প্রতিদিন সকালবেলা বাধ্য, সুশীল ছাত্রের মতন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পাঠ নিতে বসে অরবিন্দ। সে শিক্ষা করছে মাতৃভাষা। দীনেন্দ্রকুমার রায়কে আনানো হয়েছে কলকাতা শহর থেকে, যদিও শিক্ষকতার কোনও অভিজ্ঞতাই তার নেই। দীনেন্দ্রকুমার এক দরিদ্র বাঙালি লেখক, কলকাতার কল-কোলাহল ও সাহিত্য-পরিবেশ ছেড়ে এই নিস্তরঙ্গ বরোদায় এসে পড়ে থাকার কোনও বাসনা তার ছিল না, কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। বাংলা গল্প-প্রবন্ধাদি লিখে পয়সা পাওয়া যায় না, তাই বাধ্য হয়ে গৃহ-শিক্ষকতার কাজ নিতে হয়েছে। এমন ছাত্র পাওয়াও অবশ্য ভাগ্যের কথা। ছাত্রটি মাস্টারের থেকে অনেক বেশি জ্ঞানী এবং স্বয়ং একজন অধ্যাপক। বরোদা রাজ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে এর মধ্যেই অরবিন্দর বেশ নাম ছড়িয়েছে।
ছাত্র হিসেবে অরবিন্দ শুধু যে মনোযোগী তা-ই নয়, অতি খুঁতখুঁতে। বাংলা তার মাতৃভাষা হলেও শৈশব থেকেই সে মাতৃসঙ্গ বঞ্চিত, এই ভাষাতে সে কথা বলতেও পারে না। কিন্তু এখন সে উত্তমরূপে বাংলা শেখার জন্য বদ্ধপরিকর। এক একখানি বাংলা বই ধরে ধরে সে প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝে নিতে চায়।
আজ সকালে পড়ানো হচ্ছে দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’। তার এক জায়গায় রয়েছে একটি রসের ছড়া :
মদের মজাটি গাঁজা কাটি কচকচ
মাসীর পিরীতে মামা হ্যাঁকচ প্যাঁকচ…
দীনেন্দ্রকুমার ছড়াটি পড়ে শোনাতেই অরবিন্দ জিজ্ঞেস করল, হোয়াট ইজ হ্যাঁকচ প্যাঁকচ?
দীনেন্দ্রকুমার মুচকি হেসে বলল, সব কথার অনুবাদ হয় না। ওটা বুঝে নিতে হবে। বুকে হাত বুলালেই টের পাওয়া যায়।
অরবিন্দ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, রঙ্গরসিকতার বিশেষ ধার ধারে না। সে বলল, প্রত্যেকটি শব্দেরই নিশ্চয়ই একটা কিছু অর্থ থাকবে। কেন অনুবাদ করা যাবে না?
ছাত্রের ধমক খেয়ে শিক্ষক প্রথমে মাথা চুলকে বলল, হ্যাঁকচ প্যাঁকচ মানে, ইয়ে, মানে…। তারপর দীনেন্দ্রকুমার এক গেলাস জল পান করে গোঁফ টানতে টানতে বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁকচ প্যাঁকচ ইজ, ইজ, ইট মিনস, নাঃ মশাই, এর ইংরিজি করা আমার বাপের সাধ্যেও কুলোবে না। অনেক বাংলা কথা আছে, তার ইংরিজি হয় না।
অরবিন্দ জিজ্ঞেস করল, যেমন, যেমন? আর কোন বাংলা কথার ইংরেজি হয় না?
দীনেন্দ্রকুমার বলল, যেমন ধরুন আড্ডা, গুলতানি। ইংরেজরা আড্ডাও দেয় না, এর ইংরিজিও হয় না! আমাদের স্ত্রীলোকরা কথায় কথায় অভিমান করে, মেমসাহেবদের অভিমানের বালাই নেই, তাই ‘অভিমান’ শব্দটার ইংরিজিও কখনও শুনিনি। তারপর ধরুন, ন্যাড়া নেড়ীদের ধেই ধেই নেত্য! এই ধেইধেইয়ের কী ইংরেজি করব বলুন!
অরবিন্দ তবু ভুরু কুঁচকে বলল, বাট আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইজ হ্যাঁকচ প্যাঁকচ!
বাইরের বারান্দায় বসে শীতের রোদ পোহাতে পোহাতে বারীন্দ্র একটা বাংলা নভেল পড়ছিল। সে হো-হো করে হেসে উঠল।
দীনেন্দ্রকুমার বলল, আপনি পিরীত কথাটার মানে বুঝেছেন তো? কারুর সঙ্গে পিরীত হলে তবেই ওই কথাটার মানে বোঝা যায়। আপনি বরং এক কাজ করুন, এবারে ঝটপট একটা বিয়ে করে ফেলুন!
এ কথায় ক্রুদ্ধ, বিরক্ত বা লজ্জিত হল না অরবিন্দ। সোজাসুজি দীনেন্দ্রকুমারের চোখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বলল, নট এ ব্যাড আইডিয়া। আমি বিবাহের জন্য মনস্থির করে ফেলেছি।
দীনেন্দ্রকুমার বলল, খুব ভাল কথা। দেখেশুনে একটি বুদ্ধিমতী বাঙালি মেয়েকে ঘরনি করে আনুন, দিব্যি গড়গড় করে বাংলা শিখে যাবেন। মাস্টার রাখার আর দরকার হবে না।
অরবিন্দ একটুক্ষণ নীরব হয়ে রইল। নিজের জীবন সম্পর্কে তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। এই একটি দেশীয় রাজ্যে সারাজীবন অধ্যাপনা করে কাটিয়ে দেবার বিন্দুমাত্র বাসনা তাঁর নেই। ভারতের রাজধানী সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র, সেখানে একসময় তাকে পৌঁছতেই হবে। তার আগে প্রস্তুতির প্রয়োজন। আপাতত জীবনের এই পর্বে তাকে সংসারী হতে হবে, নারীবিহীন সংসার সংসারই নয়।
কিন্তু কে তার বিবাহের ব্যবস্থা করবে? পিতা নেই, মা থেকেও নেই, মাতামহ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, পিতৃ-মাতৃকুলের আর কারুর সঙ্গে বিশেষ সংস্রব রাখেনি অরবিন্দ, তার দুই দাদাও খোঁজখবর নেয় না। এ তো আর ইংল্যান্ড নয় যে নাচের আসরে রূপসী যুবতীদের সঙ্গে পরিচয় হবে, বিশেষ কোনও একজনকে পছন্দ হলে তার সঙ্গে কোর্টশিপ চলবে কিছুদিন, তারপর একদিন বিবাহের প্রস্তাব। মাঝখানে কোনও তৃতীয় ব্যক্তি থাকে না। কিন্তু এ দেশে তো সে সুযোগ নেই, অবিবাহিতা তরুণীরা সব গৃহবন্দিনী, এ দেশের দুজন নারী-পুরুষ বিবাহ করে না, তাদের বিবাহ দিতে হয়। ইংল্যান্ডে থাকার সময় এডিথ আর এস্টেল নামে দুটি রমণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তাদের যে-কোনও একজনকে অনায়াসে জীবনসঙ্গিনী করে নেওয়া যেত, কিন্তু অরবিন্দ তখনই ঠিক করে নিয়েছিল, ইংল্যান্ড নয়, ভারতই তার যোগ্য স্থান, সুতরাং কোনও ভারতীয় নারীই হবে তার স্ত্রী।
বারীন্দ্র বই মুড়ে রেখে ঘরের মধ্যে এসে সাগ্রহে বলল, সেজদা, আপনি বিয়ে করবেন? এখানে আসার আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম, বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে একদিন চায়ের নেমন্তন্ন ছিল। সে বাড়িতে একটি মেয়েকে দেখেছি, অতীব সুশ্রী, লেখাপড়ায় নাকি ফার্স্ট হয়, ভাল গান জানে, তরতরিয়ে ইংরিজিতে কথা বলতে পারে। তাকে দেখেই মনে হয়েছিল, আহা, এই মেয়েটি আমার সেজোবউদিদি হলে বেশ মানাত। এতদিন ভয়ে এই কথাটা আপনাকে বলতে পারিনি। চলুন না, একবার সবাই মিলে কলকাতায় তাকে দেখতে যাই। ব্রাহ্মবাড়ির মেয়ে, নিঃসঙ্কোচে সামনে কথাবার্ত বলতে পারে।
অরবিন্দ ওষ্ঠ বক্র করে বলল, ব্রাহ্ম? ওই যারা পায়ে মোজা পরে হাঁটে, পিয়ানো বাজায়, নকল গলায় কথা বলে, ভাসা ভাসা প্রণয়ের ভাব করে, ওই সকল মেয়ে আমার দু চক্ষের বিষ! কোনও ব্রাহ্ম মেয়েকে আমি কদাচ বিবাহ করব না।
বারীন্দ্র অবাক হয়ে বলল, কিন্তু আমরাই তো ব্রাহ্ম।
অরবিন্দ বলল, বাবা ব্রাহ্ম ছিলেন, আমি নই। শুনেছি বাবাও শেষ জীবনে ব্রাহ্মধর্মের রীতিনীতি কিছুই মানেননি। আমিও মানি না। ইংরিজি জানা স্ত্রীও আমি চাই না। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে যেমন সব রমণীদের বর্ণনা আছে, সেই সব হিন্দু মেয়েদের একনিষ্ঠতা, কোমলতা, প্রেমের গভীরতা, সেবাপরায়ণতা, আহা কী অপূর্ব সব চরিত্র, তেমন কারুকে পেলে এক্ষুনি বিবাহ করি।
দীনেন্দ্রকুমার সহাস্যে বলল, ওসব তো মশাই সব কাল্পনিক চরিত্র!
অরবিন্দ বলল, বাস্তবে হিন্দু পরিবারে অমন নারী নেই? আমি বিশ্বাস করি, অবশ্যই আছে।
দীনেন্দ্রকুমার বলল, থাকলেও কোনও মানসম্পন্ন হিন্দু পরিবার আপনাকে মেয়ে দেবে কেন? একে ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম, তারপর বিলেতে কাটিয়েছেন চোদ্দো বছর। আপনার তো জাত গেছে।
অরবিন্দ বলল, প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু সমাজে ফেরা যায় না? শুনেছি এমন হয়!
দীনেন্দ্রকুমার বলল, তা হতে পারে। কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত করতে গেলে আপনাকে গোবর খেতে হবে। পারবেন?
অরবিন্দ দৃঢ়স্বরে বলল, কেন পারব না? গোবরই খাব। এক কাজ করা যাক, সংবাদপত্রে পাত্রীর জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় না? আপনি একটি বিজ্ঞাপনের খসড়া মুসাবিদা করুন!
এরপর কয়েকদিন ধরে চলল বিবাহের আলোচনা।
এ বাড়িতে সর্বক্ষণই যেন হট্টমালা চলে। প্রচুর ঋণগ্রস্ত অবস্থায় পাটনার দোকানটি তুলে দিয়ে বারীন্দ্র এখানে এসেছিল কিছু মূলধন সংগ্রহের আশায়। কিন্তু ছোট ভাইয়ের ব্যবসায়িক উদ্যমের ব্যাপারে অরবিন্দর কোনওরকম আগ্রহ নেই। অরবিন্দর উপার্জন কম নয়, কিন্তু বেহিসেবি স্বভাবের জন্য তার সঞ্চয় কিছু নেই। পাগল মায়ের চিকিৎসার জন্য সে নিয়মিত টাকা পাঠায়। এখানকার কেউ সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এলে সে সত্যমিথ্যা যাচাই না করেই অকাতরে দান করে। কোনও কোনও মাসের শেষে তাকেই ধার করে চালাতে হয়।
দীনেন্দ্রকুমার মজলিশি স্বভাবের মানুষ! বারীন্দ্র তার রাঙা মাকে বিপদের মুখে ফেলে এসেছে, আর সেখানে ফেরার নাম করে না। এখানেই সে কোনও জীবিকার সন্ধানে আছে। স্থানীয় কিছু কিছু ব্যক্তি যখন তখন এসে পড়ে গল্পগুজবের জন্য, কেউই না খেয়ে ফেরে না। শশিকুমার হেস নামে একজন চিত্রকর এ বাড়িতে নিয়মিত অতিথি। সে-ও আসে আড্ডার লোভে। শশিকুমারকে দেখে বাঙালি বলে বোঝাই যায় না, সে অতি গৌরবর্ণ যুবাপুরুষ। তার গোফ দাড়ির রংও কটা, সবসময় সাহেবি পোশাকে থাকে, মাথার টুপিটিও খোলে না। চিত্রকলা শিক্ষার জন্য শশিকুমার বহু বছর ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে কাটিয়েছে, তাকে ইতালিয়ান বলে চালিয়ে দিলে কেউ অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু চেহারা বা পোশাক যেরকমই হোক, শশিকুমার মনেপ্রাণে বাঙালি, ইংরেজি ভাষাটিও সে ভাল জানে না। এক ফরাসি প্রণয়িনীকে সে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ব্রাহ্মমতে বিবাহ করতে চেয়েছিল, কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের নেতারা এক অজ্ঞাতকুলশীলা রমণীর সঙ্গে এই বিবাহ সমর্থন করেননি। বরোদায় কেউ তাঁর সঙ্গে ওই রমণীর সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামায় না।
একদিন আর একটি ব্যক্তি এক বিচিত্র আবেদন নিয়ে উপস্থিত হল। সে বাংলায় কথা বললেও তাকে দেখেও বাঙালি বলে মনে করার উপায় নেই। অতি দীর্ঘকায় বলশালী এক যুবা, মুখে মস্ত বড় গোঁফ, মাথায় পাগড়ি, হাতে একটি প্রকাণ্ড লাঠি। বৈঠকখানা ঘরে অরবিন্দ তখন অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল, সেই লোকটি সরাসরি ঢুকে এসে, প্রথমেই অরবিন্দকে চিনে নিয়ে তার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলল, আমি অনেক ঘুরে ঘুরে আপনার কাছে এসেছি। আপনাকে সাহায্য করতেই হবে। বাঙালিকে বাঙালি সাহায্য করে না, এই অপবাদ আপনি ঘুচাতে পারেন অবশ্যই। আপনার সাহায্য ব্যতিরেকে আমার আর গতি নেই, আমি এখানেই হত্যে দিয়ে পড়ে থাকব।
লোকটি এমন ঝড়ের বেগে কথা বলতে লাগল যে সমস্ত বাংলা বুঝতে পারল না অরবিন্দ। সে তাকাল দীনেন্দ্রকুমারের দিকে।
দীনেন্দ্রকুমারের প্রথমেই মনে হল, লোকটি ছদ্মবেশী গোয়েন্দা নয় তো! পুণায় দুজন সাহেব খুনের জের এখনও চলছে, পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে আর কোথাও কোনও ষড়যন্ত্র চলছে কি না। এই লোকটির ধরন ধারণ সন্দেহজনক। এমনও হতে পারে, এ নিজেই কোনও ষড়যন্ত্রকারী!
দীনেন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী? আপনি কোথা থেকে আসছেন?
লোকটি বলল, সবাইকে বলি, আমার নাম যতীন উপাধ্যায়। আসল নাম যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বামুনের ছেলে, বাংলাদেশের এক গ্রামে আমার জন্ম। ছেলেবেলা থেকে আমার খুব সাধ, আমি সৈনিক হব। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে লড়াই করব। কিন্তু আমি সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছি, কিন্তু বাঙালি শুনলে ইংরেজ সরকার তো সেনাবাহিনীতে নেবেই না, কোনও দেশীয় রাজ্যও সুযোগ দিতে চায় না। আমি শুনেছি, এখানকার সেনাপতি মশাই স্যারের বন্ধু, স্যার যদি আমার হয়ে একটু বলেন–
দীনেন্দ্রকুমার বললেন, বাঙালিকে নিতে চায় না, এটা এমন কিছু আশ্চর্য কথা নয়। কিন্তু কোনও বাঙালি যে স্বেচ্ছায় সৈনিক হয়ে লড়াই করতে চায়, এমন পরম আশ্চর্য কথা কখনও শুনিনি। আপনার এরকম উদ্ভট শখ হল কেন?
যতীন উঠে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠিটা বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, আমার হাতে লাঠি থাকলে দশটা লোককে একসঙ্গে সামাল দিতে পারি। আমি তলোয়ার খেলা জানি। কুস্তিতে বড় বড় পালোয়ানদের হার মানিয়েছি। একবার অযোধ্যার জঙ্গলে একটা বাঘের মুখে পড়েছিলাম। এই দেখুন, আমার পিঠে থাবার দাগ। বাঘ কিন্তু আমাকে ঘায়েল করতে পারেনি, নিজেই পিঠটান দিয়েছে। আমি বন্দুক চালাতেও পারি। আমার যোগ্যতা কম কীসে বলতে পারেন? শুধু বাঙালি বলে আমার চাকরি হবে না?
এবার অরবিন্দ বলল, বাঙালির মধ্যে যে এরকম বীরপুরুষ আছে, তা দেখে বড় সন্তুষ্ট হলাম। আমি মাধবরাওকে বলে আপনাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করাবার চেষ্টা করব অবশ্যই। এখানে আপনি উঠেছেন কোথায়?
যতীন বলল, ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্ট মন্দিরে।
অরবিন্দ বলল, আপাতত দু-চারদিন আমার এখানেই থাকুন। এখন স্নান করে নিন, মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে গেছে।
অতগুলি বছর বিলেতে কাটিয়ে এলেও অরবিন্দ সাহেবি খানা খায় না। সে প্রাণপণে বাঙালি হতে চায় বলে বাড়িতে ধুতি-কামিজ পরে, ডাল-ভাত-মাছের ঝোল আহারই তার পছন্দ। একজন রান্নার ঠাকুর আছে বটে, কিন্তু সে রান্নার কিছুই জানে না। ভাতে পোড়া লাগায়, ডালে নুন বেশি, মাছের ঝোল হয় কালিবর্ণ। প্রত্যেকদিন খেতে বসে দীনেন্দ্রকুমার বলে, উঃ, এই খাদ্য খেয়ে কি মানুষ বাঁচে? এর মধ্যেই আমার পাগল হবার উপক্রম! গৃহিণী না থাকলে কি সংসার চলে?
যতীন মাছের ঝোলমাখা ভাত মুখে দিয়েই থুঃ থুঃ করে ফেলে দিল। মুখ বিকৃত করে বলল, এই রান্না মানুষে খায়! কাল আমি আপনাদের রান্না করে খাওয়াব। দেখবেন আমার হাতের গুণ। এই হাতে আমি তলোয়ারও চালাতে পারি, আবার সবরকম রান্নও পারি।
সত্যিই পরের দিন যতীনের হাতের রান্না খেয়ে সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল। লোকটি গুণী বটে। এ বাড়ির মজলিশে সে শিরোমণি হয়ে উঠল দু দিনেই। অফুরন্ত তার গল্পের ভাণ্ডার। বারীন্দ্র অবিলম্বে তার চ্যালা হয়ে গেল। যতীনের রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতে শুনতে দীনেন্দ্রকুমারও মুগ্ধ।
অরবিন্দ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, তার উপস্থিতিতে ঠিক আড্ডা জমে না। দুপুরবেলা অরবিন্দ কলেজে চলে গেলে তখন সবাই মন খুলে কথা বলে। ছবি আঁকা ছেড়ে শশিকুমারও এসে উপস্থিত হয়।
কলকাতার কয়েকটি পত্রিকায় পাত্রী চাই-এর বিজ্ঞাপন বেরিয়ে গেছে, চিঠিপত্র আসতে শুরু করেছে। গিরীশচন্দ্র বসু নামে এক ভদ্রলোক দু-তিনখানা চিঠি লিখেছেন, তিনি ঘটকালি করছেন তাঁর এক বন্ধুর কন্যার জন্য। বন্ধুটির নাম ভূপাল বসু, কন্যাটির নাম মৃণালিনী, চোদ্দো বৎসর বয়েস, বেশ সুশ্রী, চোখ দুটিতে কোমলতা মাখানো। ভূপাল বসুও বিলেতে ছিলেন বেশ কিছুদিন, সেইজন্য বিলেত-ফেরত জামাতায় তাঁর আপত্তি নেই।
বংশ ভাল, কন্যাটিও উপযুক্ত। গিরীশবাবু বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যক্ষ, সুতরাং তাঁর কথার মূল্য আছে। অধ্যাপক অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে বন্ধু কন্যার বিবাহ দিতে তিনি খুবই আগ্রহী। এই বিবাহ যদি রেজিস্ট্রিমতে হয়, তা হলে আর প্রায়শ্চিত্ত করার প্রশ্ন নেই। কিছুদিন আগে চিত্তরঞ্জন দাশ নামে এক বিলেতফেরত ব্যারিস্টার রেজিষ্ট্রি বিয়ে করেছে। এখন অনেক বিলেতফেরতই শাস্ত্রমতে, পুরুত ডাকিয়ে বিয়ে করছে না। হিন্দু সমাজ যাদের জাতিচ্যুত করতে চায়, তারা সমাজের বিধানকে কলা দেখিয়ে সহজ সরল রেজিস্ট্রি বিবাহ সেরে নিচ্ছে।
কিন্তু অরবিন্দ প্রথম থেকেই গোঁ ধরে বসে আছে, খাঁটি হিন্দুমতে, নারায়ণশিলা সাক্ষী রেখে, যজ্ঞাগ্নির সম্মুখে বিবাহ করবে। হিন্দুধর্মের প্রাচীন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে, সে বঙ্কিমের ভক্ত, ব্রাহ্মদের বা সংস্কারপন্থিদের সে দু’ চক্ষে দেখতে পারে না। শুধু ফোটোগ্রাফ দেখেও পাকা কথা দেওয়া হবে না, কলকাতায় গিয়ে সে পাত্রী দেখে নির্বাচন করবে। আগামী সপ্তাহে কলকাতায় যাওযার একটি দিন ধার্য হয়েছে।
সন্ধের সময় এ বাড়িতে হই-হট্টগোল একেবারে বন্ধ থাকে। কলেজ থেকে ফেরার পর চা পান সেবে অববিন্দ লিখতে বসে। এই সময় কোনওরূপ গোলমাল তার সহ্য হয় না। অরবিন্দ চলে যায় দোতলায, নীচেব বৈঠকখানায় দীনেন্দ্রকুমার বারীন্দ্র-যতীনরা ফিসফিস করে কথা বলে কিংবা নিঃশব্দে তাস খেলে।
ইংরেজি ভাষায় কবিতা রচনা করে অরবিন্দ। ছাত্র বয়েসে সে ভেবেছিল, শুধু কবিতাই রচনা করবে সারাজীবন, আর কোনও জীবিকা গ্রহণ করবে না। যদি সেই সঙ্কল্পই বজায় থাকত, তা হলে আর বোধহয় ভারতে ফেবাই হত না। ইংরেজ কবিদের মতন সে বড় বড় চুল রেখেছে, টাইবিহীন পোশাক পরেছে, কফিখানায় বা বিভিন্ন পানশালায় সে তরুণ কবিবৃন্দের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাহিত্য আলোচনা ও তর্কবিতর্কে অংশ নিয়েছে। কিন্তু একটা সময় সে বুঝতে পেরেছিল, সে কিছুতেই ইংরেজ কবিদের সমকক্ষ হতে পারবে না। যতই অন্তরঙ্গতা থাক, তবু যেন বন্ধুদের সঙ্গে রাজা-প্রজার সম্পর্ক উঁকি মাবে। বিপ্লবোত্তর ফরাসি দেশ কিংবা বিসমার্কের জার্মানি সম্পর্কে কোনও আলোচনায় অংশ গ্রহণ কবতে গেলে বন্ধুরা এমনভাবে তাকাত, যেন বলতে চাইত, তুমি তো পরাধীন দেশের মানুষ, তোমাব এসব বিষয়ে কথা বলার কী অধিকার আছে!
আইরিশরাও পরাধীন, তবু আইরিশ কবি-লেখকদের ইংরেজরা সমীহ করে। কারণ আইরিশরা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে, মাঝে মাঝে চোরাগোপ্তা আক্রমণে সরকারকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। অনেক গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছে সেখানে, কে যে সেইসব সমিতির সদস্য, আর কে নয়, তা বলা শক্ত। ভারতে তো স্বাধীনতা আন্দোলনের চিহ্নমাত্র নেই। ভারতীয়রা যেন চিরকালের জন্য পরাধীন থাকতেই প্রস্তুত।
শুধু কবিতা লিখে টিকে থাকা যাবে না বুঝতে পেরেই অরবিন্দ আই সি এস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে তার চৈতন্যোদয় হল। সিভিল সার্ভিসের অফিসার হয়ে ভারতে ফিরলে তাকে ইংরেজের সরাসরি দাসত্বই করতে হবে। ওপরওয়ালা হবে সব ইংরেজ, তাদের অঙ্গুলিহেলনে চলতে হয় নেটিভ অফিসারদের। তাই ঘোড়ায় চড়ার পরীক্ষা না দিয়ে অরবিন্দ আই সি এস হবার বাসনায় জলাঞ্জলি দিল। বরোদার রাজার সচিবের চাকরি নিয়ে সে দেশে ফিরেছে, কোনওদিনই ইংরেজের অধীনে চাকরি করবে না, এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে।
এ ছাড়াও তার আরও পরিকল্পনা আছে। সব শুরু হবে ধীরে ধীরে।
কবিতা লিখতে লিখতে অরবিন্দ এক একসময় চুপ করে বসে থাকে। মনের মধ্যে এক মধুর শিঞ্জিনী ধ্বনি শুনতে পায়। এবার একজন জীবনসঙ্গিনী আসছে। এখন কিছুদিন অন্য প্রবাহে বইবে এ জীবন।
বিবাহের পর এ বাড়ির এই আড্ডা ভেঙে দিতে হবে। বাংলা শিক্ষকের আর প্রয়োজন নেই। যতীনের চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু বারীন কোথায় যাবে? নবোঢ় পত্নীকে নিয়ে মধুযামিনী যাপন করার সময় সে ছোট ভাইকে সঙ্গে রাখতে চায় না।
একটার পর একটা সিগারেট টেনে যাচ্ছে, কবিতার লাইন আর মাথায় আসছে না। কিশোরী বধূটির মুখোনি স্পষ্ট নয়, সে চপল পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বাড়ি, তার লেখার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে, এই ছবিটিই চোখে ভেসে উঠছে বারেবারে।
একসময় কলম বন্ধ করে অরবিন্দ তরতর করে নেমে এল নীচে। অন্য তিনজন তাস খেলছে মেঝেতে বসে, সে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁরে বারীন তুই নিজের জীবন সম্পর্কে কিছু পরিকল্পনা করেছিস? এইভাবে তো সারাজীবন চলবে না, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিসনি কিছু?
অতর্কিত প্রশ্নে বারীন্দ্র একটু দিশেহারা হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, মানে, পাটনায় আমার চায়ের দোকানটা প্রথমে ভালই চলছিল। কিছু টাকা পেলে ওই দোকানটাই আবার চালাতে পারি।
অরবিন্দ বলল, সে জন্য আমি টাকা দেব না। আমার ভাই সারা জীবন চায়ের দোকান চালাবে, সেটাও আমি চাই না।
দীনেন্দ্রকুমার বলল, ভদ্রলোকের ছেলে চায়ের দোকান চালাবে কী! সে ভারী বিদঘুঁটে ব্যাপার!
বারীন্দ্র মাথা চুলকে বলল, আর তো কিছু শিখিনি। লেখাপড়াও তেমন হল না।
অরবিন্দ বলল, আমি ভাবছি, তোকে দেশের কাজে লাগাব।
বারীন্দ্র উৎসাহিত হয়ে বলল, স্বদেশি ভাণ্ডার? তা পারব, তাঁতের কাপড়, মাদুর, গামছা বিক্রি কবব। কলকাতায় এরকম গোটাকতক ভাণ্ডার হয়েছে শুনেছি।
অরবিন্দ ধমক দিয়ে বলল, আবার বিক্রির কথা! ওই বুঝি দেশের কাজ? দেশের কাজ মানে হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি।
বারীন্দ্র আবার অবাক হয়ে বলল, স্বাধীনতা? তার মানে?
অরবিন্দ বলল, স্বাধীনতার মানে বুঝিস না? স্বাধীনতা মানে পরাধীনতার অবসান। ইংরেজদের দাসত্ব শৃঙ্খল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। আমরা স্বাধীন জাতি হব।
দীনেন্দ্রকুমার বলল, সে কী মশাই! ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে তারপর আমরা যাব কোথায়? তাতে যে আবার নতুন বিপদ আসবে। এ দেশটা একবার দখল করে নিল পাঠানরা। তারপর এল মোগল। মোগলদের কাছ থেকে সিংহাসন ছিনিয়ে নিল ইংরেজ। এখন ইংরেজ যদি চলে যায়, তা হলে আবার নতুন কোনও রাজশক্তি আসবে। সীমান্তের কাছে থাবা উঁচিয়ে আছে রুশ ভাল্লুক। ওরা এসে যদি রাজা হয়, তা হলে ইংরিজি ভুলে গিয়ে আমাদের আবার রুশি ভাষা শিখতে হবে।
অরবিন্দ বলল, আবার কারুকে আসতে দেব কেন? আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি না? নিজেরা দেশটা চালাতে পারি না?
দীনেন্দ্রকুমার হেসে ফেলে বলল, কী যে বলেন মিঃ ঘোষ! আমাদের কি সে শক্তি আছে? ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সদার! ইংরেজদের আমরা তাড়াবই বা কী করে, আর নতুন কেউ রাজত্ব করতে এলে তাকে বরাখবারই বা কী সাধ্য আছে? কেন, ইংরেজদের অধীনে আমরা দিব্যি আছি! রুশদের সঙ্গে লড়াই ফড়াই ওরাই করবে। আমাদের ওসব ঝাটে যাওয়ার দরকার কী? কোনও না কোনও বিদেশি রাজার অধীনে আমরা থাকব, এটাই ভারতের নিয়তি।
অরবিন্দ বলল, যারা কাপুরুষ, তারাই এরকম নিয়তিবাদী হয়। সারা দেশটা কাপুরুষে ভরে গেছে। বিদেশি শাসকরা আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ইতালি, জার্মানি কেমনভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়াল। আমেরিকা ইংরেজশাসন বন্ধনমুক্ত হয়ে নিজেরাই দেশ চালাচ্ছে, আমরা পারব না কেন?
দীনেন্দ্রকুমার বলল, ওরা সাহেবের জাত। ওদের লড়াই করার অভ্যেস আছে। আমরা কি অস্ত্র ধরতে শিখেছি কখনও?
অরবিন্দ বলল, ইংরেজ সৈন্যবাহিনীতে ভারতীয় সেপাইদেরই সংখ্যা বেশি। তারাই তো লড়াই করে।
দীনেন্দ্রকুমার বলল, যাই বলুন আর তাই বলুন মশাই, আপনার প্রস্তাব রূপকথার মতন শোনাচ্ছে। বাঘা বাঘা সব বিদেশি শক্তি অস্ত্র উঁচিয়ে আছে, তার মধ্যে আমরা দেশ চালাব? হুঁঃ! কংগ্রেসের কোনও অধিবেশনেও তো কেউ কখনও স্বাধীনতার কথা বলে না! কিছু চাকরি বাকরির সুবিধে আর করপোরেশন-মিউনিসিপ্যালিটিগুলোতে দুটো-চারটে দেশীয় প্রতিনিধিত্ব চাওয়া হচ্ছে, ইংরেজ সরকার তাই-ই দিতে চায় না।
অরবিন্দ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, কংগ্রেস! ও তো কিছু বড়লোক আর উকিল ব্যারিস্টারদের আড্ডাখানা। চোস্ত ইংরিজিতে ভিক্ষে চাওয়া। কংগ্রেসকে দিয়ে কি হবে না। অন্যভাবে তৈরি হতে হবে। বারীন, তুই কলকাতায় যেতে রাজি আছিস! বারীন্দ্র বলল, হ্যাঁ, যাব। কিন্তু সেখানে গিয়ে কোন কাজ শুরু করব, সেজদা?
অরবিন্দ বলল, অল্পবয়সী, স্বাস্থ্যবান ছেলেদের নিয়ে দল গড়তে হবে, তাদের শরীর গড়া আর অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিতে হবে। তারপর তারা স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা নেবে। এসবই করতে হবে খুব গোপনে গোপনে। দক্ষিণ ভারতে, উত্তর ভারতে এরকম অনেক গুপ্ত সমিতি স্থাপিত হয়েছে। বাঙালিরাই শুধু পিছিয়ে থাকবে?
দীনেন্দ্রকুমার বলল, অল্পবয়সী ছেলেদের ধরে ধরে না হয় দল গড়া হল। তাদের কী বোঝানো হবে? তারা যদি জিজ্ঞেস করে স্বাধীনতার মানে কী? ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করা যাবে কী করে? শুধু শুধু ছেলেভুলানো কথা বললে তো চলবে না।
অরবিন্দ বলল, তাদের বোঝাবেন যে, ইংরেজদের সেনাবাহিনীতে যে সব হাজার হাজার ভারতীয় সেপাই আছে, স্বাধীনতার আহ্বান শুনে তারা সবাই বেরিয়ে আসবে। দেশীয় রাজ্যগুলি একযোগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। পাহাড়ে অরণ্যে যত আদিবাসী আছে, তারা ক্রোধে ফুঁসছে, তাদের ওপর তো অবিচার অত্যাচার কম হয়নি। স্বাধীনতার ডাকে তারাও অস্ত্র নিয়ে ছুটে আসার জন্য প্রস্তুত।
দীনেন্দ্রকুমার বলল, সত্যিই এরা সবাই ছুটে আসার জন্য তৈরি, নাকি এসব আপনার স্বপ্ন?
অববিন্দ বলল, স্বপ্নও একসময় সত্যি হয়। পৃথিবীর সমস্ত মহৎ ব্যাপারই আগে স্বপ্নের স্তরে থাকে। এই স্বাধীনতার যজ্ঞে আমাদের যুবসমাজ যদি পিছিয়ে থাকে, তার চেয়ে লজ্জার ব্যাপার আর কী হতে পারে!
যতীন মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিল, এবার সে বলে উঠল, এই স্বপ্নের কথা শুনে আমার শিহরন হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই কলকাতায় ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে দল গড়ি।
অববিন্দ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তোমার সম্পর্কেও আমি সেই কথা ভেবে রেখেছি। এখানকার সেনাবাহিনীতে সামান্য একজন সৈন্য হয়ে তুমি পড়ে থাকবে কেন? তোমার অভিজ্ঞতা, তোমার অস্ত্রবিদ্যা তুমি নিজের দেশের মানুষের জন্য কাজে লাগাও। বারীনের সঙ্গে তুমিও কাজে লেগে পড়তে পারো। বারীন ছেলেদের জুটিয়ে আনবে, তুমি তাদের লাঠি-তলোয়ার চালনা শেখাবে।
বারীন্দ্র বলল, আমি কালই যেতে রাজি আছি। কিন্তু সেজদা, টাকা-পয়সা জুটবে কোথা থেকে? কিছু তো খরচ লাগবেই।
অরবিন্দ বলল, প্রথম কিছুদিন আমি তোর খরচ চালাব। তারপর সমিতি বড় হলে অনেক অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।
বারীন্দ্র বলল, ঠিক আছে, চাঁদা তুলব। বড় বড় লোকদের কাছে গিয়ে স্বাধীনতার ব্রতের কথা বলে টাকা চাইব।
অরবিন্দ রূঢ়ভাবে বলল, না, চাঁদা তুলে দেশ উদ্ধার করা যায় না। তা ছাড়া সব সময় মনে রাখতে হবে যে, কাজ চলবে গোপনে। সমিতির সভ্যদের মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিতে হবে। আর কেউ যেন কিছু টের না পায়।
বারীন্দ্র কিছুটা হতাশভাবে বলল, চাঁদা না তুললে টাকা আসবে কী করে?
অরবিন্দ বলল, অন্যান্য দেশে গুপ্তসমিতিগুলো কী করে টাকা তোলে তোরা জানিস না? প্রয়োজনে তারা ডাকাতি করে। আমাদেরও তাই করতে হবে।
দীনেন্দ্রকুমার আঁতকে উঠে বলল, সে কী মশাই! ভদ্রলোকের ছেলে ডাকাতি করবে কী! তাতে পাপ হবে না?
অরবিন্দ বলল, স্বাধীনতার যুদ্ধে ভদ্রলোক-অভদ্রলোক বলে কিছু নেই। সবাই সমান। স্বাধীনতা এমনই পবিত্র প্রাপ্তি যে, তা অর্জনের জন্য কোনও পন্থাই পাপ নয়।
একটু থেমে, একটা সিগারেট ধরিয়ে অরবিন্দ এবার বলল, এইসব কথা আমি অনেকদিন যাবৎ চিন্তা করেছি। আর কারুকে বলিনি। আজ হঠাৎ বলে ফেলোম। তোমাদের তিনজনকেই প্রতিজ্ঞা করতে হবে, ঘুণাক্ষরেও কারুকে কিছু জানাবে না। দীনেন্দ্রবাবু, আপনার কাছে বিশেষ অনুরোধ, এই সব বিষয় নিয়ে আপনি কারুর সঙ্গে আলোচনা করবেন না, কিছু লিখবেন না!
কয়েকদিন পরেই যতীন ছাড়া আর সবাই চলে এল কলকাতায়। ভূপাল বসুর কন্যা মৃণালিনীকে দেখে সকলেরই পছন্দ হয়ে গেল। বিয়ের জন্য একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল বৈঠকখানা রোডে। বিয়ের একদিন আগে পুরোহিত ডেকে ভাবী জামাতা ও ভাবী শ্বশুর দু’জনেই খানিকটা করে গোবর মুখে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু হল।
তারপর খাঁটি হিন্দুমতে, সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান মেনে অরবিন্দর সঙ্গে মৃণালিনী বসুর শুভ বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়ে গেল। নবদম্পতি মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য চলে গেল নৈনিতাল পাহাড়ে। বারীন্দ্র রয়ে গেল কলকাতায়।