একদিন বিকেলে দুই বুড়োর দেখা হল গাছতলায়। মহানিমের বড় গাছ। বাগানের দক্ষিণ দিকে একটা পরিষ্কার জায়গায় গাছটা পুঁতেছিল মল্লিনাথ। তখন বন মহোৎসবের খুব ধুম। এখন সেই গাছের তলাটা বাঁধিয়ে দিয়েছে তৃষা। বিকেলের দিকে চমৎকার বসার জায়গা। দক্ষিণ দিকটা ফাঁকা রাখার জন্য ওপাশে অনেকটা জমি কিনে নিয়েছিল মল্লিনাথ। সে জমি তৃষার আমলে আরও বেড়েছে। শীতের সবজির চাষ হয়। এমনিতে ভুইকুমড়ো, না হয় চিচিঙ্গে এমনি কিছু না কিছু সর্বদাই ফলছে। তবে তাতে দৃষ্টির ব্যাঘাত হয় না। গাছতলায় বসলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। উদাস হয়ে বসে থাকা যায় অনেকক্ষণ।
শ্রীনাথ বসতে এসে দেখল জায়গাটায় আর একজন বসে। তার বাবা দীননাথ।
দীননাথের সঙ্গে শ্রীনাথের বহুকাল দেখা নেই। তাই দীননাথ হাঁ করে ছেলেকে দেখলেন অনেকক্ষণ। এই কি তার মেজো ছেলে শ্রীনাথ? হরি হে! গাল তোবড়ানো, মাথার শেষ ক’গাছি চুল শনের নুড়ি, চোখ ঘোলাটে। এটা কি শ্রীনাথ, সত্যি?
বাবা। ভাল আছেন তো?
ভালই। কিন্তু তোমাকে তো ভাল দেখছি না। কী হয়েছে? সবাই বলে বটে তোমার অসুখ করেছে। কিন্তু কী অসুখ বলে না।
স্ট্রোক মত হয়েছিল একটু। সেরে গেছে।
সাবধানে থেকো। তোমার স্ট্রোক হওয়ার বয়স তো নয়!
ঠিক স্ট্রোক নয়। জানি না। ডাক্তাররা কিছু স্পষ্ট করে বলে না।
বলবে কী! জানেইনা। আজকালকার ডাক্তাররা সব পেনিসিলিন চিনেছে। যাই হোক দেয় ঠুকে। মরলে মরল, বাঁচলে বাঁচল। দু’মাসের বাচ্চা থেকে আশির বুড়ো অবধি সবাইকে এক ওষুধ। বোসো, ভাল করে পা তুলে বোসো। চাদরে হাঁটু ঢেকে নাও, যা মশা এদিকটায়!
শীতকালে একটু মশা হয়।
বুলুর বাড়িতে মশা ছিল না। শীতটা কলকাতায় এত চেপে পড়েও না। এই দুটো মাস ওর কাছে থেকে আসতে পারলে ভাল হত। কতকাল আসে না ছেলেটা।
শ্রীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, বাবা, আমাকে একটু শাসন করবেন তো মাঝে মাঝে।
শাসন!–বলে দীননাথ হাঁ করে শ্রীনাথের দিকে চেয়ে থাকেন, শাসন করব! বলো কী!
কেন, সেই যে ছেলেবেলায় যেমন করতেন!
সে তখন ছোট ছিলে করেছি। এখন আবার শাসনের কথা ওঠে কীসে?
শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, ঠিক শাসন নয় বটে। মানে কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় তা তো বুঝতাম না তখন। আপনি বা মা বলে দিতেন। আমার এখন আবার তেমনি ইচ্ছে করে। কোনটা ধর্ম কোনটা অধর্ম সব একজন কেউ এসে চিনিয়ে দিক।
তোমার কথাবার্তা ভারী উল্টোপাল্টা লাগছে। এসব তো এখন তুমি নিজেই বুঝে নেবে।
বুঝতে পারছি না বলেই বলছি। আমাকে সৎ পরামর্শ দেওয়ার কেউ নেই। অথচ আয়ুও তো ফুরিয়ে এল।
বলো কী? এর মধ্যে আয়ু ফুরোনোর কী হল?
বাঃ! আমাকে স্লো পয়জন করা হচ্ছে না?
পাগল হয়েছ! বউমাকে ডেকে সব কথা খুলে বলো। উনি বুঝবেন। আমি এসব বুঝতে পারছি না।
শুনুন! সজল আমার ছেলে। ছেলে তো?
সজল তোমার ছেলে নয় তো কার?
শ্রীনাথ ওপর-নীচে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে, আমারই। কিন্তু লোকে নানা কথা বলে মাথা ঘুলিয়ে দেয়।
লোকে মাথা ঘুলিয়ে দেবে কেন? কারা তারা?
আছে চারদিকে। আপনি শুধু বলুন, সজল আমার ছেলে?
তোমার ছেলেই তো!
সজলকে আমিও সেই কথা বলেছি। রোজ বলি। তুই আমার ছেলে।
ওসব কথা ভেবো না। মরার কথাও নয়। বুড়ো বয়সে আর-একটা পুত্রশোক আমার সহ্য হবে না। তুমি আজকাল চাকরিতে যাচ্ছ না?
আনমনে শ্রীনাথ কপিক্ষেতের ওপরে স্থির থম-ধরা বাতাসে ধোঁয়ার একটা ভাসন্ত স্তরের দিকে চেয়ে ছিল। চোখ না ফিরিয়েই বলল, আপনার বউমা বলছে আমাকে দূরে এক জায়গায় পাঠাবে। সেখানে চাষবাস দেখব। একা থাকব।
তুমিও তাই চাও নাকি?
আগে চাইতাম। আজকাল দূরে যেতে ভয় করে।
চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছ?
না। তবে ছাড়তে তো সময় লাগবে না।
এ বাজারে চাকরি দুষ্প্রাপ্য। ভেবেচিন্তে ছেড়ো।
চাকরিটা কোনও প্রবলেম নয়।
এবার দীননাথ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, প্রবলেম যে কী তাই তো মাথায় ঢোকে না। আমাদের আমলে জীবন ছিল সরল। সব বোঝা যেত। তোমাদের আমলে যত পাচঘোচ।
শ্রীনাথের চাদরে একটা কাক নোংরা ফেলেছে। সে ওপর দিকে চেয়ে বিশাল গাছটা দেখছিল। দাদা মল্লিনাথ এ গাছটা উপড়ে এনেছিল তায়েব নামে একটা লোকের উঠোন থেকে। তায়েব মল্লিনাথের মুরগি চুরি করেছিল, তারই পালটি। মল্লিনাথও পাগল কম ছিল না। বারো-চোদ্দোজন জোয়ান ধরাধরি করে শেকড়ছেড়া গাছটা এনে গর্ত খুঁড়ে দাড় করিয়ে দিল এখানে। বাঁচার কথা ছিল না, কিন্তু বেঁচে গেছে। এই গাছটা দিয়েই সেবার মল্লিনাথের বন মহোৎসব শুরু। তারপর বিস্তর গাছগাছালি লাগিয়েছিল। কিন্তু এই গাছটাকেই ভালবাসত সবচেয়ে বেশি। একটা মস্ত পাথর এনে ফেলেছিল তলায়। সেটার ওপর মাঝে মাঝে ঝুম হয়ে বসে থাকত এসে। বলত, এ হচ্ছে বিবেকানন্দ রক-এর মতো মল্লিনাথ রক। এখানে বসেই আমার একদিন রিয়ালাইজেশন হবে।
মহানিমের শুকনো পাতা একটি-দুটি খসে পড়ছে। ভারী সুন্দর তাদের পড়া। বাতাসে ঘুরপাক খায়, কখনও খাড়া হয়, কখনও আড় হয়। একটু ডাইনে বাঁয়ে হেলাদোলা করে। তারপর প্রজাপতির মতো অহংকার নিয়ে ঘাসের ওপর বা শানে বা শ্রীনাথের র্যাপারে আলগোছে বসে। বেশ লাগে দেখতে।
দীননাথ বললেন, আহ্নিকের সময় হল, উঠি।
হুঁ।–বলে শ্রীনাথ।
দীননাথ উঠলেন। উঠতে উঠতে বললেন, বুলু তোমার ছোট ভাই। তার এত বড় মিসহ্যাপ হয়ে গেল, তোমরা কেউ গেলে না!
মিসহ্যাপ? কিসের মিসহ্যাপ?
বউমার যে মরা বাচ্চা হল।
বেঁচেছে। জ্যান্ত হলে কষ্ট পেত। বড় কষ্ট বেঁচে থাকায়।
কী যে বলো সব, ঠিক নেই।
দীননাথ চলে যান।
চুপ করে বসে থাকে শ্রীনাথ। তার ডান দিকে বাড়ির ছাদের ওপর থেকে সূর্য পাটে বসে। ছায়া ঘনায়। শীত সাপের মতো শরীর বেয়ে উঠে আসে।
দুরে বেড়ার ওধারে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। এবার গলা খাঁকারি দিল। শ্রীনাথ তাকাল না।
একটু বাদে চাপা ডাক এল, শ্রীনাথবাবু! ও শ্রীনাথদা!
কে?— ম্লান স্বরে শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করে।
শুনুন না! এই বেড়ার ধারে আসুন একটু।
শ্রীনাথ চটিতে পা গলিয়ে ওঠে। ক্ষেতের জমি ডিঙিয়ে এগিয়ে যায়।
চিনতে পারছেন?
রঘু স্যাকরা না!
যাক বাবা বাঁচালেন। লোকে বলে শ্রীনাথ চাটুজ্জেকে ওষুধ করে মাথা বিগড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই ভয়ে ভয়ে ছিলাম।
কথাটা কী?
কথা আবার কী? এভাবে ফুর্তিবাজ মানুষ বাঁচে কখনও? চেহারায় তো সাতবুডোর ছাপ ফেলে দিয়েছেন।
শরীরটা ভাল নেই।
দিব্যি আছে। একটু চাঙ্গা হওয়া দরকার শুধু। দেখবেন তেড়েফুঁড়ে স্বাস্থ্য এসে যাবে। কোষ্ঠ পরিষ্কার হবে। চোখে জ্যোতি বাড়বে।
দুর!
আপনার মুখে দুর শুনলে বল মা তারা দাঁড়াই কোথা! চলুন না একটু চেখে আসবেন। ভাল না লাগলে মাথার দিব্যি দিয়েছে কে!
শ্রীনাথ রঘু স্যাকরার দিকে অর্থহীন চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার ভিতরে মদ খেয়ে ফুর্তি করার কোনও উৎসাহই নেই। তবু মনে হল, এই নেতিয়ে পড়ার হাত থেকে রেহাই মিলতেও পারে।
শ্রীনাথ ধুতির কেঁচাটা ভাল করে এঁটে হাঁচোর-পাঁচোর করে বাঁশের বেড়াটা ডিঙিয়ে গেল।
ষষ্ঠীতলায় ম্যাচ খেলে এক দঙ্গল ছেলে চৌমাথা দিয়ে ফিরছে। হাতে হাতে ক্রিকেটের সরঞ্জাম। ছ’জনের হাতে ছ’টা স্টাম্প, দু’জনের কাঁধে ব্যাট, একজন বলটা লুফছে। ছ’জনের হাতে ছ’টা প্যাড, তাই দিয়ে মাঝে মাঝে পেটাপেটি করছে নিজেদের মধ্যে আপসে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে সবাই। মাঝ বরাবর সকলের চেয়ে একমাথা উঁচু এবং দু’গুণ স্বাস্থ্যবান সজল। চোখে-মুখে আত্মপ্রত্যয় এবং গাম্ভীর্য। চাউনিতে কোনওরকম ভয়ের ছায়া নেই। দঙ্গল থেকে তাকে চোখের পলকে আলাদা করে চেনা যায়।
চৌমাথার বটতলায় গদাই নামে রোগা চেহারার একটা ছেলে বসে ছিল। দঙ্গলটাকে দেখেই সে দৌড়ে গেল।
সজল! সজল! তোর বাবাকে একটু আগে রঘু স্যাকরা নিয়ে গেল।
মুহূর্তে দঙ্গলটা ঘিরে ধরে গদাইকে, কোথায় নিয়ে গেল? কেন নিয়ে গেল?
গদাই উঁচু স্বরেই বলে, আমি ফলো করেছিলাম। স্টেশনের ওপাশে রামলাখনের বস্তিতে গিয়ে ঢুকল। রঘু স্যাকরা সজলের বাবার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ঢুকল।
সজলের মুখে ভ্রুকুটি। মুখ থমথম করছে। বাবার যে মাথাটার ঠিক নেই ইদানীং তা সে একটু-আধটু টের পায়। তবু বাবা অনেক ভাল হয়ে গেছে এখন। মদ খায় না, রাত করে ফেরে না। বাবার সঙ্গে তার এখন খুব ভাল সম্পর্ক।
চারদিকে দঙ্গলটায় ফিসফাঁস চলছে। সকলের চোখ সজলের দিকে। লিডার যা বলবে তাই হবে।
সজল হাত বাড়িয়ে একটা ছেলের হাত থেকে একটা স্টাম্প নিয়ে নিল। বলল, শালা রঘু স্যাকরা আবার আমার বাবাকে খারাপ করছে। দেখাচ্ছি শালাকে।
প্রশ্ন উঠল, রামলাখন যদি লাঠি নিয়ে বেরোয়?
সজল গম্ভীরভাবে বলে, ক’টা লাঠি আছে ওর? আমরা এতগুলো আছি কী করতে?
চল!
আর কেউ কথা বলে না। সজলের পিছু পিছু নিঃশব্দে সবাই এগোয়। একটু ভয় পাচ্ছে তারা। একটু দ্বিধা আছে। তবে সজল আছে সামনে। একটা মজাও তো হবে। রামলাখনের ঝোপড়ায় মদ বিক্রি হয়, মেয়েমানুষের নাচ হয়, তারা শুনেছে। জায়গাটা একবার দেখাও হবে। সজলের পাগলা বাপটা কী করে তাও দেখা যাবে।
স্টেশন পেরিয়ে খালটার ধারে নেমে একটু এগিয়ে দঙ্গলটা থেমে গেল।
সজল মুখ ফিরিয়ে বলল, বাইরে থাকিস। আসছি।
লক্ষ্মীছাড়া চেহারার একটা বাচ্চা মেয়ে এক পাল হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে উঠোনে ঢুকছিল। সজল তার পিছু পিছু ভিতরে পা দিল। কোথায় অনেকগুলো মুরগি ডাকছে কু কু করে। উঠোনের তিনদিকে তিনখানা মাটির ঘর। সব ক’টার চালেই লাউ ফলে আছে। উঠোনের এক কোণে গোটা দুই কাদামাখা মস্ত শুয়োর প্রাণপণে চিল্লাছে। চারদিকে বদ্ধ বাতাসে বিশ্রী পচা কটু একটা গন্ধ।
এক পলক চেয়েই কোন ঘরটায় বাবা আছে তা আন্দাজ করে নিল সজল। কোনও দ্বিধা এল না, বুক কাপল না, ভয় করল না, বরং অসহ্য রাগ আক্রোশে জ্বলতে জ্বলতে সে এক লাফে বারান্দায়। উঠে নিচু দরজাটা দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
ভিতরের দৃশ্যটা প্রথমে ভুতুড়ে বলে মনে হয়। নিবু নিবু টেমির আলোয় কিছুই দেখা যায় না। আবছা ছায়া-ছায়া জনা তিন-চার লোক বসে আছে চ্যাটাইতে।
সজল বোমাফাটানো গলায় গর্জন করল, বাবা!
লোকগুলো চমকে চায়। গেলাস থেকে মদ চলকে পড়ে।
কে রে বাবা ডাকে!—–কে যেন মোদো গলায় বলে।
একদম কাছেই চ্যাটাইয়ের ওপর বসে থাকা কুঁজো মানুষটা মুখ তুলে চেয়ে থাকে।
বাবা!–আবার গর্জন করে সজল।
কুঁজো লোকটা অবাক হয়ে বলে, সজল! এই তো আমি এখানে! আয়, কী চাস?
সজল হাতের স্টাম্পটা এত জোরে চেপে ধরে যে গাঁটগুলো ব্যথা করে ওঠে। সে হামাগুড়ি দিয়ে নিচু হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায়, কে তোমাকে এখানে এনেছে?
কেউ না। চল যাই।–বলে ওঠার চেষ্টা করে শ্রীনাথ। হাতের গেলাসটা সামনের লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এটা তুমিই মেরে দাও রঘু। আমার ছেলে এসে গেছে, আমি উঠি।
লোকটা খুব ছোট চোখে সজলকে নজর করছিল। ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করছে।
ওই লোকটা তোমাকে এনেছে, বাবা! রঘু স্যাকরা না?
আমাকে! আমাকে নিয়তি এনেছে। ও নিমিত্ত মাত্র।
কিন্তু তত্ত্বকথা শোনার মতো মেজাজ নেই সজলের। হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থাতেই সে হাত বাড়িয়ে লোকটার র্যাপার গলার কাছে মুঠো করে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে খাড়া দাড় করাল। পরমুহূর্তেই ফটাস করে তার হাতের স্টাম্পটা লোকটার হাঁটু ভেঙে দিল প্রায়।
বাইরে এসো শালা, এসো বাইরে! দেখাচ্ছি।
রামলাখন অদূরেই দাঁড়িয়ে। স্থির চোখে দেখছে। কিন্তু খদ্দেরকে বাঁচাতে সে এক পা-ও এগোল, একটি শব্দও করল না। জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা-বলে সে বিপজ্জনক মানুষকে চিনতে পারে আজকাল। শ্রীনাথবাবুর এই ছেলেটা যদিও বাচ্চা কিন্তু এর চেহারাই বলে দিচ্ছে যে, এ একদম খুনি। রেগে গেলে দুনিয়া ওলট-পালট করে দিতে পারে।
রঘু চেঁচাচ্ছে, এ কী! এ কী! এসব কী হচ্ছেটা কি? বাবারে! ওফ! হাঁটুটা ভেঙে গেছে। উরে বাবা!
শ্রীনাথ হতবাক, স্তম্ভিত। সজল রঘুকে মারছে! আঁ! সজল রঘুকে মারছে! এত বড় লোকটাকে অতটুকু ছেলে!
রঘুকে বারান্দায় টেনে আনল সজল। তার গায়ের জোর রাগের ঠেলায় এখন তিনগুণ। রঘু টালমাটাল। বারান্দায় এনে স্টাম্পটা আর একবার চালায় সজল। লাগে গোড়ালির কাছ বরাবর।
রঘু উবু হয়ে গোড়ালি চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলে, কেন মারছিস রে বারোভাতারির পুত? কোথাকার পেল্লাদ এলি?
সজল একটা লাথি কষাতেই কাত হয়ে গেল রঘু। মাজা চেপে ধরে উপুড় হয়ে গোঁ গোঁ করতে লাগল।
শ্রীনাথের সংবিৎ এল এতক্ষণে। বেরিয়ে এসে দৃশ্যটা ক্ষণেক দেখেই ভারী রাগ হয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে আচমকা ঠাস করে এক চড় বসাল ছেলের গালে, খুব গুন্ডামি শিখেছিস! আঁ! কে এসব করতে বলেছে তোকে?
সজল বাবার দিকে মুখোমুখি তাকায়। গম্ভীর হয়ে বলে, তুমি এখানে এসেছ কেন?
কেন, এলে কী? কী করবি তোরা?–রুখে উঠে শ্রীনাথ বলে।
সজল এ কথার জবাব দেয় না। বন্ধুরা ফটকের বাইরে থেকে দেখছে। সে ওদের হাতের ইশারায় এগিয়ে যেতে বলে একটু অপেক্ষা করে। তারপর বাবার একটা হাত শক্ত করে ধরে বলে, বাড়ি চলল।
রঘু উঠে বসে মাজা ধরে হাঁফাচ্ছে। বলল, দেখলেন তো, দাদা! দরকারে যেন সত্যি কথাটা বলবেন।
নিঃশব্দে সজল ঘুরে কয়েক পলক রঘু স্যাকরার দিকে চেয়ে থাকে।
সজল ছোকরাটাকে এতদিন ভাল করে লক্ষ করেনি রঘু। আজ চোখের দিকে চেয়ে হিম হয়ে গেল সে। দিনান্তের ফ্যাকাসে আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাই যথেষ্ট। এই কলমের চারাটিকে যদি কেউ শিগগির নিকেশ না করে তবে রতনপুরের কপালে কষ্ট আছে। তৃষা তো এর কাছে ছেলেমানুষ।
কিন্তু সজলকে রঘুর দিকে এগোতে দিল না শ্রীনাথ। ধমক দিয়ে বলল, কান ছিড়ে ফেলব বাঁদরামি করলে। তুমি যে এত মাথায় উঠেছ তা আগে জানলে বেতিয়ে লাল করতাম। চলো বাড়ি।
শ্রীনাথ সজলের মধ্যে ভয়ংকর কিছুই দেখতে পায় না, যা রামলাখন দেখছে, রঘু দেখছে। তার কাছে সজল এখনও প্রায় কোলের ছেলে, অবোধ, দুষ্টু। ছেলেকে বকতে বকতে সে ছেলের হাত ধরেই রাস্তায় ওঠে। সজল সাবধানে বাবাকে রেললাইন পার করায়। তারপর রিকশা ডাকে।
সারা রাস্তা সজল একটাও কথা বলল না। শ্রীনাথ একতরফা মাঝে মাঝে রুখে উঠে তাকে বকাবকি করে গেল।
শ্রীনাথকে ভাবন-ঘরে পৌঁছে দিয়ে সজল বলল, আমি মাকে খবর দিতে যাচ্ছি।
শ্রীনাথ মুখ ভেঙিয়ে বলল, যাচ্ছি! যাও না! মাথা কিনে রেখেছে নাকি সবাই আমার?
সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। গন্ধক পোড়ানোর গন্ধে উঠোনের বাতাসটা ভারী। মেজদি শাখে ফু দিল পুবের ঘরে। সজল নিঃশব্দে মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়াল।
প্লাস পাওয়ারের চশমা চোখে দিয়ে তৃষা কিছু কাগজপত্র দেখছে।
মা!
গম্ভীর তৃষা মুখ তুলে বলে, বলো।
বাবা আজ আবার রামলাখনের বস্তিতে গিয়েছিল।
তৃষা তেমন চমকাল না। অবাকও হল না। যেন একটু চিন্তিত মুখে চেয়ে বলল, তোকে কে। বলল?
আমি গিয়ে ধরে আনলাম।
এবার তৃষা অবাক হয়ে তাকায়, তুই গিয়ে ধরে আনলি?
হ্যাঁ। গদাইয়ের কাছে খবর পেয়ে বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিলাম।
তৃষা সত্যিকারের রেগে যায়। থমথমে মুখ করে বলে, ওসব নোংরা জায়গায় যেতে কে তোকে বলেছিল?
বাবা যখন যেতে পারে তখন আমার যেতে দোয কী?
মুখে মুখে কথা বলছিস! খুব সাহস হয়েছে?
সজল চোখ নামিয়ে নেয়। মৃদু স্বরে বলে, আমি তো বাবাকে আনতে গিয়েছিলাম।
ঠিক কাজ করোনি। খবরটা আমাকে দিলে যা ব্যবস্থা করার আমিই করতাম। আর কখনও ওসব জায়গায় যেয়ো না।
বাবার জন্য ব্যবস্থা মা কোনওদিনই করেনি, কিন্তু সে কথা তুলল না সজল। একটু ইতস্তত করে বলল, রঘু স্যাকরা বাবাকে নিয়ে গিয়েছিল।
তৃষা একটু কি চমকে উঠল? কিন্তু স্বাভাবিক গলাতেই বলল, ঠিক আছে, খোঁজ নিয়ে দেখব। তুমি এখন যাও।
আমি কিন্তু রঘু স্যাকরাকে মেরেছি।
তৃষা এবার বাস্তবিকই চোখে পড়ার মতো চমকে ওঠে, কী বললি?
তুই মেরেছিস? দরজার বাইরে আবছা অন্ধকারে সজলের লম্বাটে এবং চওড়া চেহারার ছায়াটার দিকে তাকিযে হঠাৎ যেন তৃষার শরীর কেঁপে ওঠে শীতে। ভয়েও কি?