ বিভাগকে হাত করে রেখেছে, কিন্তু সরকারের হাতে তো মিলিটারি আছে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে মিলিটারি বেরিয়ে এক দিনেই সব ঠান্ডা করে দেবে। আমার জ্যাঠামশাইয়ের মিলিটারির ওপর অগাধ ভক্তি ছিল।

কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেল, মিলিটারি আর বেরোল না।

এদিকে মড়াগুলো পড়ে রইল রাস্তায়। বিন্দুমাত্র ইচ্ছে না থাকলেও বার বার চোখ চলে যায় ওদের দিকে। দু-তিন দিন পরই আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, রোগা রোগা লোকগুলো মৃত্যুর পর বেশ মোটাসোটা হয়ে গেছে। পঞ্চম দিনে তাদের কারওর কারওর হাত উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। যেন শুয়ে শুয়ে কোনও একটা নাচের ভঙ্গিমায় তাদের হাতের মোটা মোটা আঙুলে বিভিন্ন মুদ্রা। একজনের উঁচু করা হাত দেখলে মনে হয়, সে আকাশের ঈশ্বরের দিকে কঁচকলা দেখাচ্ছে।

মৃত্যু আমি কম দেখিনি। তাই লঘু হাস্যময় জীবনের প্রতি আমার এত অদ্ভুত লোভ।

মানুষ-পচা বিকট গন্ধ জানলা দরজা বন্ধ করেও আটকানো যায় না। সব সময় আমাদের বাড়িতে ধুপধুনো জ্বলে। আমরা রাত্তিরে ঘুমোতে পারি না। প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখি রাস্তার মড়াগুলো এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের বাড়ির দিকে হেঁটে হেঁটে আসছে। আমার দিদি সান্ত্বনার পাগলামির লক্ষণটা আবার বেড়ে গেল।

একদিন পুলিশ এসে পাড়ায় মাইকে ঘোষণা করতে লাগল যে যদি কেউ এ-পাড়া থেকে পছন্দমতন নিরাপদ পাড়ায় চলে যেতে চায়–তা হলে পুলিশের পাহারায় তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

এই ঘোষণা শুনেই বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের হৃৎকম্প শুরু হল। তার মানেই নিশ্চয়ই এ পাড়ায় শিগগির একটা বড় রকমের হামলা হবে। এবার আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।

সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হল না। ইতিমধ্যেই একদিন টেলিফোনে বড়বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল–ওই পাড়া তখন শান্ত। আমরা কোনও রকমে বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে পুলিশের গাড়ি চেপে চলে এলাম বড়বাবুর বাড়িতে।

এখানে এসে শুনলাম, সূর্যদা মাঝখানে একদিন খবর পাঠিয়েছিল। এখন সে রিলিফের কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে আসার সময় পায় না।

জিন্নার পাকিস্তানের স্বপ্ন সফল হবার আগেই কলকাতায় ছোট ছোট পাকিস্তান আর হিন্দুস্থান হয়ে গেল। ভাগ হয়ে গেল বিভিন্ন পাড়া–এক পাড়ার মানুষ অন্য পাড়ায় যায় না–দৈবাৎ গিয়ে পড়লে প্রাণ নিয়ে ফেরে না। মাঝখানে দু-এক দিনের জন্য থামে। আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়। নেতারা পরস্পরবিরোধী চাচামেচি করে।

কলকাতার পর শুরু হল নোয়াখালিতে। হত্যা, নারীধর্ষণ আর অগ্নিকাণ্ডের খবর ছাড়া আর কোনও খবর নেই। বাংলাদেশের বদলা নেওয়া হল বিহার, আমেদাবাদ ও বোম্বাইতে।

অক্টোবরের শেষ দিকে গান্ধীজি এলেন কলকাতায়। গান্ধীজি তখন মুসলমানদের চোখে পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু। আবার তার জিন্নাতোষণ নীতির জন্য বহু সংখ্যক হিন্দুও তার ওপর খড়গহস্ত। এই অবস্থাতেও তার শান্তির আহ্বানে কিছুটা ফল হল। গান্ধীজি এসে আশ্রয় নিলেন বেলেঘাটার মুসলমান পাড়ায়। বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দিও এসে আশ্রয় নিলেন তাঁর কাছে। স্কুল কলেজের ছাত্ররা আবার শান্তি মিছিল বার করে কলকাতা পরিভ্রমণ করল, তারপর এল বেলেঘাটায়। সেই মিছিলে আমিও ছিলাম।

গান্ধীজি ও সোহরাওয়ার্দি আমাদের কাছে যুগ্ম ভাবে আহ্বান জানালেন হিন্দু-মুসলমান সমমর্মিতার জন্য। কিন্তু আমরা দেখলাম অতিশয় রূপবান, সুপুরুষ সোহরাওয়ার্দির মুখমণ্ডল অত্যন্ত বিমর্ষ। ঘটনার বল্গাহীন গতি দেখে তিনি যেন অত্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। গান্ধীজির মুখে দারুণ ক্লান্তির ছাপ। তিনি নির্বাক।

একজন গান্ধীজির বাণী চাইতে গেলে, তিনি বাংলাতেই লিখে দিলেন আমার জীবনই আমার বাণী। কিন্তু কঁপা কাঁপা অক্ষর, তাতে যেন আত্মবিশ্বাসের ছাপ নেই।

একটা ছেলে হঠাৎ সামনের দিকে ছুটে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আমার বোন…আমার বোনকে ওরা…আমারই চোখের সামনে…মেরে ফেলেছে…আপনি এর কী উত্তর দেবেন?

ছেলেটিকে জোর করে থামানো হল। তখন এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় নয়। সমমর্মিতার সময়। আমাদের জল তেষ্টা পেয়েছিল বলে বেলেঘাটার বস্তির বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে আমরা জল চাইলাম। কেউ কেউ বললেন, আমাদের একটু পানি দিন। মুসলমানের হাত থেকে জল নিয়ে সেদিন আমাদের মনে হয়েছিল, আমরা যেন অমৃত পান করছি!

কলকাতা থেকে গান্ধীজি গেলেন নোয়াখালিতে। গান্ধীজিকে একজন প্রশ্ন করেছিল, আপনি বোম্বাই, আমেদাবাদ বা ছাপরায় না গিয়ে নোয়াখালিতে কেন যাচ্ছেন? সেখানে হিন্দুরা উৎপীড়িত হয়েছে বলেই কি যাচ্ছেন?

মর্মাহত হয়ে গান্ধীজি বললেন, নোয়াখালির মতন ঘটনা যদি অন্য কোনও জায়গায় ঘটে এবং তিনি অনুভব করেন যে সেখানে না গিয়ে তার উপায় নেই, তবে তিনি নিশ্চয়ই সেখানে যাবেন। নোয়াখালির ধর্ষিতা নারীদের আকুল ক্রন্দনই তাঁকে সেখানে যাবার জন্য অস্থির করে তুলেছে।

নোয়াখালিতে গান্ধীজি নিহত হবেন এই রকম একটা আশঙ্কায় বিদেশি সাংবাদিকরা খুব তৎপর হয়ে উঠেছিল। সে রকম কিছু ঘটল না, কিন্তু সাময়িক বিরতি ছাড়া গভীর কোনও প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল না। ঘটনার গতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তখন গান্ধীজিরও নেই।

কলকাতায় গান্ধীজির অনুপ্রেরণায় আর একটি শান্তি মিছিল বেরিয়ে ওয়েলিংটনের কাছে আক্রান্ত হল। কয়েক জন শ৷ ওঁবাদীর ছিন্নভিন্ন দেহ লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়।

তার কয়েক দিনের মধ্যেই আমার জ্যাঠামশাই খুন হলেন।

বড়বাবুর বাড়িতে আমরা নিরুপদ্রবেই ছিলাম। কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের মন টিকছিল না। সেখানে। ইতিমধ্যেই বড়বাবুর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়ে যাওয়ায় আবার তার বাড়িতেই আশ্রয়প্রার্থী হয়ে ফিরে আসতে জ্যাঠামশাইয়ের আত্মসম্মানে লেগেছিল। তা ছাড়া, তার তালতলার বাড়িতে বহু টাকার সম্পত্তি পড়ে ছিল। সে সব ছেড়ে থাকার জন্য তিনি এক মুহূর্তও শান্তি পাচ্ছিলেন না। একবার কলকাতার অবস্থা একটু ঠান্ডা হতেই তিনি স্ত্রী ও মেয়েদের এ বাড়িতে রেখে জোর করে ফিরে গেলেন তালতলায়। বাড়ির মেয়েদের কান্নাকাটি এবং বড়বাবুর অনুরোধ কিছুই শুনলেন না। বাড়ির চাকর ও দারোয়ানদের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস।

দু দিন বাদেই তালতলার বাড়ি আক্রান্ত হল, আগুন লাগানো হল বাড়িতে। জ্যাঠামশাই পালাতে পারলেন না–অত্যন্ত নৃশংস ভাবে নিহত হলেন। এই ঘটনার দেড় ঘণ্টা পরেই সেই রাস্তায় জ্যাঠামশাইয়ের বহু আকাঙ্ক্ষিত মিলিটারির গাড়ির সার এসে পড়ল, কিন্তু জ্যাঠামশাইকে বাঁচাতে পারল না। জ্যাঠামশাইয়ের বিষয়সম্পত্তি ও প্রাণ একই সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেল।

আমরা জ্যাঠামশাইয়ের মৃতদেহ দেখিনি। খবর পাওয়া গিয়েছিল বারো ঘণ্টা পরে। এবং ঘটনাটি সংশয়াতীত ভাবে প্রমাণ করতে সময় লেগেছিল আরও এক দিন। তারপর মর্গ থেকে একটা কাটা-ছেঁড়া মৃতদেহ নিয়ে এসে দাহ করা হয় নিমতলায়।

খবর পেয়ে এই দুর্দিনের মধ্যেও বড়দি চলে এল খড়্গপুর থেকে। সূর্যদাও ফিরে এল বাড়িতে। জ্যাঠাইমাকে সামলাতেই সবাই হিমসিম খেয়ে গেল। জ্যাঠাইমা কিছুতেই তাঁর স্বামীর মৃত্যুসংবাদ বিশ্বাস করবেন না–তিনি সবার হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে চান তালতলার বাড়িতে। সেখানে সে-বাড়ির একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে শুধু, জানলা-দরজাগুলোরও অস্তিত্ব নেই। শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাবার পর জামাইবাবু জ্যাঠাইমাকে খড়্গপুরে নিয়ে যেতে চাইলেন।

দেশব্যাপী অবিশ্রান্ত মারামারি কাটাকাটির ফলে দেশের সাধারণ লোক একসময় তিতিবিরক্ত হয়ে বলতে লাগল, এর থেকে দেশ ভাগ হয়েও স্বাধীনতা আসে তো আসুক। তখনও বাংলা বা পাঞ্জাব ব্যবচ্ছেদের কথা বিশেষ কেউ চিন্তা করেনি। যে-দিন সত্যিই সে কথা ঘোষিত হল, সে-দিন বাংলার চেয়েও বেশি আগুন জ্বলে উঠল পাঞ্জাবে। রণদুর্মদ শিখ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ পাঞ্জাবিরা রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে লাগল।

সাতচল্লিশের মাঝামাঝি এসে কলকাতা অনেকটা শান্ত হয়ে পড়ল। মানুষজন আবার পথেঘাটে বেরোয়, দোকানপাট করে। যেসব পাড়ার লোকেরা এককাট্টা হয়ে অন্য পাড়ার আক্রমণ রুখেছে এখন তারাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া লাগায় রেশনের দোকানের লাইনে। রক্তাক্ত দিনের বিভীষিকাও জনতার মন থেকে কত তাড়াতাড়ি মুছে যায়! মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে খালি বাড়ি পড়ে আছে–অধিবাসীরা পলাতক। বিষ্ণুদের। পাড়াতেও দাঙ্গা বেশ প্রবল ভাবেই হয়েছিল, অনেক দিন ওদের খোঁজ নিতে পারিনি। একদিন গিয়ে শুনলাম, ওরা আসামে বেড়াতে চলে গেছে। সিঁড়ির মুখটাতেই রেণুর সঙ্গে দেখা।

রেণুকে দেখলেই আজকাল আমি একটু একটু ভয় পাই। রেণু আজকাল কথায় কথায় আমার বড্ড সমালোচনা করে। জামার বোতাম ঘেঁড়া থাকলে কিংবা জুতোয় পালিশ না থাকলে রেণু ভুরু কুঁচকে তাকায়। রেণু একটা কথা বোঝে না। একদল ছেলে সব সময় ফিটফাট সেজেগুঁজে থাকতে ভালোবাসে, আর একদল ছেলে সেজেগুঁজে ফিটফাট থাকার সরঞ্জামই পায় না। তাদের জুতোয় তাপ্পি থাকে, ছেঁড়া প্যান্ট সেলাই করে পরেও সেটা আবার লুকোতে চায়–ধোপাবাড়িতে পাঠাবার সামর্থ্য নেই বলেই বাড়িতে সোড়া দিয়ে কাঁচা জামা পরে। এ ছাড়াও আর একদল ছেলে থাকে, যারা পরিচ্ছন্ন শার্টেও বোতাম দেয় না, দামি প্যান্টের সঙ্গে ছেঁড়া শার্ট পরে ইচ্ছে করে এবং চুলে তেল দেওয়া পছন্দ করে না। আমি ওই তৃতীয় দলের ছেলেদের অন্তর্গত হয়ে গেছি কারণ এরাই ছাত্রদের সমাজের শিরোমণি।

রেণুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের বাড়িটা এত ফাঁকা ফাঁকা কেন রে?

সাদা রঙের স্কার্ট পরে রেণু দাঁড়িয়ে আছে, আমার দিকে স্থির দৃষ্টি, মুখে একটাও কথা নেই। কপালে এসে পড়েছে কয়েক গোছা চুল, বাঁ হাতে একটা বই, ডান হাত রেলিংয়ে। তকতকে ঝকঝকে শরীর, নির্মল চোখ, সদ্যফোঁটা ফুলের মতন শরীরে নতুন যৌবনের আভা! রেণুকে মনে হল একটা ছবির মতন–এবং সত্যিই যেন এ রকম একটি ছবি আমি আগে কোথাও দেখেছি!

রেণু আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না, সিঁড়ির ঠিক সেই ধাপেই দাঁড়িয়ে রইল। রেণুকে দেখে আমি সব ভুলে গেলাম। এই ক’মাসের ভয়াবহ সময়, রক্তপাত, দুঃস্বপ্ন, শোক। সেই ছবিটির মধ্যে যে সৌন্দর্য ছিল, তা আর সব কিছুকেই আচ্ছন্ন করে দেয়।

আমি দু’-এক পা এগিয়ে এসে বললাম, এই রেণু?

ছবিটা ভেঙে গেল। রেণু সিঁড়ি থেকে নেমে এসে বলল, ছোড়দা, নদা কেউ বাড়ি নেই।

তুই কোথায় যাচ্ছিস?

আমি মল্লিকাদের বাড়ি থেকে বই আনতে যাচ্ছি। ওদের বাড়িতে অনেক বই।

এক্ষুনি আসবি তো? আমি এখানে বসি?

রেণু গম্ভীর মুখ করে বলল, তুই আজকাল সিগারেট খাস?

আমি দারুণ অবাক হয়ে বললাম, না তো!

একজন তোকে দেখেছে!

মোটেই না। কক্ষনও হতে পারে না।

একজন যে আমাকে বলল!

কে?

সে যেই হোক না—

তবু আমি নাম শুনতে চাই।

মল্লিকার দাদা।

সেই মুহূর্তে মল্লিকার দাদাকে হাতের কাছে পেলে আমি দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিতাম। খুন করে ফেলাও বিচিত্র ছিল না।

কঠিন মুখ করে বললাম, হি ইজ এ লায়ার! ড্যাম লায়ার!

তুই সত্যি খাসনি?

না।

আমার হাত ছুঁয়ে বল।

রেণুর হাত ছুঁয়ে আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এই তো বলছি!

আসলে আমি মিথ্যে কথা বললাম। রেণুকে ভয় পাই বলেই ওর সামনে মিথ্যে কথা বলতে আমার আটকাল না। রেণু এখনও স্কুলের মেয়ে–ও কী করে বুঝবে যে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভরতি হয়ে যে-ছেলে সিগারেট না খায় এবং রেস্টুরেন্টের চায়ের কাপে ছাই না ফেলে–বন্ধুদের কাছে তার কোনও সম্মানই নেই।

এত কম বয়সেই রেণুর মধ্যে নীতিবোধ ও সততা অত্যন্ত বেশি। ওকে যখন প্রথম দেখি, তখন ও ছিল দারুণ দুরন্ত ও দুষ্টু মেয়ে–হঠাৎ কী রকম বদলে গেছে। যাবতীয় মানবিক ব্যবহারকেও ও ভালো ও মন্দ, এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে–এবং মন্দের সঙ্গে ও কোনও সংস্রব রাখতেই রাজি নয়। ওর নিজের দাদা অংশু এ রকম নয়–কিন্তু বিষ্ণুর সঙ্গে রেণুর খুব মিল আছে এ ব্যাপারে।

বিষ্ণু আর আমি আলাদা আলাদা কলেজে ভরতি হয়েছি বলে বিষ্ণুর প্রভাব আমার ওপর থেকে কমে গেছে। বিষ্ণু ভরতি হয়েছে স্কটিশ চার্চ কলেজে কিন্তু ওই কলেজে মেয়েরা পড়ে বলে আমাকে কিছুতেই সেখানে ভরতি করা হল না। আমার বাড়ির লোকেরা এ ব্যাপারে দারুণ গোঁড়া–অধিকাংশ বাঙাল পরিবারই এ রকম। আমাকে ভরতি হতে হয়েছিল সেন্ট পলস কলেজে। সেখানে একটি ছেলে একদিন আমাকে বলেছিল, তুই ট্রামরাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে পারবি? সে চ্যালেঞ্জ অস্বীকার করব কী করে?

তবু রেণুর কাছে মিথ্যে কথা বলে আমার গ্লানি হয় না। বরং বেশ মজা লাগে।

আমি তখনও রেণুর হাত ধরে আছি। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রেণু বলল, আমি তোকে। একটা চিঠি লিখেছিলাম।

কই পাইনি তো!

পাঠাইনি।

কই দে। এখন আমাকে দে।

এখন আর দিয়ে কী হবে। এমনি লিখেছিলাম।

আমার চিঠি আমাকে দিতেই হবে। আমি এক্ষুনি চাই।

রেণু বড় একরোখা মেয়ে। একবার কোনও ব্যাপারে না বললে আর সহজে হা বলানো যায় না। চিঠিটা ও কিছুতেই দেবে না। শেষ পর্যন্ত বলল, চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছে।

আমি বললাম, মিথ্যে কথা!

রেণু বলল, আমি মোটেই তোর মতন যখন-তখন মিথ্যে কথা বলি না।

আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে ছুঁয়ে বল।

রেণু ছুঁয়ে দিয়ে বলল, এই তো বলছি!

রেণুকে দেখলেই বোঝা যায়, ও মিথ্যে কথা বলার মেয়ে নয়। তবু আমার সন্দেহ যায় না। মনে হয়, আমারই মতন রেণুও এ-ক্ষেত্রে মিথ্যে কথা বলছে। কিন্তু সে কথা আর ওকে বলা যায় না।

যে-চিঠি পাওয়া যায় না, সেই চিঠির জন্য মনের মধ্যে একটা দারুণ ঔৎসুক্য থাকে। আমার বার বার মনে হতে থাকে যে সেই না-পাওয়া চিঠির মধ্যেই আমার জীবনের অনেক রহস্যের সমাধান ছিল।

নিস্তব্ধ ঠাকুরদালানে রোদ পড়েছে, তিনটি শালিক সেখানে প্রচণ্ড কলহে মত্ত। বড় থামের পাশে শুয়ে আছে একটা বিড়াল। ওপরে কার হাত থেকে একটা থালা পড়ে গেল ঝনঝন শব্দে। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, রেণুর সঙ্গে আমার সারা জীবনে কখনও বিচ্ছেদ হবে না। রেণু যেন একটা মেয়ে নয় শুধু, একটি শিল্প। যে শিল্পের সন্ধান আমাকে সারা জীবন ধরে করে যেতে হবে।

সেইসময় ভাস্কর আর পঙ্কজ এসে পড়ল। আমাকে দেখেই বলল, কী রে বাদল, তোর যে পাত্তাই নেই অনেক দিন!

ওরা দু’জনে ধপ করে ঠাকুরদালানের সিঁড়িতে বসে পড়ে বলল, এই রেণু, বিষ্ণুকে ডাক তো!

আমি বললাম, বিষ্ণু তো নেই এখানে।

সে কথা শুনে ভাস্কর ও পঙ্কজ বেশ দুঃখিত হয়ে পড়ল। ওদের মনে হল, বিষ্ণু ওদের সঙ্গে যেন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাইরে বেড়াতে যাবার আগে বিষ্ণু তার বন্ধুদের একবার খবরও দিয়ে গেল না! যদিও মাঝখানে কয়েক মাসের ডামাডোলে খবর দেবার অসুবিধা ছিল, তবু বন্ধুদের অভিমান হবেই।

বিষ্ণু আমারই সবচেয়ে পুরনো বন্ধু সুতরাং আমারও অভিমান হবার কথা ছিল। কিন্তু এসেই সিঁড়ির ওপরে রেণুর ছবির মতন দাঁড়িয়ে থাকা দেখে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এখনও রেণুর সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ পঙ্কজ আর ভাস্কর এসে পড়ায় আমি বেশ অপরাধী বোধ করছিলাম। আমার মুখখানা তেলতেলে হয়ে এসেছিল, ওরা অবশ্য সেটা লক্ষ করেনি।

ভাস্কর বলল, ওফ যা গরম! এই রেণু খাবার জল নিয়ে আয়। অনেকখানি খাবার জল নিয়ে আয়।

পঙ্কজ মুখ নিচু করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, শুনলুম নাকি তোর কোন আত্মীয়–

সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখখানা কালো হয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি কান্নার ঠিক আগের মুহূর্তের মতন। ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম, আমার জ্যাঠামশাই, আমার নিজের জ্যাঠামশাইকে, উঃ!

আমার জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুতে আমি আঘাত পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তেমন ভাবে খুব বেশি শোক পাইনি! জ্যাঠামশাই আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না–ইদানীং তার সঙ্গে একটা দূরত্বও তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

তবু, অন্যদের কাছে বলতে গেলে একটু অভিনয়ের ব্যাপার এসেই যায়। আমি এত বেশি শোকের ভান করতে লাগলুম যে ওরা আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *