2 of 3

৫৭. চয়ন যখন পড়ায়

৫৭

চয়ন যখন পড়ায় তখন বিভোর হয়ে পড়ায়। পড়ানোর মধ্যেই এক মাদকতা পেয়ে যায় সে। বিশেষ করে ছাত্র বা ছাত্রীটি ভাল পেলে। চারুশীলার দেবশিশুর মতো ছেলেটি সেদিক দিয়ে তার অতিশয় প্রিয়।

সন্ধেবেলা যখন ছাত্র আর মাস্টারমশাই মগ্ন হয়ে আছে ঠিক সেই সময়ে চারুশীলা অনেকটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে অবিন্যস্ত পায়ে ঘরে এসে ঢুকল। এবং অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বেশ কষ্ট করেই যেন চয়নকে চিনতে পারল। তারপর ভ্রূ কুঁচকে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, মেয়েটা কেমন বলুন তো?

চয়নকেও তার ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে হল। খুব অবাক হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, কোন্ মেয়ের কথা বলছেন?

যেন একটু বিরক্তি বা ধৈর্যহীনতা স্পর্শ করল কণ্ঠস্বরকে, আপনি কিছু মনে রাখতে পারেন না। আমি রশ্মির কথা বলছি।

চয়নের স্মৃতিশক্তি চমৎকার। তার মনে পড়ল। বাস্তবিক এদের বিরাট দলের সঙ্গে বনভোজনে গিয়ে সে এতই কৃতজ্ঞতা বোধ করেছিল যে বলার নয়। চারদিকে যেন মানুষ-বনস্পতি, আর সে যেন সামান্য তৃণ, তাই এইসব মহা মহা পুরুষ ও মহিলার প্রত্যেককে লক্ষ করেছিল সে। রশ্মিকে তার খুব মনে আছে। দলের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে কম কথা আর বেশি হাসির মেয়ে। দেখতে ভীষণ সুন্দর। তবে সে সৌন্দর্য উত্তেজক বা উত্তপ্ত নয়। একটু যেন শীতলতা মাখানো। হয়তো ক্লাসিক, কিন্তু এরোটিক কিছুতেই নয়।

খুব বিনয়ের সঙ্গে চয়ন বলল, দেখতে কেমন জিজ্ঞেস করছেন? দেখতে তো সুন্দরীই উনি। তবে উনি কেমন মানুষ তা তো জানি না।

আচ্ছা, আপনি কী বলুন তো! সিক্সথ্‌ সেনস্ নেই? মানুষকে দেখে কি কিছু বোঝা যায় না? মুখ নাকি মানুষের চরিত্রের দর্পণ!

চয়ন এই ছিটিয়াল, খামখেয়ালী ও অত্যন্ত উদার অর্থাৎ নানা বিপরীত গুণান্বিতা মহিলার সামনে খুবই কুণ্ঠিত হয়ে পড়ল। সে এক প্রায়-অচেনা মহিলা সম্পর্কে কী মতামত দেবে! কিন্তু না দিলেও কি ছাড়বেন চারুশীলা? সে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বলে, উনি তো মনে হয় অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, রিজার্ভড্‌ আর অত্যন্ত ভদ্র।

তা হলে?

এ প্রশ্নে আবার বাক্যহারা হওয়ার কথা চয়নের। তবু সে কেবল মাত্র প্রতিধ্বনি করল, তা হলে?

তা হলে ওর সঙ্গে হেমাঙ্গর বিয়ের বাধা কিসের? কোথায় আটকায় বলুন তো! নিশ্চয়ই ওকে হেমাঙ্গর পছন্দ, তাই না?

এরকম একটা ক্ষীণ আভাস চয়নও পেয়েছে। সে অত্যন্ত উদারতার সঙ্গে বলল, হওয়ারই তো কথা।

আপনার কি মনে হয় না যে, ওরা মেড ফর ইচ আদার?

হয়।

চারুশীলা উজ্জ্বল হয়ে বলে, হয়? তাহলে আমি নিশ্চয়ই ভুল করিনি! আচ্ছা, আপনি কথা চেপে রাখতে পারেন?

চয়ন উদ্বেগের সঙ্গে বলে, এসব কি গোপনীয় কথা?

না, এসব নয়। আপনি বোধ হয় জানেন না, হেমাঙ্গ বিয়ের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। উহক এন্ডে কোথায় চলে যাচ্ছে।

হ্যাঁ, আপনি হেমাঙ্গবাবুর হাইড আউটের কথা আমাকে বলেছেন। সামনের শনিবার সেখানে আপনার যাওয়ার কথা।

হ্যাঁ, বাঁকা মিঞার গ্রামে। সেখানে ও একটা বাড়ি কিনেছে। শুধু তাই নয়, বনসৃজন করবে বলে অনেকটা জমি কেনার চেষ্টাও করছে। বাঁকা মিঞা হেমাঙ্গর এসব কাণ্ড দেখে ভয় পেয়ে মামাকে জানিয়ে গেছে। তখনই ওর হাইড আউটের কথা আমরা জানতে পারি। হেমাঙ্গকে কি আপনার পাগলাটে বলে মনে হয়?

না তো! উনি তো বেশ স্মার্ট আর ড্যাসিং।

ছাই জানেন। আসলে একটা হাঁদারাম। ওকে আমার মতো কেউ চেনে না। যখন এইটুকু ছিল তখন আমার সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরত। সারাদিন কেবল চারুদি আর চারুদি।

সেকথাও বোধ হয় একদিন বলেছেন।

বলেছি? ওটাই আমার দোষ। বলে ভুলে যাই। ডোন্ট মাইন্ড। এসব কথা কিন্তু খুব গোপন রাখবেন।

খুব বিনয়ের সঙ্গে চয়ন বলে, গোপনই থাকবে। বলার মতো আমার কেউ নেইও।

আচ্ছা, হেমাঙ্গ কেন পালাচ্ছে বলুন তো! ব্যাপারটা খুব পাজ্‌লিং এবং অস্বস্তিকরও। একটা মেয়ের সঙ্গে ওর একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে, গার্জিয়ানরা সবাই মত দিয়েছে, তা হলে ও পালাচ্ছে কেন বলতে পারেন?

না, চয়ন তা বলতে পারে না। কিন্তু সে কথা কবুল করাটা যে ঠিক হবে না এ কাণ্ডজ্ঞান তার আছে। সুতরাং অত্যন্ত গভীরভাবে ব্যাপারটা যেন ভেবে দেখার একটা ভান করল সে। তারপর বলল, তাই তো!

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

চয়ন সময়োচিত গাম্ভীর্য এবং একটা দুঃখের ভাব মুখে ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগল। কে কাকে বিয়ে করতে চায় বা চায় না এটা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে সেটা সে জানে না। এদের সমস্যাও এত শৌখিন ও ফিনফিনে যে, সে অবাক না হয়ে পারে না। তার মতো সমস্যা তো এরা কখনও ভোগ করবে না। বিশ্বাসঘাতক এক শরীর নিয়ে সে যে টিকে আছে, প্রতি মুহূর্তে যার আশ্রয় হারানোর ভয়, যাকে প্রতিদিন হাজারো অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, যে কখনও তার যৌবনকে টেরই পায় না, উপভোগ তো দূরস্থান। সুতরাং তার কাছে এসব সমস্যা অবান্তর ও বাহুল্য। মানুষ তার সঙ্গে হেসে কথা বললে, ভাল ব্যবহার করলে, সমবেদনা প্রকাশ করলেই সে ভীষণ খুশি হয়ে যায়, তার বুকে যেন পূর্ণিমার জ্যোৎস্না এসে পড়ে।

আচ্ছা, আপনার সিক্স্‌থ্‌ সেন্স নেই?

চয়ন দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে না।

আপনি জ্যোতিষী জানেন?

আজ্ঞে না।

কিন্তু আমার যে এখন এরকম একটা কিছু দরকার।

চয়ন ঢোঁক গিলে বলে, জ্যোতিষী তো অনেক আছে।

চারুশীলা বিরক্তির সঙ্গে বলে, সে আমিও জানি। একজন বিখ্যাত জ্যোতিষীকে আমি হাত দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা আমার হাজব্যান্ড কবে চাকরি পাবে বলুন তো, আর কি চাকরি পাবে? জ্যোতিষী অনেকক্ষণ দেখে-টেখে বলল, আর দেড় বছরের মাথায় পাবে। কী চাকরি সেটা আর বলেনি। তখন আমার হাজব্যান্ড দু’হাতে পয়সা রোজগার করছে।

চয়ন জ্যোতিষীদের ব্যর্থতার কাহিনী শুনে দুঃখিতভাবে বলল, তাহলে কি করা যায়?

চারুশীলা হঠাৎ তার মুখখামুখি একটা চেয়ারে ধপ করে বসে বলল, আচ্ছা আমার কেন কেবলই মনে হয় বলুন তো, যে, আপনার বোধ হয় সত্যিই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে।

চয়নের একবার বলতে ইচ্ছে হল, সিক্সথ সেন্স আপনারই আছে, তাই বোধ হয় আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টের পান। কিন্তু সেটা বলে ফেললে স্পর্ধার প্রকাশ হয়ে যেত। তাই সে আপাদমস্তক লজ্জিত হয়ে বলে, আজ্ঞে, আমি অতি সামান্য মানুষ। আমার কোনও ক্ষমতা নেই।

চারুশীলা তার এলো চুল অবিন্যস্ত হাতে পাট করতে করতে বলল, আপনার বিনয় ব্যাপারটা আমার একদম সহ্য হয় না। ওরকম বিনয় করবেন না তো! মেরুদণ্ডটা নুয়ে যাবে যে! একটু অহঙ্কারী হতে পারেন না?

কী বলবে তা ভেবেই পেল না চয়ন। অসহায়ভাবে শুধু বলল, অহঙ্কার!

অহঙ্কার না থাকলে পুরুষমানুষকে কি মানায়? মেয়েদেরও মানায় না। একট অহঙ্কার থাকলে দেখবেন লোকে আর অবহেলা করতে সাহস পায় না। তবে অহঙ্কার করতে হলে বুদ্ধি চাই। অনেকে বোকার মতো নিজের গল্প নিজেই করে বেড়ায়। তাদের নিয়ে লোকে হাসাহাসি করে। ওরকম নয়, একটু মাথা উঁচু করে, নিজের ওপর বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা রেখে এবং কাউকেই— সে যত বড়ই হোক না কেন, বেশি মাথায় উঠতে না দিয়ে যদি চলেন তা হলে দেখবেন সবাই আপনার ওপর মনোযোগ দিচ্ছে।

প্রকাশ্যে নয়, তবে সংগোপনে চয়ন একটি হতাশার শ্বাস মোচন করল।

আর শুনুন, আমরা কিন্তু আপনার বস নই, বন্ধু। আমার হাজব্যান্ড লেফটিস্ট, একটু কমিউনিস্ট মাইন্ডেড। উনি শ্রমের মর্যাদা জানেন। আমি অবশ্য ওঁর মতো নই, তবু আমি কোনও মানুষকেই সাফারিং আর বন্ডেড দেখতে ভালবাসি না।

চয়ন বিব্রত হয়ে বলে, তা জানি। আপনারা খুবই মহৎ।

ফের? ওরকম বললে আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কি করে?

আজ্ঞে, আর একটু সময় দিন।

চারুশীলা হেসে ফেলল, বলল, সময় দিলে আরও বাজে লোক হয়ে যাবেন। মনোভাবটা শুধু পালটে ফেলুন। আপনি আমার বাড়িতে এসে আপনার শ্রম ও মেধা দান করছেন। প্রাপ্য দক্ষিণা নিচ্ছেন। এর বেশি তো কিছু নয়।

যে আজ্ঞে।

এবার আমার সমস্যাটার কথা একটু বলুন। এভাবে তো বসে থাকলে হবে না। হেমাঙ্গ আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আপনি পুরুষমানুষ বলেই জানতে চাইছি, ও আসলে কী চায়! আমি মেয়ে বলেই হয়তো ওর ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

চয়ন একটু সতর্কতামূলক নীরব থেকে বলল, হেমাঙ্গবাবুর সঙ্গে আমার এতই সামান্য পরিচয় যে, ওঁকে ঠিক বুঝবার মতো সময় পাইনি।

তাই তো বলছি, আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি বলে?

বিপন্ন চয়ন বলল, বরং আমাকে ওঁর ঠিকানাটা দিন, একবার গিয়ে ভাল করে আলাপ করে আসি।

চারুশীলা মাথা নেড়ে বলে, তাতে লাভ নেই। ও একজন অপরিচিতের কাছে কি মনের কথা খুলে বলবে?

তা হলে কি করব?

সামনের শনিবার ওর হাইড আউটে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কী হয়েছে জানেন! আমার হাজব্যান্ড অনেকদিন বাদে দেশে এলেন তো। এখন বড় বড় ক্লায়েন্টরা ঘন ঘন পার্টি দিচ্ছে। এমন সব ক্লায়েন্ট যাদের অ্যাভয়েড করা যায় না। আমার হাজব্যান্ডের অনারেই সব পার্টি। শনি রবি দুটো দিনই আমরা ভীষণ এনগেজড্‌। পরের উইক এন্ডেও।

প্রবলেমটা আমি অবশ্য ঠিক ধরতে পারিনি। হেমাঙ্গবাবু কি বিয়ে করতে চাইছেন না?

সে তো কোনও পুরুষমানুষই প্রথমে চায় না। পরে সুড়সুড় করে গিয়ে পিঁড়িতে বসে। এটা একটু অন্য ব্যাপার। প্রেম, কিন্তু বিয়ে নয়।

এ সমস্যার সঙ্গেও চয়নের পরিচয় নেই। সে তবু অত্যন্ত সমঝদারের মতো মাথা নাড়ল।

চারুশীলা বলল, দেখুন, এটা একটা প্রেস্টিজ ইসু। যদি হেমাঙ্গ বিয়ে না করে তা হলে আমাদের মাথা কাটা যাবে। রশ্মির মতো মেয়েকে বিয়ে না করতে চাওয়াটাই একটা অবাক কাণ্ড।

চয়ন যদিও এ ব্যাপারে কিছুই জানে না, তবু হঠাৎ বলে ফেলল, হেমাঙ্গবাবু আর কাউকে ভালবাসেন না তো!

বিস্মিত চারুশীলা কিছুক্ষণ চয়নের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আর কাউকে? পাগল নাকি? ওর ভিতরে ভালবাসা জিনিসটাই নেই। মেয়েদের ভয় পায়, এডিয়ে চলে। রশ্মির সঙ্গেও তো কিছু ছিল না। আমিই বলে-কয়ে ব্যাপারটা প্রায় ঘটিয়ে তুলেছিলাম। এখন কী হবে বলুন তো! আমার যে ভীষণ বিপদ!

চয়নের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নেই ঠিকই, কিন্তু সে ন্যালাখ্যাপাও নয়। দুইয়ে দুইয়ে যে চার হয় এই কাণ্ডজ্ঞান তার আছে। সে বুঝতে পারছিল এই আবেগতাড়িত মহিলা হেমাঙ্গকে বোধ হয় আদৌ অনুধাবন করেননি। একটি সুন্দরী ও শিক্ষিতা মেয়েকে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছেন মাত্র এবং তাতে যে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে চাইছেন তার মধ্যে একটু অহংবোধ কাজ করছে। আমি যা বলব হেমাঙ্গ তাই শুনবে এরকম একটা কর্তৃত্বের ভাবও হয়ত আছে। চারুশীলা অত্যন্ত ভাল মহিলা। কিন্তু তিনি নিজের চশমায় দুনিয়াকে দেখেন। অন্যকে কমই অনুধাবন করার ক্ষমতা আছে ওঁর।

চয়ন খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, বিপদ কেন বলছেন?

চারুশীলা চোখ বড় বড় করে বলে, বিপদ নয়? বিয়ে যদি ভণ্ডুল হয় তা হলে সব দোষ যে আমার ঘাড়ে এসে পড়বে!

চয়ন খুব সমবেদনার গলায় বলল, তা-ই বা কেন? এই যে বললেন ওঁদের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংও হয়েছে!

তা তো হয়েছে।

একটু মাথা চুলকে চয়ন বলে, তা হলে ওঁরাই দুজনে ওঁদের সম্পর্কটা সর্ট আউট করবেন।

চারুশীলা বিস্মিত হয়ে বলে, মধ্যস্থের বিপদ নেই বলছেন?

থাকার কথা নয়। ওঁরা তো অ্যাডাল্ট।

কিন্তু আমি যে ভীষণভাবে চাই, বিয়েটা হোক।

যদি হয় তো ওঁরাই সেটা ঘটাবেন। না ঘটলেও আপনাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই।

আপনি ভীষণ নেগেটিভ কথা বলেন। আচ্ছা, আপনাকে ঠিকানা দিলে আপনি হেমাঙ্গর হাইড আউটটা খুঁজে বের করতে পারবেন?

আমি!

কেন, আপনার কি ভয় করবে?

চয়ন মহা ফাঁপরে পড়ে বলল, উনি যখন লুকিয়েই থাকছেন তখন সেখানে গিয়ে হাজির হওয়াটা কি ভাল হবে? উনি হয়তো রাগ করবেন।

হেমাঙ্গ তেমন রাগী মানুষ নয়। তা ছাড়া একটু রিস্ক তো নিতেই হবে!

উনি কি কলকাতায় থাকছেন না?

কবে আসছে, কবে চলে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। টেলিফোনে ধরতে পারলেও বেশি কথা বলতে চাইছে না।

আর রশ্মিদেবী কি ওঁর মনোভাব জানেন?

এখনও নয়। রশ্মি একটা রিসার্চ পেপার নিয়ে খুব ব্যস্ত। তবে মাঝে মাঝে হেমাঙ্গর সঙ্গে ফোনে কথা হয়।

চয়ন একটু হেসে বলে, তা হলে ভাবছেন কেন? ওঁরা তো সম্পর্ক রেখেই চলেছেন।

চারুশীলা খুব বিরক্তির গলায় বলে, তা রাখলেই বা লাভটা কি? হেমাঙ্গ যে আরও সময় চাইছে। অথচ রশ্মির হাতে যে মোটেই সময় নেই। বিয়েটা হয়ে গেলেই ও বিলেত চলে যাবে। এদিকে এই হাঁদারামটা বিলেত যেতে চাইছে না। আচ্ছা, এদেশে আছেটা কী বলুন তো! আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই, ভিখিরি আর রোগভোগে ভরা, চারদিকে বিচ্ছিরি সব লোকজন, ধুলো, ধোঁয়া, এদেশে কিসের মধু? বিলেতে গেলে কত ভাল থাকতে পারবে। অথচ কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছে না। কী করে যে ওর মত করাই ভেবে পাচ্ছি না। ওকে যে গিয়ে একদিন ধরব তাও সময় পাচ্ছি না। আমার হাজব্যান্ড আসায় এখন বড্ড ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তিন চার মাস বাদে আমরা ওর সঙ্গেই আবার কিছুদিনের জন্য বিদেশ চলে যাব। সেসব নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আর ওই হাঁদারামটা আমার জন্য আর একটা প্রবলেম তৈরি করে রেখেছে। আপনি প্লিজ, আমাকে একটু হেল্প করুন না।

চয়ন বিপন্ন বোধ করতে লাগল। সে বুঝতে পারছে, ভদ্রমহিলা পৃথিবীকে তাঁর নিজের মতো করে চালাতে চান। সে নিজে এঁর আজ্ঞাবহ হতে রাজি আছে। কিন্তু তাতে যে কী লাভ হবে তা বোঝবার সাধ্যই তার নেই। সে তবু বিনীতভাবে বলল, যে আজ্ঞে। হাইড আউটটায় গিয়ে আমার কী কাজ হবে তা যদি বলেন তো ভাল হয়।

আমি জানতে চাই ওখানে ও কী করছে। কেনই-বা ও-জায়গাটা ও পছন্দ করল। আরও জানতে চাই, ও বিলেত যেতে চাইছে না কেন এবং বিয়েটাই বা কেন পিছোতে চাইছে। পারবেন না জেনে আসতে?

চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু আমাকে উনি হয়তো গুরুত্বই দেবেন না।

আপনাকে ও খুব ভালমানুষ বলে জানে। তা ছাড়া আপনি ইনোসেন্ট থার্ড পার্টি। আপনাকে বলতে ওর আপত্তি হবে না। শুধু মনে রাখবেন, আমি পাঠিয়েছি বলে যেন টের না পায়।

মানুষ তো আত্মহত্যাও করে, চয়নের এই অভিযান না হয় সেরকমই একটা কিছু হবে। মরিয়া হয়ে সে ঘাড় কাত করে দিয়ে বলল, ঠিক আছে।

চারুশীলা উজ্জ্বল হয়ে বলল, বাঁচালেন। কি ভাবে যাবেন বলুন তো? আপনি বরং আমাদের গাড়িটা নিয়ে শনিবার সকালে ক্যানিং চলে যান। সেখান থেকে বোধ হয় লঞ্চ ছাড়ে। জিজ্ঞেস করে করে চলে যাবেন। গাড়িটা ওখানেই থাকবে। কাজ সেরে ফিরে আসবেন।

চয়ন ম্লান একটু হেসে বলে, গাড়ি! গাড়ির কোনও দরকার নেই। ক্যানিং-এ অজস্র ট্রেন যায়।

ভ্রূ কুঁচকে চারুশীলা বলে, আপনি আমার কাজে যাচ্ছেন। আমার দায়িত্ব।

চয়ন বিনীতভাবে বলল, গাড়িতে সময় বেশি লাগবে। অকারণ অপচয়। কোনও দরকার নেই।

ঠিক আছে, তা হলে যাতায়াতের জন্য আমি আপনাকে এক হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছি।

চয়ন আতঙ্কিত হয়ে বলে, দশ বিশ টাকার বেশি লাগবে না।

আপনি কি ভিখিরির মতো যাবেন নাকি? রাস্তায় খেতেও তো হবে।

খেতে ধরুন আর দশ টাকা লাগতে পারে।

তবু রাখুন। পথে বেরোতে সব সময়ে বেশি টাকা সঙ্গে রাখতে হয়।

আপত্তি করা সত্ত্বেও চারুশীলা হাজার টাকাই গছিয়ে ছাড়ল। বলল, সবটাই খরচ করবেন। কৃপণের মতো হিসেব করবেন না। ট্রেনে অবশ্যই ফার্স্ট ক্লাসে যাবেন।

লোকাল ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস নেই যে।

ট্যাক্সি করে যাবেন তা হলে। যা খুশি করবেন, কিন্তু কিছু ফেরত দিতে পারবেন না।

শনিবারের তো এখনও দেরি আছে।

দেরি! কোথায় দেরি? মাঝখানে তো মোটে দুটো দিন!

চয়ন উদ্বেগের সঙ্গে একটা শ্বাস ছাড়ল।

চারুশীলা আরও কিছু একটা গুরুতর এবং পাগুলে প্রস্তাব করতে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় একটা মেয়ে ঘরে ঢুকে বলল, মাসি, আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি যে! এখানে বসে আছ!

ওঃ ঝুমকি! আমার যে কী বিপদ যাচ্ছে! চলো, ও ঘরে গিয়ে বসি।

ঝুমকিকেও চেনে চয়ন। তার দিকে চেয়ে চমৎকার দাঁতে ঝলমল করে হেসে বলল, ভাল আছেন চয়নবাবু?

চয়ন তটস্থ হয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

ওরা উঠে যাওয়ার পর খানিকটা স্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। এই খ্যাপাটে মহিলার সঙ্গ যদিও উদ্বেগজনক, তবু চারুশীলাকে কখনও অপছন্দও করতে পারে না চয়ন। অনেকটা এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মতোই এসে সব ওলটপালট করে দিয়ে যান।

শনিবার সকালে খুব উদ্বেগের সঙ্গেই রওনা হল চয়ন। কলকাতার বাইরে সে কমই গেছে। সুন্দরবন তার সম্পূর্ণ অচেনা রাজ্য। প্রথম প্রথম ভয়-ভয় করছিল। তারপর ট্রেনে হাজারো রকমের লোক দেখে তার মনে হল, মানুষ কত কাজে কত দিকে যায়, ভয়ের কী!

ভয় শুধু একটা। যদি হঠাৎ মাঝপথে অজ্ঞান হয়ে যায়। তার মৃগী রোগের তো কোনও সৌজন্যবোধ বা লজ্জা নেই। যেখানে সেখানে প্রকাশ ঘটে। এবারে অনেকদিন ঘাপটি মেরে আছে। হঠাৎ কখন যে লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে তার ঠিক নেই।

ক্যানিং পৌছে সে খোঁজ নিল। তারপর মজার নৌকো ভটভটিতে চেপে বসল। সাঁতার জানে না, তবু খুব একটা ভয় হচ্ছিল না তার। ভয় আসলে বসে আছে সামনের কোনও তীরবর্তী গ্রামে, হেমাঙ্গ সেজে। লোকটা এমনিতে ভদ্র ও সুজন। কিন্তু আজকের পর থেকে হেমাঙ্গ আর সুজন থাকবে না তার কাছে। একটা লোকের সঙ্গে তার চিরবিচ্ছেদ ঘটবেই ঘটবে।

খুবই সাফল্যের সঙ্গে সে উদ্দিষ্ট গাঁয়ের ঘাটে ভটভটি থেকে নামল। তারপর সামান্য খোঁজ নিতেই হেমাঙ্গর ঘরখানা খুঁজে পেল। নদীর ধারেই ঘর। একটু গাছপালা আছে। ফাঁকা ও সুন্দর জায়গায় ঘরখানা দেখেই ভাল লাগল তার। বাঃ, বেশ তো! এরকম জায়গায় এসে থাকতে ভালই লাগার কথা।

উঠোনে ঢুকে চয়ন একটু গলাখাঁকারি দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকল, হেমাঙ্গবাবু!

কেউ সাড়া দিল না। ঘরের দরজা বন্ধ।

হেমাঙ্গবাবু কি আছেন?

আরও কয়েকবার ডাকার পর দরজাটা খুলে হেমাঙ্গ বেরিয়ে এল। তবে প্রথম দর্শনেই যেন চিনতে পারল না। কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলল, আরে!

চয়নের পালানোর বা পিছোনোর উপায় নেই। সুতরাং সে দু’পা এগিয়ে বলল, আমি চয়ন।

হেমাঙ্গ হঠাৎ হাসল। সমস্ত মুখটা উদ্ভাসিত হল সেই হাসিতে। বলল, ইটস্ এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ! আপনি এখানে কি করে এলেন?

চয়ন আমতা আমতা করে বলল, এদিকটা দেখা ছিল না। তাই—

সে তো বটেই। এটা বেড়ানোর মত জায়গাও নয় শহুরে মানুষের কাছে। কিন্তু আমি এখানে থাকি কে বলল আপনাকে?

শুনলাম।

আসুন, আসুন।

ঘরে তেমন আসবাব কিছু নেই। বেশ ন্যাড়া। একখানা তক্তপোশ, একখানা মোড়া এবং খুবই পলকা ধরনের একখানা টেবিল আর চেয়ার। চেয়ারে তাকে বসতে দিয়ে হেমাঙ্গ বিছানায় বসল। বলল, কিছু খাবেন?

না। একটু জল খেলেই হবে।

জলটা দিয়ে হেমাঙ্গ খুব স্বাভাবিক গলায় বলে, চারুদি আপনাকে পাঠিয়েছে, না?

বিষম খেয়ে সামলে নিয়ে চয়ন বলে, কথাটা কবুল করা বারণ।

হেমাঙ্গ হাসল, কবুল করতে হবে না। আমি জানি।

চয়ন গেলাসটা রেখে বলল, আমি আসতে চাইনি। উনি জোর করে—

বুঝতে পারছি। তবু মন্দের ভাল। আপনার বদলে চারদি এলে অবস্থাটা খারাপ হত।

উনি কিছু জানতে চান।

হেমাঙ্গ একটু মাথা নেড়ে বলে, তাও জানি। চারুদি অনেক কিছু জানতে চায়। কিন্তু কি জানাবো তাই যে আমি জানি না!

চয়ন সভয়ে বলল, উনি খুব ইনসিস্ট্যান্ট।

আপনি বিয়ে করেছেন?

আজ্ঞে না।

হেমাঙ্গ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, বিয়ে ছাড়া মানুষের আর কিছু করার আছে কিনা তাইই আমি জানতে চাই। আপনি কী বলেন!

আমি! চয়ন একটু হাসল, আমি কিছু জানি না।

আপনি আজ আমার কাছেই থাকুন।

থাকব? কিন্তু—

থাকবেন। আপনাকে দেখে কেন যেন আমার ভাল লাগছে। কাল থেকে মনটা ভীষণ খারাপ ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *