2 of 2

৫৭. পরিদর্শকের কার্যালয়

পরিদর্শকের কার্যালয়ের জন্য চিৎপুরে একটি বাড়ি ক্রয় করেছে নবীনকুমার। নতুনভাবে সব কিছু সজিত করা হচ্ছে। সম্পাদকের কক্ষটি দ্বিতলে।

অগ্রহায়ণ মাসের এক দ্বিপ্রহরে নবীনকুমারের জুড়ি গাড়ি সেই গৃহের সামনে থামলো। আজ থেকে সে এই দৈনিক পত্রিকাটির পরিচালনা ও সম্পাদনার ভার গ্রহণ করবে। জগন্মোহন তর্কালঙ্কার ও মদনমোহন গোস্বামী নামে দুই ব্ৰাহ্মণ নবীনকুমারকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সসম্ভ্রমে নিয়ে এলো দ্বিতলে এই দুই ব্ৰাহ্মণই পত্রিকাটি শুরু করেছিল, ক্ষুদ্র আকারের এক পাতার কাগজ, তাও চালাতে পারেনি, নবীনকুমার ওদের কাছ থেকে পরিদর্শকের সর্বস্বত্ব গ্রহণ করেছে। হরিশের মৃত্যুর পর সাপ্তাহিক হিন্দু পেট্রিয়টের সে-ই মালিক। দূরবীন নামে একটি উর্দু পত্রিকাও চলে তার অথানুকূল্যে। এবার সে অধিগ্ৰহণ করলো। এই দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র।

সম্পাদকের কেদারায় আসীন হয়ে নবীনকুমার অন্যদের বললো, অনুগ্রহ করে আপনারাও বসুন! প্ৰথমেই আমি প্রয়োজনীয় কটা কতা বলে নিতে চাই।

প্রাক্তন দুই সম্পাদক ছাড়াও আর আটজন মুদ্রাকর এই কাগজের কমী। এ ছাড়াও নানাভাবে সংশ্লিষ্ট সাত-আট জন ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত। কয়েক জন আসন গ্রহণ করলো, কয়েক জন রইলো দণ্ডায়মান।

বাইশ বৎসর বয়স্ক সম্পাদক গম্ভীর কণ্ঠে বললো, প্ৰথমেই জানাই, তর্কালঙ্কার মশাই ও গোস্বামী মশাই সমেত এই পত্রিকার যাঁরা যাঁরা কর্মী ছিলেন, সকলেই ভবিষ্যতে এ কাগজে বহাল থাকবেন।

সকলে একসঙ্গে সাধু! সাধু! বলে উঠলো। ছলছল করে উঠলো তর্কালঙ্কার ও গোস্বামীর চক্ষু। তারা এতটা আশাই করেনি।

নবীনকুমার বললো, আপনারা আরও যোগ্য লোক খুঁজুন, আমার আরও কর্মী লাগবে। একপাতা নয়, এই পত্রিকা হবে চার পৃষ্ঠা।

এবার সকলে আরও বিস্মিত। চার পৃষ্ঠার বাংলা কাগজ? প্রতিদিন? এমন কথা কেউ কখনো শুনেছে!

অন্যদের মুখে বিস্ময়-লেখা পাঠ করেই নবীনকুমার আবার বললো, হ্যাঁ, প্রতিদিন চার পৃষ্ঠা। এ কাগচ হবে ইংরেজি পত্রিকাগুলির সমতুল্য। আপনারা সকলেই জানেন, এতকাল যে সব বাংলা সংবাদপত্র বেরিয়েচে, তা ইংরেজি কাগচগুলির উচ্ছিষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। ইংরেজি কাগচের বস্তাপচা পুরোনো খবর বাংলা কাগচে বেরোয়। আমি নাম কত্তে চাই না, এমন বাংলা কাগচ আচে যার সংবাদ অংশ ইংরেজি কাগচের চোথো অনুবাদ, কী তাই না?

অন্যরা আর কী বলবে! এ তো জানা কথাই। বাংলা কাগজের নিজস্ব সংবাদ সংগ্রহের সুযোগ কোথায়?

আমরা পরিদর্শকের জন্য নিজস্ব রিপোটার নিয়োগ কবে। তার হাইকেটে যাবে। মফস্বলে যাবে, হাটে-বাজারে ঘুরবে, গবরমেন্টের হাই হাই ব্যক্তিদের সঙ্গে কতা বলবে, তারপর নিরপেক্ষ সংবাদ দেবে। দেখুন, অনেক সংবাদ আচে, যা সাহেবদের কাজে লাগে। কিন্তু আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। তবু বাংলা কাগচে ইংরেজির অনুকরণ করে সেগুলি ছাপে। যেমন ধরুন, অমুক জাহাজ অমুক স্থল থেকে এসেচে। অমুক জাহাজ অমুক দিনেতে কলকাতা ছেড়ে ইংলণ্ডে যাবে। এই সংবাদ পাঠে বাঙালীর কী উপকার? আমাদের আচার-ব্যবহার সমুদয়ই ইংরেজ জাতি হতে ভিন্ন। সুতরাং বাঙলা কাগচে বাঙ্গালার নিজস্ব খবর, যাতে দেশের কল্যাণ হয়, মানুষের চেতনা জাগ্রত হয়, এমন বিষয় পরিবেষণা কত্তে হবে। তা ছাড়া আপনাদের সকলকে এক শপথ নিতে হবে, আপনারা রাজি?

সকলের মুখপাত্র হয়ে মদনমোহন গোস্বামী বললেন, সিংহামশাই, আপনার বাক্যগুলি শুনে আমাদের মনে এক নতুন ভাবের উদ্রেক হতেছে। এ সব যে বড়ই সত্য কথা। তত্ৰাচ তাহা আমরা এতদিন উপলব্ধি করি নাই।

নবীনকুমার বললো, মেডিক্যাল কলেজ থেকে ছাত্ররা পাশ করে যখন ডাক্তার হয়, তখন মানবসেবার জন্য তাদের শপথ নিতে হয়। সংবাদপত্রেও মানুষের মনের চিকিৎসা হওয়া কর্তব্য। সে কারণে আসুন আমরা শপথ গ্রহণ করি, জ্ঞানপূর্বক সত্য পথ থেকে বিচলিত হবে না। যাতে কোনো বিষয়ের অতি বর্ণন না হয় সে বিষয়ে সবিশেষ যত্নবান হবো-আর-পৃথিবীর কোনো মানুষই পক্ষপাতের হাত এড়াতে পারেন না। যদিও, তবু আমরা অঙ্গীকার কচ্চি যে, জ্ঞানত কোনো পক্ষপাত দোষে লিপ্ত হবো না। কেমন, এ শপথ ঠিক?

—অবশ্যই, অবশ্যই!

—আপনারা জানেন, আমি মহাভারত অনুবাদ-কার্যে ব্যস্ত আছি। অর্ধেকের বেশী হয়ে গ্যাচে, এ সময় সে কাজে টিল দেওয়া চলে না। সেজন্য এখানে আমি খুব বেশী সময় দিতে পারবো না। দায়িত্ব নিতে হবে আপনাদেরই। আমি সকাল আট ঘটিকা থেকে দুপুর দুই ঘটিকা পর্যন্ত মহাভারত কার্যালয়ে থাকব। সেখান থেকে আসতে আমার এক ঘণ্টা লাগবে। অর্থাৎ তিন ঘটিকা থেকে রাত্র আট-নয় ঘটিকা পর্যন্ত আমি আপনাদের সঙ্গে এখানে কাজ কর্বো!

-সে কি মহাশয়! আপনি আহার-বিশ্রামেরও সময় রাখবেন না?

—আমার এ শরীরের পক্ষে খুব বেশী আহার্যের প্রয়োজন হয় না, আর বিশ্রামের জন্যও আমার শয্যার প্রয়োজন হয় না। সেজন্য আপনাদের চিন্তা করবার দরকার নেই। বাংলার ঘরে ঘরে এই কাগচ পৌঁচে দেওয়া চাই। যাতে লোকে ইংরেজি দৈনিক ফেলে সাগ্রহে এই কাগচ পড়ে। আর একটা কতা! গোস্বামী মশাই, এ কাগচে লোকবার সময় আপনাদের ভট্টাচার্যি-বাংলা ছাড়তে হবে। সংস্কৃত আর নস্যির গন্ধওলা বাংলা আমার চাই না। সাধারণের বোধগম্য সহজ সরল ভাষাতেই সংবাদপত্র প্রচারিত হওয়া উচিত। তাতে ব্যাকরণ একটু ক্ষুণ্ণ হলে কিংবা ব্যোপদেব রাগ কল্লেন কিনা তা নিয়ে মাতা ঘামালে চলে না!

শুরু হয়ে গেল দৈনিক পরিদর্শক। চার পৃষ্ঠার কাগজ, দাম চার পয়সা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে সংবাদ পরিবেশন, ঝকঝকে ছাপা, সবই অভিনব। লোকে প্রাতরাশ গ্ৰহণ করবার আগেই যাতে এই কাগজ পেয়ে যায়, তেমন ব্যবস্থা করা হলো। শিক্ষিত ব্যক্তিরা সকলেই স্বীকার করলেন বাংলায় এমনটি আর কেউ দেখেনি।

বিদ্যাসাগর প্রথম দিন পরিদর্শক পেয়ে বিস্মিত হলেন। নবীনকুমার কী কাণ্ড শুরু করেছে! দৈনিক সংবাদপত্র বার করা কি সোজা কথা! ওদিকে মহাভারত অনুবাদের মতন অত বড় কাজ হাতে রয়েছে…হুজুগে যুবক, তবে কি মহাভারতের কাজ মুলতুবি রেখে এবার এটাতে মেতেছে?

একদিন তিনি চলে এলেন বরাহনগরে। সারস্বত-আশ্রমে মহাভারত অনুবাদের কাজ কিন্তু একটুও থেমে নেই। নবীনকুমার পণ্ডিতদের একদণ্ডও নিবৃত্তি দেয় না। পণ্ডিতরা মহাভারতের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি থেকে মিলিয়ে একটি একটি মূল নির্বাচন করে তার আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ করে রেখে দেয়। নবীনকুমার প্রত্যেক দিনের প্রথমার্ধ এখানে কাটিয়ে ভাষার পরিমার্জনা করে। তারপর সে চলে যায় পরিদর্শক কার্যালয়ে।

বিদ্যাসাগর ভাবলেন, তা হলে এই বাংলা সংবাদপত্র বেশীদিন বেরুবে না।

অথচ দিনের পর দিন ঠিক সময়ে পরিদর্শক প্ৰকাশিত হতে লাগলো।

এক সন্ধ্যাকালে পরিদর্শকের সম্পাদকের কক্ষে এসে প্রবেশ করলো সম্পাদকেরই সমবয়সী এক যুবক। নবীনকুমার সম্পাদকীয় লিখছিল অভিনিবিষ্টভাবে, যুবকটি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, কী হে, নবীনবাবু, একটু বসতে পারি?

নবীনকুমার মুখ তুলে, ঈষৎ বিস্মিত হয়ে বললো, এ কি কৃষ্ণকমল নয়? আরে, আরে, বসে বসো! অ্যাদিন বাদে হটাৎ কী মনে করে?

কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য নবীনকুমারের সহপাঠী ছিল হিন্দু কলেজে, কিছুদিন সে বিদ্যোৎসাহিনী সভাতেও যোগ দিয়েছিল উৎসাহের সঙ্গে। তারপর বেশ কিছুদিন তার দেখা নেই। কৃষ্ণকমল যেমন মেধাবী, তেমনই খেয়ালী।

কৃষ্ণকমল বললো, কেমন দেশোদ্ধার কত্তে মেতেচো, তাই দেখতে এলুম।

নবীনকুমার বললো, একটু বসো, কৃষ্ণকমল। আমি হাতের এই কাজটা সেরে নি আগে, তারপর তোমার সঙ্গে কতা কইবো।

সম্পাদকীয় লেখা শেষ করে, কপি বয়কে ডেকে তার হাত দিয়ে সেটি ছাপাখানায় পাঠিয়ে দিয়ে নবীনকুমার বললো, কৃষ্ণকমল, তুমি এসেচো বড় ভালো হয়েচে, তোমার মতন একজনকেই খুঁজচিলুম!

—ঘরে ইকো-গড়গড়া কিছুই রাখোনি?

—আমি তো ধূমপান করি না।

—তুমি না হয় নাই কল্লে, কিন্তু অতিথি আপ্যায়নের জন্য তো অন্তত রাকবে, সম্পাদকের ঘরে কত রকম মনুষ্য আসবে।

—এখুনি আনিয়ে দেবার ব্যবস্থা কচ্চি!

—থাক, থাক, আপাতত নাস্যিতেই কাজ চালাই। ভট্টাচার্যি বংশের ছেলে, সঙ্গে সব সময় নস্যির ডিবেটা রাকি।

—তা ভট্টাচার্যির বংশের সন্তান হয়েও তুমি তো পুরোপুরি নাস্তিক শুনিচি! আরও কী কী যেন কচ্চো, যা ঠিক ভট্টাচাৰ্য-সুলভ নয়?

—আরে, নাস্তিক হয় বামুনরাই। চাঁড়াল কখনো নাস্তিক হয় না। বামুন ব্যাটারা জানে যে অন্য জাতের লোকদের ভগবানের নাম করে খুব ভয় দেকাচ্ছি বটে, আসলে ভগবান-টগবান কিচু নেই। মন্দিরের পুজোরিরা দেকবে টপ করে ঠাকুরের প্রসাদ এঁটো করে খেয়ে নেয়।

-হ-হ-হ-হা।

—তোমরা কায়েতরা আর বেনেরা ধূমধাম করে মা-বাপের ছোরাদ যজ্ঞ করো, ব্ৰাহ্মণকে গোরু-বাছুর দান করো। কত না যেন পবিত্র পুণ্যের কাজ। আর সে বামুন বাছুরের গলায় দড়ি বেঁধে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে কশাইয়ের কাচে বিক্‌কিরি করে দেয়।

—হাঁ। ছেলেবেলায় এ রকম দেকিচিলুম বটে, তখন রাগ করে সেই বামুনের টিকি, কেটে নিইচিলুম। যাক সে কতা। তুমি এসে পড়েচো, তোমাকে আমার দরকার।

কৃষ্ণকমল দীঘঙ্গি, কৃশকায়, গাত্রবৰ্ণ মাজা মাজা, এই বয়েসেই একটু একটু টাক পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু গুম্ফটি বেশ পুরুষ্ট। পরনে ধুতি, বেনিয়ান ও চায়না কোট, পায়ে তালতলার চটি। ওষ্ঠে একটু যেন বিদ্রূপ হাস্য সব সময় লুকিয়ে থাকে।

এক টিপ নস্য নাকে ঠুসে দিয়ে সে বললো, আমার মতন লোককে তোমার কী দরকার পড়লো বলে তো?

—তুমি দুরাকাঙ্ক্ষে র বৃথা ভ্ৰমণ নামে একখানা বেশ সরেশ গ্ৰন্থ রচেঁচিলে, পড়ে বড় মজা পেয়েচিলুম। আর তো বাংলায় তেমন লিকলে না! তোমার মতন বিদ্বান, তীক্ষ্ণধী লোককে আমাদের চাই। তোমরা কলম ধরলে দেশের অনেক উপকার হবে। তুমি আমাদের কাগচের জন্য লেগে পড়ো।

—হুঁ, তোমার কাগচে দেশসেবার বিষয়ে অনেক বড় বড় কতা থাকে তো দেকচি। তা এ জন্য তোমার কত খর্চা হচ্ছে?

—খর্চার কত ভাবলে কি কোনো ভালো কাজ হয়?

—সাহেব ব্যবসায়ীরা তোমার কাগচে বিজ্ঞাপন দেয় না। অর্থাৎ রেভিনিউ নেই। সবটাই তোমার পার্স থেকে যাচ্চে, তাই না?

—কাগচ ঠিক মতন চললে ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন ঠিকই দেবে।

—বাংলা কাগচে? হেঃ!

—কৃষ্ণকমল, তুমি বিশ্বাস করো না বাঙালী ইংরেজের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে? ইংরেজিতে ভালো নুজি পেপার হয়। আর বাংলায় আমরা তেমন পারি না?

—ঈশ্বর গুপ্ত কিংবা গুড়গুড়ে ভট্টচার্যের মতন খিস্তি-খেউড় ছাড়ো, কাগচ চলবে। তোমার এই বড় বড় আইডিয়ালিজম-এর কথা কজন বুঝবে? দেশাত্মবোধ, হুঁ, কজন লোক জানে দেশ কাকে বলে?

—কৃষ্ণকমল, তুমি কি আমায় নিরাশ করে দেবার জন্যই আজ এখেনে এসোচো! তোমার এ সব বিনি। পয়সার উপদেশ আমি শুনতে চাই না। তুমি আমার কাগচে লিকবে কি না?

—পয়সা পেলে লিকতে পারি বটে।

—পয়সা পাবে। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপনা করচো শুনিচি, তোমার কি এমনই পয়সার অভাব যে লেকার আগেই পয়সার কথা মনে এলো?

—পয়সার চিস্তা। কার নেই! স্বয়ং লর্ড ক্যানিং পর্যন্ত বলেন যে সরকারি ফাণ্ডে টাকার অভাব। তোমাদের মতন দেশের উপকার করবার জন্য আমি মাতা ফাটাফাটি করতে রাজি নই। সমাজ পরিবর্তনের জন্য যাঁরা উজিয়ে বেড়াচ্চেন বেড়ান, আমি প্রফেশনাল মানুষ।

–বেশ ভালো কতা। প্রফেশনাল লেখক হিসেবেই তুমি আমাদের নতুন কী দিতে পারো? সাহেব-সুবোর গল্প কিংবা বিলেতি চালের বাংলা আমার চলবে না।

—তুমি দেশীয় বিষয় চাও। এ দেশের কোতায় কী কাণ্ড ঘটেচে তুমি কতটুকু জানো? তুমি এমন কোনো স্থায়নের কতা জানো, যেখেনে হাজার হাজার নারী-পুরুষ প্রকাশ্য স্থানে পাশাপাশি বসে খাওয়া-দাওয়া করে, নাচে গায়?

—হাজার হাজার নারী-পুরুষ?

—তার বেশী ছাড়া কম নয়। পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশী, এক পুরুষের পাশে তিন-চারজন যুবতী—

—এ সব কী গাঁজাখুরি চালাচ্চো, কৃষ্ণকমল? নারী-পুরুষ প্রকাশ্য স্থানে বসে আহারাদি করবে? এ কি তোমার সাধের ইংলণ্ড না। সুদূর আমেরিকা? হিন্দুস্তানে এমন সম্ভব নয়।

—হিন্দুস্তান বাদ দেও, কলকেতা থেকে মাত্র ষোল ক্রোশ উত্তরেই এমন হয়, আমি নিজের চক্ষে দেকে এসিচি। রেলযোগে কাঁচড়াপাড়া চলে যাও, তার কাচেই ঘোষপাড়া গ্ৰাম। সেখানে প্ৰতি দোল-পূর্ণিমায় আউলে সম্প্রদায়ের মেলা বসে। আউলে সম্প্রদায়ের নাম শুনেচে? শোনোনি? অথচ দেশের অবস্থা বদলাতে চাও? সেইজন্যই বলচিলুম, কজন জানে দেশ মানে কী?

—বাংলায় হিন্দুদের কত সম্প্রদায় আচে। তার মধ্যে সব কটি সম্প্রদায়ের পরিচয় না জানলেই দেশকে জানা হলো না?

-নবীন, তোমায় একটু ক্ষেপাচ্চিলুম। আমি নিজেই কি ছাই জানতুম? নেহাত গতবারে গিয়ে পড়িচিলুম। সে দেকি কি ষাট সত্তর হাজার মানুষের মেলা। তার মধ্যে চোদ্দ আনাই স্ত্রীলোক। কুলকামিনীরা আর অমন ধেই ধেই করে মেলায় যাবে এমন বিশ্বাস হয় না, মনে হলো বেশ্যার সংখ্যাই বেশী। কেউ হত্যে দিয়ে আচে, কেউ পুজো দিচ্চে, কেউ বা নাচ-গানা করে চলেছে, আবার কেউ বা নিজের লোককে বোবা সাজিয়ে বোবার কথা হোক বলে রোগ আরামের ভেস্কি দেকাচে!

–এত লোক এক সঙ্গে?

—হ্যাঁ।  আউলে সম্প্রদায়ের কর্তা এখন ঈশ্বরচন্দ্ৰ মহাশয়। তার সঙ্গে দেকা করতে গিয়ে দেকলুম, কর্তাবাবু একটা শয্যায় শয়ন করে আচেন আর অনেকগুলি স্ত্রীলোক তাকে ঘিরে বসে কেউ পদসেবা কচ্চে, কেউ গা টিপে দিচ্চে, কেউ মুখে সন্দেশ তুলে দিচ্চে, কেউ অঙ্গে চন্দন লেপচে আর কেউ গলায় মালা পরাচ্চে। বেড়ে ব্যাপার। কর্তাবাবু আমার সঙ্গে কতা বলার সময়ই পেলেন না। শুনলুম নাকি বৃন্দাবনের কেষ্টলীলার মতন। এখানেও স্ত্রীলোকদের বস্ত্ৰহরণ হয়!

—কৃষ্ণকমল, তোমার ঝোঁকটা কোন দিকে বলে তো? তুমি যেন আদি রসের ব্যাপারে বেশী মজা পেয়েচো? আমার কাগচে। ওসব আমি প্রচার কত্তে চাই না।

—ওঃ হো, তোমার বুঝি আদি রসের দিকে ঝোঁক নেই। ঐ যে হুতোম প্যাঁচার নক্সা বাজারে ছেড়েচো, তাতে তো আদিরসের টিপ্পানী কম নেই!

—ওটা, ওটা–

—বুঝিচি, ওটাও সমাজসংস্কার! শোনো, আমি এই মেলার কতা সবিস্তারে বললুম কেন জানো? ঐ মেলাটা দেকে আমি মুগ্ধ হয়িচি। শুধু আদিরসের জন্য নয়, এই প্রথম আমি একটা মেলা দেকলুম, যেখানে কোনো জাতিভেদ নেই। এখানে হিন্দু-মোছলমান সব সমান। মোছলমান এখানে সানন্দে বামুনের মুখে অন্ন দেয়, বামুন আহ্লাদ করে খায়। সদগোপ, কলু, মুচি, বৈষ্ণব সব ওখেনে এক। এমনকি নারী-পুরুষেও প্রভেদ নেই। অবস্থাবৈগুণ্যে যে-সব অবলা নারী বেশ্যা হয়েচে, তাদেরও কেউ ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রাকে না! এ যেন এক মহামিলন মেলা। এ কতা সারা দেশকে জানাবার দরকার নেই?

—বেশ তো তুমি লিকে দাও!

কৃষ্ণকমল প্রায়ই সন্ধ্যের দিকে আসতে লাগলো পরিদর্শকের সম্পাদকীয় দফতরে। কিন্তু গাল-গল্পই করে, লেখার ব্যাপারে অলস। ঈষৎ ঝাঁঝালো বিদ্রূপ মিশ্রিত গল্প বলায় তার জুড়ি নেই, কাজ বন্ধ করে নবীনকুমারকে শুনতে হয়।

নবীনকুমার তাকে লেখার জন্য তাড়া দিলেই সে বলে, আরে দাঁড়াও, তোমার কাগচ ভালো করে চলুক। আগে দেকি, তোমার এলেম কতদূর! এর মধ্যে কত টাকা গলে গ্যাচে, ঠিক করে বলো তো ভাই?

নবীনকুমার এই শেষের কথাটিতে অপ্ৰসন্ন হয়। সে হাত তুলে বাধা দিয়ে বলে, ও প্রসঙ্গ তুলো না। আমি টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে চাই না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *