দ্বারিকার পুত্রটির বয়েস দেড় বৎসর। ফুটফুটে রং, টানাটানা চক্ষু হাস্যময় মুখোনি দেখলে দেবশিশু মনে হয়। তাকে দেখলেই সকলে আদর করতে চায়। দোতলার বারান্দায় সুন্দর একটি দোলনায় শোওয়ানো হয়েছে বাচ্চাটিকে, এক ক্রিশ্চান ধাত্রী পাশে বসে তাকে দোল খাওয়াচ্ছে। সেই বারান্দায় সারসার ঝোলানো রয়েছে পাখির খাঁচা।
ভরতকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে দ্বারিকা বলল, জেগে আছে? খোকা জেগে আছে?
ঝপ করে সে তার সন্তানকে বুকে তুলে নিল। সন্তানগর্বে তার মুখোনি উদ্ভাসিত। তাকে নিয়ে প্রায় নাচতে লাগল দ্বারিকা, একবার শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল। শিশুটি ভয় না পেয়ে খটখট শব্দে হাসছে।
হঠাৎ ভরতের দিকে সন্তানকে বাড়িয়ে দিয়ে দ্বারিকা বলল, নে।
ভরত ইস্তস্তত করতে লাগল। সে শিশুদের আদর করতে পারে না। সে খুব অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের এড়িয়ে চলে। কিছু কিছু মানুষ বাচ্চাদের সঙ্গে সহজে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারে, ভরতের সে ক্ষমতা নেই। শিশুদের প্রকৃতি অতি বিচিত্র, কখন কাঁদবে, কখন হবে তার ঠিক নেই, চারুকে দেখে অকারণে ভয়ে আর্তচিৎকার করে ওঠে, কারুকে দেখে সহর্বে গলা জড়িয়ে ধরতে চায়।
আড়ষ্টভাবে ভরত খোকাকে একবার বুকে তুলে নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে রাখল। অস্ফুটভাবে বলল, বাঃ ভারী সুন্দর ছেলে!
ও শিশুটিকে স্পর্শ করা মাত্র তার বুকের মধ্যে একটা ব্যথাবোধ জেগে উঠল। দ্বারিকা গদগদ স্বরে অতটুকু ছেলের নানা গুণপনার কথা বলে চলেছে, সে-সব কিছুই ভরতের কানে প্রবেশ করছে না। তার নিজের একটি সন্তান ছিল, এক সময় সেই পুত্রটিকে নিয়েও তার স্বপ্নের অবধি ছিল না। মাতৃহীন সেই বালক কত বছর তার পিতার মুখ দেখেনি। ভরত তাকে তার মাতৃকুলের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে, আর কোনওদিন সে কটক শহরে ফিরে যাবে না। তবু এমনই হয় রক্তের টান, সেই সন্তানকে তো কিছুতেই পুরোপুরি ভুলতে পারা যায় না।
এতদিন যে সে একবারও সেই পুত্রের খোঁজখবর নেয়নি, সে কি শুধুই তার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বা স্বার্থপরতা? ভরতের ধারণা হয়ে গেছে, তার অভিশপ্ত জীবনের সংস্পর্শে থাকলে ওই শিশুটিও জীবিত থাকত না। সর্বনাশ তাকে পদে পদে অনুসরণ করে, তার আপনজনদের কেড়ে নেয়, শুধু তাকে বাঁচিয়ে রাখে আরও কোনও সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য।
দ্বারিকা বলল, জানিস ভরত, আমার মায়ের হাত দেখে এক জ্যোতিষী বলেছিল, আমাদের কোনও বংশধর থাকবে না। আমার ভাগ্যে কোনও ছেলেপুলে নেই। তাই নিয়ে মায়ের মনে কত দুঃখ ছিল। সারা ভারতে ঘুরে বেড়ানোর সময় কতবার কত জ্যোতিষীদের হাত দেখিয়েছি। এক এক ব্যাটা এক এক রকম কথা বলে। তিনজন বলেছিল, আমার শুধু কন্যাভাগ্য। ছয় সাতটি মেয়ের বাবা হব। কাশীর এক জ্যোতিষী বলেছিল, রাজা দশরথের মতন ধুমধাম করে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলে আশা আছে। খরচ হবে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা।
তারপরেই হা-হা শব্দে হেসে উঠে দ্বারিকা আবার বলল, আরে, আমার ঘরেই যে এক পাক্কা জ্যোতিষী আছে, সেটা খেয়ালই করিনি। আমার গিন্নি অনেক বড় বড় জ্যোতিষীর নাকে ঝামা ঘষে দিতে পারে। মাঝে মাঝে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করে যে পিলে চমকে যায়। একদিন তাকে কথায় কথায় বলেছিলাম, আমার নিজের ছেলে হোক না-হোক আমি পরোয়া করি না। দত্তক নেব। আমার আপন বোনের সাতটি ছেলেমেয়ে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছেলেটিকে দত্তক নেব। সেই ভবিষ্যতে এই সম্পত্তি রক্ষা করবে। তা শুনে বউ কী বলেছিল জানিস? শুধু বলেছিল, হরিদ্বারে তুমি পুত্ৰমুখ দেখবে। তখনই যে সে অন্তঃসত্ত্বা তাও টের পাইনি। হরিদ্বারে এসে বাসা ভাড়া নিলাম। ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় বসন্তমঞ্জরী এই ছেলের জন্ম দিল। ভরত, বড় ভাগ্য করে আমি এমন বউ পেয়েছি। এখন এই ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
ভরত বলল, বাঁচবে, নিশ্চয়ই বাঁচবে।
দ্বারিকা বলল, অবিকল আমার মুখের আদল। আমি যদি বাঁচি, ও কেন বাঁচবে না? বসন্তমঞ্জরী আর একটা অদ্ভুত কথা বলে, প্রায়ই বলে, ও তোমার ছেলে, আমার নয়। এর মানে কী রে? সন্তানের ওপর দাবি তো মায়ের বেশি!
ভরত বলল, এটা কথার কথা!
দ্বারিকা বলল, এই যে তোর সঙ্গে আবার দেখা হল, আমার লোক গিয়ে তোকে পাকড়াও করে আনল, সেও তো বসন্তমঞ্জরীর জন্য। সেও ভারী অদ্ভুত। এলাহাবাদে সেই যে দেখা হয়েছিল মনে আছে? সেবারেও আমার গিন্নিই তোকে দেখিয়ে দিয়েছিল। তোর সম্পর্কে ওর একটা টান আছে। . ভরত মুখ নিচু করে বলল, আমি তাকে তো একবারই মাত্র দেখেছি। তাও অল্প সময়ের জন্য।
দ্বারিকা বলল, তিনতলায় একটা ঢাকা বারান্দা আছে। বিকেলবেলায় আমরা দুজনে প্রায়ই ওখানে বসি। এক সঙ্গে চা খাই। কলকাতায় থাকার সময় বসন্তমঞ্জরী বাড়ি থেকে বেরুতেই চায় না, তিনতলা থেকে নামেই না। ওই বারান্দায় বসে পথের মানুষের স্রোত দেখা যায়, পথের মানুষরা অবশ্য আমাদের দেখতে পায় না। তো বারান্দায় বসে দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছি, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, বসন্তমঞ্জরী গুন গুন করে একটা গান গাইছিল। ওর গানটাও মেজাজের ব্যাপার। দিনের পর দিন গায় না, অনেক সাধাসাধি করলেও গাইতে রাজি হয় না, আবার হঠাৎ এক এক সময় নিজেই গেয়ে ওঠে। আমি লক্ষ করেছি, যখন গান গায়, তখনই ওর অনুভূতি খুব তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, সামনের দিকে তাকিয়ে অনেক দূর দেখতে পায়, শুধু দূরত্ব নয়, সময় পেরিয়ে যায়। আজ এক সময় আচমকা গান থামিয়ে বলল, রাস্তার অন্য দিকে ওই যে ছাতা মাথায় একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, ওই তো তোমার বন্ধু ভরত।
ভরত বলল, আমি তোদের এই নতুন বাড়িটার কথা জানতাম না। জানলে নিজেই এসে দেখা করতাম।
দ্বারিকা বলল, আরে শোন না ব্যাপারটা। তুই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিস, তোকে আমার বউ প্রথম দেখতে পেল। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। বসন্তমঞ্জরী যখন প্রথম ওই কথাটা বলল, আমি বিশ্বাস করিনি। রেলিং-এ ঝুঁকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলাম, কোন জন? তারপর লোকটিকে দেখতে পেয়ে মনে হল, ঠিকই তো, এ তো আমাদের ভরত। এলাহাবাদে কিছু না বলে চুপি চুপি পালিয়েছিল। আমাদের চাকর নকুল ওপরেই ছিল, তাকে ডেকে বলোম, শিগগির ছুটে যা, ওই ছাতা মাথায় লোকটিকে ধরে আন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি নকুলকে নির্দেশ দিচ্ছি, নকুল লোকটিকে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে ডেকে আনল। অনেকটা মুখের আদল তোর মতন হলেও সে অন্য লোক! বাঙালিই না!
ভরত বলল, এরকম ভুল তো হতেই পারে।
দ্বারিকা বলল, আলবাত ভুল হতে পারে। মানুষেরই ভুল হয়। আমি বউয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলাম। সে কিন্তু হাসল না, চুপ করে বসে রইল। যেন হার মানবে না কিছুতেই। ঠিক পাঁচ মিনিট পরে আর একটি ছাতা-মাথায় লোককে হেঁটে যেতে দেখে বসন্তমঞ্জরী জোর দিয়ে বলল, আর একবার নকুলকে পাঠাও। তোমার বন্ধুকে ডেকে আনো! নকুল দৌড়ে গিয়ে যাকে ধরল, সে সত্যিই ভরত সিংহ। যেন ম্যাজিক! দূর থেকে রাস্তার একজন মানুষকে দেখে চেনা কোনও লোকের মতন মনে হতেই পারে। কিন্তু একজন মিলল না বলে পরের একজন মিলে যাবে, এটা কী করে হয়? তুই একে কী বলবি?
ভরত বলল, কাকতালীয় ছাড়া আর কী!
দ্বারিকা বলল, আমার যেন মনে হয়, একবার মিলল না বলে বসন্তমঞ্জরী মন্ত্রশক্তিতে তোকে ডেকে আনল। কোনও ব্যাখ্যা নেই। ও নিজেও কিছু ব্যাখ্যা দিতে পারে না, খুব চাপাচাপি করলে অসহায়ভাবে বলে, মাঝে মাঝে আমার এরকম হয়। কেন হয়, জানি না। মাস কয়েক আগে গঙ্গায় একটা জাহাজডুবি হল, তুই তখন এখানে ছিলি? আরমানি ঘাটের কাছে একটা মালবোঝাই মস্ত বড় বিলিতি জাহাজ আস্তে আস্তে কাত হয়ে ডুবে গেল, সারা শহরের লোক ছুটে গিয়েছিল সে দৃশ্য দেখার জন্য। জাহাজটা ডুবতে শুরু করল বেলা তিনটের সময়, তার অন্তত এক ঘণ্টা আগে, স্নান সেরে বেরিয়ে এসে বসন্তমঞ্জরী ফ্যাকাসে গলায় আমাকে বলেছিল, ওগো, একটা জাহাজ ডুবছে। কত মানুষের বিপদ। আমাদের এ বাড়ি থেকে গঙ্গা কত দূরে, তবু আমার বউ আগাম সে দৃশ্য দেখতে পায় কী করে!
ভরত বলল, প্রাচীন ভারতে খনা, লীলাবতীদের মতন কিছু কিছু রমণীদের মধ্যে অলৌকিক শক্তি ছিল শোনা যায়। হয়তো বউঠাকুরানীও সে রকম ক্ষণজন্মা।
দোতলাতেও একটা প্রশস্ত বসবার ঘর আছে। দুই বন্ধু সেখানে বসে গল্প করল বেশ কিছুক্ষণ। বসন্তমঞ্জরী কিন্তু ক্ষণেকের জন্যও দেখা দিল না, দ্বারিকও ভরতকে তিনতলায় নিয়ে যাবার কথা উচ্চারণ করল না একবারও। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠল।
দ্বারিকা একবার বলল, ভরত, তুই প্রয়াগে আমাদের বাসাবাড়ি থেকে কেন কিছু না বলে উধাও হয়ে গেলি, সেটা আমি এখনও বুঝলাম না। তোর থাকতে ইচ্ছে না হলে তুই ডেকে আমাকে সে কথা জানিয়ে যেতে পারতি না? আমি কি তোক জোর করে আটকে রাখতে পারতাম?
ভরত বলল, সত্যি কথা বলব? সেই সময় কিছুদিনের জন্য আমার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছিল।
সামাজিক রীতি-নীতি কিছুই মনে থাকত না। আমার সেই উন্মাদ দশা কাটতে এক-দেড় বছর সময় লেগেছিল। পাগল ছাড়া বন্ধুর বাড়ির আরাম, আদরযত্ন ছেড়ে কেউ হুট করে চলে যায়? পরে আমি ভেবে দেখেছি, তোর বাড়ি থেকে যদি আমি চলে না যেতাম, তা হলে পুণাতে আমায় জেল খাটতেও হত না। নিয়তি।
দ্বারিক হেসে বলল, ভদ্দরলোকের ছেলে হয়ে শেষ পর্যন্ত তুই জেল খাটতে গেলি! তুই যে চুরি-ডাকাতি করিসনি, তা কি কেউ বিশ্বাস করবে?
ভরত বলল, আমাকে এ শহরে কে চেনে? কেউ অবিশ্বাস করলেও আমার কিছু আসে-যায় না।
দ্বারিকা বলল, তুই কলকাতায় কোনও চাকরি জুটিয়েছিস?
ভরত বলল, না। এ শহরে থাকব কি না, এখনও ঠিক করিনি। কংগ্রেসের অধিবেশন দেখতে এসেছিলাম।
দ্বারিকা বলল, তুই ভবঘুরের মতন আর কতদিন ঘুরে বেড়াবি? ঘর-সংসার করতে হবে না? প্রথম থেকে চেষ্টা করলে তুই অনায়াসে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটগিরি পেয়ে যেতিস। আমাদের সহপাঠী সারদা আর নীলমণি, দুজনেই এখন ডেপুটি, ছাত্র হিসেবে আমাদের চেয়ে নিরেস ছিল, মনে আছে? যাদুগোপালের তো ব্যারিস্টার হিসেবে খুব রমরমা। শোন ভরত, তুই আর সরকারি চাকরি পাবি না, তোর জেল খাটার কথা জানাজানি হয়ে যাবেই। আমার জমিদারির জঙ্গিপুর কাছারিতে একজন ম্যানেজার দরকার। দায়িত্বশীল, বিশ্বাসী লোক তো পাওয়াই শক্ত। তুই যদি এই ভারটা নিস আমি বেঁচে যাই। ওখানে ভাল থাকার জায়গা আছে, টাকা-পয়সা নিয়ে তোর কিছু চিন্তা করতে হবে না।
এক মুহূর্তও না ভেবে ভরত বলল, ও কাজ আমি পারব না।
দ্বারিকা বলল, কিছুদিনের জন্য গিয়েই দ্যাখ না, ভাল লেগে যেতে পারে। ওখানে খাবার-দাবার বেশ সরেস, টাটকা মাছ, দুধ যেন ক্ষীর।
ভরত বলল, জমিদারির কাছারির নায়েবি বা ম্যানেজারি মানেই বিভিন্ন রকমের মানুষদের সামলে চলা। কারুকে চোখ রাঙানি, কারুর দিকে তো হাসি। আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি কোনওদিন মফস্বলেও থাকিনি।
দ্বারিকা বলল, মফস্বলে যেতে চাস না, তা হলে কলকাতায় আমার পত্রিকাটার ভার নে তুই।। পত্রিকাটা চালাচ্ছি বটে, কিন্তু নিজে সময় দিতে পারি না, বন্ধ করে দিতেও ইচ্ছে করে না। তুই সম্পাদনার দিকটা দেখাশুনো কর।
ভরত এবারেও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, পত্রিকা সম্পাদকের যোগ্যতা আমার নেই।
দ্বারিকা বলল, তুই কত পড়াশুনো করেছিস। বঙ্কিমবাবুর উপন্যাস গড়গড়িয়ে মুখস্থ বলতে পারতি… সেই যে একবার … মনে নেই?
ভরত বলল, বই মুখস্থ করলেই কি লেখক হওয়া যায়? কোনওদিন কিছু লিখিনি আমি। অনেক বছর বাংলার বাইরে কাটিয়েছি বলে বাংলা বইয়ের সঙ্গেও সংস্রব নেই। এসব কাজ আমি পারব না। দ্বারিকা।
দ্বারিকা কয়েক পলক স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে বলল, বুঝেছি! তুই আমার কাছ থেকে কোনও টাকা-পয়সা নিতে চাস না। বন্ধুর অধীনে চাকরি করতে তো মানে লাগবে। আমার বাড়িতে এতগুলি ঘর ফাঁকা পড়ে আছে, এখানে এসে থাকতে বললেও তুই থাকবি না, তোকে বউবাজারের ওই এঁদো হোটেলই থাকতে হবে। তোকে নিয়ে আমি কী করি!
ভরত হেসে বলল, আমাকে নিয়ে এত চিন্তার কী আছে, আমি তো জলে পড়িনি! আমার ভালই দিন চলে যাচ্ছে।
দ্বারিকা ওষ্ঠ উল্টে বলল, একে ভাল চলা বলে? চাল নেই, চুলো নেই, নারীসঙ্গ বর্জিত জীবন! তুই কোনও কাজকর্ম না করে দিনের পর দিন হোটেলে কাটালে লোকে নিঘাত বলবে, তোর কাছে ডাকাতির টাকা জমা আছে।
ভরত কিছু বলার আগেই সে আবার বলল, হ্যাঁ, ভাল কথা মনে পড়েছে। যাদুগোপাল একদিন ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটকে। বাজারদর খুব ভাল।
দ্বারিকা জিজ্ঞেস করল, ও মেয়েটির কি বিয়ে হয়েছে?
বরদাকান্ত বললেন, হাসালেন স্যার। এরা হচ্ছে গোবর গাদায় পদ্মফুল। এদের কেউ বিয়ে করে না। সবাই গন্ধ শুঁকে চলে যায়। থিয়েটারে যোগ দেবার আগে ওর বিয়ে হয়েছিল কি না তা জানা যায় না, নয়নমণি ওর আগের জীবনের কথা কখনও বলে না, ওর বাপ-মায়েরও হদিশ নেই।
দ্বারিকা আবার জিজ্ঞেস করল, ওদের তো একজন করে বাঁধা বাবু থাকে। এর বাবুটি কে?
বরদাকান্ত বলল, এখন ক্লাসিকে আছে। সবাই জানে, অমর দত্ত কাঁচাখেগো দেবতা। সব অ্যাকট্রেসকেই একবার দু’বার খায়, কারুকেই বেশিদিন ধরে রাখে না। নয়নমণির সঙ্গে এদান্তি অমর দত্তর সম্পর্ক ভাল নয়, ক্লাসিক ছাড়বে ছাড়বে করছে। মিনাভা বোর্ডে যেতে পারে শোনা যাচ্ছে, এখনও ঠিক নেই, ঠিক হলে আমি খবর পেয়ে যাব। বাঁধা বাবু নেই কেউ। এ মেয়ের নজর খুব উঁচু। যাদুগোপাল রায় নামে এক ব্যারিস্টারের সঙ্গে আশনাই আছে।
দ্বারিকা বাধা দিয়ে বলল, ধ্যাৎ, বাজে কথা। যাদুগোপালের বউ ওর সঙ্গে সখী পাতিয়েছে আমি জানি।
বরদাকান্ত একটুও দমে না গিয়ে বলল, জানকী ঘোষালের মেয়ে সরলা দেবীর কাছে প্রায়ই যায়। ঠাকুরবাড়ির দুটি ছোঁড়া ওই নয়নমণিকে কজায় আনার জন্য খুব কোস্তাকুস্তি করছে। ও মেয়ে দু’জনকেই খেলাচ্ছে। মশাই, থিয়েটারের জগতে অনবরত এই সব খেলা চলে। মঞ্চে যে নাটক দেখা যায়, তার আড়ালের নাটকই বেশি জমজমাট। সে সব শুধু আমরা জানি।
দ্বারিকা বলল, বরদা, তুমি একটা সরল প্রশ্নের সাফসুফ জবাব দাও তো। মেয়েটা কেমন?
বরদাকান্ত আবার নস্যি নিয়ে একটুক্ষণ নীরব রইল। তারপর বলল, সরল না, এটা অতি কঠিন প্রশ্ন। অ্যাকট্রেস কেমন, তা জিজ্ঞেস করলে অনায়াসে উত্তর দেওয়া যেত। মেয়েটা কেমন? মরালিস্টিক বিচার আর আর্টিস্টিক বিচার, দুটো দুরকম। আমাদের মধ্যবিত্ত মরালিটি দিয়ে থিয়েটারের মানুষদের বিচার করা ঠিক নয়। ট্যালেন্ট আছে কি না সেটাই প্রধান বিচার্য। তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেন আমরা মাথা ঘামাতে যাব! নয়নমণি কারুর সঙ্গেই বেশি কথা বলে না। আমাকেও পাত্তা দেয় না। কোনও দিন ওর নামে প্রশংসাবাক্য লিখতে আমাকে অনুরোধ করেনি। আমি নিজে থেকে লিখলেও কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে যায়নি। তা হলেই বুঝে দেখুন, দেমাকিও বলতে পারেন, নিলোভও বলতে পারেন।
দ্বারিকা বলল, ঠিক আছে, তুমি যাও। শোন ভরত, যাদুগোপালের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই ঠিক হবে।. যাদুগোপাল অনুরোধ করলে, সে নিশ্চয়ই ও বাড়িতে এসে দেখা করবে।
ভরত বলল, তার দরকার নেই।
দ্বারিকা বলল, দরকার নেই মানে? তুই সব ব্যাপারেই না না বলবি! এবার তোকে ছাড়ছি না। যাদুগোপাল একটা মামলার কাজে ঢাকায় গেছে, দু’চার দিনের মধ্যেই ফিরবে। আমি তোকে নিয়ে যাব ওর বাড়িতে।
হোটেলে ফিরে ভরত বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করতে লাগল। দ্বারিকা আজ তাকে বেশ বড় একটা আঘাত দিয়েছে। ছাত্র বয়েসে দ্বারিকাকে লঘু চরিত্র, উন্মার্গগামী মনে হত। তার সান্নিধ্য খুব একটা কাম্য ছিল না। কিন্তু সে তো অসাধারণ একটা কাণ্ড করে বসল শেষপর্যন্ত। পতিতাপল্লী থেকে সে উদ্ধার করে এনেছে বসন্তমঞ্জরীকে, তাকে নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে, কী সুন্দর একটি পুত্রসন্তান পেয়েছে। দ্বারিকার মতন এমন সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারে ক’জন। মানুষ! ভালবাসার জন্য সে আর কোনও কিছুরই পরোয়া করেনি। বসন্তমঞ্জরীর একেবারে নষ্ট হয়ে হারিয়ে যাবার কথা ছিল, এখন সে জমিদারের ঘরনি।
দ্বারিকা তাকে বলেছে কাপুরুষ। সবাই তাই বলবে। ভূমিসূতাকে সে ভালবেসেছিল, সেই ভালবাসার কণামাত্র মর্যাদা পায়নি ভূমিসুতা।
এখন আর ভূমিসূতার সঙ্গে যোগাযোগ করা অর্থহীন। নিয়তির পাশাখেলায় ভূমিসূতাই এখন অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। এখন সে অনায়াসে ভরতকে অপমান করতে পারে, সবচেয়ে বড় অপমান হবে, ভরতকে চিনতেই না পারা। ভরতের এই সঙ্গতিহীন ব্যর্থ জীবনকে ওরকম একজন খ্যাতিময়ী নটী কেন মূল্য দিতে যাবে?
দ্বারিকা ছাড়বে না, সে ঝুলোঝুলি করবে। যাদুগোপালের সাহায্য নিয়ে সে ভরতকে ভূমিসূতার সামনে একবার দাঁড় করাবেই। যেচে অবজ্ঞা অপমান সইতে যাবে কেন ভরত? দ্বারিকা কিংবা যাদুগোপাল বুঝবে না, ওরা দুজনেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত, টাকা পয়সার অকুলান নেই। ধরা যাক, ভূমিসূতা তাকে চিনতে পারল, অপমান না করে কান্নাকাটি শুরু করল, তারপরেও ভরত তাকে কী বলবে? ভরতের কী বলার আছে? এখন ভালবাসার কথাও হাস্যকর শোনাবে।
নাঃ, কলকাতা শহরে তার স্থান নেই। দ্বারিকার হাত ছাড়িয়ে তাকে পালাতে হবে আবার।
অসহ্য যন্ত্রণায় ভরতের সারা রাত ঘুম এল না। চোখের জলে ভিজে গেল বালিশ। বরদাকান্তর কথাবার্তা শুনে ভূমিসূতার যে প্রতিচ্ছবি গড়ে উঠেছিল, সেই ভূমিসূতা এখন অনেক দূরের মানুষ। তবু তার কথা শোনার পর বুকের মধ্যে যেন অবিরাম রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
পরদিন সকালে জানবাজারে তার সাক্ষাত হয়ে গেল বারীন্দ্রের সঙ্গে। আনন্দে বিস্ময়ে সে ভরতের হাত চেপে ধরে বলল, ভরতদাদা, কী সৌভাগ্য আমার! কদিন ধরে আপনার কথাই ভাবছি!!
বারীন্দ্র কি এখনও ভরতকে তার ব্যবসার অংশীদার করার আশা পুষে রেখেছে? ভরতের সঞ্চিত টাকাকড়ি যে প্রায় শেষ। সে বলল, কী ব্যাপার, তুমি কি কলকাতা শহরে চায়ের দোকান খুলতে চাও নাকি?
বারীন্দ্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নেড়ে বলল, না, না। চায়ের দোকানফোকান না। অনেক বড় কাজে হাত দিয়েছি। দেশের কাজ। সারা দেশের কাজ।
তারপর ভরতের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কথা বলা যাবে না। আমরা একটা গুপ্ত সমিতি গড়েছি। তাতে আপনার সাহায্যের বিশেষ দরকার।