2 of 2

৫৬. দু-এক দিনের মধ্যেই সূর্য

দু’-এক দিনের মধ্যেই সূর্য বুঝতে পারল যে কলকাতায় নিজের বাড়িতেও সে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না। তার ব্যাপারটা তো ঠিক ঘরের ছেলের ঘরে ফিরে আসা নয়। কোনও দিনই সে পুরোপুরি পারিবারিক জীবনের মধ্যে থাকার সুযোগ পায়নি– মাঝখানে কয়েকটা বছর শুধু এক যৌথ পরিবারের মধ্যে নিজেকে মেলাবার চেষ্টা করে বিড়ম্বিত হয়েছে। এখন ফিরে আসার পর এখানে এমন কেউ নেই–যার প্রতি সে। কোনও টান অনুভব করতে পারে।

এত বড় বাড়িতে শুধু বাবা আর ছেলে। বড়বাবু তাঁর সেই তিন তলার ঘরটিতেই আছেন–এত বয়স হয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে বেশ হাঁফ ধরে–তবু ঘর বদলাননি। সূর্য থাকে দোতলায়। বাকি ঘরগুলো সব তালাবন্ধ।

বড়বাবু এত দিন পরে ছেলেকে ফিরে পেয়ে তাকে আদরযত্ন করার জন্য খুব উন্মুখ। কিন্তু তিনি জানেন না ছেলে কী খেতে ভালোবাসে, কীসে ছেলের মনে স্মৃর্তি হয়। এসব কথা তিনি মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতেও পারেন না। ঠাকুর-চাকরদের শুধু বারবার সতর্ক করে দেন, দেখবি, দাদাবাবু কী চায়।

বড়বাবুর ঘুম ভাঙে খুব ভোরে। তাকে চা দেওয়া হয় প্রত্যেক দিন ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময়! চা খেয়ে কিছুক্ষণ ছাদে পায়চারি করে তিনি নীচে নেমে আসেন। নামবার সময় সিঁড়ির পাশেই ছেলের ঘরে একবার উঁকি মারেন, ছেলেকে তিনি সকাল সকাল ডাকতে চান না। ওর শরীরের ওপর দিয়ে বহু অনিয়ম অত্যাচার গেছে–এখন একটু ভালো করে ঘুমিয়ে নিক।

কিন্তু প্রত্যেক দিনই দেখেন সূর্য আগেই ঘুম থেকে উঠে একখানা বই নিয়ে পড়তে বসে গেছে। দিনের অধিকাংশ সময়ই সূর্য বই নিয়ে কাটায়। জেলখানা থেকে এই অভ্যাসটি নিয়ে এসেছে।

বড়বাবু তখন সূর্যের ঘরে ঢুকে বলেন, জানলাটানলাগুলো সব খুলিসনি কেন? এত কম আলোয় পড়লে চোখ খারাপ হয়ে যাবে।

জেলখানার সেলে যে কয়েক বছর কাটিয়ে এসেছে, বেশি আলোই তার বোধহয় এখনও সহ্য হয় না।

বড়বাবু নিজেই জানলাগুলো খুলে দেন। বাইরের রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। সূর্যর ঘরের নতুন রং করা দেওয়ালগুলো ঝকমক করে। সূর্যর ঘরের দেওয়ালগুলোতে একটাও ছবি বা ক্যালেন্ডার নেই। হঠাৎ বড়বাবুর মনে হয়, সূর্যর। মায়ের একখানা ছবি বাঁধিয়ে রাখা উচিত ছিল। বুলবুলের একটা মাত্র ছোট ছবি আছে। তাঁর কাছে–বিবর্ণ হয়ে এসেছে এত দিন, যদি বড় করা যায়–।

বড়বাবু বললেন, মুখটুখ ধুয়ে নে। আমি নীচে যাচ্ছি, ঠাকুরকে বলছি জলখাবার দিতে–

বড়বাবু নীচ থেকে খবরের কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ির তদারকি করে আবার ফিরে আসেন দোতলার খাবার ঘরে। সূর্য না-আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।

সূর্য এসে নীরবে টোস্টে মাখন লাগাতে শুরু করে দেয়। তার এক হাতে তখনও বই।

বড়বাবু একদৃষ্টে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কোনও কথা খুঁজে পান না। অথচ অনেক কথাই বলার আছে। প্রাপ্তে তু যোড়শ বর্ষে পুত্র মিত্রবদাচরেৎ। কিন্তু ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার কোনও সুযোগই তো হল না।

ডিম খেলি না?

সূর্য বই থেকে চোখ না তুলে বলল, না। খেতে ইচ্ছে করছে না।

তোর শরীর ভালো আছে তো?

হুঁ।

তুই বাইরের কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসবি?

এবার বই মুড়ে রেখে সূর্য মুখ তুলে তাকাল। পিতাপুত্রে চোখাচোখি হল, দু’জনেই চোখ সরিয়ে নিল প্রায় একসঙ্গে।

সূর্য বলল, কোথায় যাব?

তোর শরীর সারাবার জন্য যেখানে যেতে ইচ্ছে হয়। যদি কোনও পাহাড়ি জায়গায় যেতে চাস–

আমার শরীর তো বেশ ভালোই আছে।

একথা ঠিক, সূর্যর স্বাস্থ্য এখন বেশ চমৎকার। সুগঠিত দীর্ঘ শরীর, চোখ দুটি উজ্জ্বল। তবে অন্যান্য বাইশ বছরের যুবকদের মতন তার মুখে সেই সরল লাবণ্যের ভাবটা আর নেই। চার বছরের কারাবাসই তাকে অনেক অভিজ্ঞ করে তুলেছে। সে কদাচিৎ হাসে, তবু সেই হাসির সময়েও তার মুখে এই পৃথিবীকে চিনে নেওয়ার একটা ভাব ফুটে ওঠে।

তোর মার কথা তোর একটুও মনে আছে?

এই আকস্মিক প্রসঙ্গ পরিবর্তনে সূর্য সামান্য একটু চমকে উঠল। বড়বাবু এ-বিষয়ে কোনও দিন সূর্যর সঙ্গে কথা বলেননি। সূর্য মুখ নিচু করে টেবিলের ওপর ডান করতল মেলে সেই দিকে তাকাল। নিচু গলায় বলল, হ্যাঁ, একটু একটু

তোর মনে থাকার কথা নয়। তখন তোর বয়স খুবই কম। অবশ্য তোর দু’জন মা ছিল। দ্বিতীয় মায়ের কথা হয়তো–

দু’জনের কথাই আমার মনে আছে।

তোর নিজের মা আত্মহত্যা করেছিলেন।

এই কথাটা বলে বড়বাবু তীব্র চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে চান। তাঁর এই দুর্বোধ্য স্বভাবের ছেলের কোনও দিকে কোনও দুর্বলতা আছে কিনা–এটা জানা যেন তার বিশেষ দরকার।

সূর্য স্বাভাবিক গলায় বলল, কেন?

তা আমি জানি না। কেউ জানে না।

দু’জনেই একটুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বড়বাবু বললেন, তোর মা খুব বড় শিল্পী ছিলেন। যারা তাঁকে দেখেছে–কোনও দিন ভুলতে পারবে না।

সূর্যর মুখ দেখে মনে হয়, সে তার মায়ের প্রসঙ্গ নিয়ে কারওর সঙ্গে আলোচনা করতে চায় না। এমনকী, নিজের বাবার সঙ্গেও না। সে যেন খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়ার জন্যই ছটফট করছে।

তোর মায়ের অনেকগুলো মোহর আছে আমার কাছে। সেগুলো আমি তোর কাছেই দিয়ে যেতে চাই।

আমি নিয়ে কী করব?

আমার যা কিছু আছে, তোকে এবার বুঝে নিতে হবে। আমি আর কত দিন থাকব। এবার তো একদিন যেতেই হবে।

সূর্য খুব বুদ্ধিমানের মতন মৃত্যুর প্রসঙ্গটা বুঝতে পেরেও ভাবাবেগের প্রশ্রয় দিল না। সেটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, আপনি কি শিগগিরই কোথাও যাচ্ছেন।

বড়বাবুও বুঝতে পারলেন ছেলের মনোভাব। তিনিও একটু ইতস্তত করে বললেন, ভাবছি একবার এলাহাবাদ, গোয়ালিয়ার–ওই সব দিকে ঘুরে আসব। তোর মায়ের অনেক স্মৃতি আছে ওই সব জায়গায়। তুই যাবি আমার সঙ্গে?

আপনি একাই ঘুরে আসুন।

তুই তা হলে এখানে একলা একলা কী করবি?

আমার কোনও অসুবিধে হবে না।

সূর্য উঠে পড়ল টেবিল থেকে। বড়বাবু একটু আহত ভাবে তাকিয়ে রইলেন। নিজের মায়ের সম্পর্কেও ছেলেটার আগ্রহ এত কম? অথচ তিনি তার মায়ের কথা শুনবার জন্য বার বার ছুটে যেতেন ভবানীপুরে। বড়বাবু চুপ করে ভাবতে লাগলেন নিজের মায়ের কথা। প্রায় সত্তর বছর আগে মৃতা এক কিশোরী বালিকা ছিল তার মা–এ কথা ভাবতে কী রকম অবাক লাগে। যারা মরে যায়, তাদের বয়স বাড়ে না। স্মৃতিতে তার মায়ের– চেহারা অন্যদের মুখে শুনে শুনে তিনি নিজে সেটা সৃষ্টি করেছেন–চিরকাল কিশোরীই থেকে যাবে, আর তাঁর ছেলে আজ বার্ধক্যের মধ্য সীমায়–

ঘোর ভেঙে বড়বাবু উঠে পড়লেন। মনে মনে ঠিক করলেন, যে-কোনও উপায়েই হোক চিররঞ্জনকে সপরিবারে এ বাড়িতে আবার ফিরিয়ে আনতেই হবে। আর কেউ উপস্থিত না থাকলে–ছেলের সঙ্গে একা একা তিনি কিছুতেই কথাবার্তা জমাতে পারছেন না। তার নিজেরও তো কথা বলার কোনও সঙ্গী নেই। অথচ তিনি ভেবে রেখেছিলেন, ছেলেটা ফিরে এলে তার মনের গুমোট কেটে যাবে, সারা বাড়িটাও আবার জমজমাট হয়ে উঠবে।

সূর্য সারা দিনই প্রায় নিজের ঘরেই বই নিয়ে কাটায়। কোথায় যাবে বুঝতে পারে। তার কোনও বন্ধু নেই। পলাতক জীবন শুরু হবার পর থেকে সে যাদের সঙ্গে। কাটিয়েছে, তাদের কথাই বার বার মনে পড়ে। তারা তো অনেকেই বেঁচে নেই, কিংবা কোথায় থাকে সে জানে না। তার জীবনদর্শন এখন অনেকটা বদলে গেছে। এখন তার প্রায়ই মনে হয়, যোগানন্দর মৃত্যুর জন্য সেই অনেকটা দায়ী। যোগানন্দ দল ছেড়ে সংসারের আশ্রয়ে গিয়ে লুকিয়েছিল। সূর্য অতখানি হিংস্রতার সঙ্গে তাকে টেনে বার না করলেই তো পারত। তাতে কী ক্ষতি হত দেশের? মহাসমুদ্রের মতন এই দেশে সবকিছুই তলিয়ে যায়, কোনও কিছুতেই আঁচড় পড়ে না।

মাঝে মাঝে বিদ্যুৎচমকের মতন মনে পড়ে যায় শ্রীলেখার কথা। সূর্যর মাঝে মাঝেই দৃষ্টি বিভ্রম হয়–সে হঠাৎ হঠাৎ শ্রীলেখাকে দেখতে পায়। তার নাকে ভেসে আসে শ্রীলেখার চুল কিংবা শরীরের গন্ধ। যেন এইমাত্র শ্রীলেখা কাঁদল। বই থেকে মুখ তুলে সূর্য দরজার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শ্রীলেখার অপূর্ব সুন্দর থুতনি সে কাল্পনিক। হাতে স্পর্শ করে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভাবে, জেলে থাকতে থাকতে তার মনটা দুর্বল হয়ে গেছে। এ রকম দিবাস্বপ্ন দেখার অভ্যাস তো তার ছিল না আগে।

দু’-এক দিন বাড়িতে বন্ধ থাকার পর সূর্য ঠিক করল সে তার জেলখানার সঙ্গীদের সঙ্গেই গিয়ে দেখা করবে। অতুপ্রসাদের বাড়ি বসিরহাটের দিকে। সেখানে গিয়ে তাকে সে শুনিয়ে আসবে লেবু গাছটার কথা?

তার আগে সে গেল শান্তিপ্রসাদের বাড়িতে। রাজবল্লভ পাড়ায় ওদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে সূর্য একটা আঘাত পেল। জেলখানাতেই শান্তিপ্রসাদের মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছিল, সে রোগ আর সারেনি–এখন সে বদ্ধ উন্মাদ। অন্যরা সবাই ছাড়া পেলেও শান্তিপ্রসাদের আর মুক্তি নেই। শান্তির বাবা সূর্যর পরিচয় পেয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

সূর্যর মুখ দিয়ে কোনও কথা সরে না। সে জানে না কোনও সান্ত্বনা বাক্য। তার মনে পড়ে, শান্তিপ্রসাদের বড় বড় জুলপির চুল ধরে টেনে উপড়ে দিয়েছিল এক সি আই ডি অফিসার। শান্তিপ্রসাদ তখন একটুও চাচায়নি। তার পায়ের ওপর জুতোসুদ্ধ দাঁড়িয়ে নাচানাচি করেছে দু’জন পুলিশ–তখনও মনের জোর অটুট ছিল শান্তিপ্রসাদের–তবু কেন মোটামুটি নিরুপদ্রব কারাবাসের সময়ে শান্তিপ্রসাদ পাগল হয়ে গেল কে জানে। মায়ের মৃত্যুসংবাদ কী শারীরিক অত্যাচারের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলতে পারে?

হঠাৎ সূর্যর অসম্ভব রাগ হয়। ইচ্ছে করে যে-কোনও একটা জিনিস হাতে নিয়ে মট করে ভেঙে ফেলে। দেওয়ালে শান্তিপ্ৰসাদ আর তার মায়ের যে ছবিটা ঝুলছে–সেটাই আছড়ে ভেঙে ফেললে কেমন হয়!

শান্তিপ্রসাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সূর্য কিছুক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে। সে ভাবে যে তার একটা কিছু করা দরকার। জেল থেকে ছাড়া পাবার আগে সে প্রায়ই ভাবত, কোনওক্রমে বাইরে বেরোতে পারলে আবার এই সংগ্রামেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। কোনও কাজ অসমাপ্ত রাখাই তার স্বভাব নয়–স্বাধীনতার লড়াইও তার নিজের জীবনে অন্তত অসমাপ্ত রাখবে না।

কিন্তু কী ভাবে কাজ শুরু করবে, কোন দল, কিছুই সে জানে না। তার নিজের দল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। প্রথম যখন সে হরকুমারের সংস্পর্শে আসে–তখন তার কোনও রাজনৈতিক শিক্ষা ছিল না–সে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল নিছক জেদের বশে। জেলখানায় কিছু কিছু বই পড়ে সে খানিকটা তত্ত্ব শিখেছে–কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতি সম্পর্কে তার এখনও কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি। গুপ্ত সমিতিতে–যারা কাজ করেছে প্রকাশ্য জীবনে, যেখানে বহু মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে কাজ করতে হয়–সেখানে তারা দিশেহারা হয়ে যায়। নতুন জোয়ার এসেছে গণ-আন্দোলনের–এখানে পুরনো কায়দার বিপ্লবীরা অপাঙক্তেয়।

তা ছাড়া, সূর্য লক্ষ করছে, কলকাতায় রাজনৈতিক তৎপরতা হঠাৎ যেন কমে গেছে। আগেকার মতন মিছিল কিংবা সভাসমিতিও তার চোখে পড়ে না। যুদ্ধ শেষের পর মারাত্মক ইনফ্লেশানে যে-যার সংসার সামলাতে ব্যস্ত। রাম শ্যাম যদু মধু যারা সকলেই যুদ্ধের সময় কিছু না কিছু চাকরি পেয়েছিল–এখন পটাপট চাকরি চলে যাচ্ছে। চালের দোকান, কাপড়ের দোকান শুধু নয়-কয়লার দোকানের সামনেও লম্বা লাইন। বাড়ির ঝি চাকররাও কন্ট্রোল আর লাইন–এই ইংরেজি শব্দ দুটি সব সময় ব্যবহার করে।

একদিন ক্ষিতীশদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটে। কাঁধে একটা বিরাট থলেতে ভরতি স্কুলপাঠ্য বই। ব্রজগোপালের সঙ্গে শিয়ালদার এক মেসে এই ক্ষিতীশদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সূর্যর। পুরনো আমলের দেশকর্মী ছুটকোছাটকা ভাবে বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন। এঁকে দেখে সূর্য খুব খুশি হয়ে উঠল–তবু নিজেদের পুরনো দিন সম্পর্কে কথা বলা যাবে।

ক্ষিতীশদা প্রথমে চিনতে পারলেন না সূর্যকে। ভুরু কুঁচকে বললেন, কে বলো তো তুমি, ভাইটি? কোথায় দেখেছিলে আমায়, রাজসাহীতে? তুমি কি রাজসাহীর মনোরঞ্জনদার ছেলে?

সূর্য পূর্ব পরিচয় দিতেই ক্ষিতীশদা বললেন, ওহহ, তুমি সেই যুবরাজ? তোমাকে ভুলে যাওয়া তো আমার উচিত হয়নি। চেহারা অনেক বদলে ফেলেছ। ব্রজগোপাল যে দিন প্রথম তোমাকে নিয়ে এল, আমি বলেছিলাম, এই যুবরাজটিকে কোথায় পেলে!

সূর্য জিজ্ঞেস করল, আপনি এত বইপত্তর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন? ক্ষিতীশদা সূর্যর হাত ধরে বললেন, বলছি, সব বলছি। এসো, একটু গোলদিঘিতে বসি–দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলা যাক।

ক্ষিতীশদার বয়স এখন প্রায় পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। এর মধ্যেই চোখের নীচে কালো ছোপ। কিন্তু মুখে হাসি লেগে আছে।

বই-ভরতি থলেটা পাশে নামিয়ে রেখে তিনি হাতছানি দিয়ে একটা আলুকাবলিওয়ালাকে ডাকলেন। পচা আলু যাতে না দেয় এবং কাবলি ছোলা যাতে বেশি পরিমাণ দেয়–শ্যেনচক্ষে সেদিকে নজর রেখে দান দেবার সময় আবার দরাদরি করতে লাগলেন। সূর্য কিছু একটা বলতে যেতেই তিনি বললেন, উঁহু, তুমি কোনও কথা বলবে না, আমি আজ তোমাকে খাওয়াচ্ছি। চারটি ফুটো পয়সা লোকটিকে গুণে দিয়ে তিনি সূর্যর হাতে একপাতা আলুকাবলি তুলে দিলেন এবং নিজে একটা নিয়ে বেশ হারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগলেন। বললেন, প্রায় দু মাস বাদে শখ করে চারটি পয়সা খরচ করলাম, বুঝলে ভাইটি? দিনকাল বড় খারাপ।

সূর্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ক্ষিতীশদা বললেন, তোমার কী খবর বলো? রোজগারপাতির কিছু ব্যবস্থা আছে? না হলে আমি সুরেশদাকে ধরতে পারি–

সূর্য জিজ্ঞেস করল, দাদা, আপনি কী করছেন?

ক্ষিতীশদা একগাল হেসে বললেন, আমি? আমি এখন জোয়াল বইছি। এত দিন তো বেশ জেলের ভাত জুটে যাচ্ছিল–এখন আর কে খেতে দেবে বলো? বিয়ে করে ফেলেছিলাম অনেক আগে–সব দায় দিয়ে রেখেছিলাম আমার বাপের ঘাড়ে–বাবা হঠাৎ মারা গিয়ে আমাকে বিপদে ফেলে দিলেন। এখন গোটা সংসারের জোয়াল আমার ঘাড়ে। রোজগারপাতি করা কি সোজা? আমরা নামকাটা সেপাই–আমাদের তো আর কোথাও চাকরি জুটবে না। গিয়ে ধরলাম সুরেশদাকে। সুরেশদা বললেন, চাকরি তো দিতে পারছি না–কিছু লেখেটেখো, যা পারি দেব। লিখে মাসে কুড়ি-পঁচিশ টাকা পাই–তাতে তো আর সংসার চলে না। তাই এই বইয়ের ব্যবসা ধরেছি। ইস্কুলে ইস্কুলে গিয়ে টেক্সট বই সাপ্লাই করি। হেডমাস্টারদের কাছে গিয়ে প্রাক্তন রাজবন্দি–এই বলে কাঁদুনি গাই! হে-হে-হে-হে।

যেন এটা একটা দারুণ হাসির ব্যাপার। ক্ষিতীশদা অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললেন, আমি গুজব শুনেছিলাম, তুই মারা গেছিস।

সূর্য হেসে বলল, না, মরিনি। ভালো, ভালো। বড় খুশি হয়েছি। অনেকেই তো মরেহেজে গেছে। যে কটা বেঁচে আছে আমার মতন–এখন পেটের জ্বালায় ধুকছে। তোর কম বয়স, বড় খুশি হয়েছি, আর এক পাতা আলুকাবলি খাবি?

না।

তুই তা হলে এখন কী করবি?

সেই কথাই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাইছি। আমাদের এখন কী করা উচিত? এই সময়ে আমাদের কি কিছুই করার নেই?

ক্ষিতীশদা মুখে একটা তিক্ত ভঙ্গি করে বললেন, কিছু না, কিছুনা। এ-পোড়ার দেশের জন্য আর কিছু করা উচিত না। এখন যে-যার নিজের ধান্দা দেখো।

কিন্তু ক্ষিতীশদা, আমরা এত দিন যা করলাম, তা সবই কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?

হয়ে যাবে কী, হয়ে গেছে। সব নষ্ট। কী চলছে এখন এ-দেশে? একে কি রাজনীতি বলে? না কুকুরের কামড়াকামড়ি?

সূর্য একটু দুঃখিত ভাবে বলল, ক্ষিতীশদা, আমরা কি তবে সব চুপ করে দেখব?

ক্ষিতীশদা ধমক দিয়ে বললেন, তা ছাড়া কী করবি? গোল্লায় যাক এ-দেশ! এ-দেশের কিছু হবে না। এখন দরকার কাদের জানিস, যারা এদের সবাইকে শেষ করে ফেলবে! আমরা কী জন্য স্বাধীনতার লড়াই করলাম? কতকগুলো ব্যবসায়ী আর ব্যারিস্টারের হাতে ক্ষমতা যাবে বলে? এখন সব শালা হিন্দু-মুসলমান নিয়ে লাফাচ্ছে?

আর কিছুক্ষণ কথা বলার পর ক্ষিতীশদা উঠে চলে গেলেন। বইয়ের থলিটার ভারে তাকে একটু কুঁজো হয়ে হাঁটতে হয়। সেই অবস্থায়ই বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে দৌড়ে একটা চলন্ত ট্রামে উঠে পড়লেন।

সূর্য আরও কিছুক্ষণ বসে রইল সেই বেঞ্চে। বর্তমানের রাজনীতি সে সত্যিই বুঝতে পারে না।

দেশে একটা হাওয়া উঠে গেছে যে, ইংরেজ এবার সত্যিই এ-দেশ ছেড়ে চলে যাবে। ১৯৪৮ সালেই তারা ক্ষমতা হস্তান্তরিত করছে। এখন স্বাধীনতার প্রশ্ন আর বড় নয় এখন শুধু ভাগাভাগির প্রশ্ন। আবার এসেছে ক্যাবিনেট মিশন, লর্ড ওয়াভেল গান্ধীর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠকে বসছেন–আর সব বানচাল করে দিচ্ছেন জিন্না। গান্ধীজি যতই ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম করুন, জিন্নাসাহেবের চোখে তিনি হিন্দুই রয়ে গেলেন এবং কংগ্রেস নিছক হিন্দুর পার্টি। এই কংগ্রেসের হাতে দেশের ভার দিয়ে গেলে মুসলমানদের জীবন বিপন্ন হবে। জিন্না ততদিনে এ-দেশের মুসলমানদের প্রায় বুঝিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন যে হিন্দু ও মুসলমানদের পক্ষে পাশাপাশি শান্তিতে থাকা সম্ভব নয়। হিন্দু আর মুসলমানরা এতকাল পরে ঘুম ভেঙে উঠে জানতে পারল যে তারা দুটো আলাদা জাত, তাদের দেশও আলাদা।

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা এবং তিনি। পাকিস্তান চিন্তার বিরোধী বলে কলকাতার মুসলমানরা ইদের নামাজের সময় তাঁকে ইমামের কাজ করতে দিতে অস্বীকার করে। ইসলামি শাস্ত্রে এত বড় পণ্ডিতকেও হিন্দু ঘেঁষা অপবাদ নিতে হয়। জিন্না তাকে অত্যন্ত কটু ভাষায় জানান, I refuse do discuss with you by correspondence or otherwise, as you have completely forfeited the confidence of Muslim India.

মুসলিম ইন্ডিয়া বা পাকিস্তানের চেহারা যে কী রকম হবে, সে সম্পর্কেও সাধারণ মানুষের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকেই ভাবছে-মুসলমান প্রধান রাজ্যগুলিতে আলাদা আলাদা পাকিস্তান হবে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা ভাবছে তারা সকলেই পাকিস্তান হলে তার সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। মুষ্টিমেয় ক্ষমতালোভী গোষ্ঠীর চক্রান্ত যাদের চোখে ধরা পড়েছে–তারাও এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

সূর্য এর আগের সময়টাই জেলে কাটিয়েছে বলে রাজনীতির এই নতুন অবস্থাটার, সঙ্গে সে পরিচিত ছিল না। এখন সে বাইরে এসে দেখছে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটাই দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলেছে–অথচ এ সম্পর্কে তার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। এখন যদি তাকে আবার নতুন করে লড়াই শুরু করতে হয় তা হলে কার বিরুদ্ধে লড়াই হবে?

নিজে সে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না বলেই ক্ষিতীশদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাইল। প্রায়ই সে কলেজ স্ট্রিটে চলে এসে ক্ষিতীশদার সঙ্গে দেখা করে।

একদিন ক্ষিতীশদা বললেন, চল, তোকে সুকল্যাণের বাড়িতে নিয়ে যাই। সুকল্যাণকে মনে আছে তোর?

সূর্য বলল, এই নামের কারওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি।

ক্ষিতীশদা অবাক হয়ে বললেন, সুকল্যাণকে চিনিস না? দীপ্তি? দীপ্তিকেও চিনিস না?

সূর্য এবারও দু’ দিকে মাথা নাড়ল।

ক্ষিতীশদা বললেন, চল, তোর আলাপ করলে ভালো লাগবে। আমাদের পুরনো লোক। আমি প্রায়ই দীপ্তির হাতে চা খেয়ে আসি।

সূর্য সত্যিই এর আগে সুকল্যাণ কিংবা দীপ্তি এই নামের কারওকে দেখেনি। তবু সে কৌতূহলী হয়ে ক্ষিতীশদার সঙ্গে চলল।

হাজরার মোড়ের কাছেই মোটামুটি একটা নতুন বাড়ির দোতলায় উঠে গেলেন ক্ষিতীশদা। সিঁড়ির কাছটা একটু অন্ধকার ছিল। তাই যে-মহিলা দরজা খুললেন, সূর্য তাঁর মুখটা ভালো দেখতে পায়নি।

মহিলাটি সূর্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কী, তুমি? কেমন আছ?

সূর্য বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে রইল।

মহিলাটি মুখ টিপে হেসে বললেন, এর মধ্যেই ভুলে গেলে? চিনতে পারছ না?

মহিলাটির মাথায় কোঁকড়া চুল পাতা কেটে আঁচড়ানো। ধারালো মুখ, সোনালি ফ্রেমের চশমা। ঠোঁটে চাপা হাসি। সূর্য ঘরের মধ্যে পা দেবার পর তিনি জিজ্ঞেস। করলেন, কী অমর, এখনও চিনতে পারছ না?

সূর্য অস্ফুট গলায় বলল, বনলতা মাসি?

মহিলাটি ক্ষিতিশদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ক্ষিতিশদা, একে কোথা থেকে পেলেন?

ক্ষিতীশদা কাঁধের ঝোলাটি এক পাশে নামিয়ে রেখে বললেন, রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেলাম। কলকাতার রাস্তায় এখনও এ রকম দু-একটা মণি মানিক্য মেলে। নে দীপ্তি, একটু চায়ের জল বসা। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

মহিলা আবার সূর্যর দিকে চেয়ে বললেন, আমার নাম বনলতা নয়। আমার নাম দীপ্তি।

সূর্য বলল, আমার নামও অমর নয়। আপনি আমাকে অমর বলেই জানেন। আমার নাম সূর্য।

মহিলা অবাক হয়ে বললেন, তুমিই সূর্য?

ক্ষিতীশদা বললেন, আমার নাম কিন্তু সত্যিই ক্ষিতীশ ভটচায়। আমার আর অন্য নামটাম নেই!

ক্ষিতীশদার বলার ধরনে ওরা হেসে উঠল।

সূর্য জিজ্ঞেস করল, ননী মেলোমশাই কোথায়?

দীপ্তি বললেন, উনি এখনও জেল থেকে ছাড়া পাননি।

ক্ষিতীশদা জিজ্ঞেস করলেন, ননী আবার কে?

দীপ্তি হাসতে হাসতে বললেন, দীনেনদার ভাই রণেন। সে আমার বর সেজেছিল একসময়, আপনি জানেন না? এই ছেলেটা আবার তার সঙ্গে মেলোমশাই সম্পর্ক পাতিয়ে ছিল।

ক্ষিতীশদা বললেন, উঃ, তোদের এই নামের গোলমাল নিয়ে আর পারা যায় না। যত সব নাটুকে কারবার। ও-সব চুকে বুকে গেছে, এখন ছাড় তো।

দীপ্তি বললেন, এর নামটাও তো আমি জানতাম না। সূর্যর কীর্তিকাহিনী আমি এর-তার মুখে কিছু কিছু শুনেছি কিন্তু সে যে আমাদের এই অমর, তা আমি বুঝব কী করে?

বছর সাতেক আগেকার ঘটনা হলেও সূর্যর এখনও সব মনে আছে। চন্দনগরের একটা নির্জন ভাঙা বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য তারা সংসার পেতেছিল–বনলতা আর ননীমাধব এসেছিল স্বামী-স্ত্রী সেজে–ডাকাতির অ্যাকশনের পর সূর্যর হাঁটুতে চোট লাগায় বনলতা কত যত্ন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। সেই বনলতা আজকের দীপ্তি।

দীপ্তি বললেন, আমাকে আর মাসিটাসি বলতে হবে না। দিদি বলবে এখন থেকে। তোমার তো নিজের দিদি নেই–

সূর্য বলল, আপনার মনে আছে?

আমার সব মনে আছে। তুমিই আমাকে দেখে চিনতে পারোনি।

চিনতে ঠিকই পেরেছিলাম। ক্ষিতীশদা অন্য নাম বলে নিয়ে এসেছিলেন তো—

যোগানন্দকে তুমিই মেরেছ?

না, না, আমি মারিনি।

দলের সবাই জানে–যোগানন্দকে তুমিই শাস্তি দিয়েছ–তার ডেডবডি পড়ে ছিল রাস্তায়–

সূর্য উত্তেজিত ভাবে বলল, এটা একদম ভুল। আমি পারলে যোগানন্দদাকে সর্বশক্তি দিয়ে বাঁচাতাম সেই সময়। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি। যোগানদার পুরনো কথা ভুলে যান–ফর্টি টু তে উনি যা করেছেন–ওঁর নামে স্মৃতিস্তম্ভ হওয়া উচিত।

ক্ষিতীশদা বললেন, যোগানন্দ বড় আনস্তুপুলাস ছিল হে। ওকে কেউ কোনও দিন সম্মান করবে না।

সূর্য যোগানন্দকে সমর্থন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একমাত্র সেই যোগানন্দের সঙ্গে দিনের-পর-দিন কাটিয়েছে–তার অনেক দুঃখ-পথের সঙ্গী। কিন্তু দীপ্তি বা ক্ষিতীশদা সেকথা শুনতে চাইলেন না।

এরপর একে একে আরও পুরনো বন্ধুদের কথা উঠল। কেউ মারা গেছে, কেউ এখনও জেলে, কেউ এখন দেখা হলেও ওদের সঙ্গে কথা বলে না। দল ভেঙে গেছে, যুদ্ধ করার স্পৃহা আর কারওর নেই। তবু পুরনো গল্প বলতে ভালো লাগে। ক্ষিতীশদা চন্দননগরের সেই বাড়ির বৃত্তান্ত ভালো জানেন না–খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। দীপ্তি এক একটা বলেন আর হাসিতে ফেটে পড়েন।

জানেন ক্ষিতীশদা, এই ছেলেটা তখন সাঁতার জানত না। সাঁতারও জানে না আবার বিপ্লবী হবার শখ। আমাকে ধরেছিল সাঁতার শিখিয়ে দেবার জন্য–এত বড় বুড়ো ধাড়ি ছেলেকে কি কোনও মেয়ে সাঁতার শেখাতে পারে! তারপর, ওই বাড়িটার সিঁড়িতে আবার একটা ভিমরুলের চাক ছিল–এর যা ভয়, কিছুতেই সিঁড়ির ওই জায়গাটা দিয়ে একলা যেতে পারে না–আমি ভেবেছিলাম, এ একটা বড়লোকের আদুরে ছেলে, ভিতুর ডিম–এর দ্বারা কোনও কাজ হবে না। কিন্তু ব্রজগোপালদা যে-দিন এর সাহসের কথা বললেন—

ক্ষিতীশদা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ব্রজ মানুষ চিনতে কখনও ভুল করত না।

ব্রজগোপালের কথা এসে পড়ায় তিন জনেই একসঙ্গে হঠাৎ চুপ করে যায়। ব্রজগোপালের বীভৎস মৃত্যুর কথা ওদের মনে পড়ে। কেউ আর সে প্রসঙ্গের উল্লেখ করে না।

দীপ্তি একটি মেয়েদের স্কুলে পড়ান। মাঝখানে কিছু দিন সিকিউরিটি প্রিজনার হিসেবে হিজলি জেলে ছিলেন–ফিরে এসে চাকরিটা ফেরত পেয়েছেন। এই ফ্ল্যাটে তিনি আর একজন শিক্ষিকা একসঙ্গে থাকেন। অন্য জন কয়েক দিনের জন্য দেশের বাড়িতে গেছেন। এবাড়িরই ওপরের একটা ফ্ল্যাটে সুকল্যাণ নামে ওদের প্রাক্তন দলের একজন পুরনো কর্মী সস্ত্রীক থাকেন–তারা দরকার হলে সাহায্য করেন এঁদের।

দুখানি ঘরের ছোট ফ্ল্যাট। দীপ্তির ঘরখানি সুন্দর ঝকঝকে তকতকে ভাবে সাজানো। একটি খাট, একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার। দেওয়ালে শুধু স্বামী বিবেকানন্দর একটি ছবি। বইয়ের র‍্যাকে সমস্ত বই খাকি কাগজ দিয়ে এক ভাবে মলাট দেওয়া–কোনও বইয়ের নাম পড়া যায় না।

ঘরের মধ্যে স্টোভ জ্বেলে দীপ্তি তা তৈরি করলেন গল্প করতে করতে। পেয়ালা পিরিচগুলো নতুনের মতন পরিষ্কার। দীপ্তির শরীরেও কোথাও এক ছিটে ময়লা নেই।

কথায় কথায় অনেক সময় চলে গেল। ক্ষিতীশদাকে এবার উঠতে হবে। তিনি বললেন, চল সূর্য, যাবি নাকি?

সূর্য উঠে দাঁড়াল। ক্ষিতীশদা দীপ্তিকে বলল, শোন। ভালো কথা, তোর ইস্কুলে আমার কিছু বইপত্তর বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে পারবি? ইস্কুলের লাইব্রেরি নেই?

দীপ্তি বললেন, হ্যাঁ আছে। আপনি এমনি আসুন না একদিন আমাদের স্কুলে। কিন্তু আপনি নিজে বইগুলো ঘাড়ে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ান কেন—

ক্ষিতীশদা বললেন, কী করব? আমার আর কে আছে বল?

কিন্তু এটা মোটেই ভালো দেখায় না। আমরা কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি না? আমি এখানকার কংগ্রেস কমিটিকে বলে আপনার একটা কাজের ব্যবস্থা

কংগ্রেসের কাছ থেকে দয়া নেব? দুর দুর দুর!না খেয়ে থাকব সেও ভালো। তুই কি আজকাল কংগ্রেসে ভিড়েছিস নাকি?

না, ঠিক যাইনি। তবে লাবণ্যদি প্রায়ই বলেন, কংগ্রেস কমিটির মহিলা বিভাগে যোগ। দিতে। একটা কিছু তো করতে হবে।

পলিটিকসের ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে। দেখ দীপ্তি, আমরা ছিলাম পেট্রিয়ট, আমরা যুদ্ধ করতে পারতাম কিন্তু পলিটিকস করা আমাদের দ্বারা পোষাবে না। ওসব বেনে কিংবা ব্যারিস্টারদের কাজ। বেনে ইংরেজের সঙ্গে টক্কর লড়ছে আমাদের বেনের। বাচ্চা গান্ধী।

দীপ্তি একটু আহত ভাবে বললেন, ক্ষিতীশদা মহাত্মাজি সম্পর্কে এ রকম ভাবে বলবেন না।

তারপর সূর্যর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কী করবে ঠিক করেছ?

সূর্য বলল, কিচ্ছু না।

দরজার কাছে এসে দীপ্তি সূর্যকে বললেন, আবার এসো।

সূর্য এই কথাটারই প্রতীক্ষা করে ছিল। দীপ্তির মুখ থেকে এই নিমন্ত্রণটুকু না পেলে আজ রাত্তিরটা সে খুব দুঃখিত হয়ে থাকত। অনেক দিন বাদে আজ সন্ধ্যাবেলা তার সময়টা সত্যিই খুব ভালো কাটল।

পরদিন সকালবেলাতেই সূর্য এসে দাঁড়াল দীপ্তির ফ্ল্যাটের দরজার সামনে। দরজা খুলে দীপ্তি একটু অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?

সূর্য বলল, এমনিই এলাম।

সূর্যর মুখখানা ভাবলেশহীন, সে স্থির চোখে দীপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন তার কিছু একটা গোপন কথা আছে, যা বাইরে দাঁড়িয়ে বলা যায় না।

দীপ্তি সরে দাঁড়িয়ে সূর্যকে ভেতরে আসতে দিলেন। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?

না।

এদিকে কোথাও এসেছিলে?

আপনার কাছেই এসেছি।

দীপ্তি এবার হেসে বললেন, আমাকে যে একটু বাদেই চান করে খেয়ে ইস্কুলে যেতে হবে? এখনও রান্না বাকি আছে।

সূর্য বলল, আপনি রান্না করুন না, আমি বসছি।

দীপ্তি সূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারলেন না। চায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন, সূর্য চা খাবে না। গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে আছে। ছেলেটা কি বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছে?

দীপ্তি টুকিটাকি সংসারের কাজ সারতে লাগলেন, আর মাঝে মাঝে দেখে যেতে লাগলেন সূর্যকে। সে স্থির হয়ে বসে আছে ঠিক একই রকম ভাবে। ছেলেটা সত্যিই অদ্ভুত। কারোকে এ রকম ভাবে বসে থাকতে দেখলে অস্বস্তি লাগে। দীপ্তি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বইটই পড়বে কিছু?

সূর্য বলল, আপনি আমার জন্য ব্যস্ত হবেন না।

স্নানটান সেরে দীপ্তি এবার খেতে বসবেন। কিন্তু ঘরে অন্য পুরুষ থাকলে কোনও মেয়ে কি একা খেতে পারে? তিনি বললেন, ওরে বাবা, পৌনে দশটা, আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে আমাকে।

সূর্য ইঙ্গিত বুঝল না। বলল, আমিও আপনার সঙ্গে বেরোব।

আমি খেতে বসব এখন। তুমিও আমার সঙ্গে খেয়ে নেবে?

না।

এসো না, একটু কিছু খাও।

না, আমার কিছু দরকার নেই—

দীপ্তি প্লেটে করে খানিকটা তরকারি সূর্যর সামনে এনে বললেন, একটু টেস্ট করে দেখো, আমি কী রকম রান্না করলাম–

আপনার রান্না তো আমি খেয়েছি চন্দননগরে।

এখন একটু খেয়ে দেখো–

একটু বাদে দীপ্তি ঘরে তালা দিয়ে বেরোলেন। সূর্যও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এল রাস্তায়, তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনার স্কুল কোন দিকে?

কেন, তুমি আমার স্কুলে যাবে নাকি?

না। আপনি স্কুল থেকে কখন ফেরেন?

ছুটি হয় সাড়ে চারটেয়। আমার ফিরতে ফিরতে সাড়ে পাঁচটা-ছ’টা হয়।

আর কোনও কথা না বলে সূর্য উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করল।

সে-দিন দীপ্তি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার দু-এক মিনিটের মধ্যেই সূর্য এসে হাজির হল। খানিকটা অভিযোগের সুরে বলল, আপনি বলেছিলেন ছ’টার মধ্যে বাড়ি ফেরেন। এখন সাড়ে ছ’টা বাজে।

দীপ্তি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলে নাকি?

সূর্য নির্লজ্জের মতন বলল, হ্যাঁ।

আমার সঙ্গে কি তোমার জরুরি কোনও কথা আছে?

না। আপনি কি সন্ধ্যাবেলা কোথাও বেরোবেন?

উঁহু! কেন বলো তো?

তা হলে আমি আপনার এখানে কিছুক্ষণ থাকব।

তোমার কী ব্যাপার বলো তো?

আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমি কি এখানে একটু বসতে পারি?

হ্যাঁ, বসো। বাঃ, আমি কি বারণ করেছি নাকি?

তবু দীপ্তির মনের মধ্যে একটু অস্বস্তি রয়েই যায়। স্কুল থেকে ফিরে এখন কাপড় ছাড়া, গা-ধোওয়ার সময়। পাশের ঘরটা ব্যবহার করলেও–একজন যদি এখানে একা একা বসে থাকে। পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশার অভ্যাস আছে দীপ্তির-পুরনো সহকর্মীরা মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে–অন্য কেউ এলে এ রকম অস্বস্তি হয় না–কিন্তু এই ছেলেটি বিশেষ কিছু কথা বলে না বলেই এর কাছে স্বাভাবিক হওয়া যায় না কিছুতেই।

খানিকটা বাদে দীপ্তি স্নান সেরে শাড়ি বদলে আবার এ-ঘরে এলেন। হাতে এক বাটি মুড়ি। বাটিটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন, এই নাও সূর্য। তুমি ঝাল খাও? কঁচালঙ্কা লাগবে?

সূর্য মাথা নোওয়াল। দু’টি কঁচালঙ্কা নিয়ে এসে দীপ্তি সূর্যর মুখোমুখি বসলেন। এক বাটি থেকেই দু’জনে মুড়ি তুলে তুলে খাচ্ছে। সূর্য নির্নিমেষে চেয়ে আছে দীপ্তির মুখের দিকে।

দীপ্তি বললেন, তোমার তো মা নেই, তুমি বলেছিলে। বাবা ছাড়া আর কে আছেন?

সূর্য বলল, কেউ নেই।

তাই তো, সারা দিন কি আর বাড়িতে একা একা থাকা যায়? তুমি এখন কী করবে ভাবছ? আবার কলেজে ভরতি হবে?

না।

বাঃ। পড়াশুনো করবে না আর?

অন্য কারওর কাছ থেকে আমার আর কিছু শেখার নেই।

তোমার বাড়ির অবস্থা বোধহয় ভালো, চাকরি বাকরি করার দরকার হবে না।

তাই মনে হয়।

তোমার বাবা কিছু বলেন না?

কী বলবেন?

তোমার বাবা কী বলবেন, তা আমি কী করে জানব? আমি জিজ্ঞেস করছি, তিনি কিছু বলেন কিনা।

না।

তুমি ভারী অদ্ভুত ছেলে। আমি তোমাকে বুঝতে পারি না।

আমার কোনও বন্ধু নেই।

সেই জন্যই তুমি অদ্ভুত। তোমার বয়সের ছেলেরা এই সময় রাস্তায় রাস্তায় হইহই করে ঘুরে বেড়ায়। সিনেমা থিয়েটার দেখে, খেলার মাঠে যায়–আর তুমি আমার। এখানে চুপচাপ বসে আছ।

যে-বয়সটায় আমার ওইসব শুরু করার কথা, সেই বয়সটা আমি কী রকম ভাবে কাটিয়েছি আপনি তো জানেন?

আহাহা, তোমার এখনও এমন কিছু বয়স হয়নি। বাচ্চা ছেলে! আমিও তো বাবা জেল খেটেছি, কিন্তু এখন আমার আবার সবকিছু মানিয়ে নিতে তো কোনও অসুবিধা হয়। না।

দীপ্তিদি, আপনি বুঝবেন না। আমি নিজের হাতে দু’ জন লোককে খুন করেছি– মরার ঠিক আগে আর মরার ঠিক পরে তাদের মুখ যে ভাবে বদলে গেছে, আমি তা দেখেছি। আমার থেকে মাত্র তিন হাত দূরে যোগানন্দদা গুলি খেয়ে ঘুরে পড়ে যায়– আমি তাকে কোনও সাহায্য করতে পারিনি নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য আমি দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম–এইসব কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে আমি কি কখনও স্বাভাবিক হতে পারি?

সূর্য এই কথাগুলো এমন ঠান্ডা অনুত্তেজিত গলায় বলল যে, দীপ্তি শিউরে উঠলেন। হত্যাকারী এই শব্দটা শুনলেই গা ছমছম করে–হোক না তা শত্রু-হত্যা। এই অনিন্দ্যকান্তি যুবকটি একজন খুনি–তাঁরাই একে খুনের দীক্ষা দিয়েছিলেন।

দীপ্তি টেবিলের ওপর পড়ে থাকা সূর্যর হাতের ওপর নিজের হাত রেখে খুব নরম ভাবে বললেন, ও-সব কথা ভুলে যাও। ও-সব আর মনে রেখে কোনও লাভ নেই– আমি তোমার দিদির মতন–আমি তোমাকে যতটা পারি সাহায্য করব।

সূর্য হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, হরদা আমাকে বলেছিলেন গীতা পড়তে। বলেছিলেন, দেশের জন্য যা করা যায়, যা আমাদের কর্তব্য–সেখানে হত্যার গ্লানিও আমাদের স্পর্শ করবে না। আমি জেলে বসে গীতা পড়ে দেখেছি। ও-সব গীতাফিতা আমাকে কোনও সান্ত্বনা দিতে পারে না। ইচ্ছে করলেই তো কোনও জিনিস ভোলা যায় না।

ঘরের মধ্যে অন্ধকার হয়ে এসেছে। এখনও আলো জ্বালা হয়নি। দু’জনে একটুক্ষণ চুপ করে রইল। সূর্য অন্যমনস্ক ভাবে বাটির তলা থেকে মুড়ির দু’-একটা ভাঙা টুকরো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।

দীপ্তি উঠে আলো জ্বাললেন। তারপর বললেন, তুমি বই পড়তে ভালোবাসো? আমার যখন মনখারাপ হয়, আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ি। তোমাকে একটা পড়ে শোনাব?

সূর্য ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

দীপ্তি বললেন, তোমার একদম পেট ভরল না, না? তুমি এগ পাউডারের ওমলেট খাও? যুদ্ধের পর কত কী যে বেরিয়েছে–গুঁড়ো দুধ, গুঁড়ো ডিম। দাঁড়াও, দুটো ওমলেট ভেজে আনি। তারপর কবিতা পড়ব।

অনেক রাত পর্যন্ত কবিতা পড়ে কাটাল ওরা দু’ জন। দীপ্তির খুব মমতা হচ্ছিল ছেলেটার জন্য–তিনি আর ওকে অন্য কোনও কথা ভাবার সময় দিলেন না, একটার পর একটা কবিতা পড়ে গেলেন চয়নিকা থেকে। তারপর সূর্যকে যখন একটা কিছু পড়তে বললেন, সূর্য চোখ বুজে একটু ভেবে নিয়ে শুরু করল: ইট ইজ দা উইন্টার অব ডিসকন্টেন্ট–তারপর রিচার্ড দা থার্ড-এর প্রায় অর্ধেকটা মুখস্থ বলে গেল।

সূর্য বিদায় নেবার সময় দীপ্তি তাকে বললেন, ও-সব কথা নিয়ে আর একদম চিন্তা করবে না, কেমন? কথা দাও আমাকে?

সূর্য হাসিমুখে বলল, আচ্ছা।

পরদিন সকালেই সূর্য আবার এসে হাজির হতে দীপ্তি রীতিমতন শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ছেলেটা কি প্রতিদিন দু’বেলাই এ রকম আসবে?

সূর্যকে দেখলে মনে হয় তার সারা রাত ঘুম হয়নি, চোখদুটো লালচে। চিরুনি পড়েনি মাথার চুলে। কিন্তু তার মুখে বিমর্ষ ভাবটা নেই বরং একটা উত্তেজনার ছাপ। দীপ্তি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, এত সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছ?

সূর্য জিজ্ঞেস করল, ক’টা বাজে?

সাড়ে সাতটা।

আমার অনেকক্ষণ আগে ঘুম ভেঙে গেছে–কী করব বুঝতে পারছিলাম না।

বসো। চা খেয়ে যাও। চা করছি।

আমি আজ এখানে অনেকক্ষণ থাকব। আপনার সঙ্গে গল্প করব।

দীপ্তি হেসে বললেন, অনেকক্ষণ থাকবে কী করে? আমাকে ইস্কুলে যেতে হবে না?

আজ ইস্কুলে না গেলে হয় না?

বাঃ, ইস্কুলে যাব না কেন? আমার ইস্কুলে যেতে ভালোই লাগে।

ঠিক আছে। আপনি ইস্কুল থেকে ঘুরে আসবেন, আমি আপনার এখানেই শুয়ে থাকব। আমার আর কোথাও যেতে ভালো লাগছে না।

সূর্য একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দীপ্তির দিকে, প্রখর তার দৃষ্টি। দীপ্তির কোমল মন, তার মায়া হল ছেলেটির জন্য। এ-ছেলে যদি মনে মনে কোনও কষ্ট পায়ও মুখ ফুটে কিছুতেই তা বলবে না। একে কী ভাবে সাহায্য করা যায়!

দীপ্তি বললেন, তোমার কী হয়েছে বলো তো? বাড়িতে কোনও গোলমাল হচ্ছে?

চা বানিয়ে এনে দীপ্তি সূর্যকে একপেয়ালা দিয়ে নিজের পেয়ালাটা নিয়ে বসলেন বিছানার ওপর। সূর্য নিঃশব্দে চা খেয়ে যাচ্ছে।

দীপ্তি ওকে বোঝবার চেষ্টা করছেন। যখন তখন একটি ছেলে তার সঙ্গে দেখা করতে এলে পাড়ার লোকের চোখে একটু দৃষ্টিকটু দেখাবে এটা তিনি বোঝেন কিন্তু সূর্যকে সেকথা মুখ ফুটে বলবেন কী করে?

পেয়ালা নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, তুমি তো কোনও কথাই বল না তুমি কী চাও বুঝব কী করে।

সূর্য মুখ তুলে দীপ্তির দিকে তাকাল–কোনও কথা বলল না। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সোজা চলে এল দীপ্তির সামনে। মাটিতে হাটুগেড়ে বসে দীপ্তির পা দু’খানা জড়িয়ে ধরল!

দীপ্তি বিহ্বল কণ্ঠে বললেন, এ কী করছ সূর্য।

সূর্য বলল, কিছু না। আপনার পা একটু ছুঁতে ইচ্ছে করল।

তারপর পোষা কুকুরের মতন দীপ্তির পায়ে মুখ ঘষতে লাগল।

দীপ্তি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ রক্তাভ। কয়েক পা সরে গিয়ে বললেন, এ কী?

সূর্যও উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তির কাঁধে হাত রেখে বলল, আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই।

ঠিক আছে, আগে ওই চেয়ারে গিয়ে বোসো, তারপর কথা বলব।

সূর্য দীপ্তিকে ছাড়ল না। তার মুখে এখন একটা খুশির ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠেছে। তার এ রকম মুখ সচরাচর দেখা যায় না। শক্ত করে দীপ্তিকে চেপে ধরে সে বলল, আপনাকে আমি ছাড়ব না।

দীপ্তি টের পেলেন সূর্যর গায়ে বাঘের মতন শক্তি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার ক্ষমতা তার নেই। এদিকে দরজা খোলা রয়েছে।

তিনি মিনতি করে বললেন, ছেড়ে দাও, লক্ষ্মীটি, আমাকে একটু কথা বলতে দাও।

সূর্য দীপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, আপনি আমার ওপর রাগ করছেন?

তুমি এসব কী ছেলেমানুষি করছ বলো তো? আমি তোমার থেকে বয়সে কত বড়—

কত বড়?

অন্তত সাত-আট বছর তো হবেই।

তাতে কিছু যায় আসে না।

তুমি কী চাও আমার কাছে?

আমি আপনার কাছাকাছি থাকতে চাই। খুব কাছে।

তা হয় না। অনেক দেরি হয়ে গেছে!

কীসের দেরি হয়েছে?

সূর্য, তুমি বড় ছেলেমানুষ, তুমি বুঝবে না। আমি তোমার দিদির মতন, সেই ভাবে যদি তুমি আমার কাছে আসতে চাও—

দীপ্তিদি, আপনি বড় সুন্দর।

সূর্য আবার এগিয়ে আসতেই দীপ্তি ভয় পেয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। সূর্য তাঁকে দরজার পাশেই দেওয়ালে চেপে ধরল। গভীর এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলল, আপনাকে শ্রীলেখার মতন দেখতে।

কে শ্রীলেখা?

আছে একজন। আপনার সঙ্গে তার চেহারার কোনওই মিল নেই যদিও–তবু আপনাকে দেখে তার কথাই মনে পড়ছে।

তা হলে তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি না কেন!

সেখানে যাওয়া যায় না। সূ

র্য ছেড়ে দাও। এসব পাগলামি কোরো না।

সূর্য চোখ বুজে ফেলল। দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, আমি পারব না, কিছুতেই পারব না।

তারপর মুখ নিচু করে দীপ্তির মসৃণ ঘাড়ে ঠোঁট বোলাতে লাগল। আস্তে আস্তে মুখটা নিয়ে এল দীপ্তির বুকে। ভারী নরম বুক। সূর্য যেন অতলে ডুবে যাচ্ছে–দীপ্তির বুকের ভেতরকার সীমাহীন শূন্যতায়। বড় নিশ্বাসে গন্ধ শুঁকছে।

দীপ্তি ছটফটিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করলেন না। শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। দারুণ কাতর ভাবে বললেন, কী করছ তুমি, জানো না, এ হয় না। এ হয় না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমার জীবন কী ভাবে চলবে, আমি ঠিক করে ফেলেছি।

আমি সব উলটোপালটা করে দেব। আপনাকে আমি এখান থেকে নিয়ে চলে যাব। আমার আর কেউ নেই, আমি কোথায় যাব?

সূর্য, তোমার কম বয়সকত জনের সঙ্গে তোমার আলাপ পরিচয় হবে।

আপনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমি কি মিথ্যে কথা বলছি?

তুমি আমার কাছে রোজ এসো, গল্প কোরো–কিন্তু এসব না।

এসব মানে কী? আপনি এত সুন্দর–

সূর্য প্রচণ্ড জোরে দীপ্তিকে চেপে ধরল নিজের শরীরে। যেন সে ওঁর হাড়-পঁজরা ভেঙে দেবে। তারপরই মাটিতে বসে পড়ে দীপ্তির কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে দয়া করুন। আমাকে দয়া করুন।

দীপ্তির চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। সূর্য সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলল, আমি চিরকাল আপনার কাছাকাছি থাকব। আমাকে দূরে ঠেলে দেবেন না।

দু’হাতে দীপ্তির মুখটা তুলে লোভীর মতন সেই অঞ পান করতে লাগল সূর্য। দীপ্তি আর বাধা দিলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *