2 of 3

৫৭. এরকম বৃষ্টির রূপ

॥ ৫৭ ॥

এরকম বৃষ্টির রূপ এক সময়ে ছেলেবেলায় দেখেছিল চপলা। বহুকাল আর দিগদিগন্তব্যাপী পাগল হাওয়ায় বয়ে আসা গভীর বিরামহীন বৃষ্টিপাত দেখেনি সে। সারাদিন কেবল জলের শব্দ। উল্টোপাল্টা জলের শব্দ। পুকুর ছাপিয়ে জল ঢেকে ফেলেছে বাগান, উঠোন, বারবাড়ির মাঠ। ব্রহ্মপুত্রের চেহারা দেখে শিউরে উঠতে হয়। সুড়কির রাস্তার প্রায় সমান সমান উঠে এসেছে ব্রহ্মপুত্রের স্রোত, ওপাড়ে শম্ভুগঞ্জে কোনো ডাঙাজমি দেখা যায় না। স্রোত চলেছে দ্রুতগামা রেলগাড়ির মতো, বাগানের গাছপালা অনেকগুলোই শুয়ে পড়েছে প্রবল বৃষ্টির দাপটে। শুধু বারবাড়ির দুটো কদম গাছ ভরে গেছে ন্যাড়ামাথা ফুলে।

সারাদিন যা কিছু ছোঁয়া যায় তাই যেন ভেজা, স্যাঁতা, মিয়োনো। না-শুকোনো ভেজা জামাকাপড়ের সোঁদা গন্ধ আসে বারান্দা থেকে। বাতাসটা পর্যন্ত জলে ভরা। দিন-রাত চারদিক থেকে হাজারো ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। এই ডাকটি সহ্য করতে পারে না চপলা। কেমন যেন বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করতে থাকে।

আজকাল চপলার বুকের ভিতরেই যত যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেমন উদাস লাগে, সারাদিন যেন এক ভারহীন শরীরে সে হাঁটে চলে শোয়।

চপলা আজ স্নান করেনি, প্রথম বর্ষার কাঁচা জলে তার ঠাণ্ডা লেগেছে। শরীরে একটু জ্বোরো ভাব। একটু শীত জড়িয়ে আছে হাতে পায়ে। দুপুরে খাওয়ার পর ছেলে মেয়ে নিয়ে মশারির মধ্যে শুয়ে ছিল সে। বাচ্চা দুটো ঘুমিয়ে পড়েছে, চপলার আজকাল খুব সহজে ঘুম আসতে চায় না। এপাশ ওপাশ করে শরীরে ব্যথা হয়ে গেল।

বৃষ্টির তোড়টা কিছু কমেছে। চপলা উঠে বারান্দায় এসে এলোচুলের রাশিতে আঙুল চালিয়ে জট ছাড়াতে লাগল। বাতাস কমেছে, বৃষ্টিও অনেক কম। তবে এটা সাময়িক। ঘণ্টা খানেক বাদেই হয়তো আবার এক পরত মেঘ চলে আসবে। বিভীষণ বৃষ্টি নামবে তার পর। কয়েকদিন যাবৎ রকমই হচ্ছে।

চপলা একটা হাই তুলল, এখানে থাকতে তার যে ভাল লাগছে তা নয়। আজকাল এ বাড়ির চাকর-বাকর আর কৃষ্ণকান্ত ছাড়া কেউই তার সঙ্গে বড় একটা কথা বলে না। কেন বলে না তার কারণটা বড্ড স্পষ্ট। বড় নির্লজ্জ।

কিন্তু এরা কি জানে সেই কুমারী বয়স থেকে যে পিপাসা তার বুকের মধ্যে ছিল তা আজও রয়ে গেছে। কনককান্তি সে পিপাসা মেটাতে পারেনি। সে সাধ্যই তার নেই। সেই আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে যৌবনের এই দামাল দিন পার হচ্ছে সে। কিন্তু পার হওয়া কি সোজা?

শচীন কালও এসেছিল। ভারী উদ্‌ভ্রান্ত সে। একটু রোগা হয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টিতে ক্ষ্যাপামির ভাব। একটা ওলট-পালট কিছু করে ফেলতে চায়। চপলার বয়স শচীনের চেয়ে কম, সে উকিলও নয়। তবু অভিজ্ঞতা তার অনেক বেশী। সে জানে, পুরুষের ভালবাসা হল গড়ানে জমি, সেখানে জল দাঁড়ায় না।

তা ছাড়া হুট করে কিছু করলেই তো হল না। পায়ের নিচে শক্ত জমি না থাকলে প্রেম-ট্রেম সব দু’দিনেই ভেসে যাবে। চপলা তাই অনেক করে বুঝিয়েছে কাল শচীনকে, এখুনি কিছু করে বসবেন না, প্লীজ। আর একটু সময় নিন।

কিসের সময়? আমি যে পাগল হয়ে যাবো!

পাগল হতেই তো বারণ করছি।

বারণ করলেই কি হল!

প্লীজ! ওরকম করলে আমি কিন্তু চলে যাবো।

যান না। আমি পিছু নিতে জানি।

সে তো বুঝতে পারছি। পিছু নিলে, ষোলো কলা পূর্ণ হবে। কিন্তু আমি সবদিক ভেবেচিন্তে এগোতে চাই। আপনি পাগলামি করবেন না।

শচীনের চেহারায় যে ক্ষ্যাপামির ছাপ পড়েছে সেটা কি প্রেমিক পুরুষের লক্ষণ? ঠিক বুঝতে পারছিল না চপলা, তবে একজন পুরুষ মানুষের ভিতরে যে এতটা ওলট-পালট সম্ভব এটা তার ধারণায় ছিল না। কাল শচীনকে দেখে কেন যেন তার একটু ভয় হল। একটা ঝড় সে তুলেছে কিন্তু সামাল দিতে পারবে তো? পুরুষরা যখন এরকম আমূল উন্মাদ হয়ে ওঠে তখন কি সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়? যদি দেয় তবে চপলা কী করবে?

চপলার শরীর সম্পর্কে শুচিবায়ু কেটে গিয়েছিল কৈশোরেই, যৌন সংসর্গ ঘটেনি ঠিকই, তবে স্পর্শদোষ ঘটেছিল। আজও তেমন শুচিবায়ু নেই। কিন্তু সংস্কার কাজ করে। কনককান্তির প্রতি তার বিরাগ নেই, অনুরাগও নেই। আছে থাক না, এরকম মনোভাব। শচীনের প্রতিও যে সে কোনো বাঁধন-ছেঁড়া আকর্ষণ অনুভব করে তাও নয়। সে শচীনকে অন্যরকমভাবে চেয়েছিল। একজন রূপমুগ্ধ ভক্ত। অঢেল প্রশংসাবাক্য, চাটুকারিতা আর মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে প্রতিদিন বিধৌত করে দেবে তাকে। কিন্তু খুব কাছে আসবে না, অন্তত সে রকম সাহস হবে না। চপলাও দাক্ষিণ্য দেখাবে বৈ কি! কখনো-সখনো দু-একটা স্তোক, একটু-আধটু দৃষ্টির প্রসাদ, সামান্য হাসির দাক্ষিণ্য। সেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। সে ক্ষেত্রে বিশাখার বর হলেও শচীনের সঙ্গে তার নির্দোষ অথচ গোপন একটা ইঙ্গিতময় সম্পর্ক থেকে যেত।

কিন্তু তা হল না। হিসেবে ভুল হয়েছিল চপলার। শচীনকে সে ঠিকমতো জরিপ করে নেয়নি। যতটা নিরীহ, ভীতু আর ঠাণ্ডা মাথার মানুষ বলে মনে হয়েছিল ততটা শচীন নয়। তার ভিতরটা আগ্নেয়গিরির মতো টগবগ করে ফুটছে। চপলা সেই আঁচ টের পাচ্ছে আজকাল। শচীন যদি এতটা উন্মত্ত না হত তাহলে তাদের মধ্যে এত তাড়াতাড়ি, এত অল্প সময়ের মধ্যে এরকম অবৈধ প্রণয় ঘটে উঠত না।

এখন চপলা কী করবে তা বুঝতে পারছে না। কিছুতেই বুঝতে পারছে না। চৌকাঠের বাইরে পা বাড়ালেই ফেরার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। আর ফিরতে কি কোনোদিন ইচ্ছে করবে না চপলার? সে মেয়েমানুষ। চিরকাল মেয়েমানুষেরা নিরাপদ ঘরের আশ্রয়, পুরুষের ছায়ায় নিরাপত্তা খুঁজে এসেছে। সেও তো ব্যতিক্রম নয়।

বৃষ্টির ইলশেগুঁড়ি ছাট আসছিল, তবু রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়াল চপলা। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটায় শরীর শিরশির করছে। সূতীর চাদরটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নেয় সে। ভেজা রেলিং হাতে ছ্যাঁক করে শীতল শিহরন তোলে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে জলের চাদরে ঢাকা বাগানটা দেখে সে। কিন্তু ভিতরে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না।

চপলা আস্তে আস্তে বারান্দা ধরে এগোলো। আজকাল বিশাখা আলাদা ঘরে থাকে। কৃষ্ণকান্তও আলাদা ঘরে। কৃষ্ণকান্ত আজকাল ধ্যানট্যান করে।

বিশাখার ঘরের ভেজানো দরজার বাইরে চোরের মতো এসে দাঁড়ায় চপলা। মেয়েটা বড় সুন্দরী, কিন্তু সে রকমই সাঙ্ঘাতিক মুখরা আর অহংকারী। শচীনের সঙ্গে চপলার নতুন সম্পর্কটা তৈরি হওয়ার পর থেকে কিন্তু বিশাখার আর সেই তেজ নেই। ওর চোখের কোলে আজকাল প্রায় সবসময়েই জলের দাগ লক্ষ করা যায়। সারাদিন নিজের ঘরেই বসে থাকে। বেশীরভাগ সময়ে দরজা বন্ধ। হয়তো ঘরে বসে কাঁদে, ভাবে। ইদানীং বিশাখাও ভারী রোগা হয়ে গেছে।

চপলা দরজাটা খুব সামান্য ঠেলল। খুলল না। পুরোনো পুরু কাঠের দরজা। সহজে খোলার নয়। খড়খড়ি সামান্য একটু তুলে ভিতরটা দেখতে চেষ্টা করল চপলা।

ঘরটা আধো অন্ধকার। তবে উত্তর দিককার একটা জানালা খোলা। সেটা দিয়ে মেঘলা আকাশের একটু ফ্যাকাসে আলো এসেছে ঘরে।

সেই জানালায় চুপ করে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশাখা। শরীর যেন প্রাণহীন, স্পন্দনহীন, সংজ্ঞাহীন।

চপলা অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। কিন্তু বিশাখা একটুও নড়ল না। এক চুলও না। শুধু এলানো চুল বাতাসে পিঠময় গড়িয়ে যাচ্ছে।

দৃশ্যটা দেখে কয়েকদিন আগে চপলার এক ধরনের হিংস্র আনন্দ হতে পারত। আজ হল না। আজ সামান্য একটু মোচড় দিল বুকের মধ্যে। মেয়েটা অহংকারী, মেয়েটা ঝগড়াটে, সন্দেহ নেই কিন্তু এখন যে ওর এই বোবা একটা ভাব, ওই যে পাথর হয়ে যাওয়ার মতো ভঙ্গি, এটা যেন ওর যথার্থ পাওনা নয়। শচীনের প্রতিশোধ কতটা সাঙ্ঘাতিক হতে পারে এটা বোধ হয় বোকা মেয়েটা আগে বুঝতেও পারেনি।

চপলা হঠাৎ দরজাটা ধরে টানল। বেশ জোরে। পাল্লা দুটো খটাং শব্দে খুলে গেল। খুব আস্তে মুখটা ফেরাল বিশাখা। দুটো বড় বড় চোখে নিষ্পলক দৃষ্টি। কিন্তু বিস্ময় নয়। কেমন শূন্য।

চপলা ঘরে ঢুকে দরজাটা আটকে দিল।

তোর সঙ্গে কথা আছে।

বিশাখা খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে, যেন কষ্টে চিনতে পারল চপলাকে। কিন্তু নড়ল না। ওখান থেকেই বলল, তুমি এখন যাও বড় বউদি, আমার কিছু ভাল লাগছে না।

চপলা কথাটা গায়ে মাখল না। তারও মনের অবস্থা এমন যে, ছোটোখাটো অপমান তার গায়ে লাগে না আজকাল। অনেক সময়ে বুঝতেই পারে না, কোনটা অপমান, কোনটা নয়।

চপলা বিশাখার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জানালা দিয়ে উত্তরে নদীর প্রলয়ঙ্করী চেহারার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বিশাখা যেন বা চপলার ছোঁয়াচ বাঁচাতেই একটু সরে যায়।

চপলা চাপা গলায় বলে, তোর কী হয়েছে?

কিছু নয়। তুমি যাও।

শোন, তাড়িয়ে দিস না। আমার সত্যিই কথা আছে।

আমি কিছু শুনতে চাই না। বিশাখা মাথা নেড়ে বলল। কিন্তু তার গলায় রাগের ঝাঁঝ নেই। দুটো বড় বড় চোখ হঠাৎ টলটল করে ভরে উঠল জলে।

চপলা খুব দ্রুত চাপা গলায় বলে, আমি না হয় খারাপ। খুব খারাপ। আমার চরিত্র ধরলাম ভীষণ নোংরা।

ও সব বলছ কেন? বোলো না। পায়ে পড়ি। ও সব থাক।

শোন বিশাখা, শোন।

না। বলে বিশাখা দু হাতে কান চাপা দিয়ে বলে, ও সব শুনতে চাই না।

কেমন একটা মরীয়া আবেগে চপলা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বিশাখার দু হাত চেপে ধরে রুদ্ধ গলায় বলল, শোন, শোনাটা ভীষণ দরকার।

বিশাখার দুচোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছিল। ঠোঁট কাঁপছে। তারপরই হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে ওঠে সে। মাথা নেড়ে বলে, কেন এরকম করলে বউদি? কেন এরকম হয়ে গেলে? কৃষ্ণ যে তোমাকে মায়ের মতো ভালবাসে!

এ কথায় চপলা কেমন যেন বিকল হয়ে যায়। কৃষ্ণ! কৃষ্ণ তার দেওর। ছোটো, এখনো অবুঝ। এই বালক দেওরটিকে কেন যে সে এত ভালবাসে। শুধু ভালবাসা নয়, কৃষ্ণর মধ্যে এক অদ্ভুত সম্মোহনকারী আকর্ষণ আছে। মনে হয় একদিন ছেলেটা মস্ত কিছু হয়ে উঠবে। তাই ভালবাসার সঙ্গে কৃষ্ণর প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাবও আছে চপলার। কিন্তু কৃষ্ণর কথাটা হঠাৎ বিশাখা কেন তুলল তা সে বুঝল না।

চপলা বিশাখার হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে বলে, শচীনকে তো তুই দু চোখে দেখতে পারিস না।

বিশাখা দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। জবাব দিল না।

চপলা ফের জিজ্ঞেস করল, তাহলে তোর এই অবস্থা কেন?

বিশাখা জবাব দিল না এ কথারও।

চপলা বলল, আমি খারাপ তো বলছিই। আমার খারাপ হওয়ার কারণ আছে। তুই বুঝবি না। নিজের দোষ আমি ঢাকতেও চাই না। কিন্তু আমি জানতে চাই, তোর কী হল? তুই কেন এরকম করছিস?

জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা বিশাখার নয়। সে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ল। তার পর কান্নার বাঁধ ভেঙে দিল।

অনেকক্ষণ চুপ করে দৃশ্যটা দেখল চপলা। কিন্তু আর বিশাখার কাছে যাওয়ার উৎসাহ বোধ করল না।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিল সে।

ধীরে ধীরে কিন্তু মোটামুটি দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে সে হেমকান্তর ঘরের সামনে এল।

হেমকান্তর দিবানিদ্রা নেই বড় একটা। ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে রবীন্দ্রনাথের একখানা বই পড়ছেন।

চপলা ডাকল, বাবা।

হেমকান্ত কিছু বিস্মিত চোখ তুলে বললেন, বলো।

আমি কাল কলকাতা যেতে চাই। ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?

হেমকান্ত নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, কালই যেতে চাও? কিন্তু দিনটা দেখতে হবে। পুরুতমশাইকে খবর পাঠিয়ে পাঁজিটা দেখতে বলে দাও তো।

পাঁজি দেখতে হবে না বাবা। কাল দিন শুভ। আমি জানি।

দেখেছো?

দেখেছি। আপনি শুধু একজন কাউকে সঙ্গী দিলেই হবে।

তার আর ভাবনা কি? খাজাঞ্জিমশাই যেতে পারবেন।

ভাল। আর একটা কথা বাবা, আমি যে কাল যাচ্ছি সেটা যেন গোপন থাকে।

কেন বলো তো!

কথাটার জবাব চপলা ভেবে আসেনি। হেমকান্ত এরকম প্রশ্ন করবেন বলে আশাও করেনি। সে তাই কথাটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বলল, আপনার ছেলেকে একটা টেলিগ্রাম করে দিলে ভাল হয়। স্টেশনে থাকতে পারবে।

সে তো ঠিক কথা। দেওয়া যাবে। তুমি গিয়ে গোছগাছ করো।

চপলা ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ফিরে আসে। বুকটা কেমন করছে। বুকটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে একটা পাষাণভারে।

ছেলে মেয়ে দুজন একে একে ঘুম থেকে উঠল। তাদের যান্ত্রিকভাবে সাজিয়ে দিল চপলা। খাইয়ে খেলতে পাঠাল ছাদের ঘরে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হল।

চপলা এ সময়ে একবার কাছারির দিকে উঁকিঝুঁকি দেয় রোজ। আজ দিল না। শচীনের জন্য জলখাবার পাঠানো আজকাল তারই কাজ। কিন্তু সে উঠল না। দাসীরা যা ভাল বুঝবে সাজিয়ে দেবে।

অন্ধকার ঘরে সেজ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে একজন চাকর। বাতিটা কমিয়ে মশার শব্দের মধ্যে চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকে চপলা। বাইরে বৃষ্টির জোর বাড়ছে। বাদলা বাতাস হঠাৎ ঘরে ঢুকে চারদিকের জিনিসপত্রে একটা শব্দ তুলে চলে গেল। সেজবাতি লাফিয়ে চিমনিতে কালি ফেলতে লাগল। দরজা বন্ধ করতে উঠল না চপলা।

সন্ধে পার হওয়ার মুখেই বোধ হয় আচমকা দরজায় শচীনের লম্বা ফর্সা চেহারাখানা দেখে একটু চমকে উঠেছিল চপলা।

এত সাহস শচীন কোনোদিন করেনি। তাদের দেখা হয় নিচের তলায় পিছন দিককার একটা ঘরে। দোতলা অন্দরমহল। এখানে যার-তার উঠে আসবার অধিকার নেই।

চপলা বুঝল, শচীন এখন সত্যিই পাগল।

শচীন জিজ্ঞেস করল, আজ দেখা নেই কেন? এতক্ষণ নিচে অপেক্ষা করলাম।

আজ আমার শরীর ভাল নেই।

কী হয়েছে?

জ্বর।

জ্বর! তাতে কী? একটা খবরও তো পাঠানো যেত।

আমার জ্বর তাতে আপনাকে খবর দেবো কেন? আপনি তো ডাক্তার নন। উকিল।

ওটা আবার কেমন কথা চপলা? বলে শচীন ঘরে ঢুকল। দু পা এগিয়ে এসে বলল, আজ কি মুড ভাল নেই?

চপলা শচীনের দিকে চেয়ে বলল, আপনার সত্যিই মাথার ঠিক নেই।

কেন বলো তো!

দোতলায় উঠে এসেছেন! লোকে কী ভাববে?

ভাবুক না। ভাবুক, বলুক। আমার কিছু যায় আসে না।

যায় আসে না কেন?

আমি যে পাগল! তুমিই বলেছো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *