2 of 2

৫৭. সন্ধে লাগার আগেই

৫৭

সন্ধে লাগার আগেই নামিয়ে দিয়ে গেছিল ভুচু পৃথুর বাংলোতে।

জীপ ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, কাল সকালে আমি আসতে পারব না পৃথুদা, হুদাকে দিয়ে জীপ পাঠিয়ে দেব এগারোটা নাগাদ। শামীম খেতে বলেছে তোমাকে আমাকে আর গিরিশদাকে। মনে আছে তো?

আছে।

পৃথু বলল।

তারপর বলল, হুদাকে সকাল সাতটা নাগাদ একবার পাঠাবে ভুচু? কাজ ছিল আমার একটু।

সাতটাতে? হুদা তো অত সকালে আসে না। রামদীনকে পাঠিয়ে দেব। ভেবো না কিছু। তুমিই তাহলে আমাকে তুলে নিয়ে যেও। গিরিশদা সোজাই আসবেন শামীমের বাড়ি।

তাহলে ওই কথাই রইল। বলেই হাত তুলে, জীপ চালিয়ে চলে গেল।

বসবার ঘরে ঢুকে দেখল, কোম্পানীর ক্যাশিয়ার সুব্রাহ্মনিয়ম বসে আছে। মাথায় ফোঁটা-তিলক কাটা, পরনে সাদা টেরিলিনের ট্রাউজার এবং হাফ শার্ট। এই ঠাণ্ডা মাথার মিতভাষী সুব্রাহ্মনিয়ম্‌কে দেখে আসছে এই রকমই। এই রকম সাদা পোশাকেই। বহু বছর। পৃথুকে দেখেই, উঠে দাঁড়াল সে। একটি খাম দিল পৃথুর হাতে। বলল, মিস্টার সিং।

থ্যাঙ্ক উ্য, সুব্বু।

নো মেন্‌শানা। স্যার্‌রা! বলে, দুদিকে মাথা নাড়ল সুব্বু। হিয়ার ইজ্জ আ লেট্টারা ফ্রম্ম মিসেস সিংআ স্যার্‌রা।

একটি চিঠি এগিয়ে দিল।

থ্যাঙ্ক উ্য সুব্বু।

আই অ্যম্মা সর্‌রী স্যার্‌রা।

সরি? ফর হোয়াট?

ভিতরে ভিতরে রেগে গেল পৃথু। সুব্বুও যদি কিছু বলতে যায় ওর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে তাহলে ও কার্টলি বলবে: দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস্। কিন্তু সুব্বু বলল, আই অ্যাম্মা সরি অ্যাজ আই হিয়ারা দ্যাট্টা উ্য আর লীভ্‌ভীং আস্‌সা।

আই ওল্‌সো অ্যাম, সরি সুব্বু।

গুডনাইট্টা স্যাররা। উইশ উ্য আল দ্যা বেস্টা।

থ্যাঙ্ক উ্য সুব্বু। আই ডু দ্যা সেম্‌।

বেশি কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা পৃথুর ছিল না। শারীরিক অবস্থা তো নয়ই। দরজা অবধি এগিয়ে দিল সুব্রাহ্মনিয়ম্‌কে।

সে চলে যেতেই, মেরী বলল, মেমসাহেব চিঠি পাঠিয়েছেন একটা।

কাকে দিয়ে?

ইদুরকার সাহেবের ড্রাইভারকে দিয়ে।

লছ্‌মার সিং এসে বলল, ডিনারমে ক্যা বানাউঁ সাব?

যা-কিছু আছে সবই বানিয়ে ফেলো। আমাদের সকলেরই জন্যে।

জী সাব্‌।

দুখীকে ডেকে পৃথু বলল, মেমসাহেবের চিঠিটা আমার টেবলে রাখ। পায়জামা পাঞ্জাবি দে। আমি চান করতে যাব। গীজার চালিয়েছিলি তো?

জী সাব্‌।

চান হলে ভাল করে এক কাপ কফি খাওয়াতে বলিস্ তো আমাকে, মেরীকে। কম চিনি, কম দুধ দিয়ে; পাতলা করে।

জী সাব।

চান করতে করতে পৃথু ভাবছিল, তার সুখের দিন এবারে শেষ হয়ে এল। কাল অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়বে সীওনীর দিকে। বাসটা কটায় ছাড়ে, ঠিক জানে না। তবে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছতে হবে ভোর ভোর। যাতে প্রথম বাসই ধরতে পারে। অনেক দূরের পথ। মুক্কি হয়ে, যেতে হবে লাল নীল অনেক নদী পেরিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নতুন অচেনা রঙের জীবনের দিকে।

কুর্চির সঙ্গে দেখা কি হবে? রুষাকে দেখে; পামেলার কথা শুনে, ভুচুর কাছ থেকে; মনের মধ্যে মেয়ে জাতটা সম্বন্ধেই একটা ভীতি জন্মে যাচ্ছে যেন। কুর্চির সঙ্গে এ জীবনে দেখা না হলেই ভাল। অজাইব্‌ সিং-এর কাছ থেকে কুর্চির কোথায় বাস তা জানার পরও কোনওরকম উত্তেজনাই বোধ করছে না। সীওনীতে যে যাবে, সে কথা ও আগেই ঠিক করে রেখেছিল। কারণ, তার জানাশোনা এক বিড়ি পাতার কারবারি আছেন সেখানে। তাঁর কাছে যদি জঙ্গলের কোনও কাজ জুটে যায় একটা! তাছাড়া, পেঞ্চ্‌ ন্যাশনাল পার্ক্‌-এর ফিল্ড ডিরেক্টর পারিহার সাহেবও আছেন। সামান্য একটি জীবিকার বন্দোবস্ত উনিও হয়তো করে দিতে পারবেন। তার নিজের প্রয়োজন আর কতটুকু?

সত্যিই কি তাইই? নিজের প্রয়োজন তার কিছুমাত্রও নেই?

এবার বোধহয় তার পরীক্ষা হবে।

চান করে পাজামা পাঞ্জাবি পরে ঘরে এসে একটা বড় স্যুটকেসে তার প্রিয়তম কটি বই আর লেখালেখির সরঞ্জাম ভরে নিল। বাকি সবই থাকবে এখানে। কখনও সম্ভব হলে নিয়ে যাবে; নিজে থিতু হয়ে। নইলে, ছেলেমেয়েরা তাদের খারাপ, পরিত্যক্ত বাবার স্মৃতি হিসেবেই পাবে এইটুকুই। সম্পত্তি বলতে, এইই সব। এইই পৃথু ঘোষের দেওয়া উত্তরাধিকার। আর বদনাম। নিজের কারণে, নিজের ছেলেমেয়ের কাছে ও লজ্জিত। অন্য কারও কাছে না হলেও।

মেরী, দুখীর হাত দিয়ে কফি পাঠিয়ে দিল। ড্রয়ারটা খুলতেই নস্যির কৌটো বেরোল একটা। গিরিশদার অর্ডার মতো এখানের স্যাকরাই রূপো দিয়ে বানিয়ে দিয়েছিল। নস্যিও ভরা আছে। কৌটোর উপরটাতে কাঁচ দেওয়া। দেখা যায়; কতটা আছে।

কফি খেয়ে, এক টিপ নস্যি নিয়ে রুষার চিঠিটা খুলল পৃথু। ছোট্ট চিঠি। কিন্তু খামটা খুলতেই, একটি আরও ছোট্ট চিঠি খসে গিয়ে মাটিতে পড়ল। তুলে নিতেই দেখল, টুসুর। কাঁচা, শিশুসুলভ হাতের লেখা। কিন্তু বক্তব্যে কোনও অস্পষ্টতা নেই।

মাই ডিয়ার বাবা,

এভরী বডি সেজ দ্যাট উ্য আর ভেরি নটি। আর উ্য রিয়্যালি? আই উইল পানিশ উ্য অ্যাজ মিস্‌ আডুয়াল্‌পালকার পানিশেস মী ইন দ্যা ক্লাস ফর রং-আন্‌সারস অফ সামস্‌।

বাট হোয়েন আর উ্য কামিং? আর উ্য অ্যাফ্রেইড অফ দ্যা পানিশমেন্ট? উ্য আর আ ব্যাড কিড বাবা!

কাম সুন! আই উইল ওল্‌সো প্লে গেমস উইথ উ্য আফটার আই পানিশ উ্য।

—ইয়োরস অ্যাফেকশনেটলী টুসু।

পি. এস. লিখে, বাংলায় ভাঙাচোরা অক্ষরে লিখেছে: বাবা। এখানে অনেক ফুল, পাখি, প্রজাপতি আছে। বড় বড় সাদা লেগহর্ন আর সোনালী রোড-আইল্যাণ্ড মুরগির গরম গরম ডিম পাড়ে বাবা। আমি কাল একটা ডিম ক্যাচ ধরেছিলাম। নরম আর গরম ছিল। ধরার পরেই শক্ত আর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। জানো?

টুসুর চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে গেল পৃথু। বসে থাকল চুপ করে। মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গেল।

রুষা লিখেছে,

পৃথু,

তোমার আর যাইই দোষ থাক, আত্মসম্মানের অভাব কোনওদিনও ছিল না। ইদুরকারের এই বাড়িতে এসে এবং অন্যকে দিয়ে ফোন করিয়ে আমাদের বিরক্ত করার চেষ্টা আর কোরও না। মিলিরও ওইই মত। টুসুর নিজস্ব মতামতের বয়স এখনও হয়নি। যখন হবে, তখন তার মতও যে এইই হবে, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

আমাদের চোখে তো তুমি ছোটই আছ। অন্যদের চোখেও নিজেকে এমন করে ছোট কোরও না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা কোরও না কোনও।

মিলি রুষার চিঠির নীচে লিখেছে, বাবা! তুমি আমাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের খুবই অশান্তি হয়। মা বলল যে, তোমার চোখের মলমটা তোমার লেখার টেবলের বাঁ দিকের ড্রয়ারে আছে। চোখে ব্যথা যদি হয় লাগিও। নিজের যত্ন নিও। আমরা ভাল আছি। খুব আনন্দে আছি। —ইতি মিলি।

পৃথুর চোখটা জ্বালা জ্বালা করতে লাগল। নস্যির জন্যেই হবে। অনেকদিন পর তো নিল নস্যি!

রুষাকে অনেক কিছু লিখবে ভেবেছিল। জীবনে সে যত কবিতা নিজে লিখেছে অথবা পড়েছে। সেই সবের মধ্যে বিধুরতমর চেয়েও বিধুরতম একটি কবিতা লিখবে ভেবেছিল রুষাকে।

স্ত্রী-পরিত্যক্তা স্বামীর চিঠি।

শব্দটাও কেমন নতুন নতুন শোনায় এই পুরুষশাসিত সমাজের অনভ্যস্ত কানে। কিন্তু রুষা প্রমাণ করেছে যে, স্বামীকে সহজেই পরিত্যাগ করা যায়। পৃথুর মনে হয় যে, সবাইকে সাবধান করে দেয়। কোনও স্বামীই যেন না ভাবেন যে, এমন ঘটনা শুধু তাঁর অবসরে-পড়া গল্প-উপন্যাসেই ঘটবে চিরদিন, তাঁদের নিজের নিজের জীবন চিরদিনই নিস্তরঙ্গ থাকবেই। তাহলে মস্ত ভুল হবে। কবে, কখন, কোন বয়সে এসে যে এমন ঘটনা ঘটবে, তা পূর্ব মুহূর্তেও হয়তো বলা মুশকিল।

রুষার জন্যে এক ধরনের গর্ববোধও করে পৃথু। মহিলা সমিতির সভ্যরা যে ধরনের উইমেনস লিব্‌ নিয়ে হাটচান্দ্রায় সচরাচর হইচই করেন, তাঁরা রুষাকে মন্দ বলতে পারেন, রুষা সম্বন্ধে কুৎসাও রটাতে পারেন কিন্তু পৃথুর পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র রুষাই সত্যিকারের লিবারেটেড। নিজের জীবনে মুক্ত হওয়া যে যায়, তা করে তো ও দেখিয়ে দিয়েছে। চিৎকার মারামারি না করে, কারও মতামতের দাম না দিয়ে, শুধুমাত্র নিজেরই নয়, নিজের সন্তানদের পক্ষেও যা মঙ্গলের বলে মনে করেছে, তাইই ও করেছে। পুরুষ বাঘের মতোই, সন্তানোৎপাদনের পরই ছুটি দিয়ে দিয়েছে তার খেলার সাথীকে ওই বাঘিনী। বাঘিনীরা স্বাবলম্বী হয়। আত্মসম্মানজ্ঞান প্রখর থাকে। বাচ্চাদের রক্ষা এবং বড় করে তোলার ক্ষমতার ওপরও পূর্ণ বিশ্বাস থাকে তাদের।

প্রথমটা ধাক্কা খেয়েছিল যদিও তবু, রুষার এই ব্যবহারে তার পরিচিত অন্য সকলে যতখানি বিচলিত, পৃথু কিন্তু অতখানি হয়নি। নিজের জীবন থেকে বাইরে এসে ও নিজেকে দেখছে একজন তৃতীয় ব্যক্তির মতো। উত্তেজনাহীন, অনুযোগহীন, অনুত্তাপহীন নৈর্ব্যক্তিক চোখে। ভারী একটা মজা বোধ করছে সে, তার এই আপাত-অসহায়তায়, তার পঙ্গুতায়। একটি আস্ত পা দিয়ে বাকি জীবনকে লাথি মেরে চলতে পারে, কি পারে না তাইই দেখবার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে যেন ও।

চিঠিটা কবিতা হল না। কোনও কবিরই ব্যক্তি-জীবনে কবিতা হয়তো থাকে না। এটাই সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি।

লিখল:

রুষা।

তোমার বাড়ির চাবি ফেরত পাঠালাম। আমি কাল ভোরে চলে যাব। কোথায়, তা এখনও ঠিক জানি না। তবে, পাকাপাকি একটা আস্তানা হলে, ঠিকানা নিশ্চয়ই পাঠাব। অন্য প্রয়োজন না থাকলেও, মিলি ও টুসুর স্বর্গীয় পিতার নিবাস তো একটা থাকা চাই। নইলে, ওদের পিতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।

তুমি হয়তো বলবে, ভবিষ্যতে কোনও পিতা ছাড়াই ওদের চলে যাবে। ওদের মাতৃপরিচয়ই ওদের যথেষ্ট পরিচয়। কথাটা হয়তো মিথ্যেও নয়। পিতার পরিচয়েই চিরদিন পুরুষশাসিত সমাজে ছেলে-মেয়েরা পরিচিত হয়ে এসেছে। দিন বদলাচ্ছে। বদলেছে। তুমিই সেই বদলের পতাকা বহন করে মুক্তি-মিছিলের পুরোভাগে চলেছ। তোমার এবং তোমাদের মতো অগণিতা মুক্তি-যোদ্ধাদের প্রতি আমার আন্তরিক ও অকৃত্রিম শুভেচ্ছা রইল। ঠাট্টা নয়, সত্যিই বলছি।

ভবিষ্যতের দাম্পত্য সম্পর্ক: যাই-ই বলো, এই দেশেও যে দারুণ ইনটারেস্টিং, আন্‌সার্টেন হয়ে উঠবে যে, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। অনুক্ষণ হারানোর ভয় না থাকলে, পাওয়াতে বোধ হয় কোনও মজাই থাকে না। তাই-ই না? আমাদের সম্পর্কর মতো, অনেক দম্পতির সম্পর্কই বোধ হয় গোথিক্‌ স্থাপত্যের মতো, মিড-ভিক্টোরিয়ান যুগের আসবাবপত্ররই মতো ভারী, অস্থাবর এবং অনড় হয়ে আছে। সেটা আদৌ অভিপ্রেত নয়।

ভাল থেকো। খুশি থেকো। মিলি টুসুকে সুখে রেখো। কোনও প্রয়োজন বোধ করলে আমাকে ডেকো।

টাকা পয়সার ব্যাপারটা উধাম সিং সাহেবকে বলা আছে। এ-ও বলেছি যে, তোমার কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপারে উনি মাথা ঘামাবেন না।

টুসুকে একবার দেখার ইচ্ছে ছিল বড়। যাই-ই হোক, এখন থাক। ও যখন বড় হবে আরও একটু, তখন মিলির মতো তার মতামতটাও তার নিজের মুখ থেকেই শোনা যাবে।

আমাকে হঠাৎই সব ভার মুক্ত করে দিলে তোমরা সকলে মিলে। এতদিন যেন ক্লাচ্‌-এ পা রেখে জীবনের গাড়ি চালাচ্ছিলাম। হঠাৎই পা সরিয়ে দেওয়াতে হালকা হয়ে গেছে গাড়ি। জোরে ছুটে চলেছে পাখিরই মতো…

রুষা। তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। সত্যিই বলছি। জীবনে বাঁচার মানে তুমি নিজে যেমন আবিষ্কার করেছ সাহসের সঙ্গে, আমাকেও বাঁচতে দিয়েছ। আমি জানি, তোমার এই সাহস, আমার ডাকু মগনলালকে একা গিয়ে মারার সাহসের চেয়েও অনেকই বড় সাহস। আমি সেই “অসমসাহসী” বলেই তোমাকে এই কথা বলতে পারছি। শারীরিক সাহস হচ্ছে সাহসের বহুতলা বাড়ির সবচেয়ে নিচুতলার বাসিন্দা, কমদামি; সস্তা। মনের সাহসটাই সাহস। মানুষ সেই সাহসের জন্যেই চিরদিন গর্বিত বোধ করে এসেছে। সেই সাহসেই তুমি হারিয়ে দিলে আমাকে। সত্যিই রুষা! আমি যদি তুমি হতাম, তাহলে পারতাম না বোধ হয়।

কনগ্রাচুলেশান্‌স। আমার অশেষ শুভেচ্ছা তোমার নতুন জীবনের প্রতি।

—ইতি—তোমার অশেষ প্রীতিধন্য পৃথু ঘোষ।

চিঠিটা পড়ল একবার লেখার পর।

নিজেকে যাত্রার নায়ক বলে মনে হল। সচরাচর পৌরাণিক থিয়েটারে বা যাত্রাতেই এই রকম রঙ-মাখা ঝলঝলে সিল্কের পোশাক-পরা মহৎ বাক্যবিন্যাসে অভ্যস্ত নায়ক দেখা যায়। ও নিজেও কি নিজের সত্যি-আমিত্বর ছোট্ট মাপটিকে ছাপিয়ে ওঠার অপচেষ্টাতে মেতে এমন একটি ঐতিহাসিক চিঠি লিখল রুষাকে। আসলে কী ও, ওর মনের কান্নাকেই লুকোবার জন্যেই একজন লিলিপুটিয়ান হয়েও এই রকম গালিভার হবার উচ্চাশায় মাতল?

ব্যাপারাটাকে ভাল করে আবারও ভেবে দেখল পৃথু। ভেবে দেখে, আশ্বস্ত হল যে, যা করেছে তা সম্পূর্ণ সজ্ঞানেই করেছে; একজন আধুনিক, জীবন্ত, প্রগতিবাদী, সমস্তরকম বদলে-বিশ্বাসী মানুষের মন নিয়ে। যারা মানুষের সঙ্গে মানুষের, নারীর সঙ্গে পুরুষের; স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্কের পরিবর্তনকে, বদলকে বাধা দেয় তারা সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বদলও আনতে কোনওদিনও সক্ষম হবে না। “চ্যারিটি বীগিনস্ অ্যাট হোম”-এরই মতো ওল চেঞ্জেস বীগিনস অ্যাট হোম অ্যাজ ওয়েল।

পৃথুর ব্যক্তিগত জীবনের ঝড়কে, যে ঝড় অন্য যে কোনও মানুষকেই বিধ্বস্ত করে দিতে পারত, সেই ঝড়ের প্রমত্ততাকে সে ধ্বংসের কাজে না লাগিয়ে যে ভেতরে ভেতরে কিছু গড়বার কাছে লাগাতে পেরেছে এই কথাটা ভেবেই এক গভীর অব্যক্ত আনন্দ বোধ করতে লাগল। সেই আনন্দ, পুরোপুরিই ওর একার। তার ভাগ, ইচ্ছে করলেও; আর কাউকেই দেওয়া যাবে না।

খাওয়া দাওয়ার পর ওদের ডেকে প্রত্যেককে পাঁচশ করে টাকা দিল পৃথু। বলল, কাল খুব ভোরে আমি চলে যাব। মেমসাহেবের বাড়ির এই চাবি আর এই চিঠি মেরী আর দুখী ভুচুবাবুর কাছে নিয়ে যাবে। ভুচুবাবুর লোক আসবে সকাল সাতটাতে। অত ভোরে তোমাদের কারওরই ওঠবার দরকার নেই আমার জন্যে। দুখী বসবার ঘরে শুয়ে থাকুক। আমি এলে দরজাটা খুলে দিস বাবা একটু। আবার যাওয়ার সময়। তোরা অনেক করেছিস আমার জন্যে। মেমসাহেব যদি তোমাদের রাখেন তাহলে রাখবেন। যদি চাকরি চলে যায়, তবে এই টাকা দিয়ে দু একমাস চালিয়ে নিয়ে অন্য চাকরি দেখে নিস। লছ্‌মার সিং কাল অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করবে। তোমাকে অন্য কোনও সাহেবের কাছে অথবা গেস্ট-হাউসে ডিউটিতে দেবেন হয়তো ফোতেদার সাহাব।

মেরী বলল, আমি মেমসাহেবের কাছে কাজ করব না স্যার। দুখীও বলল, আমিও না।

ওরা ভেবেছিল, এই কথায় খুশি হবে পৃথু। কিন্তু পৃথু বলল, তোমরা তোমাদের মেমসাহেবকে চিনতে পারোনি। মেমসাহেব আমার চেয়ে অনেকই ভাল।

যে-কথাটা ওদের বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বলে লাভ নেই বলে বলল না; তা হচ্ছে রুষা আগামীদিনের মেয়ে। আর পৃথু বর্তমানের। যা বর্তমান, তা অতীত হয়ে যায় তাড়াতাড়ি আর ভবিষ্যৎকে ছুঁতেও অনেক সময় লাগে বর্তমানের। ওরা এসব বুঝবে না।

পৃথু বলল, দুখীকে, একটা রিকশা ডেকে আনতে পারবি দুখী আমার জন্যে? লালটুঙ্‌-এর মোড়ে পাবি না গেলে?

পাব। কিন্তু জিগগেস করবে কোথায় যাবেন।

বলবি, রাণ্ডীমহল্লায় যাব।

মেরী মুখ নামিয়ে নিল। লজ্জায় ওর মুখ বেগ্‌নে হয়ে উঠল। দুখী থতমত খেয়ে চলে গেল রিকশা আনতে।

মেরী একটু ইতস্তত করে চলে গেল ঘর ছেড়ে। কিছু বলতে বা শুধাতে চাইছিল ও।

পৃথু বলতে পারত যে, বিজ্‌লীর কাছে যাবে। বিজ্‌লীর ঘরেই সে মগনলালকে মেরেছিল। সেই ঘরেই তার পায়ে গুলি লেগেছিল। বিজ্‌লীকে হাটচান্দ্রা ছেড়ে চলে যাবার আগে একবার ধন্যবাদ তো দিয়ে যেতে হয়!

কিন্তু মুখে বলল না কিছুই। কী লাভ? কতজনের কাছে জবাবদিহি করবে? তাছাড়া, করবেই বা কেন? নিজের কাছে জবাবদিহি যদি করা যায় তাহলে আর অন্যের কাছে তা করার দায় থাকে না।

রিক্‌শাতে যখন উঠে বসল পৃথু, তখন রাত সাড়ে নটা।

দুখী বলল, কখন ফিরবেন সাহেব?

জানি না। তোরা সকলে খেয়ে দেয়ে নে। বাইরের আলোটা জ্বেলে রাখিস দুখী আর এখানেই শুয়ে থাকিস পাখা চালিয়ে। আর, কাল কোম্পানীর ড্রাইভার এসে গাড়িটা নিয়ে যাবে। চাবি চাইলে, দিয়ে দিস।

অজাইব সিং?

অজাইব সিংকে আজ দেখতে গেছিলাম রে দুখী। পারলে, তোরাও সকলে যাস একদিন। বাহাদুর ড্রাইভার বাড়ি চেনে। অজাইব সিং আর বাঁচবে না বেশিদিন।

মরে যাবে?

আতঙ্কিত গলায় শুধোল দুখী।

হ্যাঁ। পৃথু বলল।

—ছেলেটার বয়স বড়জোর তেরো-চোদ্দ হবে। চাইল্ড-লেবার। এই বয়সে জীবন সম্বন্ধে বড় বেশি মায়া-মমতা থাকে। তাই-ই, ওর কাছে মৃত্যু বড়ই ভয়ের।

ইমরান নীচের ঘরেই ছিল। বিজ্‌লীর ঘরে গান শুনছিলেন মালাঞ্জখণ্ড-এর এক বাবু। রাত কাটাবেন অন্য কারও ঘরে। গান শুনেই চলে যাবেন।

ইমরান আদর করে বসাল ওর ঘরে এবং দৌড়ে উপরে গিয়ে খবর দিল। তাড়াতে তো আর পারে না। বাবু লক্ষ্মী!

বলল, স্রিফ পন্‌রা মিনট্‌।

সেই বাচ্চা ছেলেটাকে দেখল না পৃথু। কী যেন নাম ছিল ওর ভুলেই গেছে। কোথায় গেল সে?

ইমরান্‌, পান দিয়ে জর্দার ডিবে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ওহ্‌। উও ছোকরা। উ তো মর গ্যয়ে।

মর গ্যয়ে? কেইসে?

চীচক্‌সে। ইস মহল্লেকে বহত্‌ই আদমীনে গুজর গ্যয়ে বাবু। ডাকু মগনলালকা যো ভাই থে না, উও ভিস্তিওয়ালে। উ ভির মর চুকে।

বল কী! কবে?

দশ পনরা দিন হোগা।

তা তোমরা টিকে-টিকে নিয়েছ তো? শহরে তো এরকম শুনিনি। কী করছ তোমরা?

পান খেতে খেতে ইমরান বলল, করব আর কী? সন্ধের আগে আগে নিমপাতা পুড়িয়ে ধুঁয়ো দি ঘরে ঘরে। আর মশারি টাঙিয়ে শুই। কিন্তু তাতে কী? ঈ দেখিয়ে, বলেই চটাস করে একটা বড় মশা মারল নিজের বাঁ হাত দিয়ে বাঁ গালে।

চীচ্‌ক হলে চিকিৎসা কে করে?

কাহে? হাকিমসাহাব। হাকিম, বড়া জবরদস্ত্‌। মগর ইস সাল, ঈ শালে চীচক ঔরভি জবরদস্ত্‌ নিক্‌লা।

পৃথু রীতিমত উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তোমাদের এই কাঁচা নর্দমা-টর্দমাতে মিউনিসিপ্যালিটি ওষুধ-টষুধও ত দিতে পারে?

ইম্‌রান বলল, শালে লোগোঁনে সব হিঁয়া আতা’ মগর… মচ্ছর মারনে থোরী আতা। রাণ্ডী মহল্লেকে আদমী ঔর আওরাতকা জানকা কোঈ কিম্মত নেহি সাব। কিস্মত স্রিফ গল্লে ঔর উও চিজ্‌কি? কিস্‌কা আয়া-গ্যয়া?

তারপরই মিউনিস্যাপেলিটি ওষুধ চেয়ারম্যানের এবং কমিটি মেম্বারদের সম্বন্ধে এমন এমন সব কথা বলল তিরিশ সেকেণ্ডের মধ্যে ইমরান্‌, তাতে পৃথুর মনে হল যে, শুধু মুখের কথাতেই যদি বংশবৃদ্ধি হত তবে এতক্ষণে এই মহল্লায় হাজারখানেক মানুষের বাচ্চা মশারই মতো কিলবিল করত।

একটু পরই, সিঁড়ি বেয়ে মালাঞ্জখণ্ড-এর বাবুর নেমে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। বিজ্‌লী নিজেই তরতর করে নেমে এল। ওর পায়ের রূপোর পায়জারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল ঝুনঝুন করে। হালকা নীল-রঙা রেশমি শালোয়ার-কামিজ পরেছে ও। পৃথুকে দেখেই, আদাব করে বলল, ক্যা খুশ্‌নসীবী ঈ বান্দীকি!

বলেই, পৃথুর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ওপরে।

টানলেই তো আর তাড়াতাড়ি যেতে পারে না পৃথু। সিঁড়িটার মাঝের ল্যান্ডিং-এ মুখ থুবড়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল ও। বিজ্‌লী সময়মত জড়িয়ে না ধরলে, পড়েই যেত।

পৃথুকে সোজা ওর শোবার ঘরে নিয়ে গেল বিজ্‌লী। খাটে নিয়ে, পিঠে বালিশ দিয়ে, আরাম করে বসিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চোখে, চিবুকে, গলায় পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল শব্দ করে।

পৃথু হাসতে লাগল। বলল, ছোড়ো, ছোড়ো, গুদগুদি লাগ রহা হ্যায়।

সত্যিই কাতুকুতু লাগছিল ওর ভীষণই।

হাঁটু গেড়ে ওর দেড়খানা পায়ের মধ্যে, মাটিতে বসে পৃথুর কোলে মুখ রেখে অনেকক্ষণ ধরে নাক ডুবিয়ে চুমু খেল ও উম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌, শব্দ করে।

পৃথুর শরীরের ঘরে ঘরে আলো জ্বলতে শুরু করল। কিন্তু বিজ্‌লীকে আলগা করে সরিয়ে দিয়ে পৃথু বলল, ওঠো, ওঠো, উঠে পাশে বসো। কথা আছে তোমার সঙ্গে।

না। কোনও কথা নেই।

বিজ্‌লীর নাকের নিঃশ্বাস উষ্ণ হয়ে উঠল। দু চোখের তারা স্পন্দিত হতে লাগল। উত্তেজনায় রাজঘুঘুর মতো পেলব কোমল বুক দুটি দ্রুত ওঠানামা করতে লাগল। নরম সবুজ ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাট্‌কিলে রঙা খরগোশের গন্ধ পেয়ে তার দিকে শিকারির ল্যাব্রাডর গান্‌-ডগ যেমন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে যায় তেমনই করে পৃথুর কাম ঝিলিক তুলে বিজ্‌লীর সুগন্ধি, আমন্ত্রণ-জানানো শরীরের দিকে ছুটে যাচ্ছিল।

পৃথু তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে ডাকল তাকে। ফিরে আসতে বলল তার নিজের ভেতরে। কুকুরটা অত্যন্ত অনিচ্ছায় ফিরে এসে পৃথুর পায়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আশাভঙ্গতার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগল।

বিজ্‌লী আজ নয়। তোমাকে একটু দেখতেই এলাম আজ। পরে আসব তোমার কাছে। সময় নিয়ে। রাতভর থাকব। হয়তো জীবনভর। তবে, এখন আজকে সে সব ভাবারও সময় নেই।

কেন?

এমনিই! কালই তো এলাম মোটে। এখনও যে ভাল করে হাঁটতে পারি না। তুমিও পালাচ্ছ না। আসব আমি। দেখো।

তারপরই অবাক হয়ে বলল, ও কি? তোমার পালঙ্কর বাজুতে যে মগনলালের গুলির দাগ লেগেছিল, তা মেরামত করাওনি এখনও?

মেরামত? কেন করাব? ওই দাগ যে আমার কাছে বহতই ইজ্জতের নিশানী সাহাব। ওই দাগ যে, আমার বুকের ভেতরেও আছে।

হাসল পৃথু। ও ভাবছিল, কোথায় যেন পড়েছিল; বেনারসের বাঈজীকে নিয়ে লেখা কোনও উপন্যাসে, খুব সম্ভব, এই রকমই কিছু কথা। শরৎবাবুর লেখা নয়, আধুনিক কোনও ঔপন্যাসিকেরই। তবে, সেই উপন্যাসের ভাষাটা স্বেচ্ছাকৃতভাবে সেকেলে করেছিলেন লেখক। “সংসারে বোধ হয় এইরূপই ঘটে! যাহার নিকট হইতে যাহা বড় তীব্র বেদনার সহিত কামনা করা যায়, সে জন তাহা কখনও দিতে রাজি থাকে না। আর যে অন্যজনে তাহা বড়ই আনন্দমিশ্রিত বেদনার সহিত দিতে স্বীকৃত হয় তাহাও সেই অন্যজনের নিকট হইতে গ্রহণ করিবার কোনই উপায় থাকে না।…”

কী ভাবছেন সাহাব?

তোমাকে একটা কথা জিগ্‌গেস করতে এসেছি বিজ্‌লী।

মোটে একটা? ভেবেছিলাম, অনেক কথা জিগগেস করবেন।

ঠাট্টা নয়। মন দিয়ে শোনো যা বলছি।

বলুন।

তুমি কি কখনও বিয়ের কথা ভেবেছ বিজ্‌লী?

বিয়ে?

বলেই মুখে ওড়না চাপা দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল ও। পর মুহূর্তেই অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেল।

কী হল?

পৃথিবীতে এমন কি একজনও মেয়ে আছে যে কখনও না কখনও তার পুতুলখেলার দিন থেকে বিয়ের কথা ভাবে না? মগর আপভি মজাক উড়াহ রহা হ্যায় সাহাব?

মজাক নেহি। বিলকুলই নেহি। জারা শোচ্‌-সম্‌ঝকে বাঁতেঁ করো। ইয়ে মজাক্‌কি বাঁতে নেহি।

শাদী? কিস্‌সে? আপ্‌সে?

বিজ্‌লীর দু’চোখ রাগে ঝলমল করে উঠল।

নেহী। হাম তো শাদী-শুদা আদমী। দো বাচ্চোকো বাপ্‌। এক পায়ের ভি খো চুকা। হাম নেহী। মগর, পহিলে জবাব তো দো, মেরী সওয়ালকে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিজ্‌লী বলল, কওন শাদী করেগা হাম্‌সে?

পৃথু চুপ করে রইল।

এত গভীরভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখেনিও। সত্যিই তো! বিয়ের পর ছেলেমেয়ে নিয়ে যখন সুখের সংসার পেতেছে দুজনে তখন কোনও পার্টিতে, কোনও চার্চ-এ, কোনও মজ্‌লিসে হঠাৎ কোনও পুরনো বাবু যদি বলে বসে, আর রে! বিজ্‌লী বাঈজী না? মেয়ের বিয়ে হবে না? যা কিছু গড়ে তুলবে ওরা, সবই ভেঙে পড়বে হুড়মুড় করে এক লহমায়।

বিজ্‌লী বলল, এই দুনিয়া বড়ই খারাপ জায়গা সাহাব। গিধ্বড়-এর মতো এ। কোথাও কাউকে একটু সুখী দেখলে সে ছোঁ মেরে সেই সুখকে ধারালো ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে ভাগাড়ে নিয়ে গিয়ে দু পায়ে চেপে ধরে টুকরো করে খায়। এ দুনিয়ার আপনি কতটুকু জানেন? আর জানতেনই যদি তো আপনার আজ এই দশা হবে কেন?

চমকে উঠল পৃথু।

নিজের পায়ের দিকে চেয়ে বলল, এই দশার কথা বলছ?

না। এ তো কিছুই নয়। আপনার কথা হাটচান্দ্রার কাক-শালিকও জানে। ইমরান-এর কাছে সব শুনেছি আমি।

পৃথু লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল।

লজ্জা তো আপনার নয় সাহাব! লজ্জা তো আপনার বিবির। শরীরের মধ্যে কী বা কতখানি সুখ লুকোনো আছে তা তো তিনি আমার চেয়ে আর বেশি জানেন না? ছিঃ ছিঃ এই সস্তা শরীরের সুখের জন্যে তিনি আপনার মতো মানুষকে…

পৃথুর কান লাল হয়ে গরম হয়ে উঠল।

বলল, আমার মতো মানুষ মানে কী? আমি কী এমন অসাধারণ মানুষ? তুমি আমার বিবি বাচ্চাদের সম্বন্ধে সব জানো না। তারা খুব ভাল। আমিই তাদের যোগ্য নই।

আপনি যা খুশি বলে নিজেকে বুঝ দিন তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

বিজ্‌লী, বিজ্‌লী! বিজ্‌লী তুমি চুপ করো। তুমি সব বোঝে না। আমি আমার স্ত্রীকে ভালবাসি বিজ্‌লী!

বিজ্‌লী দু’ চোখ তুলে পৃথুর চোখে তাকাল। তারপর ওর দুটি হাত তুলে নিয়ে নিজের কোলে রাখল। মুখ নিচু করে বলল, অজীব আদমী হ্যায় সাহাব আপ্‌। খ্যয়ের…। পরের জন্মেও তো রাণ্ডী হব না। খুদাহ্‌র কাছে আর্জি করব পরের জন্মে, যেন আপনার মতো স্বামী পাই।

ছিটকে উঠল যেন পৃথু।

বলল, আমার মতো স্বামী? পাগল হয়ে যাবে তুমি। নয়তো খুন করবে এমন স্বামীকে। আমি একটা বাজে লোক। একটা যাচ্ছেতাই; থার্ডক্লাস…

দুটি হাতের পাতা তুলে নিজের মুখ ঢাকল পৃথু।

বিজ্‌লী পৃথুকে তার দু হাত দিয়ে জড়িয়ে পৃথুর মাথাটি তার বুকের মাঝে নামিয়ে আনল।

চোখ বুঁজে ফেলল পৃথু।

অনেকক্ষণ পরে চোখ যখন খুলল তখন দেখল বিজ্‌লীর দু চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছে। দু হাতে তার মাথার চুল-দাড়ি সব এলোমেলো করে দিতে দিতে বিড়বিড় করে কী সব বলছিল বিজ্‌লী। অস্ফুটে। কিছুই বুঝতে পারল না পৃথু।

পৃথু বলল, আমি এবার যাব।

যাবেন বইকি! যখনই আপনার খুশি। আপনাকে আটকাব না আমি। থাকতে বলব না। বলতাম, বলেছিলাম; যখন জানতাম যে আপনার সব কিছু আছে। যার ঘরে সুন্দরী স্ত্রী আছে, সুন্দর ছেলেমেয়ে আছে; তাকে বশ করার মধ্যে এক গভীর আনন্দ দেখি আমি। চিরদিনই! আজকে সাহাব, আপনি আমারই মতো দুঃখী হয়ে গেছেন। যে দুঃখে দুঃখী ছিলাম বলে আপনাকে বরাবরের মতো পেতে লোভ হত বড়, সেই দুঃখে আজ আপনিও দুঃখী। আজ আমি যদি আপনাকে পাই তবে আপনার বিবির কাছে মস্ত হার হবে আপনারই। আপনার বিবি বলবেন, আপনি আমার মতো এক রাণ্ডীরই যোগ্য।

পৃথু মুখ তুলে কিছু বলতে গেল বিজ্‌লীকে।

বিজ্‌লী কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আমি আপনারই ছিলাম। আপনারই থাকব। যখন খুশি আসবেন। যা চাইবেন, সবই আপনার। গান শুনবেন। আমাকে বুকের মধ্যে করে শুয়ে থাকবেন, যা-খুশি করবেন আমাকে নিয়ে। যেখানে খুশি ডেকে পাঠাবেন আমাকে, আমি সব কাজ ফেলে দৌড়ে যাব। শুধু, কখনও আমার চিরদিনের হতে চাইবেন না। আমিও চাইব না। কথা দিলাম। আমি যে, আমি যে আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি সাহাব। আপনাকে কি আমি ছোট করতে পারি?

বিজ্‌লী! আমি কাল অন্ধকার থাকতেই হাটচান্দ্রা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

হতবাক হয়ে গেল বিজ্‌লী।

বলল, কোথায়?

সীওনীতে।

সীওনী? সে যে শুনেছি, অনেকই দূর এখান থেকে। আপনাকে একটু চোখের দেখাও কি দেখতে পাব না আর?

আর কাউকেই বলিনি, কোথায় যাচ্ছি।

তুমি চিঠি লিখো। আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলে, তুমি যেখানে বলবে সেখানেই যাব। তোমাকে আদর করতে ইচ্ছে করলে, আমিও লিখব। কিন্তু এই হাটচান্দ্রাতে আর ফিরব না। আমার জীবনের আধখানা আর একটি পা এখানেই ফেলে গেলাম বিজ্‌লী।

কী যেন ভাবছিল বিজ্‌লী।

এমন সময় দরজায় কেউ টোকা দিল।

বিজ্‌লী বলল, কেউ গাইতে বা বাজাতে এসেছে। আর কী হবে? কত কীই স্বপ্ন দেখেছিলাম, খোয়াব দেখেছিলাম আপনাকে চিরদিনের মতো কাছে পাব। আর হয় না তা। আজকে আপনি বরং উঠে পড়ন সাহাব। কাল ভোরে বেরুবেন তো। যাবেন কিসে?

বাসে।

বাসে? ইসস এই ক্রাচ নিয়ে। আমাদের তো বাসেই চলাফেরা অভ্যেস। আপনার তো অভ্যেস নেই না। যান। ঘুমিয়ে নেবেন একটু।

আমারও অভ্যেস হয়ে যাবে। চাকরি তো আর নেই। অভ্যেস করতেই হবে।

জানি।

তাও জানো?

সব জানি।

তবু, আমাকে তাড়িয়ে দিলে না প্রথমেই?

হাসল বিজ্‌লী। বলল, ইচ্ছে করল না; তাই-ই।

পাঞ্জাবীর পকেট থেকে খামটা বের করল। বলল, এক হাজার টাকা আছে। রাখো।

কিসের টাকা?

বিরক্ত হয়ে বলল, বিজ্‌লী।

আমি যখন ডাকব তোমাকে, তখন ট্যাক্সি করে যেও। আমার জন্যে তুমি কষ্ট করো, তা আমি চাই না।

কী ভাবল একটু বিজ্‌লী। তারপর বলল, আগের আপনি হলে এ টাকা ছুঁড়ে মারতাম আপনার মুখে। আজকে, সাহাব এই টাকার অনেকই দাম আমার কাছে। এ টাকা কখনও খরচ না করে তুলে রাখব আলমারিতে রেশমি রুমাল জড়িয়ে। আমার নোংরা রোজগারের টাকার সঙ্গে মেশাব না কখনও। যাব। ডেকেই দেখবেন। আর একটা কথা। এই জীবনে, আর কিন্তু কখনও টাকা দেবেন না আমাকে। ভাল হবে না তাহলে।

চললাম তাহলে বিজ্‌লী।

বিজ্‌লী এতক্ষণ খুব কঠিন কঠোর ভাব দেখাচ্ছিল। পৃথু “চললাম” বলতেই, হঠাৎই গলে গেল যেন। ভেঙে পড়ল। নিচু ধরা গলায় বলল, চললাম, বলে না। চলুন পৌঁছে দিয়ে আসি আপনাকে নিচ অবধি।

কেউ এসেছে তোমার জন্যে। কোনও বাবু।

বাবুরা তো আসবে যাবেই। জীবনভর। আমার সাহাব তো রোজ রোজ আসবেন না।

যতক্ষণ না সাইকেল রিকশাটা মহল্লার গলির মোড়ে না পৌঁছল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল বিজ্‌লী। হাত তুলল, রিকশাটা মোড়ের মুখে হারিয়ে যাবার মুহূর্তে।

পৃথুও হাত তুলল।

রিকশাতে, লম্বা-চওড়া মানুষটার ক্রাচ নিয়ে বসতে কষ্টই হয়। বেঁকে বসতে হয়।

তবুও বেশ লাগছে এখন। হিম হিম ভাব রয়েছে এখনও রাতে। ভোর অবধি থাকবেও। ঝিরঝির করে হাওয়া দিয়েছে একটা। এখানে মহুয়া আর করৌঞ্জের গন্ধ নেই। পৃথুদের বাড়ির দিকটা অনেক ফাঁকা। ওদিকে পাওয়া যায়। কিন্তু মহল্লার নূপুর, সারেঙ্গী আর গানের সঙ্গে ভেসে-আসা তবলার মিশ্র আওয়াজ এই গভীর রাতে বহুদূর থেকে শোনা যাচ্ছে। বাতাসে আরও ভেসে আসছে ঈত্বর আর ফুলের গন্ধ।

ক্যাঁচার-কোঁচোর করে চলেছে রিকশাটা। ক্যাঁচার-কোঁচর, কোঁচোর-ক্যাঁচার।

যারা চিরদিন গাড়িতে চড়ে অভ্যস্ত তাদের রিকশায় চড়তে বেশ মজাই লাগে। হঠাৎই যেন সময়ের দাম কমে যায়। দূরত্ব বেড়ে যায় পথের। গাড়িতে বসলে যে হাওয়াটা এসে অসভ্যর মতো থাপ্পড় মারে, চুল এলোমেলো করে দেয়; রিক্‌শায় বসে সেই হাওয়াটাকেই তাল বা বাঁশের চাটাই-এর হাত-পাখার হাওয়ার মতো মিষ্টি লাগে।

অনেকই পরিবর্তন!

আরও অনেক পরিবর্তন অপেক্ষা করে আছে পৃথুর জন্যে সীওনীতে। উঁচু উঁচু পাহাড়ঘেরা প্রায় দেড় হাজার ফিট উঁচু হবে জায়গাটা। গরম গ্রীষ্মর প্রখর দিনেও বিশেষ থাকবে না। কিন্তু এই হাটচান্দ্রাই ছিল ভাল। চারধারে অনেকই সমান জায়গা থাকাতে পৃথুর পক্ষে হেঁটে চলে বেড়াবার সুবিধে ছিল অনেক। অনেক অনভ্যাসকেই অভ্যেস করতে হবে এখানে।

মাইকাল পাহাড়শ্রেণী হাত ধরাধরি করে এসে বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতশ্রেণীকে ছুঁয়ে রয়েছে দুপাশ থেকে। আর এই বেষ্টনীর বুকের মধ্যেই আদরিণী মেয়ের মতো পালিত হয়েছে যুগযুগান্ত ধরে দুটি সুন্দরী নদী। কালো হাঁলো আর ফর্সা বানজারের উপত্যকা ঘুমিয়ে রয়েছে এদেরই পাহারায়; ঘন, গভীর, প্রায় নিচ্ছিদ্র অরণ্যে ঘেরা। এরই একটি পাশে সীওনী। মধ্যপ্রদেশের ট্যুওরিস্ট ম্যাপে এই জায়গা কেউ খুঁজে পাবে না। তবে কেউ যেতে চাইলে অবশ্যই খুঁজে নিতে পারবেন। ছবির মতো জায়গা। সীওনী, রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর মোওগলির জায়গা বলে এবং বাবার সঙ্গে ছেলেবেলায় এখানে বহুবার আসাতে এই ছোট্ট জায়গাটি সম্বন্ধে চিরদিনই পৃথুর একটু বিশেষ দুর্বলতা ছিল। এখন তো কপালের লিখনেই যেতে হচ্ছে সেখানে বলতে গেলে। কে জানে, তার লিখন, ধূলায় ধূলি হবে কি না?

ঠুঠা বাইগাটাও যাওয়ার আগে এসে পৌঁছলে ভাল হত। কেমন আছে সে কে জানে? অবশ্য মুক্কি হয়ে বাইহার হয়েই বালাঘাটের দিকে যেতে হবে। পথে দেবী সিং-এর খোঁজ করে নেবে সান্‌জানা সাহেবের বাড়িতে একবার। মুক্কি ট্যুওরিস্ট লজ পেরিয়ে কিছুটা গেলেই বাঁ দিকে পড়ে সানজানা সাহেবের বাড়ি। মুক্কিতে তো বাস দাঁড়াবেই।

রিকশা এবার এসে বড় রাস্তায় পড়ল, জলের ট্যাঙ্কির পাশ দিয়ে। এখনও বহু পথ। গাড়িতে চলেফিরে সত্যিই পথের দূরত্ব সম্বন্ধে ধারণাটাই নষ্ট হয়ে গেছে, বুঝতে পারল। বাড়ি এখনও অনেকই দূর!

আর বাড়ি।

আনন্দ বাগচীর বড় ভাল কবিতা পড়েছিল কিছুদিন আগে। কবিতাটি মনে এল। কিন্তু ভাল গানেরই মতো, কবিতাও যদি স্থান ও সময় বিশেষে মনেই না আসে, তাহলে তা পড়া বা জানা অবান্তর। এই বাবদে, ওর বাজে স্মৃতিশক্তির কাছে পৃথু অশেষই কৃতজ্ঞ। নইলে, এমন এমন সময়েও কবিতা আসত কি মনে?

রিকশা চলছে এক লয়ে এক তালে। সামনে ঝুঁকে পড়েছে তার মাথা। মানুষকে পিঠে করে মানুষ চলেছে। দুজনেই পঙ্গু আসলে। একজনের একটা পা কাটা গেছে আর ও বেচারার থেকেও নেই। বাঁধা পড়ে আছে সাইকেলের চেনের সঙ্গে।

“শেষ ইস্টিশনে নেমে কি থাকে তোমার হাতে? কিছুই থাকে না,/ডাইনে বাঁয়ে, সীমাহীন রেললাইন চলে গেছে/অনেক উঁচুতে শুধু ভুতুড়ে সিগন্যাল দেখে লাল নীল চোখ/বুকের কিনার ঘেঁষে বেহালার ছড়ের মতন/ছুঁয়ে গেছে অদৃশ্য হুইসেল—/ঘুমের ভেতরে পাশ ফিরতে ফিরতে সমস্ত পল্লীর/গেরস্থালি বয়লারের শব্দ শোনে ধস ধস/মশারির বাইরে জাগে স্থির শব্দে মশা শেষ ইস্টিশনে নেমে মধ্যরাতে পরস্পর অচেনা মানুষ/যে যার পায়ের শব্দ কাছে টেনে ছায়ার ভেতরে/মুছে যায়—।

পকেটে ডোবাও হাতে কিছু নেই, মুঠো খোলো কিছু নেই/এইমাত্র চেকারের হাতে/তোমার মুদ্রিত পুঁজি রেখে এলে, শেষ তাস, খেলার টিকিট!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *